৯১. দুর্য্যোধনের মনোদুঃখ শ্রবণে কর্ণের প্রবোধ বাক্যএইমত কুরুপতি, চন্তিয়া আকুল মতি,অত্যন্ত উদ্বেগ চিত্ত হয়ে।ডাকাইয়া সর্ব্বজনে, বসিল নিভৃত স্থানে,যত পাত্রমিত্রগণ লয়ে।।দুর্য্যোধন হেনকালে, কর্ণে সম্বোধিয়া বলে,অবধান কর মোর বোলে।দুঃখের নাহিক ওর, দগ্ধ হৈল তনু মোর,অনুক্ষণ চিন্তার অনলে।।বিশেষ তোমরা সবে, মন্ত্রণার অনুভবে,যে কিছু করিলে সুবিচার।করিতে আমার হিত, বিধি কৈল বিপরীত,এক চিন্তা কৈলে হয় আর।।পুনঃ পুনঃ এই মত, উপায় করিনু যত,হিংসা হেতু পাণ্ডুপুত্রগণে।পরম সঙ্কটে তরে, হিতপক্ষ প্রতিকারে,না জানি করিল কোন্ জনে।।সকল বালক মিলে, ক্রীড়ার কৌতুককালে,ভীমেরে দেখিয়া বলবান।কেহ তারে নহে শক্য, নিবারিতে প্রতিপক্ষ,কালকূট করাইনু পান।।বান্ধি হস্ত পদ গলে, ফেলিনু গভীর জলে,দৈবযোগে গেল রসাতল।কেবা দিল প্রাণদান, কিবা সুধা করি পান,অযুত হস্তীর ধরে বল।।অনন্তর জতুগৃহে, তারে পোড়াইয়া দেহে,ভাবিলাম করিব সংহার।বুদ্ধিবলে তাহে তরি, দুরন্ত রাক্ষস মারি,পাইল পরম প্রতিকার।।কাল কাটি অনায়াসে, গেল পাঞ্চালের দেশে,পাঞ্চালী পাইল স্বয়ন্বরে।কি দিব ভাগ্যের লেখা, দ্রুপদ হইল সখা,জিনিলেক লক্ষ দণ্ডধরে।।অনন্তর রাজ্যে আসি, অবনী-মণ্ডল শাসি,যে কর্ম্ম করিল যজ্ঞকালে।কে তার উপমা দিবে, না হইল, না হইবে,ক্ষিতিমধ্যে ক্ষত্রিয়ের কুলে।।পিতামহ মুখে শুনি, যদুকুলে চক্রপানি,পূর্ণব্রহ্ম নিজে অবতার।ব্রাহ্মণ-চরণ ধৌতে, নিযুক্ত করিল তাতে,হেনজন যজ্ঞেতে যাহার।।হইল এমনি ক্রম, স্থলে হৈল জলভ্রম,তাহাতে ঘটিল যে দুর্দ্দশা।তাহে পেয়ে অপমান, বাঞ্ছা হল ত্যজি প্রাণ,সেই দুঃখে খেলাইনু পাশা।।হারিলেক রাজ্যধন, দাসত্ব করিল পণ,তাহে জয় হইল আমার।অন্ধরাজ বুদ্ধিদোষে, আপনার ভাগ্যবশে,যাজ্ঞসেনী করিল উদ্ধার।।সবে মিলি পুনর্ব্বার, মন্ত্রণা করিনু সার,বনবাস কৈনু নিরূপণ।না পাইল কোন দুঃখ, বনে তার নানা সুখ,স্বর্গে যেন সহস্রলোচন।।হিড়িম্বাদি জটাসুরে, মুহূর্ত্তেকে যমপুরে,পাঠাইল করিয়া বিক্রম।ভীমসেন শত্রুগণে, নিপাত করিল রণে,অনায়াসে না জানিল শ্রম।।একা পার্থ মহাবল, স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল,জিনিবারে হইল ভাজন।দ্বিতীয় বিক্রম সীমা, ভীম পরাক্রম ভীমা,যার নামে সভয় শমন।।মধ্যাহ্ন-সূর্য্যের সম, অপ্রমেয় পরাক্রম,মাদ্রীপুত্র যুগল বিশেষে।আর এক অনুমানি, লক্ষ্মীরূপা যাজ্ঞসেনী,পাইল পাণ্ডব পুণ্যবশে।।তাহার সুকর্ম্ম যত, বিশেষ কহিব কত,বলিতে না পারি এক মুখে।এক দ্রব্য সুসংযোগে, স্বর্গের অধিক ভোগে,বনেতে পাণ্ডব আছে সুখে।।নিত্য নিয়মিত যত, প্রতিদিন শত শত,ব্রাহ্মণেরে করায় ভোজন।লক্ষ লক্ষ যত আসে, তারা সব ভাগ্যবশে,বিমুখ না যায় কোন জন।।সেহেতু হিংসিতে তারে, পাঠাইনু দুর্ব্বাসারে,শিষ্য দশ সহস্র সংহতি।শুনিলাম লোকমুখে, ভোজন করিয়া সুখে,মুনি গেল আপন বসতি।।ইহা পূর্ব্বে সর্ব্ব জনে, গেলাম প্রভাস স্নানে,দেখিনু সকল বিদ্যমান।যে কর্ম্ম করিল তায়, বুঝিলাম অভিপ্রায়,নহি তার শতাংশ সমান।।তপ জপ যজ্ঞ ব্রত, বল বুদ্ধি ধৈর্য্য যত,পাণ্ডবের আছয়ে সকল।সবার সমান গুণ, বিশেষতঃ ভীমার্জ্জুন,ক্ষিতিমধ্যে দুই মহাবল।।যে কিছু উপায় শেষে, মন্ত্রণার সমাবেশে,যদ্যপি না হয় প্রতিকার।বুদ্ধিবল অনায়াসে, কাল কাটি কোন দেশে,আসিয়া করিব মহামার।।মধ্যাহ্ন মার্ত্তণ্ডসম, যেন মহাকাল যম,বারণ করিবে কোন্ জন।এই চিন্তা অবিরত, কুম্ভকার চক্রবত,সতত অস্থির মম মন।।অতি সে উদ্বিগ্ন মনে, সবাকার বিদ্যমানে,কহিল কৌরব অধিপতি।দুর্য্যোধন মনঃক্লেশে, জানি হিত উপদেশ,সূর্য্যপুত্র কহে মহামতি।।মহারাজ কি কারণে, এতেক উদ্বিগ্ন মনে,কি হেতু পাণ্ডবে কর ভয়।তোমার বৈভব বলে, স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে,উপমার যোগ্য হেন নয়।।কহিলে যে মহারাজা, পাণ্ডব প্রবল তেজা,আসিয়া করিবে মহামার।বহুদিন তারা আছে, আমরাও আছি কাছে,হিংসা কবে করিল কাহার।।বনের নিবাস গত, শেষ দিন আছে যত,যদ্যপি বঞ্চিবে মহাক্লেশে।কহ কোথা আছে ঠাঁই, লুকাইবে পঞ্চ ভাই,অজ্ঞাতে বঞ্চিবে কোন্ দেশে।।যতেক নৃপতিচয়, কেবল তোমার ভয়,কাছে না রাখিবে কোন জন।পাঠাইব চরগণে, নগর পর্ব্বত বনে,খুঁজিলে পাইবে দরশন।।আছে পূর্ব্ব নিরূপণ, দ্বাদশ বৎসর বন,বঞ্চিবেক অজ্ঞাত বৎসর।এতেক যে কালান্তরে, কেবা জীয়ে কেবা মরে,চিরজীবী নহে কোন নর।।শুভ ভাগ্যবশে যদি, বঞ্চিয়া অজ্ঞাত বিধি,আসিবেক যখন সকল।বনবাস মহাকষ্ট, চিন্তাকুল জ্ঞানভ্রষ্ট,শক্তিহীন হইবে দুর্ব্বল।।তখন করিব ক্রম, প্রকাশিয়া পরাক্রম,স্বকার্য্য সাধিব কুতূহলে।নিমিষেতে পঞ্চ জনে, পাঠাইব যমস্থানে,তোমার পুণ্যের মহাবলে।।আমার বিক্রম জানি, কি কারণে নৃপমণি,ক্ষুদ্র জনে কর এত ভয়।ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা, সবে অনুগত তোমা,কি করিবে পাণ্ডুর তনয়।।এত বলি কর্ণবীর, হিতপক্ষ নৃপতির,কহিল শুনিল সর্ব্বজন।সূর্য্যপুত্র কহে যত, তাহা নহে অন্যমত,সবাই করিবে প্রাণপণ।।এই মত সর্ব্বজনে, কহিলেন দুয্যোধনে,আশ্বাস করিয়া বহুতর।শুনিয়া এ সব বাণী, দুর্য্যোধন মহামানী,কতক্ষণে করিল উত্তর।।বলবুদ্ধি অনুভবে, যে কিছু কহিবে সবে,অন্যথা না করি কদাচন।কিন্তু নহি দীর্ঘজীবী, সর্ব্বদা এ সব ভাবি,যোগবৎ চিন্তি অনুক্ষণ।।বনের চরিত্র কথা, শ্রবণে মঙ্গল গাঁথা,প্রকাশিল মহামুনি ব্যাস।সেই কথা মনুঃসুখে, শুনিয়া লোকের মুখে,পাঁচালি রচিল তাঁর দাস।।৯২. দুর্য্যোধনের মন্ত্রণায় জয়দ্রথের দ্রৌপদী হরণে যাত্রাদুর্য্যোধন কহে, সবে কি যুক্তি করিলে।বিধাতা দিবেক বলি নিশ্চিন্ত রহিলে।।বিধিকৃত হৈলে জানি অবশ্যই জয়।তিনি না করিলে, জানি সব মিথ্যা হয়।।সংসারে থাকিয়া লোক করিবে উদ্যোগ।নিত্য নিত্য ভুঞ্জিবেক নানা উপভোগ।।অনুক্ষণ করিবেক স্বকার্য্য সাধন।পূর্ব্বমত আছে হেন বিধি নির্ব্বন্ধন।।ফল পায়, যেবা রাখে বিধাতায় মন।জীবনেতে উপায় করিবে সর্ব্ব জন।।বুদ্ধিতে পাণ্ডব যদি গুপ্তবাস তরে।অনর্থ করিবে আসি মহাক্রোধ ভরে।।ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম এক এক জন।কাহার হইবে শক্তি করিতে বারণ।।মাতুল ত্রিগর্ত্ত তুমি আমি দুঃশাসন।মহাশ্রম করিলে না পারি কদাচন।।মন্ত্রণা করিয়া যাদি সংহারিতে পারি।উদ্বেগ সাগর হৈতে অনায়াসে তরি।।কহিলে যতেক কথা, মনে নাহি লয়।পরাক্রমে পাণ্ডবেরে কে করিবে জয়।।সুযুক্তি ইহার এই, লয় মম মন।আনিব দ্রুপদ সুতা করিয়া হরণ।।দ্রুপদ নন্দিনী হয় পাণ্ডবের প্রাণ।অশেষ সঙ্কটে নিত্য করে পরিত্রাণ।।বুদ্ধিবল করি যদি তাহারে হরিবে।নিশ্চয় দেখিবে তবে পাণ্ডব মরিবে।।সে কারণে কহি আমি এ সব সম্মত।গুপ্তবেশে সেই স্থানে যাক জয়দ্রথ।।বুদ্ধিবলে বিশারদ, তারে ভাল জানি।প্রকার করিয়া যেন হরে যাজ্ঞসেনী।।লুকায়ে রাখিব কৃষ্ণা অতি গুপ্তস্থানে।খুঁজিয়া পাণ্ডব যেন না পায় সন্ধানে।।কৃষ্ণার বিচ্ছেদে বড় পাইবেক শোক।এইরূপে পঞ্চ ভাই হইবে বিয়োগ।।নিষ্কন্টক হবে রাজ্য, ঘুচিবে জঞ্জাল।নির্ব্বিরোধে রাজ্যবোগ করি চিরকাল।।তোমা সবাকার যদি হয় ত সম্মতি।তবে সে কর্ত্তব্য, এই লয় মম মতি।।এতেক কহিল যদি কৌরব -প্রধান।প্রশংসা করিল তবে মন্ত্রী জ্ঞানবান।।ধন্য ধন্য মহাশয় মন্ত্রণা তোমার।করিলে যে মন্ত্রণা, তা সবাকার সার।।যোগ্য হয় এ কর্ম্ম মোদের অভিমত।গুপ্তবেশে সেই স্থানে যাক জয়দ্রথ।।দুষ্টমতিগণ যদি এতেক কহিল।শুনিয়া নৃপতি তবে আনন্দিত হৈল।।তবে জয়দ্রথে আজ্ঞা দিল দুর্য্যোধন।তুমি শীঘ্র কাম্যবনে করহ গমন।।অন্তরে থাকিয়া তথা বীর চূড়ামণি।বুদ্ধিবলে হরিয়া আনিবে যাজ্ঞসেনী।।এতেক কহিল যদি কৌরব ঈশ্বর।কতক্ষণে জয়দ্রথ করিল উত্তর।।তোমার আজ্ঞাতে আমি যাই কাম্যবন।কিন্তু পাণ্ডবেরে সবে জানহ যেমন।।দ্বিতীয় শমন তুল্য একৈক পাণ্ডব।শতাংশ সমান তার নহি মোরা সব।।বিশেষে, আপনি মনে কর অবধান।গন্ধর্ব্ব-সমরে একা পার্থ কৈল ত্রাণ।।জীয়ন্ত ব্যাঘ্রের চক্ষু আনে কোন্ জনে।কার শক্তি হিংসিবে সে পাণ্ডু পুত্রগণে।।যদি বা তোমার বাক্য নাহি করি আন।নিমিষেতে বৃকোদর বধিবেক প্রাণ।।বিশেষ দ্রুপদসুতা লক্ষ্মী-অবতার।মহাবল পঞ্চ ভাই রক্ষক তাহার।।একান্ত থাকিবে যার জীবনের আশা।সে কেন করিবে হেন দুরন্ত প্রত্যাশা।।জয়দ্রথ মুখে তবে এই বাক্য শুনি।বিনয় পূর্ব্বক তারে কহে নৃপমণি।।কহিলে যতেক কথা, আমি সব জানি।পাণ্ডবের সম্মুখে কে হরে যাজ্ঞসেনী।।কি ছার কৌরব সেনা, তোমা গণি কিসে।অন্যে কি করিবে যারে দণ্ডপাণি ত্রাসে।।একা পার্থ জিনিলেক এ তিন ভুবন।সুরাসুর নাগ নরে সম কোন্ জন।।সুযুক্তি করেছি এই, শুন দিয়া মন।আনিবে দ্রুপদসুতা করিয়া গোপন।।নিকটে নিকটে সদা রবে সাবধানে।অতি সঙ্গোপনে, যেন কেহ নাহি জানে।।স্নান দানে যবে সবে যাবে চারিভিত।সেই কালে সেই স্থানে হবে উপনীত।।হরিয়া দ্রুপদসুতা প্রকার বিশেষে।যত্ন করি লুকাইবে অতি দূরদেশে।।খুঁজিয়া পাণ্ডব যেন উদ্দেশ না পায়।তার শোকে পাণ্ডবেরা মরিবে নিশ্চয়।।সুসিন্ধ হইবে তবে মনের অভীষ্ট।নিঃসঙ্কটে রাজ্যভোগ করিব যথেষ্ট।।তোমা বিনা অন্য জন ইথে নহে শক্য।সহায় সম্পদ মোর তুমি সে স্বপক্ষে।।বিস্তর কহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।অমূল্যে কিনিবে তুমি রাজা দুর্য্যোধন।।পুনঃ পুনঃ কহে রাজা মৃদু মৃদু ভাষ।শুনি জয়দ্রথ করে বচন প্রকাশ।।কি কারণে এত কথা কহ নরপতি।অবশ্য পালিব আমি তব অনুমতি।।এই আমি চলিলাম কাম্যক-কানন।প্রাণপণে সম্পাদিব তব প্রয়োজন।।এত শুনি তুষ্ট হৈল প্রধান কৌরব।সাজাইয়া দিল রথ করিয়া গৌরব।।সবে সম্ভাষিয়া বীর চড়ে গিয়া রথে।চালাইয়া দিল কাম্য-কাননের পথে।।যাইতে যাইতে পথে করিল বিচার।রাজার সাহসে আজি কৈনু অঙ্গীকার।।পড়িলে ভীমের হাতে নাহিক নিস্তার।ঈশ্বর করেন যদি, হইব উদ্ধার।।এতেক চিন্তিয়া মনে যুক্তি কৈল সার।চৌর্য্য বিনা কার্য্য সিদ্ধি নহিবে আমার।।এইরূপে জয়দ্রথ চিন্তাকুল মনে।উপনীত হৈল গিয়া মহাঘোর বনে।।দুদিকে কানন শোভা, মধ্য দিয়া পথ।নানাবর্ণ মৃগ পশু দেখে শত শত।।বিবিধ কুসুমে দেখে শোভিয়াছে বন।মকরন্দ পান করে সুখে অলিগণ।।বিবিধ প্রকার শোভা দেখিয়া কাননে।কাম্যবন নিকটে আইল কতক্ষণে।।নন্দনকানন তুল্য দেখে কাম্যবন।অনেক আশ্রম তথা দেখে মুনিগণ।।স্থানে স্থানে দেখে কত দেবের আশ্রম।বিবিধ বিহঙ্গ রব করে নানাক্রম।।এরূপ কৌতুক মনে করিতে ভ্রমণ।উত্তরিল কতক্ষণে যথা পঞ্চ জন।।তাহার নিকটে লুকাইল জয়দ্রথ।ছিদ্র চাহি থাকে বীর নিরখিয়া পথ।।শমন সমান জানি ভীম ধনঞ্জয়।নিকটে যাইতে নারে পরাণের ভয়।।হেনমতে রহে তথা হইয়া গোপন।এক দিন শুন রাজা দৈবের ঘটন।।৯৩. দ্রৌপদী হরণে ভীমহস্তে জয়দ্রথের অপমানশুন জন্মেজয় রাজা দৈবের ঘটন।জয়দ্রথ গুপ্তভাবে রহে কাম্যবন।।উঠিয়া প্রভাতে হেথা ভাই দুই জনে।রাজার নিকটে রাখি মাদ্রীর নন্দনে।।মৃগয়া করিতে যান ভীম ধনঞ্জয়।স্নান হেতু যান ক্রমে বিপ্র সমুদয়।।পরে চলিলেন স্নানে ভাই তিন জন।বসিয়া দ্রৌপদী একা করেন রন্ধন।।জয়দ্রথ দেখে, শূন্য হইল মন্দির।সময় জানিয়া তথা গেল মহাবীর।।কুটীর দুয়ারে গিয়া রাখিলেক রথ।শূন্যালয় দেখি আনন্দিত জয়দ্রথ।।রথ হৈতে ভূমিতলে নামে মহাবীর।কুটুম্ব জানিয়া কৃষ্ণা হইল বাহির।।মনেতে জানিল এই অপূর্ব্বা অতিথি।অতিথির সেবা হেতু চিন্তি গুণবতী।।শূন্যালয় তথা, আর নাহি কোন জন।আপনি আনিয়া দিল দিব্য কুশাসন।।পাদ প্রক্ষালন হেতু আনি দিল জল।জিজ্ঞাসা করিল, কহ ঘরের কুশল।।কোথা হৈতে এলে এবে, যাবে কোন্ দেশে।এ বনে আসিলা কোন প্রয়োজনোদ্দেশে।।জয়দ্রথ বলে, আর নাহি কোন কাজ।ভেটিবারে আইলাম ধর্ম্ম মহারাজ।।একমাত্র দেখি তুমি করিছ রন্ধন।কহ দেখি, কোথা গেল ধর্ম্মের নন্দন।।কোন্ কার্য্য হেতু গেল ভীম ধনঞ্জয়।ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী কোথা, মাদ্রীর তনয়।।কৃষ্ণা বলে, স্নানে গেল ব্রাহ্মণ-সমাজ।মাদ্রীপুত্র গেল সহ ধর্ম্মরাজ।।ভীমার্জ্জুন গেল বনে মৃগয়া কারণে।মুহূর্ত্তে এখনি সবে আসিবে এখানে।।দ্রৌপদীর মুখে শুনি এ সব বচন।দুষ্ট জয়দ্রথের সচঞ্চল হৈল মন।।বিচার করিল মনে, সবে দূরে গেল।উচিত সময় মোর বিধাতা মিলাল।।চতুর্দ্দিকে চাহে, কেন নাহিক কোথায়।চঞ্চল হইল বীর ঘন ঘন চায়।।নিকটে আছিল কৃষ্ণা, তুলি নিল রথে।শীঘ্রগতি চালাইল হস্তিনার পথে।।কৃষ্ণা বলে, চৌর্য্যকার্য্য কর কুলাঙ্গার।বুঝিলাম, কালপূর্ণ হইল তোমার।।বড় বংশে জনমিয়া কর নীচকর্ম্ম।মুহূর্ত্তে এখনি তার ফলিবেক ধর্ম্ম।।যাবৎ পুরুষসিংহ ভীম নাহি দেখে।প্রাণ লয়ে যাহ শীঘ্র ছাড়িয়া আমাকে।।আরে দুষ্ট কি করিলি, হলি মতিচ্ছন্ন।বুঝিনু তোমার এবে কাল হল পূর্ণ।।আরে অন্ধ ভালমন্দ না জান সকল।হেন কর্ম্ম কর যাতে ফলয়ে সুফল।।পরপক্ষ জন যদি আসি করে রণ।সাহায্য করিয়া তারে রাখে বন্ধুগণ।।তোর ক্রিয়া শুনি লোক কর্ণে দিবে কর।হেন দুরাচার দুই অধম পামর।।হেনমতে তিরস্কার করে যাজ্ঞসেনী।চোরা নাহি শুনে কভু ধর্ম্মের কাহিনী।।ভালমন্দ জয়দ্রথ কিছু নাহি কহে।চালাইয়া দিল রথ, তিলেক না রহে।।দ্রৌপদী দেখিল, তবে পড়িনু বিপাকে।গোবিন্দ গোবিন্দ বলি পরিত্রাহি ডাকে।।কি জানি কৃষ্ণের পায় কৈনু অপরাধ।সে কারণে হৈল মম এতেক প্রমাদ।।কোথা গেল মহারাজ ধর্ম্ম-অধিকারী।কোথা গেল মাদ্রীপুত্র বিক্রমে কেশরী।।ভুবন বিজয়ী কোথা পার্থ মহামতি।এস এস কোথা আছ, এস হে ঝটিতি।।মধ্যম পাণ্ডব এস ভীম মহাবল।দুষ্ট জনে আসি দেহ সমুচিত ফল।।তোমরা যে পঞ্চ ভাই রহিলে কোথায়।জয়দ্রথ মন্দমতি বলে লয়ে যায়।।শূন্যালয়ে আছি, দুষ্ট জানিয়া ধরিল।সিংহের বনিতা নিতে শৃগালে ইচ্ছিল।।সকল দেবের সাক্ষী দেব বিকর্ত্তন।আজন্ম জানহ তুমি সবাকার মন।।কায়মনোবাক্যে যদি আমি হই সতী।ইহার উচিত ফল পাইবে দুর্ম্মতি।।এইমত যাজ্ঞসেনী পাড়িছে দোহাই।হেনকালে আশ্রমেতে আসে তিন ভাই।।শূন্যালয় দেখি মনে হইলেন স্তব্ধ।শুনিলেন দ্রৌপদীর ক্রন্দনের শব্দ।।ব্যগ্র হয়ে তিন ভাই ধনু লয়ে হাতে।শব্দ অনুসারে শীঘ্র ধায় সেই পথে।।চিন্তাকুল ধায় সবে, না দেখেন পথ।দূর হৈতে দেখিলেন, যায় জয়দ্রথ।।আকুল হইয়া কৃষ্ণা ডাকে ঘনে ঘন।দূর হৈতে দেখিলেন, যায় জয়দ্রথ।।আকুল হইয়া কৃষ্ণা ডাকে ঘনে ঘন।দূর হৈতে আশ্বাসিয়া কহে তিন জন।।ভয় নাই, ভয় নাই, বলয়ে বচন।হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটন।।মৃগয়া করিয়া আসে ভাই দুই জন।সেই পথে জয়দ্রথ করিছে গমন।।দূর হতে শুনিলেন ক্রন্দনের রোল।উদ্ধার করহ ভীম ডাকে এই বোল।।অর্জ্জুন কহেন, ভীম শুনি বিপরীত।হেথা যাজ্ঞসেনী কেন ডাকে আচম্বিত।।কি হেতু আইল কৃষ্ণা নির্জ্জন কাননে।না জানি হিংসিল আসি কোন্ দুষ্ট জনে।।কিম্বা কেবা বিরোধিল ধর্ম্মের তনয়।আকুল আমার মন গণিয়া প্রলয়।।ভীম বলে, এ কথা না লয় মম মনে।কে যাইতে ইচ্ছা করে শমন ভবনে।।চল শীঘ্র, ভাল নহে এ সব কারণ।সমুচিত ফল দিব জানি নিরূপণ।।এত বলি দুই বীর যান বায়ুবেগে।শব্দ অনুসারে যান দ্রৌপদীর আগে।।হেনকালে দূরে দেখিলেন এক রথ।ধ্বজা দেখি জানিলেন যায় জয়দ্রথ।।তবে পার্থ মায়ারথ করেন স্মরণ।চিন্তামাত্র কপিধ্বজ আসিল তখন।।আরোহণ করিলেন দোঁহে হৃষ্টমতি।চালাইয়া দেন রথ পবনের গতি।।দেখিল নিকট হৈল অর্জ্জুনের রথ।প্রাণভয়ে পলাইয়া যায় জয়দ্রথ।।রথ হৈতে লাফ দিয়া পড়ে ভূমিতলে।অধিক ধাইল বীর প্রাণের বিকলে।।দেখিয়া ভীমের মনে হইল সন্তাপ।ক্রোধভরে রথ হৈতে পড়ে দিয়া লাফ।।বেগেতে ধাইল দুষ্ট অতি ভয়াকুলে।চক্ষুর নিমেষে ভীম ধরে তার চুলে।।মৃগেন্দ্র রুষিয়া যেন ধরে ক্ষুদ্র পশু।ক্ষুধিত গরুড়মুখে যেন সর্পশিশু।।সেইমত তার চুল ধরিলেন টানি।ক্রোধভরে গেল যথা আছে যাজ্ঞসেনী।।কহিল কৃষ্ণারে তবে আশ্বাস বচন।স্থির হও যাজ্ঞসেনী ত্যজ দুঃখ মন।।যেমত তোমাকে দুঃখ দিল দুষ্টমতি।তাহার উচিত ফল, মুখে মার লাথি।।আছিল মনের ক্রোধে দ্রুপদ-নন্দিনী।সম্বরিতে নারে ক্রোধ, দহিছে পরাণী।।তাহাতে ভীমের আজ্ঞা লঙ্ঘিতে নারিল।অধর্ম্ম নাহিক ইথে বিচারে জানিল।।তবে কৃষ্ণা আপনার মনের কৌতুকে।তিন বার পদাঘাত করে তার মুখে।।জয়দ্রথে কহে তবে ভীম মহাবল।অবশ্য ভুঞ্জিতে হয় স্বকর্ম্মের ফল।।আরে দুষ্ট, থাকে যার জীবনের আশা।সে কভু করয়ে হেন দুরন্ত ভরসা।।এই মুখে কৃষ্ণা হরি দিয়াছিলি রড়।