১১. সোমেশ্বর পর্ব্বতে ভীমেরতনুত্যাগ ও যুধিষ্ঠিরের বিলাপবলেন বৈশম্পায়ন শুন কুরুবীর।অর্জ্জুনের শোকেতে কান্দেন যুধিষ্ঠির।।বৃকোদর বলিলেন ধর্ম্ম অধিপতি।কোন্ পাপে পড়িল অর্জ্জুন মহামতি।।ভূপতি বলেন শুন পবন তনয়।আমা হৈতে দ্রৌপদীর বশ ধনঞ্জয়।।সবে হেয় জ্ঞান তার ছিল মনোগতে।এই হেতু পার্থবীর পড়িল পর্ব্বতে।।এত বলি দুইজনে বিষণ্ণ বদনে।চলেন উত্তরমুখে চিন্তি নারায়ণে।।বৃকোদর বলে তবে হইয়া আকুল।চল রাজা দুইজনে যাই সুরকুল।।চারি ক্রোশ হৈতে শুনি স্বর্গের বাজন।উঠেন পর্ব্বতে দুই পাণ্ডুর নন্দন।।ছয় জন মধ্যেতে আছেন দুইজন।শতেক যোজন সেই প্রমাণে উন্থিত।।বিবিধ বৃক্ষের মুল রতনে মণ্ডিত।হিমাগম সুশীতল অতি অনুপম।।তার তলে দুই ভাই করেন বিশ্রাম।কতক্ষণ বসি পুনঃ করেন গমন।।যাইতে দেখেন রাজা নদী সুশোভন।রেবানামে নদী সেই পাপ বিনাশিনী।।স্বর্গ হৈতে নামে তাহে ত্রিপথগামিনী।নানা রত্নে বিরচিত দুই কূল তার।।দেখিতে সুন্দর নদী মহিমা অপার।নানারত্ন গিরিবর দেখিতে সুন্দর।সুবর্ণের শৃঙ্গ মণি মাণিক্য পাথর।।অতিশয় অপূর্ব্ব পর্ব্বত সুশোভন।চন্দ্র সূর্য্য সমাগম গ্রহ তারাগণ।।সঙ্কল্প করিয়া রাজা যান একচিত্তে।না জানেন ভূমণ্ডল আছে কোন্ ভিতে।।তার জলে নরপতি করেন তর্পণ।তুষ্ট হয়ে পঞ্চাননে করেন পূজন।।পুণ্য হেতু চলিলেন স্বর্গের উপর।দর্শন করেন রাজা শিব সোমেশ্বর।।কীট পক্ষী কৃমি আদি তথা যদি মরে।রুদ্ররূপ হৈয়া তারা যায় স্বর্গপুরে।।কিন্নর গন্ধর্ব্ব তথা গান করে নিত্য।সহস্রেক সোমকন্যা করে বাদ্য নৃত্য।।সোমেশ্বর পূজিয়া করিল নমস্কার।বর চান মর্ত্ত্যে জন্ম না হোক আমার।।এত বলি স্তুতি করি আর প্রণিপাত।শিবের প্রসাদে পুষ্প পান পারিজাত।।পুষ্পমালা অঙ্গে শোভা পাইল রাজার।হরষিত নারীগণ জয় জয়কার।।প্রশংসা করিয়া কহে সোমকন্যাগণ।সুললিত স্বরে কহে মধুর বচন।।পুণ্য হেতু ভূপতি আইলা এত দূরে।এত বোল বলি রাজা শিবের মন্দিরে।।সোমেশ্বর রাজ্যে তুমি হও দণ্ডধর।যাবৎ থাকিবে পৃথ্বী চন্দ্র দিবাকর।।আমাদের স্বামী হৈয়া থাকহ আনন্দে।স্বর্গ সুখ পাবে অন্তে দেখিবে গোবিন্দে।।একক যাইবে স্বর্গে কোন্ সুখ হেতু।যে বিচারে আসে আজ্ঞা কর ধর্ম্মসেতু।।কন্যাগণ বচনে বিস্মিত যুধিষ্ঠির।আশ্বাসিয়া বলিলেন বচন গভীর।।অনুচিত কন্যাগণ বল কি কারণে।আশীর্ব্বাদ কর, যেন দেখি নারায়ণে।।শুনিয়া রাজার মুখে নিষ্ঠুর ভারতী।কন্যাগণ গেল তবে যে যার বসতি।।সোমেশ্বর বন্দি রাজা চলেন উত্তর।মহাহিম ভেদিল ভীমের কলেবর।।সোমেশ্বর পার হৈতে নারে প্রাণপণে।ভেদিল শরীর বীর পড়িল অজ্ঞানে।।পর্ব্বত পড়িল যেন পর্ব্বত অজ্ঞানে।ভীমসেন পতনে কম্পিত ধরাধর।।সমুদ্রে সুমেরু গিরি যেন নিল ঝম্প।কূর্ম্মপৃষ্ঠে থাকিয়া বাসুকী হৈল কম্প।।পড়িলেক বৃকোদর পর্ব্বত বিশালে।চলাচল কম্পমান সাগর উথলে।।বাসুকী এড়িল বিষ যোদ্ধা এড়ে বাণ।চমকিত পশু পক্ষী ছাড়িল যে প্রাণ।।স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে হইল চমৎকার।চারিদিকে সাট লাগে লঙ্কার দুয়ার।।ইন্দ্র শঙ্কা পান স্বর্গে বিষম আস্ফালে।ভূমিকম্প উল্কাপাত গগনমণ্ডলে।।প্রচণ্ড পবন বহে নির্ঘাত দুর্ব্বার।শব্দে সেতুবন্ধে হৈল তরঙ্গ গঙ্গার।।ঋষি মুনি তপস্বীর ভাঙ্গিল যে ধ্যান।বন এড়ি পশু ধায় লইয়া পরাণ।।স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে লাগিল চমৎকার।বৃকোদর পড়ে খণ্ডাইয়া ক্ষিতিভার।।যুধিষ্ঠির দেখেন পড়িল ভীম ভাই।মুর্চ্ছিত হইয়া শোকে পড়েন তথাই।।কতক্ষণে চেতন পাইয়া নৃপবর।হাহাকার করিয়া ডাকেন বৃকোদর।।মরিবারে কৈলা ভাই স্বর্গ অরোহণ।প্রাণের অধিক ভাই অতুল বিক্রম।।সংসার হইল শূণ্য তোমার বিহনে।শুনিয়া পাইল ভয় গিরিবাসীগণে।।যার পরাক্রমে তিন লক্ষ হাতী মরে।হেন ভাই পড়ে মম পর্ব্বত উপরে।।কারে লয়ে যাব স্বর্গে দেখিতে মুরারী।কেবা জিজ্ঞাসিবে পথে বচন চাতুরী।।কে আর তারিবে বনে দুষ্ট দৈত্য হাতে।কে আর করিবে গর্বব কৌরব মারিতে।।কিবা লয়ে যাব স্বর্গে দেখিবারে হরি।ভাই সব মরে মম বৃথা প্রাণ ধরি।।যবে জতুগৃহ কৈল দুষ্ট দুর্য্যোধন।পাপ পুরোচন পুরী করিল দাহন।।চলিতে না পারি সুড়ঙ্গের পথ ঘোর।পঞ্চজনে লয়ে ভাই গেলে একেশ্বর।।হিড়িন্বেরে মারিয়া হিড়েম্বা কৈলে বিভা।কত দৈত্য পলাইল দেখি তব প্রভা।।ব্রাহ্মণেরে রক্ষা কৈলে বিনাশিয়া বকে।লক্ষ রাজা জিনিয়া লভিলে দ্রৌপদীকে।।ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হৈনু তোমার প্রতাপে।মরিল কীচক বীর তব বীর দাপে।।বিরাটেরে মুক্ত কৈলা সুশর্ম্মার ঠাঁই।মম বাক্য বিনা কিছু না জানিতে ভাই।।জরাসন্ধ বধ কৈলা মগধপ্রধান।জটাসুর মারি বলে কৈলে পরিত্রাণ।।নিঃক্ষত্রা করিলে ক্ষিতি ভারত সমরে।মম সঙ্গে আইলে যাইতে সুরপুরে।।তবে কেন এড়ি মোরে পড়িলে পর্ব্বতে।উত্তর না দেহ কেন ডাকি স্নেহমতে।।পর্ব্বতে পড়িলে ভাই ছাড়িয়া আমারে।কে পথ বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসিবে বারে বারে।।বনবাসে বঞ্চিলাম তোমার সাহসে।অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ ভুঞ্জে মৃগমাংসে।।আমরা নিদ্রিত হৈলে থাকিতে জাগিয়া।আমারে ত্যজিয়া কেন রহিলে শুইয়া।।বড় দুঃখ দিয়া গেলে আমার অন্তরে।উঠহ প্রাণের ভাই উঠ ধরি করে।।মম বাক্যবশ ভাই মম বাক্যে স্থিত।তোমা সবা বিনা ভাই জীতে মৃত্যুবৎ।।যে কালে আইনু ধৃতরাষ্ট্র ভেটিবারে।অন্ধের আছিল ক্রোধ তোমা মারিবারে।।গোবিন্দ রাখেন তোমা লৌহভীম দিয়া।হেন ভাই নিদ্রা যায় পর্ব্বতে পড়িয়া।।এত বলি ভূপতি কান্দেন উচ্চৈঃস্বরে।চারি ভাই ভার্য্যা ভাবি আকুল অন্তরে।।লক্ষণ পড়িল যবে রাবণের শেলে।ক্রন্দন করেন রাম ভাই লয়ে কোলে।।সেইমত কান্দিলেন ভীমে কোলে লৈয়া।হিমে তনু কাঁপে তবু ব্যাকুল কান্দিয়া।।প্রবোধ করিতে আর নাহি কোনজন।ধর্ম্মরাজ করিলেন অরণ্যে রোদন।।জননীরে স্মরিয়া কহেন শোক পাই।এ হেন দুঃখীরে কেন গর্ভে দিলে ঠাঁই।।শৈশবে মরিল পিতা না পড়ি সে শোকে।পিতামহ ভীষ্মদেব পালিল সবাকে।।হিংসা হেতু বিষলাড়ু ভীমে খাওয়াল।পাপ দুর্য্যোধন যারে ভাসাইয়া দিল।।উদ্দেশ না পেয়ে কান্দে জননী আমার।সাত দিন মাতা মম কৈল অনাহার।।অনন্ত করিয়া কৃপা দিল প্রাণদান।তাহে না মরে ভাই পাইলে পরিত্রাণ।।দেখিবারে গোবিন্দে আইল স্বর্গপুরী।না পাইলে দেখিতে সে প্রসন্ন শ্রীহরি।।হায় বীর পার্থ কৃষ্ণা সুন্দর নকুল।হায় সহদেব বীর বিক্রমে অতুল।।হায় বিধি মম ভাগ্যে কি আছে না জানি।মম কর্ম্মে এত দুঃখ লিখিলা আপনি।।কোন জন্মে আমার আছিল কোন পাপ।সে কারণে দহে তনু শোকেতে সন্তাপ।।কি করিণু কি হইল আর কিবা হয়।এত বলি কান্দিলেন ধর্ম্মের তনয়।।হায় কুন্তী পিতা পাণ্ডু কোথা গেলে ছাড়ি।হায় দুর্য্যোধন অন্ধ বিদুর গান্ধারী।।হায় ভীষ্ম কর্ণ দ্রোণ পাঞ্চাল কুমারী।তোমা সবাকার শোক সহিতে না পারি।।হায় ভীমার্জ্জুন হায় মাদ্রীপুত্র ভ্রাতা।হায় কৃষ্ণা প্রাণপ্রিয়া তুমি গেলে কোথা।।এক দণ্ড কোথা না যাইতে আজ্ঞা বিনে।তবে আমা একা রাখি ছাড়ি গেলে কেনে।।সব দুঃখ যায় যদি পাপ আত্মা ছাড়ি।এত বলি কান্দিলেন ভূমিতলে পড়ি।।কতক্ষণে স্থির হইয়া ধর্ম্মের তনয়।ক্রন্দন সম্বরি রাজা ভাবেন হৃদয়।।কোন পাপে বৃকোদর স্বর্গ নাহি গেল।এই কথা ভূপতির মনেতে হইল।মিথ্যা বলি দ্রোণ গুরু বিনাশিল রণে।।স্বর্গে নাহি গেল ভাই ইহার কারণে।এই চিন্তা করি রাজা ভাবিত অন্তরে।।একান্তে গোবিন্দ চিন্তি চলেন উত্তরে।ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।যাঁহার চরিত্র তিন ভুবনে প্রকাশ।।ভীমের প্রয়াণ যেবা শুনে শুদ্ধভাবে।পরম কৃষ্ণের পদ সেইজন পাবে।।কাশীদাস দেব কহে গোবিন্দ ভাবিয়া।তরিবে শমন দায় শুন মন দিয়া।।১২. যুধিষ্ঠিরের সহিত বিপ্ররূপী ইন্দ্রেরও কুক্কুররূপী ধর্ম্মের ছলনামুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।উত্তরাজ্যে চলিলেন ধর্ম্মের তনয়।।কতদূরে দেখি গন্ধমাদন পর্ব্বত।যাহার সৌরভ যায় যোজনের পথ।।তাহে উঠি শুনিলেন স্বর্গের বাজনা।ভূপতি করেন মনে পূরিল কামনা।।স্বর্গের দুর্ল্লভ ভোগ সেই গিরিবরে।আরোহণ করিলেন হরিষ অন্তরে।।পর্ব্বতে দেখিল তবে ধর্ম্মের তনয়।অপূর্ব্ব মহেশ লিঙ্গ মরকতময়।।অত্যন্ত নির্জ্জন স্থান লোকে মনোহর।কোটি চন্দ্র জিনিয়া উজ্জ্বল মহেশ্বর।।হীরা মণি মাণিক্যের মন্দির সুঠাম।দেখি রাজা ভক্তিভাবে করেন প্রণাম।।হরিহর এক তনু ভিন্ন কভু নয়।হরিভক্ত মোরে হর হবেন সদয়।।এত বলি বর মাগি যান ধীরে ধীরে।কত কালে পার হব দুঃখের সাগরে।।বিষাদ ভাবেন মনে ধর্ম্মের নন্দন।কারে লৈয়া যাব আমি ত্রিদিব ভুবন।।কে মোরে করাবে দেখা কৃষ্ণের সহিতে।হিমে যদি যায় তনু তরি দুঃখ হৈতে।।বংশক্ষয় করিলাম স্বর্গে আরেহিয়া।চারি ভাই ভার্য্য বনে রহিল পড়িয়া।।পৃথিবীতে আমি কত করিলাম পাপ।কোন মুনি দেব ঋষি দিল মোরে শাপ।।কান্দেন ভূপতি স্মরি দ্রৌপদী সুন্দরী।হেনকালে আসে যত গন্ধর্ব্বের নারী।।কন্যাগণ বলে রাজা কান্দ কি কারণ।দ্বিতীয় স্বর্গের সম এ গন্ধমাদন।।স্বর্গে আসি কান্দ কেন কহ বিবরণ।এ স্থানে না হয় কেহ দুঃখের ভাজন।।কন্যাগণ বাক্য শুনি কন নৃপবর।চারি ভাই ভার্য্যা গেল পর্ব্বত উপর।।ছয়জন মধ্যে আমি আছি একজন।মহাহিমে স্বর্গপথে মৈল পঞ্চজন।।মহাবীর ভীম ভার্য্যা না দেখিব আর।এই হেতু কান্দি কন্যা শুন সমাচার।।রাজার বচন শুনি কন্যাগণ হাসে।প্রবোধ বচন কিছু কহে মৃদুভাষে।।ভাবিত না হও রাজা ভার্য্যা ভ্রাতৃশোকে।তব অগ্রে তারা সব গেছে স্বর্গলোকে।।কি কারণে কান্দ রাজা হৈয়া বিচক্ষণ।স্বর্গেতে সবার সঙ্গে হইবে মিলন।।স্বর্গপথে আসিতে পড়িল রাজা সব।তারা সবে অগ্রে গেল শুনহ পাণ্ডব।।আশীর্ব্বাদ কর মোরে দেব কন্যাগণ।স্বর্গপুরে গিয়া যেন দেখি নারায়ণ।।দ্বাপরের শেষ হল কলি অবতার।সত্য ধর্ম্ম বিবর্জ্জিত অতি কদাচার।।সে কারণে যাই স্বর্গে ইন্দ্রের ভূবন।করিলেন শ্রীমুখে অনুজ্ঞা নারায়ণ।।কন্যাগণ বলে রাজা তুমি মূঢ়জন।কি ফল পাইবা স্বর্গে দেখি নারায়ণ।।হেথা ফল পাইবা স্বর্গে দেখি নারায়ণ।হেথা ফল কত পাবে কি কব তোমারে।।না শুনিয়া নরপতি চলেন উত্তরে।হিমালয় গিরি পাইলেন মনোহর।।নারীগণ আসে নিত্য পূজিতে শঙ্কর।ত্রিভুবন সার বিশ্বকর্ম্মা বিরচিত।চতুর্দ্দশ সহস্রেক শিবলিঙ্গ স্থিত।।পরম সুন্দর গিরি কি কহিতে পারি।সুমেরু কৈলাস জিনি মহেশ্বর পুরী।।বিচিত্র নগর ঘর অতি মনোরম।কন্যগণ আসে নিত্য শিবের আশ্রম।।শুক্ল বস্ত্র পরিধান চন্দ্র সম কান্তি।রূপ দেখি মুনি গণ মনে হয় ভ্রান্তি।।নানা অলঙ্কারে শোভা ত্রৈলোক্য-মোহিনী।মুখপদ্ম করপদ্ম সকল পদ্মিনী।।বিচিত্র চম্পক দাম শোভিত গলায়।কেহ কেহ নৃত্য করে কেহ গীত গায়।।যুধিষ্ঠির নৃপতি আসেন এই পথে।পাদ্য অর্ঘ্য লয়ে আস তাঁহার সাক্ষাতে।।ঋষি মুনিগণ শুনি ধর্ম্মের প্রয়াণ।দেখিতে আইল সবে আনন্দ বিধান।।পৃথিবীর রাজা হেথা এল পুণ্যভাগে।ঝটিতি আসিল সবে যুধিষ্ঠির আগে।।দেব ঋষিগণ আসি করেন সম্ভাষ।অন্ধকার ঘুচে গেল হইল প্রকাশ।।প্রণাম করেন রাজা মুনি ঋষিগণে।নৃপতিরে আশীর্ব্বাদ কৈল সর্ব্বজনে।।শোভা পায় পর্ব্বতে বৈতরণী সরিত।অতি অপরূপ তীর নীর সুললিত।।পর্ব্বতে বেষ্টিত জল অতি সুশোভন।অষ্টাশী তপস্বী তপ করে অনুক্ষণ।।ক্রীড়া করে জলেতে বিবিধ জলচর।সুন্দর কনক পদ্ম ফুটে নিরন্তর।।অষ্টাশী সহস্র ঋষি দেখি অনুপম।যোড়হাতে নরপতি করেন প্রণাম।।যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া প্রশংসে মুনিগণ।ধন্য ধন্য রাজা তুমি হরিপরায়ণ।।এই বৈতরণী নদী পরম নির্ম্মল।উত্তর হইতে বহে দক্ষিণ মণ্ডল।।দক্ষিণ শমনপুরে প্রলয় তরঙ্গ।পাপী পার হৈতে নারে দেখি দেয় ভঙ্গ।।মর্ত্ত্যেতে গো দান করে যেই পুণ্যজনে।সুখে পার হৈয়া যায় নৌকা আরোহণে।।ভুপতি বলেন আমি পাপী নরাধম।মুনিগণ বলে তুমি মহাপুণ্যতম।।এত বলি মুনিগণ কৈবর্ত্ত ডাকিয়া।নৃপতিরে পার কৈল নৌকা আরোহিয়া।।ঋষিগণে বন্দি রাজা নদী হৈয়া পার।পুণ্য হেতু দেখিলেন স্বর্গের দুয়ার।।চন্দ্র সূর্য্য দেবগণ দেখেন প্রত্যেক।স্বর্গ আরোহণ হৈতে আছে যোজনেক।।পার হৈয়া বৃক্ষতলে বসি নরেশ্বর।স্বর্গ দেখি হইলেন চিন্তিত অন্তর।।অদ্ভূত স্বর্গের দ্বার দেখি বিদ্যমান।নানা ঋতু বিরাজিত প্রবাল পাষাণ।।হাতে অস্ত্র দ্বারপাল চৌদিকে বেষ্টিত।কত লক্ষ পুণ্যবান হয়েছে বারিত।।ইন্দ্র আজ্ঞা বিনা দ্বারী দ্বার নাহি ছাড়ে।বুকে বুকে দান্ডাইয়া আছে করযোড়ে।।যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া লইল আগুসারি।দ্বারপালগণ কহে কর যোড় করি।।তোমার জনক পূর্ব্বে পাণ্ডু নরপতি।মৃগঋষি শাপে তাঁর না হৈল সন্ততি।।বিমুখ হইয়া রাজা সংসারের সুখে।কুন্তী মাদ্রী ভার্য্যা সহ আইল হেথাকে।।অপুত্রক হেতু ইন্দ্র আজ্ঞা নাহি দিল।হেথা হৈতে পুনঃ তিনি মর্ত্ত্যপুরে গেল।।দেব হৈতে জন্ম হৈল তোমা পঞ্চভাই।পুত্রবান হইয়া বৈকুণ্ঠে পায় ঠাঁই।।তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম তব, ধর্ম্মের ঔরসে।তুমি মহা ধর্ম্মশীল জানি সবিশেষে।।মুহুর্ত্তেকে বৈস রাজা শূন্য সিংহাসনে।ইন্দ্রে জানাইয়া স্বর্গে লব এইক্ষণে।।দ্বারপাল গিয়া বার্ত্তা দিল পুরন্দরে।যুধিষ্ঠির আইলেন স্বর্গের দুয়ারে।।শুনিয়া দেবতা সবে কহে ইন্দ্র প্রতি।রথে করি যুধিষ্ঠিরে আন শীঘ্রগতি।।এত শুনি দেবরাজ বিপ্ররূপ ধরি।যুধিষ্ঠিরে ছলিবারে এল শীঘ্র করি।।ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা করেন প্রণতি।আশীর্ব্বাদ করিলেন কপট দ্বিজাতি।।জিজ্ঞাসিল যুধিষ্ঠিরে কপট ব্রাহ্মণ।বড় পুণ্যবান তুমি এলে কোনজন।।এত শুনি নৃপতি কহেন যোড়করে।পরিচয় মহাশয় কহিব তোমারে।।জম্বুদ্বীপ নামে এক আছে পৃথিবীতে।যাহে জন্মিলেন ব্রহ্মা ভার নিবারিতে।।চন্দ্রবংশে দেব অংশে হস্তিনায় ধাম।পাণ্ডুপুত্র ঋষিগোত্র যুধিষ্ঠির নাম।।রাজ্যলোভে সবান্ধবে বধিলাম রণে।লোভে পাপ আছে তাপ হৈল মম মনে।।জ্যেষ্ঠতাত সহ মাতৃ গেল তপোবনে।পঞ্চ ভাই দুঃখ পাই ভ্রমি নানা স্থানে।।আমারে বিষাদ দেখি দেব নারায়ণ।আজ্ঞা দেন কর রাজা স্বর্গ আরোহণ।।কলি অবতার হবে দ্বাপরের শেষ।এত বলি স্বস্থানে গেলেন হৃষীকেশ।।যদুবংশ করি ধ্বংস ব্রহ্মশাপ ছলে।আপনি বৈকুন্ঠে বিষ্ণু গেলেন কৌশলে।।তবে মোরা পঞ্চভাই করিয়া বিচার।পৌন্ত্রে সমর্পণ করি রাজ্য অধিকার।।পঞ্চভাই ভার্য্যা সহ আসি স্বর্গপথে।হিম শীতে পঞ্চজন পড়িল পর্ব্বতে।।শোক দুঃখ সন্তাপে তাপিত মম মন।এই নিজ তত্ত্ব দ্বিজ করি নিবেদন।।একেশ্বর দ্বিজবর যাব স্বর্গপুরী।সুমেরু পর্ব্বতে গিয়া দেখিব মুরারী।।কিম্বা প্রাণ যাক কিম্বা যাই স্বর্গপুরে।করিয়া সঙ্কল্প এই আসি এতদূরে।।কতদূর আছে স্বর্গ কহ দ্বিজবর।যাইতে পারিব, কিবা যাবে কলেবর।।ব্রাহ্মণ বলেন শুন ধর্ম্ম নরবর।এখুনি দেখিবে রাজা পঞ্চ সহোদর।।কুরুক্ষেত্রে যে ছিল আঠার অক্ষৌহিণী।সবাকারে ক্ষনেকে দেখিবে নৃপমণি।।এড়াইয়া এলে দুঃখ আর চিন্তা নাই।আমি লয়ে যাব তোমা ঈশ্বরের ঠাঁই।।নিকট হইল স্বর্গ যাবে মুহূর্ত্তেকে।শোক দুঃখ পরিহর জানাই তোমাকে।।ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরে কথা হয় এইমতে।তথা ধর্ম্ম আইলেন কুক্কুররূপেতে।।শব্দ করি ব্রাহ্মণে খাইতে শ্বান যায়।দণ্ড লৈয়া ব্রাহ্মণ মারিল তার গায়।।নির্ঘাত প্রহার করে কুক্কুরের দেহে।পরিত্রাহি ডাকি শ্বান যুধিষ্ঠিরে কহে।।ওহে পৃথিবীর রাজা মহাপুণ্যবান।নির্দ্দয় ব্রাহ্মণ বধে কর পরিত্রাণ।।দণ্ডের প্রহারে মম কম্পবান তনু।উদ্ধার করিতে কেহ নাহি তোমা বিনু।।কুক্কুরের বাক্যে রাজা উঠি যোড়হাতে।বলেন বিনয় করি বিপ্রের সাক্ষাতে।।নাহি মার কুক্কুরের শুন দ্বিজবর।শুনিয়া বিপ্রের ক্রোধ বাড়িল বিস্তর।।হাতে দণ্ড করি বলে নৃপতির প্রতি।মম হাতে কুক্কুরের নাহি অব্যাহতি।।পুণ্যহীন কুক্কুরের নাহি পরিত্রাণ।পুণ্য বিনা স্বর্গে বাস নাহি মতিমান।।ভূপতি বলেন রাখ কুক্কুরের প্রাণ।মর্ত্ত্যের অর্দ্ধেক পুণ্য দিব আমি দান।।যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি ধর্ম্ম হাসি মনে।ধরিলেন নিজ মূর্ত্তি রাজা বিদ্যমানে।।তদন্তরে দেবরাজ নিজ মূর্ত্তি হৈয়া।পরিচয় কহিলেন হাসিয়া হাসিয়া।।ধর্ম্মে ইন্দ্রে দেখি রাজা আপন নয়নে।লোটাইয়া পড়িলেন অষ্টাঙ্গ চরণে।।কোলে করি ধর্ম্ম সাধু বলেন তাঁহাকে।তুমি পুত্র যুধিষ্ঠির না চিন আমাকে।।ধর্ম্ম বলি মর্ত্ত্যলোকে বলয়ে তোমারে।তোমা জন্মাইনু আমি কুন্তীর উদরে।।এই ইন্দ্র দেবরাজ স্বর্গ অধিপতি।এস পুত্র কোলে করি কেন দুঃখমতি।।তোমার চরিত্র প্রচারিল ত্রিভুবনে।স্বর্গপুরে চল, চড়ি পুষ্পক বিমানে।।পদব্রজে পর্ব্বতে পেয়েছে বড় পীড়া।একে সুকোমল অঙ্গ শোক চিন্তা বেড়া।।সর্ব্ব দুঃখ হৈল দুর চল স্বর্গপুরে।মাতা পিতা দেখিবা সকল সহোদরে।।এতেক কহেন যদি ধর্ম্ম মহাশয়।আনন্দিত হইলেন ধর্ম্মের তনয়।।ভারত অপূর্ব্ব কথা স্বর্গ আরোহণে।যুধিষ্ঠির স্বর্গে যান কাশীদাস ভণে।।১৩. যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপুরী গমনধর্ম্ম আদি দেবচয়, দেখি রাজা সবিস্ময়,প্রণাম করেন সবাকারে।মাতলি ইঙ্গিত পেয়ে, দিব্য পুষ্পরথ লয়ে,যোগাইল রাজা যুধিষ্ঠিরে।।ধর্ম্ম ইন্দ্র দুইজনে, গন্ধমাল্য আভরণে,যুধিষ্ঠিরে করেন ভূষিত।বিবিধ বন্ধন ছান্দে, মস্তকে মুকুট বান্ধে,কিন্নর গন্ধর্ব্ব গায় গীত।।পারিজাত পুষ্পমালা, শোভয়ে রাজার গলা,বাজে শঙ্খ মৃদঙ্গ কাহাল।উর্ব্বশী প্রভৃতি নাচে, কেহআগে কেহ পাছে,জয় শব্দ কংস করতাল।মাতলি সারথি রথে, ধর্ম্ম ইন্দ্র আদি সাথে,বায়ু ইন্দ্র বরুণ হুতাশ।কেহ ছত্র শিরে ধরে, হুলাহুলি জয়স্বরে,কেহ করে চামর বাতাস।।কেহ অগ্রে যায় ধেয়ে, পঞ্চবাদ্যে বাজাইয়ে,পুষ্পবৃষ্টি আনন্দে প্রচুর।মুনিগণ বেদ গান, ধর্ম্মপুত্র স্বর্গে যান,মুহূর্ত্তে গেলেন সুরপুর।।দেখি রাজা পুণ্যকারী, সকল সুবর্ণপুরী,সর্ব্ব গৃহে কিন্নরের গান।সদা মহানন্দময়, নাহি জরা মৃত্যু ভয়,কৌতুকে বিহরে পুণ্যবান।।স্বর্গগত নরবর, তারে দেখি পুরন্দর,বসাইল রত্ন সিংহাসনে।পদ প্রক্ষালিতে বারি, পূরিয়া সুবর্ণ ঝারি,যোগাইল যত দাসগণে।।ইন্দ্র আজ্ঞা পেয়ে পরে, নানাদ্রব্য উপহারে,ভোজন করায় নরনাথে।কর্পূর তাম্বুল দিয়া, পালঙ্কেতে বসাইয়া,ইন্দ্র আশ্বাসিল ধর্ম্মসুতে।।ইন্দ্র বলে যুধিষ্ঠির, তুমি পুণ্য আত্মা ধীর,নরদেহে এলে স্বর্গপুরে।এ পুরী অমরাবতী, হও তুমি শচীপতি,যুক্তি আসে আমার বিচারে।।শুনিয়া ইন্দ্রের বাণী, যুধিষ্ঠির নৃপমণি,কহিছেন বিনয় বচন।তব বাক্যে পাই ত্রাস, কেন কর পরিহাস,আমি মূঢ়মতি আকিঞ্চন।।সত্য কৈনু মর্ত্ত্যপুরী, বৈকুণ্ঠে দেখিব হরি,তুমি মম সব দুঃখ জান।তুমি পিতা দেব আর্য্য, কর মম এই কার্য্য,স্বর্গসুখে নাহি মম মন।।ইন্দ্র বলে শুনবাণী, অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী,পঞ্চভাই শতেক কৌরবে।পিতা জ্যেষ্ঠখুল্লতাত, জ্ঞাতিগোত্র ভ্রাতৃমাত,সবা সঙ্গে বৈকুণ্ঠে মিলিবে।।এত বলি সেইক্ষণে, পুষ্পরথ অরোহণে,পাঠাইল স্বর্গ পরকাশ।ভারত সঙ্গীত গীত, হেতু সুজনের প্রীত,বিরচিল কাশীরাম দাস।।১৪. যুধিষ্ঠিরের বৈকুণ্ঠে গমন ও শ্রীকৃষ্ণ দর্শনবলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।নিজ পুণ্যে স্বর্গে গেল ধর্ম্মের তনয়।।পুষ্পরথে আরোহিয়া যান বিষ্ণুপুরে।অপ্সর অপ্সরীগণ সদা নৃত্য করে।।কেহ ছত্র ধরে কেহ চামর বাতাস।দুই দিকে সারি সারি দেবের আবাস।।ব্রহ্মলোকে দেখি রাজা ব্রহ্মা চতুর্ম্মূখে।প্রণমিয়া সম্ভাষা করিলেন কৌতুকে।।সমাদর করি ব্রহ্মা করি আলিঙ্গন।চারি মুখে প্রশংসেন ধর্ম্মের নন্দন।।তথা হৈতে নরপতি নানা স্বর্গ দেখি।অপূর্ব্ব কৈলাসপুরী দেখিয়া কৌতুকী।।চন্দ্রখণ্ড জিনি পুরী পরম উজ্জ্বল।দিবা রাত্র সমজ্ঞান সদা ঝলমল।।গণেশ কার্ত্তিক নন্দী ভূঙ্গী মহাকাল।সবা দেখি আনন্দিত ধর্ম্ম মহাপাল।।হরগৌরী দোঁহে দেখি অজিন আসনে।ভক্তিভাবে দণ্ডবৎ করেন চরণে।।আইসহ নরপতি বলে শূলপাণি।ভাল হৈল এলেস্বর্গে ত্যজিয়া অবনী।।তোমা হেন পুণ্যবান নাহি ত্রিভুবনে।স্বকায় চলিয়া এলে অমর ভুবনে।।এত বলি করিলেন প্রেম আলিঙ্গন।প্রণাম করিয়া যান পাণ্ডুর নন্দন।।কতক্ষণে বৈকুণ্ঠে হইয়া উপনীত।পুরী দেখি নরপতি হৈলেন চিন্তিত।।কিরূপে নির্ম্মাণ করিলেন নারায়ণ।ত্রিভুবনে পুরী নাহি ইহার তুলন।।প্রবেশ করেন পুরী জয় জয় দিয়া।রত্নাসনে নারায়ণ দেখিলেন গিয়া।।রথ হৈতে নামি পুরে যান পদব্রজে।প্রণাম করেন গিয়া বিষ্ণু চতুর্ভুজে।।বিদ্যমানে নারায়ণ দেখিয়া নৃপতি।চমৎকার মানিলেন অঙ্গেয় বিভূতি।।হস্ত পদ সুশোভিত কর্ণে শতদল।মকর কুণ্ডল কর্ণে করে ঝলমল।।শ্যাম অঙ্গে পীতম্বর হাটক নিছনি।নব জল মাঝে যেন হয় সৌদামিনী।।শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শোভে চারি হাতে।শ্রীবৎস কৌস্তুভমণি শোভে মরকতে।।বাম দিকে কমলা দক্ষিণে সরস্বতী।এই বেশে হৃষীকেশে দেখেন ভূপতি।।অষ্টাঙ্গে প্রণাম করি পড়েন চরণে।বলিছেন নারায়ণ আনন্দিত মনে।।আইসহ নরপতি ধর্ম্মপুত্র ধর্ম্ম ।চিরকাল না দেখিয়া পাই ব্যথা মর্ম্ম ।।আগুসরি উঠিয়া করেন আলিঙ্গন।বসিবারে দেন দিব্য কনক আসন।।পদ পাখালিতে বারি যোগায় দেবতা।চামর বাতাস করে ইন্দ্র চন্দ্র ধাতা।।সুখাসনে দুইজনে বসিয়া কৌতুকে।গোবিন্দ বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসেন হাসিমুখে।।যুধিষ্ঠির কহিলেন ধীরে পর পর।পরীক্ষিতে করিলাম রাজ্য দণ্ডধর।।দ্রৌপদী সহিত পঞ্চ আসি স্বর্গপথে।মহাহিমে পাঁচ জনে পড়িল পর্ব্বতে।।শোকে দুঃখে একাকী আইনু স্বর্গলোকে।শরীর সার্থক হৈল দেখিয়া তোমাকে।।শুনিয়া কহেন সমাদরে নারায়ণ।অগ্রে আসিয়াছে তারা আমার সদন।।করযোড়ে কহিলেন ধর্ম্মের তনয়।নয়নে দেখিলে তবে হয়ত প্রত্যয়।।শুনি নারায়ণ তবে সঙ্গেতে লইয়া।চলেন উত্তরমুখে দ্বার খসাইয়া।।দক্ষিণেতে হয় শমনের অধিকার।চর্ম্মচক্ষে দেখে তথা সব অন্ধকার।।প্রবেশ করেন সেই পুরে নরপতি।দেখিতে না পান রাজা কেবা আছে কতি।।যুধিষ্ঠিরে সবে পেয়ে জ্ঞাতি গোত্রগণে।চতুর্দ্দিকে ডাকে সবে হরষিত মনে।।দ্রোণ কর্ণ ভীষ্ম শত ভাই দুর্য্যোধন।ধৃতরাষ্ট্র বিদুর শকুনি দুঃশাসন।।ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল সুন্দর।ঘটোৎকচ জয়দ্রথ বিরাট উত্তর।।অভিমন্যু বিকর্ণ পাঞ্চালী পুত্রগণে।কুন্তী মাদ্রী দুই দেখি পাণ্ডুরাজ সনে।।দ্রৌপদী গান্ধারী আদি যত কুরুনারী।অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী আছে সেই পুরা।।সবে বলিলেন ধর্ম্ম তুমি পুণ্যবান।স্বকায়ে দেখিলে স্বর্গে দেব ভগবান।।অল্প পাপ হেতু মোরা সদা পাই ক্লেশ।সবাকারে উদ্ধারিয়া লহ নিজ দেশ।।এত শুনি যুধিষ্ঠির চান চারি কোনে।দেখিতে না পান মাত্র শুনিলেন কাণে।।নরক দেখিয়া রাজা মনে পায় ভয়।