৪৭. যযাতির প্রতি শুক্রের অভিশাপ দান হেনমতে কতদিনে যযাতি নৃপতি। বিহারে চলিল দেবযানীর সংহতি।। নানা বৃক্ষে সুশোভিত অশোকের বন। ফলে-ফুলে সুগন্ধি, সুনাদে পক্ষিগণ।। দেবযানী সহ ক্রীড়া করে নৃপবর। শর্ম্মিষ্ঠা আইল সেই বনের ভিতর।। শর্ম্মিষ্ঠার তিন পুত্র পিতারে দেখিয়া। রাজার নিকটে সবে যাইল ধাইয়া।। সুন্দর কুমার তিন দেখি দেবযানী। জিজ্ঞাসিল, কার পুত্র কহ নৃপমণি।। মৌনেতে রহিল রাজা, না দিল উত্তর। কুমারগণেরে তবে পুছিল সত্বর।। কি নাম তোমরা ধর, কাহার নন্দন। সত্য কহ, হেথায় আইলা কি কারণ।। দেবযানী বলে যদি এতেক বচন। প্রত্যেকে আপন নাম কহে তিন জন।। শর্ম্মিষ্ঠা নামেতে আমা সবাকার মাতা। রাজারে দেখায়ে বলে এই মোর পিতা।। এত বলি গেল তিনে রাজার নিকটে। প্রণিপাত করি দাঁড়াইল করপুটে।। দেবযানী-ভয়ে রাজা কিছু না বলিল। বিরস-বদনে তিন শিশু বাহুড়িল।। এত শুনি দেবযানী অরুণ-লোচন। শর্ম্মিষ্ঠাকে ডাকি তবে বলেন বচন।। পূর্ব্বে যে কহিলি তুই আমার গোচরে। ঋষি এক পুত্রদান দিলেক আমারে।। এক্ষণে তোমার কথা হইল বিদিত। শর্ম্মিষ্ঠা শুনিয়া তাহা হইল বিস্মিত।। করযোড়ে করিয়া শর্ম্মিষ্ঠা কহে বাণী। ধর্ম্মে নাহি ঘাটি আমি, শুন ঠাকুরাণি।। তুমি মোর ঈশ্বরী, তোমার রাজা পতি। সে কারণে মোর ভর্ত্তা হৈলা নরপতি।। সেবিকার পুত্রগণ তোমার সেবক। ক্রোধ পরিহর মোর দেখিয়া বালক।। দেবযানী বলে, তুমি সেবিকা হইয়া। মোর স্বামী ভোগ কর ভয় না চিন্তিয়া।। ক্রোধে দেবযানী তবে রাজা প্রতি বলে। শুক্র বাক্য লঙ্ঘন করিলে অবহেলে।। গুরুবাক্য লঙ্ঘি কর সেবিকা-গমন। জানিলাম মহাপাপী তুমি হে রাজন।। আর না রহিব আমি তোমার সদন। এত বলি দেবযানী করেন ক্রন্দন।। কাঁদিতে কাঁদিতে যান জনকের ঘর। বিনয় করিয়া রাজ্য বুঝান বিস্তর।। রাজার বিনয়- বাক্য না শুনিল কানে। দেখিয়া নৃপতি বড় ভয় পায় মনে।। পাছে নাহি চাহে ক্রোধে, যায় শীঘ্রগতি। পাছে পাছে নরপতি চলিল সংহতি।। শুক্রের সম্মুখে গিয়া হৈল উপনীত। প্রণাম করিয়া কহে রাজার চরিত।। অবধান কর পিতা মোর নিবেদন। অধর্ম্মে প্রবৃত্ত হৈল যযাতি রাজন।। তোমার নিয়ম-বাক্য হেলন করিয়া। বৃষপর্ব্ব-কন্যারে গোপনে কৈল বিয়া।। তিনপুত্র জন্মাইল তাহার উদরে। দুর্ভাগা করিল মোরে রাজা অবিচারে।। কন্যার বচন শুনি ভৃগুর নন্দন। ক্রোধ করি রাজারে বলিল ততক্ষণ।। সর্ব্বধর্ম্ম জ্ঞাত তুমি পরম পণ্ডিত। মম বাক্য লঙ্ঘ রাজা, এ কোন বিহিত।। গুরু-বাক্য নাহি মান করি অহঙ্কার। এই পাপে অঙ্গে জরা হইবে তোমার।। শুনিয়া শুক্রের শাপ, কম্পিত হৃদয়ে। করযোড় করি রাজা বলিল বিনয়ে।। মোর কোন্ শক্তি প্রভু তোমারে লঙ্ঘিতে। সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম মুনি গোচর তোমাতে।। সত্য কহি তব পাশে, শুন তপোধন। কামভাবে শর্ম্মিষ্ঠারে না করি বরণ।। ঋতুধান শর্ম্মিষ্ঠা যাচিল বারম্বার। সে কারণে ঋতু রক্ষা করিলাম তার।। ঋতুরক্ষা তরে নারী হইলে প্রার্থিত। না পূরালে মহাপাপে হয় নিপতিত।। নুপংসক হৈয়া জন্ম লভে ক্ষিতিতলে। নরকের মধ্যে গিয়া পড়ে অন্তকালে।। ঋতুদান করিলাম করি ধর্ম্ম ভয়। আর মোর অঙ্গীকার জান মহাশয়।। যেই যাহা মাগে তাহা না করিব আন। সে কারণে দিনু যে মাগিল ঋতুদান।। শুক্র বলে, ধর্ম্ম ভয় করিলা বিচার। মোর বাক্যে ভয় নাহি এত অহঙ্কার।। এতেক বলিবা মাত্র ভৃগুর নন্দন। রাজার শরীরে জরা হইল তখন।। অশক্ত হইল রাজা, শুক্ল হৈল কেশ। মুখেতে না সরে বাক্য হৈল বৃদ্ধবেশ।। আপনার অঙ্গ দেখি নৃপতি বিস্ময়। যোড়হাতে কহে পুনঃ করিয়া বিনয়।। নাহি হয় তৃপ্তি নাহি পূরে যে কামনা। তব কন্যা দেবযানী প্রথম-যৌবনা।। হইলাম বঞ্চিত এ সংসারের সুখে। কৃপায় শাপান্ত প্রভু আজ্ঞা কর মোকে।। শুক্র বলে, মম বাক্য না যায় খণ্ডন। ভোগ করিবারে রাজা আছে যদি মন।। আপনার জরাবস্থা দিয়া অন্য জনে। সাংসারিক সুখভোগ করহ আপনে।। রাজা বলে, আছে মোর পঞ্চ যে কুমার। যেই জরা লবে, তারে দিব রাজ্যভার।। শুক্র বলে, জরাভার লবে যেই জন। দীর্ঘ আয়ু হবে সেই রাজ্যের ভাজন।। বংশবৃদ্ধি হবে, আর রাজ্যে হবে রাজা। পরম পণ্ডিত হবে, বলে মহাতেজা।। শুক্রের পাইয়া আজ্ঞা যযাতি রাজন। দেবযানী সহ দেশে করিল গমন।। যযাতি-চরিত কথা শ্রবণে অমৃত। পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচিত।। ৪৮. পুরুর জরা গ্রহণ ও যযাতির যৌবন প্রাপ্তি দেশে আসি নৃপতি বসিল সিংহাসনে। জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুরে বলিল ততক্ষণে।। শুক্রশাপে জরা বাপু! হইল শরীরে। যৌবনের ভোগে মম মন নাহি পূরে।। জ্যেষ্ঠ পুত্র হও তুমি পরম পণ্ডিত। খণ্ডিতে পিতার হও তুমি পরম পণ্ডিত।। খণ্ডিতে পিতার দুঃখ হয় যে উচিত। সে কারণে মম জরা লহ রে শরীরে।। তোমার যৌবন পুত্র দেহ ত আমারে।। সহস্র বৎসরে পুত্র পাইবে যৌবন। এত শুনি যদু হৈল বিরস-বদন।। জরা সম দুঃখ পিতা নাহিক সংসারে। অন্ন-পান-হীন, শক্তি না থাকে শরীরে।। শরীর কুৎসিত হয়, লোকে উপহাসে। হেন জরা লইতে মোর মনে নাহি আসে।। আর চাহি পুত্র পিতা আছয়ে তোমার। তাহা সবাকারে জরা দেহ আপনার।। শুনিয়া হইল ক্রুদ্ধ, যযাথি রাজন। জ্যেষ্ঠ পুত্র হৈয়া তুমি হৈলা অভাজন।। তোর বংমে রাজা নাহি হবে কোনকালে। জ্যেষ্ঠ হৈয়া তুমি মোর কুপুত্র হইলে।। তাহার অনুজ, নাম তুর্ব্বসু সুন্দর। তাহারে আনিয়া জিজ্ঞাসিল নৃপবর।। শুক্রশাপে জরা হৈল, না যায় খণ্ডন। জরা লয়ে দেহ পুত্র আপন যৌবন।। সহস্র বৎসর পরে বৎস পুনর্ব্বার। তোমায় যৌবন দিয়া লব রাজ্যভার।। তুর্ব্বসু বলিল, পিতা জরা বড় দুঃখ। আচারে বর্জ্জিত, যার সংসারের সুখ।। হেন জরা লৈতে মোর নাহি লয় মতি। শুনিয়া কুপিত অতি হৈল নরপতি।। পুত্র হৈয়া পিতৃবাক্যে কর অনাদর। এই পাপে ম্লেচ্ছ দেশে হবে দণ্ডধর।। তব বংশে যতেক হইবে পুত্রগণ। মূর্খ হৈয়া করিবেক অভক্ষ্য ভক্ষণ।। দেবযানীর দুই পুত্র না শুনিল বাণী। শর্ম্মিষ্ঠার পুত্রগণে ডাকিল তখনি।। শর্ম্মিষ্ঠার জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্রুহ্যু নাম ধরে। মধুর বচনে রাজা বলিল তাহারে।। অর্পিয়া আমারে পুত্র আপন যৌবন। আমার এ জরাভার কর হে গ্রহণ।। দ্রুহ্যু বলে, রাজা জরা বহু দোষ ধরে। অন্যের থাকুক কাজ বাক্য নাহি স্ফূরে।। না পারিব সহিতে জরার যে যন্ত্রণা। অন্যেরে করহ আজ্ঞা লবে সেই জনা।। শুনিয়া ক্রোধেতে রাজা বলিল তখন। পুত্র হৈয়া পিতাবাক্য করিলা লঙ্ঘন।। চারিজাতি ভেদ না থাকিবে যেই দেশে। সেই দেশে রাজা হবে তোমার ঔরসে।। যতেক করিবে আশা হইবে নৈরাশ। কভু পূর্ণ না হইবে তব অভিলাষ।। অনু বলি পুত্র তার কনিষ্ঠ সোদর। তাহারে ডাকিয়া তবে বলে নৃপবর।। মম জরা লহ বাপু, কর পুত্র কাজ। শুনিয়া বলয়ে অনু শুন মহারাজ।। জরা সম দুঃখ নাই জগত-সংসারে। সদাই অশুদ্ধ দেহ থাকে অনাচারে।। যে কিছু খাইলে জীর্ণ না হয় উদরে। হেন জরা লৈতে পিতা না বল আমারে।। রাজা বলে, তুমি পুত্র বড় দুরাচার। পুত্র হৈয়া বাক্য তুমি লঙ্ঘিলা আমার।। যতেক জরার দোষ কহিলা আপনে। সেই সব দুঃখ তুমি ভুঞ্জ অনুক্ষণে।। তোমার ঔরসে পুত্র যতেক হইবে। যৌবন-কালেতে তারা সবাই মরিবে।। তবে ত নৃপতি বড় হইয়া চিন্তিত। সবার কনিষ্ঠ পুত্রে ডাকিল ত্বরিত।। সবা হৈতে প্রিয় তুমি কনিষ্ঠ নন্দন। প্রিয়কর্ম্ম করি রাখ আমার বচন।। শুক্র-শাপে জরা হৈল আমার শরীরে। তৃপ্তি নাহি পাই সুখে জানাই তোমারে।। পুত্র-কর্ম্ম কর, দেহ আপন যৌবন। সহস্র বৎসরে পুনঃ হইবে তেমন।। মম জরা দুঃখ পুত্র লহ নিজ কায়। গ্রহণ করিলে তুমি মম দুঃখ যায়।। পিতার বচন শুনি কহে যোড় করে। তোমার বচন রাজা কে লঙ্ঘিতে পারে।। পুত্র হৈয়া পিতৃবাক্য না রাখে যে জন। ইহলোকে অপযশ নরকে গমন।। তব জরা দেহ পিতা আমার শরীরে। আমার যৌবন ভোগ ভুঞ্জ কলেবরে।। এতেক শুনিয়া রাজা হরষিত মন। মুখে চুম্ব দিয়া পুত্রে বলেন বচন।। বংশবৃদ্ধি হবে তব ধর্ম্মেতে তৎপর। তোমার বংশেতে হবে রাজ্যের ঈশ্বর।। এতেক বলিয়া শুক্রে করিল স্মরণ। পুরু-অঙ্গে জরা থুয়ে পাইল যৌবন।। যৌবন পাইয়া তবে যযাতি রাজন। অনুক্ষণ ধর্ম্ম কর্ম্ম না যায় লিখন।। যজ্ঞ হোমে তুষ্ট করি যত দেবগণে। পিতৃগণে তুষ্ট কৈল শ্রাদ্ধাদি তর্পণে।। দানেতে তুষিল দ্বিজ দরিদ্র ভিক্ষুক। সুপালনে প্রজাগণে দিল বড় সুখ।। অভ্যাগত নাহিক দুষ্ট রাজ্যের ভিতর।। হেনমতে রাজ্য করে সহস্র বৎসর। পূর্ব্ব বাক্যে স্মরণ করিল নৃপবর।। জরায় পীড়িত পুত্র দেখিয়া নৃপতি। আপনারে ধিক্কার করেন মহামতি।। আপনার জরা দিয়া দিনু পুত্রে দুখ। পুত্রের যৌবনে আমি ভুঞ্জিলাম সুখ।। লোভেতে পুত্রের কষ্ট না দেখি নয়নে। ভোগে মত্ত আমি দুঃখী করি যে নন্দনে।। এত চিন্তি নরপতি বলিল নন্দনে। বহু ভোগ করিলাম তোমার যৌবনে।। পুত্রকর্ম্ম করি প্রীত করিলা আমারে। তোমার মহিমা যশ ঘুষিবে সংসারে।। আপন যৌবন লহ জরা দেহ মোরে। ছত্রদণ্ড দিব আমি তোমার উপরে।। এত বলি জরা নিল নহুষ-নন্দন। লভিলেন পুরু পুনঃ আপন যৌবন।। পুরু রাজা হবে বলি দিলেন ঘোষণা। পাত্র মিত্র অমাত্য ডাকিল সর্ব্বজনা।। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র যত প্রজা। রাজ্যেতে যতেক বৈসে আনাইল রাজা।। পুরু-অভিষেক দেখি যত প্রজাগণ। কহিতে লাগিল ভূপে করি সম্বোধন।। নানা শাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি নহুষ-নন্দন। জ্যেষ্ঠ পুত্র বিদ্যমানে বল কি কারণ।। কনিষ্ঠ হইবে রাজ-ছত্র অধিকারী। এ কেমন যুক্তি মোরা বুঝিতে না পারি।। সর্ব্বগুণ-যুত যদু পরম সুন্দর। তার বিদ্যমানে পুরু নহে রাজ্যেশ্বর।। ধর্ম্মনীতি বহু তুমি জান মহাশয়। কনিষ্ঠে করিবে রাজা কোন্ শাস্ত্রে কয়।। প্রজাগণ-বচন শুনিয়া নৃপবর। সর্ব্বজনে সম্ভাষিয়া করিল উত্তর।। পিতৃমাতৃ-বাক্য যেই পুত্র নাহি রাখে। তারে পুত্র বলে, হেন কোন্ শাস্ত্রে লেখে।। পুরুকে জানি যে আমি আপন কুমার। আর পুত্র অকারণ হইল আমার।। পরম পণ্ডিত পুরু জানে সর্ব্বধর্ম্ম। রাখিয়া আমার বাক্য কৈল পুত্র কর্ম্ম।। জরায় পীড়িত আমি মাগিনু যৌবন। মম বাক্য না রাখিল অন্য চারি জন।। পণ্ডিত সুবুদ্ধি পুরু করিল স্বীকার। সহস্র বৎসর নিল মোর জরাভার।। সে কারণে রাজ্যভারে পুরু যোগ্য হয়। হেন পুরু রাজা হবে ধর্ম্মে কেন নয়।। প্রজাগণ বলে, শুক্র জগতে বিদিত। তাঁহার দৌহিত্রগণ সংসারে পূজিত।। তাদের না দিয়া অন্যে দিবা অধিকার। হইলে শুক্রের ক্রোধ নাহিক নিস্তার।। রাজা বলে, শুক্রে করিয়াছি নিবেদন। যেই জরা লইবে সে রাজ্যের ভাজন।। শুক্র বলে, যেই পুত্র লবে জরাভার। আপনার রাজ্যে তারে দিবা অধিকার।। প্রজাগণ বলে কিছু কহিতাম আর। শুক্র-আজ্ঞা হইয়াছে নাহিক বিচার।। পিতৃ-মাতৃ বাক্য যেই করয়ে পালন। তারে পুত্র বলি হেন কহে মুনিগণ।। রাজযোগ্য হয় পুরু ধর্ম্মেতে তৎপর। সবার স্বীকার পুরু কর দণ্ডধর।। এত যদি বলিল সকল প্রজাগণ। অভিষেক করিল পুরুকে ততক্ষণ।। ছত্র দণ্ড দিল তবে নৃপতি যযাতি। পুত্রে শিক্ষা করাইল যত রাজনীতি।। আদিপর্ব্বে বিচিত্র যযাতি উপাখ্যান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ৪৯. যযাতির স্বর্গে ও স্বর্গ হইতে পতন হইল নৃপতি পরে জরাযুত অঙ্গ। রাজ্য ত্যজি গেল বনে মুনিগণ-সঙ্গ।। কঠিন তপস্যা রাজা করে নিরন্তর। ফল-মূলাহার করে বনের ভিতর।। অতিথির পূজা রাজা করয়ে তথায়। হেনমতে সহস্র বৎসর তথা যায়।। উঞ্ছবৃত্তি-ব্রত করি বঞ্চে বহুক্লেশে। ফল-মূল আহার ত্যজিল অবশেষে।। জলপান ত্যজিয়া করিল বাতাহার। তপস্যায় হৈল রাজা অস্থি-র্চ্ম্ম-সার।। হেনমতে গেল দুই সহস্র বৎসর। পঞ্চাগ্নি করিল বৎসরেক নৃপবর।। যোগবলে শরীর ত্যজিল মহারাজ। দিব্য রথে চড়ি গেল ইন্দ্রের সমাজ।। তথা হৈতে ব্রহ্মলোকে গিয়া নরপতি। দশলক্ষ বর্ষ ব্রহ্মলোকে করে স্থিতি।। ব্রহ্মলোক হৈতে রাজা আসে ইন্দ্রস্থানে। কপটে জিজ্ঞাসে ইন্দ্র তার বিদ্যমানে।। জরায় পীড়িত তুমি ছিলে গুণাধার। জরা নিল পুরু তব কনিষ্ঠ কুমার।। কোন্ নীতি শিখাইলে তারে মহারাজ। কেন বা ছাড়িয়া এলে ব্রহ্মার সমাজ।। রাজা বলে, শুন শিখাইলাম যে তারে। রাজনীতি বিধিমত শাস্ত্র-অনুসারে।। রাজছত্র দিয়া আমি কহিনু নন্দনে। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ কথা, শুন একমনে।। ক্রোধী নাহি হয় যেই ক্রোধ করাইলে। গালি দিলে যেই জন কিছু নাহি বলে।। পর দুঃখে দুঃখী যেই, পর উপকারী। মধুর কোমল বাক্য বলে মৃদু করি।। মর্ম্মপীড়া পরেরে না দেয় কোন কালে। কাপট্য-কুবৃত্তি-হীন, সদা সত্য বলে।। আপনার ক্লেশে করে পরে পরিত্রাণ। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ নাহি তাহার সমান।। এ সব লোকের বাক্য শুনিয়া শ্রবণে। পুত্রবৎ করিয়া পালিবে প্রজাগণে।। দানের দারিদ্র্য দুঃখ বিনাশিবে ধনে। বিপ্রগণে তুষিবে বিপুল শ্রদ্ধাদানে।। উৎসব করিয়া বন্ধু-গণেরে তুষিবে। চোর দস্যু দুষ্ট লোক রাজ্যে না রাখিবে।। দয়া করি পালিবে অনাথ বৃদ্ধ-জনে। অবহেলা না করিবে অতিথি সেবনে।। অবশেষে পুত্র করে দিয়া রাজ্যভার। তপস্যা করিবে করি ফল-মূলাহার।। ইন্দ্র বলে, রাজা তুমি পরম পণ্ডিত। তোমার যতেক কর্ম্ম না হয় বর্ণিত।। ইন্দ্রলোক ব্রহ্মলোক ভ্রম নিজ সুখে। তোমার সদৃশ নাহি দেখি তিনলোকে।। কি পুণ্য করিলে তুমি জন্মিয়া সংসারে। কহ নৃপবর, ইচ্ছা আছে শুনিবারে।। রাজা বলে, বৃষ্টিধারা গণিবারে পারি। আমার পুণ্যের কথা কহিবারে নারি।। স্বর্গমর্ত্ত্য পাতালে না দেখি হেন জন। আমার সহিত তার করি যে গণন।। শুনিয়া হাসিয়া বলে ইন্দ্র দেবরাজ। আপনা প্রশংসি নিন্দ দেবের সমাজ।। এই পাপে ক্ষীণপুণ্য হইলে যযাতি। তোমারে না শোভে আর স্বর্গের বসতি।। স্বর্গ হৈতে চ্যুত হও, বলে পুরন্দর। বিস্মিত হইয়া তবে বলে নৃপবর।। কহিলাম বাক্য আমি, আর না নেউটে। ভুঞ্জিব আপন কর্ম্ম আছে যে ললাটে।। এক নিবেদন মোর তোমার গোচরে। কৃপা করি দেবরাজ আজ্ঞা কর মোরে।। পুণ্যবান লোক যত আছে যেই পথে। সেই পথে পড়ি আজ্ঞা কর শচীপতে।। ইন্দ্র বলে, রাজা তব বুদ্ধি নাহি ঘটে। নিজগুণে পুনঃ স্বর্গে আসিবে নিকটে।। এতেক বলিতে তবে পড়িল রাজন। আকাশ হইতে যেন খসিল তপন।। হেনকালে শূন্যে অষ্টকাদি চারি জন। ডাক দিয়া বলে রহ, পড়ে কোন্ জন।। পুণ্যবান্ আজ্ঞা কভু না হয় খণ্ডন। শূন্যেতে হইল স্থিত যযাতি রাজন।। অষ্টক বলিল তুমি, কোন্ মহাজন। কোন্ নাম ধর তুমি, কাহার নন্দন।। সূর্য্য অগ্নি-চন্দ্র-তেজ দেখি যে তোমার। স্বর্গ হৈতে পড়, কেন না বুঝি বিচার।। রাজা বলে, নাম আমি ধরি যে যযাতি। পুরুর জনক আমি, নহুষ-সন্ততি।। পুণ্যবান্ জনেরে করিলাম অমান্য। সেই হেতু ইহলাম আমার ক্ষীণপুণ্য।। ধনহীনে পৃথিবীতে বন্ধুগণ ত্যজে। পুণ্যহীনে স্বর্গ ত্যজে দেবের সমাজে।। অষ্টক বলিল, তুমি আছিলা কোথায়। কি কারণে চ্যুত হইলে, কহিবে আমায়।। রাজা বলে মর্ত্তেতে ছিলাম মহারাজা। পৃথিবীর লক্ষ রাজা সবে কৈল পূজা।। পুত্রে রাজ্য দিয়া পুনঃ গেলাম কাননে। তপ আচরিলাম যে পরম যতনে।। শরীর ত্যজিয়া স্বর্গে করিনু গমন। স্বর্গভোগ করিলাম, না যায় কথন।। সহস্র বৎসর তথা স্বর্গভোগ করি। তথা হৈতে গেলাম যে ইন্দ্রের নগরী।। ইন্দ্রের অমরাবতী নাহি পাঠান্তর। নানাভোগ করিলাম সহস্র বৎসর।। তথা হৈতে ব্রহ্মলোকে হৈল মোর গতি। দশ লক্ষ বর্ষ যে হইল তথা স্থিতি।। নন্দনাদি বন তথা, কি কব সে কথা। অপ্সরীর সহ ক্রীড়া করিলাম তথা।। কামরূপী হইয়া বেড়াই যথা তথা। দেখি ইন্দ্র জিজ্ঞাসিল মোর পুণ্যকথা।। ইন্দ্রে কহিলাম আপনার পুণ্যচয়। তথা হইতে সে কারণে পড়ি মহাশয়।। অষ্টক বলিল, কহ শুনি মহামতি। স্বর্গ হৈতে পড়িলে হইবে কোন্ গতি।। রাজা বলে, ক্ষীণপুণ্য হয় যেই জন। ভৌম-নরকের মধ্যে পড়ে সেইজন।। রজোবীর্য্যযুত হয়ে পুনঃ দেহ ধরে। দ্বিপদ চৌপদ হয় কর্ম্ম-অনুসারে।। পশু কীট পতঙ্গ বিবিধ জন্ম পায়। গৃধ্র-শিবা-গণ তারে পুনঃপুনঃ খায়।। পুনঃ পুনঃ জন্ম হয় পুনঃ পুনঃ মরে। নিজ কর্ম্মে গতাগতি খণ্ডিবারে নারে।। অষ্টক কহিল, তবে কহ সবাকারে। এ ঘোর নিরয়ে নরে তরি কি প্রকারে।। রাজা বলে, তপ-শান্তি-দয়া-দান-ফলে। এ সব স্বর্গের ভোগ হয় অবহেলে।। যজ্ঞ-হোম-ব্রত করে অতিথি সেবন। গুরু-দ্বিজ-সেবা করে দেব আরাধন।। দৈবাধীন সুখ দুঃখে সদা সমজ্ঞান। তবে ত নরক হৈতে পায় পরিত্রাণ।। অষ্টক বলিল, তুমি বড় পুণ্যবান্। হেথায় নাহিক কেহ তোমার সমান।। চিরদিন হেথায় থাকহ মহাশয়। নিশ্চিন্ত হইয়া থাক নাহি ইন্দ্র-ভয়।। রাজা বলে, ক্ষীণপুণ্য রহিতে না পারি। স্বর্গেতে রহিতে আর নহি অধিকারী।। শুনিয়া অষ্টক শিবি বসু প্রতর্দ্দন। রাজারে ডাকিয়া তথা বলে চারি জন।। আমা সবাকার পুণ্য যতেক আছয়। সেই পুণ্যে হেথা তুমি রহ মহাশয়।। রাজা বলে, পরদ্রব্য না করি গ্রহণ। কৃপণের বৃত্তি এই শুন মহাজন।। শিবি রাজা বলে, তুমি তৃণগাছি দিয়া। আমা সবাকার পুণ্য লহ ত কিনিয়া।। রাজা বলে, যাহা কহ বালকের ভাষ। তৃণ দিয়া লব পুণ্য, লোকে উপহাস।। এত শুনি বলে অষ্টকাদি চারিজন। নিশ্চয় হেথায় যদি না রহ রাজন্।। তোমার সহিত তবে যাব চারি জন। যথায় নৃপতি তুমি করিবে গমন।। এতেক বচন যদি তাহারা বলিল। দিব্যমূর্ত্তি পঞ্চ-রথ সেখানে আইল।। পঞ্চরথে চড়িয়া চলিল পঞ্চ জন। ইন্দ্রের অমরাবতী করিল গমন।। বৈশম্পায়ন বলে, শুন জনমেজয়। সেই চারি জন তাঁর কন্যার তনয়।। কন্যার পুত্রের পুণ্যে তরিল যযাতি। পুনরপি স্বর্গে রাজা করিল বসতি।। যযাতি-চরিত্র কথা অমৃত-আধার। শ্রবণে মধুর নাহি সমান ইহার।। শ্রদ্ধাযুক্ত হৈয়া ইহা যে করে শ্রবণ। ধন-ধর্ম্ম-যশ লভে ব্যাসের বচন।। হৃদয়ে নির্ম্মল জ্ঞান হয় তো উদিত। পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচিত।। ৫০. পুরুবংশ কথন জন্মেজয় বলে, স্বর্গে গেল নৃপবর। পুরুকে করিল রাজা রাজ্যের ঈশ্বর।। আর চারি পুত্রে শাপ দিল নরপতি। কি কর্ম্ম করিল তারা, কহ মহামতি।। মুনি বলে, যদু হৈতে জন্মিল যাদব। তুর্ব্বসু হইতে সব যবন-উদ্ভব।। দ্রুহ্যু হৈতে হৈল উৎপত্তি ভোজ-বংশ। অনুর ঔরসে জন্ম ম্লেচ্ছ-অবতংস।। পুরুর ঔরসে জন্ম হইল পৌরব। বংশে যাঁর নিজে হইয়াছেন উদ্ভব।। তপ-জপ-যজ্ঞ-ব্রত-ধর্ম্মেতে তৎপর। পুরুর যতেক কর্ম্ম লোকে-অগোচর।। পুরুরাজ পাটেশ্বরী পৌষ্টী নাম ধরে। তিন পুত্র জন্মাইল তাহার উদরে।। প্রবীর প্রধান পুত্রে দির রাজ্যভার। শূরসেনী নামে কন্যা বনিতা তাঁহার।। তাঁর পুত্র মনস্যু হইল নরবর। তিন পুত্র হৈল তাঁর পরম সুন্দর।। তিন পুত্র মধ্যে হৈল রাজা সংহনন। মিশ্রকেশী-গর্ভে জন্মিলেক দশ জন।। দশ পুত্র মধ্যে রাজা হইল মতিনার। তংসু আদি চারি পুত্র হইল তাঁহার।। ঈলিন তংসুর পুত্র বল মহাতেজা। তাঁর পঞ্চ পুত্রে জ্যেষ্ঠ দুষ্মন্ত হৈল রাজা।। শকুন্তলা ভার্য্যা তাঁর বিখ্যাত সংসার। ভরত নামেতে পুত্র হেইল তাঁহার।। ভরতের গুণ কর্ম্ম কহিতে বিস্তার। ভূমন্যু বলিয়া পুত্র হইল তাঁহার।। সুহোত্র বলিয়া রাজা তাহাতে উৎপত্তি। তাঁর পুত্র হস্তী নামে পায় প্রতিপত্তি।। বসাইল আপনার নামেতে নগর। হস্তিনা বলিয়া নাম ভুবন ভিতর।। অজমীঢ় মহারাজ হ্স্তীর-নন্দন। তাঁর পৌত্র রাজা হৈল নাম সম্বরণ।। সম্বরণ-রাজ্যকালে হৈল অনাবৃষ্টি। দুর্ভিক্ষ হইল লোকে লুপ্তপ্রায় সৃষ্টি।। পাঞ্চাল- দেশের রাজা বলে নিল দেশ। সম্বরণ করিলেন বনেতে প্রবেশ।। সিন্ধু-নদী-কূলে হিমালয়ের নিকটে। সহস্র বৎসর তথা রহিল সঙ্কটে।। কৃপা করি বশিষ্ঠ সহায় হৈল তাঁর। পুনরপি রাজ্য-প্রাপ্ত হইল তাঁহার।। নানা যজ্ঞ দান তবে করিল নৃপতি। তাঁর জায়া সূর্য-কন্যা নামেতে তপতী।। তাঁহার নন্দন কুরু বিখ্যাত ভূতলে। কুরুক্ষেত্র কৈল রাজা নিজ পুণ্য ফলে।। জন্মেজয়-আদি করি পঞ্চ পুত্র তাঁর। ধৃতরাষ্ট্র রাজা জন্মেজয়ের কুমার।। প্রতীপ নামেতে ধৃতরাষ্ট্রের নন্দন। তিন পুত্র হৈল তাঁর বিখ্যাত ভুবন।। দেবাপি শান্তনু বাহ্লীক যে নাম হয়। তিন পুত্র প্রতীপের ঔরসে জন্মায়।। জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবাপি সন্ন্যাস-ধর্ম্ম নিল। শৈশব-কালেতে সেই অরণ্যে পশিল।। শান্তনু দ্বিতীয় পুত্র হৈল নরপতি। গঙ্গাগর্ভে তাঁর পুত্র ভীষ্ম মহামতি।। বিবাহ না করে ভীষ্ম, বংশ না হইল। সত্যবর্তী কন্যারে পিতাকে বিভা দিল।। তাঁর গর্ভে শান্তনুর যুগল কুমার। চিত্রাঙ্গদ প্রথম বিচিত্রবীর্য্য আর।। গন্ধর্ব্বে মারিল জ্যেষ্ঠ চিত্রাঙ্গদ বীরে। সে রাজ্য বিচিত্রবীর্য্য হৈল দণ্ডধরে।। বংশ না হইতে তাঁর হইল নিধন। পুনর্ব্বার বৃদ্ধি কৈল ব্যাস তপোধন।। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু আর বিদুর সে নামে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্র হৈল একশত ক্রমে।। ভ্রাতৃ সহ যুদ্ধে তারা হইল সংহার। বংশরক্ষা হেতু হৈল পাণ্ডুর কুমার।। দেব-বরে পঞ্চপুত্র পাণ্ডুর হইল। যাঁদের মহিমা-যশে পৃথিবী পূরিল।। যুধিষ্ঠির ভীম আর বীর ধনঞ্জয়। নকুল সুরূপ সহদেব মহাশয়।। অর্জ্জুনের পুত্র হৈল সুভদ্রা-উদরে। যৌবনে মরিল সেই ভারত-সমরে।। তাঁর ভার্য্যা উত্তরা আছিলা গর্ভবতী। পরীক্ষিত মহারাজ তাহাতে উৎপত্তি।। আপনি হইলা তুমি তাঁহার নন্দন। তোমার নন্দন এই দেখ দুই জন।। শতানীক আর শঙ্কু দুই সহোদর। অশ্বমেধদত্ত শতানীকের কোঙর।। পুরুবংশ সবিস্তারে যেই জন শুনে। আয়ুর্যশ পুণ্য তার বাড়ে দিনে দিনে।। ৫১. মহাভিষ রাজার প্রতি ব্রহ্মার অভিশাপ এবং শান্তনুর উৎপত্তি জন্মেজয় বলে, মুনি কহ আরবার। সংক্ষেপে কহিলা কহ করিয়া বিস্তার।। ত্রৈলোক্যপাবনী গঙ্গা বিষ্ণু-অংশে জন্ম। শান্তনুর ভার্য্যা শুনি এ অদ্ভুত কর্ম্ম।। মুনি বলে, কহি শুন তাহার কারণ। মহাভিষ নামে রাজা ইক্ষবাকু-নন্দন।। ইন্দ্রে সম তেজ যজ্ঞ করিল বিস্তর। সহস্রেক অশ্বমেধ কৈল নৃপবর।। দেব-দ্বিজ-দরিদ্রে তুষিল মহামতি। দানেতে পৃথিবী পূর্ণ কৈল নরপতি।। ব্রহ্মলোকে গেল রাজা যজ্ঞপুণ্যফলে। ব্রহ্মার সহিত তথা বৈসে কুতূহলে।। বহুকাল তথায় আছয়ে নরপতি। একদিন দেখে রাজা দৈবের যে গতি।। ধ্যানেতে আছেন ব্রহ্মা বসিয়া আসনে। সম্মুখে বেষ্টিত যত সিদ্ধ-মুনিগণে।। ব্রহ্মার সভার তুল্য, নাহি পাঠান্তর। সবে তথা চতুর্ম্মুখ, গৌর-কলেবর।। দক্ষ-আদি প্রজাপতি, ইন্দ্র আদি দেবে। দেব-ঋষি-মুনিগণ নিত্য আসি সেবে।। সভা করি বসিয়াছে মুনির সমাজ। তথায় আছয়ে মহাভিষ মহারাজ।। গঙ্গাদেবী আইলেন ব্রহ্মার সদন। হেনকালে তেজোবন্ত বহিল পবন।। বায়ুতেজে জাহ্নবীর উড়িল বসন। দেখি হেঁটমুণ্ড করিলেন সিদ্ধগণ।। অপূর্ব্ব গঙ্গার অঙ্গ দেখিয়া সঘনে। মহাভিষ রাজা দেখে নিশ্চল-নয়নে।। মহাভিষ রাজা অতি রূপে অনুপাম। তাঁর দিকে গঙ্গাদেবী চান অবিরাম।। দোঁহার দেখিয়া দৃষ্টি কহে প্রজাপতি। মোর লোকে আসি রাজা করিলা দুর্নীতি।। ব্রহ্মলোকে আসি কর মনুষ্য আচার। মর্ত্ত্যে জন্ম লয়ে ভোগ কর পুনর্ব্বার।। পুনরপি হেথায় আসিবা পুণ্যবলে। চন্দ্রবংমে জন্ম লহ গিয়া ভূমণ্ডলে।। ব্রহ্মার পাইয়া আজ্ঞা চিন্তে নরপতি। তমা হৈতে পতন হইল শীঘ্রগতি।। চন্দ্রবংশে মহারাজ প্রতীপ আছিল। মহাভিষ রাজা তাঁর গৃহে জন্ম নিল।। বাহুড়িল গঙ্গা করি ব্রহ্মা দরশন। পথেতে দেখিল আসে বসু অষ্টজন।। বিরস-বদন গঙ্গা দেখি বসুগণে। জিজ্ঞাসিল তোমরা চিন্তিত কি কারণে।। বসুগণ বলে, চিন্তা করি নিজ দোষে। বশিষ্ঠ দিলেন শাপ সবে মহারোষে।। পৃথিবীতে জন্ম হবে, কাঁপিছে অন্তর। বিশেষে মনুষ্য-যোনি নরক দুস্তর।। উপায় না দেখি সবে, চিন্তি সে কারণ। ভাল হৈল তব সঙ্গে হৈল দরশন।। কোটি কোটি পাপী পাপে করহ উদ্ধার। আমা সবাকার তুমি কর প্রতিকার।। গঙ্গা বলে, কি করিব কহ সন্নিধান। যে করিব অঙ্গীকার না করিব আন।। বসুগণ বলে, মর্ত্ত্যে জন্মিব নিশ্চয়। নরযোনি জন্মিতে হতেছে বড় ভয়।। আপনি মনুষ্যলোকে হয়ে রাজ-নারী। আমা সবাকার তুমি হও গর্ভধারী।। আর এক দিবেদন করি যে তোমারে। জন্মমাত্র ভাসাইয়া দিও তব নীরে।। বসুগণ-বাক্যে গঙ্গা স্বীকার করিল। শুনি অষ্ট বসু তবে আনন্দিত হৈল।। কুরুবংশে আছিল প্রতীত নামে রাজা। ধর্ম্মেতে তৎপর বড়, তপে মহাতেজা।। দেবাপি নামেতে তাঁর প্রথম নন্দন । অল্পকালে সন্ন্যাসী হইয়া গেল বন।। দেবাপি বিহনে রাজা হৈল পুত্রহীন। গঙ্গাকূলে থাকে সদা, বয়সে প্রবীণ।। তপ জপ ব্রত করে, বেদ অধ্যয়ন। বৃদ্ধকালে নরপতি রূপেতে মদন।। তাঁর রূপ গুণ দেখি প্রীতি যে পাইল। জল হৈতে গঙ্গাদেবী বাহির হইল।। জাহ্নবীর রূপে নিন্দে এ তিন ভুবন। দ্বিতীয় চন্দ্রের যেন হইল কিরণ।। দক্ষিণ ঊরুতে গিয়া বসিল রাজার। দেখিয়া বিস্মিত হৈল কৌরব-কুমার।। রাজা বলে, কি করিব, কি বাঞ্ছা তোমার। সত্য করি কহ যেই বাঞ্ছা আপনার।। কন্যা বলে, কুরুশ্রেষ্ঠ তুমি মহামতি। তোমায় ভজিনু আমি, হও মোর পতি।। রাজা বলে, পরদার আমি নাহি ভজি। পরদার পরশিলে নরকেলে মজি।। কন্যা বলে, নহি আমি পরের গৃহিণী। দেবকন্যা আমি, মোরে ভজ নৃপমণি।। রাজা বলে, কন্যা নাহি বল হেন বাণী। দক্ষিণ ঊরুতে বৈসে পুত্রবধূ গণি।। পুরুষের বাম ঊরু ভার্য্যার আসন। বুঝিয়া এমত বাক্য কহ কি কারণ।। সে কারণে তোমারে বধূর মধ্যে গণি। কেমনে করিব ভার্য্যা, অনুচিত বাণী।। গঙ্গা বলে, রাজা তুমি ধর্ম্ম-অবতার। তোমার মহিমা যত বিখ্যাত সংসার।। তোমার বচনে আমি হইনু স্বীকার। বরিব তোমার পুত্রে এই অঙ্গীকার।। আমার নিয়ম এই শুন মহারাজ। নিষেধ না করিবে আমার প্রিয়কাজ।। তবে সে তোমার পুত্রে করিব বরণ। এত বলি অন্তর্ধান হইল তখন।। কন্যার বচনে রাজা আনন্দিত হৈল। পুত্র হবে বলি রাজা ভার্য্যারে কহিল।। ভার্য্যা সহ ব্রতাচার করিলেন ভূপ। কতদিনে জন্মে তাঁর পুত্র অনুরূপ।। দশমাস দশ দিনে হইল কুমার। রাজীব-লোচন মুখ চন্দ্রের আকার।। শান্তশীল পুত্র, নাম শান্তনু থুইল। তাঁহার অনুজে নাম বাহ্লীক রাখিল।। দিনে দিনে বাড়ে তাঁর যুগল তনয়। কত দিনে দেখি পুত্র যৌবন সময়।। শান্তনুরে নিকটেতে আনি নৃপবর। রাজনীতি ধর্ম্ম-শিক্ষা দিলেন বিস্তর।। একদিন পুত্রে ডাকি কহিলা রাজন। বিস্মৃত না হও বৎস আমার বচন।। একদা শুনহ পুত্র বিধির বিধানে। আসিল সুন্দরী এক মম সন্নিধ্যানে।। বধূত্বে তাহারে আমি করিনু বরণ। অঙ্গীকার করি কন্যা করিল গমন।। পরিচয়ে দেবকন্যা জানিনু তাঁহায়। তোমার সদনে যদি আসে পুনরায়।। ভজিবে তাহারে যদি সে তোমারে বরে। নিষেধ না করিবা সে যেই কর্ম্ম করে।। স্বীকৃত হইল পুত্র পিতার বচনে। শান্তনুরে রাজ্য দিয়া রাজা গেল বনে।। মহাভারতের কথা অমৃতের ধার। কাশী কহে, শুনি ভববারি হই পার।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon