নরকাসুর বধ ও ষোল হাজার রাজকন্যা উদ্ধার

কে এ নরকাসুর? তিনি পৃথিবীর পুত্র। মহাভারত ও বিষ্ণুপুরাণে আছে তিনি ছলনা করে বরুণের ছত্র বলপূর্বক হরণ করেছিল, দেবজননী অদিতির কুন্ডলদ্বয় হরণ করেছিল। দেবতাদের ক্রীড়াভূমি মণিপর্বত নামক অমরগিরি মন্দরাচলের শৃঙ্গদেশ অধিকার করে সেখান হতে দেবতাদের বিতাড়িত করেছিলেন। তিনি একবার হাতির রূপ পরিগ্রহ করে বিশ্বকর্মা কন্যার সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। তিনি গন্ধর্ব, মানুষ ও দেবতাদের কন্যাদের বলপূর্বক হরণ করে তার প্রাসাদে বন্ধী করে রাখেন। এদের সংখ্যা প্রায় ষোল হাজার।
সংক্ষেপে কাহিনী:
নরকাসুরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইন্দ্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্মরণাপন্ন হন। তখন শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামাসহ গরুড় উপর চড়ে ভৌমের রাজধানী প্রাগজ্যোতিষপুরে যাত্রা করলেন। ভৌমের পুরীতে প্রবেশ করা সাধারণের পক্ষে দুষ্কর। কারণ ঐ পুরী বহু অভেদ্য পর্বত ও দূর্গ দ্ধারা এবং মুর নামক এক ভয়ঙ্কর দৈত্য দ্ধারা সুরক্ষিত ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গদা দ্ধারা গিরি দূর্গকে, বাণ দ্ধারা অস্ত্র দূর্গকে, চক্র দ্ধারা অগ্নি দূর্গকে এবং খড়গ দ্ধারা জল বায়ু মুরপাশ দূর্গকে ভেদ করলেন। পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদ দ্ধারা এবং গুরুতর গদার আঘাতে পুরীর প্রাচীর সকল ভেদ করলেন। পাঞ্চজন্য শঙ্খের ভয়ঙ্কর শব্দ শ্রবণ করে মুর দানব জল হতে উঠে সসৈন্যে ভীষণ বেগে দুই বাহু উত্তোলন করে শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমন করল। শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দ্ধারা মুরের মস্তক কর্তন করল। তখন মুরের সপ্ত পুত্র নরকাসুরের আদেশে শ্রীকৃষ্ণকে প্রবল বেগে আক্রমন করল। শ্রীকৃষ্ণে বাণের আঘাতে মুর তনয় সকলেই নিহত হলো। নরকের সেনা ও সেনাপতিগণ শ্রীকৃষ্ণের বাণের আঘাতে এভাবে নিহত হলে নরক অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি সমুদ্রজাত মদস্রাবী হস্তীতে চড়ে শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমন করে তার প্রতি শতঘ্নী অস্ত্র নিক্ষেপ করল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিরত বাণ বর্ষণে ভৌমের সেনাদের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তখন একা নরকাসুর যুদ্ধ করতে লাগল। গরুড়ের প্রবল আক্রমনে নিজ সৈনগণের মৃত্যু ও যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন হতে দেখে বিষন্ন হলেন। তারপর গরুড়ের প্রতি শক্তি নিক্ষেপ করলেন। কিন্তিু এতে গরুড়ের কিছুই হলো না। তা দেখে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শূল নিক্ষেপ করল। কিন্তু শূল নিক্ষেপের পূর্বেই অচ্যুত ক্ষুরধার চক্র নিক্ষেপ করে নরকের শিরচ্ছেদ করলেন। তার মস্তক ভূতলে পতিত হলো। দেবগণ পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন। নরক মাতা পৃথিবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনেক স্তবস্তুতি করে ইন্দ্রজননীর কুন্ডলদ্ধয় ও বরুণের ছত্র শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রদান করলেন এবং নরকপুত্র ভগদত্তের প্রতি তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকের পুরীর মধ্যে প্রবেশ করে অন্ত:পুরে অবরুদ্ধ ষোড়শ সহস্র রাজকন্যাদের কে দেখতে পেলেন। ললনাগণ শ্রীকৃষ্ণকে দেখামাত্রই মুগ্ধ হলেন এবং সেই পুরুষবরকেই দৈব-প্রেরিত অভীষ্ট পতি মনে করে মনে মনে তাকেই পতিত্বে বরণ করল। প্রত্যেক রাজকন্যাই তাকে পাওয়ার আশায় পৃথক পৃথকভাবে প্রার্থনা করে নিজেকে সমর্পন করল। নিজানন্দে পরিপূর্ণ ভগবান সেই স্ত্রীগণের প্রাসাদের অবস্থান করে সাধারণের ন্যায় গৃহস্থধর্ম পালন করে তাদের সহিত রমন করতে লাগলেন। ব্রহ্মাদি দেবতা যারা তার অবস্থানও জানতে পারে না, সে সকল ললণাগণ রমা পতিকে এ প্রকারে পতিরূপে পেয়ে অনুরাগের সহিত হাস্য, অবলোকন, নব সঙ্গম, ও জল্পনা বিষয়ে লজ্জিত হয়ে অবিশ্রান্তভাবে ভজনা করতে লাগল। শত শত দাস দাসী থাকা সত্ত্বেও সে সকল স্ত্রীগণ নিজ হাতে অচ্যুতের পদসেবা করতে লাগলেন। মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: এ কাহিনী পঠন করে নিশ্চয় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে ষোল হাজার নারীকে শ্রীকৃষ্ণ একসাথে কেন বিবাহ করলেন? কোন ব্যক্তির পক্ষে কি তা সম্ভব? আপতত: দৃষ্টিতে মনে হয় যেন তা সম্ভব নয়। কার জন্য সম্ভব নয়, নিশ্চয় কোন মানবের পক্ষে সম্ভব নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে সম্ভব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ। তিনি পরম পুরুষ, পরম ধাম। তিনিই সৃষ্টি, তিনিই স্থিতি, তিনিই প্রলয়। সত্ত্ব, তম: ও রজ: তার থেকে সৃষ্টি কিন্তু তিনি এ সৃষ্টির অন্তর্গত নন। জড় ও চেতন শক্তি তার থেকে উৎপন্ন। তিনিই একমাত্র জ্ঞাতব্য। তিনিই সমস্ত জীবের ধারক। তিনি সমস্ত জীব সর্ম্পকে জানেন, কিন্তু আমার তাকে কেও জানিনা। তিনি পরমাত্মা রূপে সকল প্রাণিতে বিরাজ করেন। তিনি বিভূচৈতন্য। তিনি অনাদি, তিনি অব্যয়, তিনি জগন্নিবাস, তিনি ভূতভাবন, তিনি ভূতেশ। তিনিই অনাদি রাধির গোবিন্দ, তিনিই সর্বকারণের কারণ, তিনিই সচ্চিদানন্দময়। তিনিই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ কথা অসিত, দেবল, আদি মুনি ঋষিরা পুরাণ, উপনিষৎ ইত্যাদি গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেই তার পক্ষেই সম্ভব। কোন মানুষের পক্ষে ষোল হাজার নারীকে বিবাহ করা সম্ভব নয়। ষোল হাজার নারী নরকের দ্ধারা হরণ হয়ে তার প্রাসাদে অন্তরীন ছিল। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় হয়তো এ সকল নারীকে কেহ বিবাহ করতে রাজী নাও হতে পারত। সমাজে তাদেরকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য তিনি তাদেরকে বিবাহ করেন। লোক-লজ্জার ভয় হতে তাদেরকে উদ্ধার করেন। এতে শ্রীকৃষ্ণের মহানুভবতার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। আসলে প্রাকৃত স্তরে অবস্থান করে অপ্রাকৃত স্তরের বিষয় চিন্তা করা খুবই দূরুহ বিষয়। কিন্তু আমরা যারা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী তাদেরকে গোবিন্দর লীলা মানতেই হবে। কারণ তিনি যে লীলাপুরুষোত্তম।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র