০৬. কির্ম্মীর বধোপাখ্যানধৃতরাষ্ট্র কহে, কহ বিদুর সুজন।এত শুনি উঠি গেল দুষ্ট দুর্য্যোধন।ক্ষত্তা বলে, শুন রাজা কির্ম্মীর নিধন।।যে কর্ম্ম করিল রাজা বীর বৃকোদর।করিতে না পারে কেহ সুরাসুর নর।।হেথা হতে পাণ্ডবেরা যবে গেল বন।পাইল তৃতীয় দিনে কাম্যক কানন।।সে বনেতে নিবসে কির্ম্মীর নিশাচর।দেবের অবধ্য পরাক্রমে পুরন্দর।।নিশাকালে পাণ্ডবেরা যান কাম্যবন।ধাইল মনুষ্য দেখি রাক্ষস দুর্জ্জন।।দুই হস্তে আগুলিল পাণ্ডবের পথ।হনুমান পূর্ব্বে যেন মৈনাক পর্ব্বত।।রাক্ষসী মায়া কৈল ঘোর অন্ধকার।মুখ মেলি আসে যেন গিলিতে সংসার।।নাকের নিশ্বাসে উড়ি যায় তরুগণ।চতুর্দ্দিকে পশু ধায় শুনিয়া গর্জ্জন।।পাণ্ডব দেখিল, আসে রাক্ষস দুর্জ্জন।ভয়েতে দ্রৌপদী দেবী মুদিল নয়ন।।ব্যস্ত হয়ে পঞ্চজন মধ্যে লুকাইল।হস্তে ধরি বৃকোদর আশ্বাস করিল।।জানিয়া রাক্ষসী মায়া ধৌম্য তপোধন।রক্ষোঘ্ন মন্ত্রেতে মায়া কৈল নিবারণ।।অন্ধকার গেল, দৃষ্ট হৈল নিশাচর।জিজ্ঞাসা করেন তারা ধর্ম্ম নৃপবর।।কি নাম, কে তুমি, হেথা এলে কি কারণ।কি করিব প্রীতি তব, কহ প্রয়োজন।।কির্ম্মীর বলিল, আমি নিশাচর জাতি।কাম্যক অরণ্য মধ্যে আমার বসতি।।মনুষ্য তপস্বী ঋষি যত বিপ্রগণে।যারে পাই তারে বধি উদর পূরণে।।দৈবে মোরে ভক্ষ্য আনি মিলাইল বিধি।দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।কে তুমি, কোথায় যাহ, কিবা নাম শুনি।কি কারণে কাম্যবনে এ ঘোর রজনী।।যুধিষ্ঠির বলে, আমি পাণ্ডুর নন্দন।আমি ধর্ম্ম, এই মম ভাই চারি জন।।রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে মোরা আইনু হেথায়।কিছুদিন কাটাইব তোমার আশ্রয়।।ভাল ভাল বলি বল দুষ্ট নিশাচর।যাহারে খুঁজিয়া ফিরি দেশ দেশান্তর।।একচক্রা নগরেতে মোর ভ্রাতা ছিল।এই দুষ্ট ভীম তারে নিপাত করিল।।ব্রাহ্মণের গৃহে দুষ্ট ছিল দ্বিজবেশে।সেই হেতু সদা আমি ভ্রমি দেশে দেশে।।আমার পরম সখা হিড়িম্বে মারিল।তার স্বসা হিড়িম্বাকে বিবাহ করিল।।রাক্ষসের বৈরী ভীম জানে সর্ব্বজন।মম হস্তে হবে তার অবশ্য মরণ।।ভীমের রুধিরে বক ভ্রাতার তর্পণ।অগ্নিতে পোড়ায়ে মাংস করিব ভোজন।।রাক্ষসের এতেক কঠোর বাক্য শুনি।বেগে ভীম এক বৃক্ষ উপাড়িয়া আনি।।গাণ্ডীব ধনুকে গুণ দিল ধনঞ্জয়।তারে নিবারিয়া ভীম নিশাচরে কয়।।ভ্রাতৃ-সখা শোকে দুষ্ট করিস্ বিলাপ।আজি তাহা সবা সহ করাব আলাপ।।মুহূর্ত্তেক রহ দুষ্ট না পালাস্ পাছে।বকের দোসর করাইব এই গাছে।।এত বলি প্রহারিল বীর বৃকোদর।বৃত্রাসুরে বজ্র যেন মারে পুরন্দর।।না কম্পয়ে রাক্ষস অটল গিরিবর।দগ্ধ কাষ্ঠদণ্ড হানে ভীমের উপর।।দণ্ড নিবারিল ভীম সব্য পদাঘাতে।পদ্মবন ভাঙ্গে যেন মাতঙ্গ কোপেতে।।করাঘাতে পদাঘাতে মুণ্ডে মুণ্ডে বাড়ি।আঁচড় কামড় চড় ভুজে ভুজে তাড়ি।।দোঁহার উপরে দোঁহে বজ্রমুষ্টি মারে।শরবনে অগ্নি যেন চড় চড় করে।।হেনমতে মুহূর্ত্তেক হইল সমর।মহাভঙ্কর যেন দানব অমর।।ভীমসেন অতি ক্রুদ্ধ আরো ম্গ্ন দুঃখে।তাহে আরো নিশাচর পড়িল সম্মুখে।।ক্ষুধিত গরুড় যেন ভুজঙ্গ পাইল।জ্বলন্ত অনলে যেন পতঙ্গ পড়িল।।ভয়ঙ্কর বেশে ভীম করিল দলন।বলবস্ত রাক্ষস সহিল কতক্ষণ।।অতি ক্রোধে ভীমসেন ধরিল রাক্ষসে।