মহাভারত:বনপর্ব-০৮১-০৮৫

৮১. দুর্য্যোধনের সপরিবারে
প্রভাস তীর্থে যাত্রা
জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান।
শুনিতে বাসনা বড় ইহার বিধান।।
সর্ব্বজন গেল যদি হইয়া বিদায়।
কি কর্ম্ম করিল সবে রহিয়া কোথায়।।
মুনি বলে, অবধান কর কুরুবর।
কৃষ্ণা সহ কাম্যবনে পঞ্চ সহোদর।।
প্রভাস তীর্থের তীরে বিচিত্র কানন।
ফল পুষ্প অপ্রমিত মৃগ পশুগণ।।
মৃগয়া করেন নিত্য বীর ধনঞ্জয়।
রন্ধনে দ্রুপদ সুতা আনন্দ হৃদয়।।
তীর্থ করি আইলেন ধর্ম্মের নন্দন।
শ্রুতমাত্র মিলিলেন পূর্ব্বের ব্রাহ্মণ।।
পূর্ব্বমত ভোজনাদি করে দ্বিজবৃন্দ।
লক্ষ্মীরূপা যাজ্ঞসেনী রন্ধনে আনন্দ।।
এই মত পঞ্চ ভাই কাননে নিবসে।
হেথা দুর্য্যোধন রাজা আনন্দেতে ভাসে।।
বিপুল বৈভব ভোগ করে ইন্দ্র প্রায়।
অর্থ রাজ্য সৈন্য যত, কহনে না যায়।।
নিজরাজ্য ধর্ম্মরাজ্য একত্র মিলিত।
বিশেষ সে রাজ্য পূর্ব্বে অর্জ্জুন শাসিত।।
সে সকল রাজা হৈল তার অনুগত।
কর দিয়া সবে তারা থাকে শত শত।।
অশ্ব গজ পত্তি যত, কে করে গণনা।
সমুদ্র সমান সব অপ্রমিত সেনা।।
ইন্দ্র দেবরাজ যথা অমর সমাজে।
দুর্য্যোধন মহারাজ পৃথিবীর মাঝে।।
এক দিন সভাস্থলে বসি কুরুপতি।
শকুনি বলিছে তারে, শুন পৃথ্বীপতি।।
উজ্জ্বল ভারতবংশ হৈল তোমা হৈতে।
তুমি মহারাজ হৈলে ভুবন মাঝেতে।।
তোমার সমান কভু না দেখি বিপক্ষ।।
কর দিয়া সেবে তোমা রাজা লক্ষ লক্ষ।
হয় হস্তী রথ পত্তি চতুরঙ্গ দল।
কুবের জিনিয়া রত্ন ভাণ্ডার সকল।।
বিপুল বৈভব তব ইন্দ্রের সমান।
কিন্তু মনে করি আমি এক মন্দ জ্ঞান।।
যেই পুষ্প না হইল ঈশ্বরে অর্পিত।
যে ধনে নাহিক হয় ব্রাহ্মণ সুতৃপ্ত।।
যে সম্পদ ভুঞ্জি নাহি বন্ধুগণ তুষ্ট।
যে সম্পদ শত্রুগণ না করিল দৃষ্ট।।
সে সকল ব্যর্থ বলি পূর্ব্বাপর কয়।
এই অনুতাপ মম জাগিছে হৃদয়।।
সদা তৃপ্ত আছে তব গুণে যত বন্ধু।
পৃথিবী করিল দীপ্ত তব যশ ইন্দু।।
এ সকল অতুল ঐশ্বর্য্য যে হইল।
দুঃখ মোর এ সম্পদ শত্রু না দেখিল।।
পূর্ব্বে ভাল মন্ত্রণা না করিলাম সব।
দেশ ছাড়ি বনে পাঠাইলাম পাণ্ডব।।
নগরের অন্তে যদি অর্পিতাম স্থল।
নিত্য নিত্য দেখাতাম ঐশ্বর্য্য সকল।।
হেরি মনাগুণে দগ্ধ হৈত পঞ্চ জন।
অসহ্য বজ্রের সম বাজিত সঘন।।
কোথায় রহিল গিয়া নির্জ্জন কাননে।
তোমার ঐশ্বর্য্য এত জানিবে কেমনে।।
কর্ণ বলে, যা কহিলে গান্ধারাধিকারী।
ইহা অনুশোচি আমি দিবস শর্ব্বরী।।
নারীর যৌবন যথা স্বামীর বিহনে।
শক্তি শৌর্য্য ব্যর্থ না দেখিলে শত্রুগণে।।
বিভব হয় যে নষ্ট বৈরী না হেরিলে।
বিধির নিয়ম ইহা আমি জানি ভালে।।
যত দিন ইহা সব না দেখে পাণ্ডব।
লাগয়ে আমার মনে বিফল এ সব।।
কিন্তু এক করিয়াছি বিচার নির্ণয়।
বুঝিয়া করহ কার্য্য, উচিত যে হয়।।
প্রভাস তীর্থের তীরে তপস্বীর বেশে।
বাস করে শত্রুগণ তথা নানাক্লেশে।।
সবে চল যাব তথা স্নান করিবারে।
হইবে অনন্ত পুণ্য স্নানে তীর্থনীরে।।
হয় হস্তী রথ পত্তি চতুরঙ্গ দল।
সবাকার পরিবার ভৃত্যাদি সকল।।
ইন্দ্রের অধিক তব বিপুল বিভব।
দেখিয়া দ্বিগুণ দগ্ধ হইবে পাণ্ডব।।
ঘোষযাত্রা করি, সর্ব্বলোকেতে কহিবে।
কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ ক্ষত্তা কেহ না জানিবে।।
ইহার বিধান এই মম মনে আসে।
এই যাত্রায় দুই কার্য্য, হৈবে বিশেষে।।
কর্ণের এতেক বাণী শুনি সেইক্ষণ।
সাধু সাধু প্রশংসা করিল দুর্য্যোধন।।
দুঃশাসন জয়দ্রথ ত্রিগর্ত্ত প্রভৃতি।
সাধু সাধু বলি উঠে যতেক দুর্ম্মতি।।
কর্ণ বলে, বিলম্ব না কর কুরুপতি।
সুসজ্জ সকল সৈন্য কর শীঘ্রগতি।।
আজ্ঞামাত্র দুঃশাসন হইল বাহির।
ডাকিল সকল সৈন্য সব যোদ্ধা বীর।।
যত বন্ধু বান্ধব সহিত পরিবার।
নারীগণ শুনি হৈল আনন্দ অপার।।
দ্রৌপদী সহিত দেখা দ্বিতীয় উৎসব।
তীর্থস্নান তৃতীয় চিন্তিয়া এই সব।।
বিশেষে সন্তুষ্টা নারী যাত্রা মহোৎসবে।
সর্ব্বকাল বন্দীরূপে থাকে বদ্ধভাবে।।
নৃযান গোযান আর অশ্বযান সাজে।
রথে রথী চড়িল পদাতি পদব্রজে।।
বাহিনী সাজিছে বহু বাজিছে বাজনা।
সমুদ্র সদৃশ সেনা, কে করে গণনা।।
সাজাইয়া সর্ব্বসৈন্য দুঃশাসন বেগে।
করযোড়ে দাণ্ডাইল নৃপতির আগে।।
শুনিয়া কৌরবপতি উঠিল সম্ভ্রমে।
বাহির হইয়া নিরীক্ষয়ে ক্রমে ক্রমে।।
সমুদ্র লহরী যেন রথের পতাকা।
মেঘের সদৃশ হস্তী, নাহি যায় লেখা।।
মনোহর মনোজ্ঞ উত্তম তুরঙ্গম।
পৃথিবী আচ্ছাদি বীর বিশাল বিক্রম।।
সশস্ত্র সকল সৈন্য দেখিতে সুন্দর।
শমন সভয় হয়, কিবা ছার নর।।
কর্ণ বলে, বিলম্বে নাহিক প্রয়োজন।
ভীষ্মদেব শুনে যদি করিবে বারণ।।
এই হেতু তিলেক না বিলম্ব যুয়ায়।
শীঘ্রগতি চল সখা, এই অভিপ্রায়।।
শুনিয়া কৌরবপতি বিলম্ব না কৈল।
গমন সময়ে সব বিদুর জানিল।।
যথা রাজা সৈন্যমাঝে যায় শীঘ্রগতি।
মধুর বচনে কহে দুর্য্যোধন প্রতি।।
শুনি তাত, যাবে নাকি প্রভাসের স্নানে।
পুণ্যকার্য্যে বাধা নাহি করি, সে কারণে।।
কুরুবংশ শ্রেষ্ঠ তুমি রাজচক্রবর্ত্তী।
পূরিল ভুবন তিন তোমার সুকীর্ত্তি।।
এ সময়ে যত কর ধৈর্য্য আচরণ।
ভূষিত বিভব হবে, দ্বিগুণ শোভন।।
সবাকার মন মুগ্ধ প্রভাস গমনে।
নিষেধ না করি আমি, এই সে কারণে।।
নানা চিত্র বিচিত্র সুন্দর বনস্থল।
দেবতা গন্ধর্ব্ব তথা নিবসে সকল।।
বহু সিদ্ধি ঋষিগণ উপনীত তথা।
কার সনে দ্বন্দ্ব নাহি করিবে সর্ব্বথা।।
দুর্য্যোধন বলে, তাত যে আজ্ঞা তোমার।
যদি দ্বন্দ্ব করি তবে কি ভয় আমার।।
মম সৈন্য দেখ তাত তোমার প্রসাদে।
ইন্দ্র যম আসে যদি জিনিব বিবাদে।।
তথাপি বিরোধে মম কোন প্রয়োজন।
শীঘ্র তুমি নিজ গৃহে করহ গমন।।
বিদুরে মেলানি করি কৌরবের পতি।
না করি বিলম্ব আর চলে শীঘ্রগতি।।
বিনা ভীষ্ম দ্রোণ দ্রোণী কৃপাচার্য্য বীর।
সর্ব্বসৈন্যে দুর্য্যোধন হইল বাহির।।
চলিতে চরণভরে কম্পিতা ধরণী।
ধূলা উড়ি আচ্ছাদিল দিনে দিনমণি।।
সৈন্য কোলাহল জিনি সাগর গর্জ্জন।
প্রমাদ গণিল সবে, না বুঝি কারণ।।
নগর ছাড়িয়া বনে করিল প্রবেশ।
মহাঘোর শব্দে পূরিল বনপ্রদেশ।।
মেঘেরে সদৃশ ধূলি গগনমণ্ডলে।
বহু ক্ষেত্র ভাঙ্গি সবে চলে বহু স্থলে।।
ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।
৮২. দুর্য্যোধনের সৈন্য দর্শনে ভীমার্জ্জুনের
রণসজ্জা ও যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা
এখানে প্রভাতে উঠি ভাই পঞ্চ জন।
নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম করি সমাপন।।
স্নান হেতু যান সবে সহ দ্বিজগণ।
ফল পুষ্প হেতু কেহ প্রবেশের বন।।
মৃগয়া করিতে যান ভীম ধনঞ্জয়।
রাজার নিকটে রহে মাদ্রীর তনয়।।
মহাবনে প্রবেশিল ক্রমে দুই ভাই।
রাশি রাশি মৃগ মারিলেন ঠাঁই ঠাঁই।।
বন ভ্রমণেতে দোঁহে শ্রান্ত কলেবর।
বিশ্রাম করেন বসি দুই সহোদর।।
শুনিলেন হেনকালে সৈন্য কোলাহল।
প্রলয় গর্জ্জন যেন সাগরের জল।।
কটকের পদধূলি ঢাকিল গগন।
মেঘে আচ্ছাদিল যেন সূর্য্যোর কিরণ।।
বলেন অর্জ্জুন প্রতি পবন নন্দন।
চল শীঘ্র মৃগয়াতে নাহি প্রয়োজন।।
শুন ভাই, হইতেছে, সৈন্য কোলাহল।
পদধূলি আচ্ছাদিল গগন মণ্ডল।।
কৃষ্ণা সহ রহিলেন পাণ্ডবের ‍নাথ।
বিশেষ বালক মাদ্রীপুত্র দুই সাথ।।
কি কর্ম্ম করিনু ভাই আসি দুই জনে।
কেবা আসি বিরোধিল ধর্ম্মের নন্দনে।।
এতেক বিচারি শীঘ্র যান দুই জন।
হেথায় মাদ্রী পুত্রে করিয়া সম্বোধন।।
সবিস্বয়ে কহেন যে ধর্ম্ম নৃপমণি।
দেখ ভাই বনে আসে কাহার বাহিনী।।
মৃগয়া করিতে গেল ভীম ধনঞ্জয়।
বিলম্ব দেখিয়া মম আকুল হৃদয়।।
এই বনে বাস করে গন্ধর্ব্ব কিন্নর।
বিরোধে আসক্ত সদা বীর বৃকোদর।।
কি জানি কাহার সাথে হইল বিরোধ।
বনে কিবা এসেছিল কোন মহাযোধ।।
আর এক মম মনে জাগে যে সংশয়।
ক্লেশযুক্ত শক্তিহীন দেখিয়া আমায়।।
বনমাঝে থাকি আমি তপস্বীর বেশ।
সহায় সম্পদহীন, নাহি রাজ্য দেশ।।
দুষ্টবুদ্ধি কর্ণ শকুনির মন্ত্রনায়।
মন্দবুদ্ধি দুর্য্যোধন আসে বা হেথায়।।
শীঘ্র কহ সহদেব করিয়া নির্ণয়।
হেনকালে উপনীত ভীম ধনঞ্জয়।।
দেখিয়া আনন্দ চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।
আলিঙ্গন দিয়া কন, কহ বিবর।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব নির্ণয় না জানি।
ঘোর শব্দে আসিতেছে কাহার বাহিনী।।
শুনিয়া বিস্ময় বড় জন্মিল হৃদয়।
বিশেষ ‍রাখিয়া হেথা গেলাম তোমায়।।
ব্যগ্র হয়ে শীঘ্র আসিলাম সে কারণে।
ধর্ম্ম বলিলেন, ইহা হয়েছিল মনে।।
তোমা দুই জনে দ্বন্দ্ব হইল কার সনে।
করিতেছিলাম চিন্তা আমি সে কারণে।।
তোমা দোঁহা দেখি গেল সন্দেহ সকল।
কিন্তু কাছে ক্রমে আসে সৈন্য কোলাহল।।
বিপক্ষ স্বপক্ষ পরপকষ এস জানি।
অনুমানে বুঝি ভাই অনেক বাহিনী।।
আজ্ঞামাত্র পার্থ রথ করিতে স্মরণ।
কপিধ্বজ যুক্ত রথ দিল দরশন।।
ধর্ম্মেরে প্রণাম করি পার্থ উঠি রথে।
চলিলেন বায়ুবেগে অন্তরীক্ষ পথে।।
শব্দ অনুসারে পার্থ পশ্চিমেতে যান।
দেখেন কৌরব সেনা সমুদ্র প্রমাণ।।
ধ্বজ ছত্র রথ রথী পদাতি কুঞ্জর।
দেখি জানিলেন পার্থ কৌরব পামর।।
তবে পুনঃ ফিরি আসি অতি শীঘ্রগতি।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিলা যথা ধর্ম্মপতি।।
পার্থে দেখি আগু হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।
জিজ্ঞাসেন কনেহ, দেব কি জিজ্ঞাস আর।
দেখিলাম সৈন্য সহ কুরু কুলাঙ্কার।।
আমা সবা হিংসিবারে আসিল এখানে।
নহে এই বনস্থলে কোন্ প্রয়োজনে।।
এত শুনি মহাক্রোধে বীর বৃকোদর।
আস্ফালন করি ভুজ উঠিল সত্বর।।
করযোড় করি বলে সম্বোধিয়া ধর্ম্ম।
দেখ মহারাজ দুষ্ট দুর্য্যোধন কর্ম্ম।
কপটে কপটী সব রাজ্যধন নিল।।
জটা বল্ক পরাইয়া কাননে পাঠাল।
দেশ হৈতে রত্ন ধন কিছু নাহি আনি।
কোনমতে তার বাঞ্ছা নাহি কৈনু হানি।।
সময় নির্ণয় মোরান না করি লঙ্ঘন।
তথাচ আসিল দুষ্ট করিতে হিংসন।।
ধর্ম্ম হেতু এত কষ্ট আমা পঞ্চ জনে।
সে ধর্ম্ম ফলিল আজি দুষ্ট দুর্য্যোধনে।।
এতেক যে সৈন্য সাজি আসিছে হেথায়।
তবু মনে লাগে ক্ষুদ্র পতঙ্গের প্রায়।।
প্রসন্ন হইয়া রাজা আজ্ঞা কর মোরে।
মুহূর্ত্তেকে সংহারিব শতেক সোদরে।।
উঠ শীঘ্র ধনঞ্জয়, বিলম্বে কি কাজ।
এত অপমানে কি তিলেক নাহি লাজ।।
নিয়ম পূরিতে দিন যে কিছু আছয়।
মোরা না লঙ্ঘিনু, সেই পাপিষ্ঠ লঙ্ঘয়।।
হে নকুল সহদেব বীরের প্রধান।
স্ববাঞ্ছিত সিদ্ধি কেন না কর বিধান।।
এতেক কহিল যদি বৃকোদর বীর।
ক্রোধেতে অস্থির হৈল পার্থের শরীর।।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত ঢালি দিল।
মাদ্রীপুত্র দুই জন গর্জ্জিয়া উঠিল।।
সুসজ্জ করিল সবে যার যে বাহন।
তূণ হৈতে লন তুলি দিব্য অস্ত্রগণ।।
আড়া ভাঙ্গি তূণমধ্যে রাখে পুনর্ব্বার।
ধনুকেতে গুণ দিয়া দিলেন টঙ্কার।।
কবচে আবৃত তনু, নানা অস্ত্র পেঁচি।
দেবদত্ত শঙখনাদ কৈল সব্যসাচী।।
পুনঃ পুনঃ গদা লোফে পবননন্দন।
তখন কহেন ধর্ম্ম মধুর বচন।।
শুন ভাই কোন্ কর্ম্ম তোমার অসাধ্য।
সহজে অর্জ্জুন এই দেবের অবধ্য।।
বালসূর্য্যসম দুই মাদ্রীর তনয়।
ইন্দ্র যম আসে যদি, কিবা তাহে ভয়।।
কিন্তু আগে কারণ করহ নিরূপণ।
কোন কার্য্য হেতু হেথা আসে দুর্য্যোধন।।
বনেতে ভ্রমণ কিংবা হেতু তীর্থ স্নান।
মৃগয়া করিতে কিবা করিল বিধান।।
নির্ণয় না জানি আগে যদি কর যুদ্ধ।
নিশ্চিত হইবে তবে ধর্ম্মপথ রুদ্ধ।।
যদি আগে তারা হিংসা করিবে তোমার।
তুমিও মারিও তারে, নাহিক বিচার।।
দুর্ব্বলের বল ধর্ম্ম, তাহে ক হেলা।
দুস্তর সাগরে আর আছে কোন্ ভেলা।।
ধর্ম্মপুত্র মুখে শুনি এতেক বচন।
বিরস বদনে নিবর্ত্তিল চারি জন।।
কূলে নিবারিল যেন সমুদ্র লহরী।
সুসজ্জ বসিল সবে ধর্ম্ম বরাবরি।।
সম্মুখে বসিল যত ব্রাহ্মণ মণ্ডল।
অমর বেষ্টিত যেন দেব আখণ্ডল।।
মৃগচর্ম্ম কুশাসনে তপস্বীর বেশ।
বল্ক পরিধান, শিরে জটাভার কেশ।।
কথোপকথনে অতি সবার আনন্দ।
হেনকালে আসে দুর্য্যোধন মতিমন্দ।।
ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী আর ভাই পঞ্চ জনা।
দক্ষিণ করিয়া চল নৃপতির সেনা।।
আগে চলে অগণিত পদাতিক ঢালী।
মনোরম তুরঙ্গমে সহ মহাবলী।।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ তবে মেঘবর্ণ হাতী।
অসংখ্য বিচিত্র চিত্র কত শত রথী।।
হেনকালে কৌরবের যত ‍নারীগণ।
ঘুচাল রথের যত বস্ত্র আচ্ছাদন।।
অঙ্গুলীতে দেখাইয়া কহে এই বাণী।
দেখ দেখ কুটীরেতে দ্রুপদ নন্দিনী।।
বড় ভাগ্যে দেখিলাম, কহে সর্ব্বজনা।
পাছে পাছে চলে সৈন্য, কে করে গণনা।।
শকট বলদ উষ্ট্রে নানা দ্রব্য বহে।
সঙ্গে কত শত ভোক্ষ্য ভোজ্য পেয় রহে।।
যে কিছু বিভব বিত্ত রাজার আছিল।
সংহতি সুহৃদ বন্ধু সকলি আনিল।।
উপমার যোগ্য হেন নহে সুরপতি।
বর্ণনা করিতে তাহা কাহার শকতি।।
এইরূপে যায় রাজা কৌরবের পতি।
প্রলয় কালের যেন কলরব অতি।।
সম্ভাষা করিতে এল সঞ্জয় নন্দন।
সম্ভ্রমে সবার করে চরণ বন্দন।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন কহ সমাচার।
কোন্ ধর্ম্মে দুর্য্যোধন করে আগুসার।।
সঞ্জয় নন্দন বলে, কর অবধান।
করিবেন ঘোষযাত্রা প্রভাসেতে স্নান।।
রাজা বলে, এ কর্ম্মে আমার অভিপ্রায়।
আর মোর আশীর্ব্বাদ কহিবে রাজায়।।
এ তীর্থে অনেক সিদ্ধ ঋষির আলয়।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ সম্প্রদায়।।
দেখ তিনি কুরুকুলে শ্রেষ্ঠ নরপতি।
বিরোধ না হয় যেন কাহার সংহতি।।
তথা হৈতে শুনিয়া সঞ্জয়সুত গেল।
ধর্ম্মের যতেক কথা রাজারে কহিল।।
শুনি অহঙ্কারে মূঢ় অবজ্ঞা করিল।
অবজ্ঞায় দুষ্ট কর্ণ শকুনি হাসিল।।
সহজে তপস্বী লোকে দেবতার ভয়।
কার শক্তি ক্ষত্রিয়ের কাছে অগ্র হয়।।
এত বলি মৌনভাবে রহে সর্ব্বজনে।
পুণ্যতীর্থ প্রভাসতে যায় কতক্ষণে।।
নানা চিত্র বিচিত্র উদ্যান মনোহর।
প্রফুল্ল কমলবনে গুঞ্জরে ভ্রমর।।
কোকিল কুহরে নিত্য নিজ মত্ততায়।
মুনির মানস হরে বসন্তের বায়।।
বিবিধ বনের শোভা কে করে বর্ণন।
দেখিয়া সানন্দচিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।।
দুঃশাসন কর্ণ আদি হরিষ বিধান।
রহিল সকল সৈন্য যথাযোগ্য স্থান।।
সারি সারি বস্ত্রগৃহ দেখিতে সুরঙ্গ।
পর্ব্বত সমান যেন পর্ব্বতের শৃঙ্গ।।
বেড়িল প্রভাসে যথা প্রভাসের বারি।
কৌতুক বিধানে স্নান করে যত নারী।।
তবে দুর্য্যোধন রাজা সহোদর শত।
ত্রিগর্ত্ত শকুনি কর্ণ অমাত্য আবৃত।।
স্নান করি কুতূহলে করে নানা দান।
হয় হস্তী গবীগণ, নাহি পরিমাণ।।
পরম কৌতুকে সবে স্নান দান করি।
বিচিত্র বসন নানা অলঙ্কার পরি।।
জলপান করি তবে বসে সর্ব্বজন।
কৌতুকে বসিয়া করে তাম্বূল চর্ব্বণ।।
আলস্য ত্যজিয়া কেহ করিল শয়ন।
কেহ পাশা খেলে, কেহ করয়ে রন্ধন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।
৮৩. দুর্য্যোধনের সৈন্যসহ
চিত্রসন গন্ধর্ব্বের যুদ্ধ
এইমত রহে সৈন্য যুড়ি বনস্থল।
গতায়াতে লণ্ডভণ্ড উদ্যান সকল।।
হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটনে।
গন্ধর্ব্ব উদ্যান এক ছিল সেই বনে।।
চিত্রসেন নাম তাঁর গন্ধর্ব্ব-প্রধান।
যাঁর নামে সুরাসুর হয় কম্পমান।।
তাঁহার কিঙ্কর ছিল বনের রক্ষক।
দেখিল, উদ্যান ভাঙ্গে রাজার কটক।।
বহু সৈন্য দেখি একা না করি বিরোধ।
দুর্য্যোধন অগ্রে গিয়া কহিছে সক্রোধ।।
শুন রাজা মোর বাক্য কর অবগতি।
প্রভু মোর চিত্রসেন, গন্ধর্ব্বের পতি।।
কুসুম উদ্যান তাঁর এই বনে ছিল।
প্রবেশি তোমার সৈন্য সকলি ভাঙ্গিল।।
বনের রক্ষক আমি, কিঙ্কর তাঁহার।
না করিলে ভাল কর্ম্ম, কি কহিব আর।।
এই কথা, মোর মুখে পাইলে সম্বাদ।
আসিয়া ইঙ্গিতে রাজা করিবে প্রমাদ।।
এত শুনি মহাক্রোধে কহে বীর কর্ণ।
বিকচ কমল প্রায় চক্ষু রক্তবর্ণ।।
ওরে দুষ্ট এত কর কার অহঙ্কার।
কি ছার গন্ধর্ব্ব তোর, কিবা গর্ব্ব তার।।
যে কথা কহিলি তুই আসি মম কাছে।
এতক্ষণ জীয়ে রহে, হেন কেবা আছে।।
সহজে অত্যল্প বুদ্ধি দ্বিতীয়ে নফর।
যাহ শীঘ্র আন গিয়া আপন ঈশ্বর।।
বলাবল বুঝি লব সংগ্রামের কালে।
কর্ণের বিক্রম সেই জানে ভালে ভালে।।
এত বলি ঢেকা মারি বাহির করিল।
মহাদুঃখ মনে রক্ষী কান্দিয়া চলিল।।
বসি আছে চিত্রসেন আপন আবাসে।
হেনকালে অনুচর কহে মৃদুভাষে।।
রক্ষা হেতু তুমি মোরে রাখিলে উদ্যানে।
দুর্য্যোধন রাজা আসে প্রভাসের স্নানে।।
তার সৈন্য উদ্যান করিল লণ্ডভণ্ড।
রাজারে কহিনু গিয়া তার এই কাণ্ড।।
কতেক কুৎসিত ভাষা কহিল তোমারে।
দুর্য্যোধন-সেনাপতি কর্ণ নাম ধরে।।
মনুষ্য হইয়া করে এত অহঙ্কার।
দোষমত দণ্ড যদি না দিবা তাহার।।
এইমত দুষ্টাচার করিবেক সবে।
লঘু গুরু মনুষ্য দেবেতে কিবা তবে।।
এত শুনি মহাক্রোধে উঠিল গন্ধর্ব্ব।
কি ছার মনুষ্য, আজি নাশিব যে গর্ব্ব।।
মরণকালেতে পিপীলিকা পাখা উঠে।
যাইতে করিল বাঞ্ছা শমন নিকটে।।
ক্রোধভরে রথারোহে চলে শীঘ্রগতি।
ধনুক টঙ্কার শুনি কম্পমান ক্ষিতি।।
দিব্য সুশাণিত শরে পূরি যুগ্ম তূণ।
ক্রোধভরে আসিতেছে জ্বলন্ত আগুন।।
কত দূরে দেখে সবে রথের পতাকা।
শূন্যপথে আসে যেন জ্বলন্ত উলকা।।
কুরুসৈন্য নিকটে আইল সেইক্ষণে।
কহিতে লাগিল অতি গভীর গর্জ্জনে।।
আরে দুষ্ট ত্যজ আজি জীবনের সাধ।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্বে বিবাদ।।
এতেক বলিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।
মুহূর্ত্তেকে শরজালে কৈল অন্ধকার।।
শুনিয়া গন্ধর্ব্ব গর্ব্ব কর্ণে হৈল ক্রোধ।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ ধায় মহাযোধ।।
সূর্য্য-অস্ত্র এড়িলেন সূর্য্যের নন্দন।
হাসি চিত্রসেন অস্ত্র কৈল নিবারণ।।
তবে ত গন্ধর্ব্ব এড়ে তীক্ষ্ণ পাঁচ বাণ।
অর্দ্ধপথে কর্ণবাণে হৈল দশখান।।
গন্ধর্ব্ব দেখিল, অস্ত্র কাটিলেক কর্ণ।
ক্রোধে কম্পমান তনু, চক্ষু রক্তবর্ণ।।
সিংহমুখ দিব্য অস্ত্র যুড়িল ধনুকে।
অস্ত্রে অগ্নি বাহিরায় ঝলকে ঝলকে।।
মহাবীর কর্ণ তবে অপূর্ব্ব সন্ধানে।
কাটিল গন্ধর্ব্ব অস্ত্র, অর্দ্ধচন্দ্র বাণে।।
সর্পবাণ যুড়িল যে গন্ধর্ব্ব তখন।
যুড়িল গরুড়বাণ সূর্য্যের নন্দন।।
তবে কর্ণ দিব্য ভল্ল মন্ত্রে অভিষেকি।
সগর্ব্বে কহিল কর্ণ চিত্রসেনে ডাকি।।
আরে দুষ্ট অহঙ্কারে না দেখ নয়নে।
গর্ব্ব চূর্ণ হবে আজি পড়ি মোর বাণে।।
আকর্ণ পূরিয়া কর্ণ কৈল নিক্ষেপণ।
উঠিয়া আকাশ পথে করিল গর্জ্জন।।
অস্ত্র দেখি ব্যস্ত হয়ে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।
শীঘ্রহস্তে এড়ে বীর চোক চোক শর।।
দুই অস্ত্রে মহাযুদ্ধ হইল অম্বরে।
কাটিল দোঁহার অস্ত্র দোঁহাকার শরে।।
অস্ত্র ব্যর্থ দেখি কর্ণ সক্রোধ অন্তর।
চিত্রসেনে প্রহারিল শতেক তোমার।।
বাণাঘাতে ব্যগ্র হয়ে গন্ধর্ব্বের পতি।
ডাকিয়া বলিল তবে কর্ণ বীর প্রতি।।
ধন্য তোর বীরপণা, ধন্য তোর শিক্ষা।
এখন বুঝহ তুমি আমার পরীক্ষা।।
এতেক বলিয়া প্রহারিল দশ বাণ।
ব্যথায় ব্যথিত কর্ণ হইল অজ্ঞান।।
কতক্ষণে চেতন পাইলা মহাবল।
বেড়িল গন্ধর্ব্বে আসি কৌরব সকল।।
শতপূর করিয়া বেড়িল সর্ব্ব সেনা।
ধনুক টঙ্কার যেন সঘন ঝন্ঝনা।।
দশদিক যুড়িয়া করিল অন্ধকার।
গন্ধর্ব্ব সবার অস্ত্র করিল সংহার।।
প্রাণপণে সবে যুদ্ধ করিল বিস্তর।
সবে নিবারণ করে গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।।
পরশুরামের শিষ্য কর্ণ মহাবীর।
অচল পর্ব্বত প্রায় যুদ্ধে রহে স্থির।।
রাখিয়া আপন সেনা আপন বিক্রমে।
প্রহরেক পর্য্যন্ত যুঝিল মহাশ্রমে।।
তবে ত গন্ধর্ব্ব মনে করিল বিচার।
জানিল কৌরব সেনা রণে অনিবার।।
মায়া বিনা এ সকল নারিব জিনিতে।
মায়ার পুত্তলী এই বিচারিল চিতে।।
রথ লুকাইল তবে না দেখি যে আর।
অর্ন্তদ্ধান করি কৈল বাণে অন্ধকার।।
অন্তরীক্ষে পড়ে বাণ, দেখে সর্ব্বজনে।
অচ্ছিদ্রে বরিষে যেন ধারার শ্রাবণে।।
কোথায় গন্ধর্ব্ব আছে, কেহ নাহি দেখে।
বৃষ্টিবৎ অস্ত্র সব পড়ে লাখে লাখে।।
মুখে মাত্র মার মার শুনি সবাকর।
সৈন্যেতে অক্ষত জন না রহিল আর।।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।
হয় হাতী রথ রথী কে করে অবধি।।
কতক্ষণ রণ সহি ছিল কর্ণ বীর।
তাহার সহিত কিছু সৈন্য ছিল স্থির।।
শূন্য তূণ, ছিন্ন গুণ, অঙ্গে শ্রমজল।
বিষণ্ণ বদন সবে হইল বিকল।।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল কর্ণবীর।
পলায় কৌরবসেনা ভয়েতে অস্থির।।
অম্বর ‍নাহিক কার, নাহি বান্ধে কেশ।
পলায় সকল সৈন্য, পাগলের বেশ।।
বেগে ধায়, পশ্চাৎ না চায়, কোন জন।
স্ত্রীগণ রক্ষকমাত্র রাজা দুর্য্যোধন।।
কতক্ষণ সহে যুদ্ধ, প্রাণ ব্যগ্রতায়।
হেনকালে চিত্রসেন আইল তথায়।।
দুর্য্যোধনে ডাকি বলে পরিহাস বাণী।
গগনে গরজে যেন ঘোর কাদম্বিনী।।
আরে মন্দমতি দুষ্ট রাজা দুর্য্যোধন।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্ব চালন।।
কোথা তোর সে বন্ধু সহায় সমুদিত।
একেলা রহিলি নারীগণের সহিত।।
এই অহঙ্কারে তুমি না দেখ নয়নে।
আজিকার রণে যাবি শমন সদনে।।
মহাভারতের কথা পুণ্য গীতিগান।
ভবসিন্ধু তরিতে নাহি ইহার সমান।।
৮৪. চিত্রসেন কর্ত্তৃক কুরুনারীগণ সহ
দুর্য্যোধনকে বন্দীকরণে ও কুরুনারীগণের
যুধিষ্ঠিরের সমীপে দূত প্রেরণ
কর্ণ ভঙ্গ দি রণে, ব্যাকুল গন্ধর্ব্ব বাণে,
পলায় সক সেনাপতি।
পলায় ত্রিগর্ত্ত নাথ, সৌবল শকুনি সাথ,
কর্ণ দুঃশাসন বিবিংশতি।।
যত যত মহাবীর, রণেতে নহিল স্থির,
প্রমাদ গণিয়া সর্ব্বজন।
কে করে তাহার লেখা, কেবল রাখিয়া একা,
নারীবৃন্দ সহ দুর্য্যোধন।।
মহাত্রস্ত হয়ে যায়, নারীপানে নাহি চায়,
রথ চালাইয়া শীঘ্রগতি।
অশ্ব গজ ধায় রড়ে, পথেতে পদাতি পড়ে,
উঠে, হেন নাহিক শকত।।
হেনমতে সৈন্য সব, করি মহা কলরব,
প্রাণ লয়ে পলায় তরাসে।
হাহাকার কোলাহল, পূর্ণ হল বনস্থল,
দেখিয়া গন্ধর্ব্বপতি হাসে।।
তবে দুর্য্যোধনে কয়, দুষ্টবুদ্ধি পাপাশয়,
না জানিস্ গন্ধর্ব্ব কেমন।
আরে মন্দ মতিমান, ভালমন্দ নাহি জ্ঞান,
অহঙ্কারে করিস্ হেলন।।
না জানিস্ নিজ বল, এখনি উচিত ফল,
মোর হাতে অবশ্য পাইবে।
লইব তোমার প্রাণ, ইহাতে নাহিক আন,
মনের বাসনা পূর্ণ হবে।।
এত বলি নিজ অস্ত্র, যুড়িলেন লঘুহস্ত,
গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর ক্রোধমনে।
অব্যর্থ জানয়ে সন্ধি, এবে সে করিয়া বন্দী,
ধরিলেক রাজা দুর্য্যোধনে।।
বন্দী হৈল কুরুশ্রেষ্ঠ, স্বপক্ষ দিলেক পৃষ্ঠ,
দোসর নাহিক আর সাথে।
স্ত্রীবৃন্দ সহিত রাজা, রথে তুলে মহাতেজা,
শীঘ্রগতি যায় স্বর্গপথে।।
ঘোর আর্ত্তনাদ করি, কান্দয়ে সকল নারী,
হায় হায় ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
কপালে কঙ্কণাঘাত, ঘন ডাকে জগন্নাথ,
পার কর বিপত্তি সাগরে।।
মোরা সর্ব্বধর্ম্ম হীন, পাপকর্ম্ম প্রতিদিন,
তব ভক্তিলেশ নাহি মনে।
সত্য মোরা হীনতপা, কেবল করহ কৃপা,
দীনবন্ধু নামের কারণে।।
ইত্যাদি অনেক করি, স্তুতি করে কুলনারী,
কেহ নিন্দা করে নিজ পতি।
দুষ্টবুদ্ধি স্বামীগণ, ধর্ম্মে হিংসে অনুক্ষণ,
সে কারণে হৈল হেন গতি।।
কুরুশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মপতি, ধর্ম্মেতে যাঁহার মতি,
অনুগত ভাই চারি জন।
কেবল ধর্ম্মের সেতু, প্রাণ ত্যজে ধর্ম্ম হেতু,
তাঁরে দুঃখ দিল দুর্য্যোধন।।
সতী সাধ্বী পতিব্রতা, দেব দ্বিজ অনুগতা,
সতত ধর্ম্মেতে যাঁর মতি।
লক্ষ্মীঅংশ যাজ্ঞসেনী, সভামধ্যে তারে আনি,
চুলে ধরি করিল দুর্গতি।।
সে ধর্ম্ম ফলিল আজি, বিপদ সাগরে মজি,
সবাই হারানু জাতি কুল।
বার্ত্তা পেয়ে ধর্ম্মরাজ, জানিয়া কুলের লাজ,
কেবল রক্ষার মাত্র মুল।।
তবে দুর্য্যোধন নারী, এই যুক্তি মনে করি,
অনুচরে কহে শীঘ্রগতি।
বিলম্ব না কর তাত, যথা পাণ্ডবের নাথ,
কহ গিয়া সকল দুর্গতি।।
কহিবে বিনয় করি, মো সবার নাম ধরি,
নিশ্চয় মজিল কুরুবংশ।
মো সবার কর্ম্মফলে, এ কুৎসা কলঙ্ক কুলে,
চিত্রসেন হাতে জাতি ধ্বংস।।
অনুচর কহে বাণী, সত্য কহ ‍ঠাকুরাণী,
পাসরিলা পূর্ব্বকথা সব।
যে কর্ম্ম করিয়া তাঁরে, পাঠাইলা বনান্তরে,
তাহা বিনা কে আছে বান্ধব।।
যে আজ্ঞা তোমার মাতা, এখনি যাইব তথা,
কহিব সকল সমাচার।
ধর্ম্মরাজ মহাশয়, বীর বটে ধনঞ্জয়,
ভীম হস্তে নাহিক নিস্তার।।
রাণী বলে ধর্ম্মরাজ, জানিয়া কুলের লাজ,
আমা সবার আপদ ভঞ্জনে।
না করিবে ভেদমতি, পরদুঃখে দুঃখী অতি,
উদ্ধারিতে পাঠাবে অর্জ্জুনে।।
স্বামী মোর অপরাধী, ইহাতে অবজ্ঞা যদি,
করিয়া উদ্ধার না করিবে।
মিলিয়া সকল নারী, বিষ ভগ্নি ভর করি,
কিংবা জলে প্রবেশি মরিবে।।
এত শুনি শীঘ্র দূত, গেল যথা ধর্ম্মসুত,
মাদ্রীর তনয় ভীমার্জ্জুন।
বেষ্টিত ব্রাহ্মণভাগে, করযোড় করি আগে,
কহিতে লাগিল সকরুণ।।
অবধান মহারাজ, দৈবের দুর্গতি কাজ,
রাজা এল প্রভাসের স্নানে।
বিধির নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম, খণ্ডন না যায় ধর্ম্ম,
বন্দী হৈল চিত্রসেন-বাণে।।
গন্ধর্ব্বের মায়াবলে, পোড়াইল অস্ত্রানলে,
প্রাণেতে কাতর যত সেনা।
কর্ণ শাল্ব দুঃশাসন, যত মহাযোধগণ,
প্রাণ লয়ে যায় সর্ব্বজনা।।
একা ছিল দুর্য্যোধন, রক্ষা হেতু নারীগণ,
প্রাণপণে যুঝিল রাজন।
যতেক নারীর সহ, করাইয়া রথারোহ,
লয়ে যায় করিয়া বন্ধন।।
প্রতিকারে নহে শক্য, পৃষ্ঠভঙ্গ দিল পক্ষ,
শেষে যায় জাতি কুল প্রাণ ।
আকুল হইয়া মনে, তব ভ্রাতৃ বধূগণে,
পাঠাইয়া দিল তব স্থান।।
আরো বা কি কব আমি, আজন্ম আমার স্বামী,
অপরাধী তোমার চরণে।
কুলের কলঙ্ক ভয়, ভয়ার্ত্ত জনের ভয়,
দূর কর আপনার গুণে।।
ইহা সবাকার দোষে, যদি এই অভিরোষে,
উদ্ধার না কর ধর্ম্মপতি।
হইবে বধের ভাগী, জীব বা কিসের লাগি,
অনল গরল জলে গতি।।
তোমার কুলের নারী, গন্ধর্ব্ব লইয়া হরি,
যাবৎ না যায় অতি দূর।
দেখিয়া উচিত কর্ম্ম, করহ কুলের ধর্ম্ম,
রক্ষা কর কুলের ঠাকুর।।
শুনিয়া চরের কথা, মর্ম্মে পাইলেন ব্যথা,
ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
কুলের কলঙ্ক আর, ভয়ান্বিত অবলার,
রক্ষা হেতু হৈলেন অস্থির।।
বিষম নিগ্রহ জানি, বিচারিয়া নৃপমণি,
অর্জ্জুনে কহেন সবিশেষ।
শীঘ্র আন দুর্য্যোধনে, কহি চিত্রসেন স্থানে,
যাবৎ না যায় নিজ দেশ।।
বিনয় পূর্ব্বক তথা, কহিবা মধুর কথা,
বহুবিধ আমার বিনয়।
যদি তাহে সাম্য নহে, দ্বৈপায়ন দাস কহে,
দণ্ড দিবা উচিত যে হায়।।
৮৫. ধর্ম্মাজ্ঞায় ভীমার্জ্জুনের যুদ্ধযাত্রা এবং
নারীগণের সহিত দুর্য্যোধনের মুক্তি
যুধিষ্ঠির বলিলেন, যাহ শীঘ্রগতি।
গন্ধর্ব্ব না যায় যেন আপন বসতি।।
ছাড়াইয়া আন গিয়া প্রধান কৌরবে।
প্রণয়পূর্ব্বক হৈলে দ্বন্দ্ব না করিবে।।
এত যদি কহিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
গর্জ্জিয়া উঠিল ভীম অর্জ্জুন সুমতি।।
ধন্য মহাশয় তুমি ধর্ম্ম অবতার।
এখনো ঈদৃশ চিত্তে মহত্ত্ব তোমার।।
আমা সবাকারে দুষ্ট যতেক করিল।
কাল পেয়ে সেই ফল এখন ফলিল।।
অহর্নিশি ‍জাগে সেই মনের অনিষ্ট।
গন্ধর্ব্ব করিল তাহা, ঘুচিল অরিষ্ট।।
অধর্ম্মে বাড়ায় রাজা অধর্ম্মীর সুখ।
তাহা দেখি নিত্য পায় পরম কৌতুক।।
ক্রমে ক্রমে সকল সংসার করে জয়।
যথাকালে মূল সহ বিনাশিত হয়।।
যত গর্ব্ব করিল কৌরব দুরাশয়।।
নিঃশত্রু হইল রাজ্য, চল নিজালয়।
এতেক বলেন যদি ভাই দুই জন।
মনেতে চিন্তেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
বিনা ক্রোধে কার্য্যসিদ্ধি না হয় নিশ্চয়।
তবে ধর্ম্ম কহিলেন ডাকি ধনঞ্জয়।।
কহিলে যতেক পার্থ অন্যথা না করি।
সে মম পরম শত্রু, আমি তার বৈরী।।
আত্মপক্ষে ঘরে দ্বন্দ্ব করিব যখন।
তারা শত সহোদর মোরা পঞ্চ জন।।
সেই দ্বন্দ্ব হয় যদি পরপক্ষগত।
তখন আমরা ভাই পঞ্চোত্তর শত।।
সে কারণে কহি ভাই করিতে উদ্ধার।
পূর্ব্বাপর আছে ভাই নীতি বিধাতার।।
আর এক কথা শুন বিচারিয়া মনে।
যদি না আনিবে তুমি রাজা দুর্য্যোধনে।।
দুষ্টবুদ্ধি অতিশয় রাজা চিত্রসেনে।
পশ্চাৎ হইবে তার অহঙ্কার মনে।।
লইবেক দুর্য্যোধনে সহ নারীবৃন্দ।
অমর মণ্ডলী তথা আছেন সুরেন্দ্র।।
সবাকার ‍আগে কহিবেক সমাচার।
জিনিনু কৌরবসেনা রণে অনিবার।।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ জন তথায় আছিল।
যত মোর পরাক্রম বসিয়া দেখিল।।
তাহার কুলের বধূ সহ দুর্য্যোধনে।
বান্ধিয়া আনিনু দেখিলেক সর্ব্বজনে।।
বারণ করিতে শক্তি নহিল কাহার।
কহিবে ইন্দ্রের আগে এই সমাচার।।
শুনিয়া হাসিবে যত অমর সমাজ।
অবজ্ঞা করিবে তোমা ইন্দ্র দেবরাজ।।
তুমি যে অবজ্ঞা কর ভাবিয়া বিপক্ষ।
দেবতা জানিবে, তুমি বলেতে অশক্য।।
আনিতে বলিনু আমি ইহা মনে করি।
নহে দুর্য্যোধন মম কোন উপকারী।।
শুনিয়া উঠিল কোপে বীর ধনঞ্জয়।
এমত কহিবে দুষ্টবুদ্ধি পাপাশয়।।
এই দেখ মহাশয় তোমার প্রসাদে।
না জীবে গন্ধর্ব্ব আজি, পড়িল প্রমাদে।।
এত বলি মহাক্রোধে উঠিয়া অর্জ্জুন।
গাণ্ডীব নিলেন হাতে বান্ধি যুগ্ম তূণ।।
যুধিষ্ঠিরে প্রণমিয়া করি কৃতাঞ্জলি।
রথে গিয়া চড়িলেন শ্রীগোবিন্দ বলি।।
পবন গমন জিনি চলে স্বর্গপথ।
ক্ষণে উত্তরিল যথা চিত্রসেন রথ।।
পাছে যান ধনঞ্জয় ফিরিয়া নেহালি।
শীঘ্রগতি রথ চালাইল মহাবলী।।
তবে পার্থ মনে মনে করেন বিচার।
পলায় গন্ধর্ব্ব ভয়ে অই কুলাঙ্গার।।
অতিবেগে ধায় রথ, যাবে স্বর্গমাঝে।
বিদিত হইবে তবে দেবতা সমাজে।।
ইহা জানি শরজালে রোধিলেন পথ।
ফাঁফর গন্ধর্ব্বপতি নাহি চলে রথ।।
চতুর্দ্দিকে ফিরি দেখে, যেতে নাহি শক্য।
পিঞ্জরের মধ্যে যেন রহে পোষা পক্ষ।।
সেইক্ষণে উপনীত বীর ধনঞ্জয়।
দেখিয়া গন্ধর্ব্বপতি কহে সবিনয়।।
কহ পার্থ কোন কাজে আসিলে হেথায়।
দুর্য্যোধন উপকারে আসিতেছ প্রায়।।
এই সে আশ্চর্য্য বড় লাগে মোর মনে।
আজন্ম হিংসিল দুষ্ট তোমা পঞ্চ জনে।।
কহিতে না পরি পূর্ব্বে দিল যত ক্লেশ।
সম্প্রতি দেখি যে বনে তপস্বীর বেশ।।
তাহার উচিত ফল পায় দৈববশে।
পথ ছাড় শীঘ্রগতি, যাই নিজ বাসে।।
পার্থ বলিলেন, জ্ঞান নাহিক তোমায়।
কহিলে যতেক কথা পাগলের প্রায়।।
আপনা আপনি লোক যত দ্বন্দ্ব করে।
আত্মপক্ষ কভু নহে প্রতিপক্ষ পরে।।
ইহাতে এতেক ছিদ্র কহিস অজ্ঞান।
আমা সবে ভিন্ন ভাব করেছিস্ জ্ঞান।।
যুধিষ্ঠির তুল্য মম ভাই দুর্য্যোধন।
তাহারে লইয়া যাস্ করিয়া বন্ধন।।
এই কুলবধূগণে তুমি লয়ে যাবে।
লোকেতে হইবে কুৎসা, কলঙ্ক রটিবে।।
কুলের কুৎসায় সুখী কুলাঙ্গার জন।
কি মতে সহিবে তাহা আমার এ মন।।
এই হেতু শীঘ্রগতি আইনু হেথায়।
ছাড় দুর্য্যোধনে, নহে যাবে যমালয়।।
করহ সকলে মুক্ত, নহে ফল দিব।
মুহূর্ত্তে শমন-গৃহে তোমারে পাঠাব।।
চিত্রসেন বলে, তোর জানিলাম মতি।
বুঝিয়া করিল বিধি এতেক দুর্গতি।।
মরিতে বাসনা তব হইল নিশ্চয়।
দুই ভাই এক সঙ্গে যাবি যমালয়।।
এত বলি দিল শীঘ্র ধনুকে টঙ্কার।
দশ দিক শরজালে হৈল অন্ধকার।।
দেখি পার্থ হইলেন জ্বলন্ত অনল।
নিমিষের মধ্যে কাটিলেন সে সকল।।
দোঁহার বিচিত্র শিক্ষা দোঁহে লঘু হস্ত।
বৃষ্টিবৎ শত শত পড়ে কত অস্ত্র।।
কাটিল দোঁহার অস্ত্র দোঁহাকার শরে।
জ্বলন্ত উলকা প্রায় উঠয়ে অম্বরে।।
হইল দোঁহার অঙ্গ শরেতে জর্জ্জর।
ভ্রুভঙ্গ তিলেক নাহি, দোঁহে ধনুর্দ্ধর।।
গন্ধর্ব্ব আপন মায়া করিল প্রকাশ।
সন্ধান পূরিয়া অস্ত্র এড়িলেন পাশ।।
দিব্য অস্ত্র এড়ি পার্থ করে নিবারণ।
দশ অস্ত্র অঙ্গে তার করেন ঘাতন।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রাক্ষসিক দীক্ষা।
নরেতে নাহক তুল্য অর্জ্জুনের শিক্ষা।।
যে বাণে গন্ধর্ব্ব বান্ধে রাজা দুর্য্যোধনে।
সেই বাণ ধনঞ্জয় যুড়ে ধনুর্গুণে।।
বান্ধি গন্ধর্ব্বের গলা ভুজের সহিত।
নিজ রথে চড়াইয়া চলেন ত্বরিত।।
দুর্য্যোধন নারী সহ গন্ধর্ব্বের পতি।
মুহূর্ত্তেকে উপনীত ধর্ম্মের বসতি।।
সমর্পিয়া সকলেরে করে নিবেদন।
যেমতে গন্ধর্ব্বপতি করিলেক রণ।।
যুধিষ্ঠির খুলিলেন দোঁহার বন্ধন।
পার্থে অনুযোগ করিলেন অগণন।।
এই চিত্রসেন হয় গন্ধর্ব্বের পতি।
ইহাকে উচিত নহে এতেক দুর্গতি।।
চিত্রসেনে কহিলেন, তুমি মতিমন্ত।
চালন করহ কেন ক্ষত্রিয় দুরন্ত।।
বালক অর্জ্জু ন করিলেক অপরাধ।
চাহিয়া আমার মুখ করহ প্রসাদ।।
না কহিবে ইন্দ্রকে এ সব অপমান।
যাহ শীঘ্র নিজালয়ে, করহ প্রয়াণ।।
শুনিয়া গন্ধর্ব্বপতি আনন্দিত মনে।
আশীর্ব্বাদ করি তবে চলে সেইক্ষণে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র