মহাভারত:অশ্বমেধপর্ব-০১১-০১৫

১১. নীলধ্বজ রাজার সহিত যুদ্ধ
বৈশম্পায়ন কহেন শুন জন্মেজয়।
দক্ষিণ দিকেতে গেল পাণ্ডবের হয়।।
পশ্চাতে চলিল সৈন্য নানা অস্ত্র ধরি।
করিল প্রবেশ গিয়া মাহেশ্বরা পুরি।।
মাহেশ্বরী পুরে রাজা নীলধ্বজ নাম।
অস্ত্র শস্ত্র বিশারদ বীর গুণধাম।।
ধর্ম্মেতে পৃথিবী পালে নীলধ্বজ রায়।
নানা সুখে আছে প্রজা ক্লেশ নাহি পায়।।
প্রবীর নামেতে তার প্রধান তনয়।
যৌবনে হইয়া মত্ত নাহি ধর্ম্ম ভয়।।
যুবতী লইয়া সদা কেলি করে জলে।
নানা রঙ্গে নানা ভঙ্গে খেলে কুতূহলে।।
হেনকালে সেই অশ্ব যায় সেই পথে।
প্রবীর বনিতা তাহা পাইল দেখিতে।।
মদন মঞ্জরী নামে প্রবীর বনিতা।
স্বামী আগে যোড়হাতে কহে ধীরে কথা।।
হের দেখ অশ্ব আসে সর্ব্বসুলক্ষণ।
ঘোড়ার অঙ্গেতে কত মুকুতা রতন।।
সোথার নূপুর ‍বাজে অশ্বের চরণে।
ভুলিল আমার মন অশ্ব দরশনে।।
অশ্ব ধরি দেহ মোরে প্রাণের ঈশ্বর।
নহিলে মরিব আমি তোমার গোচর।।
বনিতার বাক্য শুনি রাজার নন্দন।
ছুটিয়া ধরিল ঘোড়া, সর্ব্ব সুলক্ষণ।।
অশ্ব ভালে লিখন পড়িল নৃপসুত।
পড়ি লেখা অহঙ্কার বাড়িল বহুত।।
অশ্ব ধরি কুমার কহিল নারীগণে।
ঘোড়া লয়ে তোমরা চলহ নিকেতনে।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করে রাজা যুধিষ্ঠির।
অশ্বেরে রক্ষিতে এল ধনঞ্জয় বার।।
অহঙ্কারে অশ্বভালে করেছে লিখন।
ধরিতে আমার ঘোড়া, আছে কোনজন।।
যদি কেহ অশ্ব ধরে বিনাশিব তারে।
আনিব যজ্ঞের ঘোড়া, হস্তিনানগরে।।
কদাচিত আমি অশ্ব না দিব পাণ্ডবে।
ঘোড়া না পাইলে আসি সংগ্রামে করিবে।।
অতএব তোমা সবা যাও অন্তপুরে।
বান্ধিয়া রাখহ ঘোড়া লয়ে পাক ঘরে।।
হেথা অশ্ব না দেখিয়া পাণ্ডবেরগণ।
নানা অস্ত্র লয়ে যায় করিবারে রণ।।
আগে আসে পার্থ বীর ধনুঃশর হাতে।
দেখা হল তবে তাঁর প্রবীরের সাথে।।
জিজ্ঞাসা করেন তাঁরে বীর ধনঞ্জয়।
ধরিলে যজ্ঞের ঘোড়া মনে নাহি ভয়।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিছেন যুধিষ্ঠির।
ঘোড়া ধরে পৃথিবীতে আছে কোন বীর।।
প্রবীর বলিল নাহি কর অহঙ্কার।
ঘোড়া ধরি আমি নীলধ্বজের কুমার।।
বুঝিব তোমার শক্তি পাণ্ডব নন্দন।
লইবে কেমনে ঘোড়া করি তুমি রণ।।
হাসিয়া অর্জ্জুন বলে যুদ্ধ তোর সনে।
একথা জানিলে হাসিবেক ক্ষত্রগণে।।
বিবাদ করিব আমি বালক সংহতি।
যুঝিবে তোমার সঙ্গে মম সেনাপতি।।
অর্জ্জুনের বাক্য রোষে রাজার কুমার।
আকর্ণ পুরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।।
এত শুনি অগ্নিদেব প্রবেশিল রণে।
অর্জ্জুন কটক সব দহিল আগুনে।।
দেখিয়া অর্জ্জুন কহিছেন বৈশ্বানরে।
ক্ষমা করি অগ্নি হও সদয় আমারে।।
খাণ্ডব দহিয়া আমি তুবিনু তোমারে।
অক্ষয় কবচ তুমি দিয়াছ আমারে।।
এখন শত্রুতা কর কিসের লাগিয়া।
মিনতি করিয়া বলি যাহ নিবর্ত্তিয়া।।
অশ্বমেধ করিবেন পাণ্ডুর নন্দন।
তাহাতে করিবে তুমি আহুতি ভক্ষণ।।
অর্জ্জুন বচনে অগ্নি সম্প্রীতি পাইল।
তেজ নিবারণ করি অর্জ্জুনে তুষিল।।
অগ্নির পাইয়া আজ্ঞা বীর ধনঞ্জয়।
এড়িলেন বরুণাস্ত্র হইয়া নির্ভয়।।
নির্ব্বাণ হইল অগ্নি সলিল পরশে।
মন্দানল হয়ে গেল নৃপতির পাশে।।
ভয়ে ভঙ্গ দিল যত নৃপ সেনাগণ।
আপনি পলায় রাজা পরিহরি রণ।।
প্রবীর রাজার পুত্র আছিল পশ্চাতে।
দেখিয়া অর্জ্জুনে সেই আইল ত্বরিতে।।
অর্দ্ধচন্দ্রবাণে তার মুণ্ড কাটা গেল।
প্রবীর রাজার পুত্র ভূমিতে পড়িল।।
পুত্রশোকে নীলধ্বজ বিরস বদন।
ভঙ্গ দিল মনোদুঃখ পাইয়া রাজন।।
নীলধ্বজে কহে অগ্নি মধুর ভারতী।
অর্জ্জুনে জিনিতে নাহি তোমার শকতি।।
আমার বচনে তুমি পরিহর রণ।
মনুষ্য না হয় পার্থ নর নারায়ণ।।
আমি অগ্নি শুন রাজা পাণ্ডবের পক্ষ।
পাণ্ডবের সখ্যকরি না করি অসখ্য।।
তুরগ অর্পিয়া তুমি দ্রুত কর প্রীতি।
রাজ্য প্রজা রক্ষা পাবে শুন নরপতি।।
নহেত অসাধ্য বড় হইবে দুষ্কর।
রাখিতে নারিব আমি শুন নৃপবর।।
জামাতার বাক্য শুনি নীলধ্বজ রায়।
অশ্ব আনিবার তরে অন্তঃপুরে যায়।।
পুত্রশোকে নৃপতির অন্তর জর্জ্জর।
নয়নে সলিল ধারা বহে নিরন্তর।।
বিরস বদনে রাজা গেল অন্তঃপুরে।
কহিল সকল কথা প্রিয়ার গোচরে।।
সংগ্রামে পড়িল পুত্র সমাচার পেয়ে।
ক্রন্দন করেন রাণী অচেতন হয়ে।।
কোথা সে প্রবীর বলি কাঁদে নরপতি।
পুত্রশোকে অচেতনা জনা গুণবতী।।
নৃপতি বলেন তুমি না কাঁদিও আর।
অশ্ব দিয়া রাজ্য আমি রাখি আপনার।।
ছিলাম পুরুষ আমি, হইলাম নারী।
এ সব ঈশ্বরলীলা বুঝিতে না পারি।।
সম্প্রীতি করিব আমি অর্জ্জুনের সনে।
সংগ্রামে মরিল পুত্র কার্য্য নাহি রণে।।
জনা বলে কি কথা কহিলে নরপতি।
শত্রু সঙ্গে কেমনেতে করিবে পিরীতি।।
প্রবীরে মারিয়া সে হইল মোর অরি।
তার সঙ্গে প্রীতি কর কহিতে না পারি।।
সাহস করিয়া তুমি কর গিয়া রণ।
অর্জ্জুনে নাশিয়া কর শোক নিবারণ।।
নীলধ্বজ রাজা বলে শুন রূপবতী।
জামাতা হারিল রণে অর্জ্জুন সংহতি।।
যার বাহুবলে আমি জিনি সবাকারে।
স্থির হতে নারে সেই অর্জ্জুনের শরে।।
তুমি কি বুঝাবে নীতি সব আমি জানি।
পাণ্ডবের সহায় আপনি চক্রপাণি।।
প্রীতি করি তীর সনে অশ্ব সমর্পিয়া।
অশ্বরক্ষা হেতু প্রয়ে যাব গোড়াইয়া।।
শুনি তাহা জনা বলে ধিক্ বীরপণা।
রহিল ঘুষিতে অপযশের ঘোষণা।।
ক্ষত্রকুলে জনমিয়া ত্যজিলে সংগ্রাম।
শত্রুর আশ্রয় লয়ে বৃথা ধর নাম।।
তোমর সম্মুখে মৈল কোলের কুমার।
পুত্র শোকে মরি এই তোমার গোচর।।
এত বলি রাজরাণী কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।
অশ্ব লয়ে নরপতি আইল বাহিরে।।
অর্জ্জুনের অশ্ব দিল নীলধ্বজ রায়।
যোড়হাতে বলে ক্ষমা করহ আমায়।।
না জানিয়া মোর পুত্র তুরঙ্গ ধরিল।
বিধাতা তাহার ফল হাতে হাতে দিল।।
এত বলি নীলধ্বজ অর্জ্জুনের সঙ্গে।
তুরঙ্গ রাখিতে রাজা গেল অতি রঙ্গে।।
তাহা শুনি রাণী অতি ক্রুদ্ধা হয়ে মনে।
অন্তঃপুর ত্যজি গেল ভ্রাতার সদনে।।
১২. পুত্রশোকে জনার ভ্রাতৃগৃহে গমন
তবে জনাবতী নারী, অন্তরেতে ক্রোধ করি,
ত্যজিয়া আলয় ধন জন।
পুত্রশোকে অধোমুখ, মনেতে ভাবিছে দুঃখ,
স্বামী নিল বিপক্ষ শরণ।।
পথে যেতে যুক্তি করে, বিনাশিব অর্জ্জুনেরে,
সহোদর সহায় করিয়া।
না পূরিল মনোরথ, দৈবে মোর এই পথ,
কি করিব ঘরেতে বসিয়া।।
বিনাশিলে অর্জ্জুনেরে, তবে মোর আশা পূরে,
নহে আমি ত্যজিব শরীর।
কাতর হইল রাজ, দুঃখতে নাহিক লাজ,
কোথা গেল সে পুত্র প্রবীর।।
লাজ অধোমুখ হৈয়া, মনে যুক্তি বিচারিয়া,
ভ্রাতার ভবনে গেল চলি।
উলুকের বিদ্যমানে, জনা কাঁদে সকরুণে,
পুনঃ পুনঃ লোটাইয়া ধূলি।।
ভগিনীর দশা দেখি, উলুক হইল দুঃখী,
হাতে ধরি তুলিল তাহারে।
না কহিয়া বিবরণ, কাঁদে কেন অকারণ,
কেবা বল দুঃখ দিল তোরে।।
জনা বলে ওগো ভাই, কহিবারে আসি নাই,
প্রবীর মরিল আজি রণে।
অর্জ্জুন আইল পুরে, অশ্ব রাখিবার তরে,
সে হেতু সংগ্রাম তার সনে।।
যুদ্ধ করে ধনঞ্জয়, জামাতা পাইল ভয়,
পরাজয় হইল নৃপতি।
পুত্রশোক না ভাবিয়া, তুরগ দিলেন লৈয়া,
পার্থসহ করিলেক প্রীতি।।
শুনিয়া পাইনু তাপ, না ঘুচিল মনস্তাপ,
স্বামী নিল শত্রুর শরণ।
বিনাশিয়া অর্জ্জুনেরে, যদি রাজ্য দেহ মোরে,
তবে শোক হয় নিবারণ।।
এ বড় অধিক লাজ, নীলধ্বজ মহারাজ,
পুত্রশোক না করিল মনে।
জনমিয়া ক্ষত্রকূলে, অশ্ব রাখিবার ছলে,
ভয়ে গেল অর্জ্জুনের সনে।
ধরিনু চরণ তোর, প্রতিজ্ঞা রাখহ মোর,
অর্জ্জুনের বধিয়া জীবন।
আমি সে অবলাজাতি, কলঙ্কে আছয়ে ভীতি,
নহে আমি করিতাম রণ।।
ভাই যে উলুক নাম, ধর্ম্মবুদ্ধি অনুপাম,
লজ্জাতে করিল হেঁটমাথা।
অবলা প্রবলা হয়ে, নিজ পুরী তেয়াগিয়ে,
কি কারণে আসিয়াছ হেথা।।
পার্থ নর নারায়ণ, কহে যত মুনিগণ,
রণে কেহ জিনিতে না পারে।
পাণ্ডবের সখা গুরু, কৃষ্ণ বাঞ্ছাকল্পতরু,
কেবা তাঁর কি করিতে পারে।।
আপনার ভাল চাহ, নিজালয়ে চলি যাহ,
তবে সে আমার ক্রোধ নাই।
কি কর্ম্মকরিলে তুমি, কভু নাহি শুনি আমি,
প্রতিফল পাবে মোর ঠাইঁ।।
রহিবেক দুষ্ট ভাষা, নহে কাটিতাম নাসা,
অবলার এত অহঙ্কার।
ভাতৃমুখে কথা শুনি, জনা অপমান গণি,
নাহি গেল পুরে আপনার।।
মহাভারতের কথা, শুনিলে খণ্ডয়ে ব্যথা,
কলির কলুষ বিনাশন।
গোবিন্দ চরণে মন, নিয়োজিয়া সর্ব্বক্ষণ,
কাশীরাম দাস বিরচন।।
১৩. জনার দেহত্যাগ ও অর্জ্জুনের
প্রতি গঙ্গার অভিশাপ
শ্রীজনমেজয় বলে শুন তপোধন।
কি যুক্তি করিল জনা কহ বিবরণ।।
বলেন বৈশম্পায়ন শুন নরপতি।
দুর্ব্বাক্য শুনিল বহু জনা গুণবতী।।
ভ্রাতার নিকট বড় পেয়ে অপমান।
মনেতে করিল যুক্তি ত্যজিব পরাণ।।
ভাগীরথী তীরে জনা গেল শীঘ্রগতি।
যোড় হাত হয়ে বলে আপন ভারতী।।
শুন গঙ্গাদেবী আমি করি নিবেদন।
তোমার সলিলে আমি ত্যজিব জীবন।।
নাশিল অর্জ্জুন মম পুত্র ধন প্রাণ।
আপনি করিবে মাতা ইহার বিধান।।
সেই হেতু চিত্তে বড় হৈল অভিমান।
কাতর হইয়া বলি তোমা বিদ্যমান।।
এত বলি গঙ্গাজলে প্রবেশ করিল।
পুত্রশোক পেয়ে জনা শরীর ত্যজিল।।
জনার মরণে শোক পেয়ে ভাগীরথী।
ক্রোধে অভিশাপ দিল অর্জ্জুনের প্রতি।।
সতীকন্যা মরে পার্থ তোমার কারণে।
সে সকল ভয় তোর নাহি হয় মনে।।
ভীষ্মে নিপাতিলে তুমি কপট করিয়া।
ভয় না করিলে পিতামহ যে বলিয়া।।
কৃষ্ণ সখা বলি তোর বাড়ে অহঙ্কার।
না বুঝ দেবের মায়া পাণ্ডুর কুমার।।
পৌন্ত্র হস্তে ভীষ্ম বীর ত্যজিল পরাণ।
তুমি ও পুত্রের হস্তে হারাইবে প্রাণ।।
শাপিলেন গঙ্গাদেবী তবে অর্জ্জুনের।
তাহা শুনি নারায়ণ চিন্তিত অন্তরে।।
ঈষৎ হাসেন কৃষ্ণ পাণ্ডব সভায়।
ব্যাসদেব বুঝিলেন তার অভিপ্রায়।।
জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির দেব নারায়ণে।
কহ কৃষ্ণচন্দ্র তুমি হাস্য কৈলে কেনে।।
গোবিন্দ বলেন শুন ধর্ম্ম নৃপবরে।
অভিশাপ হইল যে পার্থ ধনুর্দ্ধরে।।
গঙ্গা অভিশাপ দেন দুঃখ পেয়ে মনে।
তার মৃত্যু হবে বব্রুবাহনের রণে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন হইবে কেমনে।
অভিশাপ দেন গঙ্গা কিসের কারণে।।
গোবিন্দ বলেন রাজা কর অবধান।
মাহেশ্বরীপুরে রাজা নীলধ্বজ নাম।।
ধরিল যজ্ঞের ঘোড়া তাহার নন্দন।
অশ্ব হেতু অর্জ্জুনের সঙ্গে হৈল রণ।।
প্রবীর তাহার পুত্র হত হৈল রণে।
রাজারাণী তনুত্যাগ কৈল অভিমানে।।
গঙ্গাতে মরিল সেই পুত্রশোক পেয়ে।
গঙ্গা অভিশাপ দেন দুঃখিত হইয়ে।।
নীলধ্বজ অশ্ব দিল ধনঞ্জয় বীরে।
আপনি চলিল বীর অশ্ব রাখিবারে।।
অর্জ্জুন কারণে ভয় না করিহ তুমি।
সঙ্কট হইলে রক্ষা করিব সে আমি।।
এত বলি কৃষ্ণ প্রবোধেন যুধিষ্ঠিরে।
এই বিবরণ রাজা কহিনু তোমারে।।
অমৃত সমান এই ভারত কাহিনী।
আর কি কহিব আমি বল নৃপমণি।।
১৪. নীলধ্বজ-জামাতা অগ্নির বিবরণ
শ্রীজনমেজয় বলে, শুন তপোধন।
এই আমি তোমারে করি যে নিবেদন।।
রাজার জামাতা অগ্নি হইল কেমনে।
এই কথা কৃপা করি কহিবে আপনে।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন নরপতি।
এবে কহি নীলধ্বজ রাজার ভারতী।।
জনা নাম ধরে নীলধ্বজের মহিষী।
রতি জিনি রূপ তার পরমা রূপসী।।
জনা সঙ্গে নীলধ্বজ নানা কেলি করে।
দৈবযোগে গর্ভ তার হইল উদরে।।
লক্ষ্মী-শাপে সেই গর্ভে এল বসুমতী।
স্বাহা নাম হৈল তার, শুন নরপতি।।
পরমা সুন্দরী কন্যা বাড়ে দিনে দিনে।
চন্দ্রমার শোভা যেন পৌর্ণমাসী দিনে।।
কন্যা দেখি নৃপতির আনন্দ অপার।
স্বাহা বলি নাম রাজা রাখিল তাহার।।
হইল বিবাহকাল ভাবে মনে মনে।
অনুক্ষণ যুক্তি করে পাত্র মিত্র সনে।।
কারে কন্যা দান দিব, কোথা পাব বর।
কালাতীত হৈলে হবে অতি মন্দতর।।
কন্যা বলে, শুন পিতা আমার বচন।
মনুষ্যলোকেতে মম নাহি লয় মন।।
দেবপত্নী হব আমি ইথে নাহি আন।
সত্য কহিলাম পিতা তব বিদ্যমান।।
স্বাহা-বাক্যে পুছে রাজা হরিষ অন্তরে।
কাহারে বরিবে তুমি বলহ আমারে।।
কিবা ইন্দ্র চন্দ্র কিবা শমন পবন।
কুবের বরুণ অগ্নি কারে তব মন।।
শিব ব্রহ্মা বিষ্ণু আর যত দেবগণ।
কার পত্নী হবে তুমি, বলহ বচন।।
আমার অনেক ভাগ্য ইথে নাহি আন।
দেবপত্নী হবে তুমি আমার সম্মান।।
স্বাহা বলে, শুন পিতা আমার বচন।
জীবনে মরণে অগ্নি, বলে সর্ব্বজন।।
শিশুকাল হৈতে মোর অনলে ভকতি।
শুন পিতা অগ্নিপূজা কর নিতি নিতি।।
অনল আমার স্বামী, কহিনু তোমারে।
তাঁহাকে আনিয়া দেব বিবাহ আমারে।।
রাজা বলে, কোথা পাব তাঁর দরশন।
স্বাহা বলে, আসিবেন করিলে স্বরণ।।
এত বলি রাজকন্যা পূজে বৈশ্বানরে।
স্তুতি করে স্বাহাদেবী যুড়ি দুই করে।।
স্বাহার স্তবেতে বশ হৈল বৈশ্বানর।
রহিতে না পারি আসি কহেন সত্বর।।
নিজ অভিলাষ মোরে কহ গুণবতী।
কিসের কারণে মোরে পূজ নিতি নিতি।।
স্বাহা বলে, তুমি মোরে করহ গ্রহণ।
তব পত্নী হব আমি, এই নিবেদন।।
এই হেতু স্তব করি, পূজি যে তোমারে।
এই অভিলাষ, বর দেহ ত আমারে।।
এবমস্তু বলি অগ্নি সেই বর দিল।
বর পেয়ে স্বাহা মনে সম্প্রীতি পাইল।।
জানাইল পিতৃদেবে অগ্নি-আগমন।
শুনিয়া হইল রাজা আনন্দিত মন।।
যোড়হাতে বিনয় করেন নরপতি।
কন্যাদান অগ্নিদেবে করে শীঘ্রগতি।।
যোড়হাত হয়ে রাজা বলিল অগ্নিরে।
স্বাহা নামে কন্যা আমি দিলাম তোমারে।।
আপনি করিবে দেব আমার রক্ষণ।
ধন জন রাজ্য তোমা করিনু অর্পণ।।
বিপক্ষ না আসে যেন আমার নগরে।
সতত থাকিবে তুমি আমার মন্দিরে।।
তথাস্তু বলিয়া অগ্নি সেই বর দিল।
স্বাহার সহিত তার বিবাহ হইল।।
বিপক্ষ না যায় কেহ নীলধ্বজ-পুরে।
ওহে রাজা কহি শুন অনলেন ডরে।।
কন্যা দিয়া অগ্নিদেবে রাখে নরপতি।
কহিনু তোমারে আমি পূর্ব্বের ভারতী।।
১৫. পৃথিবীর প্রতি লক্ষ্মীর অভিশাপ
শ্রীজনমেজয় বলে, শুন মহামুনি।
পূর্ব্ব বিবরণ কথা তোমা হৈতে শুনি।।
লক্ষ্মী কেন পৃথিবীকে অভিশাপ দিল।
কহ দেখি পৃথিবীর কি পাপ আছিল।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুনহ রাজন।
সংক্ষেপে তোমারে কহি সে সব কথন।।
লক্ষ্মী সঙ্গে নারায়ণ থাকেন সতত।
নানা কেলি কলারস করেন বহুত।।
অপার মহিমা তাঁর কে বুঝিতে পারে।
অবিরত কমলা থাকেন বক্ষোপরে।।
তাহা দেখি বসুমতী কহেন লক্ষ্মীরে।
তোমার সমান তপ কেহ নাহি করে।।
না দেখি এমন তপ, না শুনি শ্রবণে।
নারায়ণ সঙ্গে তুমি থাক রাত্রি দিনে।।
বক্ষঃস্থলে তোমারে ধরেন যদুপতি।
তোমার সমান কেহ নহে ভাগ্যবতী।।
কিন্তু কৃষ্ণ সনে তোমা বিচ্ছেদ করাব।
নারায়ণ সঙ্গে আমি সতত থাকিব।।
মহীবাক্য শুনি দেবী ক্রোধ উপজিল।
মনোদুঃখ পেয়ে অভিশাপ প্রদানিল।।
জন্মিবে জনার গর্ভে, হবে স্বাহা নাম।
অনল তোমার স্বামী, ইথে নাহি আন।।
পৃথিবী বলেন, তুমি শাপ দিলে মোরে।
নারায়ণ সহ দেখা নহিবে তোমারে।।
পৃথিবী পালিতে জন্মিবেন নারায়ণ।
সতত পাইব আমি তাঁর দরশন।।
অনুক্ষণ থাকিবেন গোবিন্দ আমাতে।
এত বলি বসুমতী গেলেন ত্বরিতে।।
শাপে বর পেয়ে তুষ্টা হইল ধরণী।
স্বাহা নাম হৈল নীলধ্বজের নন্দিনী।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র