পৃষ্ঠে জানু দিয়া পুনঃ ধরে পদে কেশে।।মধ্যেতে ভাঙ্গিয়া তার কৈল দুইখান।মহানাদ করি দুষ্ট ত্যজিল পরাণ।।হৃষ্ট হয়ে চারি ভাই দিল আলিঙ্গন।সাধু সাধু প্রশংসা করিল মুণিগন।।দ্রৌপদীরে আশ্বাসিয়া কহে বৃকোদর।এইমত সব শত্রু যাবে যমঘর।।এইরূপে কির্ম্মীরে মারিল বৃকোদর।তথায় যাইনু যবে হেরি পাই ডর।।দেখি পথে পড়িয়াছে পর্ব্বত প্রমাণ।আমি জিজ্ঞাসিলাম যে মুনিগণ স্থান।।মুনিমুখে শুনিলাম সব বিবরণ।এত কহি নীরব হৈল বিদুর সুজন।।ভীমের এ বীরত্বের শুনিয়া কাহিনী।নীরবে নিশ্বাস ফেলে অন্ধ নৃপমণি।।পাণ্ডবের বীরত্ব অবনীতে অতুল।ধৃতরাষ্ট্র শুনিয়া হইল চিন্তাকুল।।অরণ্যপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, সাধু করে পান।।০৭. কাম্যকবনে পাণ্ডবদিগেরনিকট শ্রীকৃষ্ণের আগমনবনে যদি গেল পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।দেশে দেশে এই বার্ত্তা পায় রাজগন।।ভোজ বৃষ্ণি অন্ধকাদি যত নৃপগণ।কৃষ্ণের সহিত গেল কাম্যক কানন।।পাঞ্চাল রাজার পুত্র সহ অনুগত।ধৃষ্টকেতু ধৃষ্টদ্যুন্ন আর বন্ধু যত।।যুধিষ্ঠিরে বেড়ি সবে বসে চতুর্ভিত।পাণ্ডবের বেশ দেখি হইল বিস্মিত।।আত্মদুঃখ কহিতে লাগিল পঞ্চ জন।হেন কর্ম্ম করিল পাপিষ্ঠ দুর্য্যোধন।।সে জন বধের যোগ্য কহে ধর্ম্মনীত।গোবিন্দ বলেন, এই আমার বিহিত।।ক্রোধেতে কম্পিত অঙ্গ কমল লোচন।সবিনয়ে ধনঞ্জয় করে নিবেদন।।ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক তুমি হও সত্যবাদী।সদয় হৃদয় তুমি, বিধাতার বিধি।।অক্রোধী অলোভী তুমি দীনে ক্ষমাবন্ত।তোমারে এতেক ক্রোধ, না পড়ে তদন্ত।।নারায়ণ রূপে তুমি হইলো তপস্বী।করিলা তাপস্যা গন্ধমাদনে নিবসি।।পুষ্কর তীর্থেতে দশ সহস্র বৎসর।একপদ বাতাহার, ঊর্দ্ধ দুই কর।।বদরিকাশ্রমে তুমি শতেক বৎসর।দেবমানে তপশ্চর্য্যা কৈলা দামোদর।।দয়ায় করহ তুমি সবার পালন।ইঙ্গিতে করহ ক্ষয়, ইঙ্গিতে সৃজন।।তুমি ত নিগুণ, কিন্তু গুণেতে পূরিত।তোমারে যে না ভজে সে ভাগ্যেতে বঞ্চিত।।এতেক বলেন যদি বীর ধনঞ্জয়।তাঁহারে কহেন তবে দৈবকী তনয়।।তোমায় আমায় কিছু নাহিক অন্তর।আমি নারায়ণ ঋষি, তুমি হও নর।।পাণ্ডবে আমায় আর নাহি ভেদ লেশ।সহিতে না পারি আমি পাণ্ডবের ক্লেশ।।যে তোমারে দ্বেষ করে, সে করে আমারে।তোমারে যে স্নেহ করে, সে আমারে করে।।তুমি হও আমার হে, আ যে তোমার।সে জন তোমার পার্থ, সে জন আমার।।এতেক বলেন কৃষ্ণ কমল লোচন।ভাল ভাল বলিয়া বলিল রাজগণ।।হেনকালে উপনীত দ্রুপদ নন্দিনী।কৃষ্ণের অগ্রেতে বলে যোড় করি পাণি।।অসিত দেবল মুখে শুনিয়াছি আমি।নাভি কমলেতে স্রষ্টা সৃজিয়াছ তুমি।।আকাশ তোমার শির, পাতাল চরণ।পৃথিবী তোমার কটি, অঙ্ঘি গিরিগণ।।শিব আদি যত যোগী তোমারে ধেয়ায়।তপস্বী করিয়া তপ সমর্পে তোমায়।।সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ইঙ্গিতে তব হয়।সবার ঈশ্বর তুমি, মুনিগণে কয়।।অনাথার নাথ তুমি, নির্ধনের ধন।সে কারণে তব পাশে, করি নিবেদন।।সুখ দুঃখ কহিতে সবার তুমি স্থান।মম দুঃখ কহি কিছু, কর অবধান।।পাণ্ডবের ভার্য্যা আমি দ্রুপদ নন্দিনী।তব প্রিয়সখী আমি বলহ আপনি।।এই নারী কেশে ধরি লইল সভায়।