অর্জুন

অর্জুন : পঞ্চ পান্ডবের মধ্যে তৃতীয় পান্ডব অর্জুন। তাকে পার্থ এবং ধনঞ্জয় নামেও ডাকা হয়। অর্জুন এর আরো বেশ কিছু নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু নাম হল –সর্বদেশ জয় করে ধন আহরণ করার জন্য তার নাম হয় ধনঞ্জয়, যুদ্ধে শক্র জয় করেন বলে তার নাম বিজয়, কৃষ্ণের নামান্তর বলে তার নাম অরিমর্দন, কপিকেতন, কপিধ্বজ, ইন্দ্রদত্ত কিরীটির জন্য কিরীটী, কৃষ্ণসখা, কৃষ্ণসারথি, কৌন্তেয়, গাণ্ডিবধন্বা, গাণ্ডিবী, নিদ্রকে জয় করেছেন বলে তিনি গুড়াকেশ, চিত্রযোধী, শক্র জয়ী বলে জিষ্ণু, তৃতীয় পাণ্ডব, ফাল্গুন নক্ষত্রযোগে জন্মের জন্য তার নাম ফাল্গুনি, বিজয়, ‍যুদ্ধে বীভিৎসতা পরিহার করেন বলে বীভৎসু, শব্দবেধী, শব্দভেদী, শুভ্রবর্ণ বলে অর্জুন শুভ্র, শ্বেতবাহ, শুভ্রাশ্ব যোজত বলে তার নাম শ্বেতবাহন, দুই হস্তেই শর সন্ধান করতে পারেন বলে সব্যসাচী, মাতার নাম পৃথা(কুন্তি) বলেই পার্থ। অর্জুন ছোট বেলা থেকেই মিতভাষী ছিলেন। কৃপাচার্য তার অস্ত্র শিক্ষাগুরু। পরবর্তীতে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে অর্জুন অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। গুরু দ্রোণ অর্জুনকে খুব ভালবাসতেন। কারণ ছোটা বেলা থেকেই অর্জুনের লক্ষ্য ভেদ ছিল নির্ভুল। গুরু দ্রোণ, অর্জুনসহ অন্যান্য পান্ডব ভ্রাতাদের এবং তার একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামাকে ধনুর্বিদ্যা চালানা শিখিয়েছেন। এদের মধ্যে সবদিক থেকে অর্জুনই শ্রেষ্ঠ ছিলেন। গুরুদক্ষিণা স্বরূপ দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করর জন্য পঞ্চপান্ডবকে আদেশ দেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দী করার জন্য মূলত: অর্জুনের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশী।

একদিন গুরুদ্রোণ শিষ্যগণকে ধর্নর্বিদ্যা পরীক্ষা করার জন্য গাছে একটি কাঠের পাখি স্থাপন করে যুধিষ্ঠিরকে বলা হয় পাখিটির শির কর্তন করার জন্য বলা হয়। বলা হয় সে কি দেখতে পাচ্ছে। যোধিষ্ঠির জানায় গাছে একটি পাখি দেখতে পাচ্ছে এবং ভূমিতে তাকেসহ ভ্রাতাদের দেখতে পাচ্ছে। একে একে দূর্যোধনসহ অন্যান্য সকলকে একই প্রশ্ন করা হয়। সকলেই যুধিষ্ঠিরের মত উত্তর দেয়। গুরুদ্রোণ তাতে অসন্তুষ্ট হন। অর্জুনকে বলা সে কি দেখতে পাচ্ছে। অর্জুন বলে শুধু পাখি দেখতে পাচ্ছে এবং পাখি অংগ নিরক্ষণ করে ধর ও দুটি চোখ দেখতে পাচ্ছে। তখন দ্রোণের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে পাখির মুন্ডু ছেদন করে। আরেক দিনের ঘটনা গুরুদ্রোণ শিষ্য সমেত গঙ্গায় স্নান করতে যান। দ্রোণকে কুমীর আক্রমণ করলে অর্জুন অলক্ষে পঞ্চবান নিক্ষেপ করে কুমীরকে খন্ড বিখন্ড করে গুরুদ্রোণকে রক্ষা করেণ। গুরু দ্রোণ অর্জুনের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ব্রহ্মশির নামক এক অমোঘ অস্ত্র প্রদান করেন। তিনি বলেন এ ব্রহ্মশির কেবল দেবতা ও রাক্ষসদের উপর প্রয়োগ করতে হবে। কদাচিৎ মানুষের উপর প্রয়োগ না করার জন্য নিষেধ করেন।

সে সময়ে তার মত এমন ধনূর্বিদ দ্বিতীয়টি আর ছিল না। অর্জুন গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে তার কাছ থেকে চাক্ষুসী বিদ্যা লাভ করেন। এ বিদ্যার দ্বারা সমস্ত কিছু দর্শন করা যায়। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হতে চক্রমধ্যে মৎস্য বিদ্ধ করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন। মায়ের ভুল আজ্ঞা পালন করতে যেয়ে ব্যাসদেবে বিধান মতে পাঁচ ভ্রাতা দ্রৌপদীকে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করেন। নারদ মুনির পরামর্শে পাঁচ ভ্রাতা একটি নিয়ম করে দ্রৌপদীর সাথে বসবাস করতে থাকেন। যখন যে ভ্রাতা দ্রৌপদীর সাথে অবস্থান করবে তখন কোন ভ্রাতা সেখানে অবস্থান করতে পারবে না। এর বত্যয় ঘটলে ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করে বার বছর বনবাসী হতে হবে। একবার ভুল করে অর্জুনকে বার বছর বনবাসী হতে হয়। বার বছর বনবাসী থাকা অবস্থায় পরশুরামের নিকট হতে অর্জুন অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। দুর্যোধন সপরিবারে দ্বৈতবনস্থিত সরোবরে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দ্বারা নিগৃহীত হলে অর্জুন তাকে উদ্ধার করেন। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করলে অর্জুন ও ভীম মিলে জয়দ্রথকে শাস্তি দেন। অজ্ঞাতবাসের শেষের দিকে দুর্যোধন বিরাটরাজের গোধন হরণ করলে অর্জুন কৌরব সেনাদের পরাজিত করে গোধন ফিরিয়ে আনেন।

অর্জুন দ্রৌপদী ছাড়াও কৌরব্য নাগকন্যা উলূপীকে বিবাহ করেন। তার গর্ভে ইরাবান নামে এক পুত্র হয়। পরে মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিঙ্গদাকে বিবাহ করেন। তার গর্ভে বভ্রুবাহন নামে এক পুত্র সন্তান হয়(তার হাতেই অর্জুনের মৃত্যু হয়ে অভিশাপ মুক্তি হন)। অর্জুনের বোন সুভদ্রাকে বিবাহ করেন। সুভদ্রার গর্ভেই বীর অভিমন্যূর জন্ম হয়।

দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে পান্ডবরা যখন বনবাসী তখন যুধিষ্ঠির অর্জুনকে ইন্দ্রলোকে ইন্দ্রের কাছে পাঠান দিব্যাস্ত্র লাভের জন্য। ইন্দ্র অর্জুনকে মহাদেবের আরাধনা করার জন্য বলেন। অর্জুন মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে পাশুপত নাম ভয়ংকর অস্ত্র লাভ করেন। ইন্দ্রলোকে থাকাকালে ইন্দ্রসখা চিত্রসেন তাকে গীত ও নৃত্যকলায় পারদর্শী করে তুলেন। তথায় অর্জুন উর্বশীর প্রেম প্রত্যাখান করেন। অপমানিত উর্বশী অর্জুনকে নর্তকরুপে স্ত্রীলোকদের মধ্যে নপুংসক হয়ে থাকার অভিশাপ দেন। পরে অবশ্য এ অভিশাপই আর্শিবাদ হয়ে দাঁড়ায় যখন অর্জুন বৃহন্নলা সেজে বিরাটরাজের কন্যা উত্তরাকে নৃত্য ও গীত শিক্ষা দিতেন।

মহাভারতের এক অন্যন্য চরিত্র অর্জুন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের বীরত্ব অসামান্য। যুদ্ধ কৌশল, ধনুর্বিদ্যা চালনা তাকে অতি উচ্চমাত্রায় স্থান দিয়েছে। তাছাড়া পান্ডবরা যখন বিপদে পড়েছে তখন অর্জুনই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। অর্জুনের হাতেই ভগদত্ত, জয়দ্রথ, দ্রোণাচার্য, কর্ণ-এর মত মহা ধনুর্ধারীকে নিহত হতে হয়েছে। পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুনই শরশয্যায় শায়িত করেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। যদুবংশ ধ্বংস হওয়ার পর অর্জুন দ্বারকার নারীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসার পথে দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পর অর্জুন তার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে দস্যূদের তিনি বাঁধা দিতে পারেননি। পান্ডবগণ পরীক্ষিতকে রাজা করে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন। অগ্নিদেবের পরামর্শে অর্জুন তার গান্ডীব-ধনু ও অক্ষয় তূণ দুটি লোহিত সাগরে নিক্ষেপ করেন। যাত্রাপথে হিমালয়ের পাদদেশে দ্রৌপদী, নকুল ও সহদেবের প্রয়াণের পর অর্জুনের প্রয়াণ হয়। একদিনে কৌরবসেনা নিহত করার প্রতিজ্ঞা করে তিনি তা রক্ষা করতে পারেননি এবং অন্যান্য ধনুর্বিদের অবজ্ঞা করার কারণেই তার শক্তির পতন হয়।
সূত্র : মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক গ্রন্থ।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র