শ্রীকৃষ্ণ সভায় নারদের আগমন এবং উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের প্রশ্ন

ঊষালগ্নে কুক্কুটগণ উচ্চরবে ডেকে উঠল। কৃষ্ণপত্নিগণ বিরহে ভয়ে কাতর হলো এবং কুক্কুটগণকে অভিসম্পাত করতে লাগল। পারিজাত বনের মধুর গন্ধবহের আমোদে অলিকুল গান করতে লাগলে বনস্থ পক্ষীকুল জাগরিত হলো এবং তারা বন্ধিগণের ন্যায় নিদ্রিত শ্রীকৃষ্ণকে নিদ্রাভঙ্গ করার জন্যউচ্চস্বরে রব করতে লাগল। ঐ রব অতি মধুর হলেও কৃষ্ণকন্ঠলগ্না বিদর্ভ-রাজনন্দিনী প্রভৃতি কৃষ্ণপ্রিয়াগণ এ ব্রহ্মমুর্হুকেও সহ্য করতে পারছিলেন না।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাধব ব্রহ্মমুর্হুতে শয্যাত্যাগ করে বারি দ্বারা মুখ প্রক্ষালণ ও গাত্র মার্জনাদি করে ইন্দ্রিয়বর্গ ও দেহাদির প্রসন্নতা সাধনে নিদ্রাজনিত জড়তা নিবারণ করলেন। বিশ্বের উৎপত্তি-বিনাশের হেতুভুত শক্তিসমূহ হতেই যার সত্তার ও আনন্দ-স্বরূপের উপলদ্ধি হয়, সে ব্রহ্মনামা পুরূষকে ধ্যান করতেন। তারপর স্নান সমাপন করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করে তর্পনাদি সমাপনান্তে গায়ত্রী জপ করতেন এবং সূর্যোদয়ে সূর্যের উপাসনা, পিতৃলোকের তর্পন, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণগণের অর্চনা করতেন। স্বর্ণমন্ডিত শৃঙ্গযুক্ত দুগ্ধবতী বহু গাভী ব্রাহ্মণগণকে দান করতেন। অত:পর ঘৃত, দর্পণ, গো, বৃষ, ব্রাহ্মণ, দেবতা সকলকে অবলোকন করে পুরবাসী ও অন্তপুরবাসী এবং প্রজাগণকে অভিলষিত অর্থাদি দান করতেন। তারপর মাল্য-অনুলেপনাদি-চর্চ্চিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকি ও উদ্ধবকে সাথে নিয়ে দিব্য রথে আরোহন করে সুধর্মা নামক সভাগৃহে প্রবেশ করতেন। সেখানে বৃষ্ণীবংশীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ শ্রীকৃষ্ণকে পরিবেষ্ঠিত হয়ে উপবেশন করতেন। যারা ঐ সভায় প্রবেশ করেন তাদের ষড় রিপু বিনাশ হয়। নরশ্রেষ্ঠ যদুগণে পরিবৃত হয়ে বাসুদেব যখন সভামধ্যস্থ শ্রেষ্ঠ আসনে উপবেশন করতেন তখন তারকাগেণে পরিবেষ্ঠিত নভোমন্ডস্থ নিশানাথের ন্যায় তিনি স্বীয় জ্যোতিতে যেন দশ দিক আলোকিত করে বিরাজ করতেন। সে সভায় পরিহাসকারী বিভিন্ন হাস্যরস দ্বারা এবং নাট্যচার্য ও নর্তকীসকল স্বীয় স্বীয় নৃত্য দ্বারা তার উপাসনা করতেন। সূতগণ, মাগধগণ এবং বন্দিগণ মৃদঙ্গ বীণা মুরজ বেণু প্রভৃতি তাল ও শঙ্খধ্বনি সহকারে নৃত্যগীত ও স্তব করতেন। সভাস্থলে সমবেত ব্রাহ্মণগণ বেদমন্ত্র সমূহ ব্যাখ্যা করতেন এবং কোন কোন ব্রাহ্মণেরা পূণ্যযশা পূর্বের রাজাগণের যশোযুক্ত কথা বলতেন। এ সময়ে প্রতিহারিগণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সংবাদ দিলেন যে, এক অপূর্বদর্শন ব্রাহ্মণ সভাদ্বারে উপনীত হয়েছেন, তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাত প্রার্থী। শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি পেয়ে ঐ নবাগত ব্রাহ্মণ সভাস্থলে প্রবেশ করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার করে কৃতঞ্জলিপুটে জরাসন্ধ কর্তৃক গিরিব্রজ দূর্গে আবদ্ধ বিশ সহস্র রাজার দু:খ দুর্দশার কথা বর্ণনা করলেন। কারণ এ সকল রাজারা জরাসন্ধের দ্বিগিজয়কালে বশ্যতা স্বীকার করেনি। যখন রাজাদের হয়ে ব্রাহ্মণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট তাদের মুক্তির জন্য আকুতি নিবেদন করছেন ঠিক তখন পিঙ্গলবর্ণ জটাভারধারী পরমদ্যুতি দেবর্ষি নারদ জাজ্বল্যমান সূর্য্যের ন্যায় আবির্ভূত হলেন। তাকে দেখে সর্ব লোকমহেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উঠে দাড়িয়ে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করলেন এবং মধুর বচনে বললেন,“ হে দেবর্ষে! অদ্য ত্রৈলোক্যের ভয় দূর হলো, বিশেষত: আপনার দর্শনে আমাদের বিশেষ লাভ হলো, কারণ আপনি সকল লোকই বিচরণ করে থাকেন; সুতরাং আপনার নিকট আমরা ত্রিভূবনের সকল বার্তা শ্রবণ করতে পারি। ঈশ্বর সৃষ্ট এ ভূবনের মধ্যে আপনার কিছুই অবিদিত নেই; অতএব, বলুন দেখি! এক্ষণে পান্ডবেরা কি কর্ম করছে, তা সবিস্তারে বুলুন।” তখন নারদ বললেন,! “হে প্রভু! বিশ্বস্রষ্টা স্বয়ং কমলযোনি ব্রহ্মাকেও যে আপনি আপনার মায়া দ্বারা বিমোহিত করেছেন তা আমি দর্শন করেছি; তাই এরূপ প্রশ্নে আমার আর আশ্চর্য বোধ হয় না। এ জগৎ বাস্তবিক অবিদ্যমান হলেও আপনারই মায়াবলে তা বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়; আপনি নিজ মায়াগুণে ইহা সৃষ্টি ও ধ্বংস করছেন। মানুষের কি সাধ্য আপনার এ লীলা উপলব্ধি করতে পারে। সেই অচিন্তস্বরূপ আপনাকে নমস্কার করি। জন্ম-মৃত্যু থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে সংসার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। আপনি স্বয়ং উদযোগী হয়ে বিবিধ অবতার রূপ গ্রহণে করে যশোময় কার্য করে, তার সেই উজ্জ্বল আলোকে অজ্ঞানান্ধ জীবের অজ্ঞানন্ধাকার দূরীভূত করছেন। তাই আমাদের একমাত্র কতর্ব্য আপনার শরণাগত হওয়া। আপনি সাক্ষাত ব্রহ্ম হয়েও নরলোকের অনুকরণ করেছেন; অতএব আপনার ভক্ত পিতৃষ্বসের এবং ভক্তদের রাজকার্য শ্রবণ করুন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আপনার তৃপ্তিকামনায় শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ রাজসূয় যজ্ঞ দ্বারা আপনার অর্চনা করবেন, আপনি তা অনুমোদন করুন। সে শ্রেষ্ঠ যজ্ঞে দেবতারা এবং যশস্বী রাজারাও আপনাকে দর্শন করবার জন্য আসবেন। যখন চন্ডালাদিরা আপনার নাম ও কর্ম শ্রবণ, কীর্তন ও ধ্যান করে পবিত্র হয়, তখন যারা আপনাকে দর্শন ও স্পর্শ করেন তারা যে পবিত্র হবেন, তাতে আর সন্দেহ কি? হে ভুবন-মঙ্গল! আপনার নির্মল যশরাশি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের দশ দিক আলোকিত করে পরিব্যপ্ত রয়েছে এবং আপনা চরণ নি:সৃত বারি স্বর্গে মন্দাকিনী নামে, পাতালে ভোগবতী নামে এবং মর্ত্যধামে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে এ ত্রিলোককে পবিত্র করছে।” নারদ যে সকল কথা বলেছিলেন তাতে জরাসন্ধকে জয় করার কথাও ছিল কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের পক্ষীয় যাদবগণ জরাসন্ধের জয় বিষয়ে মনোযোগী ছিলেন না। তাই শ্রীকৃষ্ণ যেন কিছুই উপলদ্ধি করতে পারেননি এরূপ ভাব প্রকাশ করে হাস্যচ্ছলে বাক্য কৌশলে উদ্ধবকে বলতে লাগলেন “হে উদ্ধব! তুমি আমাদের বন্ধু, পরামর্শদাতা এবং চক্ষুর ন্যায় পথ-প্রদর্শক; তোমার কথায় আমি শ্রদ্ধাবান। অতএব এ বিষয়ে যা কর্তব্য স্থির করবে আমরা তাই করব। সর্বজ্ঞ ও জগৎপতি শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক এরূপ অজ্ঞের ন্যায় মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করলে উদ্ধব তাঁর আজ্ঞা শিরোধার্য করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অভিপ্রায় যথাযথ অনুধাবন করে বলতে লাগলেন- “হে দেব! আপনার পিতৃষ্বসা কুন্তির নন্দন রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন; তৎ বিষয়ে দেবর্ষি নারদ আপনাকে যা সহায্য করার কথা বলেছেন তা আপনার করা অবশ্যই কর্তব্য। অন্যদিকে শরণপ্রার্থী রাজাগণের রক্ষা করাও আপনার কর্তব্য। হে বিভো!আমার মতে যুধিষ্ঠির যদি দিগ্বিজয়ী হয়ে রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে পারেন; তাহলে উভয় কার্যই সমাধান হয়। একটা রাজসূয় যজ্ঞ অন্যটি রাজাগণের উদ্ধার। রাজাগণকে বন্ধনমুক্ত করতে পারলে আপনারও যশোবিস্তার হবে।”
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র