দুর্ভাষা কহিল যত, কহনে না যায়।।স্ত্রীধর্ম্মে ছিলাম আমি এক বস্ত্র পরি।অনাথার প্রায় বলে নিল কেশে ধরি।।বীরবংশ পাঞ্চাল পাণ্ডবগণ জীতে।দাস্যকর্ম্ম বিধিমতে বলিল করিতে।।ভীষ্ম দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র ছিল বিদ্যমান।সবে বসি দেখিলেন মোর অপমান।।সবে বলে পাণ্ডুপুত্র বড় বলবন্ত।এত দিনে তা সবার পাইলাম অন্ত।।ধর্ম্মপত্নী আমি, হেন কহে সর্ব্বলোক।এই পঞ্চ জন সভামধ্যে বসি দেখে।।ধিক্ ধিক্ ভীম বীর, ধিক্ ধনঞ্জয়।অকারণে গাণ্ডীব ধনুক কেন বয়।।পূর্ব্বেতে এমন আমি শুনেছি বিধান।স্ত্রী কষ্ট না দেখে কভু থাকি বিদ্যমান।।হীনবল হইলে ভার্য্যায় রাখে স্বামী।সে কারণে এ সবার নিন্দা করি আমি।।পুত্ররূপে জন্মে লোক ভার্য্যার উদরে।সেই হেতু জায়া বলি বলয়ে ভার্য্যারে।।ভার্য্যা ভীতা হলে লয় স্বামীর শরণ।শরণ যে লয়, তারে করয়ে রক্ষণ।।নিলাম শরণ আমি এ পঞ্চ জনারে।কেন এরা রক্ষা নাহি করিল আমারে।।বন্ধ্যা নহি দেব আমি, ইহা পত্রবতী।পুত্রমুখ চাহি না করিল অব্যাহতি।।হীনবীর্য্য নহে মোর সব পুত্রগণ।মহাতেজা তব পুত্র প্রদ্যুন্ন যেমন।।তবে কোন দুষ্টের সহিল হেন কর্ম্ম।কপটে জিনিল মিথ্যা করিয়া অধর্ম্ম।।দাসরূপে সভাতলে বসি সবে দেখে।মম অপমান করে যত দুষ্টলোকে।।গাণ্ডীব বলিয়া ধনু ধনঞ্জয় ধরে।পৃথিবীতে গুন দিতে কেহ নাহি পারে।।ধনঞ্জয় কিম্বা ভীম আর পার তুমি।তবে কেন এত সহি, না জানিনু আমি।।ধিক্ ধিক্ মম নাথ পাণ্ডু পুত্রগণ।এত করি অদ্যাবধি জীয়ে দুর্য্যোধন।।বাল্যকাল হতে যত করে সেইজন।অগোচরে নহে সব, জান নারায়ণ।।কপটে বিষের লাড়ু ভীমে খাওয়াইল।হস্ত পদ বান্ধি গঙ্গাজলে ফেলি দিল।।জতুগৃহ করিয়া রহিতে দিল স্থান।ধর্ম্মবল অগ্নিতে পাইল পরিত্রাণ।।রাজ্যধন লয়ে তবে পাঠাইল বনে।এতেক সহিল কষ্ট কিসের কারণে।।সভায় বসিয়া নাথ দেখে পঞ্চ জন।দুঃশাসন হরে মম পিন্ধন বসন।।এতেক বলিয়া কৃষ্ণা বলে সর্ব্বজনে।তোমরা আমার নহ, জানিনু এক্ষণে।।থাকিলে কি হবে নাথ সভার গোচরে।এতেক দুর্গতি মম ক্ষুদ্রলোকে করে।।এতেক বলিয়া কৃষ্ণা কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।বারিধারা নয়নেতে অনিবার ঝরে।।পুনঃ গদগদ বাক্যে বলয়ে পার্ষতী।নাহি মোর তাত ভ্রাতা, নাহি মোর পতি।।তুমি অনাথের নাথ, বলে সর্ব্বজনে।চরি কর্ম্মে আমি নাথ তোমার রক্ষণে।।সম্বন্ধে গৌরবে স্নেহে আর প্রভুপণে।দাসীজ্ঞানে মোরে প্রভু রাখিবা চরণে।।গোবিন্দ বলেন, সখি না কর ক্রন্দন।তোমার ক্রন্দনে মোর স্থির নহে মন।।যখন বিবস্ত্রা তোমা করে দুঃশাসন।গোবিন্দ বলিয়া তুমি ডাকিলে যখন।।অঙ্গেতে হয়েছে মম সেই মহাঘাত।যাবৎ কপটী দুষ্ট না হয় নিপাত।।যেইমত কৃষ্ণা তুমি করিছ রোদন।সেইমত কান্দিবে সে সবার স্ত্রীগণ।।তোমার সাক্ষাতে আমি কহি সত্য করি।না করিলে, বৃথা বাসুদেব নাম ধরি।।আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে, শিলা জলে ভাসে।অনল শীতল হয়, সপ্ত সিন্ধু শোষে।।তথাপি আমার বাক্য না হইবে আন।দিন কত ক্রন্দন করহ সমাধান।।এতেক শুনিয়া কহিলেন ধনঞ্জয়।কৃষ্ণের বচন দেবী কভু মিথ্যা নয়।।যত কহিলেন কৃষ্ণ হবে সেই মত।অকারণে কান্দ কেন অজ্ঞানের মত।।অগিনী রোদন শুন ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।সজল নয়নে ক্রোধে কম্পিত শরীর।।এতেক লাঞ্ছনা কেবা ক্ষত্র হয়ে সয়।নিকটে না ছিনু আমি, কুরু ভাগ্যোদয়।।তথাপি কৌরবগণে করিব সংহার।শুন সর্ব্ব রাজগণ প্রতিজ্ঞা আমার।।যেই দ্রোণ গুরু বলি গর্ব্ব করে মনে।মম ভার রৈল, তারে সংহারিব রণে।।ভীষ্ম পিতামহ যে অজেয় তিন লোকে।তাঁহাকে মারিতে ভার রৈল শিখণ্ডীকে।।অর্জ্জুনেরে সূতপুত্র না ধরিবে টান।ভীমহস্তে শত ভাই ত্যজিবে পরাণ।।জগতে গোবিন্দাশ্রিত আমরা যে সব।ইন্দ্রকে জিনিতে পারি, কি ছার কৌরব।।এত বলি করে কর কচালে পাঞ্চাল।প্রতিজ্ঞা করয়ে সবে যত মহীপাল।।অরণ্যপর্ব্বের কথা শ্রবণে অমৃত।কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে অনুব্রত।।৮. শাল্ব দৈত্যের সহিত কামদেবের যুদ্ধমধুর বচনে কহিছেন জগন্নাথ।যুধিষ্ঠির আগে যোড় করি পদ্ম হাত।।দ্বারকা ছাড়িয়া আমি নিকটে থাকিলে।নিবৃত্ত করিতে পারিতাম দ্যূতকালে।।অন্ধেরে নিবৃত্ত করিতাম শাস্ত্রবলে।পাশা-আদি নীচকর্ম্মে বহু দোষ ফলে।।মৃগয়া মদিরাপান পাশা ও স্বৈরিণী।এ চারি অনর্থ হেতু, করে লক্ষ্মীহানি।।বিশেষে দেবন দোষ সর্ব্বশাস্ত্রে কয়।পাশায় এ সব দোষ একক্ষণে হয়।।বহুমতে দ্যূত করিতাম নিবারণ।না শুনিলে রণ করিতাম সেইক্ষণ।।নতুবা পাশাকে চক্রে করিতাম ছেদ।আমি তথা থাকিলে না হত ভেদাভেদ।।এ সকল বৃত্তান্ত কহিল যুযুধান।শ্রুতমাত্র নৃপতি এলাম তব স্থান।।তোমার এ বেশ বনে ফল মূলাহার।তব দুঃখ নয় রাজা সকলি আমার।।যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন নারায়ণ।আসিতে বিলম্ব এত কিসের কারণ।।মুহূর্ত্তেকে ভ্রমিবারে পার তিন পুর।তোমার হস্তিনাপুর কত বড় দূর।।গোবিন্দ বলেন, রাজা নহে অপ্রমাণ।যেই হেতু নাহি আসি, কর অবধান।।শাল্ব নামে মহাবল দৈত্যের ঈশ্বর।সসৈন্যে বেড়িয়াছিল দ্বারকা নগর।।তব রাজসূয় হতে গেলাম যখন।সবারে পীড়িল দুষ্ট করি মায়া রণ।।আমার সহিত যুদ্ধ হৈল বহুতর।বহু কষ্টে তারে মারিলাম নরেশ্বর।।এত শুনি যুধিষ্ঠির পুনঃ জিজ্ঞাসিল।কত শুনি, শাল্ব কে দ্বারকা হিংসিল।।তোমর সহিত কেন বৈরিতা হইল।কার হিত কারণ সে দ্বারকা আইল।।কোন মায়া ধরে দুষ্ট, কত করে রণ।বিস্তারি আমারে কহ শ্রীমধুসূদন।।গোবিন্দ বলেন, শুন পাণ্ডুর নন্দন।তব রাজসূয়-যজ্ঞ অনর্থ কারণ।।শিশুপাল আমা হৈতে হইল নিধন।সেই বৈর বৃক্ষ বীজ হইল রোপন।।শিশুপাল বিনাশ শুনিয়া দৈত্যেশ্বর।সসৈন্যে বেড়িল আসি দ্বারকা নগর।।দ্বারকার লোক তার আগমন শুনি।উগ্রসেন আদি সবে সাজিল বাহিনী।।দ্বারকা পশিতে যত নৌকাপথ ছিল।সকল স্থানের নৌকা ডুবাইয়া দিল।।লোহার কণ্টক সব পৌঁতাইল পথে।ক্রোশেক পর্য্যন্ত বিষ রাখিল জলেতে।।ধন রত্ন রাখে সব গর্ত্তের ভিতর।রক্ষক উদ্ধব উগ্রসেন নৃপবর।।আসিতে যাইতে লোক করে নিবারণ।বিনা চিহ্নে তথা নাহি চলে কোন জন।।চিহ্ন পেলে রক্ষকেরা ছাড়ি দেয় পথ।দৈত্যভয়ে সুরপুর রাখে যেই মত।।সৌভপতি আইল সে চতুরঙ্গ দলে।পৃথিবী কম্পিত হল রথ কোলাহলে।।চতুর্দ্দিকে দ্বারকা সে রহিল বেড়িয়া।বহু সৈন্য জলে স্থলে রহিল যুড়িয়া।।দেবালয় শ্মশান সৈন্যে পূর্ণিত কৈল।দৈত্যের যতেক বাহিনী হুহুঙ্কারিল।।দেখিয়া দৈত্যের সৈন্য বৃষ্ণি বংশগণ।বাহির হইল তবে করিবারে রণ।।চারুদেষ্ণ শাম্ব গদ প্রদ্যুন্ন সারণ।সসৈন্যে বাহির হৈল করিবারে রণ।।ক্ষেমবৃদ্ধি নামেতে শাল্বের সেনাপতি।সে যুদ্ধ করিল শাম্ব-কুমার সংহতি।।মহাবল শাম্ব জাম্ববতীর নন্দন।অস্ত্রবৃষ্টি কৈল যেন জল বরিষণ।।সহিতে না হরি রণে ভঙ্গ দিয়া গেল।ক্ষেমবৃদ্ধি ভঙ্গ দেখি সৈন্য পলাইল।।বেগবান্ নামে দৈত্য আছিল তাহার।আগুবাড়ি শাম্ব সহ যুঝিল অপার।।শাম্বের হস্তেতে মহাগদা যে আছিল।তাহার প্রহারে বেগবান্ সে পড়িল।।বিবিন্ধ্য নামেতে দৈত্য আসিয়া রুষিল।নানা অস্ত্রে দুই বীরে মহাযুদ্ধ হৈল।।মহাবীর চারুদেষ্ণ রুক্মিণী তনয়।অগ্নিবাণে সকল করিল অগ্নিময়।।সেই বাণে ভস্ম হৈল বিবিন্ধ্য অসুর।যার ভয়ে সদাই কম্পয়ে সুরপুর।।সেনাপতি পড়িল, পলায় সেনাগণ।সৈন্যভঙ্গ দেখি শাল্ব আইল তখন।।জিনিয়া মেঘের ধ্বনি তাহার গর্জ্জন।দেখি ভয়যুক্ত হৈল দ্বারকার জন।।সৌভ নামে তার পুরী, কামাচার গতি।ক্ষণেক আকাশে উঠে, ক্ষণে বৈসে ক্ষিতি।।অশ্ব রথ পদাতিক না যায় গণন।বিষম আয়ুধ ধরে সব সেনাগণ।।শাল্বে দেখি বিকম্পিত হৈল সব বীর।বাহির হইল কাম নির্ভর শরীর।।নির্ভয় করিয়া যত দ্বারকার জনে।আইল মকরধ্বজ রথ আরোহণে।।অপ্রমিত যুদ্ধ হৈল শাল্বের সংহতি।অঞ্জন-পর্ব্বত তুল্য শাল্ব দৈত্যপতি।।মর্ম্মভেদী এক অস্ত্র প্রদ্যুন্ন ছাড়িল।কবচ ভেদিয়া অস্ত্র শাল্বেরে ছেদিল।।মূর্চ্ছিত হইয়া শাল্ব রথেতে পড়িল।দেখিয়া যাদব-বল চৌদিকে বেড়িল।।হাহারবে কান্দয়ে যতেক দৈত্যগণ।কতক্ষণে শাল্ব রাজা পাইল চেতন।।গর্জ্জিয়া উঠিয়া চাপে দিলেক টঙ্কার।পলায় যাদব-দল শব্দ শুনি তার।।বহু মায়া জানে শাল্ব, মায়ার নিধান।কামদেবে প্রহারিল তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ বাণ।।মোহ হৈল প্রদ্যুন্নের মায়া অস্ত্রাঘাতে।মূর্চ্ছিত হইয়া কাম পড়িলেক রথে।।কামদেবে মূর্চ্ছা দেখি দারুক সন্ততি।রথ ফিরাইয়া পলাইল শীঘ্রগতি।।কতক্ষণে সচেতন হল মম সুত।সারথিরে নিন্দা করি বলয়ে বহুত।।কি কর্ম্ম করিলে তুমি দারুক নন্দন।মম রথ ফিরাইলে কিসের কারণ।।শাল্বে দেখি ভয় তব হৈল হৃদি মাঝ।সে কারণে সারথি করিলে হেন কাজ।।বৃষ্ণিবংশ সমরে বিমুখ কোন্ কালে।কেবা অগ্রসর হবে মোর শরজালে।।সূত বলে, ভয় কিছু নাহিক আমার।শাল্ব অস্ত্রে রথেতে মূর্চ্ছা হৈল তোমার।।রথী মূর্চ্ছা দেখি রথ ফিরায় সারথি।নাহিক তাহাতে দোষ, আছে হেন নীতি।।বিশেষ গরিষ্ঠ বাক্য শুনিয়া তাহার।ঈষৎ হাসিয়া কহে রুক্মিণী কুমার।।আর কভু কর্ম্ম না করিহ হেনমত।জীবন্ত থাকিতে রথী না ফিরাও রথ।।বৃঞ্চিবংশে হেনরূপ কভু নাহি হয়।কি বলিবে শুনি জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়।।কি বলিবে মোরে সবে পিতৃ ভ্রাতৃ তাত।তোমা হৈতে বৃষ্ণিবংশ হইল ধিক্কৃত।।কি বলিবে সাত্যকি বা উদ্ধব শুনিয়া।মৃত্যু ইচ্ছা করি আমি এসব গণিয়া।।পাছে পাছে শাল্ব মোরে প্রহারিবে শর।পলাইয়া যাব আমি স্ত্রীগণ-ভিতর।।দেখিয়া হাসিবে সব বৃষ্ণিকুল-নারী।পলাইয়া গেল বলি বহু নিন্দা করি।।এ কর্ম্ম হইতে মৃত্যু শতগুণে ভাল।দ্বারকার ভার যে আমারে সমর্পিল।।রাজসূয় যজ্ঞে গেল আমারে রাখিয়া।কি বলিবে তাত মোর এ সব শুনিয়া।।শীঘ্র বাহুড়াহ রথ দারুক নন্দন।এখনি সে সৌভ পুরী করিব নিধান।।কামের এতেক বাক্য শুনিয়া সারথি।রণমুখে রথ চালাইল শীঘ্রগতি।।শাল্বের যতেক সৈন্য, না যায় গণন।কামের সম্মূখে নাহি রহে কোন জন।।মারিল বহুত সৈন্য, না যায় গণনা।রক্তে কলকলি উঠে, আর উঠে ফেণা।।ভগ্ন সৈন্য দেখিয়া কুপিল দৈত্যপতি।নানা অস্ত্র প্রদ্যুন্নে প্রহারে শীঘ্রগতি।।পুনঃ পুনঃ মায়াবী সে হানে নানা শর।সব শর ছেদ করে কাম ধনুর্দ্ধর।।পরে ক্রোধে কামদেব নিল দিব্যবাণ।চন্দ্র-সূর্য্য তেজ দেখি যাহে বিদ্যমান।।ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নি উঠে বাণের মুখেতে।অন্তরীক্ষ বাসিগণ পলায় ভয়েতে।।অস্ত্র দেখি দেবগণ করে হাহাকার।শীঘ্র পাঠাইল তথা ব্রহ্মার কুমার।।বায়ুবেগে আসিলেন নারদ ঝটিতি।সবিনয়ে কহিলেন কামদেব প্রতি।।সম্বরহ অস্ত্র এই কৃষ্ণের নন্দন।এই অস্ত্রে রক্ষা নাহি পায় ত্রিভুবন।।শাল্ব দৈত্যরাজ কভু তব বধ্য নয়।স্বহস্তে মারিবে এরে দৈবকী তনয়।।এত শুনি হৃষ্ট হয়ে তূণে অস্ত্র থুইল।এ সব কারণ শাল্ব সকলি জানিল।।রণ ত্যজি সৌভ পুরে উত্তরিল গিয়া।নিজ রাজ্যে গেল তবে দ্বারকা ত্যজিয়া।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুন্যবান।।৯. শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক শাল্ব বধতব যজ্ঞ সাঙ্গ যবে হল নরপতি।হেথা হতে আমি ত গেলাম দ্বারাবতী।।দেখিলাম দ্বারকা যে লণ্ডভণ্ড প্রায়।বেদধ্বনি উচ্চারে অতি করুণাতায়।।পুষ্পোদ্যানে তরুগণ লণ্ডভণ্ড দেখি।জিজ্ঞাসা করিলাম যে সাত্যকিরে ডাকি।।সকল কহিল তবে হৃদিকা নন্দন।আদ্যোপান্ত যতেক শাল্বে বিবরণ।।শুনিয়া হৃদয়ে তাপ হইল অপার।ঘরে প্রবেশিতে চিত্ত নহিল আমার।।কামপাল কামদেব বাহুক প্রভৃতি।সবারে কহিনু যেন রাখে দ্বারাবতী।।হইলাম কিছু সৈন্য লইয়া বাহির।শাল্ব সহ যুদ্ধে যাই সিন্ধুনদ-তীর।।তথা শুনিলাম, শাল্ব আছে সিন্ধুমাঝে।সিন্ধুমাঝে প্রবিষ্ট হইলাম সেই সাজে।।পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদ শুনিয়া আমার।হাসিয়া ডাকিয়া বলে শাল্ব দুরাচার।।তোমারে চাহিয়া গেনু দ্বারকা নগরে।না দেখি তোমারে ফিরি আসিলাম ঘরে।।ভাগ্য মোর, তুমিত আসিলে হেথাকারে।এখনি তোমারে পাঠাইব যমদ্বারে।।এতবলি এড়িলেক লক্ষ লক্ষ বাণ।গদা চক্র শেল শূল অস্ত্র খরশান।।সব কাটিলাম আমি চেক-চোক শরে।মায়ায় উঠিল শাল্ব আকাশ উপরে।।আকাশে উঠিয়া শাল্ব বহু মায়া কৈল।দিবারাত্রি নাহি জানি, অন্ধকার হৈল।।কোটি কোটি বাণ যে এড়িল দুষ্টমতি।না দেখি রথের ঘোড়া, রথের সারথি।।শৈব সুগ্রীবাদি অশ্ব হইল অচল।ডাকিল দারুক মোরে হইল বিহ্বল।।দারুকের অঙ্গ দেখি শরেতে জর্জ্জর।তিলমাত্র অক্ষত নাহিক কলেবর।।শক্তিহীন সর্ব্বাঙ্গে বহিছে রক্তধার।চিন্তিত হইনু দুঃখ দেখিয়া তাহার।।হেনকালে দ্বারকানিবাসী একজন।সম্মূখে আসিয়া কহে করিয়া ক্রন্দন।।কি করহ বাসুদেব, চল শীঘ্রগতি।ক্ষণমাত্র রহিলে মজিবে দ্বারাবতী।।শাল্বরাজ আসি আজি দ্বারকা নগরে।যুদ্ধ করি মারিলেক তোমার পিতারে।।শীঘ্র করি উগ্রসেন দিল পাঠাইয়া।মজিল দ্বারকাপুর, রক্ষা কর গিয়া।।এত শুনি চিত্তে বড় হইল বিস্ময়।পিতৃশোকে তাপ বড় জন্মিল হৃদয়।।বলভদ্র প্রদ্যুন্ন সাত্যকি আদি করি।মহাবীরগণ সবে রক্ষা করে পুরী।।এ সব থাকিতে বসুদেবেরে মারিল।সবাই মরিল, হেন বিশ্বাস জন্মিল।।এ তিন থাকিতে যদি দেবরাজ আসে।নাহিক তাঁহার শক্তি দ্বারাকা প্রবেশে।।মায়াতে সকলি হেন জানিলাম মনে।পুনঃ যুদ্ধ আসিয়া করিনু শাল্ব সনে।।আচম্বিতে দেখি শাল্ব সৌভপুরী হতে।কেশপাশ মুক্ত পিতা পড়েন ভূমিতে।।চতুর্দ্দিকে দৈত্যগণ করিছে প্রহার।দেখিয়া আমরা সবে করি হাহাকার।।দেখিয়া এ সব কাণ্ড ব্যাকুল হইয়া।জ্ঞানচক্ষে চাহিলাম বিস্ময় মানিয়া।।দেখিলাম সব মিথ্যা স্বপ্নেতে যেমন।মায়াবী শাল্বের যত মায়ার সৃজন।।চিত্ত হৈল স্থির বুঝি অসুরের মায়া।না জানি কোথায় শাল্ব আছে লুকাইয়া।।তবে কতক্ষণে শব্দ শুনি আচন্বিতে।মার মার বলিয়া ডাকয়ে পূর্ব্বভিতে।।শব্দ অনুসারে এড়িলাম শব্দভেদী।যতেক মায়াবী দৈত্যে ফেলিলাম ছেদি।।খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িল সিন্ধু জলে।কুম্ভীর মকর মৎস্য ধরি সব গিলে।।নিঃশব্দ হইয়া সব পড়িল দানব।আর কতক্ষণে শুনি দশদিকে রব।।করিলাম গান্ধর্ব্ব অস্ত্রের নিক্ষেপণ।মায়া দূর হৈল, শাল্ব দিল দরশন।।সৈন্য হত দেখিয়া দৈত্যের অধিপতি।সে প্রাগজ্যোতিষপুরে গেল শীঘ্রগতি।।তথা হৈতে বহু সৈন্য লইয়া আইল।অন্ধকার করি দৈত্য গিরি বরষিল।।অনেক প্রকারে তাহা নারি নিবারিতে।দেখিয়া বিস্ময় হৈল আমার মনেতে।।ভাঙ্গিল আমার রথ পর্ব্বত চাপনে।হাহাকার করয়ে আকাশে দেবগণ।।মোরে না দেখিয়া ব্যাকুলিত দেবগণ।আর মিত্রগণ যত করেন রোদন।।বজ্রের প্রসাদে পুনঃ পাই পরিত্রাণ।সেই অস্ত্রে খণ্ড খণ্ড হইল পাষাণ।।পর্ব্বত কাটিয়া আমি হৈলাম বাহির।জলদ পটল হৈতে যেমন মিহির।।পুনঃ শাল্ব নানা অস্ত্র করে বরিষণ।যোড়হাতে দারুক করিল নিবেদন।।মায়ার পুত্তলি এই অসুর দুরন্ত।সুদর্শন এড় প্রভু, দৈত্য হবে অন্ত।।সৌভপুরী দানবের রবে যতক্ষণ।ততক্ষণ নহিবেক শাল্বের নিধন।।সুদর্শন এড়ি শীঘ্র কাট সৌভ-পুর।তবে ত নিধন হবে মায়াবী অসুর।।এ কথা শুনিয়া ত্যাগ করিলাম চক্র।দেখি দৈত্য হয় ব্যস্ত, সচকিত শক্র।।আকাশে উঠিল চক্র সূর্য্যের সমান।সৌভ পুরী কাটিয়া করিল খান খান।।পুনরপি সুদর্শন বাহুড়ি আইল।শাল্বেরে কাটিতে পুনঃ অনুজ্ঞা লইল।।গর্জ্জিয়া উঠিল চক্র গগন মণ্ডলে।প্রলয়ের কালে যেন শত সূর্য্য জ্বলে।।দেখি সুরাসুর সব হইল অজ্ঞান।শাল্ব দৈত্যে কাটি চক্র করে খান খান।।আর যত ছিল দৈত্য গেল পলাইয়া।দ্বারকা আসিনু তবে দৈত্যেরে বধিয়া।।এই হেতু আসিতে না পারিনু রাজন।আপনার মৃত্যুপথ কৈল দুর্য্যোধন।।তুমি সত্যবাদী, সত্য করিবে পালন।সেই বলে দুর্য্যোধন ত্যজিবে জীবন।।এয়োদশ বৎসরান্তে হইবে সংহার।ইন্দ্র আদি সখা হলে রক্ষা নাহি তার।।শুন ধর্ম্ম মহীপাল আমার বচন।গ্রহদোষ হতে দুঃখ পায় সাধু জন।।অবনীতে ছিল পূর্ব্বে শ্রীবৎস নৃপতি।শনি কোপে তিনি দুঃখ পাইলেন অতি।।চিন্তাদেবী তাঁর ভার্য্যা লক্ষ্মী অংশে জন্ম।পৃথিবীতে খ্যাত আছে তাঁহাদের কর্ম্ম।।দ্রৌপদীর কিবা দুঃখ, শুন নৃপবর।ইহা হতে চিন্তা দুঃখ পাইল বিস্তর।।দৈবেতে এ সব হয়, শুন মহীপাল।আপন অর্জ্জিত কর্ম্ম ভূঞ্জে চিরকাল।।এবে দুঃখ পাও রাজা দৈবের বিপাকে।ঈশ্বরের নিন্দ নাই, নিন্দ আপনাকে।।মূল কর্ম্ম ফলাফল ভোগায় তাহাতে।কর্ম্ম অনুসারে জীব ব্যস্ত হয় যাতে।।শুনিয়া কৃষ্ণের কথা অতি মনোহর।কহিছেন যুধিষ্ঠির যোড় করি কর।।কহ প্রভু শ্রীবৎস নৃপতি কোন্ জন।কোথায় নিবাস তাঁর, কাহার নন্দন।।চিন্তাদেবী কার কন্যা, কহ নারায়ণ।কিরূপে পাইল দুঃখ, কহ বিবরণ।।রাজপুত্র হয়ে দুঃখী আমার সমান।আর কেবা ছিল পৃথিবীতে বিদ্যমান।।কহ কহ জগন্নাথ শুনিতে আনন্দ।মুখ পদ্ম হতে ক্ষরে বাক্য মকরন্দ।।বনপর্ব্ব ব্যাস ঋষি করিল প্রকাশ।পয়ারে রচিল তাহা কাশীরাম দাস।।১০. শ্রীবৎস রাজার উপাখ্যানশ্রীকৃষ্ণ বলেন, রাজা করহ শ্রবণ।শ্রীবৎষস রাজার কথা অপূর্ব্ব কথন।।চিত্ররথ পূর্ব্বে ছিল পৃথিবীর পতি।তৎপরে শ্রীবৎস হয় তাঁহার সন্ততি।।একচ্ছত্রে ধরণী শাসিল নরপতি।রতিপতি সম রূপে, বুদ্ধে বৃহস্পতি।।সসাগরা বসুন্ধরা শাসি বাহুবলে।সকল করিল রাজা নিজ করতলে।।রাজসূয় অশ্বমেধ করে শত শত।দানেতে দরিদ্রগণে তোষে অবিরত।।অপ্রমিত গুণ তাঁর বর্ণনা না যায়।ধার্ম্মিক তাঁহার তুল্য নাহিক কোথায়।।যেই যাহা বাঞ্ছা করে, তাহা দেন তারে।দেহ রক্ষা হেতু প্রাণ নাহি দেন কারে।।চিত্রসেন রাজকন্যা তাঁহার মহিষী।চিন্তা নামে পতিব্রহা পরমা রূপসী।।শত শত চান্দ্রায়ন, কত মহাদান।করিয়াছে কেবা হেন চিন্তার সমান।।রাজা রাণী ধর্ম্ম কর্ম্ম যা করে যখন।ঈশ্বরে অর্পণ করে হয়ে শুদ্ধমন।।একগুণ দান করে শত গুণ হয়।এইরূপে শ্রীবৎসেন কতকাল যায়।।শুন হে অপূর্ব্ব কথা ধর্ম্মের নন্দন।তৎপরে হইল দেখ দৈবের ঘটন।।একদিন লক্ষ্মী আর শনি মহাশয়।উভয়েতে বাগযুদ্ধ হয় অতিশয়।।লক্ষ্মী কহে, আমি শ্রেষ্ঠা, সকল সংসারে।স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালেতে কে ছাড়ে আমারে।।কেমনে বলিলে শনি, তুমি শ্রেষ্ঠ জন।ত্রিভুবন মধ্যে তোমা কে করে অর্চ্চন।।এইরূপে দুই জনে হল গণ্ডগোল।পণ করি দুই জনে আসে ভূমণ্ডল।।লক্ষ্মী কহে, শ্রীবৎস নৃপতি বিচক্ষণ।ইহার মধ্যস্থ তবে হৌক সেই জন।।সূর্য্য পুত্র সিন্ধু কন্যা উভয়ে ত্বরিত।রাজার পুরেতে আসি হন উপস্থিত।।শ্রীবৎস নৃপতি যান স্নান করিবোরে।দুই জন উপনীত দেখিলেন দ্বারে।।দেখি ব্যস্ত নরপতি রহি যোড়করে।প্রণাম করিয়া কহে মৃদু মধুস্বরে।।কি কারণে আগমন হয়েছে এ স্থানে।শনি কহে, কার্য্য আছে তব সন্নিধানে।।আমরা দুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোন্ জন।বিচারিয়া কহ রাজা তুমি বিচক্ষণ।।এত শুনি কহে রাজা বিনয় বচনে।মীমাংসা করিব কল্য যাহা লয় মনে।।এই বাক্য করি দোঁহে করেন বিদায়।স্নান করি নিজালয়ে আসি নৃপরায়।।রাণীরে কহিল রাজা এই বিবরণ।শুনিয়া হইল রাণী বিষণ্ণ বদন।।অমরে অমরে দ্বন্দ্ব করি দুই জনে।মনুষ্যে মধ্যস্থ করে কিবা সে কারণে।।ভাল ত লক্ষণ রাজা নহে এ সকল।না জানি কি হয় বুঝি মম কর্ম্মফল।।রাজা বলে, চিন্তাদেবী চিন্তা কর মিছা।হইবে যখন যাহা ঈশ্বরের ইচ্ছা।।কাল বলবান্ দেবী জানিহ নিশ্চয়।কালপ্রাপ্ত হলে নর মৃত্যুবশ হয়।।এমত চিন্তায় গত দিবস শর্ব্বরী।কাশীদাস কহে, সাধু শুনে কর্ণ ভরি।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon