শ্রীমদ্ভগবতগীতার তৃতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

অর্জুন বললেন, হে কেশব! যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞানই শ্রেষ্ট হয় তবে আমাকে এ ভয়ানক যুদ্ধে কেন নিয়োজিত করছ? তুমি কখনও জ্ঞানের এবং কখনও বা কর্মের প্রশংসা করে আমার বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করছ, আমাকে নিশ্চিত হয়ে বল কোনটি অমার পক্ষে শ্রেয়স্কর। শ্রীভগবান বললেন হে নিষ্পাপ অর্জুন! আমি পূর্বেই বর্ণনা করেছি যে, এ সংসারে জ্ঞানকর্ম ভেদে দুই প্রকারে ব্রহ্মলাভ বা মোক্ষলাভের পথ আছে । সাংখ্যেরা বা জ্ঞানীরা জ্ঞানযোগের দ্বারা এবং যোগীরা কর্মযোগের দ্বারা ব্রহ্মলাভ বা মোক্ষলাভ করেন। কিন্তু মনে রাখিও জ্ঞানযোগের দ্বারা বুদ্ধি স্থির হলেও ইচ্ছা করে কোন কর্ম না করলেও বাস্তবিক নৈষ্কর্ম্য হয় না এবং সংন্যাস বা কর্মত্যাগ করলেই যে সিদ্ধি লাভ হয় তাও নয়। কোন ব্যক্তিই কর্ম না করে ক্ষণকালও থাকতে পারে না। ইচ্ছা না করলেও প্রকৃতি নিজগুণে (সত্ত্ব, তম ও রজ) সমস্ত মানুষকেই কর্ম করতে বাধ্য করে। যে মূঢ় ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ স্মরণ করে, সে মূঢ় মিথ্যাচার বলে কথিত হয়। যে ব্যক্তি মন দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়গণকে বশীবূত করে আসক্তি পরিহারপূর্বক কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করে, অশুদ্ধচিত্ত সন্ন্যাসী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি সর্বদা নিত্য-নৈমিত্তিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান কর; কেননা কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেষ্ঠ। বিশেষত: কর্মহীন হলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হবে না। ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম ব্যতীত অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ; অতএব, হে কৌন্তেয়! তুমি নিষ্কাম হয়ে ভগবানের প্রীতির জন্য শাস্ত্রবিহিত কর্ম কর।
সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মা যজ্ঞের সহিত ব্রাহ্মণাদি প্রজাগণকে সৃষ্টি করে বলেছিলেন- হে প্রজাগণ! এ যজ্ঞ দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও; এ যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্ট প্রদানে কামধেনুর তুল্য হোক। এ যজ্ঞ দ্বারা তোমরা ইন্দ্রিয়াদি দেবতাগণকে সন্তুষ্ট করলে তাঁরা (দেবতারা) তোমাদের সন্তুষ্ট করবেন। এভাবেই পরপস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে। যজ্ঞের ফলে সন্তষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্চিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। সুতরাং দেবতা প্রদত্ত বস্তু দেবতাগণকে নিবেদন না করে যাঁরা ভোগ করে তারা নিশ্চয় চোর(অনিবেদিত অন্ন-ব্যঞ্জনাদি অপবিত্র)। যে সকল ভগবদ্ভক্তেরা যজ্ঞাবশেষ(নিবেদিত অন্ন) ভোজন করেন, তাঁরা সকল পাপ হতে মুক্ত হন। কিন্তু যে পাপাচারগণ বা পাপাত্মাগণ কেবল নিজের জন্য অন্নপাক করে তারা পাপই ভোজন করে।
অন্ন হতে প্রাণিগণের শরীর উৎপন্ন হয়, মেঘ হতে অন্নের উৎপত্তি হয়, যজ্ঞধূম হতে মেঘ সৃষ্টি হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম হতে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়। যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। বেদ অক্ষর পুরুষ বা পরমেশ্বর হতে উৎপন্ন হয়েছে। অতএব যজ্ঞেও সর্বময় ব্রহ্ম সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত আছেন। হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এ জীবনে ঈশ্বর কর্তৃক প্রবর্তিত কর্মচক্রের অনুগম না করে, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে। কিন্তু যে ব্যক্তি বিষয়ে রতি না হয়ে আত্মাতেই রতি বা প্রীতি হয়, যার আকাঙ্খা বহির্বিষয়ে তৃপ্ত না হয়ে আত্মরতিতেই তৃপ্ত হয় এবং যে এরূপে তৃপ্ত হয়ে সন্তুষ্টচিত্ত হওয়ায় অপর কোনও বিষয়ের কামনা করে না, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই। আত্মজ্ঞানীর ইহজগতে কর্মের অনুষ্ঠান করলে অথবা না করলে পূণ্য বা পাপ কিছুই হয় না। কারণ তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না। অতএব তুমি অনাসক্ত হয়ে সর্বদা কর্তব্য (নিত্য) কর্ম অনুষ্ঠান কর; আসক্তি পরিত্যাগ করে কর্মানুষ্ঠান করলে মোক্ষলাভ হয়। জনকাদি মহাত্মগণ নিষ্কাম কর্ম করেই মোক্ষ লাভ করেছিলেন। সুতরাং