মহাভারত-আদিপর্ব-৫৭-৬১

৫৭. বিদুরের জন্ম বিবরণ
জন্মেজয় বলে, মুনি কহ বিবরণ।
যত আসি জন্ম নিল কিসের কারণ।।
মুনি বলে, মাণ্ডব্য নামেতে মুনিবর।
সত্যবন্ত ধর্ম্মশীল তপেতে তৎপর।।
বহুকাল তপ করে বৃক্ষমূলে বসি।
ঊর্দ্ধবাহু মৌনব্রতী সদা উপবাসী।।
হেনমতে বহুকাল আছে মুনিবর।
দৈবে এক দিন তথা নগর ভিতর।।
চুরি করি নগরেতে চোরগণ যায়।
নগর-রক্ষকগণ পাছে পাছে ধায়।।
পলাইতে নাহি পারে যত চোগণ।
মুনির আশ্রমে প্রবেশিল সর্ব্বজন।।
নানাদ্রব্য নগরেতে যে করিল চুরি।
মুনির আশ্রমেতে রাখিল সব পূরি।।
তার পাছে এল যত রাজচরগণ।
মুনিরে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল ততক্ষণ।।
এই পথে আগে আগে চোরগণ এল।
দেখিয়াছ মহাশয় কোন্ পথে গেল।।
কিছু না বলিল মুনি ছিল মৌনব্রতে।
হেনকালে দ্রব্য দেখে সেই আশ্রমেতে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে তথা দেখে চোরগণ।
চোরগণে ধরি তবে করিল বন্ধন।।
রাজ-চরগণ তবে করিল বিচার।
জানিল সকল কর্ম্ম এই বামনার্।।
লোকেরে বঞ্চনা করি তপের আরম্ভ।
ইহারে বন্ধন কর না কর বিলম্ব।।
চোরগণ সহিত বান্ধিয়া নিল তাঁরে।
চোর ধরিলাম বলি জানায় রাজারে।।
রাজা দিল আজ্ঞা, শূলে দেহ সর্ব্বজনে।
নগর-বাহিরে শূলে দিল ততক্ষণে।।
মাণ্ডব্যেরে শূলে ছিল চোরের সহিতে।
বহুদিন আছে মুনি বসিয়া শূলেতে।।
একদিন মুনিগণ দেখিল তাঁহারে।
দেখিয়া বিষম চিন্তা হৈল সবাকারে।।
মুনিগণ মিলি তবে সে শূল ধরিল।
অনেক যতনে উপাড়িতে না পারিল।।
জিজ্ঞাসিল মুনিগণ মাণ্ডব্যের প্রতি।
কোন্ পাপে মুনি তব এতেক দুর্গতি।।
মাণ্ডব্য বলিল, আমি বহু পাপকারী।
কোন্ পাপে হেন শাস্তি, বলিতে না পারি।।
মুনিগণ কথা কহে, শুনিল ভূপতি।
শূলেতে আছয়ে মুনি, রাজা ভীত অতি।।
মন্ত্রী সহ তথা আইলেন শীঘ্রগতি।
অশেষ-বিশেষে মুনিবরে করে স্তুতি।।
না জানিয়া কর্ম্ম হেন করিনু দুষ্কর।
অধম দেখিয়া মোরে ক্ষম মুনিবর।।
রাজা তাঁরে নানাবিধ করিল বিনয়।
দয়া করি মুনিরাজ হইল সদয়।।
তবে নরপতি সেই শূল উপাড়িল।
মুনি-অঙ্গ হৈতে শূল কাড়িতে নারিল।।
অনেক যতন কৈল না হৈল বাহির।
দেখিয়া বিস্ময়চিত্ত হৈল নৃপতির।।
বাহিরে যতেক ছিল কাটিয়া ফেলিল।
ভিতরে যে কিছু ছিল ভিতরে রহিল।।
তথাপিহ দুঃখ মন নাহিক মুনির।
নাহিক বেদনা চিত্তে প্রফুল্ল শরীর।।
মুনিগর্ভে যুক্ত শূল লোকে অসম্ভ্যাব্য।
সেই হৈতে নাম হইল অণীমাণ্ডব্য।।
একদিন মুনিবর ভাবিল অন্তরে।
কোন্ পাপে ধর্ম্ম শাস্তি দিলেন আমারে।।
ধর্ম্মস্থানে ইহা হেতু জানিতে যুয়ায়।
কোন্ পাপে হেন শাস্তি করিল আমায়।।
তবে মুনিবর গেল ধর্ম্মের সদন।
কহিল তাঁহারে সব নিজ বিবরণ।।
কহ ধর্ম্মরাজ মোরে কারণ ইহার।
কোন্ দোষে হেন গতি করিলে আমার।।
ধর্ম্মরাজ বলে, তুমি বালক-বয়সে।
বালক সহিত ছিলা বাল্যক্রীড়া-রসে।।
একদিন ক্ষুদ্র এক পতঙ্গ ধরিলা।
ঈষীকাতে তার গুহ্যে তুমি শূল দিলা।।
তাহার উচিত শাস্তি পাইলে আপনি।
যাহা করি তাহা ভুঞ্জি কহে বেদবাণী।।
এত শুনি মহাক্রোধে বলে তপোধন।
মম তপোবল আমি দেখাই এখন।।
অল্প দোষে হেন শাস্তি, এ তব বিচার।
তাহাতে বালক-বুদ্ধি, কি জ্ঞান আমার।।
বাল্যকালে অল্প দোষে অন্যায় তোমার।
এমত করিলে তবে মজিবে সংসার।।
এই হেতু নরলোকে শূদ্রযোনি মাঝ।
অবশ্য লভিবে জন্ম শুন ধর্ম্মরাজ।।
অদ্যাবধি আমি এই দণ্ডের কারণ।
করিতেছি এইরূপ নিয়ম স্থাপন।।
পাঁচ বর্ষ পর্য্যন্ত যতেক করে পাপ।
তোমার সদনে তার নাহিক সন্তাপ।।
এত বলি মুনিরাজ চলিল আশ্রম।
তাঁর শাপে শূদ্রযোনি পাইলেন যম।।
পরম পণ্ডিত, বুদ্ধি ধর্ম্মের আচার।
কুরুতে বিদুর-রূপে যম-অবতার।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম কহে সাধু পিয়ে কর্ণ ভরি।।
৫৮. ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের বিবাহ বিবরণ
হেনমতে কুরুবংশে তিন পুত্র হৈল।
অহর্নিশি নানা দান, নানা যজ্ঞ কৈল।।
তিন পুত্রে ভীষ্ম বীর করেন পালন।
নানা-শস্ত্র-শাস্ত্র-বিদ্যা করান পঠন।।
কতদিনে দেখি সবে যৌবন সময়।
বিবাহ কারণ চিন্তে গঙ্গার তনয়।।
যদুবংশে সুবল নামেতে নৃপমণি।
গান্ধারী-নামেতে কন্যা তাঁহার নন্দিনী।।
ভগবানে আরাধিয়া কন্যা পায় বর।
একশত পুত্র হবে মতা-বলধর।।
বার্ত্তা পেয়ে ভীষ্মবীর দূত পাঠাইল।
সুবল-রাজারে দূত সকল কহিল।।
বিচিত্রবীর্য্যের পুত্র ধৃতরাষ্ট্র নাম।
কুরুবংশে বিখ্যাত, ভুবনে অনুপাম।।
তাঁর হেতু বরিবারে তোমার কুমারী।
ভীষ্মবীর পাঠাইল মোরে শীঘ্র করি।।
শুনিয়া গান্ধার-রাজ ভাবে মনে মনে।
কুরুকুল মহাবংশ বিখ্যাত ভুবনে।।
সকল সম্পন্ন দেখি, অন্ধমাত্র বর।
না দিলে কুপিত হবে ভীষ্ম কুরুবর।।
এতেক বিচার করি গান্ধার রাজন।
বিবাহের দ্রব্য করিলেন আয়োজন।।
হস্তী হয় রথ রত্ন শকটে পূরিয়া।
দাস দাসী গো মহিষ বিপুরল করিয়া।।
শকুনিরে সঙ্গে দিল বিপুল ব্রাহ্মণ।
চতুর্দ্দোলে কন্যা দিল করিয়া সাজন।।
গান্ধারী শুনিল, অন্ধ-বরে সমর্পিল।
আপন স্বকর্ম্ম ভাবি চিত্তে ক্ষমা দিল।।
শুক্ল পট্টবস্ত্র দেবী শতপুর করি।
আপন নয়ন-যুগ্ম বান্ধিল সুন্দরী।।
পতি-গতি অনুসারি মুদিল নয়ন।
পতিব্রতা গান্ধারী যে জগতে ঘোষণ।।
শকুনি যে চলিল ভগিনীর সংহতি।
হস্তিনা-নগরে উত্তরিল শীঘ্রগতি।।
ধৃতরাষ্ট্রে সমর্পিল ভগিনী-রতন।
নানা রত্ন-অলঙ্কারে করিয়া ভূষণ।।
হস্তী অশ্ব রথ রত্ন করি বহু দান।
শকুনি আপন দেশে করিল পয়াণ।।
জ্যেষ্ঠের বিবাহ দিয়া গঙ্গার নন্দন।
পাণ্ডুর বিবাহ হেতু সচিন্তিত মন।।
শূর নামে যাদব কৃষ্ণের পিতামহ।
কুন্তীভোজ-নৃপতিরে বড় অনুগ্রহ।।
পিতৃষ্বসা পুত্র কুন্তে অপুত্রক দেখি।
পালিবারে দিল কন্যা পৃথা শশীমুখী।।
পৃথারে আনিয়া বলে কুন্তি-নরপতি।
অতিথি-শুশ্রুষা তুমি কর গুণবতী।।
পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে কন্যা পূজে অতিথিরে।
কতকালে আইল দুর্ব্বাসা সেই ঘরে।।
মুনিরাজে দেখি কন্যা পাদ্য-অর্ঘ্য দিল।
আপনার হস্তে দুই পদ প্রক্ষালিল।।
রত্নময় খাটে তবে করায় শয়ন।
মিষ্টান্ন পক্কান্ন দিয়া করায় ভোজন।।
করযোড় করি কুন্তী মুনি-আগে রয়।
দেখিয়া সন্তুষ্ট হৈল মুনি মহাশয়।।
তুষ্ট হৈয়া বলিল দুর্ব্বাসা মহামুনি।
এক মন্ত্র দিব তোমা, লহ সুবদানী।।
মন্ত্র জপি যেই দেবে করিবে স্মরণ।
তোমার অগ্রেতে সে আসিবে ততক্ষণ।।
এত বলি মন্ত্র দিয়া গেল মুনিবর।
মন্ত্র পেয়ে পৃথা দেবী হরিষ অন্তর।।
পরীক্ষা করিতে মন্ত্র ভোজের নন্দিনী।
মন্ত্র জপি স্মরণ করিল দিনমণি।।
পৃথার স্মরণে তথা এল দিনকর।
সূর্য্য দেখি পৃথা হৈল বিরস-অন্তর।।
করযোড় করি কুন্তী প্রণাম করিল।
সবিনয়ে পৃথাদেবী বলিতে লাগিল।।
দুর্ব্বাসার মন্ত্র আমি পরীক্ষা কারণ।
শেষ না ভাবিয়া করি তোমারে স্মরণ।।
অপরাধ করিলাম অজ্ঞানে মোহিত।
বামাজাতি সদা দোষ ক্ষমিতে উচিত।।
সূর্য্য বলে, ব্যর্থ নহে মুনির বচন।
ব্যর্থ নহে কন্যা কভু মম আগমন।।
প্রথম লইয়া মন্ত্র ডাকিলা আমারে।
তব মন্ত্র ব্যর্থ হবে না ভজিলে মোরে।।
পৃথা বলে দেখ মম শৈশব বয়স।
করিলে কুৎসিত কর্ম্ম হবে অপযশ।।
দিনকর বলে, ভয় না করিহ মনে।
মোর হেতু দোষ তব না হবে ভুবনে।।
প্রবোধিয়া পৃথারে সে অনেক প্রকার।
বর দিয়া গেল সূর্য্য নিজ স্থানে তার।।
সূর্য্য-বরে কুন্তী-গর্ভে হইল নন্দন।
দেখিয়া ভোজের কন্যা সচিন্তিত মন।।
অকুমারী কন্যা আমি বিবাহ না হয়।
তাহে গর্ভ অসম্ভব লোক-লাজ ভয়।।
বয়সে বালিকা তাহে গর্ভ উদরেতে।
বেদনা যাতনা নারি প্রসব হইতে।।
এত ভাবি স্মরিলেন দেব দিননাথে।
পুত্র প্রসবিল কুন্তি কর্ণ-রন্ধ্র-পথে।।
কর্ণমূলে জন্ম হৈল তেঁই কর্ণ নাম।
নানা অস্ত্র শিক্ষা কৈল ভৃগুরামের স্থান।।
হেনমতে কুন্তী-গর্ভে হইল নন্দন।
জন্ম হইতে অক্ষয় কবচ বিভূষণ।।
শ্রবণে কুণ্ডল শোভে সূবর্ণ মণ্ডিত।
পুত্র দেখি পৃথাদেবী হইল বিস্মিত।।
লোকে খ্যাত হবে বলি হইলা বিরস।
কুলেতে কলঙ্ক রবে, লোকে অপযশ।।
এতেক চিন্তিয়া পৃথা পুত্র লৈয়া কোলে।
তাম্রকুণ্ড করি ভাসাইয়া দিল জলে।।
এক সূত নিত্য করে যমুনায় স্নান।
ভাসি যায় তাম্রকুণ্ড দেখে বিদ্যমান।।
ধরিয়া আনিয়া দেখে সুন্দর কুমার।
আনন্দে লইয়া গেল গৃহে আপনার।।
রাধা নামে ভার্য্যা তার পরমাসুন্দরী।
অপুত্রক আছিলা, পুষিল পুত্র করি।।
বসুসেন নাম তবে রাখিল তাহার।
দিনে দিনে বাড়ে যেন চন্দ্রের আকার।।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ হৈল মহাবীর।
অহর্নিশি আরাধন করয়ে মিহির।।
জিতেন্দ্রিয় মহাবীর ব্রতে অনুরত।
ব্রাহ্মণেরে দান বীর দেয় অবিরত।।
যেই যাহা চাহে, দিতে নাহি করে আন।
প্রাণ কেহ নাহি চায়, তাই রহে প্রাণ।।
তাহারে দেখিয়া সাধু দেব পুরন্দর।
পুত্র হিতে ধরিয়া ব্রাহ্মণ কলেবর।।
কুণ্ডল কবচ দান মাগিল তাহারে।
ততক্ষণে অঙ্গ কাটি দিল পুরন্দরে।।
সন্তুষ্ট হইয়া ইন্দ্র বলে লহ বর।
একাঘ্নী মাগিয়া নিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
একাঘ্নী নামেতে অস্ত্র জানে ত্রিভুবন।
যাহারে প্রহারে তার অবশ্য মরণ।।
নিজ হস্তে কর্ণ কাটি কুণ্ডল অর্পিল।
সেই হেতু কর্ণ নাম ইন্দ্র তাঁরে দিল।।
ভোজের নন্দিনী পৃথা রহে পিত্রালয়ে।
স্বয়ম্বর করিল সে যৌবন সময়ে।।
নিমন্ত্রিয়া আনাইল যত রাজগণে।
আইল সকল রাজা সেই নিমন্ত্রণে।।
বসিল সকল রাজা যা যেই স্থান।
মধ্যেতে বসিল পাণ্ডু ইন্দ্রের সমান।।
গ্রহগণ মধ্যে যেন শোভে দিনকর।
পাণ্ডুতেজে আচ্ছাদিল যত নৃপবর।।
পাণ্ডুরে দেখিয়া পৃথা উল্লসিত-মন।
গলে মাল্য দিয়া তারে করিল বরণ।।
ভোজরাজ, পাণ্ডুর করিল সুসম্মান।
নানারত্নে ভূষিয়া করিল কন্যাদান।।
রাজগণ চলি গেল যে যার নগরে।
কুন্তী লৈয়া পাণ্ডু এল আপনার ঘরে।।
পুরন্দর-কোলে যেন পুলোমা-নন্দিনী।
রজনীপতির কোলে শোভিতা রোহিণী।।
হস্তিনা-নগরে লোক হৈল হরষিত।
স্থানে স্থানে নগরে হৈল নিত্য-গীত।।
তবে কতদিনে পাণ্ডুর পুত্র না হৈল।
পুনঃ পাণ্ডুর বিভা হেতু ভীষ্ম চিন্তিল।।
হেনকালে শুনে শল্য নামে মদ্রেশ্বর।
পৃথিবীতে বিখ্যাত অতুল গুণধর।।
তাহার ভগিনী আছে পরমা সুন্দরী।
বার্ত্তা পেয়ে গেল ভীষ্ম তাহার নগরী।।
শল্য রাজা শুনিল ভীষ্মের আগমন।
আগুসরি নিজ গৃহে নিল ততক্ষণ।।
বিধিমতে গঙ্গাপুত্রে পূজিল তখন।
জিজ্ঞাসিল কোন্ কার্য্যে হেথা আগমন।।
ভীষ্ম বলে, তুমি রাজা বিখ্যাত সংসার।
বন্ধুত্ব করিতে ইচ্ছা হয়েছে আমার।।
তোমার ভগিনী আছে কহে সর্ব্বজন।
ভ্রাতার নন্দনে মম কর সমর্পণ।।
হাসিয়া যে বলে শল্য বিধি মিলাইল।
কে জানে এমন ভাগ্য আমার যে ছিল।।
একমাত্র নিবেদন আছয়ে আমার।
পূর্ব্বাপর আমার আছয়ে কুলাচার।।
ঠেলিতে না পারি, কৈল পিতামহ পিতা।
তোমারে কহিতে যোগ্য নহে সেই কথা।।
তব স্থানে ধন লই, নহি যে নির্ধন।
কেবল চাহি যে কুল ধর্ম্মের রক্ষণ।।
শল্যের বচনে ভীষ্ম বুঝিল কারণ।
কুল-ধর্ম্ম-রক্ষা হেতু কর্ত্তব্য যতন।।
ইন্দ্র প্রতি প্রজাপতি বলিল বচন।
দেবকর্ম্ম কুলধর্ম্ম না কর লঙ্ঘন।।
আপন কুলের ধর্ম্ম করিবে পালন।
নাহিক তাহাতে দোষ, বেদের বচন।।
এত বলি ভীষ্ম দিল অমূল্য রতন।
শত কুম্ভ পূর্ণ করি দিলেন কাঞ্চন।।
অশ্ব রথ গজ দিল বিচিত্র বসন।
ধনলাভে প্রীত হৈল মদ্রের নন্দন।।
নানারত্নে ভূষিয়া ভগিনী আনি দিল।
মাদ্রী লৈয়া ভীষ্মদেব নিজ দেশে গেল।।
পাণ্ডুর বিবাহে মহা উৎসব করিল।
দেখিয়া মাদ্রীর রূপ পাণ্ডু হৃষ্ট হৈল।।
যুগল বনিতা পাণ্ডু দেখিয়া সমান।
দুই ভার্য্যা সব ভাব নাহি ভেদ জ্ঞান।।
তবে পাণ্ডু কত দিনে সবার অগ্রেতে।
প্রতিজ্ঞা করিল দিগ্ বিজয় করিতে।।
পদাতি রথাশ্ব গজ চতুরঙ্গ দলে।
সাজিয়া পশ্চিম দিকে গেল মহাবলে।।
দশার্ণ-দেশের রাজা পূর্ব্ব অপরাধী।
তাহারে জিনিয়া পাইল বহু রত্ন নিধি।।
মগধ-রাজ্যেতে জিনি মদ্ররথ রাজা।
মিথিলা ঈশ্বর কাশীকৌঞ্চ মহাতেজা।।
জমদগ্নি-সম তেজে পাণ্ডু মহামতি।
একে একে জিনিল সকল নরপতি।।
তবে ত সকল রাজা একত্র হইয়া।
পাণ্ডুর সহিত যুদ্ধ করিল আসিয়া।।
না পারিয়া ভঙ্গ দিল যত নৃপবর।
পাণ্ডুরে পূজিয়া তবে দেয় রাজকর।।
হস্তী ঘোড়া রথ রথী বিবিধ রতন।
আর কত ধন দিল, না যায় গণন।।
রাজগণ জিনি পাণ্ডু লয়ে রাজকর।
আপনার রাজ্যে গেল হস্তিনা-নগর।।
পাণ্ডুর মহিমা যশে পৃথিবী পূরিল।
পূর্ব্বেতে ভরত রাজা যে কর্ম্ম করিল।।
পাণ্ডু প্রতি বড় প্রীতি গঙ্গার নন্দন।
আশীর্ব্বাদ করি করে মস্তক চুম্বন।।
তবে একে একে পাণ্ডু সবারে বন্দিল।
যতেক আনিল দ্রব্য ধৃতরাষ্ট্রে দিল।।
ধন পাইয়া ধৃতরাষ্ট্র করিল সম্মান।
নানা যজ্ঞ করিয়া করিল বহু দান।।
বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র কৈল।
হস্তী হয় গো কাঞ্চন ভূমি দান দিল।।
ধৃতরাষ্ট্রে দিয়া পাণ্ডু রাজ্যে-অধিকার।
মৃগয়াতে রত সদা, বনেতে বিহার।।
কুন্তী মাদ্রী সহ রাজা সদা থাকে বনে।
যথা থাকে তথা যেন হস্তিনা ভুবনে।।
তবে কতদিনে ভীষ্ম বিদুর কারণ।
সুদেব রাজার কন্যা করিল বরণ।।
সুদেব রাজার কন্যা নামে পরাশরী।
রূপেতে নিন্দিত যত স্বর্গবিদ্যাধরী।।
মহা ধর্ম্মশীল এই বিদুর হইতে।
জন্মিল নন্দনগণ সে কন্যা-গর্ভেতে।।
পিতার সমান তারা অতি নম্র ধীর।
অসামান্য গুণশীল ধর্ম্মেতে সুস্থির।।
কুরুবংশবৃদ্ধি কথা যেই নর শুনে।
তার বংশ বৃদ্ধি হয় ব্যাসের বচনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।
৫৯. গান্ধারীর শত-পুত্র প্রসব
কহিলেন মুনি,         শুন নৃপমণি
       পূর্ব্ব-পিতামহ-কথা।
ব্যাস তপোনিধি,        পূজে নিরবধি,
       গান্ধারী সুবল-সুতা।।
তাঁর সেবাবশে,         বর দিল ব্যাসে,
       হইয়া হরষ-যুত।
মহা বলবান,          স্বামীর সমান,
       পাইবে শতেক সুত।।
পরম হরিষে,          কতেক দিবসে,
       গর্ভ ধরিল গান্ধারী।
কুড়ি মাস যায়,        প্রসব না হয়,
       চিত্তে চিন্তিত সুন্দরী।।
হেনকালে ধ্বনি,         আচম্বিতে শুনি,
       কুন্তীর হইল সুত।
শুনিয়া গান্ধারী,         আপনা পাসরি,
       হৈয়া পড়িল মূর্চ্ছিত।।
পুত্র হইলে জ্যেষ্ঠ,        রাজ্যে হবে শ্রেষ্ঠ,
       কুরুকুলে হবে রাজা।
কুন্তী ভাগ্যবতী,         পাইল সন্ততি,
       সবাই করিবে পূজা।।
আমি অভাগিনী,         পরম পাপিনী,
       কর্ম্মফল আপনার।
দ্বিবৎসর হইল,          কিছু না জন্মিল,
       পরিশ্রম মাত্র সার।।
প্রসবি যদ্যপি,          ভাবনা তথাপি,
       সহজে হইবে দাস।
হেন অনুমানে,          দৃঢ় কৈল মনে,
       গর্ভ করিব বিনাশ।।
লোহার মুদগরে,         আপন উদরে,
       নির্ঘাত করিয়া হানে।
পাই লোহাঘাত,         গর্ভ হৈল পাত,
       ধৃতরাষ্ট্র নাহি জানে।।
নাহি পদ মুণ্ড,         সবে মাংসপিণ্ড,
       গান্ধারী প্রসব হৈল।
ডাকাইয়া দাসী,         চিত্তে ঘৃণা বাসি,
       ফেলাইতে ইচ্ছা কৈল।।
জানিয়া কারণ,         মুনি দ্বৈপায়ন,
       আসি হৈল উপনীত।
বল ক্রোধ করি,        শুন গো গান্ধারী,
       এ কর্ম্ম কোন বিহিত।।
জানি সর্ব্ব ধর্ম্ম,        কর হেন কর্ম্ম,
       তোমার উচিত নহে।
হিংসা মহাক্লেশ,         অধর্ম্ম অশেষ,
       আপনা আপনি দহে।।
শুনিয়া বচন,          লজ্জিত বদন,
       কহে করযোড় করি।
তোমার বচন,          হইল লঙ্ঘন,
       এ বড় বিস্ময় হেরি।।
তুমি দিলা বর,         শতেক কুমার,
       হবে বলি আশা ছিল।
যুগল বরষে,           মহাশ্রম ক্লেশে,
       মাংসপিণ্ড জনমিল।।
বলে ব্যাস মুনি,         শুন সুবদনি,
       মোর বাক্য অন্য নয়।
দুঃখ পরিহর,           মোর বাক্য ধর,
       হইবে শত তনয়।।
শত কুম্ভ করি,          ঘৃতে তাহা পূরি,
       মাংসপিণ্ড সিঞ্চ জলে।
এত বলি মুনি,          বসিলা আপনি,
       মাংসপিণ্ড করি কোলে।।
শীতল জলেতে,           সিঞ্চিতে সিঞ্চিতে।
       যেন বিধি নিরমিল।
এক মাংসপিণ্ড,           হৈল খণ্ড খণ্ড,
       একাধিক শত হৈল।।
অঙ্গুলির পর্ব্ব,           প্রায় হৈল খর্ব্ব,
       ঘৃতকুম্ভে লৈয়া তুলে।
তবে তপোধন,           সুদৃঢ় বচন,
       গান্ধারী দেবীরে বলে।।
এই কুম্ভগণে,            রাখিবা যতনে,
       নাহি হও উতরোল।
আপন ইচ্ছায়,           জন্মিবে তনয়,
       নাহি ভাঙ্গ মোর বোল।।
এত বলি ঋষি,          হিমালয়বাসী,
       গেল হিমালয়ে চলি।
তবে কত দিনে,          হৈল দুর্য্যোধনে,
       মূর্ত্তিমন্ত যুগ কলি।।
ভীম যেই দিনে,          জন্মিল কাননে,
       সেই দিনে দুর্য্যোধন।
জনম মাত্রকে,            ঘোর শব্দে ডাকে,
       যেমন গৃধ্র গর্জ্জন।।
তার ডাক শুনি,          যেন গৃধ্রধ্বনি,
       গৃধ্রগণ সব ডাকে।
কুক্কুট শৃগাল,            ডাকে পালে পাল,
       নগর পূরিল কাকে।।
বহে তপ্ত বাত,           সঘনে নির্ঘাত,
       দশদিক যায় পড়ি।
মিহির মুদিল,            রুধির বর্ষিল,
       ঝনঝনা হর গিরি।।
এ সব চরিত,           দেখি বিপরীত,
       চিন্তিত কৌরবপতি।
ভীষ্ম মহামতি,           বিদুর প্রভৃতি,
       আনাইইল শীগ্রগতি।।
সবার অগ্রেতে            লাগিল কহিতে,
       ধৃতরাষ্ট্র গুণাধার।
শব্দ শুনা গেল,          পাণ্ডুপুত্র হৈল,
       বংশের জ্যেষ্ঠ কুমার।।
রাজা হবে সেহ,          নাহিক সন্দেহ,
       মোর মন তাহে সুখী।
মোর পুত্র হৈতে,          অতি বিপরীতে,
       বহু অমঙ্গল দেখি।।
বিধান ইহার,            করিয়া বিচার,
       কহ মোরে সর্ব্বজন।
রাজার বচন,           শুনে সর্ব্বজন,
       বিদুর কৈল তখন।।
ভারত সঙ্গীত            জগত মোহিত,
       কেবল অমৃতনিধি।
কাশীদাস কয়,           খণ্ডে যম-ভয়,
       পান কর নিরবধি।।
৬০. দুর্য্যোধনকে পরিত্যাগ করিতে বিদুরের মন্ত্রণা দান ও দুঃশলারজন্ম বিবরণ
বিদুর বলেন, অবধান মহারাজ।
যত অমঙ্গল দেখি, ভাল নহে কাজ।।
ইথে প্রায়শ্চিত্ত রাজা কিছু নাহি আর।
তবে সে মঙ্গল হয়, ত্যজ এ কুমার।।
কুলের অন্তক রাজা! এ পুত্র তোমার।
ইহাকে পালিলে দুঃখ পাইবা অপার।।
নিজ-কুল হিত যদি চিন্তহ রাজন্।
এক ঊন হৌক তবে শতেক নন্দন।।
কুলাঙ্গার এই শিশু-তোমার যে হৈল।
নিশ্চয় জানিহ, এই অধর্ম্ম জন্মিল।।
কুলের কারণ রাজা ত্যজি একজন।
কুল ত্যাগ করি রাজা গ্রামের কারণ।।
গ্রাম ত্যজি শুন রাজা জনপদ-হিতে।
পৃথিবীকে ত্যজি রাজা আপনা রাখিতে।।
হেন নীতি আছে রাজা কহে পূর্ব্বাপর।
জ্যেষ্ঠ পুত্র মারি বংশ রাখ নৃপবর।।
এতেক বচন যদি বিদুর বলিল।
পুত্রস্নেহে ধৃতরাষ্ট্র শুনি না শুনিল।।
তবে আর ঊনশত হইল নন্দন।
হেনমতে হৈল ভাই একশত জন।।
একশত পুত্র হৈল কন্যা এক গণি।
শুনি মুনিবরে জিজ্ঞাসিল নৃপমণি।।
আপনি বলিলা ব্যাসদেবের যে বরে।
একশত পুত্র হবে গান্ধারী-উদরে।।
অধিক হইল কন্যা কিসের কারণ।
ইহার বৃত্তান্ত মোরে কহ তপোধন।।
মুনি বলে, শুন তত্ত্ব শ্রীজন্মেজয়।
যখন বিভাগ করে ব্যাস মহাশয়।।
সতী পতিব্রতা দেবী সুবল-নন্দিনী।
মনেতে বাঞ্ছিল, এক কন্যা দেহ মুনি।।
শুনিয়াছি স্ত্রীলোকের কন্যায় পীরিত।
দানেতে অক্ষয় স্বর্গ আছে হেন নীত।।
শত পুত্র বর দিল ব্যাস মহামুনি।
নাহিক সন্দেহ পুত্র হইবে এখনি।।
কায়মনোবাক্যে যদি হই আমি সতী।
পতিব্রতা হই আমি পতি মোর গতি।।
ব্রাহ্মণেরে গবী দিয়া থাকি কোটি কোটি।
তবে মোর ইথে কন্যা হবে একগুটি।।
ব্রত তপ করে থাকি গুরুর সেবন।
যদি কভু পূজে থাকি দেব-দ্বিজগণ।।
গান্ধারী মানস আর বিধির সৃজন।
মাংসপিণ্ড ব্যাসদেব করিল সিঞ্চন।।
একশত এক ভাগ মাংসপিণ্ড হৈল।
দেখি মহামুনি ব্যাস গান্ধারীকে কৈল।।
আমার বচন বধূ কভু মিথ্যা নয়।
এই দেখ পাইলাম শতেক তনয়।।
একখানি অধিক যে সুবল-নন্দিনী।
তোমার মানস হৈতে হৈল একখানি।।
শুনি হরষিত হৈল সুবল-দুহিতা।
সে কারণে অধিক হইল এক সুতা।।
অন্যা ধৃতরাষ্ট্র-ভার্য্যা বৈশ্যের কুমারী।
বহু সেবা ধৃতরাষ্ট্রে করিলা সুন্দরী।।
তাহার উদরে হৈল একটি নন্দন।
যুযুৎসু বলিয়া নাম জানে সর্ব্বজন।।
হেনমতে একত্রেতে শত শহোদর।
সবে মহাবলবন্ত পরম সুন্দর।।
বিবাহ করিল সবে রাজার কুমারী।
জয়দ্রথে সমর্পিল দুঃশলা সুন্দরী।।
কৌরবের জন্মকথা কহিলাম সব।
বলি শুন পাণ্ডবের যেমত উদ্ভব।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
একমনে শুনিলে তরয়ে ভব-বারি।।
ইহার শ্রবণে যত সুখ লভে নর।
এমত নাহিক সুখ ত্রৈলোক্য-ভিতর।।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কহে রচিয়া পয়ার।
ভক্তিভরে শুনে যেন সকল সংসার।।
শুন শুন সাধু-সুধী হয়ে একমন।
অপূর্ব্ব ভারত-গাথা ব্যাসের রচন।।
৬১. মৃগরূপী ঋষিকুমারের প্রতি
পাণ্ডুর শরাঘাত ও শতশৃঙ্ঘ পর্ব্বতে অবস্থিতি
বহুকাল রহে পাণ্ডু বনের ভিতর।
সঙ্গে দুই ভার্য্যা আর কত অনুচর।।
নিরন্তর ভ্রমে পাণ্ডু মৃগ-অন্বেষণে।
পর্ব্বত-কন্দর ঘোর মহা শালবনে।।
সিংহ ব্যাঘ্র হ্স্তী খড়্গী ভল্লুক শূকর।
পাইয়া পাণ্ডুর শব্দ যায় বনান্তর।।
হেনমতে একদিন দেখে নৃপবর।
হরিণীযূথের মধ্যে মৃগ একেশ্বর।।
কিন্দম নামেতে সেই ঋষির কুমার।
মৃগরূপ ধরি করে মৃগীরে শৃঙ্গার।।
মৃগ দেখি পাণ্ডুরাজ প্রহারিল শর।
তীক্ষ্ণশরে ভেদিল ঋষির কলেবর।।
শরাঘাতে ঋষিপুত্র করে ছটফটি।
মৃগীর উপর হৈতে ভূমে পড়ে লুটি।।
ডাক দিয়া ঋষিপুত্র পাণ্ডু প্রতি বলে।
ধার্ম্মিক পণ্ডিত হৈয়া কি কর্ম্ম করিলে।।
মূর্খ দুরাচার যেই হিংসা করে পরে।
পরম শক্রকে হেন সময়ে না মারে।।
পাণ্ডু বলে, মৃগ তুমি নিন্দ কি কারণ।
ক্ষত্রধর্ম্ম মৃগ মারি পাই হে যখন।।
করিলা অগস্ত্যমুনি ভক্ষ্য মৃগগণ।
দেবঋষি-ভক্ষ্য হেতু মৃগের সৃজন।।
রিপু সম মৃগে অস্ত্র করিব প্রহার।
নীতিশাস্ত্রে কহে, হেন ক্ষত্রিয়-আচার।।
ঋষি কহে, মৃগবধ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।
রমণে বিরোধ করা মহাপাপ কর্ম্ম।।
কুরুবংশে জন্মি কর হেন অনুচিত।
রতিরস জ্ঞাত সব শাস্ত্রেতে পণ্ডিত।।
রাজা হয়ে নিজে কর হেন পাপাচার।
রাজা যদি পাপ করে মজিবে সংসার।।
ঋষির নন্দন আমি, তপের সাগর।
সকল ত্যজিয়া থাকি বনের ভিতর।।
মৃগরূপে করি আমি হরিণী রমণ।
হেনকালে তুমি মোরে করিলে নিধন।।
ব্রাহ্মণ বলিয়া তুমি না জান আমারে।
সেই হেতু ব্রহ্মবধ নহিবে তোমারে।।
মৃগদেহ মারিলে ইহাতে পাপ নয়।
এই পাপ মারিলা যে মৈথুন-সময়।।
এই হেতু শাপ আমি দিতেছি রাজন্।
মৈথুন সময়ে হবে তোমার মরণ।।
আমি যেমত অশুচিতে যাই পরলোকে।
এই মত অশুচিতে যাবে যমলোকে।।
স্বর্গেতে যাইতে শক্তি নহিবে তোমার।
কভু মিথ্যা নহিবেক বচন আমার।।
এত বলি ঋষিপুত্র ত্যজিল জীবন।
দেখিয়া পাণ্ডুর হৈল বিষণ্ণ বদন।।
শোকেতে আকুল হৈয়া করেন ক্রন্দন।
প্রদক্ষিণ করি মৃত-ঋষির নন্দন।।
ভার্য্যা সহ কান্দেন যেমন বন্ধুশোকে।
অশেষ বিশেষে রাজা নিন্দে আপনাকে।।
কেন হেন বড় কুলে হইল উদ্ভব।
আপনার কর্ম্মভোগ করে লোক সব।।
শুনিয়াছ পিতা করিলেন কদাচার।
কামলোভে অল্পকালে তাঁহার সংহার।।
তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম মম সহজে অধম।
দুষ্টবুদ্ধি দুরাচার তেঁই ব্যতিক্রম।।
রাজনীতি ধর্ম্ম কত আছয়ে সংসারে।
সব ত্যজি ভ্রমি মৃগ-বধ অনুসারে।।
সমুচিত ফল তার হৈল এতকালে।
খণ্ডন না হয়, কর্ম্ম-অনুসারে ফলে।।
আজি হৈতে ত্যজিলাম সংসার-বিষয়।
শরীর ত্যজিব তপ করিয়া নিশ্চয়।।
একাকী হইয়া পৃথ্বী করিব ভ্রমণ।
সকল ইন্দ্রিয়গণে করিব দমন।।
কুন্তী মাদ্রী প্রতি রাজা বলিছে বচন।
হস্তিনা-নগরে দোঁহে করহ গমন।।
ভীষ্ম জ্যেষ্ঠতাত আর অম্বালিকা মাতা।
সত্যবতী আই আর অন্ধরাজ ভ্রাতা।।
বিদুর প্রভৃতি যত সুহৃদ সকল।
যে দেখিলা শুনিলা কহিবা অবিকল।।
এত শুনি দুই জনে করেন ক্রন্দন।
কান্দিতে কান্দিতে কহে করুণ বচন।।
কি দোষে আমরা দোষী তোমার বচণে।
তোমা বিনা হস্তিনায় যাইব কেমনে।।
তোমা বিনা শরীর ধরিব কোন্ কাজে।
কিবা ফল পাইব থাকিয়া গৃহমাঝে।।
তোমা বিনা রাজা গতি নাহি আমাদের।
তোমার যে গতি সেই গতি দুজনের।।
তপস্যা করিব মোরা তোমার সংহতি।
তোমার সেবনে রাজা পাইব সদগতি।।
ফলাহারী হৈব করি ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ।
নানা তীর্থে স্বচ্ছন্দে ভ্রমিব তব সহ।।
হেনমতে আশ্রম আছয়ে সন্ন্যাসীতে।
ধর্ম্মপত্নী দোঁহে, দোষ নাহিক ইহাতে।।
নিশ্চয় নৃপতি যদি না লবে সংহতি।
ক্ষণেক রহিয়া যাহ শুন নরপতি।।
তোমার অগ্রেতে মোরা পশিব আগুনে।
স্বচ্ছন্দে গমন কর যেখানে সেখানে।।
অনেক বিনয় করি কান্দে দুইজন।
দেখিয়া ব্যাকুলচিত্ত হইল রাজন।।
পাণ্ডু বলে, নিশ্চয় সহিত যদি যাবে।
তোমরা অশেষ ক্লেশ অরণ্যেতে পাবে।।
গাছের বাকল পর, ত্যজহ বসন।
শিরে জটা ধর, আর ত্যজ আভরণ।।
ফল-মূলাহরী হও ত্যজ দিব্য হার।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ ত্যজ অহঙ্কার।।
স্বামীর বচন তবে শুনি দুই জন।
ততক্ষণে পরিত্যাগ করে আভরণ।।
কবরী এলায়ে কৈল শিরে জটাভার।
নৃপতির অগ্রে দিল সব অলঙ্কার।।
দেখিয়া নৃপতি মনে হইল বিস্ময়।
দোঁহার দেখিয়া বেশ বিদরে হৃদয়।।
তবে রাজা ত্যজিলেন নিজ অলঙ্কার।
করিয়া সকল ত্যাগ তপস্বী-আচার।।
রত্ন অলঙ্কার দ্বিজে করিলেন দান।
তপস্যা করিতে রাজা করেন প্রস্থান।।
অনুচরগণ যত আছিল সংহতি।
সবাকারে বলিলেন পাণ্ডু নরপতি।।
হস্তিনা-নগরে সবে করহ গমন।
সবাকারে কহিবা আমার বিবরণ।।
যত্নে প্রবোধিবে সবে মায়ের ক্রন্দনে।
ধৃতরাষ্ট্রে প্রবোধিবে মধুর বচনে।।
পাণ্ডুর বচন যত শুনি সর্ব্বজনে।
হাহাকার করি সবে করয়ে ক্রন্দন।।
সঘনে নিশ্বাস, মুখে কাতর বচন।
হস্তিনা-নগর সবে করিল গমন।।
একে একে সবারে কহিল সমাচার।
শুনি পুরলোকে সবে করে হাহাকার।।
অন্তুঃপুরে উঠিল ক্রন্দন-মহারোল।
প্রলয়কালেতে যেন সাগর-কল্লোল।।
গাঙ্গেয় বিদুর আদি আর যত জন।
পাণ্ডুর শোকেতে করে সকলে ক্রন্দন।।
শুনি ধৃতরাষ্ট্র রাজা অত্যন্ত অস্থির।
নাহি রুচে অন্ন জল না হন বাহির।।
রত্নময় পালঙ্ক ছাড়িয়া নৃপবর।
ভূমে গড়াগড়ি যায় শোকেতে কাতর।।
হেনমতে রোদন করিছে বন্ধুজন।
হেথা পাণ্ডু প্রবেশিল গহন কানন।।
চৈত্ররথ নামে বন অতি সে বিস্তার।
গন্ধর্ব্ব অপ্সরা তথা করিছে বিহার।।
সে বন ত্যজিয়া যান নৈমিষকানন।
বহু নদনদী দেশ করিয়া লঙ্ঘন।।
তিনে হিমালয়ে করিলেন আরোহণ।
তথা হৈতে চলিলেন শ্রীগন্ধমাদন।।
তথায় আছয়ে ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোবর।
মহাপুণ্য তীর্থ যাহে বাঞ্ছিত অমর।।
তাহে স্নান করিয়া গেলেন তিন জন।
শতশৃঙ্গ-পর্ব্বতে করেন আরোহণ।।
মহা উচ্চ গিরিবর দেখিতে উত্তম।
অনেক তপস্বী ঋষিগণের আশ্রম।।
পর্ব্বত পাইয়া রাজা আনন্দিত মন।
তপস্যা করেন তথা সহ ঋষিগণ।।
করেন কঠোর তপ তথা তিন জন।
দিনশেষে ফলমূল করেন ভক্ষণ।।
বরিষা আতপ শীত সহে কালধর্ম্ম।
কেবল শরীর, তিনে সার অস্থিচর্ম্ম।।
ঘোর তপ দেখিয়া বাখানে ঋষিগণ।
তপস্যাতে সিদ্ধ হইলেন তিনজন।।
স্বর্গেতে যাইতে শক্তি হৈল, হেন বাসি।
তথা হেতে গেলেন প্রণমি সব ঋষি।।
অতি উচ্চ গিরিবর পরশে গগন।
স্বর্গেতে যাইতে করিলেন আরোহণ।।
পথেতে দেখেন সব দেবতার স্থান।
নানা রত্নে বিভূষিত বিচিত্র নির্ম্মাণ।।
দেখেন বহিছে গঙ্গা মৃদুল তরঙ্গে।
দেবকন্যাগণে তথা ক্রীড়া করে রঙ্গে।।
কোন স্থানে দেখিলেন পর্ব্বত উপর।
জলধরগণে বৃষ্টি করে নিরন্তর।।
তাহার অন্তরেতে অগম্য ভূমি দেখি।
আছুক অন্যের কাজ, যেতে নারে পাখী।।
তিন জনে দেখিলেন তথা ঋষিগণ।
ডাক দিয়া উষিগণ বলেন বচন।।
কোথাকারে যাও হে তোমরা তিনজন।
অগম্য বিষম ভূমি, যাহ কি কারণ।।
তোমাদের কোথা ধাম কহিবে নিশ্চয়।
কিবা নাম কোথা হৈতে আইলে হেথায়।।
ঋষিগণ-বচনে বলেন নরপতি।
পাণ্ডু নামে আমি, কুরুবংশেতে উৎপত্তি।।
অপুত্রক হইলাম নিজ কর্ম্মদোষে।
সংসার ত্যজিয়া আমি যাই স্বর্গবাসে।।
শুন শুন মহামুনি করি নিবেদন।
নিশ্চয় কহিব আমি তব বিদ্যমান।।
মর্ত্তেতে মানব জন্ম হইল আমার।
ঋণ হইতে যে না পাইনু নিস্তার।।
সংসারের মধ্যে ঋণ শুন মুনিবর।
বিস্তারিয়া সব কথা কহি বরাবর।।
চারি ঋণ লইয়া মনুষ্য দেহ ধরে।
ঋণ হৈতে পার হৈলে মুক্ত কলেবরে।।
যজ্ঞ করি দেব-ঋণে হইবেক পার।
মুনিগণে তুষিবেক করি ব্রতাচার।।
পিতৃ-ঋণে মুক্ত হয় পিতৃপিণ্ড দিয়া।
মনুষ্যে হইবে পার অতিথি ভুঞ্জিয়া।।
ঋণে পার হইলাম আমি তিন স্থানে।
কিন্তু না হইনু পার পিতৃগণ-ঋণে।।
আপন কুকর্ম্ম ফল না হয় খণ্ডন।
শরীর ত্যজিতে আমি যাই সে কারণ।।
ঋষিগণ বলে, তুমি পণ্ডিত সুজন।
ধার্ম্মিক সুবুদ্ধি সর্ব্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ।।
পুত্রহীন জন স্বর্গে যাইতে না পারে ।
দ্বারপালগণ তথা দ্বাররক্ষা করে।।
অকারণে তথাকারে যাও নরপতি।
কদাচিৎ না পাইবা স্বর্গেতে বসতি।।
শুন ওহে মহারাজ আমার বচন।
মর্ত্ত্যেতে জন্মিলে হয়া অবশ্য মরণ।।
পৃথিবীতে জন্ম হয় মহাপুণ্য-ফলে।
তাহার বৃত্তান্ত আমি কহিব সকলে।।
পৃথিবীতে বহু দান পুণ্য লোক করে।
বহু তপজপ করে সংসার-ভিতরে।।
পুত্রহীন হৈলে স্বর্গে যাইতে না পারে।
নীতিশাস্ত্রে হেন কহে বেদের বিচারে।।
স্বর্গেতে যতেক বৈসে দেব সিদ্ধঋষি।
মর্ত্ত্যে পুত্র জন্মাইয়া সবে স্বর্গবাসী।।
এত শুনি বলে রাজা বিনয়-বচন।
কি করিব, মোরে আজ্ঞা কর তপোধন।।
ইহার উপায় মোরে কহ মুনিবর।
অবশ্য পালিব আমি করি অঙ্গীকার।।
মুনিগণ বলে, রাজা থাক এই স্থানে।
হইবেক পুত্র তব দেব-বরদানে।।
দিব্যচক্ষে মোরা সব করি দরশন।
মহাবীর্যবন্ত হবে তব পুত্রগণ।।
ঋষিগণ-বচনে নিবর্ত্তে নরপতি।
শতশৃঙ্গ পর্ব্বতে করিলেন বসতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র