এত বলি গণি মারে দশটী চাপড়।।বজ্রতুল্য খাইয়া ভীমের করাঘাত।সঘনে কাঁপয়ে যেন কদলীর পাত।।হেনমতে বৃকোদর মারিল প্রচুর।চুলে ধরি টানি তবে লয় কত দূর।।অনেক নিন্দিল তারে গভীর গর্জ্জনে।পুনশ্চ টানিয়া তারে আনে কতক্ষণে।।মুক্তকেশ ন্যস্তবেশ বহে রক্তধার।ফাঁফর হইয়া কান্দে, নাহিক নিস্তার।।চুলে ধরি ভূমিতলে ঘসে তার মুখ।দেখি দ্রৌপদীর মনে পরম কৌতুক।।পুনঃ পুনঃ প্রহারিল বীর বৃকোদর।প্রাণমাত্র অবশেষ রহে কলেবর।।মূর্চ্ছাগত হয়ে ভূমে পড়ে অচেতন।হেনকালে উপনীত ধর্ম্মের নন্দন।।দেখিয়া তাহার দুঃখ দুঃখিত হৃদয়।রক্ষা হেতু বিচারিয়া ধর্ম্মের তনয়।।কহিলেন, শুন ভীম, করিলে কি কর্ম্ম।বিশেষে ভগিনীপতি, মারিলে অধর্ম্ম।।ভাল হৈল দুষ্ট পাইল সমুচিত ফল।দোষ মত যত দণ্ড হইল সকল।।কিন্তু বধ্য নহে, রাখ ইহার জীবন।ভগিনী করিয়া রাঁড়ি নাহি প্রয়োজন।।ভগিনী ভাগিনা দোঁহে হইবে অনাথ।কান্দিবে সকলে আর মোর জ্যেষ্ঠতাত।।সে কারণে কহি ভাই শুনহ বচন।ছাড়হ, লইয়া যাক নির্লজ্জ জীবন।।রাজ-আজ্ঞা লঙ্ঘিবারে নারি বৃকোদর।জয়দ্রথে এড়ি বীর হইল অন্তর।।কতক্ষণে সংজ্ঞা পেয়ে সেই মূঢ়মতি।মনে মনে চিন্তা করে, পেনু অব্যাহতি।।নিঃশব্দে রহিল দুষ্ট হয়ে নম্রশির।ভৎসিয়া কনেহ তারে রাজা যুধিষ্ঠির।।কে দিল কুবুদ্ধি তোরে করিয়া কপটে।কি হেতু মরিতে এলি এমন সঙ্কটে।।ক্ষণেক না হৈত যদি মম আগমন।এতক্ষণ যাইতিস্ শমন সদন।।পলাইয়া যাহ লয়ে নিলর্জ্জ জীবন।কুবুদ্ধি দিলেক তোরে যেই দুষ্ট জন।।সেই সব জনে গিয়া কহিবে সকল।কত দিনান্তরে হবে সে সবার ফল।।তবে ধর্ম্ম কৃষ্ণারে কহিল এই কথা।দুঃখ মন তেজহ দ্রুপদ রাজ সুতা।।তোমারে দিলেক যত দুঃখ আর কষ্ট।এইমত সর্ব্বজন হইবেক নষ্ট।।এত বলি আশ্রমেতে যান ছয় জনে।দুষ্ট জয়দ্রথ তবে বিচারিল মনে।।৯৪. জয়দ্রথের শিবারাধনায় যাত্রাক্ষান্ত হইলেন যদি ভাই পঞ্চজনে।দুষ্ট জয়দ্রথ তবে বিচারিল মনে।।পাঠাইয়া দিল মোরে কৌরব প্রধান।তার কার্য্য সাধিবার বিধি কৈল আন।।কোন্ লাজে তারে গিয়া দেখাইব মুখ।উপায় চিন্তিব, যাতে খণ্ডিবেক দুঃখ।।এত কষ্ট দিল মোরে পাণ্ডব দুরন্ত।তা সবা জিনিলে মম দুঃখ হবে অন্ত।।ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম পাণ্ডব সকল।কেমনে হইব শক্য, আমি হীনবল।।তপোবলে পাণ্ডবেরা হয় বলবান।আমার তাপস্যা বিনা গতি নাহি আন।।কঠোর তপস্যা করি শুদ্ধ কলেবরে।তপেতে করিব তুষ্ট দেব মহেশ্বরে।।প্রসন্ন হইবে যবে কৈলাসের নাথ।পাণ্ডবে জিনিতে বর মাগিব পশ্চাৎ।।তবে যদি কার্য্যসিদ্ধি নহে কদাচন।ত্যজিব জীবন এই করিলাম পণ।।এত বলি হিমালয় পর্ব্বতে সে গেল।শুচি হয়ে মন আত্মা সংযত করিল।।নিয়ম করিয়া নিত্য করে নানা ক্লেশ।তপ আরম্ভিল করি হরের উদ্দেশ।।কত দিন বঞ্চিলেন খেয়ে মাত্র ফল।অতঃপর পান করে শুধু মাত্র জল।।গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালিয়া আগুনি।বসিয়া তাহার মাঝে দিবস রজনী।।বর্ষাকালে চারিমাস বসি বৃক্ষতলে।মস্তক পাতিয়া ধরে বরিষার জলে।।শীতেতে শীতল যথা সুশীতল নীর।তাহাতে নিমগ্ন হয়ে থাকে মহাবীর।।তপস্যায় বৎসরেক করি মহাক্লেশ।কঠোর তপেতে বশ হলেন মহেশ।।জানিয়া একান্ত ভক্তি দেব মহেশ্বর।মায়াদেহ ধরে হর বিপ্র কলেবর।।যথা জয়দ্রথ আছে হিমালয় গিরি।তাহার নিকটে চলিলেন ত্রিপুরারি।।সমাধি করিয়া রাজা আছয়ে নির্জ্জনে।নিমগ্ন করিয়া চিত্ত হরের চরণে।।হেনকালে ডাকি তারে বলেন ঈশ্বর।তপস্যা ত্যজহ রাজা, মাগ ইষ্টবর।।ইহা শুনি জয়দ্রথ উঠিল কৌতুকে।অপূর্ব্ব ব্রাহ্মণ মূর্ত্তি দেখিল সম্মুখে।।বিস্মিত হইয়া কহে, তুমি কোন্ জন।মহেশ কহেন, আমি দেব পঞ্চানন।।রাজা বলে, তুমি যদি দেব বিশ্বনাথ।তোমার যে নিজমূর্ত্তি ভুবনে বিখ্যাত।।কৃপা করি সেই রূপ করহ প্রকাশ।তবে সে আমার মনে হইবে বিশ্বাস।।ভক্ত জানি নিজ রূপ ধরিলেন হর।রজত পর্ব্বত জিনি দীপ্ত কলেবর।।কটিতটে ফণিরাজ, পরা বাঘছাল।শিরে জটা বিভূতি ভূষণ অক্ষমাল।।উপবীত নাগের, গলেতে হাড়মাল।সুচারু চন্দ্রের কলা শোভিয়াছে ভাল।।বাম করে শোভে শৃঙ্গ, দক্ষিণে ডমরু।দেখিয়া এমত রূপ বাঞ্ছাকল্পতরু।।আপনারে কৃতকৃত্য মানে মহাবল।দণ্ডবৎ হয়ে তবে পড়ে ভূমিতল।।অষ্টাঙ্গ লোটায় ধরি অভয় চরণ।ভক্তিভাবে বহুবিধ করিল স্তবন।।অনাথের নাথ তুমি, কৃপার নিধান।কৃপা করি নিজ গুণে কর পরিত্রাণ।।মহেশ কহেন, রাজা মাগ ইষ্টবর।শুনি জয়দ্রথ কহে যুড়ি দুই কর।।আমারে অনাথ দেখি কৃপা কর যদি।জিনিব পাণ্ডবে, আজ্ঞা কর কৃপানিধি।।এত শুনি শূলপাণি করেন উত্তর।মনোনীত দেখি রাজা চাহ অন্য বর।।জয়দ্রথ বলে, অন্য বরে কার্য্য নাই।জিনিব পাণ্ডবে আজ্ঞা করহ গোঁসাই।।মহেশ বলেন, তুমি নহ জ্ঞানযুত।পুনঃ পুনঃ কি কারণে কহ অসঙ্গত।।পাণ্ডব ভুবন-জয়ী, শুন মহামতি।তাহারে জিনিতে পারে কাহার শকতি।।মনুষ্য জানিয়া তুমি করহ অবজ্ঞা।আমিত তোমার মত নহি হীন প্রজ্ঞা।।প্রয়োজন নাহি আর কহিতে বিস্তর।অন্য যাহা ইচ্ছা, রাজা মাগ সেই বর।।আপনার ইষ্ট যে, সে শিবের অনিষ্ট।স্পষ্ট বুঝি পুনঃ কহে জয়দ্রথ দুষ্ট।।এখন জানিনু তুমি পাণ্ডবের সখা।কি হেতু আসিয়া দিলে অধমেরে দেখা।।যাহ প্রভু নিজ স্থানে করহ গমন।প্রাণ ত্যাগ করিব, করিনু নিরূপণ।।ধূর্জ্জটি বলেন, বাক্যবয় কর মিছা।করিবে যে কর, তবে আপনার ইচ্ছা।।পরাণ ত্যজহ কিম্বা যাহা লয় মতি।এই বর দিতে নাহি কাহার শকতি।।জয়দ্রথ পুনঃ বলে, করহ গমন।হেথায় রহিয়া তবে কোন্ প্রয়োজন।।নৃপতির এই বাক্য শুনি দিগম্বর।কৈলাস শিখরে যান দুঃখিত অন্তর।।পুনর্ব্বার জয়দ্রথ আরম্ভিল তপ।পাণ্ডবের পরাভব অন্তরেতে জপ।।নানা ক্লেশে মহাবীর বঞ্চে অহির্নিশি।তার তপ দেখি চমকিত সর্ব্ব ঋষি।।ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে করি অনাহার।হেনমতে বৎসরেক গেল পুনর্ব্বার।।হেরিয়া জয়দ্রথের তপ জপ ভক্তি।হরের রহিতে আর না হইল শক্তি।।যথায় নৃপতি বসি সহে তপঃক্লেশ।সন্নিকটে পুনরপি আসিয়া মহেশ।।রাজারে কহেন, তপ কর কি কারণ।চতুর্ব্বগ চাহ, যাহে লয় তব মন।।রাজ্য অর্থ বিধ্যা কিম্বা সন্ততি বৈভব।যাহা চাহ, তাহা লহ, কি আছে দুর্ল্লভ।।ইহা কহিলেন যদি করুণার নিধি।জয়দ্রথ নৃপতিরে বিড়ম্বিল বিধি।।মহামদে অন্ধ, রোষে আচ্ছাদিত মন।সকল ছাড়িয়া চাহে পরের হিংসন।।জয়দ্রথ বলে, যদি তুমি বর দিবে।নিশ্চয় আমার মন, জিনিব পাণ্ডবে।।ইহা বিনা অন্য বরে মম কার্য্য নাই।বুঝিয়া বিধান এই করহ গোঁসাই।।শুনিয়া কহেন শিব, শুনহ পামর।পৃথিবীতে কত শত আছে ইষ্ট বর।।ইহা ছাড়ি ইচ্ছা কর পরের হিংসন।বিশেষে পাণ্ডব তাহে, নহে অন্য জন।।অচ্ছেদ্য অভেদ্য যেই, অজেয় সংসারে।কোন জন হবে শক্য, জিনিতে তাহারে।।বিশেষ অর্জ্জুন নামে তাহে একজন।তাহার মহিমা বল জানে কোন জন।।পরম পুরুষ যেই ব্রহ্মা-সনাতন।দুই দেহ ধরিলেন নিজে নারায়ণ।।বিশেষে হরিতে পৃথিবীর মহাভার।নর নারায়ণ রূপে পূর্ণ অবতার।।নররূপ ধরে পার্থ কুন্তীর নন্দন।যদুকুলে শ্রীগোবিন্দ নিজে নারায়ণ।।মহামদে অন্ধমতি, না জান কারণ।অর্জ্জুনে জিনিতে বর দিবে কোন জন।।হইবে গোবিন্দ যবে অর্জ্জুনের পক্ষ।বর কিসে গণি, আমি না হইব শক্য।।যদ্যপি একান্ত কৃপা আছয়ে আমায়।আজ্ঞা কর জিনি যেন সহ ধনঞ্জয়।।জীবন সফল তবে, পূর্ণ হবে আশ।এত শুনি কহিলেন, পুনঃ কৃত্তিবাস।।বড় বংশ জন্মি তোর হীন বুদ্ধি হয়।কি কারণে করা রাজা অসৎ আশ্রয়।।অর্জ্জুন অজেয় জান, এ তিন ভুবনে।সুরাসুর নাগ নর আমা আদি জনে।।আমার একান্ত ভক্ত পার্থ মহাবীর।অভেদ অর্জ্জুন আমি, একই শরীর।।বিশেষ আমার মিত্র প্রধান যাদব।তাঁহার প্রধান সখা তৃতীয় পাণ্ডব।।আর ইন্দ্রদেব হৈতে লভিয়াছে জন্ম।ত্রিভুবনে বিখ্যাত যে অর্জ্জুনের কর্ম্ম।।জিনিতে নারিবে রাজা কভু হেন জনে।উপায় করিব এক তোমার কারণে।।অভিমন্যু পুত্র তার অতি বলবান।কৃষ্ণের ভাগিনা, প্রিয় প্রাণের সমান।।জিনিবে সমরে তারে দিলাম এ বর।বিমুখ করিবে আর চারি সহোদর।।আত্মা হৈতে পুত্র হয়, শাস্ত্রে হেন কয়।অভিমন্যু বধিলে জিনিবে ধনঞ্জয়।।আর দেখ অবধ্য পাণ্ডব পঞ্চ জন।অস্ত্রাঘাতে কদাচিৎ না হবে মরণ।।কি কর্ম্ম করিবে তারে করিয়া বিমুখ।চিরকাল পুত্রশোকে পাইবেক দুখ।।এত শুনি তুষ্টমতি হয়ে নরপতি।চরণে ধরিয়া বহু করিল প্রণতি।।কৈলাস শিখরে তবে যান মহেশ্বর।জয়দ্রথ যায় তবে হস্তিনা নগর।।মহাভারতের কথা সুধা সমতুল।কাশী কহে, ব্যাসের গাথা বিশ্বে অতুল।।৯৫. হস্তিনায় জয়দ্রথের আগমনহেথায় কৌরবপতি চিন্তাকুল হয়ে।নিত্য অনুতাপ করে মন্ত্রিগণ লয়ে।।রাজা বলে, কহ মোরে যত মন্ত্রিগণ।জয়দ্রথ নৃপতির বিলম্ব কারণ।।কেহ বলে, জয়দ্রথ গেল বহুদিন।কর্ম্মে কি হইবে শক্য বল বুদ্ধি-হীন।।কেহ বলে, পাণ্ডব দেখিল জয়দ্রথে।নিশ্চয় ত্যজিল প্রাণ ভীম-বজ্র-হাতে।।কেহ বলে, কার্য্যসিদ্ধি করিলে নারিল।লজ্জায় না দিল দেখা নিজ রাজ্যে গেল।।এইরূপে চিন্তাকুল আছে নরপতি।হেনকালে জয়দ্রথ আসিল দুর্ম্মতি।।নিরখিয়া ভূপতির আনন্দ প্রচুর।সভাশুদ্ধ নরপতি গেল কত দূর।।বহু কাল পরে পেয়ে বন্ধু দরশন।পরস্পর হর্ষভরে করে আলিঙ্গন।।তবে দুর্য্যোদন রাজা আনন্দিত মনে।হাতে ধরি বসাইল নিজ সিংহাসনে।।কৌতুকে করেন দোঁহে কথোপকথন।রাজা বলে, কহ শুনি বিলম্ব কারণ।।নিবেদিল জয়দ্রথ দুঃখ আপনার।পূর্ব্বাপর আদ্যোপান্ত যত সমাচার।।শুনি জয়দ্রথ মুখে সব বিবরণ।হরিষ বিষাদ মনে রহে দুর্য্যোধন।।দুর্য্যোধন বলে, আমি চিন্তা করি মিছা।হইবে অবশ্য যাহা ঈশ্বরের ইচ্ছা।।অকারণে চিন্তা করি নাহি প্রয়োজন।বিধির নিয়োগ হয় যখন যেমন।।সভা ভাঙ্গি নিজস্থানে গেল সর্ব্বজন।দুঃখ মনে নিজগৃহে রহে দুর্য্যোধন।।মহাভারতের কথা মহাকাব্য ভাণ্ড।শ্রীদ্বৈপায়ন রচিত অষ্টাদশ কাণ্ড।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon