মহাভারত:শান্তিপর্ব-০২৬-০৩০

২৬.শিবচতুর্দ্দশী-ব্রত উপাখ্যান
শান্তনু-কুমার সর্ব্বশাস্ত্র বিশারদ।
ইতিহাস কথা কহে শুনে সভাসদ।।
ধৃতি নামে এক দ্বিজ বড় দুষ্টমতি।
বুদ্ধিবলে হরে সেই পরের যুবতী।।
সদাকাল দুষ্টবুদ্ধি পাপী দুরাচার।
মল্ল নামে দ্বিজবর জনক তাহার।।
দুষ্ট পুত্র দেখি বিপ্র ভাবে নিরন্তর।
কিরূপে করিব বশ আপন কোঙর।।
নিগড় বন্ধনে বান্ধি রাখিলেন ঘরে।
তপস্যা করিতে মল্ল গেল গঙ্গাতীরে।।
বড় দুষ্ট দ্বিজ সেই ভাবে মনে মনে।
বুদ্ধিবলে মুক্ত কৈল নিগড় বন্ধনে।।
দণ্ডক নামেতে বনে গেল পলাইয়া।
ক্ষুধার নিবৃত্তি কৈল ফল-মূল খাইয়া।।
ভ্রমিল কানন মধ্যে দিন অবশেষ।
ক্ষুধায় পীড়িত হৈল রজনী প্রবেশ।।
চিন্তাকুল ‍দ্বিজপুত্র ভ্রময়ে কাননে।
কতদূরে রম্য স্থান দেখে মহাবনে।।
উত্তম প্রশস্ত ভূমি দেখে অনুপাম।
কি কহিব তার গুণ হরের বিশ্রাম।।
রম্যস্থান দেখিয়া রহিল দ্বিজবর।
আরোহণ কৈল বিল্ববৃক্ষের উপর।।
পশুভয়ে উঠিয়া রহিল বৃক্ষডালে।
ভূতগণ সহ তথা আইলা শূলপাণি।।
বৃক্ষতলে বসিয়া রহিলা মহেশ্বর।
ভূতগণ বেড়ি আছে ঠাকুর শঙ্কর।।
ভূতের ভ্রূকুটি দেখি দ্বিজের তনয়।
নিঃশব্দ রহিল বড় মনে পেয়ে ভয়।।
সেই দিন তিথি শিবরাত্রি চতুর্দ্দশী।
দ্বিজপুত্র অরণ্যে রহিল উপবাসী।।
ক্ষুধাতুর ভয়ে নিশি করে জাগরণ।
পিতা মাতা চিন্তি বিপ্র করেন রোদন।।
ভাবিত শরীরে নিদ্রা নাহি হৈল তার।
আকুল শরীরে রহে করি নিরাহার।।
চক্ষুজল পড়ে তার পৃথিবী-উপরে।
বিল্বপত্র সনে পড়ে মহেশের শিরে।।
সন্তুষ্ট হইলা শিব পুষ্পজল পেয়ে।
হেন বুঝি কেহ পূজে শিবরাত্রি পেয়ে।।
কৈলাসে পরম সুখ ভুঞ্জিবে বিশেষ।
এই বর দিলা তারে ঈশ্বর মহেশ।।
শিব দিলা বর, তাহা শুনি দ্বিজমণি।
বৃক্ষ হৈতে নামিয়া করিল স্তুতিবাণী।।
বৃক্ষতলে আছ তুমি, আমি নাহি জানি।
করিনু দুষ্কর দোষ ক্ষম শূলপাণি।।
সুমতি হইল বিপ্র শিব-দরশনে।
বহুবিধ স্তব কৈল বেদের বিধানে।।
তুমি অনাথের নাথ দুষ্ট বিনাশন।
নমো নমঃ শম্ভু ঋষি নমঃ পঞ্চানন।।
এরূপে অনেক স্তুতি করিল ব্রাহ্মণ।
তুষ্ট হৈয়া বর তারে দিলা ত্রিলোচন।।
মহাসুখী হও তুমি সংসার ভিতরে।
তোমার মহিমা খ্যাত হবে চরাচরে।।
অন্তে শিবলোকে যাবে চড়ি দিব্য রথে।
চতুর্দ্দশী-উপবাস মহাপুণ্য হৈতে।।
ব্রত উপবাস তুমি কর জাগরণ।
শিবরাত্রি-নিয়মে থাকিবে সর্ব্বক্ষণ।।
শিবরাত্রিদিনে যেবা করে শিবপূজা।
মহাসুখ ভুঞ্জিয়া কৈলাসে হয় রাজা।।
হেনমতে রজনী বঞ্চিয়া ঘোর বনে।
পাইয়া শিবের বর আইল নিজস্থানে।।
নিত্য নিয়মিত করে শিবের পূজন।
শিবরাত্রি ব্রত উপবাস জাগরণ।।
এইরূপে এইকালে বঞ্চিয়া কৌতুকে।
অন্তকালে শিবলোকে গেল মহাসুখে।।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হৈল দণ্ডী দণ্ডদায়।
পূর্ব্বের কাহিনী এই কহিনু তোমায়।।
ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।
২৭. শিব চতুর্দ্দশীর মাহাত্ম্য
যুধিষ্ঠির বলিলেন কর অবধান।
ব্রতের মাহাত্মা কিছু করহ বাখান।।
ভীষ্ম বলিলেন তাহা কহিতে কে পারে।
সংক্ষেপেতে কিছু রাজা কহিব তোমারে।।
ইক্ষ্বাকু বংশেতে রাজা চিত্রভানু নাম।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ রণে অনুপাম।।
জম্বুদ্বীপে একচ্ছত্র হৈল নরপতি।
কুবের সদৃশ তার ঐশ্বর্য্য বিভূতি।।
শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে দিনকর।
প্রজার পালনে যেন রাম রঘুবর।।
দ্বিজসেবা বিনা রাজা অন্য নাহি জানে।
যেই যাহা মাগে দেয় তোষয়ে ব্রাহ্মণে।।
শিবব্রতে রত সদা শিবপরায়ণ।
শিবচতুর্দ্দশী ব্রত করে আচরণ।।
ভার্য্যার সহিত রাজা উপবাস করি।
দান ধ্যান করি বসিয়াছে অন্তঃপুরী।।
হেনকালে অষ্টাবক্র সঙ্গে শিষ্যগণ।
সত্বরে চলিয়া গেল রাজার সদন।।
দেখি আস্তে ব্যাস্তেতে উঠিয়া নরপতি।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল শীঘ্রগতি।।
বসিবারে আনি দিল দিব্য কুশাসন।
একে একে বসিল সকল মুনিগণ।।
সূপকারগণে আজ্ঞা দিল নরবর।
দিব্য উপহার দ্রব্য আসিল বিস্তর।।
যথাযোগ্য সবাকারে করায় ভোজন।
ভোজনান্তে দ্বিজগণ কৈল আচমন।।
তাম্বূল কর্পূর আদি করিল ভক্ষণ।
নৃপে চাহি অষ্টাবক্র চলিল বচন।।
ভ্রাতৃ মিত্র আদি সবে করিল ভোজন।
ভার্য্যা সহ উপবাস কর কি কারণ।।
দ্বিতীয় প্রহর বেলা সুদৃশ্য ভাস্কর।
কোন হেতু উপবাসে আছ নরবর।।
কিবা চিত্তে দুঃখ তব না জানি কারণ।
আত্মাকে দিতেছ দুঃখ কোন্ প্রয়োজন।।
এক আত্মা জগতের হন নারায়ণ।
আত্মা তুষ্ট হৈলে তুষ্ট ব্রহ্ম সনাতন।।
ষটচক্র কথা রাজা শুন দিয়া মন।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে স্থিত নারায়ণ।।
চতুর্থ অদ্ভূত দল প্রথমে গণিবে।
দ্বিতীয়েতে অষ্টদল উপরে বর্ণিবে।।
তৃতীয়েতে শতদল তাহার উপরে।
সূক্ষারূপে বৈসে জীব তাহার ভিতরে।।
মাঝেতে কেশর চতুর্দ্দিকে কর্ণিকার।
জীব আত্মা স্থিত তথা পদ্মের আকার।।
তদন্তে অদ্ভূত চক্র চতুর্থ উপর।
অষ্টোত্তর শতদল তাহার ভিতর।।
পঞ্চশত দল জীব মধ্যে কর্ণিকার।
কহিব তাহার কথা করিয়া বিস্তার।।
তদন্তেরে শতচক্র দলের নির্ম্মাণ।
দেব মুনিগণ করে যাহার বাখান।।
চতুর্দ্দিকে সূক্ষরূপে দলের গাঁথনি।
স্বহস্তে বিধাতা তাহা নির্ম্মাণ আপনি।।
চতুর্দ্দিকে কর্ণিকার মধ্যেতে কেশর।
সূক্ষারূপে তাহে উপবিষ্ট দামোদর।।
তার তিন ভাগ মধ্যে বৈসে নারায়ণ।
সুসিদ্ধ সজ্ঞান ভক্তি লভে যেই জন।।
শরীরেতে আত্মারূপে বৈসে নারায়ণ।
তপ ব্রত ফলে তার কোন্ প্রয়োজন।।
রাজা বলে মুনিবর কহিলে প্রমাণ।
মম পূর্ব্বজন্ম কথা কর অবধান।।
চতুর্দ্দশী মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।
ইহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।।
অজ্ঞানে সজ্ঞানে নর উপবাস করি।
সমাহিত হয়ে পূজা কর ত্রিপুরারী।।
বিশ্বপত্র ধুস্তুর কুসুম রাশি রাশি।
রক্তচন্দনাদি নানা গন্ধে বস্ত্র ভূষি।।
পূজা ভক্তি করি স্তব করে পঞ্চাননে।
তাহার পূণ্যের কথা কি কব বদনে।।
পৃথিবীর রেণু যেবা গণিবারে পারে।
সরোবর জল যদি কলসীতে ভরে।।
বৃষ্টিবিন্দু জল যদি পারয়ে গণিতে।
তথাপি তাহার পুণ্য না পারি বলিতে।।
পূর্ব্বে ব্যাধকুলে জন্ম আছিল আমার।
সুস্বর আছিল নাম মহা দুরাচার।।
পরদ্রব্য পরবৃত্তি করি অপহার।
অধর্ম্মেতে রত ছিনু বিখ্যাত সংসার।।
মৃগ ব্যাঘ্র আদি পশু নানা পক্ষীগণ।
যতেক করিনু বধ না যায় লিখন।।
সেইরূপে নির্ব্বাহিনু কতেক দিবস।
একদিন অরণ্যে গেলাম দৈববশ।।
কুজ্বাটিতে অন্ধকার দেখিতে না পাই।
একেশ্বর ঘোর বনে ভ্রমিয়া বেড়াই।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে হৈল দিবা অবসান।
আসিতে না পারি গৃহে হইনু অজ্ঞান।।
ঘোর অন্ধকার নিশি চতুর্দ্দশী দিনে।
ক্ষুধা তৃষ্ণাযুক্ত আমি ভ্রমি একা বনে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে তথা হৈল ঘোর নিশি।
বিল্ববৃক্ষে আরোহিনু মনে ভয় বাসি।।
নিত্য নিত্য মৃগয়া করিয়া যাই ঘরে।
নগরে বেচিয়া আনি দিই পরিবারে।।
তবেত ভক্ষণ করে ভার্য্যা পুত্রগণ।
উপবাসী রহি আজি দৈবের কারণ।।
মম মুখ চাহি আছে ভার্য্যা পুতগণ।
ধনহীন নরজন্ম হয় অকারণ।।
ভ্রাতৃ বন্ধু অনেক আছয়ে জ্ঞাতিগণ।
সবে ধনবান আমি দরিদ্র দুর্জ্জন।।
উপবাসী গৃহে আছে ভার্য্যা পুত্রগণ।
কেহ না চাহিবে ধনহীনের কারণ।।
এইরূপে হৃদয়েতে করিয়া চিন্তন।
আকুল হইয়া বহু করিনু ক্রন্দন।।
অশ্রুজল পড়ি মম ভাসে কলেবর।
পব্বপত্র ছিল এক বৃক্ষের উপর।।
পত্র পড়ে মম অশ্রুজলের সহিত।
আচম্বিতে একপত্র পড়িল ত্বরিত।।
তাহাতে সন্তুষ্ট হন দেব পঞ্চান।
নিরাহারে সেই রাত্রি করিনু বঞ্চন।।
প্রাতঃকালে মৃগ মারি লইয়া ত্বরিত।
নিজ গৃহে গিয়া আমি হৈনু উপনীত।।
আমার বিহনে সবে দুঃখিত আছিল।
মোরে দেখি সবে ক্ষুধা তৃষ্ণা পাসরিল।।
নগরেতে মৃগমাংস শীঘ্রগতি লৈয়া।
বেচিয়া ভক্ষণ দ্রব্য আনিনু কিনিয়া।।
শীঘ্রগতি ভার্য্যা গিয়া করিল রন্ধন।
হেনকালে অতিথি আইল এক জন।।
সেই অতিথিরে আমি করাই ভোজন।
পারণের মহাফল পাই সে কারণ।।
এইরূপে কত দিন দুঃখে মোর গেল।
আয়ুঃশেষে মৃত্যু আসি উপনীত হৈল।।
মহাভয়ঙ্কর দুই যমের কিঙ্কর।
আসি মহাপাশে মোরে বান্ধিল সত্বর।।
যমের এ সব কর্ম্ম জানি পঞ্চানন।
দ্রুতগতি পাঠাইল দূত দুইজন।।
শিবের অকৃতি দোঁহে পরম সুন্দর।
অকপটে মোর পাশ খুলিল সত্বর।।
দেখিয়া বিস্মিত যমদূত দুইজন।
জিজ্ঞাসিল কে তোমরা কহ বিবরণ।।
এতেক শুনিয়া তারা করিল উত্তর।
শিবের নিকটে থাকি শিবের কিঙ্কর।।
শিবের আজ্ঞায় পাশ করিনু মোচন।
কহ শুনি কে তোমরা হও দুই জন।।
বিকৃত আকার মূর্ত্তি লোহিত নয়ন।
কোথায় নিবাস কর কাহার নন্দন।।
কি হেতু এ ব্যাধপুত্রে করিলে বন্ধন।
এত শুনি যমদূত বলয়ে বচন।।
মোরা দুই জন ধর্ম্মরাজ অনুচর।
তাঁর আজ্ঞা বহি ফিরি যত চরাচর।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব চারণ নরগণ।
সংসারের মধ্যেতে মরয়ে যত জন।।
তাহারে লইয়া যায় যমের সদন।
পাপ পুণ্য বুঝি দণ্ড করেন শমন।।
এই ব্যাধ মহাপাপী অধম দুর্জ্জন।
ইহার পাপের কথা না যায় কথন।।
যমপুরে গেলে পাপ হইবে খণ্ডন।
কি কারণে এই দুষ্টে করিলে মোচন।।
এত শুনি পুনঃ কহে শিবের কিঙ্কর।
তোমার ঈশ্বরে গিয়া কহরে বর্ব্বর।।
শিবের অনুজ্ঞা মোরা লঙ্ঘিতে না পারি।
এই ব্যাধপুত্রে লয়ে যবে শিবপুরী।।
সর্ব্বপাপে এই ব্যাধ হইবে মোচন।
শিব চতুর্দ্দশী ব্রত কৈল আচরণ।।
তোর কিছু অধিকার নাহিক ইহাতে।
এত বলি মোরে নিল শিবের সভাতে।।
তিন লক্ষ বর্ষমম তথা হৈল স্থিতি।
দেবতুল্য নানা ভোগ ভুঞ্জি নিতি নিতি।।
অনন্তর ইন্দ্রলোকে হইল গমন।
তিন কল্প কথা সুখে করিনু বঞ্চন।।
অনন্তর হৈল মোর ব্রহ্মলোকে স্থিতি।
চৌদ্দ মন্বন্তর তথা হইল বসতি।।
অনন্তর বৈকুণ্ঠেতে করিণু প্রয়াণ।
লক্ষী সহ বিরাজিত যথা ভগবান।।
তিনকোটি বর্ষ তথা সুখেতে বঞ্চিনু।
তারপর এই রাজবংশেতে জন্মিনু।।
অজ্ঞানেতে শিবচতুর্দ্দশী মহাব্রত।
আচরিনু হীনজাতি হয়ে ব্যাধসুত।।
সেই পুণ্যে হেন গতি হইল আমার।
ইক্ষ্বাকুবংশেতে জন্ম বৈভব বিস্তর।।
শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত করি আচরণ।
সে কারণে উপবাসী আছি তপোধন।।
এত শুনি সবিস্ময় মহা তপোধন।
পুনরপি নৃপতিরে জিজ্ঞাসে কারণ।।
অপমান পেয়ে দুই যমের কিঙ্কর।
ধর্ম্মরাজে দিয়া কিবা করিল উত্তর।।
রাজা বলে মুনিবর কর অবধান।
বিস্ময় হইয়া দূত হয়ে অপমান।।
ক্রোধে থর থর অঙ্গ সঘনে কম্পিত।
যমের সাক্ষাতে গিয়া হৈল উপনীত।।
ভীতমন দুতগণে দেখিয়া শমন।
জিজ্ঞাসিল কহ দূত কেন দুঃখী মন।।
আমার কিঙ্কর তোরা নির্ভয় অন্তরে।
কার শক্তি তোলবারে হিংসা করিবরে।।
দূতগণ বলে আর কি কহিব কথা।
দণ্ডভগ্ন আজি হৈতে হইল সর্ব্বথা।।
আজি হৈতে জগতের হইল নিস্তার।
পাপপুণ্য বিচার ঘুচিল তা সবার।।
সুস্বর নামেতে ব্যাধ মহা দুরাচার।
আজি দৈবে পরলোক হইল তাহার।।
তাহারে আনিতে মোরা করিনু গমন।
পাশে বান্ধি লয়ে আসি করিয়া তাড়ন।।
হেনকালে আসি দুই শিবের কিঙ্কর।
পাশ হৈতে মুক্ত তারে করিল সত্বর।।
নানা কটুত্তর বলি আমা দুই জনে।
রথে তুলি তারে লয়ে গেল দূতগণে।।
এই হেতু চিত্তে দুঃখ হইল সবার।
আজি হৈতে তোমার ঘুচিল অধিকার।।
এত শুনি হাসি যম বলয়ে বচন।
হেন কর্ম্ম আর না করিহ কদাচ।।
শিব নামে রত যেই বিষ্ণুপরায়ণ।
বিষ্ণু শিব সমরূপে ভাবে যেই জন।।
ব্রত আচারিয়া যেবা পূজে পঞ্চানন।
চতুর্দ্দশী মহাব্রত যে করে সাধন।।
ভূমিদান অন্নদান করয়ে যে জন।
বিষ্ণুভক্তি করি কিবা পূজয়ে ব্রাহ্মণ।।
একাদশী চান্দ্রায়ণ পূর্ণিমার ব্রত।
সংসারের মধ্যে নর ইহাতে যে রত।।
তীর্থ পর্য্যটন করি পূজে দেবরাজে।
বারাণসীক্ষেত্রে গিয়া যেবা প্রাণ ত্যজে।।
তারপরে অধিকার নাহিক আমার।
কদাচ না যাবি তোরা তারে অনিবার।।
এত শুনি হৈল দূত সবিস্ময় মন।
কহিনু তোমারে আমি কথা পুরাতন।।
এত শুনি অষ্টবক্র হন হৃষ্টমন।
আশীষ করিয়া নৃপে গেল তপোধন।।
সেই হৈতে হৈল ঋষি শিবপরায়ণ।
শিবব্রতে রত হৈল অচ্যুত নন্দন।।
বসন্ত প্রথম ঋতু চতুর্দ্দশী দিনে।
এই উপবাস যেবা করে একমনে।।
সর্ব্বকালে ফল লভে নাহিক সংশয়।
শিব চতুর্দ্দশী ব্রতে মহাফল পায়।।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথনে।
কাশীদাস দেব কহে গোবিন্দ চরণে।।
২৮. অনন্ত ব্রতের মাহাত্ম্য
ভীষ্ম বলিলেন শুন রাজা যুধিষ্ঠির।
শোক দূর কর রাজা চিত্ত কর স্থির।।
আর কিছু ইতিহাস শুন দিয়া মন।
অনন্ত নামেতে ব্রত অপূর্ব্ব কথন।।
নারদের মুখে পূর্ব্বে করিণু শ্রবণ।
সেই ইতিহাস কহি শুন দিয়া মন।।
চিত্রাঙ্গদ নামে ‍রাজা কৌশলেতে স্থিতি।
সোমবংশ চূড়ামণি মহাধর্ম্মে মতি।।
শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে বৈশ্রবণ।
কীর্ত্তি ভাগীরথ সম মহাবিচক্ষণ।।
মন্ত্রণাতে বৃহস্পতি গুণে গুণধাম।
প্রজার পালনে যেন ছিলেন শ্রীরাম।।
অনন্ত নামেতে ব্রত গোবিন্দ উদ্দেশে।
ভার্য্যা সহ নরবর আচরে বিশেষে।।
বিচিত্র মন্দির এক করিয়া রচন।
লিঙ্গরূপে তাহাতে স্থাপিয়া নারায়ণ।।
রাজধর্ম্ম নিত্যকর্ম্ম ত্যজিয়া রাজন।
আপনি হস্তেতে করে মন্দির মার্জ্জন।।
অনন্তরে স্নানদান করি নরবর।
নানা উপহারে পূজে দেব দামোদর।।
পূজা শেষে করাইল ব্রাহ্মণ ভোজন।
অবশেষে লইয়া কুটুম্ব পরিজন।।
আনন্দিত হয়ে সবে করয়ে ভোজন।
এইরূপে নিত্য নিত্য পূজে নারায়ণ।।
বাদ্য বাজাইয়া এই জানায় নগরে।
অনন্ত নামেতে ব্রত বিখ্যাত সংসারে।।
দ্বিজ ক্ষন্ত্র বৈশ্য শূদ্র চতুর্ব্বিধ জন।
এই ব্রত যেবা না করিবে আচরণ।।
সবংশে লইব তারে শমনের ঘরে।
নগরে বাজারে এইরূপ বাদ্য করে।।
রাজভয়ে সর্ব্বলোক প্রাণপণ করে।
নিয়ম করিয়া শুভ ব্রত যে আচরে।।
ব্রত পুণ্যফলে সবে নিষ্পাপ হইল।
যতদূর ভুপতির অধিকার ছিল।।
যত লোক ছিল ভূপতির অধিকারে।
ব্রতপুণ্যফলে যার বৈকুণ্ঠ নগরে।।
সত্যকালে যেন লোক পুণ্যবান ছিল।
রাজার প্রতাপে তেন দ্বাপর হইল।।
জানিয়া দ্বাপরযুগ এ সব কারণ।
চিন্তাকুল হইয়া ভাবিল মনে মন।।
পূর্ব্বে প্রজাপতি হেন করিল বিচার।
সংসার উপরে দিল মম অধিকার।।
কোটি লোক মধ্যে কেহ মম অধিকারে।
নিয়ম করিয়া ভজিবেক দামোদরে।।
সহস্রেক মধ্যে কেহ হবে মহাজন।
মহাব্রত আচরি ভজিবে নারায়ণ।।
যতেক সংসারে প্রজা হবে পাপাচারী।
অল্প আয়ু হয়ে যাবে যমের নগরী।।
এইরূপ নিয়ম করিয়া সৃষ্টিধর।
অধিকার দিল মোরে সংসার উপর।।
মহাধর্ম্মশীল দেখি এই নৃপমণি।
ব্রহ্মার নিয়ম ভঙ্গ করে হেন জানি।।
কোনমতে ব্রত ভঙ্গ হইলে রাজার।
তবে সে নিয়ম রক্ষা হয়ত ব্রহ্মার।।
এইরূপে দ্বাপর ভাবিয়া মনে মন।
বিশ্বকর্ম্মা শিল্পিবরে করিল স্মরণ।।
সেইখানে বিশ্বকর্ম্মা আইল তখন।
করযোড়ে দ্বাপরে করিল নিবেদন।।
কি হেতু আমারে দেব ডাকিলে আপনে।
কোন কর্ম্ম সাধি দিব কহ নিজগুণে।।
দ্বাপর বলিল মোর কর এই কার্য্য।
অনুগ্রহ করি এক করহ সাহায্য।।
দিব্য এক কন্যা দেহ করিয়া গঠন।
পৃথিবীর মধ্যে যেন হয় সুলক্ষণ।।
তার রূপে গুণে যেন মোহে সর্ব্বজন।
এত শুনি বিশ্বকর্ম্মা করিল রচন।।
পৃথিবীর যত রূপ করিয়া মোহন।
মোহিত নামেতে কন্যা করিল সৃজন।।
দ্বাপরেরে কন্যা দিয়া হৈল অন্তর্দ্ধান।
দেখিয়া দ্বাপর হৈল অতি হর্ষবান।।
দ্বাপরের অগ্রে কন্যা কর যুড়ি কয়।
কি কর্ম্ম করিব আজ্ঞা কর মহাশয়।।
শুনিয়া দ্বাপর হৈল আনন্দিত মন।
কহে মর্ত্ত্যলোকে তুমি করহ গমন।।
চিত্রাঙ্গদ নামে রাজা বিখ্যাত ভুবনে।
আমাঅতি সুলক্ষণ।।
রক্তবস্ত্র পরিধানা অরুণ উদিত।
দেখি স্মরশরে রাজা হইল মোহিত।।
ক্ষণেকে চৈতন্য তবে পাইয়া নৃপতি।
নিকটেতে গিয়া জিজ্ঞাসিল কন্যা প্রতি।।
কি নাম ধরহ তুমি কোথায় বসতি।
সত্য করি কহ মোরে না ভাণ্ডহ সতী।।
নিজ পরিচয় মম গুন গুণবতী।
সোমবংশে জন্ম চিত্রাঙ্গদ নরপতি।।
তোমারে দেখিয়া মন মজিল আমার।
মম ভার্য্যা হও তুমি কর অঙ্গীকার।।
কন্যা বলে হই আমি অযোনি উৎপত্তি।
এইত পর্ব্বত মধ্যে আমার বসতি।।
অনূঢ়া যে আছি আমি বিবাহ না হয়।
মোহিনী আমার নাম বিধির নির্ণয়।।
এক সত্য কর রাজা আমার গোচরে।
তবে আমি পরিণয় করিব তোমারে।।
ইচ্ছামত তোমারে কহিব যেই কথা।
আমার সে কথা কভু না হবে অন্যথা।।
যদি বা দুষ্কর হয়ে এ তিন ভুবনে।
মম বাক্য কভু নাহি করিবা খণ্ডনে।।
রাজা বলে আমি সত্য করি অঙ্গীকার।
কভু না খণ্ডিব কন্যা বচন তোমার।।
এত শুনি কন্যা করিলেন অনুমতি।
পুরোহিত বিপ্রেরে স্মরিল নরপতি।।
কঙ্কায়ন নামে মুনি বিখ্যাত জগতে।
পূর্ব্বাপর পুরোহিত সোমক বংশেতে।।
রাজার স্মরণে দ্বিজ আইল তখন।
প্রণমিয়া নৃপতি কহিল বিবরণ।।
পুরোহিত উভয়ে বিবাহ করাইল।
সেই রাত্রি নরপতি তথা নির্ব্বাহিল।।
মোহিনীরে কৈল রাজা মুখ্য পাটেশ্বরী।
ইন্দ্রের শোভয়ে যেন পুলোমা কুমারী।।
এইরূপে কতদিন রাজা বিহরয়।
অনন্ত ব্রতের আসি হইল সময়।।
চিত্ররেখা সহ রাজা ব্রত আচরিল।
উপবাস করি ব্রত নিয়মে রহিল।।
ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজগণে।
অন্নদান তুষিল যতেক দুঃখীজনে।।
দৈবের লিখন কভু না হয় খণ্ডন।
যুগবাক্য মোহিনীর হইল স্মরণ।।
নৃপতিরে চাহি কন্যা বলয়ে বচন।
উপবাসে কি কারণে আছহ রাজন।।
এতেক দুষ্কর ব্রতে কোন প্রয়োজন।
আমার বচনে রাজা করহ ভোজন।।
আমার বচন রাজা কহ সবাকারে।
হেন পাপ ব্রত যেন কেহ না আচরে।।
কন্যার বচন রাজা শুনি বজ্রাঘাত।
ক্রোধানলে নয়নে হইল অশ্রুপাত।।
ক্ষণে ক্রোধ সন্বরিয়া বলয়ে বচন।
অবলা স্ত্রীজাতি তুমি না বুঝ কারণ।।
এই ত অনন্ত ব্রত বিখ্যাত সংসারে।
হেন ব্রত বল মোরে ভঙ্গ করিবারে।।
অবলা স্ত্রীজাতি কিবা বলিব তোমারে।
এই ব্রত আচরিলে সর্ব্ব দুঃখে তরে।।
স্বর্গভোগ মহাফল অবহেলে পায়।
কদাচিত যমের নগর নাহি যায়।।
পূর্ব্ব কথা মম এই করহ শ্রবণ।
যেই হেতু এই ব্রত করি আচরণ।।
সত্যযুগে ছিনু আমি শ্বপচের বংশে।
সুষেণ আছিল নাম শূদ্র অবতংসে।।
বেশ্যাতে ছিলাম মত্ত মদ্যপানে রত।
পশু পক্ষী মৃগ বধ কৈনু শত শত।।
মম দুষ্টাচার দেখি ভ্রাতৃ বন্ধুগণ।
দূর করি দিল মোরে করিয়া তাড়ন।।
ক্রোধচিত্তে ঘোর বনে করিয়া প্রবেশ।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় হয়ে আকুল বিশেষ।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে পাই কেশব মন্দির।
তাহাতে আশ্রয় করি হইয়া অস্থির।।
অনন্ত ব্রতের সেই দিন শুভক্ষণ।
উপবাসী রহিলাম করিয়া শয়ন।।
দৈবযোগে নিশাশেষে সর্প ভয়ঙ্কর।
