১১. শ্রীবৎস রাজার সিংহাসন নির্ম্মাণও লক্ষ্মী, শনির সিংহাসনে উপবেশনপ্রভাতে উঠিয়া রাজা, লইয়া সকল প্রজা,মন্ত্রণা করেন এই সার।বচন নাহিক কবে, অথচ বিচার হবে,ইথে ভার ইষ্টদেবতার।।এত বলি অনুচরে, আজ্ঞা দেন নরবরে,আন দুই দিব্য সিংহাসন।এক স্বর্ণে বিনির্ম্মিত, এক রৌপ্য বিরচিত,দই পার্শ্বে দুয়ের স্থাপন।।আসনের নানা সাজ, সাজাইয়া মহারাজ,আপনি বসিল মধ্যস্থলে।কমলা শনির সাথে, আসিল বৈকুণ্ঠ হতে,বসিলেন আসন বিমলে।।সম্মূখে দাঁড়ায়ে রাজা, বিধিমতে করি পূজা,প্রকাশিয়া মহতী ভকতি।কৃতাঞ্জলি প্রণিপাতে, দাঁড়াইল যোড়হাতে,বহুবিধ করিলেন স্তুতি।।হইয়া আহ্লাদ যুতা, বসিল জলধিসুতা,স্বর্ণছত্র সিংহাসনোপরে।বামে শনি মহাশয়, আসন রজতময়,রবি শশী যেন তমো হরে।।বসিলেন তিন জনে, নানা কথা আলাপনে,রাজার পীযূষ বাক্য শুনি।সংসার সাগরে সেতু, জীব তরাবার হেতুমরচিলেন ব্যাস মহামুনি।।কাশীরাম দাসে কয়, তরিবারে ভবভয়,নাহি হবে জঠর যন্ত্রণা।কৃষ্ণ নাম কর সার, জনম না হবে আর,এই মম বচন রচনা।।১২. শ্রীবৎস রাজার বিচার ও শনির কোপদুই সিংহাসনে তবে বসি দুই জন।কথায় কথায় জিজ্ঞাসিলেন তখন।।কহ ভূপ এ দুয়ের শ্রেষ্ঠ কোন্ জন।শুনিয়া হাসিয়া রাজা বলেন বচন।।আসন ছত্রেতে বিধি বুঝি লহ মনে।বামে বসে সাধারণ, প্রধান দক্ষিণে।।শুনি শনি হয় অতি কোপান্বিত মন।ম্লানমুখ হয়ে শনি করেন গমন।।লক্ষ্মী কহিলেন, তুষ্ট করিলে আমায়।অচলা হইয়া রব তোমার আলয়।।আশীর্ব্বাদ করি দেবী করেন গমন।বিষণ্ণ হইয়া রাজা ভাবেন তখন।।এরূপে শ্রীবৎস রাজা বঞ্চে কত দিন।ছিদ্র অন্বেষণে শনি ভ্রমে অনুদিন।।শুন রাজা যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।দৈবেতে কুগ্রহ ঘটে শ্রীবৎস রাজার।।সিংহাসনে স্নান করি বৈসে নরপতি।হেনকালে শুন নৃপ দৈবের দুর্গতি।।কৃষ্ণবর্ণ তথা এক কুক্কুর আসিয়া।সেই জল অকস্মাৎ খাইল চাটিয়া।।এক ছিদ্র দেখি শনি প্রবিষ্ট হইল।ক্রমে ক্রমে বুদ্ধি হ্রাস হইতে লাগিল।।বিষম শনির কোপ বাড়ে অনুদিন।ক্রমে ক্রমে বৈভবাদি সব হৈল হীন।।অকস্মাৎ পড়ে গৃহ মন্দির প্রাচীর।শত শত মঞ্চ সুন্দর মন্দির।।অকস্মাৎ কোন স্থানে অগ্নিদাহ হয়।দিবস রজনী প্রায় সব ধূম্রময়।।বিনা মেঘে রক্তবৃষ্টি হয় চতুর্দ্দিকে।অকস্মাৎ উল্কাপাত কালপেচাঁ ডাকে।।দিবসে প্রকাশে সব নক্ষত্র মণ্ডল।ধূমকেতু খসি পড়ে, অতি অমঙ্গল।।শনি কোপানলেতে পড়িল নৃপবর।রাজ্যরক্ষা নাহি হয়, উৎপাত বিস্তর।।গজ বাজী পদাতি মরিল লক্ষ লক্ষ।গাভী বৎস পশু পক্ষী নাহি পায় ভক্ষ্য।।অকস্মাৎ রথধ্বজ ভাঙ্গিতে লাগিল।দাবানল আসি যেন অরণ্য দহিল।।শ্রীবৎসের রাজ্যে শনি ঘটান প্রমাদ।যুবক যুবতী হয় হরিষে বিষাদ।।কাক শিবা শকুনি গৃধিনী নাচে রঙ্গে।ভূত প্রেত দৈত্য দানা পিশাচের সঙ্গে।।বিপদ সাগরে পড়ে শ্রীবৎস নৃপতি।রোদন করিয়া ফেরে, শুন মহামতি।।রাজার নিকটে আসি যত প্রজাগণ।এই দুঃখে দুঃখী হয়ে করয়ে রোদন।।কোথা বা যাইব, আর কোথা বা রহিব।অনাহারে মহাকষ্টে কেমনে বাঁচিব।।তিন দিবা রাত্রি রাজা নগর ভ্রমিয়া।ঘরে ঘরে দেখিলেন সকল চাহিয়া।।শঙ্কায় কম্পিত নৃপ হৈল মুহ্যমান।বিলাপ করিয়া রাণী হইল অজ্ঞান।।রাজা বলে, কান্দ কেন পাগলের প্রায়।জনম হইলে মৃত্যু সকলেরি হয়।।স্বকীয় কর্ম্মের ভোগ হয় যে আমার।কেন বা রোদন ইথে কর প্রিয়ে আর।।সসাগরা পৃথিবীর পতি যেই জন।তাহার এমন দশা দৈবের ঘটন।।দৈব যাহা করে, তাহা কে করে অন্যথা।ঈশ্বরের ইচ্ছা হেন, খেদ কর বৃথা।।আমার একান্ত ভার তাঁহার উপর।আমি কি করিব চিন্তা, কর্ত্তা ত ঈশ্বর।।১৩. শ্রীবৎস ও চিন্তার বনগমনএইরূপ বিবেচনা করিয়া ভূপতি।ত্রিপক্ষের পর তাঁর স্থির হল মতি।।শনি দুঃখ দিবেন আমারে এইমতে।উপায় ইহার এক, ভাবি জগন্নাথে।।চিন্তাদেবী কর তুমি কিঞ্চিৎ সঞ্চয়।হীরা মুক্তা মণি স্বর্ণ যাহা মনে লয়।।প্রবাল প্রস্তর আর যত জহরত।বহুমূল্য অল্পভার এমত রজত।।সঞ্চয় করিয়া লহ বিচিত্র বসন।অন্য বস্ত্র দিয়া সব কর আচ্ছাদন।।শুনি রাণী কাঁথা এক করিল তখন।কাঁথার ভিতরে রাখে বহুমূল্য ধন।।রাজা বলে, শুন রাণী আমার বচন।শনিদোষে মজিল সকল রাজ্যধন।।কেবল আছয়ে মাত্র জীবন দোঁহার।এখন উপায় কিছু নাহি দেখি আর।।পিত্রালয়ে যাও তুমি রাখিতে জীবন।যথা তথা আমি কাল করিব ক্ষেপন।।শনিত্যাগ যদি হয় কখন আমার।তব সহ মিলন হইবে পুনর্ব্বার।।এত শুনি চিন্তাদেবী লাগিল কহিতে।না যাব বাপের বাড়ী রহিব সঙ্গেতে।।পিতৃগৃহে যাইবার সময় এ নয়।হাসিবেক শত্রুগণ, সে দুঃখ না সয়।।দুঃখের সময় তব থাকিব সংহতি।যা হবে তোমার গতি, আমার সে গতি।।তব সঙ্গে থাকি আমি সেবিব ও পদ।আমি সঙ্গে থাকিলে না ঘটিবে আপদ।।গৃহিণী থাকিলে সঙ্গে গৃহস্থ বলায়।উভয়ে যেখানে থাকে, তথা সুখ পায়।।শনির দোষেতে তুমি আমারে ছাড়িবে।চিন্তারে ত্যজিয়া চিন্তা দুঃখ ত পাইবে।।শুনিয়া রাণীর কথা নৃপতি দুঃখিত।আশ্বাস করিয়া এই করিল নিশ্চিত।।শুন ধর্ম্ম অবতার অদ্ভূত বচন।শ্রীবৎস শনির দোষে করিল যেমন।।অর্দ্ধ রাত্রি কালে তবে উঠি নরপতি।রাণীরে করিয়া সঙ্গে যান শীঘ্রগতি।।