বেদ কিভাবে ধরাতলে এলো?

পরম ধার্মিক বেদার্থবেত্তার অগ্রগণ্য সূত গোস্বামী স্বইচ্ছায় নৈমিষারণ্য ক্ষেত্রে উপস্থিত হলে শৌনকাদি মুনি জিজ্ঞাসা করলেন,” হে মহাত্মান সূত! আপনি বেদব্যাসের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। সর্ব বেদের যথার্থ তত্বজ্ঞ। আপনি সম্প্রতি এমন কোন পুরাণ কীর্তন করুন যাতে স্বর্গ ও মোক্ষ উভয়ই লাভ হয়। সূত মুনি বললেন,“মুনিবর! আপনারা ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম লাভ করেছেন। আপনারও অনুরুপ তপস্যার দ্বারা পরা কাষ্ঠা হয়েছেন। আপনাদের পবিত্র হৃদয় হতে এ প্রশ্ন আবিষ্কৃত হল। এ প্রশ্নসূধা  শ্রবণ করে আমি কৃতার্থ হলাম। পুরাকালে যোগেশ্বর মহাদেব নারদকে যে মহাভাগবত নামক পরম গুহ্য পুরাণ বলেছিলেন, বেদব্যাস তপোবলে সে পুরাণ প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে জৈমিনি মুনির নিকট আদ্যপান্ত কীর্তন করেছিলেন। আমি সে পুরাণরত্ন আপনাদের নিকট বলব। আপনি ইহা  পরম যত্নসহকারে শ্রবণ করবেন। এ পুরাণ পাঠে, কি  শ্রবণে যে পূণ্যজন্মে মহেশ্বর শত বর্ষেও তার সংখ্যা করতে সমর্থ হন না। আর আমি কি প্রকারেই বা তার পূণ্যসীমা বলতে পারব।” সূত মুনির এ বাক্য শ্রবণ করে সকলেই সন্তুষ্ট হলেন এবং আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে সকলেই পুনরায় বলতে লাগলেন,“হে মুনিশ্রেষ্ট সূত! যে প্রকারে এ পুরাণ ধরাতলে আর্বিভূত হলো তা সবিস্তারে কীর্তন করুন।” সূত গোস্বামী তখন কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন,“হে মহর্ষিগণ! শ্রবণ করুন। যিনি বেদজ্ঞ, যিনি অশেষ ধর্ম শাস্ত্রের পারদর্শী, মহাবুদ্ধিমান এবং তত্ত্বজ্ঞানী; সে ধর্মবিৎ ভগবান বেদব্যাস একদা চিন্তা করলেন,“আমি সপ্তদশ মহাপুরাণ প্রস্তুত করে আনন্দিত হয়েছি; কিন্তু ইহাকে পূর্ণ আনন্দ বলা যায় না, কারণ তাহলে আমার হৃদয় পরিতৃপ্ত হতো। আর কোন স্পৃহা থাকত না। ভগবতীর পরম মহাত্ম  যাতে বিস্তৃত আছে, পিতার নিকট শুনেছি যার পর পরম মহাপুরাণ আর নেই, আমি কিভাবে বা কি প্রকারে সে পুরাণরত্ন সংগ্রহ করব? মহাযোগী মহেশ্বরও অনায়াসে যার পরম তত্ত্ব জানতে পারে না, সে পরমেশ্বরীর পরম তত্ত্ব আমার হৃদয়ে যে উদয় হবে, ইহা অত্যন্ত অসম্ভব! এরূপ চিন্তা করতে করতে বেদব্যাস ক্ষুদ্ধ হলেন। আবার পরক্ষণেই চিন্তা করলেন তপস্যার দ্বারা অসাধ্য কিছু নেই। সর্বশাস্ত্রেই এর প্রমাণ আছে। তারপর বেদব্যাস হিমালয় পর্বতে গমন করে দূর্গা-ভক্তি-পরায়ণ হতে তপস্যা করতে লাগলেন। 
তারপর পরাশর সন্তান ব্যাসদেব হিমালয় পর্বতে বহুকাল কঠোর তপস্যা করলে ভক্তবৎসলা সর্বাণী সন্তুষ্ট হয়ে অদৃশ্যরুপে আকাশপথে থেকে দৈববাণী করে বললেন,“হে মহর্ষি! যেখানে চতুর্বেদ আছে, সে ব্রহ্মলোকে তুমি গমন কর, আমার নির্বিকার পরম তত্ত্ব জানতে পারবে। শ্রুতিগণ কর্তৃক স্তবপাঠে আমি দৃষ্টিগোচর হয়ে তোমার অভিলাষ পূর্ণ করব।” বেদব্যাস দৈববাণী শুনে সত্ত্বর ব্রহ্মলোকে গমন করে চতুর্বেদকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বললেন,“ হে শ্রুতিগণ! ব্রহ্ম তত্ত্ব কি, তা প্রকাশ করে শরণাগত শিষ্যের সংশয় দূরীভূত করুন।” মহর্ষি বিনয় বাক্যে চতুর্বেদ সন্তুষ্ট হয়ে প্রত্যেকেই ব্রহ্মতত্ত্ব বলতে লাগলেন। 
ঋকবেদ উবাচ
যদন্ত:স্থানি ভূতানি যত: সর্বং প্রবর্ত্ততে। 
যদাহুস্তৎ পরং তত্ত্বং সৈকা ভগবতী স্বয়ং।।
অর্থ :ঋকবেদ বললেন,” স্থূল সূক্ষ্ম এ সমস্ত জগত প্রপঞ্চ যাতে সূক্ষ্ম রুপে বিলীন থাকে, আবার ক্ষণকাল মাত্রেই যাঁর ইচ্ছানুসারে সচরাচর জগত হয়ে প্রকাশমান হয়, যিনি স্বয়ং ভগবতী শব্দে কীর্তিতা হন, সেই পরম তত্ত্ব।
যজুর্বেদ উবাচ
যা যজ্ঞৈরখিলৈরীশো যোগেনচ সমীড্যতে।
যত: প্রমাণং হি বয়ং সৈকা ভগবতী স্বয়ং।।
অর্থ : যজুর্বেদ বললেন,” নিখিল যজ্ঞ এবং যোগদ্বারা যিনি স্তূয়মান হন এবং যাঁতে আমরা ধর্ম বিষয়ে প্রমাণ স্বরুপ হয়েছি, সেই অদ্বিতীয়া স্বয়ং ভগবতীই পরং ব্রহ্ম তত্ত্ব।
সামবেদ উবাচ
যযেদং ভ্রাম্যতে বিশ্বং যোগিভি র্যা বিচিন্ত্যত্নে।
যদ্ভাসা ভাসতে বিশ্বং সৈকা দূর্গা জগন্ময়ী।।
অর্থ : সামবেদ বললেন,” র্যার দ্বারা এ বিশ্ব সংসার ভ্রমবিলষিত হচ্ছে, যোগিগণের যোগচিন্তায় যিনি চিন্তনীয়া হন, যাঁর তেজ:প্রভাতেই সমস্ত জগত প্রকাশ পাচ্ছে, সেই জগন্ময়ী দূর্গাই পরং তত্ত্ব। 
অথর্ববেদ উবাচ
যাং প্রপশ্যন্তি দেবেশীং ভক্ত্যানুগ্রাহিনো জনা:।
তামাহু: পরমং ব্রহ্ম দূর্গাং ভগবতী মুনে।।
অর্থ : অর্থবেদ বললেন,” ভক্তি দ্বারা যাঁর অনগ্রহাশ্রিত লোকেরাই যাঁকে বিশ্বেশ্বরী স্বরুপে দেখতে পায়, যাঁকে ভগবতী দূর্গা-শব্দে বলে, সেই পরং ব্রহ্ম তত্ত্ব। শ্রুতিগণের এ প্রকার বাক্য শ্রবণ করে মহর্ষি বেদব্যাস দূর্গাকেই পরমব্রহ্মরুপে জান করলেন। শ্রুতিগণ আরও বললেন,” আমার যা বলেছি, এখন তোমাকে সেরুপ দর্শন করাব। এ বলে শ্রুতিগণ  সকলে একবাক্যে চিদানন্দরুপী সর্বদেবময়ী পরমেশ্বরীরর  স্তব করতে লাগলেন। 
হে বিশ্বময়ী দূর্গে! অনিত্য সংসার মধ্যে আপনিই পরমা প্রকৃতি; ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি আপনার শক্তি দ্বারা এ অসীম জগতের সৃষ্টি কার্যাদি সাধন করছেন। মা! আপনি সকলের বিধাতা হয়েও নির্বিধাতা; আপনার চরণ সেবা করে হরি দুর্জয় দানবদিগকে অবলীলাক্রমে সংহার করেন এবং মহাদেব কালকূট হলাহল পান করে আপনার কৃপাবলে জীবিত আছেন। আপনি জগতের অতীত এবং বাক্য মনের অগোচর; আর পরম পবিত্র, আমাদের কি সাধ্য আপনার মহিমা কীর্তন করি! পরম পুরুষ দেহাভিমানী ও অহংভাবাপন্ন হলে আপনার মায়ায় বশীভূত হন। হে দেবি অম্বিকা! আপনাকে আমরা প্রণাম করি। জগতে স্ত্রী পুরুষ প্রভৃতি যত রূপ ও বস্তু আছে, সে সকল আপনার মূর্তি; কিন্তু আপনি সে সকলেরই অতীত, সমাধিভাবাপন্ন মনোমাত্রের গোচর পরং ব্রহ্মারুপিণী। হে জননি! যখন আপনার সৃষ্টির ইচ্ছা হয়, তখন শক্তি দ্বারা মূর্তি পরিগ্রহ করেন; যেরুপ জল হতে করকার উৎপত্তি হয়, সেই রুপ আপনার শক্তি হতে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের উদয় হয়; অতএব জ্ঞানী ব্যক্তি আপনার মায়াশক্তিকেই ব্রহ্ম বলে নিরুপণ করেন। দেহের মধ্যে যে ষটচক্র আছে, তাতে ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি পরম দেবতাগণ বিরাজমান আছেন, তাঁরা আপনার শক্তিলাভ ব্যতীত শবের ন্যায় অকর্মণ্য। হে বিশ্বময়ি! দেবতার একান্ত-বন্দিত যে আপনার পদদ্বয়, তার শক্তিকেই নিখিল জগতের সমুদয় কার্য সাধিত হয়; অতএব, হে শক্তিরুপিণী দূর্গে দেবি! আমাদের প্রতি অনুকম্পা বিতরণ করুন।” এভাবে দেবগণ বিবিধভাবে স্তব করার পর জগতের আদিভূতা সেই ব্রহ্মাসনাতনী প্রসন্ন হয়ে বেদানুগৃহীত বেদব্যাসকে আপনার কতকগুলি রুপ দর্শন করিয়ে বেদব্যাসের সংশয় দূরীভূত করলেন। প্রথমত: দিব্য অস্ত্র দ্বারা বিভূষিত-সহস্র-বাহুযুক্ত, আভা সহস্র সূর্যের , কোটি চন্দ্রে সমান শান্ত জ্যেতির্ময়ী, কখন সিংহ বাহনে, কথন শবাসনে, চতুর্বাহু যুক্ত, নবীন মেঘ মালার ন্যায় নীকান্তি। কখন ‍দ্বিভূজা, কখন দশভূজা, কখন অষ্টাদশভূজা, কখন শতভূজা, কখন অনন্তবাহুযুক্তা দিব্যরুপধারিণী । কখন বিষ্ণুরুপা, বামভাগে কমলা। কখন কৃষ্ণরুপা, কখন কৃষ্ণরুপা, বামে গোপাঙ্গনা। কখন ব্রহ্মরুপা, বামাংশে সাবিত্রী। কখন বিশ্বরূপা সঙ্গে বিশানী। এভাবে  সেই ব্রহ্মরুপিণী ব্রহ্মময়ী অনেকপ্রকার রুপ ধারণ করে বেদব্যাসের সন্দেহ দূর করলেন। পরাশর সন্তান বেদব্যাস ভগবতী দূর্গাকেই পরমব্রহ্মস্বরুপে নিশ্চিত হলেন এবং সাক্ষাত ব্রহ্মময়ীকে দর্শন করে মহর্ষি জীবন্মুক্তও হলেন। সে জগদম্বা বেদব্যাসের অভিলাষপূরণের জন্য একটি নির্মল কমলের উপর মনোহর-কেলিযুক্ত রূপধারণ করলে বেদব্যাস সে কমলের সহস্র দলে পরমাক্ষরযুক্ত মহাভাগবতনামক পুরাণ দর্শন করলেন। তারপর বেদব্যাস দেবীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে পরম আনন্দে আশ্রমে ফিরে আসলেন। 
তারপর বেদব্যাস পরমাক্ষরযুক্ত যে মহাভাগবতপুরান পদ্মদলের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন তদ্রুপ জৈমিনি মুনির কাছে তা প্রকাশ করলেন। বেদব্যাসেন সন্তান শোকদেবকেও তিনি তা শ্রবণ করিয়েছিলেন। তিনি তার পিতার কৃপাবলে সমস্তই স্মৃতিপটে রেখেছিলেন। এভাবে মহাভাগবতপুরাণ ধরাতলে প্রকাশিত হয়েছিল।  
  




Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র