শ্রীমদ্ভগবতগীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আমি পূর্বে এ অব্যয় জ্ঞানযোগ সূর্য্যকে বলেছিলাম, সূর্য্য তার নিজ পুত্র মনুকে বলেছিলেন, মনু তা তার পুত্র ইক্ষ্বাকুকে বলেছিলেন। হে পরন্তপ! পরম্পরাক্রমে রাজর্ষিগণ এ যোগ লাভ করেছিলেন কিন্ত কালের প্রভাবে ইহলোকে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল। এ অনাদিসিদ্ধ জ্ঞানেযোগ আজ আমি তোমাকে বললাম। কেননা তুমি আমার ভক্ত ও সখা। তাই তুমি এ জ্ঞানের রহস্য হৃদঙ্গম করতে পারবে। অর্জুন বললেন, হে ভগবন! তোমার জন্মেরবহুপূর্বে সূর্য্যদেব জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে তুমি যে সৃষ্টির প্রারম্ভকালে সূর্য্যদেবকে এ জ্ঞানযোগের বৃত্তান্ত বলেছিলেন তা আমি কেমন করে জানতে পারি?তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে অর্জুন! আমি বহুবার জন্মগ্রহণ করেছি। তোমারও অনেক বার জন্ম হয়েছে। কিন্ত তুমি তা স্মরণ করতে পারছ না। কিন্ত আমি সমস্ত কিছূ জ্ঞাত আছি। আমি জন্মমরণরহিত এবং সর্বভূতেশ হয়েও নিজ মায়াকে অবলম্বনপূর্বক জন্ম পরিগ্রহ করে থাকি। হে ভারত! যে যে সময়ে ধর্মের গ্লানি হয়ে থাকে এবং অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয, সে সে সময় আমি দেহ ধারণ করে অবতীর্ণ হই। সাধুদের রক্ষা, দুষ্টদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। হে অর্জুন! যিনি আমার এ দিব্য জন্ম ও কর্মবৃত্তান্ত যথাযথভাবে জানেন, দেহান্তর হলেও তার পুনর্জন্ম হয় না। তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
বিষয়াসক্ত, ভয় ও ক্রোধ বর্জিত, আমাতে একাগ্রচিত্ত এবং আমার শরণাগত বহু ব্যক্তি জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা পবিত্র হয়ে আমার স্বরূপ লাভ করেছেন। হে পার্থ! যারা যে ভাবে আমাকে উপাসনা করে, আমি তাদেরকে সেভাবে অনুগ্রহ করে থাকি। কর্মাধিকারী মুনুষ্যগণ নানা প্রকারে পূজা করলেও তারা একমাত্র আমারই অনুসরণ করে থাকে। মনুষ্যলোকে কর্মসমূহের ফল অবিলম্বে পাওযা যায়। তাই মানুষেরা কর্মাফলাকাঙ্খী হয়ে প্রায়ই ইহলোকে দেবতার পূজা করে থাকে। আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে সমাজে চারিটি বর্ণ বিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের সৃষ্টি কর্তা হলেও আমাকে অকর্তা ও অব্যয় বলে জানবে। কোন কর্মই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না, কোন কর্মফলের বাসনও আমার নেই। যে ব্যক্তি এরূপে আমাকে জানেন তিনিও কোন কর্মফলে আবদ্ধ হন না। আত্মাকে এরূপ অকর্তা ও অভোক্তা জেনে প্রাচীন সমস্ত মুক্ত পুরুষেরা (জনকাদি) নিষ্কাম কর্ম করেছেন। অতএব তুমিও সেই প্রাচীন মহাজনদের ন্যায় নিষ্কাম কর্ম কর।
কর্তব্য কর্ম কি এবং অকর্তব্য কি উহা নিরূপণ করতে বুদ্ধিবান ব্যক্তিগণও মোহপ্রাপ্ত হন। এ জন্য আমি তোমাকে কর্ম ও অকর্ম বিষয়ে উপদেশ প্রদান করছি। তুমি তা জেনে সমস্ত অশুভ অবস্থা হতে মুক্ত হতে পারবে। । কর্মের অতিগুঢ় রহস্য হৃদয়ঙ্গম করা অত্যন্ত কঠিন। তাই বিহিত কর্ম, অবিহিত কর্ম ও কর্মত্যাগ সম্পর্কে যথাযথভাবে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি কর্মসত্ত্বেও কর্মহীন, কর্ম অসত্ত্বেও কর্মযুক্ত বলে নিজেকে মনে করেন তিনিই মানুষদের মধ্যে বুদ্ধিমান। সব রকম কর্মে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত। যার কর্মসমূহ কামনাশূন্য এবং তার কর্মসকল জ্ঞানাগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়েছে, জ্ঞানিগণ তাকে পন্ডিত বলে থাকেন। যিনি কর্মফলের আসক্তি সর্ম্পূণরুপে ত্যাগ করে সবর্দা তৃপ্ত এবং কোন রকম আশ্রয়ের অপেক্ষা করেন না, তিনি সব রকম কর্মে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও কর্মফলের আশায় কোন কিছুই করেন না। যার চিত্ত ও দেহ বিশুদ্ধ হয়েছে; যিনি কামনা ও সর্বপ্রকার বিষয় পরিগ্রহ ত্যাগ করেছেন; তিনিই কর্তৃত্বাভিমানবর্জিত হয়ে কেবল শরীর দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করে পাপভাগী হন না। যিনি অনায়াসে যা লাভ করেন তাতেই সন্তষ্ট থাকেন, যিনি শীত-উষ্ণ, সুখ-দু:খ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না; মাৎসর্য্যরহিত, যার সিদ্ধি ও অসিদ্ধি বিষয়ে সমান জ্ঞান তিনি স্বাভাবিক কর্ম করেও সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হন না। যিনি রাগ দ্বেষাদি পরিত্যাগপূর্বক নিষ্কাম হয়েছেন; যার চিত্ত জ্ঞানে অবস্থান করছে, তিনি যজ্ঞাদি কর্ম সকলকে রক্ষা করার জন্য কর্মের অনুষ্ঠান করলেও সে কর্ম সকল ফল সহিত বিনষ্ট হয়ে থাকে।
অর্পণ ব্রহ্ম, ঘৃতও ব্রহ্ম, অগ্নিতে ব্রহ্মরূপ হোতা যে হোম করছে তাও ব্রহ্ম এবং যজ্ঞাদি দ্বারা লভ্য স্বর্গাদিওর ব্রহ্ম। এরূপ কর্মে যার ব্রহ্মবুদ্ধি তিনি ব্রহ্মকেই লাভ করেন। কোন কোন যোগী পূর্বোক্ত প্রকারে দৈব যজ্ঞাদি করে থাকেন অপর তত্ত্ববেত্তা যোগীগণ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আত্মাকে আহুতি প্রদান করে থাকেন। অন্যান্য কিছু পুরুষ শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণকে সংযমরূপ অগ্নিতে, আর কতিপয় পূরুষ শব্দাদি বিষয়রাশিকে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দান করে থাকেন। কোন কোন যোগী ইন্দ্রিয়গণের কর্ম ও প্রাণাদির কর্মরাশিকে জ্ঞানোদ্দীপিত আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে হোম করে থাকেন। কোন কোন ব্যক্তি দ্রব্য ত্যাগরূপ যজ্ঞ, কোন কোন ব্যক্তি তপোরূপ যজ্ঞ, কোন কোন ব্যক্তি জ্ঞানরূপ যজ্ঞ এবং কোন কোন যত্নশীল পুরুষ অত্যন্ত দৃঢ়ব্রতরূপ যজ্ঞ করে থাকেন। অন্যান্য যোগীগণ অপান বায়ুতে প্রাণের আহুতি প্রদান করেন, অপর কেহ কেহ প্রাণে অপানের হোম করে এবং অন্যান্য কোন কোন সংযতাহারী যোগী প্রাণ ও অপানের গতি রোধপূর্বক প্রাণায়ামপরায়ণ হয়ে প্রাণে জ্ঞানেন্দ্রিয়কে ও কর্মেন্দ্রিয়কে আহুতি দিয়ে থাকেন। এ সকল যজ্ঞকারিগণ যজ্ঞ সম্পাদনপূর্বক নিষ্পাপ হয় যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত ভোজন করে সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। এরূপ যজ্ঞানুষ্ঠানবিহীন মনুষ্যগণ এ মনুষ্য লোকই প্রাপ্ত হয় না, তবে স্বর্গাদি তো দূরের কথা। এ সকল বহুবিধ যজ্ঞ বেদমুখে বিস্তৃত হয়েছে (শাস্ত্রে কথিত হয়েছে), এ সমস্ত কর্ম বিভিন্ন কর্মজাত, আত্মার সহিত কোন সম্পর্ক নেই । সেগুলি জানার মাধ্যমে তুমি সংসার হতে মুক্তি লাভ করতে পারবে। হে পরন্তপ! দ্রব্যময় যজ্ঞাদি অপেক্ষা জ্ঞানময় যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। কারণ ফলের সহিত সমস্ত কর্মই জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়ে থাকে।
হে অর্জুন! তুমিব্রহ্মবেত্তা গুরুর চরণে দন্ডবৎ প্রণাম করে বিনম্র চিত্তে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর এবং অকৃত্রিম সেবায় তাদের সন্তষ্টু কর তাহলে তত্ত্বদর্শী গুরুগণ তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে জ্ঞান উপদেশ করবেন। হে পান্ডব! এভাবে জ্ঞান লাভ করলে তুমি আর মোহাভিভূত হবে না এবং এ জ্ঞানের দ্বারা তুমি আপনাতে সমস্ত ভূতগণকে অভিন্ন দেখে অবশেষে পরমাত্মাতে আত্মাকে অভেদ দর্শন করবে। তুমি যদি অন্যান্য সকল পাপী থেকেও অধিকতর পাপী হয়ে থাক তাহলেও সে পাপরূপ সমুদ্র এ জ্ঞানরূপ নৌকা দ্বারা অনায়াসে পার হতে পারবে। হে অর্জুন! প্রজ্জ্বলিত অগ্নি যেমন কাষ্ঠসমূহে দগ্ধ করে তেমনি জ্ঞানাগ্নিও সমস্ত কর্মকে ভস্মসাৎ করে থাকে। এ ইহ জগতে জ্ঞানের মত পবিত্রতাকারক আর কোন বস্তুই নেই। কর্মযোগ দ্বারা যিনি এ জ্ঞান লাভ করেছেন তিনি কালক্রমে আত্মায় পরা শান্তি লাভ করেন। যিনি ইন্দ্রিয়গুলোকে বশীভূত করে শ্রদ্ধাসহকারে গুরুজনের আজ্ঞাবহ ও শুশ্রূষারত হন, তিনিই জ্ঞান লাভ করে অবিলম্বেই মোক্ষ লাভ করেন। অজ্ঞ, শাস্ত্রে শ্রদ্ধাহীন (জ্ঞান ও কর্মের অনুষ্ঠান বিষয়ে) সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি পরমার্থের অযোগ্য হয়। সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির ইহলোকও নেই,পরলোকও নেই এবং ঐহিক সুখও নেই। হে ধনঞ্জয়! সমত্ববুদ্ধিরূপ যোগ দ্বারা যিনি সমস্ত কর্ম ভগবানকে অর্পণ করেছে এবং আত্মজ্ঞান দ্বারা যাঁর সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়েছে তাকে কোন কর্মই আবদ্ধ করতে পারে না। অতএব হে ভারত! তুমি জ্ঞানরূপ খড়্গ দ্বারা হৃদয়স্থিত অজ্ঞানসম্ভূত সংশয় নাশপূর্বক কর্মযোগ অনুষ্ঠান কর এবং যুদ্ধের জন্য উঠে দাঁড়াও।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র