মহাভারত:বনপর্ব-০৮৬-০৯০

৮৬. দুর্য্যোধনের সপরিবারে স্বরাজ্যে প্রস্থান
গন্ধর্ব্ব বিদায় হয়ে গেল নিজস্থান।
দুর্য্যোধন আসি ধর্ম্মে করিল প্রণাম।।
বসিল মলিন মুখে হয়ে নম্রশির।
মধুর বচনে কহিছেন যুধিষ্ঠির।।
শুন ভাই, হেন কর্ম্ম না করিহ আর।
পৌরুষ নাহিক ইথে আমা সবাকার।।
বিশেষ বৈভব কালে ধর্ম্ম-আচরণ।
সমধিক হয় ইহা খ্যাতির কারণ।।
কহিলেন এই মত বহু নীতি বানী।
অগ্রসরি নারীগণে আনে যাজ্ঞসেনী।।
দ্রৌপদীরে প্রণমিল যত নারীগণ।
যতেক দুঃখের কথা কৈল নিবেদন।।
দুস্তর সাগর মাঝে ডুবিল তরণী।
নিজগুণে উদ্ধারিলা ধর্ম্ম নৃপমণি।।
বুঝিলাম, কুরুবংশ রক্ষার কারণে।
নিবসতি তোমা সবে কৈলে এই বনে।।
তবে কৃষ্ণা সবাকারে করিল সম্মান।
ক্ষুধার্ত্ত দেখিয়া দিল দিব্য অন্নাপান।।
একত্র হইল তবে যত সৈন্যগণ।
পরম কৌতুকে কবে করিল ভোজন।।
রাজা আদি করিয়া ভুঞ্জিল ক্রমে ক্রমে।
নারীবৃন্দ আকুল হইল সবে ঘুমে।।
ভয়ে কেহ নাহি শোয় রাজার কারণে।
দ্রৌপদী সহিত আছে কথোপকথনে।।
তবে মানী দুর্য্যোধন মলিন বদনে।
বিদায় লইয়া চলে ধর্ম্মের চরণে।।
মধুর সম্ভাষে রাজা করিয়া বিদায়।
অগ্রসরি কতদূর যান ধর্ম্মরায়।।
শীঘ্রগামী চলে সবে যত সেনাগণ।
বিরস বদনে যায় রাজা দুর্য্যোধন।।
নগরে যাইতে আর আছে কত পথ।
সেইখানে দুর্য্যোধন রহাইল রথ।।
মাতুল শকুনি আর কর্ণ দুঃশাসনে।
সম্বোধিয়া কহিতে লাগিল দুঃখমনে।।
স্বসৈন্য সহিত দেশে যাহ সর্ব্বজন।
নিশ্চয় কহিনু আমি ত্যজিব জীবন।।
পূর্ব্বে না বুঝিনু আমি আপনার বল।
বিধি তার সমুচিত দিয়াছেন ফল।।
পূর্ব্বে যদি এ সকল কহিতে হে সবে।
যুধিষ্ঠির সহ কেন বিরোধ হইবে।।
ভীমার্জ্জুন হতে মোরে স্নেহ তাঁর অতি।
স্বচ্ছন্দে পালিত মোরে ধর্ম্ম নরপতি।।
ভ্রাতৃভেদ করাইলে করিয়া আশ্বাস।
আমি মন্দমতি, তাহে করিনু বিশ্বাস।।
অনুক্ষণ কহ সবে, মারিব পাণ্ডব।
চক্ষু কর্ণে বিবাদ ঘুচিল আজি সব।।
পলাইলে সবে মোরে রাখি যুদ্ধভূমে।
বান্ধিয়া লইতেছিল গন্ধর্ব্ব-আশ্রমে।।
‌আর দেখ অপরূপ রহস্য বিধির।
আজন্ম হিংসিনু আমি রাজা যুধিষ্ঠির।।
উদ্ধার করিল সেই আমা হেন জনে।
মরণ অধিক লাজ মস্তক মুণ্ডনে।।
চিত্রসেন হস্তে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ শতগুণ।
অযশ লভিনু উদ্ধারিল যে অর্জ্জুন।।
কোন্ লাজে লোকমাঝে দেখাব বদন।
নিশ্চয় না যাব দেশে, এই নিরূপণ।।
তবে কর্ণ মহাবীর দেখিয়া অশক্য।
কহিতে লাগিল কথা রাজহিত পক্ষ।।
শুন রাজা কি কারণে চিন্ত অকারণ।
জয় পরাজয় যত দৈবের ঘটন।।
ইন্দ্র দেবরাজ হন অমর ঈশ্বর।
সদাকাল দেখ তাঁর দানবের ডর।।
কতবার স্বর্গভ্রষ্ট করাইল তাঁরে।
পুনরায় পায় রাজ্য উপায় প্রকারে।।
পূর্ব্বাপর হেন নীতি বিধির আছয়।
কখন বা জয় যুদ্ধে, কভু পরাজয়।।
কহিলে যে যুধিষ্ঠির উদ্ধার কারণ।
আপনার স্বীয় ধর্ম্ম কৈল প্রবর্ত্তন।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির অধর্ম্মের ভয়ে।
সে কারণে পাঠাইল বীর ধনঞ্জয়ে।।
সৈন্য হেতু সেনাপতি জয় করে রণ।
পূর্ব্বাপর এইমত বিধির ঘটন।।
শুন ওহে মহারাজ আমার বচন।
আজি আমি কহি কথা, করিব যেমন।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি সবাকার আগে।
মহাবীর ধনঞ্জয় থাক্ মোর ভাগে।।
তব হস্তে ভীমসেন না ধরিবে টান।
আর জনে সংহারিব পতঙ্গ সমান।।
পরাজয় হেতু রাজা কর অভিমান।
শাস্ত্রমত কহি শুন তাহার বিধান।।
বিদ্যার সমান বন্ধু নাহি ত্রিভুবনে।
অপত্য সমান স্নেহ নাহি অন্য জনে।।
শত্রু কেহ নহে রাজা ব্যাধির সমান।
সবারে অধিক দেখ দৈব বলবান।।
দৈব রণ বুঝি ক্ষমা করিলাম সবে।
মনুষ্য হইলে অপমান বলি তবে।।
এতেক বলিল যদি সূর্য্যের নন্দন।
তথাপিহ মৌনভাবে আছে দুর্য্যোধন।।
হেনকালে মিলি দৈত্য দানব সকল।
দুর্য্যোধন দুঃখে কহে হইয়া বিকল।।
আমাদের হিতে জন্ম হইল ইহার।
তেঁই সে ইহার দুঃখে দুঃখ সবাকার।।
আশ্বাস করিয়া সবে বলে শূন্যবাণী।
ঘরে যাহ ওহে রাজা কর্ণ কথা শুনি।।
যাহ কুরুশ্রেষ্ঠ রাজা আপন আলয়।
কর্ণের প্রতিজ্ঞা রাজা কভু মিথ্যা নয়।।
যুদ্ধে পরাজয় হেতু না করিহ মনে।
দেবতা মনুষ্যে যুদ্ধ ভঙ্গ সে কারণে।।
এত শুনি উঠিলেন কৌরবের পতি।
সসৈন্যেতে নিজরাজ্যে যায় শীঘ্রগতি।।
পাইয়া এ সব বার্ত্তা ভীষ্ম মহাবল।
ধৃতরাষ্ট্র অগ্রে গিয়া কহিল সকল।।
তোমার পুত্রের কথা করহ শ্রবণ।
যে হেতু বিলম্ব তার হৈল এতক্ষণ।।
যথায় কাম্যকবন প্রভাসের তীর।
পঞ্চ সহোদর যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।
দুষ্টবুদ্ধি কর্ণ শকুনির দুষ্টপণে।
বৈভব দেখাতে গেল লয়ে সর্ব্বজনে।।
গন্ধর্ব্ব অধিপ সহ সংগ্রাম হইল।
সসৈন্যে শকুনি কর্ণ দূরে পলাইল।।
নারীবৃন্দ সহ পরে ধরি দুর্য্যোধনে।
গন্ধর্ব্ব লইতেছিল করিয়া বন্ধনে।।
দয়ার সাগর অতি, ধর্ম্মের তনয়।
উদ্ধারিল পাঠাইয়া বীর ধনঞ্জয়।।
এখনো এরূপ যার ধর্ম্ম আচরণ।
তাহার সর্ব্বত্র জয়, জানিহ রাজন।।
শুনিয়া অন্ধের হৈল ব্যাকুলিত মন।
বহু মতে নিন্দা করে নিজ পুত্রগণ।।
মহাভারতের কথা ধর্ম্ম উপাখ্যান।
ভবসিন্ধু তরিতে হয় পুণ্য সোপান।।
৮৭. হস্তিনায় সশিষ্য সুর্ব্বাসার আগমন
জনমেজয় বলে, মুনি কহ বিবরণ।
সহজে অশুদ্ধবুদ্ধি রাজা দুর্য্যোধন।।
আজন্ম হিংসিল দুষ্ট নানা দুরাচারে।
ক্ষমাবন্ত ধর্ম্মশীল ধর্ম্ম অবতারে।।
তথাপিহ করি স্নেহ তারেন সঙ্কটে।
হেন জনে দুঃখ দুষ্ট দিলেক কপটে।।
মৃত্যু হৈতে উদ্ধারিল যেই মহাজন।
পুনরপি বাঞ্ছা করে তাহার মরণ।।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম, না করে গণন।
সে হেতু সবংশে মজে রাজা দুর্য্যোধন।।
শুনিনু অপূর্ব্ব কথা তোমার বদনে।
অতঃপর কি করিল দুষ্টবুদ্ধিগণে।।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।
পিতামহগণ তবে গেল কোন্ স্থানে।।
শুনিতে আনন্দ বড় জন্ময়ে অন্তরে।
মুনিবর বিস্তারিয়া বলহ আমারে।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন কুরুবর।
কাম্যক-কাননে আছে পঞ্চ সহোদর।।
যজ্ঞ জপ ব্রত তপ ধর্ম্ম আচরণ।
পূর্ব্বমত শত শত ব্রাহ্মণ ভোজন।।
হেথায় আসিয়া তবে কৌরব প্রধান।
গন্ধর্ব্বপতির হাতে পেয়ে অপমান।।
আহারে অরুচি হৈল, অভিমান মনে।
একান্তে বসিয়া কহে যত দুষ্টগণে।।
হে কর্ণ প্রাণের সখা, মাতুল ঠাকুর।
কি মত প্রকারে মোর দুঃখ হবে দূর।।
করিলে সুযুক্তি সবে যতেক মন্ত্রণা।
বিশেষ হইল সেই আপন যন্ত্রণা।।
সুন্দর দেখিতে চক্ষে পরিল অঞ্জন।
বিধির বিপাকে অন্ধ হইল নয়ন।।
গন্ধর্ব্ব করিল যত মোর অপমান।
ততোধিক শত্রুহস্তে হয়ে পরিত্রাণ।।
ইহা হতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ, গণি শতগুণে।
এতেক দুর্গতি হবে, কেবা ইহা জানে।।
আর দেখ পাণ্ডবের পুণ্যের প্রকাশ।
স্বর্গের অধিক সুখ অরণ্যে নিবাস।।
ইন্দ্রের সমান সঙ্গী চারি সহোদর।
সূর্য্যতুল্য শত শত কত দ্বিজবর।।
মনের মানসে সবে করে নানা ভোগ।
দ্রুপদ-নন্দিনী একা করয়ে সংযোগ।।
জানিনু নিশ্চয় তারা দৈবে বলবান।
মম সুখ নহে তার শতাংশে সমান।।
সূর্য্যের সমান পঞ্চ শত্রু বলবন্ত।
ত্রয়োদশ বৎসরান্তে করিবেক অন্ত।।
অর্জ্জুনে জিনিবে হেন নাহি ত্রিভুবনে।
সুরাসুর নর আদি আছে যত জনে।।
মাতুল, ত্রিগর্ত্ত, তুমি, আমি, দুঃশাসন।
বহুশ্রম করিলে না পারি কদাচন।।
বনের নিবাস শেষ যে কিছু আছয়।
ইতিমধ্যে এমন উপায় যদি হয়।।
প্রকারে পরম শত্রু যদি হয় নাশ।
আমার মনের হয় পূর্ণ অভিলাষ।।
এতেক কহিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
কহিতে লাগিল তবে দুষ্ট মন্ত্রিগণ।।
কি কারণে কর তুমি পাণ্ডবের ভয়।
নিজ পরাক্রম নাহি জান মহাশয়।।
বুদ্ধিবলে করিব উপায় যত আছে।
তাতে রক্ষা পেয়ে দেখি কেমনেতে বাঁচে।।
অস্ত্রের অনলে দগ্ধ করিব পাণ্ডবে।
সামান্য কর্ম্মেতে কেন চিন্ত এত সবে।।
দুষট মন্ত্রিগণ যত কহিলেক ভাষা।
তার কত দিনান্তরে আইল দুর্ব্বাসা।।
সঙ্গেতে সহস্র দশ শিষ্য মহাঋষি।
মধ্যাহ্ন সূর্য্যের প্রায় উত্তরিল আসি।।
দুর্য্যোধন শুনি তবে ঋষি আগমন।
আগুসরি কত দূরে গেল সর্ব্বজন।।
যতেক অমাত্য আর সহোদর শত।
মুনির চরণে সবে হৈল দণ্ডবত।।
প্রণাম করিল শিষ্যগণে সর্ব্বজনে।
বসাইল মুনিরাজে রত্ন সিংহাসনে।।
সুবাসিত জল আনি রাজা দুর্য্যোধন।
আপনি করিল ধৌত মুনির চরণ।।
পাদ্য অর্ঘ্য আদি দিয়া পূজে মুনিরাজে।
সেই মতে পূজিলেক শিষ্যের সমাজে।।
করযোড় করি তবে রাজা দুর্য্যোধন।
কহিতে লাগিল কিছু, বিনয় বচন।।
নিবেদন আছে কিছু, কিন্তু ভয় নয়।
আমার ভাগ্যের কথা কহনে না যায়।।
আজি মোরে সুপ্রসন্ন হৈল দেবগণ।
সে কারণে দেখিলাম তোমার চরণ।।
মুনি বলে, শুনিয়াছি তব ভাগ্য কথা।
সে হেতু আসিতে বাঞ্ছা বহুদিন হেথা।।
তোমার বৈভব যত শুনি লোকমুখে।
দেখিতে আসিনু হেথা মনের কৌতুকে।।
রাজা বলে, উগ্র তপ কৈল পিতৃগণ।
জানিনু প্রসন্ন মোরে দেব দ্বিজগণ।।
পাইলাম আজি পূর্ব্ব তপস্যার ফল।
নিশ্চয় জানিনু মোর জনম সফল।।
জানিলাম আজি মোরে সুপ্রসন্ন বিধি।
নতুবা আমার গৃহে কেন তপোনিধি।।
বহুবিধ স্তব কৈল কৌরব সমাজ।
বসিবারে আজ্ঞা করি কহে মুনিরাজ।।
মুনি বলে, ভাগ্যবন্ত তুমি ক্ষিতিতলে।
নহিবে এমন আর ক্ষত্রিয়ের কুলে।।
মহাবংশজাত তুমি খ্যাত চরাচর।
তব পূর্ব্ব পিতামহ যত পূর্ব্বাপর।।
মহাকীর্ত্তিমান যত সবে মহাতেজা।
সে মত হইলে তুমি নিজে মহারাজা।।
কিন্তু পূর্ব্ব পিতামহ করিল যে কর্ম্ম।
সেইমত প্রাণপণে পাল কুলধর্ম্ম।।
যজ্ঞ তপ ব্রত আর ব্রাহ্মণ ভোজন।
সুনীতে করিবে নিত্য প্রজার পালন।।
দ্রব্য কিনি মূল্য দিবে, উচিত যে হবে।
বিক্রয় করিতে ঔপাধিক না লইবে।।
পালন করিবে প্রজা পুত্রের সমানে।
দোষমত শাস্তি দিবে দুষ্টবুদ্ধি জনে।।
মান্যজনে নিত্য নিত্য বাড়াইবে মান।
যে কিছু কহিবে কথা বিনয় বিধান।।
সতত না হয় শান্তি, সদা নহে রোষ।
কালের উচিত কর্ম্ম পরম পৌরুষ।।
দুষ্ট বুদ্ধিদাতা যেই দুষ্ট দুরাচার।
সে সবার সহ নাহি করিবে ব্যাভার।।
সতত শাসনে যেন থাকে সর্ব্ব ক্ষিতি।
অনুরক্ত থাকে যেন সকল নৃপতি।।
পরপক্ষে কদাচিৎ নহিবে বিশ্বাস।
রাখিবে অন্তর জানি যত দাসী দাস।।
বিরূপ না হও কভু আত্মপক্ষ জনে।
পালিবে এ সব কথা পরম যতনে।।
নহুষ যযাতি আদি পূর্বব বংশ যত।
পৃথিবী পালিত সবে করি এই মত।।
সে সবা হইতে তব বিপুল বিভব।
দ্বিগুণ পাইবে শোভা হইলে এ সব।।
এত শুনি সবিনয়ে বলে কুরুপতি।
যাহা করিয়াছি আমি, আপন শকতি।।
অতঃপর যাহা হয়, তব উপদেশ।
আপনি করিয়া কৃপা কহিলে বিশেষ।।
পালন করিবে যত্নে তব এই কথা।
আপনি হইলা মম জ্ঞান চক্ষুদাতা।।
পূর্ব্বপিতামহগণ চিল উগ্রতপা।
সে কারণে কর প্রভু এতদূর কৃপা।।
এখন হইল প্রভু সফল জীবন।
এরূপে অনেক স্তুতি কৈল দুর্য্যোধন।।
হেনমতে কথোপকথনে মুনিরাজ।
পরম আনন্দ মতি কৌরব সমাজ।।
নানা বাক্য কথায় কৌতুক মনঃসুখে।
মুনিরে করিল বশ যত সভালোকে।।
একদা একান্তে বসি রাজা দুর্য্যোধন।
ডাকিল শকুনি কর্ণ ভাই দুঃশাসন।।
কর্ণে সম্বোধিয়া কহে কৌরব প্রধান।
আমার বচন সখা কর অবধান।।
বিচার করিনু এক আমি মনে মনে।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবেরা রহে কাম্যবনে।।
দ্রুপদ-নন্দিনী কৃষ্ণা লক্ষ্মীর সমান।
তাহার প্রসাদে সবে পায় পরিত্রাণ।।
সূর্য্যের কৃপার ফলে কিঞ্চিৎ রন্ধনে।
পরম সন্তোষে তাহা ভুঞ্জে লক্ষ জনে।।
যত লোক যায় তথা, সবে অন্ন পায়।
যতক্ষণ যাজ্ঞসেনী কিছু নাহি খায়।।
অক্ষয় থাকয়ে যত চতুর্ব্বিধ ভোগ।
অপূর্ব্ব দিখেহ কিবা বিধির সংযোগ।।
দ্রুপদ-নন্দিনী কৃষ্ণা করিলে ভোজন।
কিঞ্চিৎ মাগিলে নাহি পায় কোন জন।।
প্রতিদিন হেনমতে ভুঞ্জায় সবায়।
দশ দণ্ড নিশাযোগে নিজে কিছু খায়।।
সেকালে, সে স্থানে যদি যান মুনিরাজ।
সংহতি করিয়া যত শিষ্যের সমাজ।।
দ্রৌপদীর ভোজনান্তে যাবে সেইস্থানে।
সেবায় নহিবে ক্ষম ভাই পঞ্চ জনে।।
দোষ দেখি মহামুনি দিবে ব্রহ্মশাপ।
মরিবে পাণ্ডব-বংশ, ঘুচিবে সন্তাপ।।
তোমা সবাকার মনে না জানি কি লয়।
ঋষিরে কহিব বুঝি যদি যোগ্য হয়।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় সর্ব্বজন।।
সবে বলে মহারাজ যে আজ্ঞা তোমার।
করিলে মন্ত্রণা এই সংসারের সার।।
এমত কৌতুকমতি আছে সর্ব্বজন।
ভক্তিভাবে করে নিত্য মুনির সেবন।।
একদা দিনান্তে বসি হর্ষে মুনিরাজ।
নিকটে ডাকিয়া যত কৌরব সমাজ।।
হ্তি উপদেশ আর মধুর বচন।
দুর্য্যোধনে সম্বোধিয়া কহে তপোধন।।
শুন রাজা ত্রিভুবনে পূরে তব যশ।
তোমার সেবায় বড় হইলাম বশ।।
ইষ্ট বর মাগি লহ মম বিদ্যমানে।
বিদায় করহ শীঘ্র, যাই যথাস্থানে।।
মুনির বচন শুনি রাজা দুর্য্যোধন।
গদগদ ভাষে কহে বিনয় বচন।।
ধন ধর্ম্ম দারা পুত্র বিভব বিপুল।
কেবল তোমার মাত্র আশীর্ব্বাদ মূল।।
পরিপূর্ণ আছে সৈন্য, রাজ্য অধিকার।
কেবল রহুক ভক্তি চরণে তোমার।।
আর এক নিবেদন শুন মহাশয়।
কহিতে সঙ্কোচ করি, কৃপা যদি হয়।।
যথায় কাম্যক বনে পাণ্ডুর তনয়।
সংহতি করিয়া যদি শিষ্য সমুদয়।।
উত্তীর্ণ হইবে যবে দশ দণ্ড নিশি।
সেকালে অতিথি হবে, ওহে মহাঋষি।।
ভক্তিভাব বুঝিয়া জানিবা তার মন।
সবে বলে ধর্ম্মবন্ত পাণ্ডুর নন্দন।।
পূজা করে দেব দ্বিজে, ভক্তি অতিশয়।
সেই কথা পরীক্ষা করিতে যোগ্য হয়।।
সকালে সকল দ্রব্য হয় উপস্থিত।
রন্ধন করেন কৃষ্ণা নিত্য নিয়মিত।।
ভোজন করয়ে যত নিযুক্ত ব্রাহ্মণ।
তাহার মধ্যেতে যদি হয় লক্ষ জন।।
খাদ্যদ্রব্য পরিপূর্ণ থাকে সে সময়।
অনায়াসে খায় তথা যত লোক যায়।।
অভক্তি ভক্তির ভাব না হয় বিদিত।
সে কারণে কালাতীতে যাইতে উচিত।।
দশ দণ্ড নিশা যবে উত্তীর্ণ হইবে।
পাক সমাপন করি যাজ্ঞসেনী খাবে।।
শয়নের উদ্যোগ করিবে সর্ব্বজন।
সেইকালে শিষ্য সহ যাবে তপোধন।।
তবে যদি মধ্যাহ্ন কালের অনুসারে।
যে জন করয়ে ভক্তিভাব বলি তারে।।
সন্দেহ ভাঙ্গিতে ইথে তোমা ভিন্ন নাই।
পরীক্ষিতে যাবে তথা দিনেক গোঁসাই।।
দুর্য্যোধন নৃপতির নম্রকথা শুনি।
কৃপা করি কহিতে লাগিল মহামুনি।।
কোন ভার দিলে রাজা এই কোন্ কথা।
তব প্রীতি হেতু আমি যাইব সর্ব্বথা।।
জানিব সত্যের ভাব রাজা যুধিষ্ঠিরে।
দ্বিতীয় করিব স্নান পুষ্করের নীরে।।
তৃতীয়ে তোমার বাক্যে করিব এ কাজ।
শীঘ্রগতি বিদায় করহ মহারাজ।।
শুনিয়া আনন্দমতি রাজা দুর্য্যোধন।
সবান্ধবে প্রণাম করিল হৃষ্টমন।।
বহুবিধ বিনয় করিল সর্ব্বজনে।
সেইমতে সাদরে সম্ভাষি শিষ্যগণে।।
বিদায় হইয়া মুনি করিল গমন।
রহিল আনন্দমনে রাজা দুর্য্যোধন।।
ব্যাসের রচিত গাথা ভারতোপাখ্যান।
জীবে উদ্ধারিতে এই পুণ্যের সোপান।।
৮৮. কাম্যক বনে যুধিষ্ঠিরের
নিকট দুর্ব্বাসার আগমন
বিদায় লইয়া মুনি দুর্য্যোধন স্থানে।
বহু শিষ্য সহ যায় আনন্দিত মনে।।
যাইতে যাইতে মুনি বিচারিল মনে।
কহিল ডাকিয়া কাছে যত শিষ্যগণে।।
চল সবে এই পথে প্রভাসের তীর।
কাম্যবনে যাব যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।
বহু দিন পরে ধর্ম্মে করিব দর্শন।
পরম ধর্ম্মাত্মা তারা ভাই পঞ্চ জন।।
প্রভাসের স্নান আর ধর্ম্মের সম্ভাষ।
দুর্য্যোধন রাজার মনের অভিলাষ।।
অনায়াসে তিন কর্ম্ম হবে এককালে।
এতেক বলিয়া মুনি পূর্ব্বদিকে চলে।।
জনপদ ছাড়ি সবে প্রবেশিল বন।
হেনকালে অস্তাচলে যান বিকর্ত্তন।।
পূর্ব্বদিক সুপ্রসন্ন কৈল কলানিধি।
কুমুদিনী বিকশিতা দেখিয়া কৌমুদী।।
মাধব মাসেতে সিতপক্ষে চতুর্দ্দশী।
সেই দিনে যাত্রা করে দুর্ব্বাসা মহর্ষি।।
কৌতুকে পথেতে নানা কথার প্রবন্ধ।
বিচিত্র বনের শোভা দেখিয়া সানন্দ।।
অতিক্রান্ত হৈল ক্রমে যবে অর্দ্ধনিশি।
অত্যন্ত আনন্দযুক্ত গেল মহাঋষি।।
যথায় ধর্ম্মের পুত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
উত্তরিল মহামুনি প্রভাসের তীর।।
যুধিষ্ঠির শুনি তবে মুনি আগমন।
আগুসরি কত দূর যান পঞ্চ জন।।
দুর্ব্বাসা দেখিয়া সবে আনন্দিত মন।
সেইমত চলিল যতেক দ্বিজগণ।।
চিন্তাযুক্ত যুধিষ্ঠির করেন বিচার।
এ রাত্রে কি হেতু মুনি করে আগুসার।।
বিশেষে ‍দুর্ব্বাসা মুনি আর কেহ নয়।
অল্পদোষে মহারোষে করিবে প্রলয়।।
চিত্তেতে ভাবেন ধর্ম্ম, চিন্তা করি মিছা।
অবশ্য হইবে যাহা ঈশ্বরের ইচ্ছা।।
দেখিতে দেখিতে তথা আসে মুনিরাজ।
সংহতি সহস্র দশ শিষ্যের সমাজ।।
ভূমে লুটি প্রণমিয়া করেন সম্মান।
পাদ্য অর্ঘ্যেতে পূজেন দেবের সমান।।
মুনিরে প্রণাম করে ভাই পঞ্চ জনে।
সেইমত সম্ভাষেন যত শিষ্যগণে।।
আছিল রাজার সঙ্গে যতেক ব্রাহ্মণ।
মুনিরাজে সম্ভাষণ করে সর্ব্বজন।।
বয়োধিকে মান্য করি প্রণাম করিল।
জ্যেষ্ঠজন কনিষ্ঠেরে আশীর্ব্বাদ দিল।।
সমান সমান জনে ধরি দেয় কোল।
নমস্কার আশীর্ব্বাদ হৈল মহাগোল।।
তবে যুধিষ্ঠির রাজা যুড়ি দুই কর।
বিনয় করেন মুনিরাজ কবরাবর।।
ধর্ম্ম বলিলেন, মুনি করি নিবেদন।
শুনিবারে ইচ্ছা আগমনের কারণ।।
কোন দেশে হৈতে আজি হৈল আগমন।
কোন দেশ করিবেন মঙ্গল ভাজন।।
তীর্থ অনুসারে, কিম্বা মম ভাগ্যোদয়।
বিশেষ করিয়া সহ কৃপা যদি হয়।।
মুনি বলে, শুন যদি জিজ্ঞাসিলে তুমি।
সশিষ্যে হস্তিনাপুরে গিয়াছিনু আমি।।
অনেক করিল সেবা ভাই শত জনে।
তোমারে দেখিতে বড় ইচ্ছা হৈল মনে।।
এ হেতু হেথায় এবে কির আগমন।
যেমন কৌরব মোর, পাণ্ডব তেমন।।
আর এক কথা শুন ধর্ম্মের নন্দন।
পথশ্রমে ক্ষুধাতুর আছি সর্ব্বজন।।
রন্ধন করিতে কহ, যাত শীঘ্রগামী।
তাবৎ প্রভাসে গিয়া সন্ধ্যা করি আমি।।
শুনিয়া মুনির কথা ধর্ম্মের তনয়।
মনেতে চিন্তেন, আজি না জানি কি হয়।।
অন্তরে জন্মিল ভয় পাছে করে ক্রোধ।
অনুমতি দিলেন মুনির অনুরোধ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন মম ভাগ্যোদয়।
সে কারণে আগমন আমার আলয়।।
সন্ধ্যা হেতু গতি এবে কর মহাশয়।
করিব যে কিছু মম ভাগ্যোদয়ে হয়।।
তবে মুনি চলিলেন সহ শিষ্যগণে।
প্রভাসের কূলে গেল সন্ধ্যার কারণে।।
চিন্তাযুক্ত যুধিষ্ঠির আপন আশ্রমে।
দ্রৌপদীরে আসিয়া কহেন ক্রমে ক্রমে।।
ধর্ম্মের যতেক কথা দ্রৌপদী শুনিল।
উপায় না দেখি কিছু প্রমাদ গণিল।।
কৃষ্ণা বলে, যেই কথা কৈলে মহাশয়।
হেন বুঝি, বিধি কৈল অকালে প্রলয়।।
সশিষ্য অতিথি হৈল উগ্রতপা ঋষি।
আমার নহিল শক্তি আজিকার নিশি।।
রজনী প্রভাতে কালি সূর্য্যের প্রসাদে।
দশলক্ষ হইলে ভুঞ্জাব অপ্রমাদে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, কৃষ্ণা উত্তম কহিলে।
মুনি ক্রোধানলে আজি সব দগ্ধ হৈলে।।
কি কর্ম্ম করিবে কালি প্রভাতে কে জানে।
দুর্ব্বাসার ক্রোধ সহে কাহার পরাণে।।
দ্রৌপদী কহিল, এ কি দৈবের সংযোগ।
‌আমার কর্ম্মের ফল, কে করিবে ভোগ।।
সুকর্ম্মের চিহ্ন যদি হৈত মহারাজ।
দিবসে আসিত তবে মুনির সমাজ।।
আমা সবা হতে কিছু নাহি প্রতিকার।
কেবল পারেন কৃষ্ণ করিতে উদ্ধার।।
তবেত দ্রৌপদী দেবী ভাবে মনে মন।
কৃষ্ণ বিনা এ সময়ে রাখে কোন্ জন।।
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু পাণ্ডব-সারথি।
তুমি যদি এইবার না কর রক্ষণ।।
তবেত পাণ্ডব বংশ হইল নিধন।
এমতে দ্রৌপদী দেবী অনুক্ষণ ভাবে।
যুধিষ্ঠিরে কহে দেবী, কহ কিবা হবে।।
অনর্থ হৈল বড় দুর্ব্বাসা আগমনে।
বুঝিলাম, রক্ষা নাহি শুনহ রাজনে।।
দ্রৌপদীর মুখে রাজা শুনিয়া বচন।
জ্ঞানাহত যুধিষ্ঠির হইল তখন।।
হেঁটমুখে বসি রাজা ভাবিতে লাগিল।
দুর্ব্বাসার ক্রোধে বুঝি সকলি মজিল।।
এ সময়ে কৃষ্ণ বিনা কে করে তারণ।
ভকতের নাথ কৃষ্ণ পতিত পাবন।।
কোথা কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
পার কর জগন্নাথ বিপদসাগরে।।
পার কর শ্রীগোবিন্দ হৈয়া কৃপাময়।
রাখহ পাণ্ডবকুল মজিল নিশ্চয়।।
তোমা হেন আছে যার মহারত্ন নিধি।
এমন সংকট তারে মিলাইল বিধি।।
তোমারে পাণ্ডব বন্ধু বলি লোকে কয়।
সে কথা পালন কর, ওহে দয়াময়।।
কৃষ্ণা সহ পঞ্চ ভাই আকুল হইয়া।
ডাকিতেছে কোথা কৃষ্ণ উদ্ধার আসিয়া।।
হেথায় কৌতুকে কৃষ্ণ দ্বারকা নগরে।
শয়ন করিয়াছেন রুক্মিণীর ঘরে।।
আর্ত্ত হয়ে ভক্ত ডাকে বলি জগন্নাথ।
বাজিল অন্তরে যেন কণ্টকের ঘাত।।
রহিতে নাহিক শক্তি ভক্ত-দুঃখ জানি।
ব্যস্ত হয়ে উঠিলেন দেব চক্রপাণি।।
চিন্তান্বিত অন্তরে করেন ছটফট।
রুক্মিণী কহেন দেখি, করিয়া কপট।।
চিত্তের চাঞ্চল্য আজি দেখি কি কারণ।
হেন বুঝি, কোথা যাবে হইয়াছে মন।।
অরণ্যে দ্রৌপদী সখী আছয়ে যথায়।
অকস্মাৎ মনে বুঝি পড়িল তাহায়।।
শ্রীকৃষ্ণ কহেন, শুন প্রাণপ্রিয়তমা।
অদ্যকার এই অপরাধ কর ক্ষমা।।
ভক্তাধীন করি মোরে সৃজিল বিধাতা।
আমার কেবল ভ্ক্ত সুখদুঃখদাতা।।
মম ভক্তজন যথা তথা থাকে সুখে।
আমিহ তথায় থাকি পরম কৌতুকে।।
মম ভক্তজন দেখ যদি দুঃখ পায়।
সে দুঃখ আমার হেন জানিহ নিশ্চয়।।
সে কারণে ভক্ত দুঃখ খণ্ডাই সকল।
নহিলে কি হেতু নাম ভকতবৎসল।।
আমার একান্ত ভক্ত রাজা যুধিষ্ঠির।
বিপদসাগরে পড়ি হয়েছে অস্থির।।
দুঃখ পেয়ে ডাকে ধর্ম্ম কোথা জগন্নাথ।
বাজিল অন্তরে সেই কণ্টকের ঘাত।।
যতক্ষণ নাহি দেখি ধর্ম্মের নন্দন।
ততক্ষণ মম দুঃখ না হবে খণ্ডন।।
এই আমি চলিলাম যথা ধর্ম্মমণি।
এত শুনি কহেন রুক্মিণী ঠাকুরাণী।।
তোমার একান্ত ভক্তি আছয়ে পাণ্ডবে।
সর্ব্বকালে এইরূপ জানি অনুভবে।।
বিশেষে করিল বশ দ্রুপদের সুতা।
তোমার বাসনা সর্ব্বকাল থাক তথা।।
গমন রজনীকালে উচিত না হয়।
সে কারণে নিবেদন করি মহাশয়।।
যাইবে অবশ্য কালি তপন উদয়।
যে ইচ্ছা তোমার, কর তুমি ইচ্ছাময়।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সত্য কহিলে যে তুমি।
ক্ষণেক তথায় যদি নাহি যাই আমি।।
সবংশে মজিবে রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
আমার গমন তবে কোন্ প্রয়োজন।।
এত বলি করিলেন গরুড়ে প্রয়োজন।
আসিল স্মরণমাত্রে বিনতা নন্দন।।
আসিল উড়িয়া বীর যথা জগন্নাথ।
সম্মূখে দাঁড়ায় বীর করি যোড়হাত।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুণ্যবান।।
৮৯. যুধিষ্ঠিরের স্মরণে শ্রীকৃষ্ণের কাম্যক বনে আগমন
আসিয়া খগেন্দ্র কহে বন্দিয়া চরণ।
কি হেতু নিশাতে প্রভু করিলে স্মরণ।।
কি হেতু হইল আজি চিত্ত উচাটন।
শীঘ্রগতি কহ হরি তার বিবরণ।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সখা পাণ্ডপুত্রগণ।
বসতি করেন যথা করিব গমন।।
এত বলি খগোপরি করি আরোহণ।
নিমিষেতে উপনীত যথা কাম্যবন।।
হেথায় আকুল চ্ত্তি ধর্ম্মের নন্দন।
হেনকালে আসিলেন হরি খগাসন।।
যুধিষ্ঠির শুনি তবে কৃষ্ণ আগমন।
পাইলেন প্রাণ যেন প্রাণহীন জন।।
ব্যগ্র হয়ে কতদূরে গিয়া পঞ্চ জনে।
নিকটেতে পাইলেন দৈবকী নন্দনে।।
আনন্দ বাড়িল তাঁর নাহিক অবধি।
দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।
আনন্দ অধীর অন্তরে দেন আলিঙ্গন।
আনন্দ সলিলে পূর্ণ হইল লোচন।।
পূর্ণ করি মানিলেন মন অভিলাষ।
অন্য অন্য সর্ব্বজনে করিল সম্ভাষ।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা কহ সমাচার।
যুধিষ্ঠির কহে, কৃষ্ণ কি কহিব আর।।
কহিতে বদনে মম নাহি স্ফুরে ভাষা।
এত রাত্রে শিষ্য সহ অতিথি দুর্ব্বাসা।।
প্রভাসের কূলে গেল সন্ধ্যার কারণ।
উপায় করিতে শক্য নহে কোন জন।।
সবংশে মজিনু আমি, বুঝি অভিপ্রায়।
কাতর হইয়া তেঁই ডাকিনু তোমায়।।
তোমা বিনা পাণ্ডবের আর কেহ নাই।
মম নিবেদন এই কহিলাম ভাই।।
রাখহ মারহ তব যাহা মনে লয়।
বিলম্ব না সহে বড় সঙ্কট সময়।।
যুধিষ্ঠির এত যদি কহে নারায়নে।
গোবিন্দ কহেন, চিন্তা না করিহ মনে।।
শিষ্যগণ সহ মুনি আসুক হেথায়।
সবাকারে ভুঞ্জাইব সে আমার দায়।।
এত বলি সানন্দিত করি ধর্ম্মমণি।
ত্বরিতে গেলেন কৃষ্ণ যথা যাজ্ঞসেনী।।
কৃষ্ণে দেখি দ্রৌপদীর পূরে অভিলাষ।
বসিতে আসন দিয়া কহে মৃদুভাষ।।
ভকতবৎসল প্রভু তুমি অন্তর্য্যামী।
দীনবন্ধু নাম সত্য জানিলাম আমি।।
কি জানি তোমার ভক্তি আমি হীনজ্ঞান।
বিপদে পড়িনু, প্রভু কর পরিত্রাণ।।
সন্ধ্যা করি যাবৎ না আইসে মহামুনি।
উচিত বিধান শীঘ্র কর চক্রপাণি।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, তাহা বিচারিব পাছু।
ক্ষুধায় শরীর পোড়ে খাই দেহ কিছু।।
বিলম্ব না সহে, মোরে অন্ন দেহ আনি।
পশ্চাৎ করিব যাহা কহ যাজ্ঞসেনী।।
কৃষ্ণা বলে, জানি নিজে সব সমাচার।
আপনি এমত কহ অদৃষ্ট আমার।।
অন্না দিতে আমি যদি হতেম ভাজন।
ঘোর নিশি তোমারে স্মরিব কি কারণ।।
ছল করি কহ কথা জানিয়া সকল।
বুঝিতে না পারি হরি মম কর্ম্মফল।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, তনু দহে যে ক্ষুধায়।
পাইলে উত্তম পরিহাসের সময়।।
কহিতে নাহিক শক্তি, স্থির নহে মন।
উঠ উঠ বিলম্বেতে নাহি প্রয়োজন।।
এত শুনি কহে দেবী দ্রুপদ তনয়া।
বুঝিতে না পারি দেব কেন কর মায়া।।
যখন হইল গত দশ দণ্ড নিশি।
ভুঞ্জিলেন সেইকালে যত দেব ঋষি।।
অবশেষে ছিল কিছু করিনু ভোজন।
শূন্যপাত্র আছে মাত্র দেখ নারায়ণ।।
দিন নহে, দ্বিতীয় প্রহর হৈল নিশি।
উপায় করিব কিবা আমি বনবাসী।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাজ্ঞসেনী শুন বলি।
অবশ্য আছয়ে কিছু দেখ পাক স্থালী।।
রন্ধন ব্যঞ্জন অন্ন যে কিছু আছয়।
অল্পেতে হইব তৃপ্ত, কিছু হৈলে হয়।।
আলস্য ত্যজিয়া উঠ, করহ তল্লাস।
বিলম্ব না সহে আর, ছাড় পরিহাস।।
কৃষ্ণের বচন শুনি কৃষ্ণা গুণবতী।
দখাইতে পাকপাত্র আনে শীঘ্রগতি।।
আনিয়া দ্রৌপদী কহে, দেখ জগন্নাথ।
দেখিয়া কৌতুকে কৃষ্ণ পাতিলেন হাত।।
শাকের সহিত মাত্র এক অন্ন ছিল।
কৃষ্ণের প্রসাদ হেতু অনন্ত হইল।।
ভোজন করিয়া তৃপ্ত দেব দামোদর।
জলপান করিলেন, ভরিল উদর।।
কৌতুকে উঠিয়া তবে দেব জগন্নাথ।
উদগার করয়া দেন উদরেতে হাত।।
দ্রৌপদীরে কহিলেন, মোর ক্ষুধা গেল।
আজিকার ভোজনেতে মহাতৃপ্তি হৈল।।
ইহা বলি পুনঃ পুনঃ তুলেন উদগার।
ত্রিভুবনে সেই মত হইল সবার।।
সর্ব্বভূতে আত্মরূপে যেই নারায়ণ।
তাঁহার তৃপ্তিতে তৃপ্ত হইল ভুবন।।
হেথায় দুর্ব্বাসা ঋষি সহ শিষ্যগণ।
বুঝিতে না পারি কিছু ইহার কারণ।।
উদর পূরিল মন্দানলে সবাকার।
সঘনে নিশ্বাস বহে, উঠিছে উদগার।।
বিস্ময় মানিয়া তবে কহে মুনিরাজ।
নিকটে ডাকিয়া নিজ ‍শিষ্যের সমাজ।।
মুনি বলে, শুন শুন সব শিষ্যগণ।
বুঝিতে না পারি কিছু ইহার কারণ।।
অকস্মাৎ হল দেখ উদর আধ্নান।
পাইতেছি যত কষ্ট নাহি পরিমাণ।।
অনুমান করি কিছু না পারি বুঝিতে।
পথ পরিশ্রমে কিবা বায়ু বৃদ্ধি হৈতে।।
শিষ্যগণ বলে, যাহা কৈলে মহাশয়।
আমা সবাকার মনে হইল বিস্ময়।।
সন্ধ্যা হেতু আসি যবে প্রভাসের জলে।
শরীর দহিতেছিল ক্ষুধার অনলে।।
অকস্মাৎ এই মত হৈল সবাকার।
উদর পূরণে যন উঠিছে উদগার।।
অন্য অন্যে বিচার করেন জনে জন।
কেহ না কহিল কারে লজ্জার কারণ।।
মুনি বলে মহাশ্চর্য্যে ডুবে মম মন।
ব্রহ্মাণ্ড ভাবিয়া কিছু না পাই কারণ।।
যখন সন্ধ্যায় আসি প্রভাসের তীরে।
রন্ধন করিতে বলিলাম যুধিষ্ঠিরে।।
সংগ্রহ করিল তারা করি প্রাণপণ।
কোন্ লাজে গিয়া তারে দেখাব বদন।।
বুঝিয়া বিধান তবে করহ বিচার।
শিষ্যগণ বলে, প্রভু কি কহিব আর।।
আজি তথা গিয়া লজ্জা পাব কি কারণ।
উঠিতে শকতি নাহি কে করে ভোজন।।
ঈশ্বর করিলে কালি উঠিয়া প্রত্যূষে।
অতিথি হইয়া যাব পাণ্ডব সকাশে।।
ইহার উপায় আর নাহি মহাশয়।
মুনি বলে, এই কথা মম মনে লয়।।
বঞ্চিব রজনী আজি প্রভাসের কূলে।
যে কিছু কর্ত্তব্য কালি করিব সকলে।।
এত বলি সবে তবে করিল শয়ন।
জানিলেন সব তত্ত্ব দৈবকী নন্দন।।
কৃষ্ণা সহ যান কৃষ্ণ যথা যুধিষ্ঠির।
সবার সম্মূখে কহে দেব যদুবীর।।
শুন শুন ধর্ম্মরাজ করি নিবেদন।
দ্রৌপদী প্রস্তুত কৈল করিয়া রন্ধন।।
সকল সম্পূর্ণ হৈল বিলম্ব কি আর।
ভীমেরে করহ আজ্ঞা মুনি ডাকিবার।।
শুনিয়া কৃষ্ণের কথা পাণ্ডব নন্দন।
আশ্চর্য্য তখন রাজা ভাবে মনে মন।।
প্রস্তুত হইল সব কারণ জানিল।
মুনিরে ডাকিতে রাজা ভীমে আজ্ঞা দিল।।
কত দূরে গিয়া ডাকে পবন-নন্দন।
আকাশ ভাঙ্গিয়া যেন ভীমের গর্জ্জন।।
শীঘ্র এস মুনিগণ, বিলম্বে কি কাজ।
প্রস্তুত হয়েছে সব, ডাকে ধর্মরাজ।।
ভীমের পাইয়া শব্দ যত মুনিগণ।
শীঘ্রগতি মিলি সবে দুর্ব্বাসারে কন।।
শুন শুন ডাকে অই পবন-নন্দন।
ইহার উপায় মুনি কি হবে এখন।।
এই রাত্রে যদি সবে করিব ভোজন।
চলিতে না হবে শক্তি হইবে মরণ।।
নাহি গেলে মহাবীর আসিবে হেথায়।
মনেতে ভাবিয়া মুনি করহ উপায়।।
তুমি না করিলে ত্রাণ কে করিবে আর।
পলাইতে শক্তি নাই তুমি কর পার।।
সকলে পাইল ভয় যত ঋষি মুনি।
অন্তরে জপেন নাম রাখ চক্রপাণি।।
উদর হয়েছে ভারি, উঠিছে উদগার।
এ সময়ে যদুনাথ সবে কর পার।।
এইমত বহু স্তব কৈল সর্ব্ব জন।
ভীমেরে ডাকেন কৃষ্ণ শুনহ বচন।।
পথশ্রমে নিদ্রায় আছেন মুনিগণ।
নিদ্রাভঙ্গ নাহি কর পবন নন্দন।।
শুনিয়া কৃষ্ণের আজ্ঞা পবন নন্দন।
তথা হৈতে ধর্ম্ম কাছে যান ততক্ষণ।।
অনন্তর মিষ্ট বাক্যে কহে জগন্নাথ।
আনন্দেতে যাহ নিদ্রা পাণ্ডবের নাথ।।
মুনির কারণ মনে না করিহ ভয়।
আজি না আসিবে মুনি জানিহ নিশ্চয়।।
স্নান দান করি কালি প্রভাসের জলে।
ভোজন করিবে সবে আসিয়া সকালে।।
শুনিয়া কৃষ্ণের মুখে এতেক বচন।
ধর্ম্ম বলেন বিলম্ব তাই এতক্ষণ।।
তোমার অসাধ্য দেব আছে কোন্ কর্ম্ম।
পাণ্ডবকুলের আজি হৈল পুনর্জ্জন্ম।।
বিস্তর কহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
সহায় সম্পদ মম তুমি নারায়ণ।।
না জানি পূর্ব্বেতে কত করিনু কুকর্ম্ম।
সে কারণে দুঃখে শোকে গেল মম জন্ম।।
প্রথম বয়সে বিধি দিল নানা শোক।
অল্পকালে পিতা মম গেল পরলোক।।
গোঁয়াইনু সেইকালে পরের আলয়।
দুঃখ না জানিনু অতি অজ্ঞান সময়।।
তদন্তরে দুষ্টবুদ্ধি দিলেক যন্ত্রণা।
জতুগৃহে প্রাণ পাই বিদুর-মন্ত্রণা।।
বনের অশেষ দুঃখ ভ্রমণ সঙ্কটে।
আপনি রাখিলে ধৃতরাষ্ট্রের কপটে।।
এ সব সঙ্কট হতে তুমি মাত্র ত্রাতা।
এমত সংযোগ আনি করিল বিধাতা।।
রাজ্যনাশ বনবাস হীন সর্ব্ব ধর্ম্মে।
বিধির নিযুক্ত এই পূর্ব্বমত কর্ম্মে।।
সবে মাত্র পূর্ব্ববংশে ছিল উগ্রতপা।
কেবল তাহার ফলে তুমি কর কৃপা।।
এতেক কহেন যদি ধর্ম্মের নন্দন।
তদন্তরে কহিলেন দেব নারায়ণ।।
শুন ধর্ম্মসুত যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
কহিলে যতেক কথা সব আমি জানি।।
পাইলে যতেক দুঃখ অন্যথা না হয়।
কিন্তু তুমি ধর্ম্ম নাহি ত্যজ মহাশয়।।
আর যে কহিলে, তুমি হীন সর্ব্বধর্ম্মে।
পৃথিবী পবিত্র হৈল তোমার সুকর্ম্মে।।
দান ধর্ম্মে রাজনীতে এ তিন ভুবনে।
আছয়ে তোমার তুল্য, নাহি লয় মনে।।
দুর্ব্বলের বল ধর্ম্ম, আমি জানি ভালে।
এই দুঃখ তোমার খণ্ডিবে অল্পকালে।।
অধর্ম্মী জনের সুখ কভু স্থায়ী নয়।
জোয়ারের জল প্রায় ক্ষণকাল রয়।।
মনেতে রাখিবে মম এই নিবেদন।
মহাকষ্টে সত্য নাহি ছেড়ো কদাচন।।
এত বলি জনার্দ্দন লইয়া বিদায়।
গরুড় উপরে চড়ি যান দ্বারকায়।।
কৃষ্ণেরে বিদায় করি ভাই পঞ্চ জন।
হৃষ্ট মনে সবে তবে করেন শয়ন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।
৯০. দুর্ব্বাসার পারণ
প্রভাতে উঠিয়া তবে ধর্ম্মের নন্দন।
নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম কৈল সমাপন।।
দুর্ব্বাসা অতিথি হেতু সচিন্তিত মন।
নানা কার্য্যে নানা স্থানে ধায় সবর্ব জন।।
ফল পুষ্প হেতু কেহ প্রবেশিল বনে।
ভীমার্জ্জুন দোঁহে যান মৃগয়া কারণে।।
স্নান করি আসিলেন দ্রুপদ নন্দিনী।
আনন্দ বিধানে পূজে দেব দিনমণি।।
নানা দ্রব্য কৌতুকে আনিল সর্ব্ব জন।
দ্রুপদ নন্দিনী গেল করিতে রন্ধন।।
যথায় রন্ধন করে দ্রুপদ নন্দিনী।
সত্বর তথায় আসিলেন ধর্ম্মমণি।।
কহেন মধুর বাক্যে ধর্ম্মের নন্দন।
শীঘ্রগতি গুণবতী করহ রন্ধন।।
আজিকার দিন যদি যায় ভাল মতে।
তবে জানি কিছুকাল বাঁচিত জগতে।।
মহোগ্র দুর্ব্বাসা ঋষি, সর্ব্বলোকে বলে।
সংসার দহিতে পারে কোপের অনলে।।
স্নান করি অবিলম্বে আসিবে সে জন।
সংহতি করিয়া যত শিষ্য তপোধন।।
স্বচ্ছন্দ বিধানে যদি পায় অন্ন পান।
তবে সে হইবে সবাকার পরিত্রাণ।।
এই হেতু বড় চিন্তা হয় মোর মনে।
যা করিতে পার কৃষ্ণা আপনার গুণে।।
তোমা হতে সঙ্কটেতে সবে সদা তরি।
তুমি করিয়াছ বন হস্তিনা নগরী।।
তোমার যতেক গুণ না হয় বর্ণন।
কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা যে পাণ্ডবের ভূষণ।।
আসিয়া রাখিলে কৃষ্ণ, ছিল যত দায়।
এখন করহ তুমি উচিত যে হয়।।
কৃষ্ণা বলে, মহারাজ করি নিবেদন।
অল্প কার্য্যে এত চিন্তা কর কি কারণ।।
ধর্ম্মপথ মত যদি আমি হই সতী।
একান্ত আমার যদি ধর্ম্মে থাকে মতি।।
সূর্য্যের বচন, আর তোমার প্রসাদে।
দশ লক্ষ হৈলে ভুঞ্জাইব অপ্রমাদে।।
চিন্তা না করহ কিছু ইহার কারণ।
এই দেখ মহারাজ করি যে রন্ধন।।
যাহ শীঘ্র শিষ্য সহ আন মুনিবর।
শুনি রাজা যুধিষ্ঠির হরিষ অন্তর।।
হেথায় দুর্ব্বাসা মুনি উঠিয়া সকালে।
করিল আহ্নিক স্নান প্রভাসের জলে।।
সেই মত কৈল, যত শিষ্যের সমাজ।
হেনকালে সবে ডাকি কহে মুনিরাজ।।
সবে জান কালি যে কহিনু ধর্ম্মরাজে।
অত্যন্ত লজ্জিত আমি আছি সেই কাজে।।
চল শীঘ্র সেই স্থানে যাব সবর্ব জন।
করিব ধর্ম্মের প্রতি শান্ত আচরণ।।
এত বলি শিষ্য সহ চলে মুনিরাজ।
শুনিয়া সানন্দমতি পাণ্ডব সমাজ।।
আগুসারি কত দূর সর্ব্ব জন আসি।
সাদরে আহবইনল সশিষ্য মহাঋষি।।
অনেক করিয়া ভক্তি ভাই পঞ্চজনে।
বসাইল মৃগচর্ম্ম কুশের আসনে।।
সুশীতল জল আনি ধর্ম্মের নন্দন।
কৌতুকে করেন ধৌত মুনির চরণ।।
আনন্দ বিধানে তবে পঞ্চ সহোদরে।
সেই পাদোদক সবে মিলি ভক্তিভরে।।
পান করি বন্দনা কিরেন সবে শিরে।
তবে ধর্ম্ম নৃপবর কহে ধীরে ধীরে।।
নিশ্চয় আমারে আজি সুপ্রসন্ন বিধি।
পাইলাম আজি বিনা যত্নে রত্ননিধি।।
সুপ্রভাত হৈল মোর আজিকার নিশি।
কৃপা করি আসিলেন নিজে মহাঋষি।।
পৃথিবীরে ভাগ্যহীন ‍আমার সমান।
নহিল, না হবে, হেন করি অনুমান।।
তপস্যা করিল পূর্ব্ব পিতামহগণ।
যে কিছু আমার আর পূর্ব্ব উপার্জ্জন।।
কৃপা কর আমারে সে ফলে সর্ব্বজনে।
নহিলে অধম আমি তরি কোন্ গুণে।।
যুধিষ্ঠির মুখে শুনি এতেক বচন।
তুষ্ট হয়ে বলে তবে মহা তপোধন।।
শুন ধর্ম্মসুত যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
আপনারে না জানিয়া বহ হেন বাণী।।
তুমি ধর্ম্মবন্ত সত্যবাদী মতিমান।
পৃথিবীতে নাহি কেহ তোমার সমান।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক তুমি, ক্ষত্রিয় সুধীর।
সমুদ্র সমান অতি গুণেতে গভীর।।
অসার সংসার, এই সার মাত্র ধর্ম্ম।
তোমার হইল রাজা সহজ এ কর্ম্ম।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ মাৎসর্য্য মত্ততা।
তোমার নিকটবর্ত্তী নহিল সর্ব্বথা।।
সুখ দুঃখ শরীরের সহযোগ ধর্ম্ম।
সময়ে প্রবল হয় আপনার কর্ম্ম।।
তাহতে সন্তাপ নাহি করে জ্ঞানবান।
সাধুর জীবন মৃত্যু একই সমান।।
সাধুর গণনে রাজা তুমি অগ্রগণ্য।
পৃথিবীর লোক যত করে ধন্য ধন্য।।
তোমার বংশেতে যত মহারাজ ছিল।
ধার্ম্মিক তোমার তুল্য নহিবে নহিল।।
কহিলাম সত্য, এই লয়ে মম মন।
বসুমতী পতি যোগ্য তুমি হে রাজন।।
এ তিন ভুবনে তব পরিপূর্ণ যশ।
তোমার গুণেতে রাজা হইলাম বশ।।
কিন্তু এক কথা কহি, শুন মহারাজ।
সম্প্রতি তোমার ঠাই পাইলাম লাজ।।
কহিয়া তোমারে হেথা করিতে রন্ধন।
সন্ধ্যা হেতু প্রভাসেতে গেনু সর্ব্ব জন।।
সায়ংসন্ধ্যা জপ আদি যে কিছু আছিল।
ক্রমে ক্রমে সর্ব্বজন সমাপ্ত করিল।।
পথশ্রমে উঠিবার শক্তি কার নাই।
আলস্যেতে না পারে কেহ, এই সে কারণ।
তব স্থানে লজ্জা বড় হইল রাজন।।
ক্ষুধার্ত্ত আছয়ে সবে, করিবে ভোজন।
স্নান করি গিয়া, যদি হইল রন্ধন।।
ধর্ম্ম বলে, কালি মম দুরদৃষ্ট ছিল।
সে কারণে সবাকার আলস্য হইল।।
হইল আমার যদি সুকর্ম্মের লেশ।
তবে মহামুনি আসি করিলে প্রবেশ।।
দেবের দুর্ল্লভ হয় তর আগমন।
অল্প ভাগ্যে এ সব না হয় কদাচন।।
মম শক্তি অনুরূপ অন্ন জল স্থল।
তোমার প্রসাদে মুনি প্রস্তুত সকল।।
এত বলি মহানন্দে উঠি ধর্ম্মপতি।
নিকটে ডাকেন ভীমার্জ্জুন মহামতি।।
আজ্ঞা দেন ধর্ম্মসুত করিবারে স্থান।
শ্রুতমাত্র দুই ভাই হৈল সাবধান।।
নানা দিকে স্থান করি দিল অন্ন জল।
নিযুক্ত করিল তাহে রক্ষক সকল।।
আনন্দ বিধানে তবে ভাই দুই জনে।
শীঘ্রগতি জানাইল ধর্ম্মের নন্দনে।।
ধর্ম্ম বলে, অবধান কর মুনিরাজ।
অতঃপর বিলম্বেতে নাহি কিছু কাজ।।
হইবে রৌদ্রের তেজ হলে অতি বেলা।
বিধাতা নিযুক্ত করিলেন বৃক্ষতলা।।
মুনি বলে, যুধিষ্ঠির তুমি সাধুজন।
অট্টালিকা হৈতে ভাল তোমার আশ্রম।।
কদর্য্য স্থানেতে যদি সাধুজন রয়।
স্বর্গের সমান তাহা, বেদে হেন কয়।।
এত বলি মহানন্দে উঠি মুনিবর।
আনন্দ বিধানে বসে সহ শিষ্যবর।।
বসিলেন মুনিগণ যথাযোগ্য স্থান।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই হরিষ বিধান।।
অন্ন পরিবেশনাদি করে সবে আনি।
বাটিয়া ব্যঞ্জন অন্ন দেন যাজ্ঞসেনী।।
সবে অতি শীঘ্রহস্ত ভাই পঞ্চ জন।
যেই তাহা চাহে, তাহা দেন সেইক্ষণ।।
অপরূপ দেখ তার দৈবের করণ।
একবার একদ্রব্য করয়ে রন্ধন।।
আপনার ইচ্ছাবশে যত করে ব্যয়।
সূর্য্য অনুগ্রহে পুনঃ পরিপূর্ণ হয়।।
স্থানে স্থানে বসিলেক ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।
ভোজন করেন সবে বড় কুতূহলী।।
না জানি খায় বা কত, দেয় কত আনি।
খাও খাও বলে সবে, এই মাত্র শুনি।।
অবিলম্বে তাহা পায় যাহা অভিলাষী।
ভোজন করিল দশ সহস্র তপস্বী।।
অনন্তরে উঠি সবে করে আচমন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় সর্ব্ব জন।।
দুর্ব্বাসা বলেন, রাজা তুমি ভাগ্যবান।
নহিল নহিব আর তোমার সমান।।
এমন প্রকার যদি পাই বনবাস।
তবে আর কিবা কার্য্য স্বর্গে অভিলাষ।।
তোমার ভ্রাতারা সবে মহা শুণবান।
দ্রুপদ নন্দিনী হয় লক্ষ্মীর সমান।।
ভোজনে যেমন তৃপ্ত হইলাম আমি।
এইমত নিরন্তর হবে তুষ্ট তুমি।।
কদাচিৎ চিন্তা কিছু না করিহ মনে।
খণ্ডিবে তোমার দুঃখ অতি অল্প দিনে।।
তোমারে দিলেক দুঃখ যাহার মন্ত্রণা।
মজিবে তাহার বংশ পাইয়া যন্ত্রণা।।
কহিলাম ধর্ম্মপুত্র, মিথ্যা নহে বাণী।
দ্রৌপদী দেখহ এই লক্ষ্মী-স্বরূপিণী।।
বিদায় করহ শীঘ্র, যাই তপোবন।
শুনিয়া কহেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
সফল এ জন্ম কর্ম্ম মানিনু আপনি।
যাহে এত কৃপা করে কৃপাসিন্ধু মুনি।।
মম এই নিবেদন তোমার অগ্রেতে।
কদাচিৎ বিচলিত নহি সত্যপথে।।
দুর্ব্বাসা বলেন, রাজা তুমি পুণ্যবান।
পৃথিবীতে নাহি আর তোমার সমান।।
সত্য করি কহি কথা, শুন দিয়া মন।
যবে গিয়াছিনু আমি হস্তিনা ভুবন।।
সেবাতে করিল বশ রাজা দুর্য্যোধন।
হেথায় আসিতে মোরে কহে পুনঃ পুনঃ।।
বিনয় করিয়া মোরে পাঠাইল হেথা।
দশ দণ্ড রাত্রি পর তুমি যাবে তথা।।
মনেতে করিল সেই নিশাকালে গেলে।
অতিথি সেবিতে নারি পড়িবে জঞ্জালে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন মহামুনি।
সম্পদ বিপদ মোর দেব চক্রপাণি।।
আর এক নিবেদন শুন, মহাশয়।
তুমি যে আসিলে হেথা মোর ভাগ্যোদয়।।
তোমার চরণে যদি থাকে মোর মন।
আমারে করিতে নষ্ট নারে অন্যজন।।
এত বলি ধর্ম্মপুত্র নমস্কার কৈল।
সন্তুষ্ট হইয়া মুনি আশীর্ব্বাদ দিল।।
আর চারি ভাই তবে বন্দে মুনিরাজে।
সেই মত সম্ভাষণ করে শিষ্যমাঝে।।
সবে আশীর্ব্বাদ করি বেদ বিধিমতে।
তুষ্ট হয়ে সর্ব্বজন চলে পর্ব্ব পথে।।
আনন্দিত ভ্রাতৃসহ ধর্ম্মের কুমার।
দুর্য্যোধন পায় ক্রমে সব সমাচার।।
পরাণে কাতর দুষ্টবুদ্ধি দুরাশয়ে।
অসহ্য বজ্রের প্রায় বাজিল হৃদয়ে।।
আহারে অরুচি, চিত্ত সতত চঞ্চল।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সদা, শরীর দুর্ব্বল।।
এইরূপে দুর্য্যোধন চিন্তাকুল হয়ে।
একান্তে বসিল যত ‍পাত্রমিত্র লয়ে।।
ত্রিগর্ত্ত শকুনি কর্ণ দুঃশাসন আদি।
হেনকালে কহে রাজা কর্ণেরে সম্বোধি।।
ভারতের কথা ব্যাসদেবের রচন।
কাশীরাম রচে ছন্দে দুর্ব্বাসা পারণ।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র