মহাভারত:বনপর্ব-০৫৬-০৬০

৫৬. যুধিষ্ঠিরের নিকট মহর্ষি নারদের
আগমন ও তীর্থস্নানের আগমন
ও র্তীর্থস্নানের ফল বর্ণন
এইমতে রোদন করয়ে ভ্রাতৃগণ।
শোকাকুল অধোমুখ ধর্ম্মের নন্দন।।
হেনকালে নারদ করেন আগমন।
আশীর্ব্বাদ করি বৈসে মহা তপোধন।।
নারদেরে যুধিষ্ঠির কহেন বিনয়।
কহ মুনিবর মম খণ্ডুক বিস্ময়।।
তীর্থস্নান করি ক্ষিতি প্রদক্ষিণ করে।
কোন ফল লভে নর, কহ তা আমারে।।
নারদ কহেন, পূর্ব্বে ভীষ্ম সত্যব্রত।
পৌলস্ত্যের কহিল যাহা তব পিতামহে।।
সে সকল কহি শুন, অন্যমত নহে।
যার হস্ত পদ মন সদা পরিষ্কৃত।
বিদ্যা কীর্ত্তি তপস্যাতে যেই হয় রত।।
প্রতিগ্রহ নাহি করেম সর্ব্বদা সানন্দ।
অহঙ্কার নাহি যার, নহে ক্রোধে অন্ধ।।
অল্পাহরী জিতেন্দ্রিয় সত্য ব্রতাচার।
আত্মতুল্য সর্ব্বপ্রাণী দৃষ্টিতে যাহার।।
ঈদৃশ হইলে সেই তীর্থফল পায়।
পদে পদে যজ্ঞফল ত্যজি তীর্থে যায়।।
দরিদ্রের শক্য নাহি হয় যজ্ঞকর্ম্ম।
যজ্ঞাপেক্ষা তীর্থস্নানে লভে অতি ধর্ম্ম।।
দৃঢ়ভক্তি তিন রাত্রি তীর্থে যদি থাকে।
সর্ব্ব যজ্ঞফল পায়, যায় ইন্দ্রলোকে।।
পুষ্কর নামেতে তীর্থে যদি করে স্নান।
সর্ব্বপাপে মুক্ত সেই দেবতা সমান।।
একগুণ দানে কোটিগুণ ফল লাভে।
অমর কিন্নর দৈত্য সেই তীর্থ সেবে।।
দশ কোটি তীর্থ আছে পৃথিবী ভিতর।
নৈমিষকানন পরে চম্পানদীবর।।
তদন্তরে দ্বারাবতী যায় যেই জন।
দশকোটি যজ্ঞফল পায় সেইক্ষণ।।
তদন্তরে যায় গঙ্গা সাগরসঙ্গম।
তাহে স্নানে কোন কালে নাহি দণ্ডে যম।।
শঙ্কুকর্ণেশ্বর দেবে কৈলে দরশন।
দশ অশ্বমেধ ফল পায় সেইক্ষণ।।
কামাখ্যা নামেতে তীর্থে যদি করে স্নান।
সিদ্ধিপদ পায় আর জন্মে দিব্যজ্ঞান।।
তদন্তরে কুরুক্ষেত্রে যায় যেই জন।
যাহার নামেতে সর্ব্বপাপ বিমোচন।।
বায়ুতে ক্ষেত্রের ‍ধূলি যদি লাগে গায়।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয়ে সুরপুরে যায়।।
স্নানে ব্রহ্মলোকে যায়, নাহিক সংশয়।
সরস্বতী স্নানেতে নিষ্পাপ অঙ্গ হয়।।
গোকর্ণে করিয়া স্নান দেখে নারায়ণ।
সদাকাল নিবসয়ে বৈকুন্ঠ ভুবন।।
বাচা নামে তীর্থ যথা জন্মিল বরাহ।
স্নান কৈলে মুক্ত হয়, পাপশূন্য দেহ।।
রামহ্রদ নামে মহাতীর্থ গুণধর।
যাহাতে করিলে স্নান হয় পুণ্যবর।।
পূর্ব্বেতে পরশুরাম মারি ক্ষত্রগণ।
ক্ষত্রিয় রক্তেতে সেই করিল তর্পণ।।
তুষ্ট হয়ে পিতৃগণ তারে দিল বর।
পুণ্যতীর্থ হৌক যে বলিল ভৃগুবর।।
ইথে যে করিবে পিতৃলোকের তর্পণ।
ব্রহ্মলোকে বসিবে তাহার পিতৃগণ।।
কপিল নামেতে তীর্থ তাহার অন্তর।
সরযূর স্নানে সূর্য্যলোকে যার নর।।
স্বর্গদ্বার আদি করি যত তীর্থ সার।
সপ্তঋষ্যাশ্রম মহাসরযূ কেদার।।
গোদাবরী বৈতরণী নর্ম্মদা কাবেরী।
জাহ্নবী যমুনা জয়া জয়া সর্ব্বদাতা বারি।।
অশ্বমেধ বাজপেয় রাজসূয় আদি।
যত যত যজ্ঞ বেদে করিয়াছে বিধি।।
সর্ব্ব যজ্ঞফল লভে তীর্থগণ স্নানে।
সর্ব্বপাপ ধৌত হয়, বৈসে দেবাসনে।।
এত বলি চলিল নারদ তপোধন।
তীর্থযাত্রা ইচ্ছিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাহার শকতি ইহা বর্ণিবারে পারি।।
কহে কাশীরাম, প্রভু নীলশৈলারূঢ়।
দক্ষিণে অনুজাগ্রজ সম্মুখে গরুড়।।
৫৭. শ্রীতীর্থক্ষেত্র মাহাত্ম্য
বামে সিন্ধুতনয়া নিকটে সুদর্শন।
জলদ অঙ্গেতে শোভে তড়িত বসন।।
বদন নয়ন শোভে জগমন ফাঁদ।
নির্ম্মল গগনে যেন শোভে পূর্ণচাঁদ।।
যে মুখ দেখিলে মুক্তি আঁখির নিমিষে।
সেইক্ষণে মুক্ত হয় জন্ম কর্ম্মপাশে।।
জন্মে জন্মে তপব্রতে ক্লেশ করে কায়।
ক্ষিতি প্রদক্ষিণ করে, সব্বতীর্থে যায়।।
যাহাতে না পায় যজ্ঞ দানে সেবি দেবে।
নিমিষেতে শ্রীমুখ দেখিয়া তাহা লভে।।
ব্রহ্মা শিব শচীপতি আদি দেবগণ।
নিত্য নিত্য আসে মুখ দর্শন কারণ।।
তাহা যে দেখয়ে লোক পশ্চাতে থাকিয়া।
বেত্রের প্রহারে লোক জর্জ্জর হইয়া।।
যার অংশে অবতার হয পৃথিবীতে।
যুগে যুগে দুষ্ট নাশে, শিষ্টেরে পালিতে।।
অজ ভগ অগোচর যাঁহার মহিমা।
দেবগণ পুরাণে না ‍পায় যাঁর সীমা।।
ব্রহ্মাণ্ড ডুবায় ব্রহ্ম প্রলয়ের কালে।
সপ্ত কল্পজীবী মুনি ভাসি সিন্ধুজলে।।
বিশ্রাম পাইল মুনি প্রভুর নিকটে।
সেই হতে রহিল আপনি বৃক্ষবটে।।
কে বর্ণিতে পারে মার্কণ্ডেয় হ্রদ গুণ।
যার জলে স্নানে ভূমে জন্ম নহে পুনঃ।।
দক্ষিণেতে শ্বেতগঙ্গা মাধব সমীপে।
যাহে স্নানে ভূমি জন্ম নহে পুনঃ।।
দক্ষিণেতে শ্বেতগঙ্গা মাধব সমীপে।
যাহে স্নানে স্বর্গে নর বৈসে দেবরূপে।।
রোহিণীকুণ্ডের গুণ কি বলিতে পারি।
তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে পীয়ে যার বারি।।
গরুড়ে আরূঢ় কাক বৈকুন্ঠেতে গেল।
সেই হৈতে জন্মক্ষেত্রে পত্র ত্যাগ কৈল।।
কোটি কোটি তীর্থ লয়ে যথা মহানদী।
নানাশব্দ বাদ্যে প্রভু সেবে নিরবধি।।
যার বায়ে সকল পাপীর পাপ খণ্ডে।
যার নাম শুনিলে এড়ায় যমদণ্ডে।।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয়, যার দরশনে।
সদাকাল বৈসে স্বর্গে সহ দেবগণে।।
সমুদ্রে করিয়া স্নান যদি পূজা দেখে।
চতুর্ভূজ হয়ে রহে ইন্দ্রের সম্মুখে।।
ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোবরে যদি করে স্নান।
পুনর্জ্জন্ম নহে তার দেবতা সমান।।
অশ্বমেধ দান যত করিল ভূপতি।
কোটি কোটি ধেনুখুরে ক্ষুণ্ণা বসুমতী।।
গোমূত্র ফেণায় ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোজন্ম।
যাহে স্নাহে খণ্ডে কোটি জন্মের অধর্ম্ম।।
এই পঞ্চ তীর্থ নীলশৈল মধ্যে বৈসে।
পাপলেশ নাহি থাকে তাহার পরশে।।
ভাগ্যবন্ত লোক যেই সদা করে স্নান।
কাশীরাম দাস তার প্রণমে চরণ।।
৫৮. ইন্দ্রের আজ্ঞায় লোমশ
মুনির কাম্যক বনে আগমন
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিৎ বংশধর।
কাম্যবনে নিবসরে চারি সহোদর।।
হেনকালে আইল লোমশ মুনিবর।
দীপ্তিমান তেজ যেন দীপ্ত বৈশ্বানর।।
মুনি দেখি যুধিষ্ঠির সহ ভ্রাতৃগণ।
প্রণাম করিয়া দেন বসিতে আসন।।
জিজ্ঞাসেন কি হেতু আইলা মুনিবর।
আশিস্ করিয়া মুনি করিল উত্তর।।
ইচ্ছা অনুসারে আমি করি পর্য্যটন।
একদিন সুরপুরে করিনু গমন।।
দেখিয়া আশ্চর্য্যবোধ করিলাম মনে।
ইন্দ্রসহ ধনঞ্জয় বৈসে একাসনে।।
আমারে কহিল তবে সহস্র লোচন।
যুধিষ্ঠির স্থানে তুমি করহ গমন।।
কহিবে সংবাদ এই তাঁহার গোচরে।
কুশলে নিবসে পার্থ অমর নগরে।।
দেবকার্য্য সাধি অস্ত্র পারগ হইলে।
আসিবেন ধনঞ্জয় কতদিন গেলে।।
ভ্রাতৃগণ সহ তুমি তীর্থে কর স্নান।
তপ আচরণ কর, দ্বিজে দেহ দান।।
তপের উপর আর অন্য কর্ম্ম নাই।
যাহা ইচ্ছা হয় তাহা তপোবলে পাই।।
কিন্তু আমি কর্ণেরে যে ভালমতে জানি।
অর্জ্জুনের ষোল অংশে তারে নাহি গণি।।
তার ভয় অন্তরে যে আছে ধর্ম্মরায়।
তাহা ত্যজ, ধর্ম্ম তার করিবে উপায়।।
তব ভ্রাতা পার্থ যে কহিল সমাচার।
নিবেদন করি শুন কুন্তীর কুমার।।
হিমালয়ে হৈমবতী করিয়া সেবন।
সুরাসুরে অগোচর পাইয়াছে ধন।।
সমুদ্র মথনে যেই অস্ত্র উপজিল।
মন্ত্র সহ পাশুপত পশুপতি দিল।।
যে অস্ত্র থাকিলে হস্তে ত্রৈলোক্য বিজিত।
হেন অস্ত্র দিল হর হয়ে হরষিত।।
কুবের বরুণ যম দিল অস্ত্রগণ।
সম্প্রীতে আছে সে সুখে ইন্দ্রের ভবন।।
নৃত্য গীত বিশ্বাবসু তনয়া শিখায়।
তার হেতু তাপ নাহি ভাব সর্ব্বদায়।।
আমারে বলিল পুণঃ বিনয় বচন।
আপনি থাকিয়া তীর্থ করাবে ভ্রমণ।।
তীর্থে নিবসয়ে দৈত্য দানব দুর্জ্জন।
তুমি রক্ষা করিবে গো মোর ভ্রাতৃগণ।।
রাখিল দধীচি যথা দেব পুরন্দরে।
অঙ্গিরা রাখিল যথা দেব দিবাকরে।।
ইন্দ্রের বচনে তব অনুজ সম্মতি।
তীর্থস্থানে নরপতি চল শীঘ্রগতি।।
দুইবার দেখিয়াছি তীর্থ আছে যথা।
তব সহ যাইব তৃতীয়বার তথা।।
বিষম সঙ্কট স্থানে আছে তীর্থগণ।
বিনা সব্যসাচী যেতে নারে অন্যজন।।
তুমিও যাইতে রাজা পার ধর্ম্মবলে।
পরাক্রম বিশেষ অনুজগণ মিলে।।
হইবে বিপুল ধর্ম্ম, অধর্ম্মের ক্ষয়।
নিজরাজ্য পাবে শেষে, হবে শত্রু জয়।।
লোমশের বচন শুনিয়া যুধিষ্ঠির।
আনন্দেতে পুলকিত হইল শরীর।।
বিনয় পূর্ব্বক করিলেন সদুত্তর।
কহে নহে, সুধাবৃষ্টি কৈলা মুনিবর।।
কি বলিব প্রত্যুত্তর মুখে না আইসে।
বাঞ্ছা পূর্ণ লাগি মোর তব কৃপাবশে।।
যে অর্জ্জুন লাগি মোর নাহি ক্ষণ সুখ।
চক্ষু মেলি নাহি চাহি ভ্রাতৃগণ মুখ।।
পাইলাম তাহার কুশল সমাচার।
ইহার অধিক লাভ কি আছে আমার।।
সবার ঈশ্বর যেইইন্দ্র দেবরাজ।
আপনি করেন বাঞ্ছা অর্জ্জুনের কাজ।।
যে আজ্ঞা করিলে মুনি তীর্থের কারণ।
পূর্ব্ব হইতে আমি এই করিয়াছি পণ।।
বিশেষ আমার সঙ্গে যাবেন আপনি।
তীর্থযাত্রা মোর পক্ষে বহু লাভ গণি।।
লোমশ বলেন, রাজা যাইবে কি মতে।
এই দ্বিজগণ আছে তোমার সঙ্গেতে।।
বিষম দুর্গম পথ পর্ব্বত কানন।
ফল মূল নাহি মিলে, দুষ্ট জন্তুগণ।।
যাইতে নারিবে সবে থাকিলে সংহতি।
ইহা সবে বিদায় করহ নরপতি।।
যুধিষ্ঠির কহে তবে শুন দ্বিজগণ।
হস্তিনা নগরে সবে করহ গমন।।
যেই যাহা বাঞ্ছ, ধৃতরাষ্ট্রেরে মাগিবে।
নিজ নিজ বৃত্তি যদি তথা না পাইবে।।
পাঞ্চাল দেশেতে সবে করিবে গমন।
যথোচিত পূজা তথা পাবে সর্ব্বজন।।
এত বলি সবারে পাঠান হস্তিনায়।
যোগ্য বৃত্তি দিল ধৃতরাষ্ট্র সে সবায়।।
অল্প দ্বিজ সঙ্গে নিয়া ধর্ম্ম নরপতি।
তিন রাত্রি বঞ্চি তথা লোমশ সংহতি।।
চারি ভাই কৃষ্ণা সহ ধৌম্য পুরোহিত।
তীর্থ করিবারে যাত্রা করেন ত্বরিত।।
হেনকালে উপনীত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
নারদ পর্ব্বত আর বহু মুনিগণ।।
যথোচিত পূজিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
আশিস্ করিয়া কহিছেন মুনিগণ।।
তীর্থযাত্রা করিবারে যদি আছে মন।
মন শুদ্ধ কর রাজা করিয়া যতন।।
নিয়মী সুবুদ্ধি হৈলে তীর্থফল পায়।
মন শুদ্ধ কর রাজা করিয়া যতন।।
নিয়মী সুবুদ্ধি হৈলে তীর্থফল পায়।
মন শুদ্ধ নহিলে সকলি মিথ্যা হয়।।
চারি ভাই কৃষ্ণা সহ করিয়া স্বীকার।
মুনিগণ চরণে করেন নমস্কার।।
অভেদ্য কবচ সবে অঙ্গেতে পরিল।
দ্রৌপদী সহিত রাজা রথে আরোহিল।।
পুরোহিত আদি আর যত ভ্রাতৃগণ।
চতুর্দ্দশ রথে আরোহিল সর্ব্ব জন।।
মার্গশীষ মাস গেল, পূর্ব্বমুখে গতি।
তীর্থযাত্রা করিলেন পাণ্ডব সুকৃতী।।
মহাভারতের কথা পুণ্যফল দাতা।
কাশীদাস রচে পয়ার প্রবন্ধে গাঁথা।।
৫৯. যুধিষ্ঠিরের তীর্থযাত্রা
ও অগস্ত্যোপাখ্যান
চলিলেন ধর্ম্মরাজ সহ মুনিগণে।
কত দিনে উপনীত নৈমিষ কাননে।।
গোমতীতে স্নান করি, করি বহু দান।
তথা হৈতে পরতীর্থে করেন প্রয়াণ।।
যেখা প্রয়াগ তীর্থ যমুনা সঙ্গম।
কত দিনে উপনীত অগস্ত্য আশ্রম।।
লোমশ কহিল তবে পূর্ব্ব বিবরণ।
দৈত্য মারি আশ্রম করিল তপোধন।।
স্বচ্ছন্দে সকল পৃথ্বী করিল ভ্রমণ।
এক দিন শুন রাজা তার বিবরণ।।
এক দিন এক গর্ত্তে দেখে মুনিরাজ।
পিতৃগণ অধোমুখে আছে তার মাঝ।।
দেখিয়া হইল শঙ্কা জিজ্ঞাসে সবারে।
কি হেতু পড়িলে সবে গর্ত্তের ভিতরে।।
সবে বলে, না করিলে বংশের উৎপত্তি।
তেঁই আমা সবাকার হৈল হেন গতি।।
যদি শ্রেয়ঃ চাহ তুমি আমা সবাকার।
বংশ জন্মাইয়া তুমি করহ উদ্ধার।।
পিতৃগণ বচন শুনিয়া মুনিরাজ।
বংশ হেতু চিন্তিত হইল হৃদিমাঝ।।
বিদর্ভ রাজার কন্যা অতি অনুপমা।
রূপে গুণে মনোহরা লোপামুদ্রা নামা।।
যৌবন সময় তার দেখিয়া রাজন।
কারে দিব লোপামুদ্রা চিন্তে মনে মন।।
হেনকালে উপনীত মহা তপোধন।
যথোচিত পূজা করি জিজ্ঞাসে রাজন।।
কি হেতু আসিলে, আজ্ঞা কর মুনিবর।
শুনি মুনিরাজ তবে করিল উত্তর।।
পিতৃগণ আদেশে জন্মাব সন্ততি।
তব কন্যা লোপামুদ্রা দেহ নরপতি।।
এত শুনি নরপতি হৈল অচেতন।
প্রত্যুত্তর দিতে মুখে না আসে বচন।।
উঠিয়া গেলেন রাজ মহাদেবী স্থানে।
রাণীকে কহেন রাজা করুণ বচনে।।
মাগে লোপামুদ্রারে অগস্ত্য মহাঋষি।
নাহি দিলে শাপেতে করিবে ভস্মরাশি।।
এত বিচারিয়া দোঁহে সন্তাপিত শোকে।
শুনি লোপামুদ্রা কহে জননী জনকে।।
মম হেতু তাপ কেন ভাবহ হৃদয়।
আমারে অগস্ত্যে দিয়া খণ্ডাহ এ ভয়।।
তবে লোপামুদ্রার বুঝিয়া যে অন্তর।
বিধিমতে মুনি করে দেন নৃপবর।।
লোপামুদ্রা প্রতি তবে কহে তপোধন।
মম ভার্য্যা হৈলে, কর মম আচরণ।।
দিব্য বস্ত্র ত্যজ রত্ন ভূষণ সকল।
শিরেতে ধরহ জটা, পিন্ধহ বাকল।।
মুনিবাক্যে সেইক্ষণে সকলি ত্যজিল।
জটাচীর লোপামুদ্রার ভূষণ করিল।।
তবে ত অগস্ত্য মুনি ভার্য্যারে লইয়া।
গঙ্গাতীরে মহামুনি রহিলেন গিয়া।।
নিরন্তর করে কন্যা মুনির সেবন।
তপ শৌচ আচমন মুনি আচরণ।।
হেনমতে তথা থাকি বহুদিন গেল।
এক দিন মুনিরাজ ভার্য্যারে কহিল।।
পুত্র হেতু করিয়াছি তোমারে গ্রহণ।
বংশ না হইল তোমার কিসের কারণ।।
এত শুনি লোপামুদ্রা যুড়ি দুই কর।
বিনয় পূর্ব্বক কহে ‍মুনির গোচর।।
কামদেবে কৈল ধাতা সৃষ্টির কারণ।
বিনা কামে নাহি হয় বংশের সৃজন।।
জটাচীর ফলাহার ধূলাতে ধূসর।
ইথে কাম কি মতে জন্মিবে মুনিবর।।
আপনি কি জান মুনি এই বংশকাজ।
বংশ হেতু ইচ্ছা যদি শুন মুনিরাজ।।
পূর্ব্বে যথা ছিল মম বস্ত্র অলঙ্কার।
দিব্য গৃহ দাসগণ ভক্ষ্য উপহার।।
সে সকল বস্তু যদি পাই পুনর্ব্বার।
তবে ত জন্মিবে পুত্র উদরে আমার।।
এত শুনি অগস্ত্যের চিন্তা হৈল মনে।
উপায় চিন্তিল পুনঃ কন্যার বচনে।।
শ্রুতপর্ব্বা নামে রাজা ইক্ষবাকু নন্দন।
ভার্য্যা সহ তথাকারে গেল তপোধন।।
দেখি শ্রুতপর্ব্বা রাজা পূজে বহুতর।
জিজ্ঞাসিল কি হেতু আইলা মুনিবর।।
মুনি বলে, বৃত্তিহেতু আসিলাম আমি।
বৃত্তি অর্থ কিছু রাজা মোরে দেহ তুমি।।
যে কিছু মাগিল মুনি, সব দিল রাজা।
পাত্র মিত্র সহিত করিল বহু পূজা।।
দিব্য গৃহ আসন ভূষণ দাসগণ।
বাঞ্ছামত পাইয়া রহিল তপোধন।।
তবে যত প্রজাগণ রাজার সংহতি।
অগস্ত্যেরে কহে তারা, করিয়া মিনতি।।
ইল্বল নামেতে দৈত্য মায়ার সাগর।
বাতাপি নামেতে আছে তার সহোদর।।
মায়াবলে ধরে ধুষ্ট গাড়ল মূরতি।
কাটিয়া রন্ধন করি ভুঞ্জিয়া যে থাকে।।
এইমতে মারে দুষ্ট বহু দ্বিজগণ।
অদ্যাবধি হিং‍সা করে পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।।
ইল্বলের ভয়েতে তাপিত এ নগর।
শুনিয়া অগস্ত্য মুনি চিন্তিত অন্তর।।
আশ্বাসিয়া সবাকারে করিল নির্ভয়।
একাকী চলিল মুনি ইল্বল আলয়।।
মুনি দেখি ইল্বল পূজিল বহুতর।
জিজ্ঞাসিল সবিনয়ে করিয়া আদর।।
কি হেতু আসিলে, আজ্ঞা কর তপোধন।
শুনিয়া উত্তর কৈল কুম্ভক নন্দন।।
বহু পরিশ্রমে আসিলাম তব পুর।
বহুদিন উপবাসী, ভুঞ্জাও প্রচুর।।
সম্পূর্ণ করিয়া মোরে করাহ ভোজন।
হাসিয়া ইল্বল বলে, বৈস তপোধন।।
কাটিয়া মায়াবী মেষ করিল রন্ধন।
অগস্ত্য মুনিরে দিল করিতে ভোজন।।
মুনি বলে, এই মাংসে কি হবে আমার।
সকলি আনিয়া দেহ যত আছে আর।।
শির কটি চারি পদ আনি দেহ মেষ।
তাবৎ খাইব আমি না রাখিব শেষ।।
মুনিবাক্য শুনিয়া ইল্বল আনি দিল।
অস্থি সহ মুনিবর সকলি খাইল।।
কতক্ষণে ইল্বল ডাকিল সহোদরে।
বাহিরাও বাতাপি, ডাকিল বারে বারে।।
হাসিয়া বলেন মুনি কেন ডাক পাপী।
অগস্তের ঠাঁই কোথা পাইবে বাতাপি।।
বাতাপি পাইবে আর না করিহ আশ।
এত দিনে হৈল দুরাচারের বিনাশ।।
এত শুনি ইল্বল যুড়িয়া দুই কর।
স্তুতি করি কহে তবে মুনির গোচর।।
কি করিব প্রিয় তব, কহ মুনিবর।
মুনি বলে, প্রাণী হিংসা করিলে বিস্তর।।
যত রত্ন ধন তুমি পাইয়াছ তায়।
সকলি আমায় দিয়া রাখ আপনায়।।
সেইক্ষণে দুষ্ট দৈত্য আনি সব দিল।
দ্রব্য লয়ে মুনিরাজ আশ্রমে চলিল।।
বসন ভূষণ দিব্য রত্ন অলঙ্কার।
দেখি লোপামুদ্রা হৈল আনন্দে অপার।।
সন্তুষ্টা হইয়া কন্যা ভাবে মনে মন।
বংশ হেতু মুনিবরে করে নিবেদন।।
মুনি বলে, পুত্র বাঞ্ছা কতেক তোমার।
লোপামুদ্রা বলে হৌক একটী কুমার।।
এক পুত্র গুণবান হোক তপোধন।
অকৃতি সহস্র পুত্রে নাহি প্রয়োজন।।
তবে প্রীত হয়ে কাম বাড়িল দোঁহার।
মুনির ঔরসে তাঁর জন্মিল কুমার।।
অগস্ত্য সমান হৈল পরম পণ্ডিত।
শুনিলে পূর্ব্বের কথা অগস্ত্যা চরিত।।
অগস্ত্য মুনির কথা অদ্ভূত মানুষে।
হেলায় সমুদ্র পান করিল গণ্ডূষে।।
সূর্য্য পথ রুদ্ধ করিলেক বিন্ধ্যাচল।
অন্ধকারে ব্যাপিলেক পৃথিবীমণ্ডল।।
অগস্ত্য প্রভাবে লোকে সে ভয় ঘুচিল।
অন্ধকার দূর হৈল, সূর্য্য পথ পাইল।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ মুনিরাজ সে অগস্ত্য বিবরণ।।
কি কারণে মুনিরাজ সমুদ্র শুষিল।
কোন হেতু অন্ধকার, কিরূপে খণ্ডিল।।
৬০. অগস্ত্যযাত্রার বিবরণ
ও বিন্ধ্যাপর্ব্বতের দর্প চূর্ণ
লোমশ বলেন, শুন ধর্ম্মের কুমার।
যেমতে খণ্ডিল মুনি গোর অন্ধকার।।
গিরিমধ্যে আছয়ে সুমেরু গিরিবর।
প্রদক্ষিণ করি তারে ভ্রমে দিনকর।।
তাহা দেখি বিন্ধ্যাগিরি সক্রোধ হইয়া।
দিনমণি প্রতি তবে বলিল ডাকিয়া।।
যেমত আবর্ত্ত কর সুমেরু শিখরে।
সেইমত প্রদক্ষিণ করহ আমারে।।
সূর্য্য বলে, রথে বসি আবর্ত্তন করি।
সৃষ্টি সৃজিলেন যেই সৃষ্টি অধিকারী।।
তাঁর নিয়োজিত পথে করিব ভ্রমণ।
শক্তি নাহি, অন্য পথে করিতে গমন।।
এত শুনি বিন্ধ্য বলে সক্রোধ বচনে।
দেখি, মেরু প্রদক্ষিণ করিবে কেমনে।।
বাড়িল বিষম বিন্ধ্য করিয়া আক্রোশ।
না হয় রবির গতি, না হয় দিবস।।
ক্রোধ করি কামরূপী বাড়াইল অঙ্গ।
ব্যাপিল আকাশপথ না চলে বিহঙ্গ।।
ঢাকিল সূর্য্যের তেজ, হৈল অন্ধকার।
প্রলয় হইল, যেন মানিল সংসার।।
দেবগণ মিলি সবে করে নিবেদন।
না শুনিল বিন্ধ্যাগিরি কাহার বচন।।
তবে যত দেবগণ একত্র হইয়া।
অগস্ত্য মুনির আগে নিবেদিল গিয়া।।
চন্দ্র সূর্য্যপথ রুদ্ধ বিন্ধ্যাগিরি করে।
তোমা বিনা নাহি দেখি তাহারে নিবারে।।
রক্ষা কর মুনিরাজ সৃষ্টি হৈল নাশ।
শুনিয়া অগস্ত্য মুনি করিল আশ্বাস।।
বিন্ধ্যাগিরি পাশে তবে যায় তপোধন।
মুনি দেখি প্রণাম করিল সর্ব্ব জন।।
নাগ নর পশু পক্ষী স্থাবর জঙ্গম।
অগস্ত্য মুনির তেজ জিনি সূর্য্য সম।।
মুনি দেখি বিন্ধ্যাগিরি প্রণাম করিল।
ঈষৎ হাসিয়া মুনি আশীর্ব্বাদ দিল।।
যাবৎ না আসি আমি দক্ষিণ হইতে।
তাবৎ পর্ব্বত তুমি থাক এইমতে।।
এত বলি মুনিরাজ করিল গমন।
পুনঃ যে উত্তরে নাহি গেল কদাচন।।
তাঁর আজ্ঞা লঙ্ঘি গিরি কভু নাহি উঠে।
সৃষ্টি রক্ষা করিলেন অগস্ত্য কপটে।।
আরণ্যক পর্ব্বতে অগস্ত্য উপাখ্যান।
কাশী কহে, ধর্ম্ম পুণ্য লাভের সোপান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র