১০৬. সীতা হরণ ও শ্রীরামের পঞ্চবানর ও বিভীষণের সহিত মিলনহেনকালে আসি তথা রাবণ দুর্জ্জয়।হরিয়া লইল সীতা দেখি শূন্যালয়।।শীঘ্র চালাইল রথ, শ্রীরামের শঙ্কা।পলায় পরাণ লয়ে যথা পুরী লঙ্কা।।পরিত্রাহি ডাকে সীতা, রাম রাম বলি।চিহ্ন হেতু স্থানে স্থানে অলঙ্কার ফেলি।।জটায়ু নামেতে পক্ষী দশরথ সখা।যুদ্ধ কৈল, রাবণ কাটিল তার পাখা।।পড়িয়া রহিল পথে পক্ষী পুরাতন।লঙ্কাপুরী প্রবেশিল ক্রমে দশানন।।রাবণ বিনয় করি সীতারে বুঝায়।কৃপা করি দেবী তুমি ভজহ আমায়।।সীতা বলে, মম প্রভু রাম বিনা নাই।কত দিনে সবংশে মজিবে তাঁর ঠাঁই।।ইহা শুনি বন্দী কৈল অশোক কাননে।রক্ষক রহিল চেড়ী শত শত জনে।।হেথা মৃগ মারি রাম আশ্রমে আসিতে।লক্ষ্মণ সহিত তবে দেখা হৈল পথে।।শ্রীঘ্রগতি আশ্রমে আসিয়া দুই বীর।শূন্যালয় দেখি দোঁহে হলেন অস্থির।।অনেক বিলাপ করি দুই সহোদর।অন্বেষণ করিবারে চলেন সত্বর।।শোকাকুল হয়ে ভ্রমে কাননে কাননে।জিজ্ঞাসেন ডাকি রাম তরু লতাগণে।।ত্যজিয়া আহার জল আলস্য শয়ন।এইমতে দুই ভাই করেন ভ্রমণ।।সীতার কঙ্কণ এক ছিল সেই পথে।তুলিয়া নিলেন রাম কান্দিতে কান্দিতে।।যত দূর চিহ্ন পান বসন ভূষণ।সেই অনুসারে দোঁহে করেন গমন।।দেখিলেন রাম জটায়ুকে মৃতবৎ।পর্ব্বত প্রমাণ পক্ষী যুদ্ধেতে আহত।।তাহার নিকটে চলিলেন দুই জন।জটায়ু তুলিল মুণ্ড জানিয়া কারণ।।জিজ্ঞাসিতে পক্ষিরাজ কহিলেক কথা।লঙ্কাপুরী দশানন হরি নিল সীতা।।অরুণ-নন্দন আমি তব পিতৃসখা।বধূর অবস্থা দেখি যুদ্ধে আসি একা।।অনেক করিনু যুদ্ধ করি প্রাণপণ।হত পাখা হল শেষে বধূর কারণ।।তোমারে সংবাদ দিতে আছিল জীবন।উদ্ধার করিও রাম এই নিবেদন।।এতেক বলিয়া পক্ষী ত্যজিল জীবন।জানিয়া পিতার সখা ভাই দুই জন।।অগ্নিকার্য্য করি তার পম্পা নদীতটে।তথা হৈতে যান ঋষ্যমূকের নিকটে।।তথায় দেখেন পঞ্চ বানর প্রধান।সুষেণ সুগ্রীব নল নীল হনূমান।।দোঁহারে প্রণাম করি জিজ্ঞাসে সম্ভ্রমে।শ্রীরাম সকল কথা কহিলেন ক্রমে।।সুগ্রীব জানিল, এই পুরুষ রতন।প্রণাম করিয়া করে নিজ নিবেদন।।মোর জ্যেষ্ঠ বালি হয়, রাজ্য অধিকারী।বলে রাজ্য নিল, আমি যুদ্ধেতে না পারি।।মুনিশাপে আসে হেথা, তার শক্তি নাই।সে কারণে আছি প্রাণে, শুনহ গোঁসাই।।রাম বলে, আজি হৈতে তুমি মোর মিতা।তব রাজ্য দিব আমি, তুমি দিবে সীতা।।সুগ্রীব বলিল, তবে যে আজ্ঞা তোমার।সীতা উদ্ধারিতে প্রভু হৈল মোর ভার।।শ্রীরাম কহেন, কালি প্রত্যূষ সময়।বালিকে মারিয়া রাজা করিব তোমায়।।হেনমতে রঘুনাথ বালিরাজা মারি।সুগ্রীবের করিলেন রাজ্য অধিকারী।।চারি মাস সেই স্থানে রহে রঘুনাথ।কপিরাজ সুগ্রীবের লয়ে তবে সাথ।।সমুদ্রের তীরে যান সৈন্য সমাবেশে।হনূমানে পাঠাইল সীতার উদ্দেশে।।পবন নন্দন বীর পোড়াইল লঙ্কা।রাজপুত্রে মারি বীর নৃপে দিল শঙ্কা।।সীতার উদ্দেশ করি আসে মহাবীর।শ্রীরাম লক্ষ্মণ তাহে হইলেন স্থির।।হেনকালে শুন রাজা দৈব বিবরণ।রাবণ অনুজ ধর্ম্মশীল বিভীষণ।।করযোড় করি নৃপে কহে বিধিমতে।সীতা দিয়া শরণ লইতে রঘুনাথে।।ধন রাজ্য বংশ বৃদ্ধি কর নরপতি।শুনিয়া রাবণ ক্রোধে মারিলেক লাথি।।যেইকালে বিভীষণে প্রহারে চরণে।রাজ্যলক্ষ্মী আশ্রয় করিল বিভীষণে।।অতি দুঃখে বহির্গত হৈল বিভীষণ।রামের চরণে গিয়া লইল শরণ।।শ্রীরাম কহেন, তুমি শত্রু সহোদর।কিরূপে বিশ্বাস তোমা করিবে অন্তর।।বিভীষণ বলে, প্রভু মনে ভাব যদি।তোমার সেবক আমি জনম অবধি।।ইথে অন্যমত যদি করি কদাচন।হইব কলির রাজা, কলির ব্রাহ্মণ।।কলিতে জন্মিব, আর জীব দীর্ঘকাল।শুনিয়া রামের হৈল আনন্দ বিশাল।।লক্ষ্মণ কহেন হাসি করি যোড়কর।উত্তম করিল দিব্য রাক্ষস ঈশ্বর।।তপস্যা করিয়া চিরকাল যাহা পায়।পরদ্রোহ করিয়া এ সব যদি হয়।।ইহা ছাড়ি অন্য বাঞ্ছা করে কোন্ জন।হাসিয়া কহেন রাম, বালক লক্ষ্মণ।।কলিতে ব্রাহ্মণ রাজা দীর্ঘজীবী জন।এই তিনে পরিত্রাণ নাহি কদাচন।।করিল কঠোর দিব্য রাক্ষসের পতি।না বুঝি হাসিলে ভাই, তুমি শিশুমতি।।আজি হৈতে মিত্র মম হৈল বিভীষণ।তোমারে অর্পিব লঙ্কা মারিয়া রাবণ।।বিচার করিল তিনজন এই মত।ল্ঙ্কায় গমনে সবে হলেন উদ্যত।।বানর সকলে সিন্ধু বান্ধে অবহেলে।পাষাণ ভাসিল রাজা সাগরের জলে।।বান্ধে নল জলনিধি রাম উপরোধে।কটক সকলে পার হয়ে কার্য্য সাধে।।১০৭. শ্রীরামের লঙ্কায় প্রবেশ ও যুদ্ধপ্রধান প্রধান যোদ্ধৃপতি দিল থানা।সকল লঙ্কায় হৈল শ্রীরামের সেনা।।ভয়েতে রাবণ বন্ধ করিলেন দ্বার।মন্ত্রী লয়ে পরামর্শ করে যুদ্ধ সার।।সবান্ধবে সুসজ্জায় আসে দশানন।দেখি চমকিত হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।জিজ্ঞাসেন বিভীষণে মানিয়া বিস্ময়।একে একে বিভীষণ দিল পরিচয়।।শ্রীরাম কহেন শুনি মিত্র বিভীষণে।নাহিক বুদ্ধির লেশ অজ্ঞান রাবণে।।শতেক ইন্দ্রের নাহি এত পরিচ্ছদ।কি কারণে নষ্ট করে এতেক সম্পদ।।এইমত চিত্তে রাম করেন বিচার।হেথায় রাবণ আসি কৈল মহামার।।সেনাপতি সেনাপতি হইল সংগ্রাম।ইন্দ্রজিৎ লক্ষ্মণ, রাক্ষসপতি-রাম।।রণেতে পণ্ডিত রাম যুদ্ধে পরিপাটী।মাথার মুকুট দশ ফেলিলেন কাটি।।লজ্জা পেয়ে পলাইল রাজা দশানন।উভয় সৈন্যেতে আর নাহি দরশন।।তবে রাম পাঠালেন বালির নন্দনে।অনেক ভৎসিল গিয়া রাজা দশাননে।।অঙ্গদের বাক্যে দশানন দুঃখমতি।পাঠাইল বহু বহু শ্রেষ্ঠ সেনাপতি।।মুনি বলে, সেই কথা কহিতে বিস্তর।সংক্ষেপে কহিব শুন ধর্ম্ম নৃপবর।।বজ্রদন্ত মহাবাহু মহাকায় আদি।প্রহস্ত করিল যুদ্ধ, নাহিক অবধি।।পড়িল রাক্ষস সেনা নাহি পরিমিত।ক্রোধভরে আসে তবে বীর ইন্দ্রজিত।।করিল রাক্ষসী মায়া বহু বহু রণে।নাগপাশে বন্দী কৈল শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।গরুড় স্মরিয়া রাম পবন আদেশে।নাগপাশে মুক্ত হৈলা প্রকার বিশেষে।।গর্জ্জিয়া বানরগণ করে সিংহনাদ।শুনিয়া রাবণ রাজা গণিল প্রমাদ।।বিস্ময় মানিয়া অতি চিন্তাকুল মনে।মহাপাশ মহোদরে পাঠাইল রণে।।আর চারি সেনাপতি রাবণ কুমার।মহাক্রোধ আসি সবে করে মহামার।।শিলা বৃক্ষ লয়ে যুদ্ধ করিল বানর।অস্ত্রশস্ত্রে বিশারদ যত নিশাচর।।উভয় সৈন্যেতে যুদ্ধ হৈল অপ্রমিত।ছয় সেনাপতি মরে সৈন্যের সহিত।।শুনিয়া রাবণ রাজা গণিল প্রমাদ।পুণর্ববার আসে তবে বীর মেঘনাদ।।অপূর্ব্ব রাক্ষসী মায়া ইন্দ্রজিৎ জানে।দেখিতে না পায় কেহ থাকে কোন্ স্থানে।।করিল সংগ্রাম ঘোর রাবণ সন্ততি।চারি দ্বারে মারিল প্রধান সেনাপতি।।থাকুক অন্যের কার্য্য শ্রীরাম লক্ষ্মণে।জিনিয়া পরম সুখে কহিল রাবণে।।কেবল জীবিত মাত্র ছিল তিন জন।হনুমান, সুষেণ, রাক্ষস বিভীষণ।।উপদেশ কহিলেন সুষেণ প্রধান।গন্ধমাদন গিরি আনিল হনূমান।।ঔষধি চিনিয়া দিল বানর সুষেণ।আপনি বাটিয়া দিল রক্ষ বিভীষণ।।যেই মাত্র পাইলেন ঔষধের ঘ্রাণ।যত ছিল মৃত সৈন্য, সবে পায় প্রাণ।।মৃত সৈন্য প্রাণ পায় হনূর প্রসাদে।কাঁপিল রাবণ বানরের সিংহনাদে।।তবে বহু যুদ্ধ করি মরে অকম্পন।ভয় পেয়ে কুম্ভকর্ণে জাগায় রাবণ।।নিদ্রা হতে উঠি যায় রাজ সম্ভাষণে।দেখিয়া বিস্মিত হৈল ভাই দুই জনে।।বিভীষণে জিজ্ঞাসিল কহ সমাচার।সত্তর যোজন উচ্চ শরীর কাহার।।তবে বৃথা কি কারণে করিতেছ রণ।রাক্ষসের মায়া কিছু না বুঝি কারণ।।বিভীষণ বলে, ভয় ত্যজহ অন্তর।কুম্ভকর্ণ নামে মোর্এক সহোদর।।পূর্ব্বে ব্রহ্মা বর দিয়া কৈল নিরূপণ।নিদ্রা ভাঙ্গি জাগাইলে অবশ্য মরণ।।পাচঁ মাসে জাগাইল ভয় পেয়ে মনে।সন্দেহ নাহিক আজি, মরিবেক রণে।।এত যদি কহিলেন রক্ষ বিভীষণ।তুষ্ট হয়ে রাম তারে দেন আলিঙ্গন।।রাবণ কহিল কুম্ভকর্ণে সমাচার।ক্রোধে মহাবীর আসি কৈল মহামার।।গিলিল বানর একেবারে শতে শতে।বাহির হইল কেহ নাক-কান-পথে।।দেখিয়া বিকট মূর্ত্তি ধায় সৈন্যগণ।অস্ত্র যুড়ি অগ্রে যান কমললোচন।।রামে দেখি কম্ভকর্ণ ধায় গিলিবারে।সত্বর মারেন রাম ব্রহ্ম-অস্ত্র তারে।।সেই বাণে মরিল দুরন্ত নিশাচর।পুষ্পবৃষ্টি করিলেন যতেক অমর।।ভীত হইল রাবণ, সৈন্য নাহি আর।কি প্রকারে এ বিপদে পাইবে নিস্তার।।বানর পড়িয়া লঙ্কা কৈল ছারখার।কাহারে পাঠাব যুদ্ধে, কে করিবে পার।।ভাবিয়া পাঠায় শেষে মকরাক্ষ বীরে।সে আমি অনেক যুদ্ধ করিল সমরে।।বহু যুদ্ধ করি মৈল শ্রীরামের বাণে।কুম্ভ ও নিকুন্ত পরে প্রবেশিল রণে।।বল বুদ্ধি বিক্রমেতে বাপের সমান।প্রাণপণে যুঝিল সুগ্রীব হনূপান।।দুই ভাই পড়ে ক্রমে সহ সর্ব্বসেনা।তবে ইন্দ্রজিৎ বীরে নাহি সম্ভাবনা।।তবে ইন্দ্রজিতে আজ্ঞা দিল দশানন।সসৈন্য মারহ তুমি শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।সংহতি লইয়া তবে সেনা অপ্রমিত।যুদ্ধ হেতু অগ্রসর হয় ইন্দ্রজিত।।ক্রোধে আসি মেঘনাধ করে বহু রণ।তেমতি করিল যুদ্ধ ঠাকুর লক্ষ্মণ।।সংহতি লইয়া তবে সেনা অপ্রমিত।যুদ্ধ হেতু অগ্রসর হয় ইন্দ্রজিত।।ক্রোধে আসি মেঘনাদ করে বহু রণ।তেমতি করিল যুদ্ধ ঠাকুর লক্ষ্মণ।।মায়ায় রাক্ষস যুদ্ধ করে বহুতর।দেখাদেখি মহাযুদ্ধ হৈল পরস্পর।।সহিতে নারিল যুদ্ধ রাবণ নন্দন।ভঙ্গ দিয়া প্রবেশিল নিজ নিকেতন।।প্রবেশ করিয়া সেই যজ্ঞ আরম্ভিল।হেনকালে বিভীষণ লক্ষ্মণে কহিল।।যজ্ঞ আরম্ভিল দেব রাবণ-কুমার।যজ্ঞ সাঙ্গ হৈলে মৃত্যু নাহিক উহার।।বিধিবাক্য আছে হেন, আমি জানি ভালে।তবে সে মারিতে পার যজ্ঞ নষ্ট কৈলে।।শুনিয়া হইল সবে হরষিত মন।যজ্ঞ নষ্ট কৈল গিয়া পবন নন্দন।।তবে ব্রহ্মা-অস্ত্রে তারে মারিল লক্ষ্মণ।নিশ্চিন্তে হইল স্বর্গে সহস্র-লোচন।।বার্ত্তা পেয়ে শোকাকুল রাক্ষসের পতি।রাবণ আসিল রণে অতি ক্রোধমতি।।১০৮. রাবণ বধপুত্রশোকে রণে আসে রাজা দশানন।দেখি অগ্রসর হন ঠাকুর লক্ষ্মণ।।লক্ষ্মণের সঙ্গে আসে বীর বিভীষণ।বিভীষণে দেখি করে রাবণ চিন্তন।।এই পাপ হৈতে মোর সবংশে নিধন।ইহারে বধিয়া শেষে বধিব লক্ষ্মণ।।এতেক ভাবিয়া দুষ্ট অতি ক্রোধমনে।লক্ষ্মণে ছাড়িয়া অস্ত্র মারে বিভীষণে।।এড়িলেন শেলপাট ভীষণ দর্শন।দিব্য অস্ত্র এড়ি তাহা কাটিল লক্ষ্মণ।।মহাক্রোধে পুনঃ শেল মারে বিভীষণে।পুনশ্চ লক্ষ্মণ তাহা কাটে দিব্য বাণে।।দুই শেল অস্ত্র যদি কাটিল লক্ষ্মণ।ময়দত্ত শেল হাতে লইল রাবণ।।ডাকিয়া কহিল তবে লক্ষ্মণের তরে।বুঝিলাম বীরপণা, রক্ষা কৈলে পরে।।আপনা সংবর শীঘ্র, যায় শক্তিবর।দেখিয়া লক্ষ্মণ বীর হলেন ফাঁফর।।প্রাণপণে বাণ মারে, নারে নিবারিতে।কালদ্ণ্ড সম শক্তি আসে শূন্যপথে।।নির্ভয়ে বাজিল গিয়া লক্ষ্মণের বুকে।পড়িল লক্ষ্মণ বীর, রক্ত উঠে মুখে।।শোকাকুল রঘুনাথ হলেন অজ্ঞান।পর্ব্বত আনিল তবে বীর হনূমান।।পর্ব্বতে ঔষধি ছিল, তার অনুভবে।লক্ষ্মণ পাইল প্রাণ, আনন্দিত সবে।।কাল পূর্ণ হৈল, রণে আসিল রাবণ।আপনি গেলেন রণে কমললোচন।।রাবণে দেখিয়া রথে রঘুনাথে ক্ষিতি।ইন্দ্র পাঠাইল রথ মাতলি সংহতি।।সেই রথে রঘুনাথ চড়েন কৌতুকে।মাতলি লইল রথ রাবণ সম্মুখে।।অপ্রমিত যুদ্ধ হৈল দুই মহাবলে।উপমা নাহিক স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে।।যার যত শিক্ষা ছিল, দোঁহে কৈল রণ।মহাক্রোধভরে তবে কমললোচন।।রাবণের দশ মুণ্ড কাটিলেক শরে।পুনর্ব্বার উঠে মুণ্ড বিধাতার বরে।।পুনঃ পুনঃ যতবার কাটেন রাবণে।বিনাশ না হয় দুষ্ট পূর্ব্বের সাধনে।।যোড়করে বিভীষণ করে নিবেদন।অন্য অস্ত্রে না মরিবে দুর্জ্জয় রাবণ।।মৃত্যুবাণ আছে ওর মন্দোদরী পাশ।সে বাণ আনিলে হবে রাবণের নাশ।।হণূমানে নিবেদিল কমললোচন।ছলেতে আনিল বাণ পবননন্দন।।সেই বাণ লয়ে রাম যুড়িল ধনুকে।ক্রোধভরে মারিলেন রাবণের বুকে।।হেনমতে ভূমিতলে পড়ে দশানন।পুষ্পবৃষ্টি কৈল তবে যত দেবগণ।।তবে সীতা আনিল রাক্ষস বিভীষণ।দেখিয়া কহেন তাঁরে কমললোচন।।তোমারে রাখিল দশ মাস নিশাচর।না জানি আছিল সীতা কেমন প্রকার।।আমারে করিবে নিন্দা, এই বড় ভয়।পরীক্ষা দেহ ত সীতা যদি মনে লয়।।এমত শুনিয়া সীতা অতি দুঃখ মনে।অগ্নিকুণ্ড জ্বালাইতে কহেন লক্ষ্মণে।।লক্ষ্মণ করিল কুণ্ড, প্রবেশিলা সীতা।কৌতুক দেখিতে যত আসিল দেবতা।।রামের আদেশে সীতা পড়েন অনলে।হেন কালে উঠে অগ্নি সীতা লয়ে কোলে।।ব্রহ্মা আদি সর্ব্বদেব একত্র মিলিল।করিয়া অনেক স্তুতি রাম্যেরে কহিল।।আপনা না জানি কর মনুষ্য-আচার।তুমি নারায়ণ, সীতা লক্ষ্মী-অবতার।।আসিল দেখিতে তোমা যত পিতৃলোক।এই দেখ, দশরথ তোমার জনক।।দেবগণ বলে, রাম মাগ ইষ্টবর।শুনিয়া কহেন রাম জীউক বানর।।পরে রাম সম্ভাষণ করি সর্ব্ব জন।যত দেবগণ গেল আপন ভবন।।বিভীষণে দেন রাম রাজ্য অধিকার।বানর কটকে কৈল বহু পুরষ্কার।।সসৈন্যে গেলেন রাম অয্যোধ্যা নগর।সিংহাসন বসিলেন হয়ে রাজ্যেশ্বর।।মহাভারতের মাঝে রামের আখ্যান।পাঠে ধর্ম্ম পুণ্য লভে, জন্মে দিব্যজ্ঞান।।১০৯. দন্তবনক্র ও শিশুপালরূপে জয়-বিজয়ের তৃতীয়বার জন্মএতেক শুনিয়া ধর্ম্ম কন মুনি প্রতি।কহ তপোধন জয়-বিজয় ভারতী।।শুনিবারে চিত্তে জাগে অতি কৌতূহল।পুণ্যকথা কহি শান্ত কর দুঃখানল।।নৃপ-বাক্যে মুনি কহে, কহি শুন ধর্ম্ম।ভারত শ্রবণ সম নাহি আর কর্ম্ম।।ধর্ম্মী তুমি, তাই চাহ শুনিতে পুণ্য কথা।তেঁই শুনাব তোমারে পুণ্যশ্লোক গাথা।।জয়-বিজয়ের তৃতীয় জন্ম কথন।সংক্ষেপে কহি শুন হইয়া এক মন।।সেবক উদ্ধার হেতু প্রভুর এ কর্ম্ম।হেনমতে দুই ভাগে লয়ে দোঁহে জন্ম।।জন্মিল বিজয় জয় ভূমে পুনর্ব্বার।দন্তবক্র শিশুপাল নাম দোঁহাকার।।পূর্ণব্রহ্ম যদুকুলে হয়ে অবতার।তব যজ্ঞে শিশুপালে করেন উদ্ধার।।তিন অবতারে কৃষ্ণ দেব ভগবান।ভক্তজনে করিলেন ভবে পরিত্রাণ।।রামের এতেক দুঃখ ধরিয়া শরীর।কি দুঃখ তোমার বনে রাজা যুধিষ্ঠির।।সীতার দুঃখের কথা শুনিলে শ্রবণে।দ্রৌপদীর দুঃখ তার নহে একগুণে।।সবার দুঃখের কথা করিয়া শ্রবণ।সীতাদুঃখে দ্রৌপদীর বিদরিল মন।।মুনি বলে শুন রাজা, দুঃখ হৈল অন্ত।অল্পিদেন নষ্ট হবে কৌরব দুরন্ত।।বিশেষ দ্রৌপদী এই সাবিত্রী সমান।যে জন উভয় কুল কৈল পরিত্রাণ।।নানা সুখ ত্যজিলেক স্বামীর কারণে।তথাপি না ত্যজিলেক স্বামী সত্যবানে।।ক্ষত্রকুলে তার তুল্য নহে কোন জন।দ্রৌপদীতে দেখি যেন তাঁহার লক্ষণ।।সতী সাধ্বী পতিব্রতা লক্ষ্মী-অবতার।অক্ষেতে দাসত্ব মুক্ত কৈল সবাকার।।এতেক ব্রাক্ষণ যার ভুঞ্জে অপ্রমাদে।কদাচ না হবে দুঃখ ইহার প্রসাদে।।পশ্চাতে জানিবে রাজা নয়নে দেখিবে।কহিনু ভবিষ্য কথা নিশ্চয় ফলিবে।।ভ্ক্ত জয় বিজয়ের তিন জন্ম কথা।তিন অবতারে শ্রীহরির কার্য্য গাথা।।সবিশেষে মুনিবর কন নৃপভাগে।সবিত্রী কথা শুনিবারে কৌতুক জাগে।।ব্যাস বিরচিত মহাভারত আধারে।যাহা নাই, নাই তাহা, বিশ্বের মাঝারে।।১১০. সাবিত্রী উপাখ্যানজিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির, শুন মহামুনি।কহিলে রামের কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।।হইল শরীর মুক্ত, সফল এ জন্ম।সাবিত্রী কাহার নাম, কিবা তাঁর কর্ম্ম।।কিবা ধর্ম্ম আচরিল, কিবা উগ্রতপে।কোন্ কোন্ কুল উদ্ধারিল কোন্ রূপে।।শুনিবারে ইচ্ছা বড় জন্মিল অন্তরে।মুনিরাজ বিস্তারিয়া কহ গো আমারে।।মুনি বলে, শুন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই অপূর্ব্ব কাহিনী।।মদ্রদেশে চিল অশ্বপতি মহীপাল।পুত্রহেতু শিব সেবা করে বহুকাল।।সন্তান বিহীন রাজা নিরানন্দ মতি।কত দিনে হৈল এক কন্যা রূপবতী।।তপ্তবর্ণ যিনি তার শরীরের শোভা।কলঙ্ক বিহীন কলানিধি মুখ-আভা।।বিহঙ্গম-চঞ্চু জিনি বিরাজিত নাসা।দশন-মুকুতাপাঁতি, সুমধুর ভাষা।।মদনের ধনু জিনি তার যুগ্ম ভুরূ।মৃণাল জিনিয়া বাহু, রামরম্ভা ঊরু।।কুরঙ্গ-নয়নী ধনী, মনোহর কেশ।মৃগেন্দ্র লজ্জিত হয় দেখি মধ্যদেশ।।রূপের সমান তার গুণের গণনা।শুদ্ধমতি সর্ব্বশাস্ত্রে অতি সে প্রবীণা।।সুপ্রিয়বাদিনী সতী সর্ব্বভূতে দয়া।অশ্বপতি হৃষ্টমতি দেখিয়া তনয়া।।সাবিত্রী রাখিল নাম বিচারি তাহার।সর্ব্বদা পবিত্রা কন্যা, পবিত্র আচার।।দিনে দিনে বাড়ে কন্যা, পিতার মন্দিরে।স্বচ্ছন্দে গমনে যায়, যথা ইচছা করে।।সমান বয়স প্রিয়সখীগণ সাথে।ভ্রমণ করয়ে সুখে চড়ি দিব্য রথে।।বিশেষ, বাপের রাজ্যে কিছু নাহি ভয়।উপনীত হৈলে গিয়া মুনির আলয়।।বিবিধ কৌতুক দেখে অশ্বপতি-সুতা।হেনকালে শুন রাজা অত্যাশ্চর্য্য কথা।।দ্যুমৎসেন নামে অবন্তীর পতি।শত্রু নিল রাজ্য, বনে করিল বসতি।।তাহার নন্দন ছিল নাম সত্যবান।রূপেতে নাহিক কেহ তাহার সমান।।মুনিপুত্রগণ সহ আছিল ক্রীড়ায়।সাবিত্রী থাকিয়া দূরে দেখিল তাহায়।।কন্দর্প জিনিয়া রূপ কিশোর বয়স।দেখিয়া নরেন্দ্রসুতা জিজ্ঞাসে বিশেষ।।কাহার নন্দন এই, কহ মুনিগণ।যার রূপে সমুজ্জ্বল এই তপোবন।।বনবাসী জন কহে, কর অবধান।দ্যুমৎসেনের পুত্র, নাম সত্যবান।।সাবিত্রী শুনিয়া কথা হন হৃষ্টমতি।মনেতে করিয়া তাঁরে কৈল নিজপতি।।গৃহেতে আসিয়া তবে নৃপতির সুতা।জননীর কাছে গিয়া রাণী কহে নৃপবরে।।শুনিয়া কহিল রাজা দুঃখিত অন্তরে।কোন্ বংশে জন্ম তার, কিবা তার ধর্ম্ম।।না জানি কেমনে আমি করি হেন কর্ম্ম।এইরূপে আছে রাজা নিরানন্দ মন।এক দিন উপনীত ব্রহ্মার নন্দন।।নারদ মুনিরে দেখি সুখী সর্ব্বজনে।হৃষ্টমতি নরপতি মুনি আগমনে।।বসালেন দিব্য সিংহাসনের উপর।বেদের বিহিত স্তুতি করেন বিস্তর।।আনন্দে বসিল সবে কথোপকথনে।সহসা সাবিত্রী কন্যা আসে সেই স্থানে।।কন্যা দেখি নৃপতিরে কহে তবে মুনি।পরমা সুন্দরী এই কাহার নন্দিনী।।অশ্বপতি বলে, মুনি কি কহিব আর।অপত্য আমার এই কন্যামাত্র সার।।মুনি বলে, সুলক্ষণা তোমার দুহিতা।বিবাহ দিয়াছ, কিবা এ অবিবাহিতা।।রাজা বলে, শিশুমতি অত্যল্প বয়স।যোগ্যাযোগ্য ভালমন্দ, না জানি বিশেষ।।বরিয়াছে মনে মনে কারে তপোবনে।নিরূপণ নাহি জানি সন্দ আছে মনে।।ভাল হৈল ভাগ্যবশে আসিলে আপনি।ঘুচিল মনের ধন্দ ওহে মহামুনি।।নারদ কহেন তবে সাবিত্রীর প্রতি।কোন বংশে জন্ম তার, কাহার সন্ততি।।সাবিত্রী কহিল, দেব মুনির আশ্রমে।দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান নামে।।নারদ কহিল, আমি জানি সর্ব্ব বার্ত্তা।তাহা ছাড়ি তুমি মাগো বর অন্য ভর্ত্তা।।সাবিত্রী কহিল, পূর্ব্বে বরিয়াছি মনে।অন্যে বরি ভ্রষ্টা হব কিসের কারণে।।মুনি বলে, দোষ নাই, শুন মোর কথা।সাবিত্রী কহিল, মুনি না হবে অন্যথা।।পুনঃ পুনঃ দোঁহাকার এই বাক্য শুনি।ব্যস্ত হয়ে তাঁরে জিজ্ঞাসিল নৃপমণি।।তাহার বৃত্তান্ত শুনি, কহ মুনিবর।কি হেতু বরিতে বল অন্য কোন বর।।কোন্ বংশে জন্ম তার কাহার নন্দন।কহ শুনি মুনিবর ব্যস্ত বড় মন।।নৃপতির মুখে শুনি এতেক বচন।কহিতে লাগিল কৃপাবশে তপোধন।।সূর্য্যবংশে শূরসেন রাজার সন্ততি।দ্যুমৎসেন নামে রাজা অবন্তীর পতি।।মহিমা সাগর মহারাজ গুণবান।পৃথিবীতে নাহি শুনি তাঁহার সমান।।খণ্ডন না যায় রাজা দৈবের নির্ব্বন্ধ।কত দিনে নৃপতির চক্ষু হৈল অন্ধ।।চক্ষুহীন শিশু পুত্র নাহি অন্য জন।সময় পাইয়া রাজ্য নিল শত্রুগণ।।ভার্য্যা পুত্র সঙ্গে করি করে বনবাস।মহাক্লেশে আছে সবর্ব সুখেতে নিরাশ।।বিচার করিয়া দেখ দৈবের সংযোগ।শরীর ধরিলে হয় সুখ দুঃখ ভোগ।।রাজা বলে, চরিতার্থ হৈনু তপোধন।এই চিন্তা করি সদা নিরানন্দ মন।।সুখ দুঃখ শরীরের সহযোগে জন্ম।সময়ে প্রবল হয় আপনার কর্ম্ম।।আপন ইচ্ছায় ভাল মন্দ কিছু নয়।দৈবের সংযোগে সেই যখন যে হয়।।বরযোগ্য বটে যদি সেই সত্যবান।আজ্ঞা কর, কন্যাধনে করি তাঁরে দান।।মুনি বলে, তাহে মানা করিতেছি আমি।পুনঃ পুনঃ মোরে কেন জিজ্ঞাসহ তুমি।।কুলে শীলে রূপে গুণে তোমা হৈতে শ্রেষ্ঠ।সকল সুন্দর বটে, একমাত্র কষ্ট।।আজি হৈতে যেই দিনে বর্ষ পূর্ণ হবে।সেই দিন সত্যবান নিশ্চয় মরিবে।।কহিনু ভবিষ্য কথা যদি লয় মনে।যোগ্য দেখি কন্যাদান কর অন্য জনে।।শুনিয়া মুনির মুখে এতেক ভারতী।কহিতে লাগিল অশ্বপতি নরপতি।।কদাচ কর্ত্তব্য মম নহে এই কর্ম্ম।শিশুর ক্রীড়ায় নাহি কভু ধর্ম্মাধর্ম্ম।।ধনে মানে কুলে শীলে হবে গুণবান।বিচার করিয়া তারে দিব কন্যাদান।।দোষ না থাকিবে তার, হবে রাজ্যেশ্বর।এমত পাত্রেতে কন্যা দিব মুনিবর।।কন্যা-দানকর্ত্তা পিতা আছে পূর্ব্বাপর।তাহে যদি মনে নহে, হবে স্বয়ম্বর।।আনাইব পৃথিবীর যত নৃপচয়।দেখিয়া বরিবে কন্যা, যারে মনে লয়।।কি হেতু বরিবে অল্প আয়ু সত্যবান।বিশেষ বৈধব্য দুঃখ মরণ সমান।।শুনিয়া দোঁহার মুখে এতেক ভারতী।কৃতাঞ্জলি সাবিত্রী কহিছে গুণবতী।।শুনহ জনক মম সত্য নিরূপণ।কদাপি নয়নে নাহি হেরি অন্য জন।।যখন মানসে তাঁরে বরিয়াছি আমি।জীবনে মরণে সেই সত্যবান স্বামী।।বৈধম্য যন্ত্রণা যদি থাকে মোর ভোগ।খণ্ডণ না যাবে পিতা, দৈবের সংযোগ।।অনিত্য সংসার এই, অবশ্য মরণ।না মরিয়া চিরজীবী আছে কোন্ জন।।মৃত্যুর উৎপত্তি দেখ শরীরের সাথে।আজি কিম্বা কালি কিম্বা শত বৎসরেতে।।অসার সংসার মাত্র, আছে এক ধর্ম্ম।কিমতে তাহারে ছাড়ি করি অন্য কর্ম্ম।।ধিক্ ধিক্ কিবা ছার সুখ অভিলাষ।ধর্ম্ম ছাড়ি অধর্ম্মে যে করে সুখ আশ।।কি করিবে সুখ পিতা, কত কাল জীব।কুকর্ম্মে আজন্মকাল নরকে থাকিব।।এত শুনি ধন্য ধন্য করি তপোধন।আশীর্ব্বাদ করি যান নিজ নিকেতন।।অশ্বপতি দুঃখ অতি পাইল অন্তরে।কহিল অনেক কথা সাবিত্রীর তরে।।বুঝাইল নরপতি বিবিধ বিধান।সাবিত্রী কহিল, মোর পতি সত্যবান।।ভারত-পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।পাঁচালী প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon