মহাভারত:বনপর্ব-০৩১-০৩৫

৩১. ভীমের প্রতি যুধিষ্ঠিরের প্রবোধ বাক্য
যুধিষ্ঠির বলে, ভীম কহিলে প্রমাণ।
পীড়িলে আমারে তুমি দিয়া বাক্যবাণ।।
আমা হতে দুঃখেতে পড়িলে তোমা সব।
আমা হেতু সহিলে শত্রুর পরাভব।।
ক্রোধের সমান শত্রু নাহিক সংসারে।
ক্রোধ হৈলে ভাল মন্দ বিচার না করে।।
মায়াবী শকুনি সহ খেলিনু যখন।
যত হারি, ক্রোধ করি তত করি পণ।।
না হৈল আমার শক্তি নিবৃত্ত হইতে।
আগু পাছু বিচার না করিলাম চিতে।।
এত অপকর্ম্ম করিবেক দুর্য্যোধন।
আমার এতেক জ্ঞান না হয় তখন।।
যত অপমান কৈল সাক্ষাতে দেখিলে।
মম হেতু স্থির হৈয়া সকলি সহিলে।।
দ্বাদশ বৎসর বনবাস করি পণ।
অজ্ঞাত বৎসর এক জান ভ্রাতৃগণ।।
হারিয়া কাননে আমি করিনু প্রবেশ।
কোন মুখে পুনর্ব্বার যাব আমি দেশ।।
কুরুসভা মধ্যে যাহা করেছি নির্ণয়।
অন্যথা করিতে তাহা মম শক্তি নয়।।
মম বাক্যে সবে যদি আছ অবস্থিত।
তবে হেন কহিবারে না হয় উচিত।।
রণ সাধ ছিল যদি তোমা সবা মন।
সেই কালে না করিলে কিসের কারণ।।
পাশার সময়ে তবে কেন না করিলে।
তাহে পরাভব হয়ে কি হেতু ক্ষমিলে।।
পুনঃ বনবাস পুনঃ খেলিবার কালে।
তখন আমারে কেন ক্ষান্ত না করিলে।।
সময়ে না করি কর্ম্ম অসময়ে চাহ।
অকারণে বাক্যবাণে আমারে পোড়াহ।।
এইক্ষণে প্রাণ আমি ছাড়িবারে পারি।
তথাপিহ সত্য আমি করিব লঙ্ঘন।
অপযশ অধর্ম্ম ঘুষিবে ত্রিভুবন।।
রাজ্য ধন পুত্র আদি বহু যজ্ঞ দান।
সত্যের নিকটে নহে শতাংশ সমান।।
পুরুষ হইয়া যার বাক্য সত্য নয়।
ইহলোকে তারে কেহ না করে প্রত্যয়।।
অন্তকালে হয় তার নরকেতে গতি।
ইহা জানি ভ্রাতৃগণ স্থির কর মতি।।
কাল কাটি পুনরপি লব রাজ্যভার।
কষ্টেতে সুজন ভ্রষ্ট, নহে সত্যাচার।।
নৃপতির বাক্য শুনি বলে বৃকোদর।
হেন নীতি করে রাজা দীর্ঘজীবী নর।।
নির্ণয় করিয়া যেবা নিজ আয়ু জানে।
সে জন কদাপি বর্ত্তে এই আচরণে।।
নিরন্তর কালচক্র ভ্রমিছে উপর।
জলবিম্ব সম দেখি নর কলেবর।।
বৎসরের প্রায় এক দিবস কাটিয়া।
দ্বাদশ বৎসর রব এ কষ্ট পাইয়া।
বৎসরেক অজ্ঞাত থাকিব কোন মতে।
মহেন্দ্র পর্ব্বতে চাহ তৃণে লুকাইতে।।
আমারে কে নাহি জানে পৃথিবী ভিতর।
বাল বৃদ্ধ যুবা মধ্যে খ্যাত বৃকোদর।।
অর্জ্জুনেরে কিরূপে লুকাবে নৃপবর।
হস্ত দিয়া আচ্ছাদিতে চাহি দিনকর।।
দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা কিরূপে লুকাবে।
কদাচিৎ ইহা হৈতে যদি পার পাবে।।
সদ্ভাবে কদাপি রাজ্য না দিবে দুরন্ত।
আমি হই হীনবল, সে যে বলবন্ত।।
তখন উপায় রাজা কি করিবে তার।
শক্তি বৃদ্ধি হেতু রাজা বিচার তোমার।।
হীনবল হৈল শত্রু তারে নাহি ক্ষমে।
উপায় করয়ে সদা নিজ পরাক্রমে।।
শক্তিমন্ত হয়ে যদি না করে উপায়।
লোকে কাপুরুষ বলে, বৃথা জন্ম যায়।।
সত্য হেতু মনে যদি করহ নিশ্চয়।
আছয়ে উপায় তার, শাস্ত্রে হেন কয়।।
সোম পূতিকার মত কহে মুনিগণ।
এক মাসে বৎসরেক করিবে গণন।।
ত্রয়োদশ মাস রহি বনের ভিতরে।
উপায় করহ রাজা শত্রু মারিবারে।।
ভীমের বচন শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
স্তব্ধ হয়ে ক্ষণকাল চিন্তে মহামতি।।
রাজা বলে, ভীম যাহা করিলে বিচার।
কপট এ ধর্ম্ম, চিত্তে না লয় আমার।।
মেরুসম ধর্ম্ম আমি লঙ্ঘিব কেমনে।
কবু নহে বৈরীজয় পাপ আচরণে।।
কর্ণ সখা তার, যারে যম করে ভয়।
তিন লোক বিজয়ী সে রাধেয় দুর্জ্জয়।।
ভুবন ভিতরে যত জন ধরে ধনু।
অভেদ্য কবচে যার আবরিত তনু।।
মদগর্ব্বে অহঙ্কারী ক্রোধী সদাকাল।
হেন জনে বিধাতা করিল মহীপাল।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য এই তিন জন।
তাহার যেমন ভাবে, আমারে তেমন।।
তথাপি সবাই বশ হৈল দুর্য্যোধনে।
বহু মান্য পূজা সদা নিকটে সেবনে।।
আর যত মহারাজ আছে বলবান।
মম স্থান হৈতে প্রীতি পায় তার স্থান।।
সবে প্রাণ দিবে দুর্য্যোধনের কারণে।
কেমনে মারিবে তুমি হেন দুর্য্যোধনে।।
এই চিন্তা সদা মম জাগে রাত্রি দিনে।
কিমতে লইব রাজ্য ভাবিতেছি মনে।।
এই সে কারণে মম হৃদয় চিন্তিত।
বিনা সখা দুর্য্যোধন না হয় বিজিত।।
ধর্ম্ম সখা বিনা নহে সমরে বিজয়।
বেদের লিখন, যথা ধর্ম্ম তথা জয়।।
হেন ধর্ম্ম ত্যজিয়া অধর্ম্ম আচরিলে।
কহ ভীম, শত্রু জয় হইবে কি ভালে।।
ভুজগর্ব্ব বলে তুমি কর অহঙ্কার।
সাহসিক কর্ম্ম সেই, নহে সুবিচার।।
সুমন্ত্রণা সুবিক্রম গুপ্ত রাখি মনে।
দেবতা প্রসন্ন হৈলে, তবে শত্রু জিনে।।
এত শুনি বৃকোদর হইল বিমন।
ক্রোধেতে নিশ্বাস বহেল প্রলয় পবন।।
যুধিষ্ঠির ভীম সহ কথার সময়।
আইলেন তথা সত্যবতীর তনয়।।
মহাভারতের কথা জ্ঞানের প্রকাশ।
শ্রবণে অধর্ম্ম হরে, কহে কাশীদাস।।
৩২. শিব আরাধনার্থ অর্জ্জুনের
হিমালয়ে গমন
ব্যাসদেবে দেখি পূজে পাণ্ডু পুত্রগণে।
আশীর্ব্বাদ করি মুনি বসেন আসনে।।
যুধিষ্ঠির প্রতি তরে কহে মুনিবর।
শত্রুগণে ভয় তব হয়েছে অন্তর।।
তোমার হৃদয় তত্ত্ব জানিলাম আমি।
সে কারণে হেথা আইলাম শীঘ্রগামী।।
শত্রুর যে ভয়, তাহা ত্যজ নৃপবর।
আমি যাহা বলি, তাহা করহ সত্বর।।
অশুভ সময় গেল, হইল সুকাল।
এক বিদ্যা দিব আমি, লহ মহীপাল।।
এই বিদ্যা হৈতে হবে শিব দরশন।
তোমারে সদয় হইবেন ত্রিলোচন।।
নর ঋষি মূর্ত্তি তব ভাই ধনঞ্জয়।
এই মন্ত্রবলে ক্ষিতি করিব বিজয়।।
এই বন ত্যজি রাজা যাহ অন্য বন।
এক স্থানে বহু বধ হয় মৃগগণ।।
বনে এক ঠাঁই বসি কোন কর্ম্ম নাই।
তীর্থ দরশন করি ভ্রম ঠাঁই ঠাঁই।।
এত বলি একান্তে লইয়া মহামতি।
যুধিষ্ঠিরে দেন বিদ্যা নাম প্রতিস্মৃতি।।
মন্ত্র দিয়া মুনিরাজ গেলেন স্বস্থান।
মন্ত্র পেয়ে যুধিষ্ঠির হরিষ বিধান।।
ব্যাস অনুমতি পেয়ে কুন্তীর নন্দন।
দ্বৈতবন ত্যজিয়া গেলেন সেইক্ষণ।।
উত্তর মুখেতে সরস্বতী নদীতীরে।
গিয়া উত্তরিনে কাম্যক বনান্তরে।।
কাম্যক বনের মধ্যে নিলেন আশ্রয়।
বড়ই নিগম বন, নাহি কোন ভয়।।
মৃগয়া করেন নিত্য, পোষেণ ব্রাহ্মণ।
বড়ই নিগম বন, নাহি কোন ভয়।।
মৃগয়া করেন নিত্য, পোষেন ব্রাহ্মণ।
পিতৃশ্রাদ্ধ দেবার্চ্চন করে অনুক্ষণ।।
কতদিনে মুনিবাক্য করিয়া স্মরণ।
নিকটে ডাকিয়া পার্থে বলেন বচন।।
ভীষ্ম দ্রোণ ভূরিশ্রবা কৃপ কর্ণ দ্রৌণি।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ জানহ আপনি।।
যত বলবান রাজা আছে পৃথিবীতে।
সবাই হইল ভাই দুর্য্যোধন ভিতে।।
আমার কেবল ভাই তোমার ভরসা।
দুঃখে তুমি উদ্ধারিবে করিয়াছি আশা।।
সে সবারে জিনিতে হইল উপদেশ।
উগ্রতপ কর গিয়া, সেবহ মহেশ।।
যেই বিদ্যা আমারে দিলেন পিতামহ।
ইহা জপ ত্বরিতে মিলহ শিব সহ।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ দিবেন দর্শন।
তাঁ সবারে সেবিয়া পাইবে অস্ত্রগণ।।
পূর্ব্বে বৃত্রাসুর হেতু যত দেবগণ।
আপনার অস্ত্র ইন্দ্রে দিল সর্ব্বজন।।
পাইবে সকল অস্ত্র ইন্দ্রে তুষ্ট কৈলে।
সর্ব্বত্র হইবে জয় শিবেরে ভজিলে।।
হিমালয় গিরি আজি করহ গমন।
নিকটে তথায় দেখা পাবে ত্রিলোচন।।
এত বলি দিব্য বিদ্যা দিয়া সেইক্ষণ।
আশিস্ করিয়া শিরে করেন চুম্বন।।
আজ্ঞা পেয়ে বাহির হৈলেন ধনঞ্জয়।
গাণ্ডীব নিলেন তূণ যুগল অক্ষয়।।
চতুর্দ্দিকে দ্বিজগণ শুভ শব্দ কৈল।
বাহির হবার কালে দ্রৌপদী বলিল।।
জন্মকালে যা বলিল যত দেবগণ।
সে সকল প্রাপ্তি হৌক সেবি ত্রিলোচন।।
যত কটু ভাষায় বলিল দুর্য্যোধন।
সেই অগ্নি তাপে অঙ্গ হয়েছে দহন।।
উপায় করহ তারে সমুচিত ফলে।
নির্ব্বিঘ্ন হইয়া পুনঃ আইস মঙ্গলে।।
এতেক বলিয়া দেবী করিল বিদায়।
অর্জ্জুন বিচ্ছেদে বড় মনস্তাপ পায়।।
দেব দ্বিজ গুরুজনে বন্দিয়া তখন।
বাহির হৈলেন পার্থ হরষিত মন।।
চলিলেন ধনঞ্জয় উত্তর মুখেতে।
অল্পদিনে উত্তরেন হেমন্তপর্ব্বতে।।
হিমাদ্রির পারে গন্ধমাদন ভূধর।
ইন্দ্রকীল গিরি হয় তাহার উত্তর।।
বহু কষ্টে তথায় গেলেন ধনঞ্জয়।
শূণ্যবাণী হৈল, ইথে করহ আশ্রয়।।
আগে পথ নাহি আর মানুষ যে যায়।
শুনি পার্থ মহাবীর রহেন তথায়।।
হেনকালে একজন জটিল তপস্বী।
ডাকিয়া অর্জ্জুনে বলে নিকটেতে আসি।।
কে তুমি, কবচ খড়গ ধনু অস্ত্র ধরি।
কি হেতু আইলে তুমি পর্ব্বত উপরি।।
অস্ত্রধারী হয়ে তুমি এলে কি কারণ।
এ পর্ব্বতে নিবসে নিষ্কাম যত জন।।
ধনু অস্ত্র ফেলহ, ফেলহ শর তুণ।
দিব্যগতি পেলে অস্ত্রে কোন্ প্রয়োজন।।
বড় তেজোবন্ত ‍তুমি, আইলে সে কারণ।
শুনিয়া নিঃশব্দ হয়ে রহেন অর্জ্জুন।।
উত্তর না পাইয়া বলয়ে জটাধর।
বর মাগ ধনঞ্জয়, আমি পুরন্দর।।
করযোড়ে অর্জ্জুন মাগেন বর দান।
কৃপা যদি কর তবে দেহ অস্ত্রগণ।।
ইন্দ্র বলে, হেথা আসি কি কাজ অস্ত্রেতে।
দেবত্ব লইয়া ভোগ করহ স্বর্গেতে।।
পার্থ বলে যদি হেথা ইন্দ্রপদ পাই।
তথাপি ত্যজিতে আমি নারি চারি ভাই।।
দুর্গম অরণ্যে রাখি আসি ভ্রাতৃগণে।
অস্ত্র বাঞ্ছা করি আমি শত্রুর নিধনে।।
সে সবারে ত্যজি আমি রহিব কেমনে।
সতত করিবে চিন্তা আমার কারণে।।
অস্ত্র দেহ পুরন্দর কৃপা যদি মনে।
ইন্দ্র বলে, আগে তুষ্ট কর ত্রিলোচনে।।
তাঁর অনুগ্রহে সব সিদ্ধ হবে কাজ।
এত বলি অন্তর্হিত হন দেবরাজ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৩৩. কিরাতার্জ্জুনের যুদ্ধ ও
অর্জ্জুনের পাশুপত অস্ত্র লাভ
হিমালয় গিরিবরে ইন্দ্রের নন্দন।
করেন তপস্যা আরাধিতে ত্রিলোচন।।
গলিত বৃক্ষের পত্র ভক্ষ্য পক্ষান্তরে।
কত দিনে মাসেকেতে খান একবারে।।
কতদিন দুই চারি মাসে একদিনে।
কতদিন অর্জ্জুন থাকেন বায়ুপানে।।
এক পদাঙ্গুলিভরে রহেন দাঁড়ায়ে।
ঊর্দ্ধ দুই বাহু করি নিরালম্ব হয়ে।।
তাঁর তপে সন্তাপিত হল গিরিবাসী।
গন্ধর্ব্ব চারণ সিদ্ধ যত মহাঋষি।।
হরের চরণে গিয়া নিবেদিল সব।
হিমালয়ে কেমন থাকিব বল ভব।।
পর্ব্বত তাপিত দেব অর্জ্জুনের তপে।
আজ্ঞা কর, মোরা সবে থাকি কোন রূপে।।
গিরিশ বলেন, সবে যাহ নিজাশ্রয়ে।
আমি বর দিয়া শান্ত করি ধনঞ্জয়ে।।
এত বলি মেলানি দিলেন সর্ব্বজনে।
মায়ায় কিরাতরূপে ধরে ততক্ষণে।।
কিরাত গৃহিণীরূপা নগেন্দ্র নন্দিনী।
সে রূপেতে হইলেন তাঁহার সঙ্গিনী।।
শ্রীমন্ত পিনাক ধনু পৃষ্ঠে শরাসন।
অর্জ্জুনের সম্মূখে গেলেন ত্রিলোচন।।
হেনকালে এক মহা বরাহ আইল।
গর্জ্জিয়া অর্জ্জুন পানে ত্বরিত ধাইল।।
বরাহ দেখিয়া পার্থ গাণ্ডীব লইয়া।
সন্ধান পূরেন ধনুগুণ টঙ্কারিয়া।।
বলিলেন ডাকিয়া কিরাত ভগবান।
বরাহে তপস্বী তুমি না মারহ বাণ।।
দূর হৈতে তাড়িয়া আনিলাম বরাহ।
তুমি কেন বরাহেরে মারিবারে চাহ।।
না শুনিয়া পার্থ তহে করি অনাদর।
বরাহের উপরে মারেন তীক্ষ্ণশর।।
কিরাত যে দিব্য অস্ত্র মারিল শূকরে।
দুই অস্ত্রে যেন বজ্র পর্ব্বত বিদরে।।
গিরিশৃঙ্গে শরবৃষ্টি দেখি ভয়ঙ্কর।
মায়া ত্যজি হইল দারুণ কলেবর।।
পার্থ বলে, কে তুমি কিরাত নারী সঙ্গ।
আমারে তিলেক তোর নাহিক ভ্রভঙ্গ।।
বরাহরে অস্ত্র আমি মারি আগুয়ান।
তুমি কি কারণে তারে প্রহারিলে বাণ।।
এই দোষে তোর আজি লইব পরাণ।
হাসিয়া উত্তর করিলেন ভগবান।।
কোথা হৈতে কে তুমি আইলে তপচারী।
এ ভূমিতে মৃগয়ার আমি অধিকারী।।
মারিলাম আমি বাণ, পড়িল শূকর।
তুমি অস্ত্র মার কেন শূকর উপর।।
অনুচিত কৈলে আর ‍চাহ মারিবারে।
যত শক্তি আছে তব দেকাও আমারে।।
ক্রোধে ধনঞ্জয় অস্ত্র করেন প্রহার।
ডাকিয়া কিরাত বলে, আমি আছি মার।।
পুনঃ পুনঃ ধনঞ্জয় প্রহারয়ে শর।
জলদ বরিষে যেন পর্ব্বত উপর।।
পাষাণে সরিষা যেন পড়িল ঠিকরে।
তিলমাত্র মোহ না হইল কলেবরে।।
বায়ব্য অনল অস্ত্র ছিল পার্থ স্থানে।
সব অস্ত্র প্রহার করেন ত্রিলোচনে।।
কিরাতের অঙ্গে বাণ বিদ্ধ নাহি হয়।
তাহা হেরি পার্থের চিত্তে জাগে বিস্ময়।।
এত বাণ বরিষণে কিছু নাহি হয়।
বিস্ময় মানিয়া মনে ভাবে ধনঞ্জয়।।
কিবা যম পুরন্দর কিবা ভূতনাথ।
অন্য কে সহিতে পারে এই অস্ত্রাঘাত।।
যে হউক আমি আমি করিব সংহার।
ক্রোধেতে নিলেন বীর খড়গ তীক্ষ্ণধার।।
শিবের মস্তকে বাজি হৈল দুই খণ্ড।
পাষাণে বাজিয়া যেন পড়ে ইক্ষুদণ্ড।।
খড়্গ ব্যর্থ গেল, হাতে অস্ত্র নাহি আর।
গাণ্ডীব ধনুক লয়ে করেন প্রহার।।
হাসিয়া নিলেন ধনু কাড়ি ত্রিলোচন।
ক্রোধে পার্থ শিলাবৃষ্টি করে বরিষণ।।
পর্ব্বত উপরে যেন শিলা চূর্ণ হয়।
ক্রোধে প্রহারেন মুষ্টি বীর ধনঞ্জয়।।
করিলেন ক্রোধে মুষ্টি প্রহার ধূর্জ্জটি।
মুষ্ট্যাঘাতে শব্দ যেন হৈল চটচটি।।
ভুজে ভুজে ঊরু ঊরু চরণে চরণে।
মল্লযুদ্ধ ক্ষণকাল হৈল দুই জনে।।
দুই অঙ্গ ঘরষণে অগ্নি বাহিরায়।
অতি ক্রোধে ধূর্জ্জটি প্রহারিলেন তাঁয়।।
মৃতবৎ হয়ে পার্থ পড়েন ভূতলে।
ক্ষণেক চেতন পেয়ে থাক থাক বলে।।
যাবৎ না পূজি মম ইষ্ট ত্রিলোচন।
তাবৎ থাকহ তুমি কিরাত দুর্জ্জন।।
এত বলি শিবলিঙ্গ করিয়া রচন।
নানাবিধ পুষ্পরাশি কৈলেন চয়ন।।
পূজিয়া মৃত্তিকা লিঙ্গে দেন পুষ্পমালা।
সেই মাল্যেতে শোভিল কিরাতের গলা।।
দেখিয়া অর্জ্জুন হইলেন সবিস্ময়।
নিশ্চয় জানিলেন যে এই মৃত্যুঞ্জয়।।
বিনয় কহেন পার্থ করি প্রণিপাত।
করিলাম দুষ্কৃতি যে ক্ষম ভূতনাথ।।
শিব বলে, যে কর্ম্ম করিলে ধনঞ্জয়।
দেবাসুর মানুষে কাহার শক্তি নয়।।
আমার সহিত সম করিলে সমর।
তুমি আমি সমশক্তি নাহিক অন্তর।।
দিব্যচক্ষু দিব তোমা দৃষ্ট হৈবে সব।
এত বলি দিব্যচক্ষু দেন দেবদেব।।
দিব্যচক্ষু পাইয়া দেখেন ধনঞ্জয়।
উমার সহিত উমাকান্ত দয়াময়।।
অর্জ্জুন করেন স্তুতি যড়ি দুই কর।
জয় শিব, জয় শম্ভু, জয় ভূতেশ্বর।।
ত্রিনেত্র ত্রিগুণময় ত্রিলোকের নাথ।
ত্রিবিক্রমপ্রিয় হর ত্রিপুরনিপাত।।
হেলায় করিলা প্রভু দক্ষযজ্ঞ নাশ।
ইঙ্গিতে বিজয় কৈলা মৃত্যু কামপাশ।।
নমো বিষ্ণুরূপ তুমি, বিধাতার ধাতা।
ধর্ম্ম অর্থ ‍কাম মোক্ষ চতুর্ব্বর্গদাতা।।
অজ্ঞানে করিনু প্রভু কাজ অবিহিত।
চরণে শরণ লৈনু, ক্ষম গঙ্গানাথ।।
হাসিয়া অর্জ্জুনে দেব দেন আলিঙ্গণ।
ক্ষমিলেন অজ্ঞাতের প্রহার পীড়ন।।
শিব বলে, আপনারে নাহি জান ‍তুমি।
পূর্ব্বকথা কহি শুন যাহা জানি আমি।।
নারায়ণ সহ তুমি নর ঋষি রূপে।
সংসার ধরিলে অতিশয় উগ্রতপে।।
এই যে গাণ্ডীব ধনু আছয়ে তোমার।
তোমা বিনা ধরিবারে শক্তি আছে কার।।
তোমা হৈতে কাড়িয়া লইনু মায়াবলে।
মায়ায় হরিনু আমি এ তূণ যুগলে।।
পুনরপি সেই অস্ত্রে পূর্ণ হৌক তূণ।
নিজ ধনু তূণ তুমি ধরহ অর্জ্জুন।।
প্রীত হইলাম আমি মাগি লহ বর।
শুনিয়া কহেন পার্থ যুড়ি দুই কর।।
যদি কৃপা আমারে করিলা গঙ্গাব্রত।
আজ্ঞা কর, পাই আমি অস্ত্র পাশুপত।।
শঙ্কর বলেন, তাহা লহ ধনঞ্জয়।
অন্য জনে নহে শক্ত পাশুপত লয়।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের এ অস্ত্র নাহি জানে।
পৃথিবী সংহার হেতু আছে মম স্থানে।।
যে অস্ত্র যুড়িলে লক্ষ লক্ষ অস্ত্র হয়।
শক্তিশেল কোটি কোটি অস্ত্র বরিষয়।।
প্রীতিতে তোমার বশ হইলাম আমি।
ধরিবার যোগ্য হও, অস্ত্র লহ তুমি।।
বিধাতার বাক্যে লহ নরালোকে জন্ম।
এই অস্ত্রে বীরবর সাধ দেবকর্ম্ম।।
এত বলি মন্ত্র সহ দেন ত্রিলোচন।
মূর্ত্তিমন্ত হয়ে অস্ত্র আইল তখন।।
অস্ত্র দিয়া মহেশ বলেন পুনর্ব্বার।
এ অস্ত্রে কারে পাছে করহ সংহার।।
এ অস্ত্রে রক্ষা নাহি পায় ত্রিভুবন।
স্বযোগ্য পাইলে অস্ত্র করিবে ক্ষেপণ।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব করি নিবেদন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেতে করিবা আগমন।।
শিব কন, সখা তব বৈকুণ্ঠের পতি।
হরিহর এক আত্মা জান মহামতি।।
কুরু পাণ্ডবের ‍যুদ্ধ হইবে যখন।
তাহাতে সাহায্য আমি করিব তখন।।
এত বলি হর হইলেন অন্তর্দ্ধান।
অস্ত্র পেয়ে ধনঞ্জয় আনন্দ বিধান।।
আপনারে প্রশংসা করেন ধনঞ্জয়।
এত কৃপা কৈল হর, শত্রুকে কি ভয়।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে সাধু নর।।
৩৪. অর্জ্জুনের ইন্দ্রালয়ে গমন
হেনকালে তথা আসি যত দেবগণ।
অর্জ্জুন উপর করে পুষ্প বরিষণ।।
দক্ষিণে থাকিয়া ডাকি বলে প্রেতপতি।
মম বাক্য ধনঞ্জয় কর অবগতি।।
বর দিতে তোমারে আইনু দেবগণে।
লইয়াছ জ্ন্ম তুমি শত্রু নিবারণে।।
দেব দৈত্য অসুর যতেক পৃথিবীতে।
সবে পরাভব হবে তোমার অস্ত্রেতে।।
তব শত্রু আছে যেই কর্ণ ধনুর্দ্ধর।
তব হস্তে হত হবে সেই বীরবর।।
হের লহ এই অস্ত্র অব্যর্থ সংসারে।
আমার প্রধান অস্ত্র দণ্ড নাম ধরে।।
এত বলি মন্ত্র সহ দিল প্রেতপতি।
পশ্চিমে থাকিয়া ডাকি বলে জলপতি।।
আমার বরুণ পাশ অর্ব্যর্থ সংসারে।
এই যে দেখহ, যম নিবারিতে নারে।।
প্রীতিতে তোমারে দিনু ধরহ অর্জ্জুন।
ইহা হৈতে কর সদা বিপক্ষ দলন।।
উত্তরে থাকিয়া ডাকি কুবের বলিল।
অর্জ্জুন তোমারে যম বরুণ অস্ত্র দিল।।
এবে মম স্থানে লহ অস্ত্র অন্তর্দ্ধান।
এই অস্ত্রে হর কৈল ত্রিপুরে নিধন।।
মৃত্যুপতি জলপতি দিল যক্ষপতি।
ডাকি বলে সুরপতি অর্জ্জুনের প্রতি।।
কুন্তীগর্ভে জাত তুমি আমার নন্দন।
অসুর বধিতে আমি দিব অস্ত্রগণ।।
এখনি পাঠাব রথ তোমারে লইতে।
স্বর্গেতে আসিবে তুমি মাতলি সহিতে।।
হেথা এলে পূর্ণ হবে তব প্রয়োজন।
এত বলি চলি গেল সব দেবগণ।।
কতক্ষণে রথ লৈয়া আইল মাতলি।
ঘোর মেঘ মধ্যে যেন স্ফুরিত বিজলী।।
বায়ুবেগে অদ্ভূত তুরঙ্গ রথ বয়।
নিশাকালে হৈল যেন রবির উদয়।।
ডাকিয়া মাতলি বলে অর্জ্জুনের প্রতি।
ইন্দ্রের আজ্ঞায় রথে চড় শীঘ্রগতি।।
তোমা দরশনে বাঞ্ছা করে দেবরাজ।
আর যত আছে তথা দেবের সমাজ।।
আনন্দে করেন পার্থ রথ আরোহণ।
মাতলি চালায় রথ পবন গমন।।
পথেতে দেখিল পার্থ দেব ঋষিগণ।
বিমানেতে আরোহণ যত পুণ্যজন।।
গন্ধর্ব্ব অপ্সর যত আনন্দে বিহরে।
কতক পড়িছে তারা দেখে বীরবরে।।
বিস্ময় মানিয়া কহে অর্জ্জুন তখন।
কত শুনি মাতলি এ সব কোন জন।।
মাতলি বলিল, এই পুণ্যবানগণ।
পৃথিবীতে সুকর্ম্ম করিল অগণন।।
রাজসূয় অশ্বমেধ আদি যত কৈল।
সম্মূখ সংগ্রাম করি শরীর ছাড়িল।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় দিল বহু দান।
দেবপূজা উগ্র তপ কৈল তীর্থস্নান।।
সেই সব জন এই বিমানে বিহরে।
বিনা পুণ্যে নাহি শক্তি আসে স্বর্গপুরে।।
তারা বলি ত্রৈলোক্যেতে ঘোষয়ে মানুষে।
পুণ্যক্ষয় হয়ে গেল হের দেখ খসে।।
সুরা পিয়ে, মাংস খায়, গুরুপত্নী হরে।
কদাচিৎ সে জন না আসে স্বর্গপুরে।।
আনন্দে অর্জ্জুন সব করেন দর্শন।
কোটি কোটি বিমানেতে ভ্রমে পুণ্যজন।।
শত শত বরাঙ্গনা সেবয়ে তাঁহারে।
সুগন্ধ সহিত বায়ু সদা মন হরে।।
সিদ্ধ সাধ্য সেবে দেব মরুৎ অনল।
সপ্ত বসু রুদ্রগণ আদিত্য সকল।।
দিলীপ নহুষ আদি যত মহীপতি।
দেবঋষি রাজঋষি বহু সিদ্ধ যতি।।
অর্জ্জুনে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল সর্ব্বজন।
কহ ত মাতালি এই কাহার নন্দন।।
পরিচয় দিয়া তবে মাতলি চলিল।
বায়ুবেগে ইন্দ্রালয়ে উপনীত হৈল।।
ইন্দ্রালয়ে যান তবে ইন্দ্রের নন্দন।
সভাস্থ সকল দেবে করেন বন্দন।।
ইন্দ্রের বিচিত্র সভা বর্ণন ‍না যায়।
যেন শত চন্দ্র, শত সূর্য্যের উদয়।।
রথ হৈতে অবতরি যান বীরবর।
দুই হাত ধরি তাঁরে তুলে পুরন্দর।।
আলিঙ্গন চুম্ব দিল মস্তক উপর।
আসনেতে বসাইল সভার ভিতর।।
ইন্দ্র বিনা বসিবারে নারে অন্য জন।
দেব ঋষি মান্য যেই ইন্দ্রের আসন।।
আপন আসনে ইন্দ্র বসালেন কোলে।
মুহুমুহুঃ সহস্রেক নয়নে নেহালে।।
আসনে বসিয়া পার্থ পাইলেন শোভা।
মঘবার কোলে যেন দ্বিতীয় মঘবা।।
পুণ্যকথা ভারতের আনন্দ লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম ক্ষয়, পরলোকে তরি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৩৫. ইন্দ্রসভায় ঊর্ব্বশী প্রভৃতির নৃত্যগীত
হেনকালে শতক্রতু, অর্জ্জুনের প্রীতি হেতু,
আজ্ঞা কৈল নৃত্যের কারণ।
বিশ্বাবসু হাহা হুহু, ইত্যাদি গন্ধর্ব্ব বহু,
চিত্রসেন তুম্বুরু গায়ন।।
নানা ছন্দে বাদ্য বায়, মধুর সুস্বর গায়,
নৃত্য করে যতেক অপ্সর।
ঊর্ব্বশী ঘৃতাচী গৌরী, মিশ্রকেশী বিভাবরী,
গাহে গান মধুর সুস্বর।।
অলম্বষা ধন্যা অম্বা, গোপালী মেনকা রম্ভা,
বিপ্রচিত্তি সুধা সুধাপ্রভা।
চিত্রসেনা চিত্ররেখা, অপ্সরী মৃদঙ্গমুখা,
বুদ্ধুদা রোহিণী সুরলোভা।।
নৃত্যগীতে সপ্রতিভা, পূর্ণচন্দ্র মুখপ্রভা,
অঙ্গ ঢাকি অম্লান অম্বরে।
ইষৎ নয়ন কোণে, নিরখয়ে যেইজনে,
অন্য থাক, মুনি মন হরে।।
জঘন কুঞ্জরকর, ক্ষীণ মাজা মৃগবর,
নিতম্ব ভূধর পয়োধর।
বিনাশে মুনির তপ, বর্ণন না যায় রূপ,
দিতে নাহি অন্য পাঠান্তর।।
নৃত্যগীত বাদ্যে সবে, মোহিত যতেক দেবে,
আনন্দিত হৈল সুরগণ।
অর্জ্জুনের ম্লানমুখ, ভাবিয়া পূর্ব্বের দুখ,
ভ্রাতা মাতা করিয়া স্মরণ।।
ক্ষণেক নয়নকোণে, চাহিলা ঊর্ব্বশী পানে,
জানিলেন সহস্রলোচন।
নৃত্যগীত নিবারিল, সবারে বিদায় দিল,
নিজধামে গেল দেবগণ।।
দিব্য সুধারস কথা, আরণ্যপর্ব্বের গাথা,
শুনিলে অধর্ম্ম হয় নাশ।
কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র