লোকসংগ্রহ বা সাধারণের উন্মার্গ প্রভৃতি নিবারণের জন্য ও তাদের শিক্ষার জন্যও কর্ম করা উচিৎ। কারণ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেরূপ কর্মের অনুষ্ঠান করেন, অন্যান্য সাধারণ মানুষেরা তার অনুসরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্যান্য মানুষ তারই অনুসরণ করে। হে পার্থ! দেখ, স্বর্গামর্ত্যাদি ত্রিলোকে আমার নিজের কোন কর্তব্যই নেই, কোন অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য বস্তু নেই তথাপিও আমি সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত আছি; কর্ম ত্যাগ করেনি। কারণ, হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে শুভ কর্মে প্রবৃত্ত না হই তবে কর্মের অধিকারী মুনুষ্যগণ সর্বদা আমারই পথ অনুসরণ করবে অর্র্থাৎ অলস হয়ে কর্মত্যাগ করবে। অতএব আমি কর্ম না করলে মনুষ্যগণ উৎসন্ন হবে। ফলে আমার দোষে বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হবে এবং প্রজাগণের সর্বনাশ ঘটবে। হে ভারত! অজ্ঞানীগণ যেমন আসক্ত হয়ে কর্মের অনুষ্ঠান করেন তেমনি জ্ঞানীগণ লোক শিক্ষার ইচ্ছায় অনাসক্ত হয়ে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন। বিদ্বান (ব্রহ্মজ্ঞ পন্ডিত) ব্যক্তিগণ কর্মাসক্ত অজ্ঞ ব্যক্তিদের বুদ্ধি প্রভেদ (বিভ্রান্ত না করে) না করে তিনি স্বয়ং বহু প্রকার কর্মানুষ্ঠান করে তাদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করবেন। প্রকৃতির গুণ দ্বারা ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে আসক্ত অর্থাৎ ফলের জন্য আমরা কর্ম করি - এরূপ অভিমান করে। আত্মবেত্তা বিদ্বান ব্যক্তিগণ প্রকৃতির গুণে বিমোহিত এরূপ লোকের বুদ্ধি বিচলিত করবেন না।
তুমি আমাতে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে, অন্তর্যামী পুরুয়ের অধীন হয়ে “আমি” কর্ম করছি এ প্রকার ভেবে কামনা, মমতা ও শোক পরিত্যাগপূর্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। যারা শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হয়ে (অর্থাৎ আমার উপদেশের মিথ্যা দোষ না ধরে) আমার এ মতের অনুগমন করে তারাও সমস্ত কর্ম বন্ধন হতে মুক্ত হন। কিন্তু যারা অসূয়াপূর্বক হয়ে পুর্বোক্ত মতের অনুসরণ করেন না তাদেরকে সকল জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় ও পরামার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে। সকল প্রাণিই নিজ নিজ প্রকৃতির বশে কার্য করে থাকে। এমন কি জ্ঞানবান ব্যক্তিও প্রকৃতির বশীভূত। অতএব নিগ্রহ বা বলপূর্বক ইন্দ্রিয়দমনে কি ফল লাভ হবে? সকল ইন্দ্রিয়েরই অনুকূল বিষয়ে আসক্তি ও প্রতিকূল বিষয়ে বিরক্তি আছে। এ উভয়ই প্রাণির পরম শক্র। অতএব ইহাদের বশীভূত হওয়া উচিৎ নয় কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বর্ণাশ্রমবিহিত স্বধর্ম সাধনে নিধনও কল্যাণকর; কিন্তু অন্যের বর্ণাশ্রমোচিত ধর্মের অনুষ্ঠান অধোগতির কারণ বলে বিপজ্জনক। হে বার্ষ্ণেয়! মানুষ কার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়। পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে উদ্ভুত কামই মানুষকে এ পাপে প্রবৃত্ত করে, এ কামই প্রতিহত হলে ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শক্র বলে জানবে। অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে সেরূপ কাম জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। হে কৌন্তেয়! এ কাম জ্ঞানীদের চিরশক্র। ইহা অনলের ন্যায় দুষ্পূরণীয়। এ তৃষ্ণারূপ কাম দ্বারা বিবেক বুদ্ধি আবৃত থাকে। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও সংকল্পবিকল্পাত্মক মন এবং নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি) কামের আশ্রয়স্থল। এ ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে। হে ভরতর্ষভ! এ জন্যে তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপরূপ কামকে বিনাশ কর। স্থূলদেহ হতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয় হতে মন এবং মন হতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। আর বুদ্ধি হতেও যিনি শ্রেষ্ঠ তিনি হচ্ছেন “আত্মা”। হে অর্জুন! তুমি শুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা মনকে সমাহিত করে বুদ্ধির দ্রষ্টা পরমাত্মাকে এরূপ জেনে অজ্ঞানমুলক দুর্জয় শক্র কামকে জ্ঞান দ্বারা বিনাশ কর।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র