মহাভারত:আশ্রমিকপর্ব-০০১-০০৫

০১. ধৃতরাষ্ট্রের বৈরাগ্য ও বিদুরের
সহিত কথোপকথন
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়কহ মহামুনি।
তদন্তরে কি কর্ম্ম হইল তাহা শুনি।।
পিতামহ উপাখ্যান অপূর্ব্ব চরিএ।
তোমার প্রসাদে শুনি হইব পবিত্র।।
অম্বমেধ যজ্ঞ শেষে পিতামহগণ।
কি কি কর্ম্ম করিলেন কহ তপোধন।।
কি করিল অন্ধরাজ সুবল নন্দিনী।
নারীগণ কি করিল কহ শুনি মুনি।।
শুনিতে আনন্দ বড় জন্মায় অন্তরে।
মুনিরাজ দয়া করি বলহ আমারে।।
মুনি বলিলেন রাজা কর অবধান।
অতঃপর শুন পিতামহ উপাখ্যান।।
যজ্ঞ কর্ম্ম সমাপিয়া ভাই পঞ্চজন।
দিলেন ব্রাক্ষ্মণগণে বহুবিধ ধন।।
হেনমতে পঞ্চভাই হরিষ অন্তর।
নানা দান উৎসব করেন নিরন্তর।।
যজ্ঞ বিনা সে সবার অন্যে নাহি মতি।
ভ্রাতৃসহ বঞ্চেন শুনহ নরপতি।।
সত্যধর্ম্মশাস্ত্র আর প্রজার পালন।
দুষ্ট চোর ভয় খন্ডে বৈরীর মর্দ্দন।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।
অনুক্ষণ ধর্ম্ম বিনা গতি নাহি আর।।
দাস দাসী প্রজা আদি অনুগত জনে।
রাজার পালনে সবে সদা হৃষ্টমনে।।
ভ্রাতৃঘণ সহ তথা ধর্ম্মের নন্দন।
ইষ্ট তুল্য ধৃতরাষ্ট্রে করেন সেবন।।
ভীমার্জ্জুন আর দুই মাদ্রীর নন্দন।
সতত রহেন ধৃতরাষ্ট্রের সদন।।
ভীমসেন মহাবীর পবন নন্দন।
পূর্ব্ব দুঃখ অন্তরে না হয় পাসরণ।।
স্মরিয়া সে সব দুঃখ ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
ক্রোধ করি অন্ধরাজে কহে কটুভাষ।।
পূর্ব্ব কথা বুঝি প্রায় হৈলে পাসরণ।
জতুগৃহে পোড়াইলে আমা পঞ্চজন।।
খলমতি কদাচারী তুমি কুরুকুলে।
আমা সবা হিংসা করি সবংশে মজিলে।।
শত পুত্র তব আমি করিনু সংহার।
তবু দুঃখ পাসরণ নহেত আমার।।
এত বলি দুই বাহু করে আস্ফালন।
দন্ত কড়মড় করে অরুণ লোচন।।
ভীমবাক্যে ধৃতরাষ্ট্র সর্ব্বদা অস্তির।
অন্তরে অনল দহে কুরু মহাবীর।।
অর্জ্জুন সহিত দুই মাদ্রীর নন্দন।
ধৃতরাষ্ট্র আজ্ঞাতে চলেন অনুক্ষণ।।
ভীম বাক্যজালে রাজা দহে কলেবর।
দ্বিগুন পূর্ব্বের শোক দহয়ে অন্তর।।
হায় পুত্র দুর্য্যোধন বীর চুড়ামণি।
তোমার বিরহে দহে এ পাপ পরানী।।
এক পুত্র হৈলে লোকে আনন্দ অপার।
তোমা হেন শত পুত্র মরিল আমার।।
আজ্ঞাতে করিলে বশ পৃথিবীর রাজা।
ভক্তিভাবে তোমার চরণ কৈল পূজা।।
ইন্দ্রের বৈভব কৈলে পৃথিবী ভিতর।
তোমার জনক হনে হইল কাতর।।
এইরূপে অনুতাপ করে অনুক্ষণ।
দুই এক দিন রাজা না করে ভোজন।।
গান্ধারী প্রবোধ বহু করেন রাজারে।
সত্যবর্ম্ম বিচারিয়া বিবিধ প্রকারে।।
অকারণে তাপ কেন কর নরপতি।
কর্ম্ম অনুরূপ রাজা শুভাশুভ গতি।।
জানি পুনঃ শোচন না করে জ্ঞানবান।
আমারে যেরূপ ভাবে হৃদয় তোমার।।
সেইরূপ তোমা প্রতি হৃদয় আমার।
ভীম প্রতি যেইরূপ তোমার হৃদয়।।
সেইরূপ ভাবে ভীম শুন মহাশয়।
শিশুকাল হৈতে তুমি ভীমেরে হিংসিলা।।
অনেক মন্ত্রণা করি নানা দুঃখ দিলা।
ধৃতরাষ্ট্র বলে ভীম বড় দুরাচার।
একেশ্বর শত পুত্র মারিল আমার।।
তাহারে দেখিলে মম সর্ব্ব অঙ্গ দহে।
দ্বিগুন বাড়য়ে অগ্নি হৃদয়ে না সহে।।
যুধিষ্ঠির গুণ কথা না যায় বর্ণন।
সাধুপুত্র গুণবান ধর্ম্মের নন্দন।।
ভীমের এমন ভাব সে কিছু না জানে।
যা রহে জীবন মম ভীমের বচনে।।
এইরূপে অন্ধরাজ গান্ধারী সহিত।
হেনকালে বিদুর হইল উপনীত।।
প্রণমিয়া অন্ধেরে বিদুর মহামতি।
জিজ্ঞাসিল উচাটন কেন নরপতি।।
কোন দুঃখে দুঃখী তুমি কহত আমারে।
ইষ্টদেব তুল্য তোমা সেবে যুধিষ্ঠিরে।।
ভ্রাতৃগণে নিয়োজিল তোমার সেবনে।
অপর আছয়ে যত দাস দাসীগণে।।
ধর্ম্মপথে যুধিষ্ঠির নহে বিচলিত।
আর চারি সহোদর তার মনোনীত।।
রাজ্য অর্থ ধন আদি সকলি তোমার।
পিতৃতুল্য ভাবে তোমা ধর্ম্মের কুমার।।
আপন ইচ্ছায় তব যেই মনে লয়।
যত ইচ্ছা দান ভোগ কর মহাশয়।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে তুমি কহিলে প্রমাণ।
বেদতুল্য তব বাক্য কভু নহে আন।।
মমহিত উপদেশ যতেক কহিলা।
না শুনিনু তব বাক্য করে অবহেলা।।
সেই হেতু এই গতি হইল আমার।
তবে সুখ দুঃখ কথা কি আর বিচার।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির সর্ব্ব গুণাধার।
কোন দোষে দোষী নহে ধর্ম্মের কুমার।।
পুত্রের অধিক মম করয়ে সেবন।
তার গুনে হৈল মম শোক নিবারণ।।
কোন দোষে দোষী নহে রাজা যুধিষ্ঠির।
কিন্তু ভীম দুরাচার দহয়ে শরীর।।
কোন কর্ম্ম হেতু আমি যদি কহি তারে।
কর্ম্ম না করিয়া আর কহে কটুত্তরে।।
শত পুত্র মারি দুঃখ নহে নিবারণ।
দন্ত কড়মড় করে বাহু আস্ফালন।।
ভীমের চরিত্র দেখি দহে মম কায়।
কি কহিব কহ মোরে ইহার উপায়।।
বিদুর কহেন শুন স্থির কর মন।
ভীমের বচনে রাজা নহ উচাটন।।
অপমান করে তোমা যদি যুধিষ্ঠির।
তব যেই চিত্তে লয় কর নররব।।
তুমি যেই ভাবকর বৃকোদর প্রতি।
তোমারেও দুষ্টভাব করয়ে মারুতি।।
ইহা জানি কৃকোদরে ত্যজহ আক্রোশ।
যুধিষ্ঠির প্রতি তুমি নহ অসন্তোষ।।
তোমারে বিমনা যদি শুনে ধর্ম্মরায়।
এইক্ষণে আসিয়া পড়িবে তব পায়।।
তুমি অসন্তোষ যদি হও নরপতি।
রাজ্য ত্যজি বনে যাবে ধর্ম্ম নরপতি।।
তাহারে প্রসন্ন ভাব হও নরনাথ।
এত বলি বিদুর করিল প্রণিপাত।।
পুনরপি ধৃতারাষ্ট্র সকরুণে কয়।
যুধিষ্ঠির ক্রোধ মম কদাচিত নয়।।
আমি ধৃতরাষ্ট্র রাজা বিখ্যাত ভুবনে।
মহাধনুর্দ্ধর পুত্র একশত জনে।।
সকল সংহার মম করে যেইজন।
তাহার পালিত হয়ে রাখিব জীবন।।
ধিক্ ধিক্ জীবনে এমন ছার আশ।
সংসার যুড়িয়া লজ্জা লোকে উপহাস।।
দ্বিতীয় বাসব মম পুত্র দুর্য্যোধন।
তাহা বিনা পাপ প্রাণ রহে এতক্ষণ।।
এইরূপে শোচনা করিয়া বহুতর।
পুনঃ বিদুরের প্রতি করিল উত্তর।।
অবধানকরভ ভাই বচন আমার।
যে বিধান চিত্তে আমি করেছি বিচার।।
রাজ্য সুখ ভোগ নানা করিনু বিস্তর।
মম সম সুখ নাহি ভুঞ্জে কোন নর।।
অতঃপর চিত্তে সে সকল ক্ষমা দিব।
বনবাসে গিয়া আমি যোগ আরম্ভিব।।
রাজনীতি ধর্ম্ম হেন আছে পূর্ব্বাপর।
শেষকালে প্রবেশিবে অরণ্য ভিতর।।
অবশেষে কাল মম হৈল উপনীত।
যোগ ধর্ম্ম আচরণ হয়ত বিহিত।।
সত্য সত্য বনে যাব নাছিক সংশয়।
যোগ আচরিব গিয়া কহিনু নিশ্চয়।।
বিদুর বলেন রাজা কর অবধান।
যতেক কহিলে সত্য কভু নহে আন।।
রাজা হয়ে শেষকালে যাব বনবাস।
যোগ আচরিব গিয়া করিয়া সন্ন্যাস।।
বেদের বচন ইথে নাহিক সংশয়।
কিন্তু এক কথা কহি শুন মহাশয়।।
আপনি বৃদ্ধক অতি শরীর দুর্ব্বল।
শোকাতুর অন্ধ তব নয়ন যুগল।।
অভ্যন্তর যেতে তব নাহিক শকতি।
ঘোর বনে কিমতে পশিবে নরপতি।।
ভয়ঙ্কর বনজন্তু সিংহ ব্রাঘ্রগণ।
প্রলয় মহিষ গজ ঘোর দরশন।।
কিমতে রহিবে তথা তাহা মোরে কহ।
আর তাহে মহারাজ চক্ষে না দেখহ।।
অপমৃত্যু হয় পাছে এই বড় ভয়।
এই হেতু ইথে মোর চিত্তে নাহি লয়।।
সে কারণে কহি আমি গুন মহারাজ।
গৃহাশ্রমে থাকিয়া না হয় কোন কাজ।।
দ্বিজগণে দান দেহ বহুবিধ ধন।
প্রবাল মুকুতা মণি রজত কাঞ্চন।।
ভুমিদান অন্নদান আর নানা দান।
অন্ন দান নহে অন্য দানের সমান।।
যাহা ইচ্ছা দান কর আপনার মনে।
কৃষ্ণপদ চিন্তা কর বসিয়া নির্জ্জনে।।
সর্ব্ব কার্য্য সিদ্ধ যবে হবে এইমতে।
পাইবা উত্তম গতি শুন নরপতে।।
ধর্ম্মের নন্দন দেখ রাজা যুধিষ্ঠির।
ভ্রাতৃ মন্ত্রী বন্ধুশোকে আকুল শরীর।।
তোমার সেবন হেতু করে গৃহবাস।
তোমার এ মতি শুনি হইবে নিরাস।।
তোমা বিনা সকল ত্যজিবে ধর্ম্মরায়।
ব্রক্ষ্মচর্য্য আচরি কাননে পাছে যায়।।
এই হেতু রাজা আমি কহি যে তোমায়।
গৃহাশ্রমে রহি গতি চিন্তু কর রায়।।
ইহা বিনা উপায় নাহিক রাজা আর।
মম চিত্তে লয় রাজা এই তো বিচার।।
ধৃতরাষ্ট্র কহে তুমি পরম পন্ডিত।
তোমার বচন খ্যাত বেদের বিহিত।।
যতেক কহিলে কিছু না হয় বিধান।
কিন্তু এক কথা কহি কর অবধান।।
করুণানিদান সেই নন্দের কুমার।
করুণানিদান সেই নন্দের কুমার।
একমনে ভজিলে সে করয়ে উদ্ধার।।
সকল ইন্দ্রিয়গণ কর নিবারণ।
কায়মনোবাক্যেতে চিন্তিবে নারায়ণ।।
গৃহাশ্রমে হেন শক্তি নহিবে আমার।
সে কারণে বনে যেতে করেছি বিচার।।
বনজন্তুগণ হেতু কহিলে প্রমাণ।
আপন অদৃষ্ট ফল না হবে এড়ান।।
যা থাকে অদৃষ্টে তাহা অবশ্য হইবে।
পূর্ববার্জ্জিত ফল যাহা তাহা কে খন্ডাবে।।
অভয় পদারবিন্দ করিয়া ভাবন।
সর্ব্ব ভয় হইতে হইবে বিমোচন।।
ইহা ভিন্ন অন্য চিত্তে না লয় আমার।
বনবাসে যাইব কহিনু সারোদ্ধার।।
ধৃতরাষ্ট্র মন বুঝি বিদুর সুমতি।
আশ্বাসিয়া বলে পুনঃ শুন নরপতি।।
তুমি যদি বনবাসে যাইবা নিশ্চয়।
আমিও সংহতি তব যাব মহাশয়।।
আমি তব ভৃত্য, তুমি আমার ঈশ্বর।
ঈশ্বর বিহনে কিবা করিবে কিঙ্কর।।
যথায় যাইবা তুমি যাইব সংহতি।
তোমার যে গতি রাজা আমারসে গতি।
যুধিষ্ঠিরে প্রবোধ করিব বিধিমতে।
তাঁর অনুমতি বিনা না পারি যাইতে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে ‍তুলি কহ যুধিষ্ঠিরে।
সাত্ত্বনা পূর্ব্বক কহ বিবিধ প্রকারে।।
তুমি আমি গান্ধারী সঞ্জয় আদি করি।
নানামতে প্রবোধিব ধর্ম্ম অধিকারী।।
এত শুনি বিদুর চলিল ধর্ম্ম স্থানে।
বসিয়া আছেন ধর্ম্ম রত্নসিংহাসনে।।
পাত্র মিত্র ভ্রাতৃগণ চৌদিকে বেষ্টিত।
ব্রাক্ষ্মণমন্ডলী সঙ্গে ধৌম্য পুরোহিত।।
স্বধর্ম্মে করেন রাজ্য ধর্ম্মের নন্দন।
পুত্রবৎ পালেন যতেক প্রজাগণ।।
সর্ব্বজীবে সমভাব দয়ার ঈশ্বর।
ধর্ম্ম অবতার ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির।।
যুধিষ্ঠির গুণে বশ হৈল সর্ব্বজন।
শোক দুঃখ সকল হইল বিস্মরণ।।
প্রাতঃকালে উঠি রাজাকরি স্নান দান।
পাত্র মিত্র ভ্রাতৃগণে করেন সম্মান।
তদন্তরে দ্বিজগণে করিয়া সম্মান।
বিবিধ রতন দেন নাহি পরিমাণ।
অশ্ব বৃষ গাভী বৎস আর নানা ধন।
ভুমিদান অন্নদান বিবিধ বসন।।
হেনমতে দান কর্ম্ম করি সমাপন।
ধৃতরাষ্ট্রে গান্ধারীকে করি সম্ভাষণ।।
সেবায় নিযুক্ত করি ভ্রাতৃ বন্ধুজনে।
আজ্ঞা মাগি রাজকার্য্যে যান সেইক্ষণে।।
সিংহাসনে বসিয়া করেন রাজকার্য্য ।
পাত্রমিত্র ভ্রাতৃ বন্ধু সহিত সাম্রাজ্য।।
রাজকার্য্য অবসানে আসিয়া মন্দিরে।
ব্রাক্ষ্মণে করেন পূজা নানা উপচারে।।
যাহাতে যাহার প্রীতি ভক্ষ্যদ্রব্য আদি।
সবারে করেন দান সহিত দ্রৌপদী।।
যথোচিত তৃপ্ত করি অন্ধ নরবরে।
সেইমত গান্ধারীকে পূজেন সাদরে।।
দোঁহা অনুমতি লয়ে বিদায় হইয়া।
ভোজন করেন রাজা বন্ধুগণ লৈয়া।।
এইমত নিত্যকর্ম্ম করি ধর্ম্মরায়।
সাধু সর্ব্বগুণান্বিত অপ্রমিত কায়।।
ভারত আশ্রমপর্ব্ব অপূর্ব্ব আখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।
০২. ধৃতরাষ্ট্রের বনগমনেচ্ছা শুনিয়া
যুধিষ্ঠিরের খেদোক্তি
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ মুনিবর।
কহ শুনি কিবা কর্ম্ম হল তারপর।।
মুনি বলে শুন কুরুকুল অধিকারী।
বিদুর আইল যুধিষ্ঠির বরাবরি।।
রাজার নিকটে বসি বলয়ে বচন।
অবধানে শুন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।।
পরম ভাজন তুমি সাদু সুপন্ডিত।
তব গুণে বসুমতী হইল পূর্ণিত।।
তোমা হৈতে কুরুকুল পবিত্র হইল।
তোমার সমান রাজা না হবে নহিল।।
যত রাজকর্ম্ম নীতি, শাস্ত্রেতে বাখানে।
সকল তোমাতে পূর্ণ, তুমি পূর্ণ গুণে।।
যেই কৃষ্ণ অনাদি পুরুষ সনাতন।
যাঁর তত্ত্ব না পান স্বয়ম্ভূ পঞ্চানন।।
আগমে কিঞ্চিৎ তত্ত্ব না পায় যাঁহার।
হেন প্রভু বশ হৈল গুণেতে তোমার।।
ব্রাক্ষ্মণ সেবার গুণ কে বলিতে পারে।
সকল ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠ সংসার ভিতরে।।
ব্রাক্ষ্মনেতে প্রীতি হন দেব নারায়ণ।
এই হেতু দ্বিজসেবা কর অনুক্ষণ।।
পাত্রমিত্র প্রজা বন্ধু সুহৃদ সুজন।
সদয় হৃদয়ে কর সবার পালন।।
এইমত বিধিমত কহিয়া রাজারে।
কহিলেন শেষ ধৃতরাষ্ট্রের উত্তরে।।
ধৃতরাষ্ট্র পাঠাইল তোমার সদনে।
এই ভিক্ষা দেও মোরে প্রসন্ন বদনে।।
রাজার নিয়ম এই আছে পূর্ব্বাপর।
ক্ষত্রধর্ম্ম বিধি নীতি বেদের উত্তর।
রাজা হয়ে করিবেক প্রজার পালন।
দান ব্রত যজ্ঞ নানা ধর্ম্ম উপার্জ্জন।।
শেষকালে তনয়েরে রাজ্য ভার দিয়া।
বনবাস করিবেন যোগ আচরিয়া।।
ফলমুলাহারী হয়ে করিবে বসতি।
সমাধি সাধিয়া লভিবেক দিব্যগতি।।
সে কারণে ধৃতরাষ্ট্র পাঠাইল মোরে।
সান্ত্বনা পূর্ব্বক তোমা কহিবার তরে।।
অবশেষে কাল এই হইল আমার।
কুলধর্ম্ম মত আমি করিব আচার।।
যথাশক্তি কিছুমাত্র যোগ আচরিব।
তব অনুমতি হলে কাননে পশিব।।
বিদুর বচন শুনি যেন বজ্রাঘাত।
পড়িল অস্থির হয়ে পান্ডবের নাথ।।
কি বলিলা খুল্লতাত নিষ্ঠুর বচন।
কোন দোষে জৌষ্ঠতাত করেন বর্জ্জন।।
জ্যেষ্ঠতাত মোরে যদি ত্যজিবে নিশ্চয়।
তবে আর কিসের আমার গৃহাশ্রয়।।
আমিও সন্ন্যাসী হৈয়া যাব বনবাসে।
কি করিব ধন জন বন্ধু গ্রাম দেশে।।
এত বলি যুধিষ্ঠির আকুল হৃদয়।
বিদুর সহিত যান অন্ধের আলয়।।
কান্দেন অন্ধের পদ ধরি ধর্ম্মরায়।
কোন দোষে তাত তুমি ত্যজিবা ‍আমায়
রাজ্য দেশ ধন জন সকলি তোমার।
তোমা বিনা পান্ডবের কেবা আছে আর
কোন দোষে দোষী আমি নাহি তব পদে।
বালকেরে ত্যাগ কর কোন অপরাধে।।
আমি রাজা হৈতে যদি দুঃখ তব মনে।
আমি অভিষেক করি তোমার নন্দনে।।
যুযুৎসুরে অভিষেক করিব এখনি।
হস্তিনার পাটে তারে দিব রাজধানী।।
তোমার কিঙ্কর আমি, তুমি মম প্রভু।
তোমার আদেশ আমি লঙ্ঘি নাই কভু।।
যুযুৎসু আছয়ে সেই তোমার নন্দন।
বৈশ্যার কুমার, তারে জানে সর্ব্বজন।।
তথাপি তাহারে আমি রাজ্যভার দিব।
যে আজ্ঞা করিবে তুমি এখনি করিব।।
এইক্ষণে প্রাণ আমি ছাড়িবারে পারি।
তোমার বচন আমি লঙ্ঘিবারে নারি।।
ক্ষমা কর অপরাধ হয়ে সুপ্রসন্ন।
নহে আমি এইক্ষণে হই অবসন্ন।।
এইরূপে ‍যুধিষ্ঠিরে সহ ভ্রাতৃগণ।
লোটাইয়া ধরিলেন অন্ধের চরণ।।
তুষ্ট হয়ে ধৃতরাষ্ট্র কহে যুধিষ্ঠিরে।
আলিঙ্গন করি কহে মধুর উত্তরে।।
কোন দোষে দোষী তুমি নহ মম স্থানে।
পরম সন্তুষ্ট আমি হই তব গুণে।।
ইষ্টদেব তুল্য তুমি করহ সেবন।
তব গুণে হৈল সব শোক পাসরণ।।
দুঃখ না ভাবিহ তাত, স্থির কর মন।
আমার অপ্রিয় তুমি নহ কদাচন।।
সর্ব্বসুখ ভুঞ্জিলাম তোমার কল্যাণে।
অবশেষে কাল আসি হৈল এইক্ষণে।।
পরকাল চিন্তিবারে হয়ত উচিত।
ইহাতে সম্মতি দান হয়তো বিহিত।।
রাজধর্ম্ম-নীতি যাহা বেদের উত্তর।
শেষকালে পশিবেক অরণ্য ভিতর।।
যথাশক্তি যোগ করিবেক আচরণ।
সকল ইন্দ্রিয়গণ করি নিবারণ।।
যত যত হৈল রাজা এ মহীমণ্ডলে।
এই অনুসারে কর্ম্ম করিল সকলে।।
আমিও সাধিব যোগ শক্তি অনুসারে।
প্রসন্ন হইয়া তাত বলহ আমারে।।
তুমি সাধু শুদ্ধমতি, তুমি গুণবান।
পৃথিবীর মধ্যে তাত তোমার বাখান।।
আমা হৈতে দুঃখ পাইয়াছ বহুতর।
সে সব স্মরণে মম বিদরে অন্তর।।
ধর্ম্মবলে সকল সঙ্কটে হৈলে পার।
শত্রু জিনি উদ্ধারিলে নিজ রাজ্যভার।।
স্বচ্ছন্দে ভুঞ্জহ রাজ্য আমার পীরিতি।
নানা ধন উপার্জ্জন কর রাজনীতি।।
বন্ধুগণ পালহ, পালহ প্রজাগণ।
উদ্বেগ ছাড়িয়া রাজকার্য্যে দেহ মন।।
যুযুৎসু আছয়ে যে আমার নন্দন।
বৈশ্যার উদরে জন্ম বিখ্যাত ভুবন।।
রাজ্যযোগ্য সেই জন নহে কদাচন।
আপনি করিবে তুমি তাহারে পালন।।
এই ভিক্ষা মাগি আমি শুন ধর্ম্মরায়।
মায়া মোহ ছাড়ি মোরে করহ বিদায়।।
এত বলি করিলেন মস্তক চুম্বন।
বহু আশীর্ব্বাদ কৈল অম্বিকা-নন্দন।।
কান্দেন চরণ ধরি ধর্ম্মের তনয়।
বালকের প্রতি তাত না হও নির্দ্দয়।।
যত ইচ্ছা ধন রত্ন দ্বিজে দেহ দান।
গৃহাশ্রমে থাকি কর যোগ জপ ধ্যান।।
গৃহাশ্রমে সর্ব্ব ধর্ম্ম পাই নরনাথ।
হোম যজ্ঞ ব্রত ধর্ম্ম দান কর তাত।।
দারুণ ভারত-যুদ্ধে হৈল কুলক্ষয়।
সেই তাপে সদা মম দহিছে হৃদয়।।
তোমা দরশনে মম স্থির তবু মন।
সর্ব্বতাপ সম্বরিনু তোমার কারণ।।
তোমার কারণে আমি করি ‍গৃহবাস।
পূর্ব্বেতে যাইতেছিনু লইয়া সন্ন্যাস।।
রাজ্য ধন অর্থে মোর নাহি প্রয়োজন।
সকল সম্পদ মম তোমার চরণ।।
তোমার বিহনে মোর না রহিবে প্রাণ।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমার বিদ্যমান।।
এইমত ধর্ম্মরাজ করেন মিনতি।
সান্ত্বাইতে না হইল কাহার শকতি।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুমত।
একমনে সাধু সব পিয়ে অবিরত।।
০৩. ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর কথোপকথন
এইরূপে অন্ধরাজ ভাবিতে ভাবিতে।
কাটালেন পঞ্চদশ বর্ষ হস্তিনাতে।।
ভোজনে না রুচে অন্ন নিদ্রা নাহি হয়।
নিরন্তর অন্ধরাজ চিন্তিত হৃদয়।।
কি করিব, কি হইবে, চিন্তা অনুক্ষণ।
গৃহবাস হৈল মোর নিগড় বন্ধন।।
যুধিষ্ঠির কদাচিৎ না ছাড়িবে মোরে।
কি কর্ম্ম করিব, বৃদ্ধ গৃহ-কারাগারে।।
কিমতে যাইব বনে, না দেখি উপায়।
দুই চক্ষুহীন বিধি করিল আমায়।।
আহা বিধি কোন্ বুদ্ধি করিব এখন।
কিরূপে হইবে মোর কারা-বিমোচন।।
কোন্ রূপে পরলোকে পাইব সদগতি।
কোন্ রূপে ধর্ম্মপথে হইবেক মতি।।
এই অনুশোচ করে দিবস রজনী।
গান্ধারীরে চাহি বলে কুরু-নৃপমণি।।
অবধান কর দেবি বচন আমার।
গৃহবাস হৈল মোর মহা কারাগার।।
মহাপাশে বান্ধিয়া রাখয়ে যেন লোকে।
তেমতি বন্ধনে আছি দৈবের বিপাকে।।
বিধি মোরে বিড়ম্বিল করি নানা পাকে।
মহামায়া জালে বন্দী করিল আমাকে।।
পরবশবর্ত্তী হয়ে আজন্ম বঞ্চিনু।
আপনার বংশ আমি আপনি নাশিনু।।
পাপ চেষ্টা করি জন্ম গেল মিছা কাজে।
কিরূপে পাইব ত্রাণ ভবসিন্ধু মাঝে।।
না দেখি উপায়, ভবসিন্ধু ঘোরতর।
কিরূপে হইব পার দুস্তর সাগর।।
এখন না চিন্তি যদি ইহার উপায়।
নিশ্চয় ঠেকিব ঘোর শমনের দায়।।
সেই ভয়ে ত্রাণকর্ত্তা প্রভু নারায়ণ।
ভক্তি বিনা বশ প্রভু নহে কদাচন।।
দান যজ্ঞ ব্রত হোম করে অনুব্রতে।
হরিভক্তি সমান নাহিক ত্রিজগতে।।
অভয় পদারবিন্দে ভক্তি আছে যার।
হেলায় তরিবে সেই এ ভবসংসার।।
হেন প্রভু ভক্তি আমি করিব কেমনে।
উপায় নাহিক মম এ ছার জীবনে।।
গান্ধারী বলয়ে, রাজা কহি সারোদ্ধার।
নিজ কর্ম্ম সাধিবারে হয়ত বিচার।।
ব্রহ্মচর্য্য আচরণ হয়ত বিধান।
হরি ভক্তি বিনা রাজা কর্ম্ম নাহি আন।।
যুধিষ্ঠির ছাড়িয়া না দিবে কদাচিৎ।
না মানিব উপরোধ, যাইব নিশ্চিত।।
তপোবনে প্রবেশিয়া তপ আচরিব।
যোগ আচরিয়া ভবসিন্ধু পার হব।।
ইহা বিনা কিবা আর আছয়ে উপায়।
ইথে অসম্মত কেন হয় ধর্ম্মরায়।।
এইরূপে বিচার করয়ে দুইজন।
নিশ্চিত যাইব বনে, নাহি নিবারণ।।
ভারতে আশ্রমপর্ব্ব অপূর্ব্ব কথন।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচন।।
০৪. ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও বিদুরের
অরণ্যযাত্রা শ্রবণে কুন্তীর আগমন
রজনী প্রভাত, উঠি নরনাথ,
বিদুরে ডাকিয়া আনি।
গদ গদ স্বরে, কহেন বিদুরে,
ধৃতরাষ্ট্র নৃপমণি।।
এস ভাই মোর, প্রাণের দোসর,
সাধু সর্ব্ব গুণাশ্রয়।
দেবগুরু জিনি, বুদ্ধিমত্ত গণি,
ক্ষিতি সম ক্ষমাময়।।
তুমি মোর মন, আত্মা প্রাণ ধন,
হিত উপদেশ কহ।
অতঃপর আমি, হব বনগামী,
এই যুক্তি ভাই দেহ।।
তোমার কল্যাণে, পশিব কাননে,
সাধিব আপন কাজ।
সাধি যোগ ভক্তি, পাব অব্যাহতি,
এ ভব-সংসার মাঝ।।
ধর্ম্মের নন্দন, শুনিলে এমন,
যাইতে না দিবে মোরে।
আপন ইচ্ছায়, যাব সর্ব্বদায়,
উপরোধে কিবা করে।।
ঘোর তপোবনে, পশিব কেমনে,
যুক্তি দেহ তুমি মোরে।
এত শুনি কথা, নোয়াইয়া মাথা,
ক্ষত্তা কহে যোড় করে।।
আমি তব ভৃত্য, আজন্ম পালিত,
আমার ঈশ্বর তুমি।
তুমি যদি বন, করিবে গমন,
কি আর করিব আমি।।
সংহতি যাইব, বনে প্রবেশিব,
তথায় করিব সেবা।
যে গতি তোমার, সে গতি আমার,
প্রভু পরিহারে কেবা।।
বিদুর বচন, শুনিয়া রাজন,
প্রশংসিল বহুতর।
ত্যজিয়া বসন, বাকল পিন্ধন,
করিলে নৃপবর।।
গান্ধারী সুন্দরী, পতি অনুসারি,
বাকল কৈল পিন্ধন।
জটা করি কেশ, তপস্বীর বেশ,
ধরিলেন তিন জন।।
হেনই সময়ষ আইল সঞ্জয়,
ধৃতরাষ্ট্র সম্ভাষণে।
করি প্রণিপাত, যুড়ি দুই হাত,
নিবেদয়ে সকরুণে।।
হের নরপতি, কর অবগতি,
তোমার কিঙ্কর আমি।
তোমার বিহনে, কি কাজ জীবনে,
সঙ্গে লহ মোরে তুমি।।
বিদুর সঞ্জয়, অন্বিকা-তনয়,
সুবল নন্দিনী আর।
শুভক্ষণ করি গৃহ পরিহরি,
বলে কৈল আগুসার।।
হেনকালে তথা, ভোজের দুহিতা,
পাইয়া সে সমাচার।
ত্যজিয়া মন্দির, হইল বাহির,
ত্যজি পুত্র পরিবার।।
তপস্বিণী-বেশে, আসি অন্ধপাশে,
প্রণমিয়া কহে বাণী।।
ওহে কুরুপতি, তোমার সংহতি,
কাননে যাইব আমি।।
সঙ্গে লহ মোরে, যাহ যথাকারে,
আমি অনুগত জনা।
তোমার প্রসাদে, তরিব আপদে,
করিব কৃষ্ণ-ভজন।।
শুনিয়া রাজন, আশ্বাস বচন,
দিলেন কুন্তীর তরে।
শুনি ভোজসুতা, হৈল হরষিতা,
গান্ধারী হৃষ্ট অন্তরে।।
ভারত শ্রবণ, কারণ তারণ,
এই মনে মোর আশ।
কৃষ্ণদাসাগ্রজ, কৃষ্ণ পদাম্মুজ,
বন্দি কহে কাশীদাস।।
০৫. ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী,
বিদুর ও সঞ্জয়ের অরণ্যযাত্রা
ধৃতরাষ্ট্র রাজা যান গহন কানন।
শুনিয়া ব্যাকুল চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।।
ভ্রাতৃগণ কৃষ্ণাসহ আসি দৌড়াদৌড়ি।
অন্ধরাজ গান্ধারী কুন্তীর পায়ে পড়ি।।
ধূলায় ধূসর হৈয়া করয়ে ক্রন্দন।
আনাথ হইল আজি পান্ডুপুত্রগণ।।
পিতৃশোক নাহি জানি তোমার কারণে
সর্ব্বশোক পাসরিনু তোমা দরশনে।।
তোমার বিহনে সব হৈল অন্ধকার।
কোন সুখে গৃহেতে রহিব মোরা আর।।
কি দেখি ধরিব প্রাণ উপায় কি হবে।
তোমার সহিত তাত বনে যাব সবে।।
এইরূপে যুধিষ্ঠির কান্দিয়া অপার।
প্রবোধ করেন সবে অশেষ প্রকার।।
বিদুর সঞ্জয় দোঁহে বিচারিয়া মনে।
ডাকিয়া নিভৃতে কহে মাদ্রীর নন্দনে।।
রাজার নন্দিনী কুন্তী রাজার গৃহিনী।
জনম দুঃখেতে গেল হেন অনুমানি।।
তোমরা উভয় তাঁর অতিপ্রিয়তর।
কুন্তীরে প্রবোধ দেহ দুই সহোদর।।
তোমা দোঁহাকার স্নেহ নারিবে ছাড়িতে।
যাইতে নারিবে কুন্তী হেন লয় চিতে।।
এত শুনি দুই ভাই চলিল তখন।
জননীর গলে ধরি কান্দে দুইজন।।
কোথায় যাইবে তুমি নিষ্ঠুর হইয়া।
কিমতে বঞ্চিত মোরা তোমা না দেখিয়া।।
যদি আমা দোঁহে ছাড়ি যাইবে কাননে।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমা বিদ্যমানে।।
এত বলি কান্দে দোঁহে উচ্চরব করি।
ব্যাকুল হইয়া চিত্তে ভোজের কুমারী।।
কি করিবে ইহার উপায় নাহি দেখি।
কহিতে লাগিল কুন্তী দ্রৌপদীরে ডাকি।।
তুমি শ্রদ্ধা পতিব্রতা লক্ষ্মী অবতার।
এই বাক্য প্রতিপাল্য করিবা আমার।।
এই দুই পুত্র মোর প্রাণের সমান।
এদিগে পালিবা তুমি হৈয়া সাবধানে।।
আমারে পাসরে যেন তোমার পালনে।
অনুমতি কর মাতা আমি যাই বনে।।
এত বলি শিরোঘ্রাণ করিল চুম্বন।
প্রণমিয়া যাজ্ঞসেনী করয়ে রোদন।।
পঞ্চপুত্র কোলে করি ভোজের নন্দিনী।
শিরে চুম্ব দিয়া করে আশীর্ব্বাদ বাণী।।
বিবিধ প্রকারে প্রবোধিয়া পঞ্চজনে।
চলিলেন কুন্তীদেবী ধৃতরাষ্ট্র সনে।।
উচ্চেঃস্বরে কান্দে সবে প্রবোধ না মানে।
শোকের নাহিক অন্ত ভাই পঞ্চজনে।।
মা মা বলি যুধিষ্ঠির ডাকেন সঘনে।
নির্দ্দযা নিষ্ঠুর মাতা হৈলা কি কারণে।।
সহদেব নকুল এ ভাই দুইজনে।
তিলেক না জীব মাতা তোমার বিহনে।।
পূর্ব্বে যবে বনে পাঠাইল দুর্য্যোধন।
মম মঙ্গে বনে গেল ভাই চারিজন।।
ঝরিত নয়ন সদা তোমার বিহনে।
তোমার ভাবনা বিনা না করিত মনে।।
তদন্তরে তোমার পাইয়া দরশন।
তিলেক বিচ্ছেদ নহে ভাই দুইজন।।
কেমনে চলিলা মাতা নির্দ্দয়া হইয়া।
এই দুই শিশু প্রতি না দেখ চাহিয়া।।
আমা সম ভাগ্যহীন নাহি অবনীতে।
জনম অবধি মজিলাম দুঃখ চিতে।।
ছার রাজ্য ধন মম ছার গৃহবাস।
তোমা বিনা হৈল মম সকল নিরাশ।।
ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির যত বধূগণ।
দুঃশলা সুন্দরী আদি কান্দে সর্ব্বজন।।
হাহাকার করি সবে কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
আমা সবা ছাড়ি কোথা যাও নৃপবরে।।
হাহা বিধি কি ‍উপায় করিব এখন।
এত ক্লেশে পাপ প্রাণ রহে কি কারণ।।
পাষাণে রচিত দেহ আমা সবাকার।
এতেক প্রহারে তনু না হয় বিদার।।
গড়াগড়ি যায় সবে ধূলায় ধূসর।
চিত্তের পুত্তলি প্রায় ভূমির উপর।।
দেখিয়া ব্যথিত হৈল বিদুর সুমতি।
ডাকদিয়া কহিলেন যুধিষ্ঠির প্রতি।।
শোক ত্যজ শুন রাজা আমার বচন।
আমা সবাকার শোক কর নিবারণ।।
ইহা সবাকার প্রতি করহ আশ্বাস।
প্রবোধিয়া সবাকারে লহ গৃহবাস।।
ধর্ম্মের নন্দন তুমি ধর্ম্ম অবতার।
তোমার এতেক মোহ অতি অবিচার।।
সবারে সান্ত্বনা করি স্থির কর মন।
তোমারে বুঝায় হেন আছে কোনজন।।
এইরূপে বিদুর কহিল বহুতর।
অনেক সান্ত্বনা করি পঞ্চ সহোদর।।
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন বিদুর সুমতি।
হেন অবধান কর বিদুরের প্রতি।।
এ সময় ব্রাক্ষ্মনেরে দিব কিছু দান।
কিছু ধন মাগি আন ধর্ম্মরাজস্থান।।
অন্ধের বচনে ক্ষত্তা কহে যুধিষ্ঠিরে।
কিছু ভিক্ষা চাহে তোমা অন্ধ নৃপবরে।।
ধর্ম্ম বলিলেন ভিক্ষা কিসের কারণ।
তাঁহারি সকল রাজ্য প্রজা ধন জন।।
আমি আদি সকল বিক্রিত তাঁর পায়।
হেন বাক্য কহিবারে তাঁরে না যুয়ায়।।
এত বলি যুধিষ্ঠির ডাকি ভ্রাতৃগণে।
ধন আনিবারে আজ্ঞা দিলেন তখনে।।
ধর্ম্মরাজ আজ্ঞা পেয়ে চারি সহোদর।
ভান্ডার হইতে ধন আনে বহুতর।।
প্রবাল মুকুতা স্বর্ণ মনি মরকত।
বিবিধ রতনরাশি কৈল শত মত।।
হরষিত অন্ধরাজ গান্ধারী সহিত।
দ্বিজগণে ধন দান কৈল অপ্রমিত।।
ভূমিদান অন্নদান করিল বিস্তর।
হস্তী অশ্ব ধেনু বৎস রত্ন বহুতর।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি রাজা দুর্য্যোধন।
সবাকার নাম করি দ্বিজে দিল দান।।
দানেতে তুষিয়া সব ব্রাক্ষ্মণ মন্ডল।
বনে যেতে অন্ধরাজ হইল বিকল।।
বহু আশীর্ব্বাদ কৈল ভাই পঞ্চজনে।
আলিঙ্গন শিরোঘ্রাণ করিল চুম্বনে।।
প্রণমিয়া পঞ্চ ভাই কান্দে চুম্বনে।
কৃতাঞ্জলি প্রণমিল গান্ধারীর পায়।।
আশীর্ব্বাদ কৈল দেবী প্রসন্নবদনে।
অঙ্গে হাত বুলাইয়া ভাই পঞ্চজনে।।
একে একে সবাকারে করিয়া বিদায়।
বনবাস গমন করিল কুরুরায়।।
গান্ধারীর স্কন্ধে আরোপিয়া বাম হাত।
ধীরে ধীরে চলিলেন কুরুকুল নাথ।।
গান্ধারীর বামভাগে চলিল সঞ্জয়।
অগ্রে অগ্রে চলিলেন ক্ষত্তা মহাশয়।।
হেনমতে অন্ধরাজ চলেন কানন।
দেখিবারে আইল সকল প্রজাগণ।।
বালবৃদ্ধ যুবা ধায় কুলবধূগণে।
ধৃতরাষ্ট্র বেশ দেখি কান্দে সর্ব্বজনে।।
ওহে অন্ধরাজ তুমি যাও কোথাকারে।
কি হেতু তপস্য বেশ ধরেছ শরীরে।।
দুই চক্ষু অন্ধ তব অর্পূর্ব্ব শরীর।
কি মতে ছাড়েন তোমা রাজা যুধিষ্ঠির।।
বাহড় বাহড় রাজা না যাও কাননে।
তোমার বিহনে রাজা জীবে কোনজনে।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।
সেবিবে তোমায় সেই ধর্ম্মের আচার।।
এইরূপে চতুর্দ্দিকে কাঁদে সর্ব্বজন।
প্রবোধিয়া ধৃতরাষ্ট্র চলিল কানন।।
পথ দেখাইয়া ক্ষত্ত, আগে আগে যায়।
কুরুক্ষেত্র নিকটে আইল কুরুরায়।।
তথা হৈতে চলি গেল জাহ্নবীর কূলে।
স্নানদান করিলেন নামি গঙ্গাজলে।।
বসিয়া গঙ্গার তীরে কথোপকথনে।
সেই দিন বঞ্চিল জাহ্নবী জলপানে।।
রজনী প্রভাত হৈল সূর্য্যের উদয়।
প্রভাতে উঠিয়া তবে বিদুর সঞ্জয়।।
গঙ্গার পশ্চিমে বন নামে দ্বৈপায়ন।
নানাবিধ বৃক্ষলতা শোভিত কানন।।
অশোক চম্পক বৃক্ষ পলাশ কাঞ্চন।
অর্জ্জুন খর্জ্জুর আম্র জাম তরু বন।।
রাজবৃক্ষ শাল তাল আর আমলকী।
কন্টকী দাড়িম্ব নারিকেল হরিতকী।।
শিরীষ কদম্ব ঝাটি বদরী খদির।
তিন্তিড়ী বহেড়া আর নারঙ্গ জন্বীর।।
দিবদারু ভদ্রারুক নিম্ব তরুবর।
বিচিত্র কদলীবৃক্ষ দেখিতে সুন্দর।।
নানা পুষ্প সৌরভে শোভিত বনস্থলী।
ভ্রমর গুঞ্জরে তাহে কোকিল কাকলী।।
বিচিত্র তুলসীবৃক্ষ অতি শুশোভন।
বিচিত্র মঞ্জরী তাহে নবদলগণ।।
আমোদে পূর্ণিত হয় সকল কানন।
পুষ্পভরে লম্ববান যত তরুগণ।।
মল্লিকা মালতী যূথী জাতি নাগেশ্বর।
করবী বকুল জবা রঙ্গন টগর।।
সেউতী মাধবীলতা কুটজ কিংশুক।
সেফালিকা সারি সারি দেখায় কৌতুক।।
নব নব দলেতে পূর্ণিত ফল ফুল।
তার গন্ধে মকরন্দ ধায় অলিকুল।।
ময়ূর কোকিলগণে করে কুহুরব।
মন্দ মন্দ সমীরণ বহে সুসৌরভ।।
বন দেখি আনন্দিত বিদুর সঞ্জয়।
হেথায় বঞ্চিব হেন চিন্তিল হৃদয়।।
দুইখানি কুটীর রচিল সেইখানে।
মনিগণ নিবসয়ে তার সন্নিধানে।।
সম্ভাষিয়া মুনিগণে করিয়া বিনয়।
অন্ধের নিকটে গেল বিদুর সঞ্জয়।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী সহিত ভোজসুতা।
সবে লয়ে কুটীরে আইল পুনঃক্ষত্তা।।
কানন নিবাসী যত ঋষি মুনিগণ।
আইল করিতে ধৃতরাষ্ট্র সম্ভাষণ।।
যথাবিধি সবাকারে পূজিয়া সাদরে।
হরযিতে জিজ্ঞাসিল অন্ধ নৃপবরে।।
মহামুনি ঋষিগণ ধৃতরাষ্ট্র প্রীতে।
আশ্রম করিয়া রহিলেন চতুর্ভিতে।।
দেখিয়া পাইল প্রীতি অন্ধ নরবরে।
ব্রক্ষ্মচর্য্য আচরিল শুদ্ধ কলেবরে।।
নিকটে জাহ্নবী নীরে স্নান দান করি।
হোমকর্ম্ম সমাপিয়া কুরু অধিকারী।।
গৃহমধ্যে কুশাসন করিয়া স্থাপন।
পূর্ব্বমুখে বসিলেন করি যোগাসন।।
হৃদয়ে পরম পদ চিন্তিয়া সাদরে।
মন্ত্র জপ করে অন্ধ ভক্তি পুরঃসরে।।
নিকটে বিদুর আর সঞ্জয় সুমতি।
যোগাসন কবি দোঁহে করিলেন স্থিতি।।
এইরূপে সকলে বসিল যোগাসনে।
মন্ত্র ধ্যান করি কৃষ্ণ জপেন সুক্ষণে।।
দিন শেষে বিদুর সঞ্জয় দুইজন।
ফল মূল আনি সবে করিল ভক্ষণ।।
পুন্যকথা আলাপেতে বঞ্চিয়া রজনী।
হেনমতে কাননে রহিল নৃপমণি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুন্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র