ব্রজের গোপীনিদের বস্ত্রহরণ

ব্রজের গোপীনিদের বস্ত্রহরণঃ হেমেন্তকালের প্রথম মাসে অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে ব্রজের কুমারীগণ (মূলত: ব্রজের বিবাহিত ও অবিবাহিত গোপীনিগণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত ছিল) হবিষ্যান্ন ভোজন করে দেবী কাত্যায়নীর পূজা অর্চানা শুরু করেন। কুমারীগণ প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যমুনা নদীতে স্মান করে নদীতীরস্থ কাত্যায়নী দেবীর বালুকাময় প্রতিমা তৈরী করে সুগন্ধী গন্ধমালা, ধূপ, দীপ, বলি, প্রবাল, ফল, তন্ডুল ও অন্যান্য উপকরণ সামগ্রী দ্বারা দেবীর পূজার্চনা করতে লাগল। কুমারীগণের “হে কাত্যায়নী! হে মহামায়ে! হে মহাযোগিনী! হে অধিশ্বর! আপনাকে নমস্কার করছি। আপনি নন্দরাজ তনয় শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের পতিরূপে প্রদানের ব্যবস্থা করে দিন।” কৃষ্ণগতপ্রাণ ব্রজের কুমারীগণ এভাবে একমাস শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য দেবী কাত্যায়নীর পূজা করছিল। গোপীনিগণ প্রতূ্ষ্যে ঘুম হতে উঠে একে অপরের হাত ধরাধরি করে উচ্চস্বরে সুললিত কন্ঠে কৃষ্ণ গীত করতে করতে যমুনা নদীতে স্নান করত। অন্যান্য দিনের মত একদিন গোপীনিগণ নদীর তীর বস্ত্র রেখে হাত ধরাধরি করে কৃষ্ণ গুণগান করতে করতে যমুনার জলে জল-ক্রীড়া করতে লাগল। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তাদের মনোবাসনা অবগত হয়ে তাদেরকে ফল প্রদান করার জন্য বয়স্য বালকসহ তথায় আগমন করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীনিগণের বস্ত্রসকল নিয়ে কদম্ব বৃক্ষে আরোহণ করে সখাগণের সাথে পরিহাস করতে করতে বললেন,“ হে অবলাগণ! তোমরা সকলে তীরে এসে নিজ নিজ বস্ত্র গ্রহণ করে পরিধান কর। আমি তোমাদের সাথে সত্যই পরিহাস করছি না। দীর্ঘদিন ব্রত পালন করার পর তোমরা কৃশ হয়েছে। আমি যে মিথ্যা কথা বলি না তা আমার সখাগণ জানে। তোমরা একে একে বা একত্রে মিলিত হয়ে যার যার বস্ত্র নিয়ে যাও।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এ বাক্য শ্রবণ করে গোপীনিগণ প্রেমরসে অবগাহন করলেন; লজ্জাও পেলেন, পরস্পরকে নিরীক্ষণ করে হাসাহাসি করলেন কিন্তু জল থেকে উঠলেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরিহাস বাক্যে তারা বিভ্রান্ত হলেন। তাই যমুনা শীতল জলে আকন্ঠ নিমগ্ন থেকে কম্পিত কন্ঠে বলতে লাগল,“ হে কৃষ্ণ! তুমি অন্যায় করিও না। তুমি নন্দরাজের পুত্র। আমরা তোমাকে ব্রজের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভালবাসি। আমাদের বস্ত্রগুলি ফিরিয়ে দাও। দেখ আমরা শীতে কাঁপছি।” গোপীনিদের মধ্যে বয়স্কা গোপীনিগণ বললেন,“ হে শ্যামসুন্দর! আমরা তোমার দাসী। তুমি যা আজ্ঞা করবে আমরা তাই করিব। হে ধর্মজ্ঞ! আমাদের বস্ত্রগুলি ফিয়ে দাও, নয়তো রাজাকে বলে দিব।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন,“ হে শুচিস্মিতা অবলাগণ! তোমরা যদি আমার দাসী হও, তবে কথানুসারে কাজ কর। আমি আদেশ করছি-তোমরা তোমাদের বস্ত্রসমূহ আমার নিকট এসে গ্রহণ কর। আমার কাছে না আসলে আমি কখনও বস্ত্র ফেরত দিব না। আর রাজার কথা বলছ, রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে কি করবে?” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করার পর গোপীনিগণ আর কোন আপত্তি করল না। শীতকম্পিতকলেবরা শীতকর্শিতা সকল গোপীনিগণ নিজ নিজ হস্ত দ্বারা গোপনাঙ্গ আচ্ছাদন করে ধীরে ধীরে জল হতে তীরে উঠে আসল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীগণের প্রেমভাব দর্শন করে প্রীত হলেন এবং স্কন্ধে বস্ত্রসকল রেখে হাসতে হাসতে বললেন,“ ব্রতপালনকালে তোমরা বিবস্ত্র হয়ে জলে স্নান করেছ, তাতে নিশ্চয় দেবতাকে (বরুণ বা নারায়ণের) অবজ্ঞা করে অপরাধ করেছ। তাই সে পাপ মোচনের জন্য মস্তকে অঞ্জলিবব্ধ করে অধোদিকে নমস্কার করে পরে সকলেই বস্ত্র গ্রহণ কর।” বিবস্ত্র হয়ে স্নান করা দোষ হয়েছে এবং তাতে ব্রতভঙ্গের আশংকায় ব্রজনারীগণ তাৎক্ষণিক ব্রতপূর্ণতা কামনায় ব্রত ও অশেষ কর্মের সাক্ষাৎ ফলস্বরূপ সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই প্রণাম করল কারণ তিনিই তো সকল পাপ হরণকারী। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীনিগণের প্রতি কৃপা করত: সদয় হয়ে বস্ত্রসকল ফিরিয়ে দিলেন। অচ্যুত শ্রীকৃষ্ণ ব্রজনারীগণের বস্ত্রহরণ করে বঞ্চনা করলেন, তাদের লজ্জাশীলতা হানি করলেন, উপহাস করলেন। এক কথায় বলা চলে গোপীনিগণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্রীড়া-পুত্তলিকার মত ব্যবহার করেছেন। তথাপি অবলা ব্রজনারীগণ শ্রীকৃষ্ণের ব্যবহারে কোন দোষই ধরেনি। কারণ প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গলাভই তাদের কাছে দোষ দৃষ্টি নিবৃত্ত করেছিল। ব্রজনারীগণ নিজ নিজ বস্ত্র পরিধান করলেন কিন্তু সে স্থান ত্যাগ না করে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলেন। কারণ কৃষ্ণসঙ্গ বশত: তাকে পাওয়ার জন্য তাদের চিত্ত ব্যাকুল হয়েছিল আর তাই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সলজ্জদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল। এ ব্রজললনাগণ অচ্যুত শ্রীকৃষ্ণের পাদস্পর্শ কামনা করেই ব্রতধারণ করেছিল- তাদের উদ্দেশ্যে জেনে ভগবান দামোদর তাদেরকে বললেন,“ হে সাধ্বীগণ! একমাত্র আমাকে পাওয়ার জন্য তোমাদের সঙ্কল্প, তা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি অনুমোদনও করেছি এবং সে অভিলাষ বা সঙ্কল্প সত্য হওয়ার যোগ্য। হে সুন্দরীগণ! যাদের চিত্ত একনিষ্টভাবে আমাতে সমর্পিত, কামভোগের জন্য কখনও তাদের কামনা হয় না, যেমন বীজ ভাজা বা সিদ্ধ হলে আর অঙ্কুরোদগম হয় না। হে অবলাগণ! তোমরা সিদ্ধ হয়েছে। তোমরা এখন ব্রজে গমন কর। আমাকে উদ্দেশ্যে করে তোমরা কাত্যায়নী দেবীর পূজা করেছে তাই আগামী রাজনীসমূহে আমার সাথে তোমরা বিহার করতে পারবে।” তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশানুসারে গোবিন্দের চরণ স্মরণ করতে করতে অতি কষ্টে ব্রজে গমন করল। বস্ত্রাহরণের মাহাত্ম্য: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গোপীগণের বস্ত্রাহরণ বিষয়টি স্থূলদৃষ্টিতে বিচার করলে সাধারণের ন্যায় খারাপ বলে বোধ হয়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ভাবরসে অবগাহন করলে তখন আর তাকে খারাপ বোধ বলে মনে হবে না। বস্ত্রাহরণের আসল রস আমরা আস্বাদন করতে পারি না বলে বিষয়টি আমাদের কাছে অন্যদৃষ্টি ভঙ্গির অবতারণা করে। আসলে পুরো বিষয়টি অপ্রাকৃত। ভগবান স্বয়ং বলেছেন- “আমার ভক্ত আমাকে যেভাবে পেতে চায় আমি তাদের কাছে সেভাবেই ধরা দেই।” কৃষ্ণগতপ্রাণ ব্রজগোপীনিদের মনের বাসনা জানতে পেরেই তিনি তাদেরকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন। আসলে কি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীনিদেরকে নগ্নভাবে দেখতে চেয়েছিল? এ প্রশ্ন অনেকের মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক। তিনি কেন ব্রজনারীদের বস্ত্রহরণ করলেন? এ লীলা থেকে আমার কি শিক্ষা পায় তাও বিচার্য বিষয়। এ লীলার উদ্দেশ্যে হচ্ছে ব্রজকুমারীগণের কঠিন পরীক্ষা, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানেন ব্রজনারীগণ তাকে পতি হিসেবে পেতে চায়। কিন্তু লজ্জা, নিন্দা, ভয় প্রভৃতি অষ্টপাশমুক্ত না হলে ভগবানকে লাভ করা যায় না। ব্রজানারীরা কুলকুমারী। লজ্জাই তাদের প্রধান বাধা। এ সকল ব্রজনারীগণ লজ্জা, নিন্দা, ভয় প্রভৃতি অষ্টপাশ (ঘৃনা, লজ্বা,ভয়,শংকা,জুজুপ্সা,কুল,জাতি,শীলা) থেকে মুক্ত হয়েছে কিনা তা দর্শন করার অভিপ্রায়েই বস্ত্রহরণ করে নগ্নাবস্থায় পর পুরুষের সম্মুখে আসার জন্য বলেছিলেন। অবশেষে ব্রজনারীগণ মান, অপমান, লজ্জা, নিন্দা ও ভয় সব ত্যাগ করে নগ্নাবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ব্রজনারীদের শরীর দর্শন করে তাদেরকে অপ্রাকৃত করলেন এবং আগামী রজনীতে তাদেরকে নিয়ে বিহার করার কথা বললেন। এখানে অনেক গোপীনিই ছিল কিন্তু গুটিকয়েক গোপীনির ভাগ্যেই এ দূর্লভ সুযোগ হয়েছিল। সুতরাং এ থেকে আমার সহজেই অনুমান করতে পারি যে, এ লীলা অপ্রাকৃত লীলা। শুধু এ লীলাই নয় ভগবানের সমস্ত লীলাই অপ্রাকৃত। ভগবানের লীলা বুঝার মত আমাদের ক্ষমতা নেই বলেই আমরা তার লীলাকে ভাসাভাসাভাবে বিচার করি। লীলার গভীরে প্রবেশ করা কলিযুগের মানুষের পক্ষে দুষ্কর। যারা অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তারই লীলার রস আস্বাদন করতে পেরেছেন। আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত লীলাই মানুষের জন্য, মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। ভগবানের লীলা আমাদের অনুকরণের জন্য নয়। জড় জগতের এ সংসারে থেকেও আমরা ভগবানের জন্য আমরা কাজ করতে পারি, তার চাওয়া-পাওয়া অতি সহজেই পূরণ করতে পারি। এর জন্য আমাদের রকেট সাইন্স জানার কোন প্রয়োজন নেই। ভগবানকে জানার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে ভক্তিযোগ। ভক্তির মাধ্যমেই কেবল তাকে জানা যায়। পূর্বে মহাজনগণ স্বরূপত ভক্তির মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তবে সে ভক্তি হতে হবে নিষ্কাম।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র