সহজ ভাষায় বেদকে জানা

বেদ কি? কি আছে বেদে? কেন বেদ নিয়ে যুগ যুগ ধরে এত আলোচনা-সমালোচনা, এত তর্ক-বিতর্ক, এত গবেষণা চলছে। মতভেদ, কাল ও রচনা নির্ধারণে শাস্ত্রের প্রমাণক ও যুক্তিও সমান তালে চলছে। তবুও যেন তার শেষ হচ্ছে না। তার গভীরতা যেন পরিমাপ করা যাচ্ছে না। বেদকে জানার বা ধারণ করার যে জ্ঞান সে জ্ঞানই আমরা আয়ত্ব করতে পারছিনা। পৃথিবীর এমন কোন জায়গা নেই যেখানে বেদ নিয়ে স্বপক্ষেই হোক বা বিপক্ষেই হোক আলোচনা করা হয়নি বা করা হচ্ছে না।
বেদ কি? কেবলই একটি গ্রন্থ? কেবল মাত্র শ্লোক বা মন্ত্র? বেদ কি সেই উদাত্তাদি স্বর-যে স্বরে বেদ মন্ত্র উচ্চারিত হয়? বেদ কি যাগ-যজ্ঞাদি কর্ম মাত্র? জ্ঞানীগণ তাদের জ্ঞানের ভান্ডার থেকে বিভিন্নভাবে বেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। বেদ শব্দটি সংস্কৃত বিদ ধাতু হতে উৎপত্তি হয়েছে। ‘বিদ’ধাতুর অর্থ ‘জানা বা জ্ঞান’। ইংরেজী wit শব্দ এই বিদ ধাতুর রূপান্তর। কেবল জানা বললেই কি সব জানা শেষ হয়ে যায়। ধর্ম জানা, অধর্ম জানা, সত্য জানা, অসত্য জানা, স্বরূপ জানা ইত্যাদি। জ্ঞানলাভের জন্য দুটি উপায় আছে- বুদ্ধি ও বোধি। বুদ্ধি দিয়ে আমার অনেক কিছূ জানতে পারি কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন ‘বোধি’। যা দ্বারা ধর্মাধর্মের সত্যাসত্যের জ্ঞানলাভ হয় অর্থাৎ যা দ্বারা স্বরূপ জানা যায়, এক কথায় যা দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক সর্ববিধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায় তাই “বেদ”। জ্ঞান সত্য, জ্ঞান নিত্য, জ্ঞান সনাতন, জ্ঞান অপৌরূষেয়, সুতরাই জ্ঞানই ধর্ম। যা জ্ঞানের বিপরীত তাই অধর্ম।
শ্রীঅরবিন্দ তার Life Divine নামক দিব্যগ্রন্থে বোধির নাম দিয়েছেন Pure reason.তার ভাবার্থ এ রকম-“ভাগবত জীবনের জ্ঞান অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজাত। এই পৃথিবী ও তাহার প্রাকৃতিক ঘটনা আমাদের বৃদ্ধির আলোতে ধরা পড়ে-কিন্তু শারীর বুদ্ধি সেই অতীন্দ্রিয় রহস্যের সন্ধান জানে না- তাহার জন্য চাই নির্মল বোধি।” এ জন্যেই শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
প্রত্যক্ষেণানুমিত্য বা যস্তুপায়ো ন বুধ্যতে।
এতং বিন্দতি বেদেন তস্মাৎ বেদস্য বেদতা।।
অর্থাৎ যা প্রত্যক্ষ বা অনুমানের দ্বারা জানা যায় না, বেদে তা জানা যায়, অনুমান ও প্রমাণের অজ্ঞাত সামগ্রীর সন্ধান করে বলেই বেদের বেদত্ব। যা স্বপ্রমাণ, যা স্বত:সিদ্ধ, যা প্রমাণের আবশ্যক করে না তাই ‘বেদ’। শ্রুতি বলেছেন-‘বিজ্ঞানং ব্রহ্মেতি ব্যজানা’ অর্থাৎ জ্ঞানও যা ব্রহ্মও তা। প্রাচীন ঋষিগণ বলেছেন- ‘ন বেদা বেদমিত্যাহুর্বেদো ব্রহ্ম সনাতনম’ অর্থাৎ মন্ত্রাদিসম্বলিত পুস্তকখন্ড মাত্র বেদ নহে; সনাতন ব্রহ্মকেই বেদ বেলে। ‘বেদ’ তারাই নাম যা সত্যরূপ, জ্ঞানরূপ ও প্রমাণরূপে চিরবিদ্যমান আছে। সাংখ্যগণ বলেন যে- ‘বেদ অনাদিং বীজাঙ্কুরবৎ’অর্থাৎ বৃক্ষ আগে না বীজ আগে? ইহা যেমন নির্ণয় করা যায় না; সেরূপ জ্ঞারূপ বেদের ও সেরূপ উৎপত্তি ও লয় নির্ণয় করা যায় না। যা পুরুষকৃত তার উৎপত্তি ও নাশ আছে। কিন্তু জ্ঞানের আদি অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে? সুতরাং বেদ অনাদি অপৌরুষেয়। শ্রীমৎশঙ্করাচার্য্য বলেন- 'বেদশব্দেন তু সর্বত্র শব্দরাশির্বিবক্ষিত:।' বেদের শব্দরূপ চারিভাগে বিভক্ত। যথা- ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। মহর্ষি আপস্তম্ব বলেন-‘মন্ত্র ব্রাহ্মণর্য়ো বেদ নামধেয়ম’। মন্ত্র-রূপ ও ব্রাহ্মণ-রূপ শব্দরাশিই ‘বেদ’। মন্ত্র হচ্ছে জ্ঞানমূলক। মন্ত্রের আরেক নাম হচ্ছে সংহিতা। এ সংহিতা ভাগেই রয়েছে ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। অর্থাৎ মন্ত্রভাগ বলতে আমার চারিবেদকে বুঝি। ঋকবেদ পদ্যে, যজুর্বেদ গদ্যে ও সামবেদ গীত এ বিভক্ত ছিল। সাধারণত: যজ্ঞ কর্মের সুবিধার জন্যেই বেদকে চারটি ভাগ করা হয়। কারণ তখনকার সময়ে যজ্ঞকর্মই প্রচলিত ছিল। যজ্ঞকর্মের প্রয়োজনীয় অংশ ব্যতীত অন্যান্য অংশ অথর্ববেদে অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ যজ্ঞের অপ্রয়োজনীয় অংশ অথর্বেবেদে লিপিবদ্ধ হয়। এজন্যে ইহার নাম হয় অথর্ববেদ। সংহিতা অংশে বৈদিক দেবতাদের স্তব-স্তুতি ও দার্শনিক বিষয়াদি আছে। আর ব্রাহ্মণ হচ্ছে কর্মবিধি (বিধি, নিষেধ, যজ্ঞ, ইতিহাস ও অর্থবাদ প্রভৃতি নিয়ে গদ্য অংশ)। ব্রাহ্মণ অংশকে আবার আরণ্যক বলা হয়। কারণ ঋষিগণ অরণ্যে বসে বানপ্রস্থ আশ্রমে ধ্যান ও উপাসনা করতেন। আরণ্যেকের উপসংহার হচ্ছে উপনিষৎ। উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষৎ নিয়ে বিশাল জ্ঞানের ভান্ডারকে একত্রে বলা হয় বেদ-সাহিত্য। এ সাহিত্যের আবার দুটি ভাগ আছে। একভাগকে বলা হয় কর্মকান্ড ও আরেক ভাগকে বলা জ্ঞানকান্ড। জ্ঞানকান্ড হচ্ছে সেই কান্ড যেখানে আরণ্যক ও উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা করা হয়। আর কর্মকান্ডে যজ্ঞ বিষয়ক কার্যাদি সন্নিবেশিত। ঋষিগণকে বেদমন্ত্রের দ্রষ্টা বলা হয়। তাদের অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বেদ প্রতিভাত হয়েছিল। পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে-
ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তার:।
ন কশ্চিদ্বেদকর্তা চ বেদস্মর্তা চর্তুভূজ:।।
যুগান্তেহন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্মহর্ষয়:।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা: স্বয়ম্ভুবা।।
অর্থ: ঋষিরা মন্ত্রদ্রষ্টা, তারা বেদকর্তা নয়। কেহই বেদের কর্তা নয়, চতুর্মুখ ব্রহ্মা বেদস্মর্ত্তা। প্রলয়ে বেদ অন্তর্হিত হয়, স্বয়ম্ভুব দ্বারা অনুজ্ঞাত হয়ে মহর্ষিরা তপস্যাপূর্বক ইতিহাসসহ সেই বেদ লাভ করেন।
তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষি কবে কখন কোথায় এ বেদমন্ত্র উপলব্দি করেছিলেন তার কোন ইতিহাস নেই। বেদের কাল নিরূপন করাও দুরূহ বিষয়। তবে এ কথা ঠিক মন্ত্রগুলি বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দেশে রচিত। শুধু গুরু পরম্পরায় সেই মন্ত্র ও জ্ঞানরাশি বহু বছর ধরে একটি বৈদিক ধারার সৃষ্টি করে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সমস্ত বেদ সংকলিত করে চারিভাগে বিভক্ত করে তার চার শিষ্যকে বেদ জ্ঞান দান করেন। পৈলকে তিনি ঋকবেদ জ্ঞান দান করেন, বৈশম্পায়নকে যজুর্বেদ জ্ঞান দান করেন, জৈমিনিকে সামবেদ জ্ঞান দান করেন এবং সুমন্তুকে অথর্ববেদ জ্ঞান দান করেন।{(বেদান্ত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)(চলবে)}

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র