এইকালে লক্ষ্মীদেবী আসিয়া তথায়।সদয় হইয়া এই বলেন রাজায়।।যথায় থাকিবে, তথা করিব গমন।কায়ার সহিত ছায়া মিলন যেমন।।কিছুকাল দুঃখ তুমি গ্রহেতে পাইবে।পুনর্ব্বার নিজরাজ্যে ঈশ্বর হইবে।।এক্ষণে বিদায় রাজা হইলাম আমি।শুভক্ষণে বনপথে হও অগ্রগামী।।অতিশয় ঘোর রাত্রে যান নররায়।রমণী সহিত কাঁথা করিয়া মাথায়।।গৃহের বাহিরে কভু না যায় যে জন।সেই চিন্তা পদব্রজে করিল গমন।।কণ্টক অঙ্কুর যত ফুটে তাঁর পায়।অতি ক্লেশে পতি সহ দ্রুত গতি যায়।।সঘনে নির্জ্জন বনে প্রবেশ করিল।তার মধ্যে মায়ানদী দেখিতে পাইল।।অকূল সমুদ্র প্রায়, নাহি পারাপার।ভূপতি করেন চিন্তা, কিসে হব পার।।নদীর কুলেতে বসি কাঁদেন দুজন।হায় বিধি মম ভাগ্যে এই কি লিখন।।কর্ণধাররূপে শনি আসিয়া তখন।ভগ্ন নৌকা লয়ে ঘাটে দিল দরশন।।মন্দ মন্দ বাহে তরী, চলে বা না চলে।নৌকা দেখি নরপতি কাণ্ডারীরে বলে।।ত্বরা করি পার করি দেহ হে কাণ্ডারী।বিলম্ব না সহে, দুঃখ সহিতে না পারি।।নাবিক আসিয়া কহে, তুমি কোন জন।রমণী সহিতে রাত্রে কোথায় গমন।।হরিয়া কাহার নারী কোথা নিয়া যাও।পরিচয় দেহ আগে, কূলেতে দাঁড়াও।।রাজা বলে, শুনিয়াছ শ্রীবৎস নৃপতি।সেই আমি, এই মম নারী চিন্তা সতী।।আমার কুদিন হয় দৈবের ঘটনে।নারী সঙ্গে করি তাই আসিয়াছি বনে।।শনি কহিলেন, তবে বুঝেছি বিস্তর।তাল ও বেতাল সিদ্ধ আছিল তোমার।।তারা সবে কোথা গেল বিপত্তি সময়।কোথা গেল মন্ত্রীবর্গ, কহ মহাশয়।।রাজা বলে, ভাই বন্ধু যত পরিবার।বিপত্তি সময়ে সঙ্গী নহে কেহ কার।।অসার সংসার এই মায়া মদে মজে।সকল করয়ে নষ্ট ধর্ম্মপথ ত্যজে।।আমার আমার বলে, কেহ কারো নয়।কস্য মাতা কস্য পিতা শাস্ত্রে এই কয়।।কেবা কার পতি পুত্র, কেবা বন্ধু জন।মায়াবদ্ধ হয়ে প্রাণী করিছে ভ্রমণ।।আপনার রক্ষা হেতু যদি রাখে ধর্ম্ম।আপনার নাশ হেতু, করয়ে কুকর্ম্ম।।আমার সর্ব্বদা হয় ধর্ম্মেতে বাসনা।কায়মনোবাক্যে এই করি হে ভাবনা।।শুনিয়া হাসিয়া শনি কহে পুনর্ব্বার।অতি জীর্ণ ভগ্ন নৌকা, দেখহ আমার।।দুই জন হলে যেতে পারে পরপারে।তিনজন, ক্ষীণতরী, পারে কি না পারে।।আপনি সুবুদ্ধি বট, দেখ বর্ত্তমান।বিবেচনা করি রাজা কর অনুমান।।কান্তারে লইয়া আগে পার হও তুমি।কান্তা যদি লহ, তবে কাঁথা রাখ ভূমি।।শুনিয়া নাবিক বাক্য করেন বিচার।কাঁথা পার করি আগে, শেষে হব পার।।রাজা রাণী দুই জনে ধরিয়া কাঁথায়।যতনে তুলিয়া দেন শনির নৌকায়।।কাঁথা লয়ে সূর্য্যপুত্র বাহিয়া চলিল।দেখিতে দেখিতে মায়ানদী শুখাইল।।শ্রীবৎস নৃপতি খেদে করে হায় হায়।যে সকল দেখিলাম, ভোজবাজী প্রায়।।বুঝিলাম এ সকল শনির চাতুরী।মায়া করি বহু ধন করিলেক চুরি।।দেখিলে সাক্ষাতে রাণী বঞ্চনা শনির।চঞ্চল হৃদয় তাঁর নাহি হয় স্থির।।চিন্তিয়া কহেন রাজা করিব গমন।উঠিতে নাহিক শক্তি, না চলে চরণ।।বহুকষ্টে গমন করিয়া দুই জন।প্রবেশ করেন শেষে চিত্রধ্বজ বন।।হেনকালে সেই স্থানে হইল প্রভাত।পূর্ব্বদিকে সমুদিত দেব দিননাথ।।ক্ষুর্ধাত্ত তৃষ্ণার্ত্ত দোঁহে কাতর হৃদয়।রম্যস্থান দেখি রাণী নৃপতিরে কয়।।চলিতে না পারি নাথ করি নিবেদন।বিশ্রাম করহ এই স্থানে কিছুক্ষণ।।দিব্য জল স্থলে নানা পুষ্প বিকসিত।এই স্থানে স্নান কর, আছ ত ক্ষুধিত।।রমণী কাতরা দেখি ব্যথিত অন্তর।বন হতে ফল মূল আনেন সত্বর।।উভয়ে করিয়া স্নান ইষ্টপূজা করি।কুড়াইয়া আনে বহু সুপক্ক বদরী।।উভয়ে খাইল জল শ্রান্তি হৈল দূর।গমন করিতে শক্তি হইল প্রচুর।।নানাস্থান এড়াইল পর্ব্বত কানন।নদ নদী কত শত বন-উপবন।।তমাল পিয়াল শাল বৃক্ষ নানাজাতি।মল্লিকা মালতী বক চম্পক প্রভৃতি।।বদরী খর্জ্জুর জম্বূ পলাশ রসাল।নারিকেল গুবাক দাড়িম্ব আর তাল।।কদলী বয়ড়া ফল আর আমলকী।কদম্ব অশ্বথ বট নিম্ব হরীতকী।।জারুল পারুল বেল প্রিয়ঙ্গু অগুরু।রক্তসার চন্দন বাদাম দেবদারু।।ইত্যাদি অনেক বৃক্ষে নানা পক্ষিগণ।ব্যাঘ্র্যাদি হিংস্রক কত করিছে ভ্রমণ।।মৃগেন্দ্র গজেন্দ্র উষ্ট্র গণ্ডার কাসর।ঘোটক গোধিকা খর ভল্লুক শূকর।।শত শত পশু দেখে বনের ভিতর।বিকট দশন দেখে অতি ভয়ঙ্কর।।ভূচর খেচর কত, কে করে গণন।দেখিয়া চিন্তিত রাজা অতি ঘোর বন।।মনে মনে বলে, রক্ষা কর লক্ষ্মীপতি।সংসারের সার তুমি, অগতির গতি।।দয়া করি দীননাথ করুণা নিদান।সমূহ সঙ্কটে প্রভু কর পরিত্রাণ।।তোমা বিনা রক্ষা করে, নাহি হেন জন।আমার ভরসামাত্র প্রভুর চরণ।।গোবিন্দ গোপাল গিরিধারী গদাধর।ত্রাণ কর মোরে বড় হয়েছি কাতর।।এইরূপ বলি রাজা স্মরে চক্রপাণি।অকস্মাৎ তথা এই হৈল দৈববাণী।।যত দিন নৃপ তুমি থাকিবে কাননে।থাকিব তোমার সঙ্গে রক্ষার কারণে।।শুনিয়া আনন্দ বড় হইল অন্তরে।বনমধ্যে ভ্রমে সদা নির্ভয় শরীরে।।একদিন বনমধ্যে করে দরশন।মৎস্যঘাতী ধীবর আসিছে কত জন।।ধীবর দেখিয়া রাজা করয়ে যাচন।কিছু মৎস্য দেহ, আজি করিব ভোজন।।জেলে বলে, কুক্ষণেতে ধরি জাল করে।কিছুই না পাইলাম ফিরে যাই ঘরে।।রাজা বলে, শুন সবে আমার বচন।পুনর্ব্বার ফেল জাল, পাইবে এখন।।তাল বেতালের স্মরিলেন শ্রীবৎস।সকলে ফেলিয়া জাল পায় বহু মৎস্য।।চতুর ধীবর জাল করিয়া বিস্তার।পুনর্ব্বার ফেলে জাল করিয়া বিস্তার।।পাইয়া অনেক মীন কৈবর্ত্তের গণ।জানিল, সাধক বটে এই দুই জন।।সাদরে শকুল মৎস্য দিল নৃপতিরে।মৎস্য পেয়ে নৃপবর কহেন রাণীরে।।ক্ষুধার্ত্ত হয়েছি রাণী কাতর জীবন।মীন পোড়াইয়া দেহ, করিব ভোজন।।শুনিয়া কহেন রাণী যে আজ্ঞা তোমার।মীন-পোড়া খেলে হয় শনি প্রতিকার।।ইতিমধ্যে যুধিষ্ঠির করহ শ্রবণ।মায়া করি শনি মৎস্য করিল হরণ।।সবিষাদে চিন্তাদেভী অনল জ্বালিল।যতন পূর্ব্বক সেই মৎস্য পোড়াইল।।মীন দগ্ধ করি চিন্তা, চিন্তা করে মনে।মৎস্য পোড়া রাজহস্তে দিব বা কেমনে।।ক্ষীর ছানা নবনী যে করিত ভোজন।বনে আসি মীনগন্ধ খাবে সেই জন।।কিরূপে এই ছাই খাওয়াব তাঁহারে।শতেক ব্যঞ্জক হয় যাঁহার আহারে।।এতেক চিন্তিয়া চিন্তা মীন লয়ে করে।ধুইয়া আনিব বলি গেল সরোবরে।।জলেই ধুইতে পোড়া মৎস্য পলাইল।ইহা দেখি চিন্তাদেবী কান্দিতে লাগিল।।হাহাকার করি রাণী কান্দে বিনাইয়া।কি বলিবে মহারাজ এ কথা শুনিয়া।।কে দেখেছে কে শুনেছে পোড়া মৎস্য বাঁচে।কি হইবে মম ভাগ্যে, না জানি কি আছে।।শুনিয়া বিশ্বাস নাহি করিবে ভূপতি।একে ত ক্ষুধার্ত্ত রাজা হবে ক্রুদ্ধ মতি।।বলিবেন তুমি মৎস্য করেছ ভক্ষণ।পালাল বলিয়া এবে কর প্রতারণ।।হায় বিধি এত দুঃখ ঘটালে আমায়।এখন রয়েছে প্রাণ, নাহি কেন যায়।।এত ভাবি চিন্তাদেবী কান্দিতে কান্দিতে।সকল বৃত্তান্ত কহে রাজার সাক্ষাতে।।শুনিয়া হাসিয়া রাজা রাণীরে কহিল।এ বড় আশ্চর্য্য কথা শুনিতে হইল।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।১৪. শ্রীবৎসের প্রতি শনির বাক্যঅন্তরীক্ষে থাকি শনি, কহিছে আকাশ বাণী,শুন শুন শ্রীবৎস নৃপতি।আমি ছোট লক্ষ্মী বড়, তুমি কহিয়াছ দড়,তার শাস্তি করিব সম্প্রতি।।সম্পত্তিতে করি গর্ব্ব, আমারে করিলে খর্ব্ব,আমি তব কি করিতে পারি।যেই লজ্জা দিলে মোরে, সেকথা কহিব কারে,শুন দুষ্টমতি মন্দকারী।।পণ্ডিত ধার্ম্মিক জ্ঞানে, আইলাম তব স্থানে,তুমিত করিবে সুবিচার।কপট চাতুরী করি, মম গুণ পরিহরি,তুমি দুঃখ দিয়াছ অপার।।কি কব দুঃখের কথা, স্মরণে মরম-ব্যথা,রহিবেক হৃদয়ে আমার।আসন বলিয়া শ্রেষ্ঠ, লক্ষ্মীরে বলিলে জ্যেষ্ঠ,এবে লক্ষ্মী কোথায় তোমার।।করিয়াছি রাজ্যনাশ, অপর অরণ্যে বাস,শেষে এই স্ত্রী ভেদ করিব।শুন রাজা বলি তোরে, তবেত চিনিবে মোরে,নহে মিথ্যা যে কথা বলিব।।শুন শুন মহারাজ, ধরিয়া বিবিধ সাজ,দেব দৈত্য নাগ আদিগণে।অবধ্য সর্ব্বত্রগামী, সর্ব্বঘটে থাকি আমি,অতিশয় পূজ্য ত্রিভুবনে।।শুন হে শ্রীবৎস ভূপ, ত্রেতাযুগে রামরূপ,হইল প্রভুর অবতার।এক ব্রহ্ম চারি অংশে, জন্মিলেন রঘুবংশে,রাজা দশরথের কুমার।।দশরথ ধর্ম্মাচর, দেন তাঁরে রাজ্যভার,আমি তাঁরে পাঠাই কানন।অনুজ লক্ষ্মণ সাথে, প্রবেশে গহন পথে,জটাবল্ক করিয়া ধারণ।।স্বয়ং লক্ষ্মী সীতা সতী, পতি অনুগতা অতি,শুনহে দুর্গতি যত তাঁর।কাননে পতির সহ, ভুঞ্জিবারে পাপগ্রহ,বনে গেল দীনের আকার।।পর্ব্বত কানন পথে, বঞ্চিয়া স্বামীর সাথে,পরে তাঁরে হরে দশানন।রাজ্য ধন স্বামী ছাড়ি, গেলেন রাবণ-বাড়ী,বাস হৈল অশোক কানন।।আর কিছু বলি শুন, দেবদেব পঞ্চানন,সতী কন্যা অর্দ্ধ অঙ্গ যাঁর।সতী গতে কৃত্তিবাস, দক্ষযজ্ঞ করি নাশ,ছাগমুণ্ড দক্ষের আকার।।সতী দেহত্যাগ করে, জন্মি হিমালয়-ঘরে,সর্ব্বহেতু মম মায়াজাল।আমারে হেলন করি, ইন্দ্র স্বর্গ পরিহরি,দুঃখেতে বঞ্চিল কত কাল।।মম সহ বাদ করি, বৈকুণ্ঠ নিবাসী হরি,কীটরূপ ধারণ করিল।ঘুচিল বৈকুণ্ঠ-লীলা, গণ্ডকী পর্ব্বতে শিলা,দেবমানে বহুকাল ছিল।।বলি দৈত্য অধিপতি, স্বর্গ রসাতল ক্ষিতি,ত্রিভুবন করে অধিকার।হেলন করিল মোরে, পাতালে লইয়া তারে,রাখিলাম বদ্ধ কারাগার।।স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল, সর্ব্বত্র আমার বল,সবে করে আমার পূজন।তোর কাছে অল্প আমি, তুই পৃথিবীর স্বামী,লক্ষ্মী তোর দেখিব কেমন।।এতেক কহিয়া শনি, হইল আকাশগামী,স্বপ্নবৎ শুনিল রাজন।চিন্তিয়া বুঝিল মর্ম্ম, শনির যতেক কর্ম্ম,হল রাজা নিরানন্দ মন।।অরণ্যপর্ব্বের কথা, অতি সুখ মোক্ষ-দাতা,রচিলেন মহামুনি ব্যাস।রচিল পাঁচালি ছন্দে, মনের আবেশানন্দে,কৃষ্ণদাসানুজ কাশীদাস।।১৫. আকাশবাণী শ্রবণে শ্রীবৎসরাজার খেদোক্তিশুনিয়া আকাশ বাণী শনির ভারতী।ডাকিয়া বলিল রাজা চিন্তাদেবী প্রতি।।যতেক কহিল শনি, প্রত্যক্ষ হইল।রাজ্যনাশ বনবাস সর্ব্বনাশ কৈল।।বিবাদ করিয়া যদি দোঁহে না আসিবে।তবে কেন চিন্তাদেবী এমত হইবে।।আমার কুদিন হল বিধির ঘটনা।নৈলে কেন দ্বন্দ্ব করি আসিবে দুজনা।।ভাবিয়া চিন্তিয়া দেবি কি হইবে আর।নিজ কর্ম্মার্জ্জিত পাপ হয় ভুঞ্জিবার।।কারণ করণ কর্ত্তা দেব গদাধর।আমার একান্ত ভার তাঁহার উপর।।ধর্ম্মে বিচলিত মন নহেত আমার।নিজকর্ম্মে দুঃখ পাই, কি দোষ তাঁহার।।চিন্তাযুক্ত হয়ে রাজা বঞ্চেন কানন।ফলমূল আহারেতে করেন যাপন।।ধর্ম্মচিন্তা করে রাজা, স্মরে বিধাতায়।এইরূপে পঞ্চ বর্ষ নানা দুঃখ পায়।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon