চন্দ্রবংশ

চন্দ্রবংশ : চন্দ্র থেকে উদ্ভুত বলে এর নাম  চন্দ্রবংশ। চন্দ্রবংশ যাদব ও পৌরব নামে দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম বংশ যদু থেকে এবং দ্বিতীয় বংশ পুরু থেকে উদ্ভূত। কৃষ্ণ যদুবংশোদ্ভূত এবং কুরুপান্ডব পুরুবংশোদ্ভূত। চন্দ্র ব্রহ্মার মানস পুত্র অত্রিমুনির সন্তান। চন্দ্র জন্মের পরই ত্রিচক্র রথে চড়ে পৃথিবী পরিক্রমা ও আলোকদান করতে থাকেন। তিনি দক্ষপ্রজাপতির কন্যা ভরণী, কৃত্তিকা, আর্দ্রা, অশ্লেষা, মঘা, উত্তরফাল্গুনী, বিশাখা, উত্তরাষাঢা, রোহিনী নামে সাতাশজন কন্যাকে বিবাহ করেন। তাদের মধ্যে চন্দ্র রোহিনীকে সর্বাপেক্ষা বেশী ভালবাসতেন। কিন্তু তার ফলে অন্যান্য স্ত্রীগণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে দক্ষপ্রজাপতরি কাছে অভিযোগ করেন। কিন্ত দক্ষপ্রজাপতি জামাতাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে অভিশাপ দেন যে, চন্দ্র পুত্রকন্যাহীন হবে এবং যক্ষ্মারোগগ্রস্ত হবে। কন্যারা ভীত হয়ে তার অভিশাপ প্রত্যাহারের জন্য প্রার্থনা করলে দক্ষপ্রজাপতি শাপ দেন যে যক্ষ্মারোগে চন্দ্র মাসের মধ্যে এক পক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত হবেন ও  অন্য পক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবেন। এ দুই পক্ষই কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ নামে প্রসিদ্ধ  (কালিকাপুরান)। চন্দ্রের পুত্রের নাম বুধ। তার মাতার নাম ইলা (বৈবস্বত মনুর কন্যা)। একদিন চন্দ্র  দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার রুপ দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে অপহরণ করেন। তখন বৃহস্পতি চন্দ্রের এ কুকীর্তি দেবতাদের অবহিত করেন। দেবতার ও ঋষিরা বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য চন্দ্রকে অনুরোধ করেন। কিন্তু চন্দ্র তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করলে রুদ্রদেব বৃহস্পতির পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। তখন ব্রহ্মা শংকিত হয়ে আসন্ন বিপদ অনুধাবন করে রুদ্রদেবকে নিবৃত্ত করেন এবং তারাকে চন্দ্রের কাছ থেকে উদ্ধার করে বৃহস্পতির নিকট প্রত্যার্পণ করেন। যে সময় তারা বৃহস্পতির নিকট আসেন তখন সে অন্ত:সত্ত্বা ছিল। বৃহস্পতি তাকে গর্ভমোচন করে তার কাছে আসতে আদেশ দেন। তখন তারা শরস্তম্ভে গর্ভ ত্যাগ করেন। সে গর্ভ থেকে একটি সুন্দর পুত্রের জন্ম হয়। ব্রহ্ম তারাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন এটি চন্দ্রের পুত্র। তখন ব্রহ্মা এ  পুত্রকে গ্রহণ করে এর নাম দেন বুধ এবং ব্রহ্মা তাকে গ্রহাধিপত্যে স্থাপন করেন। বুধের পুত্রের নাম পুরূরবা। তার স্ত্রীর নাম উর্বশী। একদিন ইন্দ্রসভায় রাজা পুরূরবার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হলে উর্বশী’র নৃত্যে তাল ভঙ্গ হয়। এতে ইন্দ্র উর্বশীর প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণের অভিশাপ দেন। উর্বশী মর্ত্যলোকে এসে পুরূরবার স্ত্রী হন। পুরূরবা ও উর্বশীর সাত পুত্র। আয়ু, অমাবসু, বিশ্বায়ু, স্রুতায়ু, দৃঢ়ায়ু, বলায়ু ও শতায়ু। আয়ু চন্দ্রবংশের রাজা হন। তিনি রাজকন্যা প্রভাকে বিবাহ করেন। তাদের নহুষসহ পাঁচপুত্র হয়। নহুষ  চন্দ্রবংশের রাজা হন। তিনি খুবই পুণ্যবান  ও বীর্যশালী রাজা ছিলেন এবং সাধনার দ্বারা তিনি নিজেকে আত্মসংযমী করেন। রাজা হয়েও তার  কোন ভোগ বিলাশ ছিল না। তিনি ভোগ  বিলাশ ত্যাগ করে পূণ্যকর্মে এমনভাবে নিয়োজিত হন যে একবার হঠাৎ করে গোবধ করে মহাপাপ করেও ঋষিগণের কৃপায় পাপ হতে মুক্তি পান। ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যা ও বৃত্তাসুরকে হত্যা করে শ্রান্ত ও অচেতন হয়ে  তিনি জলমধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছিলেন। ফলে দেবতারা ও মহর্ষিরা নহুষকে স্বর্গের দেবরাজ করে দেন। দেবরাজ হয়ে তিনি কামপরায়ণ হয়ে উঠেন এবং অগস্ত্যের মাথায় পা স্পর্শ  করার ফলে মুনির অভিশাপে তিনি অজগর সর্প হয়ে বিশাখযুপ বনে পতিত হন। নহুষেয় প্রার্থনায় মুনি বলেন যে, যুধিষ্ঠির তাকে স্পর্শ করলে সে শাপমুক্ত হবে। নহুষের ছয় পুত্রের যযাতি জ্যৈষ্ঠ পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর যযাতি চন্দ্রবংশের রাজা হন। তার দুই স্ত্রী  দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা। দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা আর শর্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বিষপর্বার কন্যা। দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্বসু নামে দুই পুত্রের জন্ম হয় এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্য, অনু  ও পুরু নামে তিন পুত্রের জন্ম হয়। শুক্রাচার্যের অগোচরে শর্মিষ্ঠাকে গ্রহণ করায় শুক্রাচার্যের অভিশাপে যযাতি জরাগ্রস্ত প্রাপ্ত হন। তখন যযাতির অনুরোধে শুক্রাচার্য বলেন যে, যদি অন্য কে  ইচ্ছায় যযাতির জরাগ্রস্ত গ্রহণ করে তবেই সে নিজের জরাগ্রস্ত সংক্রামিত করে নিজে শাপ মুক্ত হতে পারবে এবং তাকে রাজ্যভার অর্পণ করবে। তখন যযাতি একে একে সকল পুত্রকে তার জরা গ্রহণ করতে বললে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র পুরু তার পিতার জরাগ্রস্ত গ্রহণ করতে সম্মত হন। যযাতি তখন তার জরাগ্রস্ত পুরুরে দেহে সংক্রামিত করেন। এভাবে পুরু অনেক বৎসর যৌবন-তৃষ্ণা উপভোগ করে পুনরায় যযাতি নিজে তার পুত্রের জরাগ্রস্থ গ্রহণ করেন। পিতৃআজ্ঞা পালন করায় যযাতি পুরুকে রাজা করেন। পুরুর তিন পুত্র-প্রবীর, ঈশ্বর ও রৌদ্রাশ্ব। পুরু ও তার ভ্রাতা যদু ও চন্দ্রবংশের দুই শাখার প্রতিষ্ঠাতা। পুরু বংশধরদের পৌরব বলা হয়। এ  পৌরব বংশ হতে কৌরব ও পান্ডব বংশের সৃষ্টি। যযাতির মৃত্যুর পর পুরু চন্দ্রবংশের রাজা হন। প্রবীরের হাতে তিনি রাজ্যভার অর্পণ করেন। প্রবীর শূরসেনী নামে কন্যাকে বিবাহ করেন। তার পুত্র মনস্যু চন্দ্রবংশের রাজা হন। রাজা মনস্যুর তিন পুত্র। তাদের মধ্যে রাজা হন সংহনন। সংহনন এর দশ পুত্র। রাজা হলেন মতিনা। মতিনার চার পুত্র। রাজা হল তংসু। তংসুর চার পুত্র। ঈনিল তার মহাতেজা পুত্র। তার পঞ্চ পুত্র হলো রাজা দুষ্মন্ত। দুষ্মন্তের পুত্রের নাম রাজা ভরত। মুনিবরের উপদেশামৃত স্মারণ করেই তিনি তার পালিত পুত্র ভরদ্বাজ ভূমন্যু কে যুবরাজ অভিষিক্ত করেন। তার পুত্রের নাম সুহোত্র। তিনি রাজা হলেন। সুহোত্রের পুত্রের নাম হস্তী। তার নামানুসারে রাজ্যের নাম  হয় হস্তীনাপুর। হস্তীর তিন পুত্র। অজমীড়, দ্বিমীড় ও পুরুমীড়। অজমীড়ের পুত্রের নাম হয় সংবরণ। তিনি রাজা হন। সূর্যকন্যা তপতীকে বিবাহ করেন। তাদের পুত্রের নাম কুরু।  কুরু অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ রাজা  ছিলেন। কুরুর পাঁচ পুত্র। অবিক্ষিত, অবিষ্যৎ, চৈত্ররথ, মুনি ও জন্মেজয়। জন্মেজয়ের পুত্র ধৃতরাষ্ট রাজা হলেন। ধৃতরাষ্টের পুত্র প্রতীপ।প্রতীপের তিন পুত্র। দেবাপি, শান্তুনু আর বাহ্লীক। শান্তুনু হস্তীনাপুরের রাজা হলেন। রাজা শান্তুনু দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী গঙ্গাদেবী ও দ্বিতীয় স্ত্রী সত্যবতী। প্রথম স্ত্রী সন্তান দেবব্রত (ভীষ্ম) ও দ্বিতীয় স্ত্রীর সত্যবতীর দুই সন্তান বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ। যুদ্ধে গন্ধর্বের হাতে অকাল মৃত্যু হয়ি। বিচিত্রবীর্য রাজা হয়। সন্তান জন্ম দেয়ার পূর্বেই বিচিত্রবীর্য মৃত্যু বরণ করেন। তখন পুরুবংশ রক্ষার প্রয়োজনে রাজ মাতা সত্যবতীর নির্দেশে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যসদেব অম্বিকা, অম্বালিকা ও এক দাসী গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুর নামে ক্ষেত্রজ (তখনকার সময় কোন রাজার পুত্র সন্তান না হলে বা পুত্র সন্তান হওয়ার পূর্বেই যদি রাজা মৃত্যুবরণ করেন তাহলে পুত্র সন্তানের জন্য রাজার ভাই বা ব্রাহ্মণের দ্বারা উপৎপাদিত সন্তানকেই ক্ষেত্রজ সন্তান বলা হয়। উৎপাদন করেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মন্ধ হওয় পান্ডু হস্তীনাপুরের রাজা হন। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী। তার শতপুত্র। পান্ডুর দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রী। কুন্তির পুত্র যুধিষ্ঠির,  ভীম ও অর্জুন। আর মাদ্রীর পুত্র নকুল ও সহদেব। অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্রের নাম অভিমুন্যু। অভিমন্যুর পুত্রের নাম রাজা পরীক্ষিত। পরীক্ষিতের পুত্রের নাম রাজা জন্মমেজয়। তার দুই পুত্র শতানীক ও শঙ্কু। শতানীকের পুত্রের নাম অশ্বমেধদত্ত। এ হচ্ছে পুরুবংশের বিবরণ। এখানে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, ত্রেতাযুগে যেমন সূর্যবংশের পরিচয় রামায়ণে লিপিবদ্ধ আছে তেমনি দ্বাপর যোগের চন্দ্রবংশের বংশ পরিচয়ও মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে। এ দুই গ্রন্থ ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থ যেমন- মহাভারত, ভাগবত, অগ্নিপুরাণ, গরুড়পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের বংশ পরম্পরা বিবৃত আছে। তবে এসব গ্রন্থে সূর্যবংশে ও চন্দ্রবংশে বংশ পরম্পরায় অনেক গড়মিল পরিলক্ষিত হয়। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে এ সকল বংশে হাজার হাজার মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের নাম বংশানুক্রমে লিপিবদ্ধ করা অত্যন্ত দূষ্কর ব্যাপার। যার ফলে পুরাণসমূহের মধ্যে এ রকম মতভেদ দৃষ্ট হয়। তবে লিপিকারদের ভুলের কারণে হতে পারে।  
(সূত্র: পৌরাণিক ভাষা, বিষ্ণুপুরাণ, পৃথিবীর ইতিহাস)         

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র