অনুমানে বুঝিলেন এই যমালয়।।ভাবিত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন কৃষ্ণেরে।কেন কৃষ্ণ নাহি দেখি জ্ঞাতি বান্ধবেরে।।কেন বা হইল মম নরক দর্শন।বিশেষ কহিয়া কৃষ্ণ স্থির কর মন।।গোবিন্দ বলেন রাজা করহ শ্রবণ।কিছু পাপ হতে হৈল নরক দর্শন।।জ্ঞাতি গোত্র নাহি দেখ তথির কারণে।পাপক্ষয় হৈল এবে ত্যজ ভয় মনে।।জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল কহ মুনিবর।কোন্ পাপ করিলেন ধর্ম্ম নরবর।।আজন্ম তপস্বী জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী।দান ধর্ম্মে মতি সদা পাতক বিবাদী।।তাঁহার হইল পাপ কেমন প্রকারে।মুনিবর বিস্তারিয়া কহিবা আমারে।।১৫. যুধিষ্ঠিরের নরক দর্শনের হেতুও শ্বেতদ্বীপে গিয়া স্বজনাদি দর্শনজন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, কহ মুনিবর।কোন পাপ করিলেন ধর্ম্ম-নৃপবর।।আজন্ম তপস্বী জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী।দান ধর্ম্মে মতি সদা, পাতক-বিবাদী।।তাঁহার হইল পাপ কেমন প্রকারে।বিস্তারিয়া মুনিবর কহিবে আমারে।।মুনি কহে শুনি জন্মেজয় সাবধানে।যুধিষ্ঠিরে পাপ হৈল যাহার কারণে।।ভারত সমরে যবে হৈল মহামার।সারথি হলেন নারায়ণ অর্জ্জুনের।।মারিলেন বহু সৈন্য উপায় করিয়া।ভীষ্ম বীরে বধিলেন শিখণ্ডী রাখিয়া।।তবে সেনাপতি হৈল দ্রোণ মহাশয়।অশ্বথামা তাঁর পুত্র সমরে দুর্জ্জয়।।অনেক প্রকারে দ্রোণ না হয় বিনাশ।দেখিয়া উপায় করিলেন শ্রীনিবাস।।কপটে মারেন হস্তী অশ্বথামা নামে।‘অশ্বথামা হত’ শব্দ হইল সংগ্রামে।।শুনি চমৎকার লাগে দ্রোণের অন্তরে।‘অশ্বথামা হত’ হরি কহেন সমরে।।প্রত্যয় না যান দ্রোণ কৃষ্ণের উত্তরে।সত্য মিথ্যা জিজ্ঞাসিল রাজা যুধিষ্ঠিরে।।দ্রোণবাক্য শুনিয়া চিন্তিত নৃপমণি।কিরূপে কহিব আমি অসত্য এ বাণী।।কৃষ্ণ বলিলেন রাজা না কহিলে নয়।মিথ্যা না কহিলে, দ্রোণ নাহি পরাজয়।।পুনঃ পুনঃ নিন্দিয়া বলিল বৃকোদর।‘অশ্বথামা হত’ দ্রোণ কহ নৃপবর।।মিথ্যা বাক্য ভয় যদি কর নৃপবর।‘ইতি গজ’ তার পরে বল লঘুস্বর।।সঙ্কটে পড়িয়া রাজা না কহিলে নয়।ডাকিয়া দ্রোণেরে বলিলেন মহাশয়।।অশ্বথামা হত হৈল ইহা আমি জানি।লঘুশব্দে ‘ইতি গজ’ বলেন আপনি।।‘অশ্বথামা হত’ শুনি ধর্ম্মের বদনে।দ্রোণাচার্য্য পুত্রশোকে প্রাণ দিল রণে।।এই পাপ করিলেন ধর্ম্মের নন্দন।তোমারে জানাই আমি পূর্ব্বের কথন।।জন্মেজয় বলে তবে কহ মুনিবর।পিতামহে লৈয়া কি করিলেন শ্রীধর।।মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের কুমার।এইরূপে যুধিষ্ঠির দেখি অন্ধকার।।গোবিন্দেরে জিজ্ঞাসেন পাপের কারণ।কপট করিয়া কহিলেন নারায়ণ।।কৌরব সহিত যবে হইল সমর।চক্রব্যূহ করি যুঝে দ্রোণ ধনুর্দ্ধর।।তীক্ষ্ম অস্ত্রে জর্জ্জরিত করিল তোমারে।অভিমুন্যে ডাকি তুমি কহিলে তাহারে।।পিতার সমান তুমি মহাযোদ্ধাপতি।ব্যূহ ভেদি মার পুত্র দ্রোণ মহারথী।।গুরুবধে আজ্ঞা দিলে হয়ে ক্রোধমন।দ্বিতীয় অবধ্য জাতি হয়ত ব্রাহ্মণ।।গুরুবধ মহাপাপ শুন নরপতি।সেই মহাপাপ তব হৈল মহামতি।।পাপেতে নরক রাজা দেখ অন্ধকার।রাজা বলিলেন কর সঙ্কটে উদ্ধার।।তবে হরি অনুজ্ঞা দিলেন খগেশ্বরে।শ্বেতদ্বীপ সরোবরে লহ নৃপবরে।।পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিব আপনি।দেখাব ধর্ম্মেরে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী।।বিষ্ণুর বচন শুনি খগ মহাবীর।যুধিষ্ঠিরে নিয়া গেল সরোবর তীর।।পাখসাটে পর্ব্বত উড়িয়া যায় দূরে।মুহূর্ত্তেকে সেই দ্বীপে গেল খগেশ্বরে।।সরোবরে দেখিলেন ধর্ম্মের নন্দন।দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ বিদ্যাধরগণ।।জলে জলচরগণ নানা ক্রীড়া করে।ঋষি মুনি মুনীন্দ্র যোগীন্দ্র চারি তীরে।।বিচিত্র নগর বন সাগর চত্বর।বৈকুণ্ঠ সমান পুরী অতি মনোহর।।অনেক ঈশ্বর মুর্ত্তি সর্ব্বদের স্থান।ভ্রমর ঝঙ্কারে মত্ত কোকিলের গান।।মনুষ্য হইয়া যদি তাহে স্নান করে।দেবদেহ পেয়ে যায় বৈকুণ্ঠ নগরে।।হেন সরোবর দেখি ধর্ম্মের নন্দন।মহাজলে স্নান করি করেন তর্পণ।।মানব শরীর ছাড়ি দেবদেহ পান।দুঃখ শোক পাসরিয়া সর্ব্বসিদ্ধ হন।।নরদেহ ত্যজি রাজা দেবদেহ ধরে।পৃষ্ঠে করি গরুড় উড়িল বায়ুভরে।।মুহূর্ত্তেকে গেল যথা দেব নারায়ণ।চতুর্ভূজে ধর্ম্মরাজ কৈল সমর্পন ।।রাজারে দেখিয়া হরি কহেন হাসিয়া।নিমেষ নাহিক আর নাহি অঙ্গছায়া।।কিরূপ আছিলে রাজা হইলে কিরূপ।বিচারিয়া মনে বুঝ আপন স্বরূপ।।ভূপতি বলেন শুন অনাদি গোঁসাই।তোমার প্রসাদে মম পূর্ব্বরূপ নাই।।দেবত্ব পাইনু মনে হেন হয় জ্ঞান।তোমার অসাধ্য কিছু নাহি ভগবান।।মর্ত্ত্যেতে রাখিলে হরি অশেষ সঙ্কটে।নিজ পুরী এড়ি সদী ভক্তের নিকটে।।রাজসূয় করালেন দিয়া বন্ধুবল।শিশুপাল দন্তবক্রে দিলে প্রতিফল।।রাখিলে দ্রৌপদী লজ্জা কৌরব সমাজে।দ্বাদশ বৎসর রক্ষা কৈলে বনমাঝে।।দুর্ব্বাসারে দুর্য্যোধন পাঠাইল যবে।সেই দিন সমাধান করিত পাণ্ডবে।।নিশাকালে রক্ষা কৈলে কাননেতে গিয়া।মোহিলা মুনির মন বিষ্ণুমায়া দিয়া।।তদন্তরে সান্দীপন মুনির আশ্রমে।আম্র হেতু সঙ্কটে তারিলে পথশ্রমে।।অজ্ঞাত বৎসর এক বিরাট ভুবনে।শত্রু হৈতে রক্ষা কৈলা চক্র আচ্ছাদনে।।তাহার অন্তরে মম রাজ্যের লাগিয়া।আপনি হস্তিনাপুরে গেলা দূত হৈয়া।।আমারে বিভাগ নাহি দিল দুর্য্যোধনে।বান্ধিয়া রাখিতে তোমা বিচারিল মনে।।আপনি বিরাটমূর্ত্তি দেখাইলে তারে।সমূলে করিলা ক্ষয় ভারত সমরে।।জ্ঞাতিবধ পাপে মম শরীর বিকল।অশ্বমেধ করাইলা হইয়া সবল।।পুত্রহস্তে অর্জ্জুন মরিল মণিপুরে।প্রাণ দিয়া যজ্ঞপূর্ণ কৈলা গদাধরে।।মৎস্য কূর্ম্ম বরাহ হইয়া খর্ব্বরূপে।পাতালে রাখিলা ছলি বলিরাজ ভূপে।।ভূগৃরাম রামচন্দ্র কামপাল রাম।বৌদ্ধ কল্কি নারায়ণ নরসিংহ শ্যাম।।বারে বারে জন্ম লও দুষ্ট বিনাশিতে।যুগে যুগে অবতার দেবতার হিতে।।তোমার চরিত্র চারি বেদে না নিরখি।জ্ঞাতিগোত্র দেখাইয়া কর মোরে সুখী।।রাজার বিনয় বাক্য শুনি নারায়ণ।আশ্বাসিয়া কহিলেন মধুর বচন।।সর্ব্ব দুঃখ গেল রাজা না কর সন্তাপ।সবন্ধু কুটুম্ব গোত্র দেখহ মা বাপ।।এত বলি যান হরি রাজারে লইয়া।কুরুপুরে প্রবেশেন দ্বার ঘুচাইয়া।।রাজারে কহেন হরি শুন ধর্ম্মপুত্র।অনুপম দেখহ দ্বিতীয় কুরুক্ষেত্র।।পিতা পাণ্ডু দেখ রাজা জননী কুন্তীকে।শ্বেতছত্র বিরাজিত রাজার মস্তকে।।বামে মাদ্রী বসিয়াছে মদ্রের কুমারী।অন্ধরাজ বসিয়াছে সহিত গান্ধারী।।দেখহ বিকর্ণ কর্ণ কৌরবকুমার।দুর্য্যোধন শত ভাই সঙ্গে সহোদর।।ভগদত্ত শল্য মদ্ররাজ জয়দ্রথ।অভিমন্যু ঘটোৎকচ সুরথ ভরত।।বিকট দ্রুপদ দেখ স্বপুত্র সহিতে।পাঞ্চালীর পঞ্চপুত্র দেখহ সাক্ষাতে।।শিশুপাল সুশর্ম্মা মগধ নৃপমণি।একে একে দেখ অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী।।শুকুনি উত্তর পুণ্ড দ্রোণাচার্য্য গুরু।ভগদত্ত শল্য রাজা সিন্ধু ভীম ঊরু।।পঞ্চজন পড়িলেন স্বর্গেতে আসিতে।চারি ভাই দেখ বাজা দ্রৌপদী সহিতে।।বিস্ময় মানিয়া রাজা কৃষ্ণের বচনে।চিত্রের পুত্তলি প্রায় চান চারি পানে।।পাসরিয়া সকল মর্ত্ত্যের শত্রুকার্য্য।যথাযোগ্য মিলন করেন হৈয়া ধৈর্য্য।।আনন্দ সাগরে মগ্ন হৈল তনু মন।যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া সানন্দ জ্ঞতিগণ।।কেহ আশীর্ব্বাদ করে কেহ প্রণিপাত।পিতা মাতা জ্যেষ্ঠতাত বন্দে নরনাথ।।ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীরে করি দণ্ড নতি।মহা আনন্দিত রাজা দেখি গোত্র জ্ঞাতি।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon