মহাভারত:আদিপর্ব-৭৭-৮১

৭৭. যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যে অভিষেক
মুনি বলিলেন, রাজা কর অবধান।
অনন্তর শুন পিতামহ উপাখ্যান।।
ধৃতরাষ্ট্র নরপতি বুঝিয়া বিধান।
যুবরাজ করিতে করেন অনুমান।।
কুরুকুলে জ্যেষ্ঠ কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির।
সকল জনের প্রিয় ধর্ম্মশীল ধীর।।
যুধিষ্ঠিরে অভিষেক কৈল যুবরাজ।
হইল পরম প্রীত সকল সমাজ।।
যুধিষ্ঠির-সৌজন্যেতে সবে রৈল বশে।
পৃথিবী হইল পূর্ণ ধর্ম্মপুত্র-যশে।।
ভীমার্জ্জুন দুই ভাই রাজাজ্ঞা পাইয়ে।
চতুর্দ্দিকে রাজগণে বেড়ায় শাসিয়ে।।
জিনিলে অনেক দেশ, কত লব নাম।
বহু রাজা সহ হৈল অনেক সংগ্রাম।।
উত্তর পশ্চিম পূর্ব্ব জম্বুদ্বীপ আদি।
জিনিয়া আনিল দোঁহে বহু রত্ন নিধি।।
কুরুকুলে ক্রমে যেই অসাধ্য আছিল।
ভীমার্জ্জুনে দুই ভাই আয়ত্ত করিল।।
নানারত্নে কৈল পূর্ণ হস্তিনা-নগর।
পৃথিবী পূরিল যশে দুই সহোদর।।
নকুল দুর্জ্জয় যোদ্ধা সর্ব্বগুণে ধীর।
কৌরব-কুমার মধ্যে সুন্দর শরীর।।
সহদেব হইল মন্ত্রী অতুল ভুবনে।
সর্ব্বজ্ঞ হইল দেব-গুরু আরাধনে।।
পাণ্ডবের প্রশংসা করয়ে সর্ব্বজন।
ধন্য ধন্য বলি ক্ষিতি হইল ঘোষণ।।
কুরুবংশে কুলক্রমে যত রাজগণ।
পাণ্ডব-সূর্য্যেতে যেন তারা আচ্ছাদন।।
দিনে দিনে বাড়ে তেজ শুক্লপক্ষ শশী।
পাণ্ডবের কীর্ত্তি লোক গায় অহর্নিশি।।
ধৃতরাষ্ট্র শুনিয়া হইল ছন্নমতি।
পাণ্ডবের যশ কীর্ত্তি বাড়ে নিতি নিতি।।
বিধির লিখন কেবা খণ্ডাইতে পারে।
হিংসা জন্মিল চিত্তে অন্ধ-নরবরে।।
মম-পুত্রগণ-গুণ কেহ নাহি বলে।
পাণ্ডবের যশ প্রচারিল ভূমণ্ডলে।।
এই সব ভাবনা করয়ে অনুক্ষণ।
নয়নে নাহিক নিদ্রা না রুচে ভোজন।।
কুরুবংশে বৃদ্ধ মন্ত্রী জাতিতে ব্রাহ্মণ।
কণিকেরে ডাকি আনাইল ততক্ষণ।।
একান্তে কণিকে আনি বলিল তাহাকে।
পরম বিশ্বাস তেঁই জানাই তোমাকে।।
দিবানিশি আমার হৃদয়ে নাহি সুখ।
তোমার মন্ত্রণা-বলে খণ্ডিবে সে দুঃখ।।
পাণ্ডবের যশ কীর্ত্তি বাড়ে দিনে দিনে।
চিত্ত স্থির নহে মম ইহার কারণে।।
ইহার উপায় তুমি বলহ সত্বর।
কণিক শুনিয়া তবে করিল উত্তর।।
আমার বচন যদি রাখ নররায়।
খণ্ডিবে সকল চিন্তা, হইবে বিজয়।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, তুমি যে কর বিচার।
মম দৃঢ় বাক্য, সেই কর্ত্তব্য আমার।।
কণিক বলিল, রাজা শুন রাজনীত।
পূর্ব্বপার আছে হেন শাস্ত্রের বিহিত।।
কার্য্য না থাকিলে তবু সাধিবেক দণ্ড।
আত্মবশ করিবেক সব রাজ্যখণ্ড।।
আত্মছিদ্র লুকাইবে পরম যতনে।
পরছিদ্র পাইলে ধরিবে ততক্ষণে।।
সময় বুঝিয়া রাজা করিবেক কর্ম্ম।
ক্ষণে গুপ্ত ক্ষণে ব্যক্ত যেন হয় কূর্ম্ম।।
দুর্ব্বল দেখিয়া শত্রু দয়া নাহি করি।
শরণ লইলে তবু না রাখিবে বৈরী।।
বালক দেখিয়া শত্রু না করিবে ত্রাণ।
ব্যাধি অগ্নি রিপু ঋণ একই সমান।।
শত্রুকে বলিষ্ঠ দেখি করিবে বিনয়।
অপমান বহুক্লেশ সহিবে হৃদয়।।
সদাই থাকিবে তারে স্কন্ধেতে করিয়া।
সময় পাইলে মার ভূমে আছাড়িয়া।।
পূর্ব্বর বৃত্তান্ত এক শুন নরপতি।
বনেতে শৃগাল বৈসে বিজ্ঞ সর্ব্বনীতি।।
সিংহ ব্যঘ্র নকুল মূষিক ও শৃগাল।
পঞ্চজন সখা বনে আছে চিরকাল।।
একদিন বনে চরে একটি হরিণী।
অতিশয় মাংস গায়ে, আছয়ে গর্ভিণী।।
শৃগাল দেখিয়া বলে, মৃগের ঈশ্বরে।
য্ত্ন করি সিংহ না পারিল ধরিবারে।।
শৃগাল বলিল, তবে শুন সখাগণ।
ধরিব হরিণী, শুন আমার বচন।।
বলেতে সমর্থ কেহ নহিবে তাহার।
মূষিক হইতে মৃগী করিব সংহার।।
শ্রান্ত আছে হরিণী, শুইবে কোন স্থান।
ধীরে ধীরে মূষা তথা করহ প্রয়াণ।।
দূরে থাকি যাবে তথা করিয়া সুড়ঙ্গ।
নিঃশব্দে যাইবে যেন না জানে কুরঙ্গ।।
সুড়ঙ্গ-ফুকরে তার চরণ যথায়।
কাটিবে পদের শির করিয়া উপায়।।
পদ-শির কাটা গেলে অশক্ত হইবে।
অবশেষে সিংহ তারে অবশ্য ধরিবে।।
এত শুনি সম্মত হইল সর্ব্বজন।
যা বলিল জম্বূক করিল ততক্ষণ।।
কাটা গেল পদ-শির মূষিক-দংশনে।
হীনশক্তি দেখি সিংহ ধরিল তখনে।।
হরিণী পড়িল সবে হরিষ বিধানে।
শৃগাল আপন চিত্তে করে অনুমান।।
বুদ্ধিবলে মৃগে আমি করিলাম হত।
সিংহ ব্যাঘ্র খেলে মাংস আমি পাব কত।।
সকল খাইতে মাংস করিব উপায়।
প্রযত্ন করিব, পাছে যে হয় সে হয়।।
ইহা ভাবি শৃগাল করিয়া যোড়কর।
নীতি বুঝাইয়া কহে সবার গোচর।।
দেখ দৈবযোগে আজি পড়িল হরিণী।
মাংস শ্রাদ্ধ করি, আছি পিতৃলোকে ঋণী।।
স্নান করি শুচি হৈয়া সবে এস গিয়া।
ততক্ষণে মৃগী আমি থাকি আগুলিয়া।।
বুদ্ধিমন্ত শৃগালের যুক্তি-অনুসারে।
ততক্ষণে গেল সবে স্নান করিবারে।।
সবা হৈতে শ্রেষ্ঠ সিংহ বলিষ্ঠ বিশেষে।
গিয়া স্নান করি এল চক্ষুর নিমিষে।।
স্নান করি আসি সিংহ দেখয়ে জম্বুকে।
অত্যন্ত বিরসে বসি আছে হেঁটমুখে।।
সিংহ বলে, সখে কেন বিরস বদন।
স্নান করি, এস মাংস করিব ভক্ষণ।।
শৃগাল বলিল, সখা কি কহিব কথা।
মূষিকের বচনে জন্মিল বড় ব্যথা।।
যখন আপনি গেল স্নান করিবারে।
কুবচন বলে যে, কহিতে লজ্জা করে।।
মহাবলী সিংহ ইহা বলে সর্ব্বজন।
আমি মারিলাম মৃগ, সে করে ভক্ষণ।।
সিংহ বলে, হেন বাক্য সহে কোন্ জন।
কোন্ ছার মূষা হেন বলিবে বচন।।
না খাইব মাংস আমি খাউক আপনি।
নিজ বীর্য্যবলে মৃগ ধরিব এখনি।।
হেন বাক্য বলে, তার মুখ না চাহিব।
আপন অর্জ্জিত বস্তু আপনি খাইব।।
এত বলি গেল সিংহ গহন কাননে।
স্নান করি ব্যাঘ্র তবে আইল সে স্থানে।।
আস্তে ব্যস্তে কহে শিবা শুন প্রাণসখা।
ভাগ্যেতে তোমারে সিংহ না পাইল দেখা।।
দৈবাৎ তোমারে ক্রোধ হইয়াছে তার।
নাহি জানি কে কহিল, কিবা সমাচার।।
এখনি গেলেন তেঁই তোমা ধরিবারে।
আমারে বলিল, তুমি না বলিহ তারে।।
চিরকাল সখা তুমি, না বলি কেমনে।
বুঝিয়া করহ কার্য্য যেবা লয় মনে।।
এতেক শুনিয়া ব্যাঘ্র শৃগাল-বচন।
হৃদয়ে বিস্মিত হৈয়া ভাবে মনে মন।।
নাহি জানি কোন্ দোষ করিলাম তার।
ক্রোধ করিয়াছে কোন্ না বুঝি বিচার।।
মহা চিন্তাকুল হয়ে, ভাবিতে লাগিল।
কি করিব কোথা যাব অন্তরে ভাবিল।।
হেথায় থাকিলে হবে বড়ই প্রমাদ।
স্থান তেয়াগিয়া যাই কি কাজ বিরাদ।।
এত বলি ব্যাঘ্র প্রবেশিল ঘোর বনে।
কতক্ষণে মূষিক আইল সেই স্থানে।।
মূষিকে দেখিয়া শিবা যুড়িল ক্রন্দন।
আইসহ সখা তোমা করি আলিঙ্গন।।
কেন সখা নকুলের হইল কুমতি।
ছাড়িতে নারিল পূর্ব্ব আপন প্রকৃতি।।
আচম্বিতে সর্প সঙ্গ হৈল তার দেখা।
যুদ্ধে হারি তার কাছে হৈল তার সখা।।
স্নান করি এখানে আইল দুই জন।
সর্পেরে না দিনু মাংস করিতে ভক্ষণ।।
পঞ্চ জন মিলিয়া যে মারিলাম মৃগী।
এখন নকুল আনে আর এক ভাগী।।
সখা না পাইল, ভাগ নকুল কুপিল।
তোমারে ধরিয়া খেতে নকুল বলিল।।
দুই জন মিলি গেল তোমা খুঁজিবারে।
হেথা এলে ধরিহ বলিয়া গেল মোরে।।
এত শুনি মূষিকের উড়িল পরাণ।
অতি শীঘ্র পলাইয়া গেল অন্য স্থান।।
হেনকালে নকুল আসিয়া উপনীত।
ক্রোধে শিবা কহে তারে সময় উচিত।।
সিংহ-আদি তিন জন করিল সমর।
হারিয়া আমার যুদ্ধে গেল বনান্তর।।
তোর শক্তি থাকে যদি, আসি কর রণ।
নহিলে পলাহ তুমি লইয়া জীবন।।
সহজে নকুল ক্ষুদ্র শিবা বলবান।
বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল অন্য স্থান।।
হেনমতে চারি ঠাঞি চারি বুদ্ধি কৈল।
বুদ্ধে সবা জিনি মৃগ আপনি খাইল।।
কণিক বলিল, রাজা কর অবধান।
এমত করিলে রাজা হয় রাজ্যবান।।
বলিষ্ঠে বুদ্ধিতে জিনি মারিবেক বলে।
লুব্ধ জনে ধন দিয়া মারিলেক ছলে।।
শক্ররে পাইলে রাজা কভু না ছাড়িবে।
জন্মাইয়া বিশ্বাস বিপক্ষেরে মারিবে।।
জানিবে, যে শত্রু মম জীবনের বৈরী।
তাহারে মারিবে আনাইয়া দিব্য করি।।
ছলে বলে শত্রুকে পাঠাবে যম-ঘর।
হেনমতে আছে রাজা বেদেরে বিচার।।
বিশ্বাসিয়া দিব্য করি মারে শত্রু সব।
নাহিক ইহাতে পাপ, কহেন ভার্গব।।
এ সব বুঝিয়া রাজা করহ উপায়।
এবে না করিলে শেষে দুঃখ পাবে রায়।।
এত বলি কণিক চলিল নিজ ঘর।
চিন্তিতে লাগিল মনে অন্ধ নৃপবর।।
পুণ্য-কথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।
কাশীরাম দাস কহে অদ্ভুত চরিত্র।।
জন্মেজয় বলে, কহ কহ মুনিবর।
বিস্তারিহা কহ মোরে ঘুচুক আঁধার।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
কহিব অপূর্ব্ব আমি ভারত কথন।।
৭৮. মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনায়
 পাণ্ডবদিগের বারণাবতে গমন
যুধিষ্ঠির যুবরাজ, সুখী সর্ব্বজন।
স্থানে স্থানে বিচার করয়ে প্রজাগণ।।
ধর্ম্মশীল যুধিষ্ঠির দয়ার সাগর।
পুত্রভাবে দেখে প্রজা অমাত্য কিঙ্কর।।
যুধিষ্ঠির রাজা হৈলে সবে থাকি সুখে।
রাজার নন্দন, রাজ্য সম্ভবে তাহাকে।।
ভীষ্ম রাজা না হলেন সত্যের কারণ।
ধৃতরাষ্ট্র না হইল অন্ধ দ্বিনয়ন।।
পূর্ব্বেতে ছিলেন রাজা পাণ্ডু মহাশয়।
বিধি এই আছে, রাজপুত্র রাজা হয়।।
বিশেষ রাজার যোগ্যপাত্র যুধিষ্ঠির।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় সুবুদ্ধি গভীর।।
চলহ যাইব প্রজা আছি যে যতেক।
যুধিষ্ঠিরে রাজা কর করি অভিষেক।।
হাট বাট নগরে চত্বরে এই কথা।
দুর্য্যোধন শুনিয়া পাইল বড় ব্যথা।।
বিরস-বদনে গেল রাজার গোচর।
দেখিল, জনক বসি আছে একেশ্বর।।
সকরুণে পিতারে বলয়ে দুর্য্যোধন।
অবধানে শুন যাহা, কহে প্রজাগণ।।
নগরে শুনিনু আমি আশ্চর্য্য বচন।
অবধান কর রাজা করি নিবেদেন।।
অবজ্ঞায় অনাদর করিল তোমারে।
রাজা ইচ্ছা করে সবে কুন্তীর কুমারে।।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ সেই রাজযোগ্য নয়।
যুধিষ্ঠিরে রাজা কর, সে রাজ-তনয়।।
এইমত বিচার করয়ে সর্ব্বজন।
রাজপুত্র যুধিষ্ঠির হইবে রাজন।।
তাহার নন্দন হৈলে হবে সেই রাজা।
আমা সবাকারে আর না গণিবে প্রজা।।
বৃথাই জীবন ধরি, বৃথা জন্ম মোর।
বৃথা বহন করি এ হেয় কলেবর।।
এ ছার জীবনে আর নাহি প্রয়োজন।
নিশ্চয় মরিব আমি তব বিদ্যমান।।
অকারণে জন্মে যেই পর-ভাগ্যজীবী।
অকারণে আমারে ধরিল এ পৃথিবী।।
পুত্রের শুনিয়া রাজা এতেক বচন।
হৃদয়ে বাজিল শেল চিন্তিত রাজন।।
কি করিব, কি হইবে, চিন্তে মনে মন।
হেনকালে আসে তথা দুষ্ট মন্ত্রিগণ।।
দুঃশাসন কর্ণ আর শকুনি দুর্ম্মতি।
বিচারিয়া কহে কথা অন্ধরাজ প্রতি।।
পাণ্ডবের ভয় রাজা তবে দূর হয়।
বাহির করিয়া দেহ করিয়া উপায়।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া বলে অম্বিকা-নন্দন।
কিমতে বাহির করি পাণ্ডুপুত্রগণ।।
যখন আছিল পাণ্ডু পৃথিবীতে রাজা।
সেবকের প্রায় মম করিত সে পূজা।।
নাম মাত্র রাজা সেই আমি দিলে খায়।
নিরবধি সমর্পয়ে যথা যাহা পায়।।
মম আজ্ঞাবর্ত্তী হৈয়া ছিল অনুক্ষণ।
ভাই হয়ে কারো ভাই না হয় এমন।।
তাহার অধিক হয় তার পুত্রগণ।
আজ্ঞাবর্ত্তী হৈয়া মম থাকে অনুক্ষণ।।
দেবপ্রায় আমারে সে সেবে যুধিষ্ঠির।
কোন্ দোষ দিয়া তারে করিব বাহির।।
অবিচার করি যদি আমি তার সনে।
অবশ্য ফলিবে মোরে, শুন মন্ত্রিগণে।।
অহিংসক জনেরে হিংসয়ে যেই জন।
অবশ্য তাহার হয় নরকে পতন।।
হিংসা সম পাপ নাহি জান সর্ব্বজন।
দয়া বিনা ধর্ম্ম নাহি এ তিন ভুবন।।
বিশেষে বলিষ্ঠ হয় পঞ্চ সহোদর।
তার অনুগত যত আছয়ে কিঙ্কর।।
পিতৃ পিতামহ তার পুষিল সবারে।
কার শক্তি হয় বহিষ্কার করিবারে।।
দুর্য্যোধন বলে, যাহা কহিলে প্রমাণ।
পূর্ব্বে আমি জানিয়া করিলাম বিধান।।
যত রথী মহারথী আছে ভ্রাতৃগণ।
সবারে করিব বশ দিয়া বহুধন।।
সেবকগণেরে প্রতি নাহিক বিচার।
চিত্তেতে বুঝিয়া কার্য্য কর আপনার।।
এক বাক্য কহি, পিতা কর অবধান।
আছয়ে অপূর্ব্ব অতি অনুপম স্থান।।
নগর বারণাবত দেশের বাহির।
ভ্রাতৃ-মাতৃসহ তথা যাক যুধিষ্ঠির।।
হেথা আমি নিজরাজ্য স্ববশ করিলে।
এ স্থানে আসিবে পুনঃ কত দিন গেলে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলেন, করিলা যে বিচার।
নিরবধি এই চিত্তে জাগয়ে আমার।।
পাপকর্ম্ম বলি ইহা প্রকাশ না করি।
গুপ্তে রাখিলাম লোকাচারে বড় ডরি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুরের ধর্ম্মচিত।
এ কথা স্বীকার না করিবে কদাচিত।।
এই চারি জনা যদি নহিবে স্বীকার।
কার্য্যসিদ্ধি হইবেক কিমত তোমার।।
এত শুনি পুনরপি বলে দুর্য্যোধন।
তাহার যেমন ভীষ্ম আমার তেমন।।
অধর্ম্ম নাহিক হয়, ধর্ম্মার্থ বিচার।
ইহাতে নাহিক পাপ শুন কহি সার।।
অশ্বত্থামা গুরুপুত্র মম অনুগত।
দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা আমার সম্মত।।
বিদুর সর্ব্বাংশে সেবা করে পাণ্ডবেরে।
হইলে সহজে একা কি করিতে পারে।।
ত্বরিতে চিন্তহ পিতা উপায় ইহার।
পাণ্ডব থাকিতে নিদ্রা নাহিক আমার।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, যদি করি বহিষ্কার।
অপযশ ঘুষিবেক সকল সংসার।।
এমন উপায় করি করহ মন্ত্রণা।
আপন ইচ্ছায় যায় নগর বারণা।।
এত শুনি দুর্য্যোধন চলিল সত্বর।
নানারত্ন লৈয়া গেল মন্ত্রিগণ-ঘর।।
তবে দুর্য্যোধন দিয়া বিবিধ রতন।
ক্রমে ক্রমে বশ করে সম মন্ত্রিগণ।।
শিখাইল মন্ত্রিগণে কপট করিয়া।
নগর বারণাবত উত্তম বলিয়া।।
অনুব্রত কহে সবে সম্মুখে বিমুখে।
নগর বারণা সম নাহি ইহলোকে।।
দুর্য্যোধন-সম্মতি পাইয়া মন্ত্রিগণে।
সেইমত বলিতে লাগিল অনুক্ষণে।।
কত দিনে হৈল শিবরাত্রি চতুর্দ্দশী।
রাজার নিকটে বলে মন্ত্রিগণ বসি।।
নগর বারণাবত পুণ্যক্ষেত্র গণি।
প্রত্যক্ষে বৈসেন তথা দেব শূলপাণি।।
আর মন্ত্রী বলে, সে জগতে মনোরম।
নগর বারণাবত ভুবনে উত্তম।।
আর মন্ত্রি বলে, তার নাহিক তুলনা।
অমর কিন্নর তথা থাকে সর্ব্বজনা।।
মহাতীর্থ মহাস্থান ভুবন-মোহন।
নিত্যকৃত্য আসি করে যত দেবগণ।।
হেনমতে মন্ত্রিগণ বলিল বচন।
বিধির লিখন কর্ম্ম না যায় খণ্ডন।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে পুণ্যক্ষেত্রবর।
দেখিব বারণাবত কেমন নগর।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত-মন।
হৃদয়ে কপট, মুখে অমৃত- বচন।।
ইচ্ছা যদি হয় তথা করিতে বিহার।
সঙ্গে করি লৈয়া যাহ যত পরিবার।।
জননী সহিতে তথা পঞ্চ সহোদর।
যথাসুকে বিহরহ বারণানগর।।
ধনরত্ন সঙ্গে লহ যেই মন লয়।
কত দিন বঞ্চিয়া আইস নিজালয়।।
এত যদি ধৃতরাষ্ট্র বলে বারে বার।
বিস্মিত হইল রাজা ধর্ম্মের কুমার।।
দেখিবারে ইচ্ছামাত্র হইল আমার।
এখন যাইতে বলে সহ পরিবার।।
ধৃতরাষ্ট্র-আজ্ঞাবহ ধর্ম্মের নন্দন।
তাঁর আজ্ঞা কখন না করেন লঙ্ঘন।।
যাইব বারণাবত করি অঙ্গীকার।
ধৃতরাষ্ট্র-চরণে করেন নমস্কার।।
বিজ্ঞ মন্ত্রিগণে তবে করিয়া সম্ভাষ।
যুধিষ্ঠির চলিলেন জননীর পাশ।।
দেখি দুর্য্যোধন হৈল হরিষ অন্তর।
পুরোচন মন্ত্রী বলি ডাকিল সত্বর।।
জাতিতে যবন, দুর্য্যোধনের বিশ্বাস।
একান্তে আনিয়া তারে কহে মৃদুভাষ।।
তোমার সমান নাহি মন্ত্রীর ভিতরে।
পরম বিশ্বাসী তেঁই ডাকি হে তোমারে।।
তোমার সহিত আমি করি যে বিচার।
অন্য-জন-মধ্যে ইহা না হয় প্রচার।।
নগর বারণাবতে পাণ্ডুপুত্র যায়।
নগর বারণাতে পাণ্ডুপুত্র যা।
তারা না যাইতে আগে যাইবা তথায়।।
খচর সংযোগ রথে করি আরোহন।
অতি শীঘ্র তুমি তথা করহ গমন।।
উত্তম দেখিয়া স্থল করিবা আলয়।
অগ্নিগৃহ বিরচিবা যেন ব্যক্ত নয়।।
স্তম্ভ নির্ম্মি গর্ভ তার ঘৃতে পূরাইবে।
শণ আর জাউ দিয়া প্রাচীর রচিবে।।
মধ্যে মধ্যে দিবে বাঁশ ঘৃতে পূর্ণ করি।
যেই মতে অগ্নি দিলে নিবাইতে নারি।।
এমত রচিবা, কেহ লক্ষিতে না পারে।
নানা চিত্র বিরচিবা লোক মনোহরে।।
জতুগৃহ বেড়িয়া করিবে অস্ত্রঘর।
মঞ্চ বিরচিয়া অস্ত্র রাখিবে ভিতর।।
জতুগৃত হইতে কদাচিত হয় ত্রাণ।
অস্ত্রগৃহে অস্ত্রে বাজি হারাইবে প্রাণ।।
তার চতুর্দ্দিকে তবে খুদিবে গভীর।
লাফে যেন পার নাহি হয় ভীম বীর।।
সময় বুঝিয়া অগ্নি দিবে সে আলয়।
একত্র থাকিবা তবে সমস্ত সময়।।
ত্বরিতে চলিয়া যাহ, না কর বিলম্ব।
শীঘ্রগতি কর গিয়া গৃহের আরম্ভ।।
দুর্য্যোধন আজ্ঞা পেয়ে মন্ত্রী পুরোচন।
বাহন যুড়িল রথে পবন-গমন।।
ক্ষণেকে পাইল গিয়া বারণানগর।
গৃহ বিরচিতে নিয়োজিত অনুচর।।
যেমন করিয়া কহিলেন দুর্য্যোধন।
ততোধিক গৃহ বিরচিল পুরোচন।।
ভ্রাতৃ সহ যুধিষ্ঠির সহিত জননী।
সহ বৃদ্ধগণে যান মাগিতে মেলানি।।
বাহ্লীক গাঙ্গেয় দ্রোণ কৃপ সোমদত্ত।
গান্ধারী সহিত গৃহে নারীগণ যত।।
একে একে সবা স্থানে লইয়া বিদায়।
পুরোহিত বিপ্রগণে প্রণমিল রায়।।
পাণ্ডবে বিদায় লৈতে দেখি দ্বিজগণ।
ধৃতরাষ্ট্রে নিন্দে বহু করি কুবচন।।
দুষ্টবুদ্ধি ধর্ম্মশীল পাণ্ডু-পুত্রগণ।
বাহির করিয়া দেয় দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
হেন ছার নগরে রহিতে না যুয়ায়।
যথা যান যুধিষ্ঠির, যাইব তথায়।।
কুরুকুলে মহাপাপী এই নৃপবর।
ইহার পাপেতে হৈবে সকল সংহার।।
ধৃতরাষ্ট্র করে যদি হেন দুরাচার।
কেমনে করেন ইহা গঙ্গার কুমার।।
তারা সবে সহিবেক, সবে দুষ্ট চিত।
মোরা সবে না সহিব, যাইব নিশ্চিত।।
এত বলি দ্বিজগণ চলিল সুমতি।
দারা পুত্র পরিবার লইয়া সংহতি।।
আগুসরি বিদুর গেলেন কত দূরে।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন কূট ভাষাচারে।।
বারণাবতেতে যাহ পঞ্চ সহোদর।
সাবধানে থাকিবা, আছয়ে তাহে ডর।।
যাহে জন্মে তাহে ভক্ষ্যে শীতল বিনাশে।
ইহার আছয়ে ভয় যাই সেই দেশে।।
এত বলি বিদুর করিল আলিঙ্গন।
স্নেহবশে শির ধরি করিল চুম্বন।।
নয়নের নীর ঝরে, ভাষে গদগদে।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই প্রণমিল পদে।।
বাহুড়িয়া বিদুর চলিল নিজালয়।
বারণা গেলেন পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
প্রবেশ করেন গিয়া নগর ভিতর।
আগুসরি নিল যত নগরের নর।।
হেনকালে পুরোচন করে নমস্কার।
ভূমিষ্ঠ হইয়া যেন রাজ-ব্যবহার।।
করযোড় করি দুষ্ট পুরোচন কহে।
হেথায় রহিয়া কেন, চল নিজ গৃহে।।
পূর্ব্ব হইতে হেথা আছে পুরীর নির্ম্মাণ।
মনোহর দিব্যস্থান স্বর্গের সমান।।
কুবের ভাস্কর জিনি পুরীর গঠন।
তাদৃশী নাহিক মর্ত্তে ইহার প্রমাণ।।
তব আগমন শুনি করিনু মণ্ডন।
বিলম্ব না কর তুমি, দিন শুভক্ষণ।।
এত শুনি হৃষ্ট হৈয়া পঞ্চ সহোদর।
জননী সহিত গিয়া প্রবেশেন ঘর।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ মনোহর সে আলয়।
দেখি হৃষ্ট হইলেন ধর্ম্মের তনয়।।
তবে কতক্ষণে পুরী করি নিরীক্ষণ।
ভীমে দেখি যুধিষ্ঠির বলেন তখন।।
গৃহের পরীক্ষা দেখি লহ বৃকোদর।
মোর মনে বিশ্বাস না হয় এই ঘর।।
বৃকোদর নিল সেই ঘরের আঘ্রাণ।
জানিলেন ঘর জতু-ঘৃতের নির্ম্মাণ।।
বৃকোদর বিস্মিত কহেন যুধিষ্ঠিরে।
জতু-ঘৃত সরিষা তৈল গন্ধ পাই ঘরে।।
প্রত্যক্ষে অগ্নির ঘর ইথে নাহি আন।
আমা সবা দহিবারে করেছে নির্ম্মাণ।।
পথে দেখিলাম যত অনুচরগণ।
এই সব দ্রব্য এনেছিল অনুক্ষণ।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে প্রমাণ হইল।
আসিতে জটিল ভাষে বিদুর বলিল।।
বিশ্বাস করিয়া সবে থাকিলে এ ঘরে।
অচেতন হৈব যবে মোরা নিদ্রা ঘোরে।।
তখন অনল ইথে দিবে পুরোচন।
হেন বুদ্ধি করিয়াছে দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
ভীম বলিলেন এই অনলের ঘর।
পুনরপি যাই চল হস্তিনা-নগর।।
যুধিষ্ঠির বলেন, এ নহে সুবিচার।
এই কথা লোকে তবে হইবে প্রচার।।
দুর্য্যোধন বিচার করিবেক নিজ চিতে।
নিশ্চয় আমার কার্য্য পারিল জানিতে।।
সৈন্যগণে সাজি দুষ্ট করিবেক রণ।
তার হাতে সর্ব্ব-সৈন্য সর্ব্ব রত্ন-ধন।।
কি কাজ বিবাদে ভাই না যাব তথায়।
নির্ধন নিঃসৈন্য আমি, নাহিক সহায়।।
সাবধান হৈয়া এই গৃহেতে বঞ্চিব।
আমরা যে জানি ইহা কারে না বলিব।।
পঞ্চ ভাই একত্র না রব কোন স্থালে।
হেথা হৈতে পলাইব কত দিন গেলে।।
অনুক্ষণ মৃগয়া করিব পঞ্চজন।
পথ ঘাট জ্ঞাত হব বন উপবন।।
সব জ্ঞাত হৈব, ইহা কেহ নাহি জানে।
হেনমত বিচার করিল ছয় জনে।।
সেথায় আকুল চিত্ত বিদুর সুমতি।
নিরন্তর অনুশোচে পাণ্ডবের প্রতি।।
কিমতে বাহির হৈবে জতুগৃহ হৈতে।
প্রেরিয়া কোন্ দূতে রক্ষিব অলক্ষিতে।।
বিচারিয়া বিদুর করিল অনুমান।
খনক আনিল, জানে সুডঙ্গ নির্ম্মাণ।।
খনক সুবুদ্ধি বড় বিদুরে বিশ্বাস।
সকল কহিয়া পাঠাইল ধর্ম্মপাশ।।
খনক করিল যুধিষ্ঠিরে নমস্কার।
ধীরে ধীরে কহে বিদুরের সমাচার।।
পাঠাইল বিদুর আমাকে তব কাছে।
ভূমি খনিবার বিদ্যা আমার যে আছে।।
একান্তে কহিল মোরে ডাকি নিজ পাশ।
বিদুরের লোক বলি না যাবে বিশ্বাস।।
অতএব, এই চিহ্ন কহিল আমারে।
আসিতে কি কূট ভাষা কহিল তোমারে।।
যুধিষ্ঠির শুনিয়া করিলেন আশ্বাস।
জানিলাম তোমারে নাহিক অবিশ্বাস।।
বিদুরের প্রিয় তুমি, তেঁই পাঠাইল।
তুমি যে বিদুর তুল্য, তাই জানা গেল।।
আমা সবাকার ভাগ্যে হৈলে উপনীত।
অবধানে দেখ দুষ্ট কৌরব-চরিত।।
শণ-জতু-ঘৃত-বাঁশ-সংযোগে রচিত।
যন্ত্রের খিলনি করি গৃহ চতুর্ভিত।।
করে চতুর্দ্দিকে গর্ত্ত গভীর বিস্তার।
অক্ষৌহিণী-বলে পুরোচন রাখে দ্বার।।
এইরূপে পড়িয়াছি বিপদ বন্ধনে।
উপায় করিয়া মুক্ত কর ছয় জনে।।
লোকে যেন নাহি জানে সব বিবরণ।
হেন বুদ্ধি কর, তুমি হও বিচক্ষণ।।
শুনিয়া খনক তবে করিল উত্তর।
খুদিতে লাগিল গর্ত্ত গৃহের ভিতর।।
সুড়ঙ্গের মুকে দিল কপাট উত্তম।
উপরে মৃত্তিকা দিয়া কৈল ভূমি সম।।
চতুর্দ্দিকে ছিল গর্ত্ত গহন গভীর।
ততোধিক তথায় খনিল মহাবীর।।
গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত সুড়ঙ্গ খনি গেল।
সম্পূর্ণ করিয়া কার্য্য আসি নিবেদিল।।
শুনিয়া হরিষ চিত্তপঞ্চ সহোদর।
প্রণমিয়া খনক চলিল নিজ ঘর।।
পুনরপি কহে পূর্ব্ব বিদুর-বচন।
চতুর্দ্দশী-রাত্রে অগ্নি দিবে পুরোচন।।
সাবধান হইয়া থাকিবে ছয় জন।
এত বলি খনক চলিল ততক্ষণ।।
বিদুরে কহিল গিয়া সব বিবরণ।
বারণাবতেতে যত কৈল প্রকরণ।।
খনকের মুখে বার্ত্তা বিদুর পাইল।
শুনিয়া বিদুর বড় সন্তুষ্ট হইল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৭৯. জতুগৃহ-দাহ
হেনমতে তথায় রহিল ছয় জন।
মৃগয়া করিয়া ভ্রমে বন উপবন।।
বৎসরেক জতু-গৃহে করিল নিবাস।
পুরোচন জানিল যে হইল বিশ্বাস।।
পুরোচন-মন বুঝি ধর্ম্মের নন্দন।
ভাইগণে আনিয়া বলেন ততক্ষণ।।
আমা সবা বিশ্বাস জানিল পুরোচন।
সাবধান হইয়া থাকিব ছয় জন।।
আজি রাত্রে অগ্নি দিবে বুঝি পুরোচন।
বিদুরের কথা ভাই চিন্তহ এখন।।
ভীম বলে, দিবসে করিতে নাহি বল।
রাত্রি হৈলে পাবে দুষ্ট আপনার ফল।।
কুন্তীদেবী শুনিয়া বলেন পুত্রগণে।
পলাইয়া কোথায় ভ্রমিবে বনে বনে।।
ভালমতে করি আজি ব্রাহ্মণ-ভোজন।
ক্ষুধিত বিপ্রেরে তোষ দিয়া বহুধন।।
জননীর আজ্ঞায় আনিল দ্বিজগণ।
কুন্তীদেবী করাইল ব্রাহ্মণ-ভোজন।।
ভোজন করিয়া দ্বিজ গেল সর্ব্ব জন।
অন্ন হেতু আইল যতেক দুঃখিগণ।।
পঞ্চ পুত্র সহ এক নিষাদ-রমণী।
অন্ন হেতু এল যথা কুন্তী ঠাকুরাণী।।
পুত্রগণে দেখি কুন্তী জিজ্ঞাসেন তায়।
আপন দুঃখের কথা নিষাদী জানায়।।
তার দুঃখে হইলেন কুন্তী দুঃখান্বিতা।
তথায় রহিল সুকে নিষাদ-বনিতা।।
দিনকর অস্ত গেল, নিশা প্রবেশিল।
যথাস্থানে সর্ব্বলোক শয়ন করিল।।
পরিবার সহ গৃহে শোয় পুরোচন।
কত রাত্রে হইল নিদ্রায় অচেতন।।
বৃকোদরে আজ্ঞা দেন ধর্ম্মের নন্দন।
পুরোচন-দ্বারে অগ্নি দেহ এইক্ষণ।।
বৃকোদর পুরোচন-দ্বারে অগ্নি দিল।
অগ্নি দিয়া মাতৃ সহ গর্ত্তে প্রবেশিল।।
তদন্তরে জতুগৃহে দিয়া হুতাশন।
সুড়ঙ্গে প্রবেশ কৈল পবন-নন্দন।।
মাতৃ সহ পঞ্চ ভাই অতি শীঘ্র চলে।
হেথা জতুগৃহ ব্যাপ্ত হইল অনলে।।
অগ্নির পাইয়া শব্দ গ্রামবাসিগণ।
জল লয়ে চতুর্দ্দিকে ধায়সর্ব্বজন।।
নিকটে যাইতে শক্তি নহিল কাহার।
চতুর্দ্দিকে ভ্রমে লোক করি হাহাকার।।
জৌ-ঘৃত-তৈলের গন্ধ চতুর্দ্দিকে ধায়।
জতুগৃহ বলি লোকে বুঝিবারে পায়।।
দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্র কর্ম্ম কৈল দুরাচার।
কপটে দহিল পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।।
ধর্ম্মশীল পঞ্চ ভাই, নহে অপরাধী।
সর্ব্ব-গুণনিধি জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী।।
তবে সবে জানিল পুড়িল পুরোচন।
ভাল ভাল বলিয়া বলয়ে সর্ব্বজন।।
নিদ্দোষী জনেরে হিংসা করে যেই জন।
এইরূপ শাস্তি তারে দেন নারায়ণ।।
এত বলি কান্দে যত নগরের লোক।
পাণ্ডবের গুণ স্মরি করে বহু শোক।।
জননী সহিত হেথা পাণ্ডুর নন্দন।
সুড়ঙ্গে বাহির হৈয়া প্রবেশিল বন।।
ঘোর অন্ধকার নিশা গহন কানন।
লতা বৃক্ষ কন্টকেতে যায় ছয় জন।।
রাজার কুমার সব, রাজার গৃহিনী।
তাহে অন্ধকার নিশা পথ নাহি চিনি।।
চলিতে অশক্ত কুন্তী, ধর্ম্ম যুধিষ্ঠির।
ধনঞ্জয় মাদ্রী-পুত্র কোমল শরীর।।
কত দূরে যান কুন্তী হন অচেতন।
শীঘ্রগতি যাইতে না পারে পঞ্চজন।।
তবে বৃকোদর নিল মায়ে স্কন্ধে করি।
দুই স্কন্ধে মাদ্রী-পুত্র, হস্তে দোঁহা ধরি।।
বায়ু বেগে যান ভীম লৈয়া পঞ্চজনে।
বৃক্ষ শীলা চূর্ণ হয় ভীমের চরণে।।
অতি শীঘ্রগতি যায় ভীম মহাবীর।
নিশাযোগে উত্তরিল জাহ্নবীর তীর।।
গভীর গঙ্গার জল, অতি সে বিস্তার।
দেখি হৈল চিন্তিত কেমনে হই পার।।
চিন্তিত ভোজের পুত্রী পঞ্চ সহোদর।
গঙ্গাজল-পরিমাণ করে বৃকোদর।।
হেনকালে দিব্য এই আইল তরণী।
পবন গমন তাহে শোভে পতাকিনী।।
নৌকায় কৈবর্ত্ত বিদুরের অনুচর।
নৌকা পাই পঞ্চ ভাই চিন্তিত অন্তর।।
দূরে থাকি কৈবর্ত্ত করিল নমস্কার।
কহিতে লাগিল বিদুরের সমাচার।।
আমারে পাঠায় দিল পরম যতনে।
তোমা সবা পার করিবারে নৌকাযানে।।
অবিশ্বাসী নহি আমি বিদুরের জন।
সঙ্কেতে আমারে পাঠাইলে সে কারণ।।
যখন আইলা সবে বারণানগর।
কূটভাষে তোমারে সে করিল উত্তর।।
যাহে জন্মে তাহে ভক্ষ্যে, শীতল বিনাশে।
ইহার আছয়ে ভয় যাহ সেই দেশে।।
এই চিহ্ন বলে মোরে আসিবার কালে।
পাঠাইল পার করিবারে গঙ্গাজলে।।
কৈবর্ত্ত-বচন শুনি বিশ্বাস জন্মিল।
ছয় জন দিয়া নৌকা-আরোহণ কৈল।।
চালাইল নৌকা তবে পবন-গমনে।
পুনরপি কহে দাস বিদুর-বচন।।
বিদুর বলিল এই করুণা বচন।
হেথা তাক শিরে-ঘ্রাণ করি আলিঙ্গন।।
কতকাল অজ্ঞাতে বঞ্চহ কোন স্থানে।
দুঃখ ক্লেশ সহি কর কালের হরণে।।
এই কথা কহিতে হইয়া গঙ্গাপার।
কূলে উঠিলেন সবে পাণ্ডুর কুমার।।
বলেন কৈবর্ত্ত প্রতি ধর্ম্মের নন্দন।
বিদুরে কহিবা গিয়া এই নিবেদন।।
বিষম প্রমাদ হৈতে হইলাম পার।
তোমা হৈতে পাণ্ডবের বন্ধু নাহি আর।।
তোমার উপায় হেতু রহিল জীবন।
পুনঃ ভাগ্য হইলে হইবে দরশন।।
এত বলি কৈবর্ত্তেরে করিল মেলানি।
বনেতে প্রবেশ কৈল প্রভাত রজনী।।
গঙ্গার দক্ষিণে যান কুন্তীর নন্দন।
বাহি নৌকা দাস কৈল উত্তরে গমন।।
এ স্থানে প্রভাত হৈলে নগরের লোক।
জতুগৃহ নিকটে আসিয়া করে শোক।।
জল দিয়া নিভাইল যে ছিল অনল।
ভস্ম উলটিয়া সবে নিরখে সকল।।
দ্বারমধ্যে দেখিল পুড়িল পুরোচন।
তাহার সুহৃদ যত ভাই বন্ধুগণ।।
অস্ত্রগৃহে পুড়িল যতেক অস্ত্রধারী।
প্রত্যেকে প্রত্যেক ভস্ম দেখিল বিচারি।।
জতুগৃহ-দ্বারে তবে গেল ততক্ষণ।
দেখিল অনলে দগ্ধ আছে ছয় জন।।
দেখিয়া সকল লোক হাহাকার করে।
গড়াগড়ি দিয়া পড়ে ভূমির উপরে।।
হায় হায় কোথা কুন্তী-মাদ্রীর নন্দন।
নিরখিয়া সর্ব্বলোক করয়ে ক্রন্দন।।
এই কর্ম্ম করিল পাপিষ্ঠ দুর্য্যোধন।
জতুগৃহ করিতে পাঠাল পুরোচন।।
দুষ্টবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র মনে ইহা জানে।
কপট করিয়া দগ্ধ কৈল পুত্রগণে।।
এইক্ষণে আমা সবাকার এই কাজ।
লোক পাঠাইয়া দেহ হস্তিনার মাঝ।।
ধৃতরাষ্ট্রে বল না করিয়া কিছু ভয়।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ তোর হৈল দুরাশয়।।
হস্তিনাগনরে দূত গেল শীঘ্রগতি।
জানাইল সমাচার অন্ধরাজ প্রতি।।
জৌগৃহে ছিলেন কুন্তী পাণ্ডুর নন্দন।
নিশাযোগে অগ্নি তাহে দিল কোন্ জন।।
পুত্রসহ কুন্তীদেবী হইল দাহন।
পরিবার সহ দগ্ধ হৈল পুরোচন।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র শোকে অচেতন।
ক্ষণেক নিঃশব্দ হৈয়া করিল ক্রন্দন।।
হাহা কুন্তী যুধিষ্ঠির ভীম ধনঞ্জয়।
হাহা সহদেব আর নকুল দুর্জ্জয়।।
আজি জানিলাম আমি পাণ্ডুর নিধন।
ভ্রাতৃশোক না ছিল এ সবার কারণ।।
বহুবিধ বিলাপ করয়ে অন্ধবর।
সমাচার গেল অন্তঃপুরের ভিতর।।
গান্ধারী প্রভৃতি ছিল যত নারীগণ।
শোকেতে আকুল সবে করয়ে ক্রন্দন।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য বাহ্লীক বিদুর।
পাণ্ডবের মৃত্যু শুনি শোকেতে আতুর।।
নগরের লোক সব কান্দয়ে শুনিয়া।
পাণ্ডবের গুণ সব হৃদয়ে স্মরিয়া।।
কেহ ডাকে যুধিষ্ঠির, কহ বৃকোদর।
কেহ ধনঞ্জয়, কেহ মাদ্রীর কোঙর।।
হা হা কুন্তী বলি কেহ করয়ে ক্রন্দন।
এই মত নগরে কান্দয়ে সর্ব্বজন।।
তবে ধৃতরাষ্ট্র শ্রাদ্ধ করিল বিধান।
ব্রাহ্মণেরে দিলা বহু রত্ন ধেনু দান।।
হেথায় পাণ্ডবগণ ভুঞ্জি অতি ক্লেশ।
হিড়িম্বের অরণ্যেতে করিল প্রবেশ।।
পরিশ্রম আর ভয় ক্ষুধা তৃষ্ণা যত।
কহেন ডাকিয়া কুন্তী প্রতি পঞ্চসুত।।
বহুদূর আইলাম অরণ্য ভিতর।
তৃষ্ণায় আকুল নাহি চলে কলেবর।।
যাইতে না পারি আর বিনা জলপানে।
কতক্ষণ বিশ্রাম করহ এই স্থানে।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির বলেন বচন।
না জানি মরিল, কিবা জীয়ে পুরোচন।।
দুষ্ট দুরাচার দুর্য্যোধনের মন্ত্রণা।
এই সমাচার পাছে কহে কোন জনা।।
তবে ত সাজিয়া দল আসিবে হেথায়।
কি করিব তবে পুনঃ কহ ত উপায়।।
ভীম বলে, নিঃশব্দে থাকহ এইখানে।
পশ্চাতে যাইব তৃপ্ত হৈয়া জলপানে।।
অন্য সর্ব্বজনেরে রাখিয়া বটমূলে।
জল-অন্বেষণে ভীম ভ্রমে নানা স্থলে।।
জলচর-পক্ষ শব্দ শুনি কত দূরে।
শব্দ-অনুসারে গেল জল আনিবারে।।
জলেতে নামিয়ে বীর কৈল স্নানপান।
জল লইবারে ভীম পাত্র নাহি পান।।
পাত্র না পাইয়া ভীম বস্ত্র ভিজাইল।
বসনে করিয়া জল লইয়া চলিল।।
দুই ক্রোশ গিয়াছিল জলের কারণ।
ক্ষণমাত্রে পুনঃ এল পবন-নন্দন।।
দেখিল সকলে নিদ্রাগত অচেতন।
কহিতে লাগিল ভীম বিলাপ বচন।।
বসুদেব-ভগিনী যে কুন্তী ভোজসুতা।
বিচিত্রবীর্য্যের বধূ পাণ্ডুর বনিতা।।
বিচিত্র পালঙ্কোপরি শয্যা মনোহর।
নিদ্রা নাহি হয় যাঁর তাহার উপর।।
হেন মাতা গড়াগড়ি যায় ভূমিতলে।
হরি হরি বিধি হেন লিখিল কপালে।।
কমল অধিক যার কোমল শরীর।
হেন ভাই ভূমিতে লোটায় যুধিষ্ঠির।।
তিন লোক ঈশ্বরের যোগ্য যেই জন।
সহজ মনুষ্য প্রায় ভূমিতে শয়ন।।
অর্জ্জুন সমান বীর্য্যবন্ত কোন্ জন।
হেন ভাই কৈল হায় ভূমিতে শয়ন।।
অর্জ্জুন সমান বীর্য্যাবন্ত কোন্ জন।
হেন ভাই কৈল হায় ভূমিতে শয়ন।।
সুন্দর নকুল সহদেব অনুপাম।
বীর্য্যাবন্ত বুদ্ধিমন্ত সর্ব্ব গুণধাম।।
এরূপ দুর্গতি নাহি হয় কোন জনে।
দুষ্টবুদ্ধি জ্ঞাতি দুর্য্যোধনের কারণে।।
আপদে তরয়ে লোক জ্ঞাতির সহায়।
বনে যেন বৃক্ষে বৃক্ষে বাতে রক্ষা পায়।।
দুর্য্যোধন কুলাঙ্গার হৈল জ্ঞাতি-বৈরী।
গৃহ ত্যাজি যার হেতু বনে বনচারী।।
দুর্য্যোধন কর্ণ আর শকুনি দুর্ম্মতি।
ধৃতরাষ্ট্র সেও দুষ্ট করিল অনীতি।।
ধর্ম্মেরে না করে ভয় রাজ্যে লুব্ধ মন।
পাপেতে নিমগ্ন হৈল, দুষ্ট দুর্য্যোধন।।
পুণ্যবলে নাহি দুষ্ট জীয়ে দেববলে।
কোন্ দেবে বরদাতা হৈল কোন্ কালে।।
হেন কদাচার নাহি করে কোন জন।
বিধিমতে শাস্তি আমি দিব ভালে ভালে।।
জ্যেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্র মহারাজা।
তাহাকে নিষেধ করে নাহি হেন রাজা।।
এই পাপে কৌরবেরে করিব নিধন।
অবশ্য মারব আমি শতেক নন্দন।।
এত দুঃখ সহ কেন ঈশ্বর আমার।
আজ্ঞা পেলে কটাক্ষেতে করি যে সংহার।।
মহাধর্ম্মশীল তুমি ধর্ম্মেতে তৎপর।
তাই এত দুঃখ পাও গুণের সাগর।।
সে কারণে আজ্ঞা না করেন যুধিষ্ঠির।
গদার বাড়িতে তার লোটাতে শরীর।।
কোন্ মন্ত্রে মহৌষধি কৈল কোন্ জন।
সে কারণে রহে দুষ্ট তোমার জীবন।।
ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির না জানে পাপাচার।
সে কারণে এ দুঃখ আমা সবাকার।।
কোন কর্ম্মে অশক্ত যে আমি ইহা সব।
তব আজ্ঞা না করেন মারিতে কৌরব।।
কহিতে কহিতে ক্রোধ হৈল বৃকোদর।
দুই চক্ষু লোহিত কচালে দুই করে।।
পুনঃ ক্রোধ সম্বরিয়া দেখে ভ্রাতৃগণে।
নিদ্রা ভঙ্গ না করেন, বিচারিয়া মনে।।
জাগিয়া রহিল ভীম বটবৃক্ষ মূলে।
চারি ভাই মাতা নিদ্রা যায়েন বিভোলে।।
হেনকালে হিড়িম্ব নামেতে নিশাচর।
বিপুল-বিস্তার কায়, লোকে ভয়ঙ্কর।।
দন্তপাটি বিদাকাটী জিহ্বা লহ লহ।
দীর্ঘকর্ণ রক্তর্ব্ণ চক্ষু কূপগৃহ।।
কৃষ্ণ অঙ্গ অতি ব্যঙ্গ শিরা দীর্ঘতর।
সেই কাল ছিল ভাল মহীর উপর।।
পেয়ে গন্ধ হয়ে অন্ধ চৌদিকেতে চায়।
চন্দ্রপ্রভা মুখ শোভা জলরুহ প্রায়।।
সুশোভন ছয় জন দেখি বটমূলে।
হৃষ্টমতি স্বসা প্রতি নিশাচর বলে।।
চারিদিন ভক্ষ্যহীন আছি উপবাসে।
দৈবযোগে দেখ আগে আইল মানুষে।।
সুপ্রভাত অকস্মাৎ মাংস উপনীত।
ছয় জনে মোর স্থানে আনহ ত্বরিত।।
নাহি ভয় আগুসরি যাহ শীঘ্রগতি।
মোর বন কোন্ জন বিরোধিবে তথি।।
ভ্রাতৃ-কথা শুনি তথা চলিল রাক্ষসী।
বীরবর বৃকোদর যথা আছে বসি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
৮০. পাণ্ডবদের নিকট হিড়িম্বার আগমন 
নিশাচরী দূরে থাকি,  বীর বৃকোদরে দেখি,
     শরীর নেহালে ঘনে ঘন।
কিবা সুমেরুর চূড়া, যেন শাল-দ্রুম কোঁড়া,
      শশিমুখ পঙ্কজ-নয়ন।।
সিংহের বিক্রম ধর,  ভুজযুগ করিকর,
      কম্বুকন্ঠ খগবর-নাসা।
অঙ্গ নিরখিয়া ক্ষণে,  মাতিল অনঙ্গ-বাণে,
     মনে চিন্তে হিড়িম্বের স্বসা।।
এমন সুন্দর রূপে,   নাহি দেখি ইহলোকে,
     যক্ষ রক্ষ মনুষ্য ভিতরে।
মম ভাগ্য হেতু বিধি,  মিলাইল হেন নিধি,
     স্বামী আমি করিব ইহারে।।
ভাই মোর দুরাচারী,  এ হেন পুরুষে মারি,
     মাংস খাইবেক মনসুখে।
ইহারে রাখিয়া আমি, বরিয়া করিব স্বামী,
     চিরকাল বঞ্চিব কৌতুকে।।
এতেক কামনা করি,  কামরূপা নিশাচরী,
     দিব্যরূপা হইল কামিনী।
পূর্ণচন্দ্র মুখখানি, নয়ন কুরঙ্গ জিনি,
     স্তন-যুগ বরা নিতম্বিনী।।
কামের কার্ম্মূক ভূরু, তিলফূল নাসা চারু,
     শ্রুতিযুগ নিন্দিত গৃধিনী।
করিকর-যুগ ঊরু, সুন্দর কদলী-তরু,
     মত্ত-বর-মাতঙ্গ-চলনী।।
চম্পক-কুসুম আভা, অঙ্গের বরণ-শোভা,
    কটাক্ষে মোহিত মুনি-মন।
আসিয়া ভীমের পাশে, সলজ্জিত মৃদু-ভাষে,
    কহে যেন কোকিল ভাষণ।।
কহ তুমি কোন্ জন, কোথা হৈতে আগমন,
     কি হেতু আইলা এই বন।
দেবতার মূর্ত্তি প্রায়, ভূমিতলে নিদ্রা যায়,
    কেবা হয় এই চারি জন।।
নিদ্রা যায় নিরুপমা, সুবদনী ঘনশ্যামা,
   এ রামা তোমার কেবা হয়।
এ ঘোর দুর্গম বনে, নিদ্রা যায় অচেতনে,
    নাহি জান রাক্ষস-আলয়।।
তিলেক নাহিক ডর, যেন আপনার ঘর,
    অতিশয় দেখি দুঃসাহস।
এই বন-অধিকারী, পাপ-আত্মা দুরাচারী,
    ভয়ঙ্কর হিড়িম্ব রাক্ষস।।
হ্য় সে আমার ভ্রাতা, মোরে পাঠাইল হেথা,
     তোমা সবা ধরিয়া লইতে।
মনুষ্যাদি-জন বৈরী, মাংসলোভী পাপকারী,
    ইচ্ছা করে তোমারে খাইতে।।
দেখিয়া তোমার অঙ্গ, দহিছে অনঙ্গে অঙ্গ,
    স্বামী করি বরিনু তোমারে।
মিথ্যা নাহি কহি আমি  বুঝি কার্য্য কর স্বামী,
     সাবধান হও রাক্ষসেরে।।
আজ্ঞা কর এইক্ষণে, লৈয়া যাই অন্য স্থানে,
     পর্ব্বত-কন্দর অন্য বনে।
হিড়িম্বার মুখে শুনি, মেঘের নিনাদ-বাণী,
     বৃকোদর কহে ততক্ষণে।।
দেখি তোরে সুলক্ষণী, কহিস্ অনীতি-বাণী,
     এই কথা না সম্ভবে লোকে।
কেন হেন দুরাচারী, ভ্রাতৃ মাতৃ পরিহরি,
     স্ত্রী লইয়া যাইব কৌতুকে।।
সবারে রাক্ষস মুখে, দিয়া আমি যাব সুখে,
    তোমারে লইয়া অন্য স্থান।
কহিতে এমন কাজ, মুখে তোর নাহি লাজ,
    কামশরে হইলি অজ্ঞান।।
এত শুনি নিশাচরী, কহে যোড়কর করি,
     মৃদু মৃদু মধুর বচনে।
আজ্ঞা কর মহাশয়, যে তোমার প্রিয় হয়,
     প্রাণপণে করিব এক্ষণে।।
বড় দুষ্ট মম ভ্রাতা, এখনি আসিবে হেথা,
     সাবধান হইতে জানাই।
জাগাইয়া সর্ব্বজনে,  মোর পৃষ্ঠ-আরোহণে,
     চলহ অন্যত্র লৈয়া যাই।।
ভীম বলে ভ্রাতৃ মায়, সুখে শুয়ে নিদ্রা যায়,
     কেন নিদ্রা করিব ভঞ্জন।
তোর ভাই কোন্ ছার, কেবা ভয় করে তার,
     আমি তারে না করি গণন।।
কীটজ্ঞান করি রক্ষ, দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ,
     নাহি সহে মোর পরাক্রম।
হের দেখ সুলোচনি, আমার যুগল-পাণি,
     দেখিয়া করয়ে ভয় যম।।
যাহ বা থাকহ হেথা, মনে লয় যেই কথা,
    কর চিত্তে যেই অভিলাষ।
নতুবা তথায় গিয়া,  ভায়ে দেহ পাঠাইয়া,
    কি করিবে আসি মোর পাশ।।
ভীম হিড়িম্বাতে কথা, বিলম্ব দেখিয়া হেথা,
     হিড়িম্ব হইল ক্রোধমন।
অতি ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, যুগান্তের সমবর্ত্তী,
    আসে ঘোর করিয়া গর্জ্জন।।
দেখি মহাপ্রিয়ঙ্করী, স্তব্ধ হৈয়া নিশাচরী,
     সকরুণে কহে বৃকোদরে।
হের দেখ মোর ভ্রাত, যেন ঘোর মহাবাত,
     আইসে দুরন্ত-ক্রোধ ভরে।।
নির্দ্দয় নিষ্ঠুরতর, খাইল অনেক নর,
      দেখিয়াছি আমি বিদ্যমান।
বিলম্ব না কর তুমি, বিশেষ রাক্ষস-ভূমি,
      মায়ারী অধিক বলবান।।
বিলম্ব না কর প্রভু, আজ্ঞা মোরে দেহ তবু,
      পৃষ্ঠে করি লই সবাকারে।
উড়িব পবনভরে, যথা বল তথাকারে,
      লৈয়া যাব নিমেষ ভিতরে।।
হিড়িম্বে দেখিয়া উগ্র, হিড়িম্বারে দেখি ব্যগ্র,
      হাসি বলে মরুত-নন্দন।
স্থির হও সুবদানি,  কি ভয় কর লো ধনি,
      বসি দেখ কৌতুক এখন।।
আসুক তোমার ভাই,  মুহূর্ত্তেকে মোর ঠাঁই,
      প্রাণ দিবে পতঙ্গ সমান।
এইমাত্র হবে তোকে,  মজিব ভ্রাতার শোকে,
     ইহা বই নাহি দেখি আন।।
ভারত-সঙ্গীত-রস, শ্রবণেতে পুণ্য যশ,
      সদা শুভ পরম পবিত্র।
কলির কলুষ-নাশ, বিরচিল কাশীদাস,
     আদিপর্ব্বে পাণ্ডব-চরিত্র।।
৮১. হিড়িম্ব রাক্ষস বধ
ভীম-হিড়িম্বাতে হয় কথোপকথন।
দূরে থাকি হিড়িম্ব করয়ে নিরীক্ষণ।।
বসিয়াছে হিড়িম্বা ভীমের বাম দিকে।
ভুবন-মোহন রূপ বিদ্যুৎ ঝলকে।।
কবরী বেড়িয়া দিব্য কুসুমের মালে।
মাণিক প্রবাল মুক্তাহার শোভে গলে।।
বসন ভূষণ দিব্য নূপুর কঙ্কণ।
স্বর্গ-বিদ্যাধরী মোহে নবীন যৌবন।।
প্রিয়ভাষে যেমন দম্পতি কথা কয়।
দেখিয়া হিড়িম্ব ক্রোধে জ্বলে অতিশয়।।
ভগিনীরে ডাক দিয়া বলয়ে হিড়িম্ব।
এই হেতু এতক্ষণ তোমার বিলম্ব।।
ধিক্ তোর জীবনে কুলের কলঙ্কিনী।
মনুষ্য-স্বামীতে লোভ করিলি পাপিনি।।
মম ক্রোধ তোমার হইল পাসরণ।
মম ভক্ষ্যে ব্যাঘাত করিলি সে কারণ।।
এই হেতু আগে তোরে করিব সংহার।
পশ্চাতে এ সব জনে করিব আহার।।
এত বলি যায় হিড়িম্বারে মারিবারে।
নয়ন লোহিত, দন্তকড়মড় করে।।
ভীম বলে, রাক্ষস রে তোর লাজ নাই।
ভাগিনীকে পাঠাইলি পুরুষের ঠাঁই।।
তুই পাঠাইলি, তেঁই আইল হেথায়।
মদনের বশ হৈয়া ভজিল আমায়।।
কামপত্নী আমার হইল তোর স্বসা।
মোর বিদ্যমানে দুষ্ট বলিস দুর্ভাসা।।
মরিবারে চাহ রে করিস্ অহঙ্কার।
এইক্ষণে পাঠাইব যমের দুয়ার।।
মাতা ভ্রাতা শুইয়া নিদ্রায় যে বিহ্বল।
নিদ্রাভঙ্গ হইবেক না করিস্ গোল।।
ভীমের বচনেতে রাক্ষস নাহি থাকে।
ঊর্দ্ধবাহু যায় মারিবারে হিড়িম্বাকে।।
হাসিয়া কুন্তীর পুত্র দুই হাতে ধরে।
এক টানে লয় অষ্ট-ধনুক অন্তরে।।
মহাবল রাক্ষস আপন হাতে কাড়ি।
বৃকোদরে ধরিলেক করিয়া আঁকাড়ি।।
বায়ুর নন্দন ভীম অতি ভয়ঙ্কর।
পরম আনন্দ যার পাইলে সমর।।
মত্ত মৃগপতি যেন ক্ষুদ্র মৃগে ধরে।
পুনরপি টানিয়া লইল কতদূরে।।
দুই জনে টানাটানি ধরি ভূজে ভূজে।
শুণ্ডে শুণ্ডে টানাটানি যেন গজে গজে।।
দুই মেষ যেন মুণ্ডে মুণ্ডে তাড়াতাড়ি।
সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে দন্ত কড়মড়ি।।
দুই মত্ত সিংহ যেন করে সিংহনাদ।
মেঘের নিঃস্বন যেন বজ্রের নিনাদ।।
দোঁহাকার আস্ফালনে ভাঙ্গে বৃক্ষগণ।
পলায় কাননবাসী ত্যজিয়া কানন।।
কাননে পূরিল শব্দ দোঁহার গর্জ্জনে।
নিদ্রাভঙ্গ হইয়া উঠিল পঞ্চজনে।।
বসিয়াছে হিড়িম্বা নিন্দিতা বিদ্যাধরী।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল ভোজের কুমারী।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া কুন্তী উঠি শীঘ্রগতি।
মৃদুভাষে জিজ্ঞাসেন হিড়িম্বার প্রতি।।
কে তুমি, কোথা হৈতে আইলা গো হেথা।
অপ্সরী নাগিনী কিবা বনের দেবতা।।
হিড়িম্বা প্রণাম করি কুন্তী প্রতি বলে।
জাতিতে রাক্ষসী আমি, নিবাস এস্থলে।।
এই বন-নিবাসী হিড়িম্ব নিশাচর।
মহাযোদ্ধা বীর সে আমার সহোদর।।
পঞ্চ পুত্র সহ তোমা ধরি লইবারে।
ভাই মোরে পাঠাইয়া দিল হেথাকারে।।
পরম সুন্দর দেখি তোমার তনয়।
কামে বশ হৈয়া আমি ভজিনু তাহায়।।
বিলম্ব দেখিয়া হেথা আসে মোর ভাই।
তোমার পুত্রের সহ যুঝে দেখ তাই।।
হিড়িম্বার মুখে শুনি এতেক উত্তর।
চারি ভাই ভীম-স্থানে চলিল সত্বর।।
ভীম-হিড়িম্বের যুদ্ধ না যায় বর্ণনা।
যুগল পর্ব্বত-প্রায় দেখি দুই জনা।।
যুদ্ধ-ধূলি-ধূসর দোঁহার কলেবর।
কুজ্ঝাটিতে আচ্ছাদিল যেন গিরিবর।।
দুই ভিতে দোঁহাকারে টানে দুইজন।
নিশ্বাস-পবন ঝড়ে উড়ে বৃক্ষগণ।।
ডাক দিয়া যুধিষ্ঠির বলেন বচন।
রাক্ষসের ভয় ভাই না কর এখন।।
তোমা সহ রাক্ষসের হৈয়াছে বিবাদ।
নিদ্রায় ছিলাম, এত না জানি প্রমাদ।।
সবে মিলি রাক্ষসেরে করিব সংহার।
এত শুনি বলে ভীম পবন-কুমার।।
কি কারণে সন্দেহ করহ মহাশয়।
এইক্ষণে বিনাশিব রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
পথিক লোকের প্রায় দেখ দাণ্ডাইয়া।
এত বলি দিল লাফ ভুজ প্রসারিয়া।।
অর্জ্জুন বলেন, বহু করিলে বিক্রম।
রাক্ষসের যুদ্ধে বহু হৈল পরিশ্রম।।
বিশ্রাম করহ তুমি থাকিয়া অন্তরে।
আমি বিনাশিব ভাই দুষ্ট নিশাচরে।।
অর্জ্জুন-বচনে ভীম অধিক কুপিল।
চুলে ধরি হিড়িম্বেরে ভূমিতে ফেলিল।।
চড় আর চাপড় মুষ্টিক পদাঘাত।
পশুবৎ করি তারে করিল নিপাত।।
মধ্যদেশ ভাঙ্গিয়া করিল দুইখান।
দেখাইল নিয়া সব ভ্রাতৃ-বিদ্যমান।।
পরস্পর আলিঙ্গন পঞ্চ সহোদরে।
প্রশংসিল ভ্রাতৃ-সব বীর বৃকোদরে।।
অর্জ্জুন বলিলেন, চাহিয়া যুধিষ্ঠিরে।
এই ত নিকটে গ্রাম আছে নহে দূরে।।
এই সমাচার যদি শুনে কোন জন।
লোক-মুখে বার্ত্তা তবে পাবে দুর্য্যোধন।।
সে কারণে ক্ষণেক না রহিতে যুয়ায়।
শীঘ্র চল অন্য স্থান ত্যজিয়া হেথায়।।
এই বিবেচনাতে পাণ্ডব পঞ্চজন।
মাতা সহ শীঘ্রগতি করয়ে গমন।।
হিড়িম্বা চলিল তবে কুন্তীর সংহতি।
হিড়িম্বা দেখিয়া ক্রোধে বলয়ে মারুতি।।
সহজে রাক্ষস-জাতি নানা মায়া ধরে।
ধরিয়া মোহিনী বেশ ভাণ্ডে সবাকারে।।
আপন স্বভাব কভা ছাড়িতে না পারে।
সময় পাইলে আমা পারে মারিবারে।।
সহজে ভ্রাতার বৈরী সাধিবার মনে।
আমার সংহতি এ চলিল সে কারণে।।
এক চড়ে করি তোরে ভ্রাতার সংহতি।
এত বলি মারিবারে যায় মহামতি।।
যুধিষ্ঠির বলে ভীম নহে ধর্ম্মাচার।
অবধ্যা স্ত্রীজাতি, কেন করিবা সংহার।।
মহাবল হিড়িম্বেরে করিলা সংহার।
তোমা বধিবারে শক্তি কি আছে ইহার।।
যুধিষ্ঠির বচনে রহিল বৃকোদর।
হিরিম্বা কুন্তীরে কহে হইয়া কাতর।।
কায়মনোবাক্যে মোর সত্য অঙ্গীকার।
তোমা বিনা গুরু মোর গতি নাহি আর।।
তোমারে না ভুলাইব প্রপঞ্চ বচনে।
স্ত্রীলোকের কর্ম্মপীড়া জানহ আপনে।।
কামবশ হৈয়া আমি অজ্ঞান হইনু।
আপন কুলের ধর্ম্ম ভ্রাতৃ ত্যাগ কৈনু।।
সব ত্যজি ভজিলাম তোমার নন্দনে।
এক্ষণে অনাথা আমি নিলাম শরণে।।
শরণাগতেরে ক্রোধ না হয় উচিত।
আপনি করহ দয়া দেখিয়া দুঃখিত।।
সদাই সেবিব আমি তোমার চরণে।
বহু সঙ্কটেতে আমি উদ্ধারিব বনে।।
আজ্ঞা কর আমা ভজিবারে বৃকোদরে।
নহিলে ত্যজিবে প্রাণ তোমার গোচরে।।
কৃতাঞ্জলি করি আমি করি যে বিনয়।
শুনি কুন্তীদেবী তবে দ্রবিল হৃদয়।।
কুন্তীদেবী ডাকিয়া বলিল যুধিষ্ঠিরে।
হিড়িম্বা আসক্ত হইল বৃকোদর বীরে।।
হিড়িম্বা কাতর-বাণী শুনিয়া তখন।
দয়াময় যুধিষ্ঠির কহেন তখন।।
সত্য বলে হিড়িম্বা, নাহিক ইথে আন।
শরণ লইলে জনে করি তার ত্রাণ।।
চলি যাহ হিড়িম্বা লইয়া বৃকোদরে।
যথাসুখে ক্রীড়া কর বনের ভিতরে।।
পুনরপি আমা সবা নিকটে মিলিবা।
আপনার সত্যবাক্য কভু না লঙ্ঘিবা।।
ধর্ম্মের পাইয়া আজ্ঞা অতি হৃষ্টমন।
ভীমে লয়ে হিড়িম্বা চলিল ততক্ষণ।।
শূন্যপথে লইয়া চলিল নিশাচরী।
নানা বন উপবনে ভ্রমে ক্রীড়া করি।।
যথা মন করে তথা যায় মুহূর্ত্তেকে।
নদ নদী মহাগিরি ভ্রময়ে কৌতুকে।।
নিত্য নিত্য নববেশ ধরে অনুপাম।
হেনমতে করে বহু ক্রীড়া অবিশ্রাম।।
কত দিনে ঋতুযোগ হৈল গর্ভবতী।
ভয়ঙ্কর-মূর্ত্তি পুত্র হইল উৎপত্তি।।
জন্মমাত্র যুবক হইল মহাবীর।
যক্ষ রক্ষ সুরাসুরে বিপুল শরীর।।
বিবিধ বরণ কচ ঘট স্থূলাকার।
ঘটোৎকচ নাম তেঁই ভীমের কুমার।।
মহাবলবান হৈল হিড়িম্বা নন্দন।
ইন্দ্রের একাঘ্নী শক্তির যে হবে ভাজন।।
ঘটোৎকচ মাতৃসহ মন্ত্রণা করিয়া।
কৃতাঞ্জলি কহে দোঁহে দণ্ডবৎ হৈয়া।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি আপন আলয়।
স্মরিলে আসিব এই রহিল নিশ্চয়।।
আজ্ঞা পেয়ে মায়ে পুত্রে করিল গমন।
উত্তর দিকেতে গেল আপন ভবন।।
পাণ্ডবেরা চলিলেন সংহতি জননী।
এক স্থানে না থাকেন একই রজনী।।
পরিধান বল্কল শিরে শোভে জটাভার।
কোথাও ব্রাহ্মণ, কোথা তপস্বী-আকার।।
পথে লোকজন দেখি লুকায়েন বনে।
শীঘ্রগতি যান যথা কেহ নাহি জানে।।
ত্রিগর্ত্ত পাঞ্চাল মৎস্যাদি যত দেশ।
ভ্রমিলেন বহুক্লেশ করিয়া বিশেষ।।
হেনমতে ভ্রমেন যে পাণ্ডু- পুত্রগণ।
আচম্বিতে আইলেন ব্যাস তপোধন।।
ব্যাসে দেখি কুন্তীদেবী পুত্রের সহিতে।
কৃতাঞ্জলি প্রণমিলা দাঁড়ায়ে অগ্রেতে।।
ব্যাসের সাক্ষাতে কুন্তী করেন ক্রন্দন।
বহু বিলাপিয়া দেবী বলেন বচন।।
নিবর্ত্তিয়া তাঁরে ব্যাস কহিলেন বাণী।
আমারে কি বল ইহা, সব আমি জানি।।
অধর্ম্ম করিল ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ।
অনেক সঙ্কটেতে ভ্রমিলা বনে বন।।
যত কৈল, অগোচর নাহিক আমায়।
সে কারণে দেখিবারে এলাম হেথায়।।
দুঃখ না ভাবিহ বধূ স্থির কর মন।
অচিরে হইবে তব দুঃখ বিমোচন।।
তব পুত্রগণ গুণ না জানহ তুমি।
মম অগোচর নাহি সব জানি আমি।।
ধর্ম্মবলে বাহুবলে জিনিবে সকলে।
বিভব করিবে সাগরান্ত ভূমণ্ডলে।।
এক্ষণে যে বলি আমি শুন সাবধানে।
বহুদুঃখ পেলে বহু ভ্রমিয়া কাননে।।
নিকটে নগর এই একচক্রা নাম।
কতদিন রহি তথা করহ বিশ্রাম।।
গুপ্তবেশে এইখানে থাক ছয় জনে।
তাবৎ থাক আমি না আসি যত দিনে।।
এত বলি ব্যাস সবে লইয়া সংহতি।
নগরে ব্রাহ্মণ-গৃহে দিলেন বসতি।।
ব্রাহ্মণের গৃহে রহিলেন ছয় জন।
স্বস্থানে গেলেন ব্যাস মহা-তপোধন।।
 

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র