চরণে আমার আসি দংশিল সত্বর।।
বিষের জ্বলনে মৃত্যু হইল আমার।
দুই যমদূত আসিল বিকৃতি আকার।।
মহাপাশে শীঘ্র মোরে করিল বন্ধন।
হেনকালে এল বিষ্ণুদূত দুইজন।।
যমদূতে অনেক করিল তিরস্কার।
শীঘ্রগতি মুক্তি তারা করিল আমার।।
রথে করিল নিল মোরে বৈকুণ্ঠ ভুবন।
অপমান পেয়ে গেল যমদূতগণ।।
দুই লক্ষ বর্ষ বিষ্ণু লোকে হৈল স্থিতি।
অনন্তর ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।।
কত দিন ব্রহ্মলোকে সুখেতে বঞ্চিনু।
তারপরে পুনরপি মর্ত্ত্যলোকে এনু।।
দুই মন্বন্তর তথা করিনু বিহার।
সেই পুণ্যে রাজবংশে জনম আমার।।
হেন ব্রত করিবারে নিষেধ করহ।
এমত কুৎসিত বাক্য কভু না বলহ।।
কন্যা বলে রাজা তুমি করিলা স্বীকার।
না খণ্ডিবে কোন কালে বচন আমার।।
এবে তুমি মিথ্যাবাদী জানিনু কারণ।
মিথ্যা সম পাপ নাহি বেদের বচন।।
আপনার সত্য রাজা করহ পালন।
মম বাক্য এই ব্রত করহ ভঞ্জন।।
এতেক শুনিয়া রাজা হৈল ভীত মন।
কন্যারে চাহিয়া রাজা বলিল বচন।।
যে বলিলে কন্যা সত্য কভু নহে আন।
ত্যজিবারে পারি আমি আপনার প্রাণ।।
তথাপি এ ব্রত আমি না পারি ত্যজিতে।
সে কারণে কহি আমি তোমার সাক্ষাতে।।
এইক্ষণে নিজ আত্মা করিব নিধন।
এত বলি জৈষ্ঠপুত্রে আনি সেইক্ষণ।।
ছত্রদণ্ড দিয়া তারে বলিল বচন।
প্রাণত্যাগ করি আমি সত্যের কারণ।
রাজ্যখণ্ড যত দেখ সকলি তোমার।
দেব দ্বিজে ভক্তি পূজা করিবে সবার।
যোগাসন করি তবে বসিল রাজন।
দেহ ছাড়ি বৈকুণ্ঠেতে করিল গমন।।
রাজার মরণে সবে করয়ে ক্রন্দন।
অনেক কান্দিল পুরে পাত্র মন্ত্রীগণ।।
রাজার শরীর লয়ে করিল দাহন।
নৃপতি বিচ্ছেদে সবে নিরানন্দ মন।।
শ্রাদ্ধশান্তি করিলেন শাস্ত্রের বিধানে।
ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজেগণে।।
ইহা দেখি কন্যা তবে স্বস্থানে চলিল।
বাদ্য বাজাইয়া সবে নগরে বলিল।।
স্ত্রীর সহ সত্য না করিবে কদাচন।
স্ত্রীর বাক্য কদাচ না করিবে গ্রহণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
২৯. অষ্টমী ব্রত-কথন প্রস্তাবে অহল্যার শাপ-বিবরণ
আর এক কথা কহি অষ্টমী-আচার।
আপনি ভবানী সে অষ্টমী অবতার।।
অষ্টমীর ব্রতফল শুনহ রাজন।
মহাপুণ্য তিথি হয় শুনহ কারণ।।
গৌতমের স্থানে ইন্দ্র পড়েন আপনে।
নানাশাস্ত্রে শিক্ষা করে গৌতমের স্থানে।।
দশ বিদ্যা আছে আর যন্ত্র সারোদ্ধার।
সকলি পড়ায়মুনি সকল বিচার।।
পড়িয়া শুনিয়া ইন্দ্র মতিচ্ছন্ন হৈল।
গুরুপত্নী হরি বলি মনেতে করিল।।
আর দিন মুনি গেল তপস্যা করিতে।
দণ্ড কমণ্ডলু নিলা কোশাকুশী হাতে।।
তপস্যা করিতে ‍মুনি গেলা তপোবন।
দেখিয়া ত ইন্দ্র তবে ভাবে মনে মন।।
তদন্তরে দেবরাজ মুনিবেশ ধরি।
হস্তে কমণ্ডলু লৈয়া চলিলা সত্বরি।।
অহল্যা নিকটে ইন্দ্র আইলা তখনে।
অহল্যা বলেন, মুনি ফিরি আইলা কেনে।।
মায়া করি বলে ইন্দ্র অহল্যার তরে।
তপস্যা করিতে যাই কানন-ভিতরে।।
তথায় দেখিনু আমি মৃগীর সঙ্গম।
তাহাই দেখিয়া মোর স্থির নহে মন।।
এই সে কারণে আইনু শুন প্রাণপ্রিয়া।
প্রাণরক্ষা কর মোরে আলিঙ্গন দিয়া।।
পতিগতি অহল্যা ত সতী পতিব্রতা।
স্বামীর বচন কভু না হবে অন্যথা।।
শীঘ্র শয্যা করি তবে দিল আলিঙ্গন।
অহল্যা সহিত ইন্দ্র ভুঞ্জিল রমণ।।
নানামতে স্বামী প্রতি করিল সেবন।
সন্ধ্যার সময় মুনি আসে ততক্ষণ।।
ইন্দ্র জানিলেন তবে মুনি আগমন।
বুঝি ইন্দ্র পলায়ন করিল তখন।।
তারপর মুনি এল তপস্যা করিয়া।
মুনিকে দেখিয়া দেবী বিস্ময় হইয়া।।
ভূমিকম্প হৈল বুঝি না বুঝি কারণ।
এখনি আমার সঙ্গে ভুঞ্জিল রমণ।।
এখনি আইল পুনঃ দণ্ড হাতে করি।
বুঝিতে না পারি যত মুনির চাতুরী।।
বিস্ময় হইয়া দেবী ভাবে মনে মন।
অহল্যা দেখিয়া মুনি ভাবেন তখন।।
চুল কেন খসে তোর খসিল সিন্দূর।
লোচনে কাজল কেনে হৈল তোর দূর।।
মলিন বদন দেখি অলকা মলিন।
বদন উপরে কেনে দেখি অন্য চিন।।
বসন কোঁকড়া কেন পদ নহে স্থির।
নিদ্রাগত দেখি কেন তোমার শরীর।।
স্তনযুগ দেখি কেন রক্তের আকার।
নখের আচঁড় কেন হৃদয় মাঝার।।
নয়নযুগল তোর কেন বা বিভোর।
ঘন ঘন হাই উঠে উদর ডাগোর।।
আমাকে দেখিয়া কেন কাঁপ থর থর।
ঊরু দুই দেখি তোর রক্ত যেন ভর।।
উলট পালট কেশ দেখিয়া কেমন।
শীঘ্রগতি কহ কথা মোর বিদ্যামান।।
আরক্ত লোচন করি মুনি যদি চায়।
অহল্যার প্রাণ উড়ে যোড় হাতে কয়।।
নিবেদন করি কিছু তোমার চরণে।
আপনি যে কর্ম্ম কর পাসর আপনে।।
এখনি আপনি তুমি করিলে রমণ।
পুনরপি দোষ দেহ না বুঝি কারণ।।
তুমি বুঝি বসেছিলে সদাশিব পাছে।
সিদ্ধি ভাঙ্গ কিছু বুঝি পাও তাঁর কাছে।।
এত শুনি মুনিবর করিলেন ধ্যান।
ধ্যানেতে সকল তত্ত্ব হৈল বিদ্যামান।।
জানিল পাপিষ্ঠ ইন্দ্র করে হেন কর্ম্ম।
ইহা সম অধার্ম্মিক নাহিক অধম।।
গুরুপত্নী হরে বেটা বৈসে দেবপুরী।
যতেক পড়াই তারে এত যত্ন করি।।
তাহার দক্ষিণা দিল গুরুপত্নী হরি।
হেন কর্ম্ম কৈল হৈয়া স্বর্গ-অধিকারী।।
বেদাগম নানা শাস্ত্র পড়াইনু তারে।
উচিত দক্ষিণা বেটা দিলেক আমারে।।
যে কর্ম্ম করিল আজি, দিব তার ফল।
ভগময় হক বেটার শরীর সকল।।
নিরবধি সর্ব্বক্ষণ মলমূত্র ঝরে।
কন্দর্প-জর্জ্জর সদা হইবে শরীরে।।
দুঃখানলে দগ্ধ সদা হইবে অন্তর।
মহাদুঃখ পাবে ইন্দ্রদেব নিরন্তর।।
ইন্দ্রত্ব হইল দূর বসিতে না পারে।
নিরবধি কামজ্বর থাকয়ে অন্তরে।।
এইমতে ইন্দ্রে শাপ দিলা মহামুনি।
তবে শাপ দিলা তার আপন রমণী।।
অহল্যা বলেন প্রভু বুঝি দেহ শাপ।
মায়াছলে মোরে তব শিষ্য করে পাপ।।
বুঝিয়া শাপহ মোরে শুনহ গোঁসাই।
সহজে অবলা জাতি বল বুদ্ধি নাই।।
ইন্দ্রের কপটে আমি পড়িনু সঙ্কটে।
কতকালে মোরে প্রভু আনিবে নিকটে।।
শুনি মুনি অহল্যার কাতর বচন।
আশ্বাসিয়া মুনিবর বলে ততক্ষণ।।
যেকালে জন্মিবে রাম দশরথ-ঘরে।
বিশ্বামিত্র লৈয়া যাবে মিথিলা নগরে।।
শ্রীরাম-পরশে তোর হইবে মোচন।
তবে তুমি আসি পাবে মোর দরশন।।
এত বলি মুনিবর তারে শাপ দিল।
পাষাণ মূরতি ধরি অহল্যা রহিল।।
সেইমত রহে দেবী বনের ভিতরে।
গৌতম চলিয়া গেল অন্য বনান্তরে।।
প্রভাসের তীরে মুনি আশ্রম করিল।
সেইখানে মহামুনি তপেতে রহিল।।
সত্য গেল, ক্রেতাযুগে রাম অবতার।
দশরথ-ঘরে জন্মে সংসারের সার।।
বিশ্বামিত্র লয়ে যায় যজ্ঞ রাখিবারে।
অহল্যা পাষাণ সেই বনের ভিতরে।।
বিশ্বামিত্র বলে, রাম শুনহ বচন।
ইহাকে পরশ কর কমললোচন।।
মুক্তিপদ পাবে এই অহল্যা সুন্দরী।
পাষাণ হইতে শীঘ্র দেহ মুক্তি করি।।
রাম বলে, কোন্ হেতু হইল পাষাণ।
তবে মুনি কহিলেন পূর্ব্বের আখ্যান।।
শুনিয়া কহেন রাম, আমি নাহি পারি।
পরনারী পরশনে পাপ হবে ভারি।।
মুনি বলে, তুমি হও সবার জীবন।
তুমি না তারিলে তরাইবে কোন্ জন।।
তুমি যে জগৎকর্ত্তা চারিবেদ-সার।
রমণী পুরুষ সব রচন তোমার।।
তবে রাম পদাঙ্গুলে অহল্যা ছুঁইলা।
পাষাণ-মূরতি ছাড়ি পূর্ব্বদেহ হৈলা।।
তবেত পাইল দেহ মুক্তিপদ পেয়ে।
রামের চরণে পড়ে দণ্ডবৎ হয়ে।।
সংসারের সার তুমি দেব নারায়ণ।
আদি ও অনাদি তুমি সবার জীবন।।
তুমি ত্রিদশের নাথ তোমা বিনা নাই।
সর্ব্বদেবগণে প্রভু তোমারে ধেয়ায়।।
কৃপা করি মুক্ত মোরে করিলে এখন।
তোমার পরশে ধরি মানবী জীবন।।
তোমার পদের আমি কি জানি মহিমা।
চারি মুখে ব্রহ্মা যার দিতে নারে সীমা।।
এমতে অহল্যা বহু করিল স্তবন।
রামেরে প্রণাম করি করিল গমন।।
প্রভাসের তীরেতে আছেন মুনিবর।
সেইস্থানে গেলা দেবী স্বামীর গোচর।।
মুনি দেখি অহল্যার সিদ্ধ হৈল কাম।
মুনির চরণে দেবী করিল প্রণাম।।
দেখিয়া সন্তোষ বড় হৈলা মুনিবর।
অহল্যারে বসাইলা ঊরুর উপর।।
গায়ে হস্ত দিয়া মুনি করিল সান্ত্বনা।
এতকাল দুঃখ দিল অসৎ-বাসনা।।
এইমতে দুইজন হৈল একত্তর।
প্রভাসের তীরে রহে সানন্দ অন্তর।।
কহিনু অহল্যা, হৈল পাপেতে মোচন।
মহাপাপ মুক্ত হবে যে করে শ্রবণ।।
নারীতে শুনিলে সেই পুত্রবতী হয়।
পাপীতে শুনিলে তার পাপ হয় ক্ষয়।।
এইত কহিনু অহল্যার উপাখ্যান।
তার পর শুন রাজা ইন্দ্রের মোচন।।
৩০. ইন্দ্রের শাপমোচন
সহস্র যোনিতে ইন্দ্র পীড়িত শরীরে।
বসিতে না পারে সেই দেবের ভিতরে।।
মহাপীড়া কামজ্বরে করয়ে রোদন।
কে আছে আমার দুঃখ করিতে মোচন।।
দেবগুরু বৃহস্পতি কহিলা তাহারে।
আমার বচন তুমি শুন পুরন্দরে।।
যেখানে পতন হই, সেইখানে উঠি।
তাহারে সন্তোষ করি যার স্থানে ঘাটি।।
লাজ ভয় ছাড় ইন্দ্র, বলিনু তোমারে।
ব্রহ্মশাপ খণ্ডাইতে অন্যে নাহি পারে।।
গৌতম বিহনে ইহা অন্যে নাহি পারে।
গর্ব্ব ত্যজি যাও ‍তুমি মুনির গোচরে।।
তাঁহার চরণ ধরি বলহ একান্ত।
শাপ দিলে মহামুনি করহ শাপান্ত।।
এত শুনি ইন্দ্র গেল মুনির নিয়ড়ে।
দণ্ডবৎ হইয়া মুনির পদে পড়ে।।
অপরাধ ক্ষমা কর শুন মহাশয়।
শাপিলে শাপান্ত প্রভু করিতে যুয়ায়।।
সংসারের সার তুমি আমি পাপ কৈনু।
তাহার উচিত ফল তেমনি পাইনু।।
আর দুঃখ সহা নাহি যায় মুনিবর।
কৃপা করি মহামুনি করহ উদ্ধার।।
শুনিয়া ইন্দ্রের বাক্য দয়া উপজিল।
হিত উপদেশ মুনি তাহারে কহিল।।
মুনি বলে, শুন এবে আমার বচন।
অষ্টমীর ব্রত বিনে নাহি দেখি আন।।
মহা অষ্টমীর ব্রত কর পুরন্দর।
গুরুপত্নী হরিয়াছ হইয়া বর্ব্বর।।
কেমনে করিবে ব্রত শুনহ বচন।
সপ্তমীতে সংযম করিবে নিষ্ঠাপন।।
অষ্টমীতে উপবাস করি নিরাহার।
বৈষ্ণবী ভবানী পূজি দিবে উপচার।।
বলিদান নাহি দিবে, নহে ব্যবহার।
পূজিবে ভবানী দেবী দিয়া উপহার।।
কায়মনোবাক্যে তুমি পূজিবে ভবানী।
নবমীতে পারণ করিবে দেবমণি।।
তিন দিনে তিন গুণ আপনি ভবানী।
লয়েন সংসারে পূজা শুন সুরমণি।।
সপ্তমীতে রজোগুণ হইয়া পার্ব্বতী।
আপনি লয়েন পূজা দেবী ভগবতী।।
অষ্টমীতে লন পূজা যেমত প্রকার।
কহি যে তোমারে এই শুন সমাচার।।
অষ্টমীতে মহামায়া-স্বরূপা বৈষ্ণবী।
এই ত পূজায় তুষ্টা হৈলা মহাদেবী।।
নবমীতে তমোগুণ হইয়া ভবানী।
সংসারে লয়েন পূজা সংসার কারিণী।।
ছাগাদি মহিষ মেষ দিয়া বলিদান।
করিবে ভবানী-পূজা হৈয়া সাবধান।।
এইমত কর তুমি ভবানীর পূজা।
হইবে সহস্র চক্ষ, শুন দেবরাজা।।
সহস্রলোচন নাম হইবে তোমার।
কহিনু তোমারে আমি মহাব্রতাচার।।
এত শুনি দণ্ডবৎ হৈল মুনি পায়।
অষ্টমী পূজিতে ইন্দ্র চলিল ত্বরায়।।
দেবগুরু বৃহস্পতি পুরোহিত হৈল।
বিবিধ প্রকারে ইন্দ্র পূজা আরম্ভিল।।
যেমত বিধানে পূজা গৌতম কহিল।
বৃহস্পতি সহ ইন্দ্র পূজা আরম্ভিল।।
স্থাপন করিলা দেবী ঘটের উপরে।
অধিবাস করি ইন্দ্র হরিষ অন্তরে।।
শঙ্খ ও দুন্দুভি বাজে সর্ব্বদেবপুরী।
কায়মনোবাক্যে ইন্দ্র পূজে হর-গৌরী�া।।
দশন মুকুতা পাঁতি ঝলমল করে।
কত শশী উদয় হইল স্বর্গপুরে।।
মুখের উদয় দেখি কত চন্দ্র জিনি।
যাহার দর্শনে স্থির হৈল সর্ব্ব প্রাণী।।
কিবা সে চরণ-শোভা রকত-উৎপল।
হৃদয়ের দুঃখ শোক ঘুচিল সকল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশী কহে, শুনিলে জন্ময়ে দিব্যজ্ঞান।।
২৬. শিবচতুর্দ্দশী-ব্রত উপাখ্যান
শান্তনু-কুমার সর্ব্বশাস্ত্র বিশারদ।
ইতিহাস কথা কহে শুনে সভাসদ।।
ধৃতি নামে এক দ্বিজ বড় দুষ্টমতি।
বুদ্ধিবলে হরে সেই পরের যুবতী।।
সদাকাল দুষ্টবুদ্ধি পাপী দুরাচার।
মল্ল নামে দ্বিজবর জনক তাহার।।
দুষ্ট পুত্র দেখি বিপ্র ভাবে নিরন্তর।
কিরূপে করিব বশ আপন কোঙর।।
নিগড় বন্ধনে বান্ধি রাখিলেন ঘরে।
তপস্যা করিতে মল্ল গেল গঙ্গাতীরে।।
বড় দুষ্ট দ্বিজ সেই ভাবে মনে মনে।
বুদ্ধিবলে মুক্ত কৈল নিগড় বন্ধনে।।
দণ্ডক নামেতে বনে গেল পলাইয়া।
ক্ষুধার নিবৃত্তি কৈল ফল-মূল খাইয়া।।
ভ্রমিল কানন মধ্যে দিন অবশেষ।
ক্ষুধায় পীড়িত হৈল রজনী প্রবেশ।।
চিন্তাকুল ‍দ্বিজপুত্র ভ্রময়ে কাননে।
কতদূরে রম্য স্থান দেখে মহাবনে।।
উত্তম প্রশস্ত ভূমি দেখে অনুপাম।
কি কহিব তার গুণ হরের বিশ্রাম।।
রম্যস্থান দেখিয়া রহিল দ্বিজবর।
আরোহণ কৈল বিল্ববৃক্ষের উপর।।
পশুভয়ে উঠিয়া রহিল বৃক্ষডালে।
ভূতগণ সহ তথা আইলা শূলপাণি।।
বৃক্ষতলে বসিয়া রহিলা মহেশ্বর।
ভূতগণ বেড়ি আছে ঠাকুর শঙ্কর।।
ভূতের ভ্রূকুটি দেখি দ্বিজের তনয়।
নিঃশব্দ রহিল বড় মনে পেয়ে ভয়।।
সেই দিন তিথি শিবরাত্রি চতুর্দ্দশী।
দ্বিজপুত্র অরণ্যে রহিল উপবাসী।।
ক্ষুধাতুর ভয়ে নিশি করে জাগরণ।
পিতা মাতা চিন্তি বিপ্র করেন রোদন।।
ভাবিত শরীরে নিদ্রা নাহি হৈল তার।
আকুল শরীরে রহে করি নিরাহার।।
চক্ষুজল পড়ে তার পৃথিবী-উপরে।
বিল্বপত্র সনে পড়ে মহেশের শিরে।।
সন্তুষ্ট হইলা শিব পুষ্পজল পেয়ে।
হেন বুঝি কেহ পূজে শিবরাত্রি পেয়ে।।
কৈলাসে পরম সুখ ভুঞ্জিবে বিশেষ।
এই বর দিলা তারে ঈশ্বর মহেশ।।
শিব দিলা বর, তাহা শুনি দ্বিজমণি।
বৃক্ষ হৈতে নামিয়া করিল স্তুতিবাণী।।
বৃক্ষতলে আছ তুমি, আমি নাহি জানি।
করিনু দুষ্কর দোষ ক্ষম শূলপাণি।।
সুমতি হইল বিপ্র শিব-দরশনে।
বহুবিধ স্তব কৈল বেদের বিধানে।।
তুমি অনাথের নাথ দুষ্ট বিনাশন।
নমো নমঃ শম্ভু ঋষি নমঃ পঞ্চানন।।
এরূপে অনেক স্তুতি করিল ব্রাহ্মণ।
তুষ্ট হৈয়া বর তারে দিলা ত্রিলোচন।।
মহাসুখী হও তুমি সংসার ভিতরে।
তোমার মহিমা খ্যাত হবে চরাচরে।।
অন্তে শিবলোকে যাবে চড়ি দিব্য রথে।
চতুর্দ্দশী-উপবাস মহাপুণ্য হৈতে।।
ব্রত উপবাস তুমি কর জাগরণ।
শিবরাত্রি-নিয়মে থাকিবে সর্ব্বক্ষণ।।
শিবরাত্রিদিনে যেবা করে শিবপূজা।
মহাসুখ ভুঞ্জিয়া কৈলাসে হয় রাজা।।
হেনমতে রজনী বঞ্চিয়া ঘোর বনে।
পাইয়া শিবের বর আইল নিজস্থানে।।
নিত্য নিয়মিত করে শিবের পূজন।
শিবরাত্রি ব্রত উপবাস জাগরণ।।
এইরূপে এইকালে বঞ্চিয়া কৌতুকে।
অন্তকালে শিবলোকে গেল মহাসুখে।।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হৈল দণ্ডী দণ্ডদায়।
পূর্ব্বের কাহিনী এই কহিনু তোমায়।।
ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।
২৭. শিব চতুর্দ্দশীর মাহাত্ম্য২৮. অনন্ত ব্রতের মাহাত্ম্য
ভীষ্ম বলিলেন শুন রাজা যুধিষ্ঠির। শোক দূর কর রাজা চিত্ত কর স্থির।। আর কিছু ইতিহাস শুন দিয়া মন। অনন্ত নামেতে ব্রত অপূর্ব্ব কথন।। নারদের মুখে পূর্ব্বে করিণু শ্রবণ। সেই ইতিহাস কহি শুন দিয়া মন।। চিত্রাঙ্গদ নামে ‍রাজা কৌশলেতে স্থিতি। সোমবংশ চূড়ামণি মহাধর্ম্মে মতি।। শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে বৈশ্রবণ। কীর্ত্তি ভাগীরথ সম মহাবিচক্ষণ।। মন্ত্রণাতে বৃহস্পতি গুণে গুণধাম। প্রজার পালনে যেন ছিলেন শ্রীরাম।। অনন্ত নামেতে ব্রত গোবিন্দ উদ্দেশে। ভার্য্যা সহ নরবর আচরে বিশেষে।। বিচিত্র মন্দির এক করিয়া রচন। লিঙ্গরূপে তাহাতে স্থাপিয়া নারায়ণ।। রাজধর্ম্ম নিত্যকর্ম্ম ত্যজিয়া রাজন। আপনি হস্তেতে করে মন্দির মার্জ্জন।। অনন্তরে স্নানদান করি নরবর। নানা উপহারে পূজে দেব দামোদর।। পূজা শেষে করাইল ব্রাহ্মণ ভোজন। অবশেষে লইয়া কুটুম্ব পরিজন।। আনন্দিত হয়ে সবে করয়ে ভোজন। এইরূপে নিত্য নিত্য পূজে নারায়ণ।। বাদ্য বাজাইয়া এই জানায় নগরে। অনন্ত নামেতে ব্রত বিখ্যাত সংসারে।। দ্বিজ ক্ষন্ত্র বৈশ্য শূদ্র চতুর্ব্বিধ জন। এই ব্রত যেবা না করিবে আচরণ।। সবংশে লইব তারে শমনের ঘরে। নগরে বাজারে এইরূপ বাদ্য করে।। রাজভয়ে সর্ব্বলোক প্রাণপণ করে। নিয়ম করিয়া শুভ ব্রত যে আচরে।। ব্রত পুণ্যফলে সবে নিষ্পাপ হইল। যতদূর ভুপতির অধিকার ছিল।। যত লোক ছিল ভূপতির অধিকারে। ব্রতপুণ্যফলে যার বৈকুণ্ঠ নগরে।। সত্যকালে যেন লোক পুণ্যবান ছিল। রাজার প্রতাপে তেন দ্বাপর হইল।। জানিয়া দ্বাপরযুগ এ সব কারণ। চিন্তাকুল হইয়া ভাবিল মনে মন।। পূর্ব্বে প্রজাপতি হেন করিল বিচার। সংসার উপরে দিল মম অধিকার।। কোটি লোক মধ্যে কেহ মম অধিকারে। নিয়ম করিয়া ভজিবেক দামোদরে।। সহস্রেক মধ্যে কেহ হবে মহাজন। মহাব্রত আচরি ভজিবে নারায়ণ।। যতেক সংসারে প্রজা হবে পাপাচারী। অল্প আয়ু হয়ে যাবে যমের নগরী।। এইরূপ নিয়ম করিয়া সৃষ্টিধর। অধিকার দিল মোরে সংসার উপর।। মহাধর্ম্মশীল দেখি এই নৃপমণি। ব্রহ্মার নিয়ম ভঙ্গ করে হেন জানি।। কোনমতে ব্রত ভঙ্গ হইলে রাজার। তবে সে নিয়ম রক্ষা হয়ত ব্রহ্মার।। এইরূপে দ্বাপর ভাবিয়া মনে মন। বিশ্বকর্ম্মা শিল্পিবরে করিল স্মরণ।। সেইখানে বিশ্বকর্ম্মা আইল তখন। করযোড়ে দ্বাপরে করিল নিবেদন।। কি হেতু আমারে দেব ডাকিলে আপনে। কোন কর্ম্ম সাধি দিব কহ নিজগুণে।। দ্বাপর বলিল মোর কর এই কার্য্য। অনুগ্রহ করি এক করহ সাহায্য।। দিব্য এক কন্যা দেহ করিয়া গঠন। পৃথিবীর মধ্যে যেন হয় সুলক্ষণ।। তার রূপে গুণে যেন মোহে সর্ব্বজন। এত শুনি বিশ্বকর্ম্মা করিল রচন।। পৃথিবীর যত রূপ করিয়া মোহন। মোহিত নামেতে কন্যা করিল সৃজন।। দ্বাপরেরে কন্যা দিয়া হৈল অন্তর্দ্ধান। দেখিয়া দ্বাপর হৈল অতি হর্ষবান।। দ্বাপরের অগ্রে কন্যা কর যুড়ি কয়। কি কর্ম্ম করিব আজ্ঞা কর মহাশয়।। শুনিয়া দ্বাপর হৈল আনন্দিত মন। কহে মর্ত্ত্যলোকে তুমি করহ গমন।। চিত্রাঙ্গদ নামে রাজা বিখ্যাত ভুবনে। আমাঅতি সুলক্ষণ।। রক্তবস্ত্র পরিধানা অরুণ উদিত। দেখি স্মরশরে রাজা হইল মোহিত।। ক্ষণেকে চৈতন্য তবে পাইয়া নৃপতি। নিকটেতে গিয়া জিজ্ঞাসিল কন্যা প্রতি।। কি নাম ধরহ তুমি কোথায় বসতি। সত্য করি কহ মোরে না ভাণ্ডহ সতী।। নিজ পরিচয় মম গুন গুণবতী। সোমবংশে জন্ম চিত্রাঙ্গদ নরপতি।। তোমারে দেখিয়া মন মজিল আমার। মম ভার্য্যা হও তুমি কর অঙ্গীকার।। কন্যা বলে হই আমি অযোনি উৎপত্তি। এইত পর্ব্বত মধ্যে আমার বসতি।। অনূঢ়া যে আছি আমি বিবাহ না হয়। মোহিনী আমার নাম বিধির নির্ণয়।। এক সত্য কর রাজা আমার গোচরে। তবে আমি পরিণয় করিব তোমারে।। ইচ্ছামত তোমারে কহিব যেই কথা। আমার সে কথা কভু না হবে অন্যথা।। যদি বা দুষ্কর হয়ে এ তিন ভুবনে। মম বাক্য কভু নাহি করিবা খণ্ডনে।। রাজা বলে আমি সত্য করি অঙ্গীকার। কভু না খণ্ডিব কন্যা বচন তোমার।। এত শুনি কন্যা করিলেন অনুমতি। পুরোহিত বিপ্রেরে স্মরিল নরপতি।। কঙ্কায়ন নামে মুনি বিখ্যাত জগতে। পূর্ব্বাপর পুরোহিত সোমক বংশেতে।। রাজার স্মরণে দ্বিজ আইল তখন। প্রণমিয়া নৃপতি কহিল বিবরণ।। পুরোহিত উভয়ে বিবাহ করাইল। সেই রাত্রি নরপতি তথা নির্ব্বাহিল।। মোহিনীরে কৈল রাজা মুখ্য পাটেশ্বরী। ইন্দ্রের শোভয়ে যেন পুলোমা কুমারী।। এইরূপে কতদিন রাজা বিহরয়। অনন্ত ব্রতের আসি হইল সময়।। চিত্ররেখা সহ রাজা ব্রত আচরিল। উপবাস করি ব্রত নিয়মে রহিল।। ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজগণে। অন্নদান তুষিল যতেক দুঃখীজনে।। দৈবের লিখন কভু না হয় খণ্ডন। যুগবাক্য মোহিনীর হইল স্মরণ।। নৃপতিরে চাহি কন্যা বলয়ে বচন। উপবাসে কি কারণে আছহ রাজন।। এতেক দুষ্কর ব্রতে কোন প্রয়োজন। আমার বচনে রাজা করহ ভোজন।। আমার বচন রাজা কহ সবাকারে। হেন পাপ ব্রত যেন কেহ না আচরে।। কন্যার বচন রাজা শুনি বজ্রাঘাত। ক্রোধানলে নয়নে হইল অশ্রুপাত।। ক্ষণে ক্রোধ সন্বরিয়া বলয়ে বচন। অবলা স্ত্রীজাতি তুমি না বুঝ কারণ।। এই ত অনন্ত ব্রত বিখ্যাত সংসারে। হেন ব্রত বল মোরে ভঙ্গ করিবারে।। অবলা স্ত্রীজাতি কিবা বলিব তোমারে। এই ব্রত আচরিলে সর্ব্ব দুঃখে তরে।। স্বর্গভোগ মহাফল অবহেলে পায়। কদাচিত যমের নগর নাহি যায়।। পূর্ব্ব কথা মম এই করহ শ্রবণ। যেই হেতু এই ব্রত করি আচরণ।। সত্যযুগে ছিনু আমি শ্বপচের বংশে। সুষেণ আছিল নাম শূদ্র অবতংসে।। বেশ্যাতে ছিলাম মত্ত মদ্যপানে রত। পশু পক্ষী মৃগ বধ কৈনু শত শত।। মম দুষ্টাচার দেখি ভ্রাতৃ বন্ধুগণ। দূর করি দিল মোরে করিয়া তাড়ন।। ক্রোধচিত্তে ঘোর বনে করিয়া প্রবেশ। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় হয়ে আকুল বিশেষ।। ভ্রমিতে ভ্রমিতে পাই কেশব মন্দির। তাহাতে আশ্রয় করি হইয়া অস্থির।। অনন্ত ব্রতের সেই দিন শুভক্ষণ। উপবাসী রহিলাম করিয়া শয়ন।। দৈবযোগে নিশাশেষে সর্প ভয়ঙ্কর। চরণে আমার আসি দংশিল সত্বর।। বিষের জ্বলনে মৃত্যু হইল আমার। দুই যমদূত আসিল বিকৃতি আকার।। মহাপাশে শীঘ্র মোরে করিল বন্ধন। হেনকালে এল বিষ্ণুদূত দুইজন।। যমদূতে অনেক করিল তিরস্কার। শীঘ্রগতি মুক্তি তারা করিল আমার।। রথে করিল নিল মোরে বৈকুণ্ঠ ভুবন। অপমান পেয়ে গেল যমদূতগণ।। দুই লক্ষ বর্ষ বিষ্ণু লোকে হৈল স্থিতি। অনন্তর ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।। কত দিন ব্রহ্মলোকে সুখেতে বঞ্চিনু। তারপরে পুনরপি মর্ত্ত্যলোকে এনু।। দুই মন্বন্তর তথা করিনু বিহার। সেই পুণ্যে রাজবংশে জনম আমার।। হেন ব্রত করিবারে নিষেধ করহ। এমত কুৎসিত বাক্য কভু না বলহ।। কন্যা বলে রাজা তুমি করিলা স্বীকার। না খণ্ডিবে কোন কালে বচন আমার।। এবে তুমি মিথ্যাবাদী জানিনু কারণ। মিথ্যা সম পাপ নাহি বেদের বচন।। আপনার সত্য রাজা করহ পালন। মম বাক্য এই ব্রত করহ ভঞ্জন।। এতেক শুনিয়া রাজা হৈল ভীত মন। কন্যারে চাহিয়া রাজা বলিল বচন।। যে বলিলে কন্যা সত্য কভু নহে আন। ত্যজিবারে পারি আমি আপনার প্রাণ।। তথাপি এ ব্রত আমি না পারি ত্যজিতে। সে কারণে কহি আমি তোমার সাক্ষাতে।। এইক্ষণে নিজ আত্মা করিব নিধন। এত বলি জৈষ্ঠপুত্রে আনি সেইক্ষণ।। ছত্রদণ্ড দিয়া তারে বলিল বচন। প্রাণত্যাগ করি আমি সত্যের কারণ। রাজ্যখণ্ড যত দেখ সকলি তোমার। দেব দ্বিজে ভক্তি পূজা করিবে সবার। যোগাসন করি তবে বসিল রাজন। দেহ ছাড়ি বৈকুণ্ঠেতে করিল গমন।। রাজার মরণে সবে করয়ে ক্রন্দন। অনেক কান্দিল পুরে পাত্র মন্ত্রীগণ।। রাজার শরীর লয়ে করিল দাহন। নৃপতি বিচ্ছেদে সবে নিরানন্দ মন।। শ্রাদ্ধশান্তি করিলেন শাস্ত্রের বিধানে। ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজেগণে।। ইহা দেখি কন্যা তবে স্বস্থানে চলিল। বাদ্য বাজাইয়া সবে নগরে বলিল।। স্ত্রীর সহ সত্য না করিবে কদাচন। স্ত্রীর বাক্য কদাচ না করিবে গ্রহণ।। মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।। ২৯. অষ্টমী ব্রত-কথন প্রস্তাবে অহল্যার শাপ-বিবরণ আর এক কথা কহি অষ্টমী-আচার। আপনি ভবানী সে অষ্টমী অবতার।। অষ্টমীর ব্রতফল শুনহ রাজন। মহাপুণ্য তিথি হয় শুনহ কারণ।। গৌতমের স্থানে ইন্দ্র পড়েন আপনে। নানাশাস্ত্রে শিক্ষা করে গৌতমের স্থানে।। দশ বিদ্যা আছে আর যন্ত্র সারোদ্ধার। সকলি পড়ায়মুনি সকল বিচার।। পড়িয়া শুনিয়া ইন্দ্র মতিচ্ছন্ন হৈল। গুরুপত্নী হরি বলি মনেতে করিল।। আর দিন মুনি গেল তপস্যা করিতে। দণ্ড কমণ্ডলু নিলা কোশাকুশী হাতে।। তপস্যা করিতে ‍মুনি গেলা তপোবন। দেখিয়া ত ইন্দ্র তবে ভাবে মনে মন।। তদন্তরে দেবরাজ মুনিবেশ ধরি। হস্তে কমণ্ডলু লৈয়া চলিলা সত্বরি।। অহল্যা নিকটে ইন্দ্র আইলা তখনে। অহল্যা বলেন, মুনি ফিরি আইলা কেনে।। মায়া করি বলে ইন্দ্র অহল্যার তরে। তপস্যা করিতে যাই কানন-ভিতরে।। তথায় দেখিনু আমি মৃগীর সঙ্গম। তাহাই দেখিয়া মোর স্থির নহে মন।। এই সে কারণে আইনু শুন প্রাণপ্রিয়া। প্রাণরক্ষা কর মোরে আলিঙ্গন দিয়া।। পতিগতি অহল্যা ত সতী পতিব্রতা। স্বামীর বচন কভু না হবে অন্যথা।। শীঘ্র শয্যা করি তবে দিল আলিঙ্গন। অহল্যা সহিত ইন্দ্র ভুঞ্জিল রমণ।। নানামতে স্বামী প্রতি করিল সেবন। সন্ধ্যার সময় মুনি আসে ততক্ষণ।। ইন্দ্র জানিলেন তবে মুনি আগমন। বুঝি ইন্দ্র পলায়ন করিল তখন।। তারপর মুনি এল তপস্যা করিয়া। মুনিকে দেখিয়া দেবী বিস্ময় হইয়া।। ভূমিকম্প হৈল বুঝি না বুঝি কারণ। এখনি আমার সঙ্গে ভুঞ্জিল রমণ।। এখনি আইল পুনঃ দণ্ড হাতে করি। বুঝিতে না পারি যত মুনির চাতুরী।। বিস্ময় হইয়া দেবী ভাবে মনে মন। অহল্যা দেখিয়া মুনি ভাবেন তখন।। চুল কেন খসে তোর খসিল সিন্দূর। লোচনে কাজল কেনে হৈল তোর দূর।। মলিন বদন দেখি অলকা মলিন। বদন উপরে কেনে দেখি অন্য চিন।। বসন কোঁকড়া কেন পদ নহে স্থির। নিদ্রাগত দেখি কেন তোমার শরীর।। স্তনযুগ দেখি কেন রক্তের আকার। নখের আচঁড় কেন হৃদয় মাঝার।। নয়নযুগল তোর কেন বা বিভোর। ঘন ঘন হাই উঠে উদর ডাগোর।। আমাকে দেখিয়া কেন কাঁপ থর থর। ঊরু দুই দেখি তোর রক্ত যেন ভর।। উলট পালট কেশ দেখিয়া কেমন। শীঘ্রগতি কহ কথা মোর বিদ্যামান।। আরক্ত লোচন করি মুনি যদি চায়। অহল্যার প্রাণ উড়ে যোড় হাতে কয়।। নিবেদন করি কিছু তোমার চরণে। আপনি যে কর্ম্ম কর পাসর আপনে।। এখনি আপনি তুমি করিলে রমণ। পুনরপি দোষ দেহ না বুঝি কারণ।। তুমি বুঝি বসেছিলে সদাশিব পাছে। সিদ্ধি ভাঙ্গ কিছু বুঝি পাও তাঁর কাছে।। এত শুনি মুনিবর করিলেন ধ্যান। ধ্যানেতে সকল তত্ত্ব হৈল বিদ্যামান।। জানিল পাপিষ্ঠ ইন্দ্র করে হেন কর্ম্ম। ইহা সম অধার্ম্মিক নাহিক অধম।। গুরুপত্নী হরে বেটা বৈসে দেবপুরী। যতেক পড়াই তারে এত যত্ন করি।। তাহার দক্ষিণা দিল গুরুপত্নী হরি। হেন কর্ম্ম কৈল হৈয়া স্বর্গ-অধিকারী।। বেদাগম নানা শাস্ত্র পড়াইনু তারে। উচিত দক্ষিণা বেটা দিলেক আমারে।। যে কর্ম্ম করিল আজি, দিব তার ফল। ভগময় হক বেটার শরীর সকল।। নিরবধি সর্ব্বক্ষণ মলমূত্র ঝরে। কন্দর্প-জর্জ্জর সদা হইবে শরীরে।। দুঃখানলে দগ্ধ সদা হইবে অন্তর। মহাদুঃখ পাবে ইন্দ্রদেব নিরন্তর।। ইন্দ্রত্ব হইল দূর বসিতে না পারে। নিরবধি কামজ্বর থাকয়ে অন্তরে।। এইমতে ইন্দ্রে শাপ দিলা মহামুনি। তবে শাপ দিলা তার আপন রমণী।। অহল্যা বলেন প্রভু বুঝি দেহ শাপ। মায়াছলে মোরে তব শিষ্য করে পাপ।। বুঝিয়া শাপহ মোরে শুনহ গোঁসাই। সহজে অবলা জাতি বল বুদ্ধি নাই।। ইন্দ্রের কপটে আমি পড়িনু সঙ্কটে। কতকালে মোরে প্রভু আনিবে নিকটে।। শুনি মুনি অহল্যার কাতর বচন। আশ্বাসিয়া মুনিবর বলে ততক্ষণ।। যেকালে জন্মিবে রাম দশরথ-ঘরে। বিশ্বামিত্র লৈয়া যাবে মিথিলা নগরে।। শ্রীরাম-পরশে তোর হইবে মোচন। তবে তুমি আসি পাবে মোর দরশন।। এত বলি মুনিবর তারে শাপ দিল। পাষাণ মূরতি ধরি অহল্যা রহিল।। সেইমত রহে দেবী বনের ভিতরে। গৌতম চলিয়া গেল অন্য বনান্তরে।। প্রভাসের তীরে মুনি আশ্রম করিল। সেইখানে মহামুনি তপেতে রহিল।। সত্য গেল, ক্রেতাযুগে রাম অবতার। দশরথ-ঘরে জন্মে সংসারের সার।। বিশ্বামিত্র লয়ে যায় যজ্ঞ রাখিবারে। অহল্যা পাষাণ সেই বনের ভিতরে।। বিশ্বামিত্র বলে, রাম শুনহ বচন। ইহাকে পরশ কর কমললোচন।। মুক্তিপদ পাবে এই অহল্যা সুন্দরী। পাষাণ হইতে শীঘ্র দেহ মুক্তি করি।। রাম বলে, কোন্ হেতু হইল পাষাণ। তবে মুনি কহিলেন পূর্ব্বের আখ্যান।। শুনিয়া কহেন রাম, আমি নাহি পারি। পরনারী পরশনে পাপ হবে ভারি।। মুনি বলে, তুমি হও সবার জীবন। তুমি না তারিলে তরাইবে কোন্ জন।। তুমি যে জগৎকর্ত্তা চারিবেদ-সার। রমণী পুরুষ সব রচন তোমার।। তবে রাম পদাঙ্গুলে অহল্যা ছুঁইলা। পাষাণ-মূরতি ছাড়ি পূর্ব্বদেহ হৈলা।। তবেত পাইল দেহ মুক্তিপদ পেয়ে। রামের চরণে পড়ে দণ্ডবৎ হয়ে।। সংসারের সার তুমি দেব নারায়ণ। আদি ও অনাদি তুমি সবার জীবন।। তুমি ত্রিদশের নাথ তোমা বিনা নাই। সর্ব্বদেবগণে প্রভু তোমারে ধেয়ায়।। কৃপা করি মুক্ত মোরে করিলে এখন। তোমার পরশে ধরি মানবী জীবন।। তোমার পদের আমি কি জানি মহিমা। চারি মুখে ব্রহ্মা যার দিতে নারে সীমা।। এমতে অহল্যা বহু করিল স্তবন। রামেরে প্রণাম করি করিল গমন।। প্রভাসের তীরেতে আছেন মুনিবর। সেইস্থানে গেলা দেবী স্বামীর গোচর।। মুনি দেখি অহল্যার সিদ্ধ হৈল কাম। মুনির চরণে দেবী করিল প্রণাম।। দেখিয়া সন্তোষ বড় হৈলা মুনিবর। অহল্যারে বসাইলা ঊরুর উপর।। গায়ে হস্ত দিয়া মুনি করিল সান্ত্বনা। এতকাল দুঃখ দিল অসৎ-বাসনা।। এইমতে দুইজন হৈল একত্তর। প্রভাসের তীরে রহে সানন্দ অন্তর।। কহিনু অহল্যা, হৈল পাপেতে মোচন। মহাপাপ মুক্ত হবে যে করে শ্রবণ।। নারীতে শুনিলে সেই পুত্রবতী হয়। পাপীতে শুনিলে তার পাপ হয় ক্ষয়।। এইত কহিনু অহল্যার উপাখ্যান। তার পর শুন রাজা ইন্দ্রের মোচন।। ৩০. ইন্দ্রের শাপমোচন সহস্র যোনিতে ইন্দ্র পীড়িত শরীরে। বসিতে না পারে সেই দেবের ভিতরে।। মহাপীড়া কামজ্বরে করয়ে রোদন। কে আছে আমার দুঃখ করিতে মোচন।। দেবগুরু বৃহস্পতি কহিলা তাহারে। আমার বচন তুমি শুন পুরন্দরে।। যেখানে পতন হই, সেইখানে উঠি। তাহারে সন্তোষ করি যার স্থানে ঘাটি।। লাজ ভয় ছাড় ইন্দ্র, বলিনু তোমারে। ব্রহ্মশাপ খণ্ডাইতে অন্যে নাহি পারে।। গৌতম বিহনে ইহা অন্যে নাহি পারে। গর্ব্ব ত্যজি যাও ‍তুমি মুনির গোচরে।। তাঁহার চরণ ধরি বলহ একান্ত। শাপ দিলে মহামুনি করহ শাপান্ত।। এত শুনি ইন্দ্র গেল মুনির নিয়ড়ে। দণ্ডবৎ হইয়া মুনির পদে পড়ে।। অপরাধ ক্ষমা কর শুন মহাশয়। শাপিলে শাপান্ত প্রভু করিতে যুয়ায়।। সংসারের সার তুমি আমি পাপ কৈনু। তাহার উচিত ফল তেমনি পাইনু।। আর দুঃখ সহা নাহি যায় মুনিবর। কৃপা করি মহামুনি করহ উদ্ধার।। শুনিয়া ইন্দ্রের বাক্য দয়া উপজিল। হিত উপদেশ মুনি তাহারে কহিল।। মুনি বলে, শুন এবে আমার বচন। অষ্টমীর ব্রত বিনে নাহি দেখি আন।। মহা অষ্টমীর ব্রত কর পুরন্দর। গুরুপত্নী হরিয়াছ হইয়া বর্ব্বর।। কেমনে করিবে ব্রত শুনহ বচন। সপ্তমীতে সংযম করিবে নিষ্ঠাপন।। অষ্টমীতে উপবাস করি নিরাহার। বৈষ্ণবী ভবানী পূজি দিবে উপচার।। বলিদান নাহি দিবে, নহে ব্যবহার। পূজিবে ভবানী দেবী দিয়া উপহার।। কায়মনোবাক্যে তুমি পূজিবে ভবানী। নবমীতে পারণ করিবে দেবমণি।। তিন দিনে তিন গুণ আপনি ভবানী। লয়েন সংসারে পূজা শুন সুরমণি।। সপ্তমীতে রজোগুণ হইয়া পার্ব্বতী। আপনি লয়েন পূজা দেবী ভগবতী।। অষ্টমীতে লন পূজা যেমত প্রকার। কহি যে তোমারে এই শুন সমাচার।। অষ্টমীতে মহামায়া-স্বরূপা বৈষ্ণবী। এই ত পূজায় তুষ্টা হৈলা মহাদেবী।। নবমীতে তমোগুণ হইয়া ভবানী। সংসারে লয়েন পূজা সংসার কারিণী।। ছাগাদি মহিষ মেষ দিয়া বলিদান। করিবে ভবানী-পূজা হৈয়া সাবধান।। এইমত কর তুমি ভবানীর পূজা। হইবে সহস্র চক্ষ, শুন দেবরাজা।। সহস্রলোচন নাম হইবে তোমার। কহিনু তোমারে আমি মহাব্রতাচার।। এত শুনি দণ্ডবৎ হৈল মুনি পায়। অষ্টমী পূজিতে ইন্দ্র চলিল ত্বরায়।। দেবগুরু বৃহস্পতি পুরোহিত হৈল। বিবিধ প্রকারে ইন্দ্র পূজা আরম্ভিল।। যেমত বিধানে পূজা গৌতম কহিল। বৃহস্পতি সহ ইন্দ্র পূজা আরম্ভিল।। স্থাপন করিলা দেবী ঘটের উপরে। অধিবাস করি ইন্দ্র হরিষ অন্তরে।। শঙ্খ ও দুন্দুভি বাজে সর্ব্বদেবপুরী। কায়মনোবাক্যে ইন্দ্র পূজে হর-গৌরী�া।। দশন মুকুতা পাঁতি ঝলমল করে। কত শশী উদয় হইল স্বর্গপুরে।। মুখের উদয় দেখি কত চন্দ্র জিনি। যাহার দর্শনে স্থির হৈল সর্ব্ব প্রাণী।। কিবা সে চরণ-শোভা রকত-উৎপল। হৃদয়ের দুঃখ শোক ঘুচিল সকল।। মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশী কহে, শুনিলে জন্ময়ে দিব্যজ্ঞান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র