০৬. যদুকুল ধ্বংস ও বলরামের দেহত্যাগএইরূপে বলাবলি হইল বিস্তর।গর্জ্জিয়া উঠিল কৃতবর্ম্মা ধনুর্দ্ধর।।হাতে অসি করি যায়, কাটিবার আশে।গর্জ্জন করিয়া বলে বচন কর্কশে।।আরে দুরাচার পাপী শিনির নন্দন।এতেক তোমার গর্ব্ব না বুঝি কারণ।।গোবিন্দের নিন্দা কর দুষ্ট অধোগামী।ইহার উচিত ফল তোরে দিব আমি।।ভূরিশ্রবা ঢাল খাঁড়া লৈয়া বীর দাপে।কোন্ পরাক্রম কর এতেক প্রতাপে।।নৃপতি সমুহ মধ্যে কৈল অপমান।কোন্ লাজে ধর দুষ্ট এ পাপ পরাণ।।অপমান হৈতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ শত গুণে।ধিক্ ধিক্ আরে দুষ্ট নির্লজ্জ জীবনে।।আমার নিন্দহ দুষ্ট না বুঝি কারণ।পাণ্ডবের সর্ব্বনাশ কৈল কোনজন।।দ্রোণপুত্র প্রবেশিল শিবির ভিতরে।সকল করিল ক্ষয় দ্রোণি একেশ্বরে।।আমা দোঁহে আছিলাম দাণ্ডাইয়া দ্বারে।রে দুষ্ট আমারে গালি দেহ অহঙ্কারে।।এত বলি অসি ল’য়ে কাটবারে ধায়।গর্জ্জিয়া সাত্যকি বলে জমদগ্নি প্রায়।।উচিত কহিতে ক্রোধ হইল তোমার।আমারে মারিতে এস আরে দুরাচার।।তোর দর্প ঘুচাব কাটিব তোর শির।এত বলি অসি ল’য়ে ধায় মহাবীর।।অসির প্রহারে বীর কাটে তার শির।ভূমেতে লোটায় কৃতবর্ম্মার শরীর।।হাহাকার শব্দে ডাকে যতেক যাদব।মার মার বলিয়া ধাইল যত সব।।দেখিয়া অদ্ভুত কর্ম সবিস্ময় মন।আত্মা আত্মা বিবাদী হইল সর্ব্বজন।।কৃতবর্ম্মা বধ হইল দেখিয়া নয়নে।সাত্যকিরে মারিবারে ধায় যদুগণে।।নানা অস্ত্র ফেলি মারে সাত্যকি উপর।মুষলধারায় যেন বর্ষে জলধর।।স্নেহ করি কেহ হৈল সাত্যকির ভিত।অস্ত্র বৃষ্টি করে কেহ অতি ক্রোধচিত।সহোদরে সহোদরে হৈল দুই দল।মার মার শব্দেতে হইল কোলাহল।প্রলয় সময়ে যেন উথলে সাগর।দেবাসুরে হয় যেন যুদ্ধ ঘোরতর।ঘোরতর গর্জ্জন সঘনে সিংহনাদ।ঝাঁকে ঝাঁকে বাণ বৃষ্টি নাহি অবসাদ।।ধনুকে যুড়িতে বাণ বিলম্ব না করে।হাতে অস্ত্র বীর সব করয়ে প্রহারে।।অস্ত্রে অস্ত্র নিবারণ করে জনে জনে।সর্ব্ব অস্ত্র ক্ষয় হৈল অস্ত্র নাহি তূণে।।ক্রোধমনে যুদ্ধ করে নাহি অবসান।দাণ্ডাইয়া কৌতুক দেখেন ভগবান।।অদ্ভুত দেখিয়ে রাম বিষন্নবদন।বৃত্তান্ত জানিয়া স্থির হৈলেন তখন।যুঝয়ে যাবদকূল আপনা আপনি।খড়গ ল’য়ে কেহ কেহ করে হানাহানি।।ধনুকে ধনুকে যুদ্ধ অস্ত্র বরিষণ।ঝঞ্চনা পড়য়ে যেন ভীষণ দর্শন।।ধনুক টঙ্কার শব্দে পূরিল গগন।ভয়ে ভীত তিন লোক শুনিয়া গর্জ্জন।।রনস্থলে গালাগালি করে ভাই ভাই।ইষ্ট বন্ধু কার’ পানে কেহ নাহি চাই।।শক্তি তুলি হানে কেহ কাহার’ উপর।শেল জাঠা শক্তি মারে ভুষণ্ডী তোমর।।আপনা পাসরি সবে কোপে অচেতন।পাথর তুলিয়া মারে ঘোর দরশন।মুদ্গর তুলিয়া কেহ মারে কার’ মাথে।রথ অশ্ব সারথি মারে এক ঘাতে।।আঁকড়ি করিয়া কেহ ধরে রথখান।সিংহনাদ ছাড়ি ফেলে দিয়া এক টান।।প্রহারে না করে ভয় অভেদ্য শরীর।অতুল সাহস সবে রণে মহাবীর।।হেনমতে যুঝে যত যাদব-কুমার।শূন্য কর হৈল কার’ অস্ত্র নাহি আর।।যতেক বিক্রম কৈল কিছু না হইল।যাদবগণের অঙ্গ তিল না ভেদিল।।উপায় করেন তবে দেব ভগবান।নিকটে খগ্ড়ার নল বন উপজিল।।যদুগণে দেখাইয়া কন দামোদর।নল বৃক্ষ ফেলি মার সবে পরস্পর।।এই উপদেশ যদি যদুগণে পায়।শীঘ্রগতি নলবন উপাড়িতে যায়।।নল খাগ্ড়ার গাছ ধরি যদুগণ।অন্যে অন্যে প্রহার করয়ে জনে জন।।অস্ত্রেতে না ভেদে যেই যাদব শরীর।নল খাগ্ড়ার ঘায় পড়ে সব বীর।।অঙ্গে পরিশিবামাত্র পড়ে সেইক্ষণ।ব্রহ্মশাপে ধ্বংস হয় যত যদুগণ।।জনে জনে মারামারি অতিশয় ক্রোধ।ভাই ভাই খুড়া জ্যেঠা নাহি উপরোধ।।হেনমতে যদুগণে হয় মহারণ।দারুকে ডাকিয়া কন শ্রীমধুসূদন।সত্বরে দারুক যাহ মথুরানগরে।মম রথ করি লহ বজ্র মহাবীরে।।মথুরায় রাখ নিয়া প্রপৌত্র আমার।অস্ত গেল যদুকুল কিবা দেখ আর।।সে কারণে বজ্র লৈয়া যাও মথুরায়।স্ত্রীগণ লইয়া পিছে যাইবে তথায়।।আমিও পৃথিবী ছাড়ি যাব নিজস্থানে।আজি হৈতে সপ্তম দিবস পরিমাণে।।কার্ত্তিকী পূর্ণিমা হবে কৃত্তিকানক্ষত্র।সেই দিনে দ্বারাবতী গ্রাসিবে সমুদ্র।।এই সব বিবরণ কহিবে সবারে।ব্রহ্মশাস্ত্র বুঝাইবে শোক নাশিবারে।।তথা হৈতে হেথায় আইস শীঘ্রগতি।পুনঃ যাইবারে হবে হস্তিনা বসতি।।পাণ্ডবগণেরে দিয়া মম সমাচার।আনিবেক প্রিয়সখা অর্জ্জুন আমার।।এত বলি দারুকেরে দিলেন বিদায়।বজ্রে ল’য়ে দারুক গেল মথুরায়।।প্রদ্যুম্নের পৌত্র অনুরুদ্ধের তনয়।উষার উদরে জন্ম বজ্র মহাশয়।।মধুপুরে রাখি তারে কৃষ্ণের আদেশে।সবাকারে সমাচার দিলেক বিশেষে।।দারুক বচনে সবে হৈল চমৎকার।আকাশ ভাঙিয়া শিরে পড়ে সবারকার।।অস্থিত হইয়া সবে ভূমিতলে পড়ি।চিত্রের পুত্তলি প্রায় যায় গড়াগড়ি।।অচেতন দেখিয়ায় দারুক সবাকারে।ব্রহ্মশাপ বুঝাইল বিধিধ প্রকারে।।ব্রহ্মে মন নিযুক্ত করিয়া সবাকার।শ্রীকৃষ্ণের নিকটে চলিল পুনর্ব্বার।।আসিয়া দেখিল সেই প্রভাসের তীরে।ভূমিতলে পড়িয়াছে যত যদুবীরে।।অন্যে অন্যে মারি সবে হইল নির্ম্মূলে।।ধূলায় ধুসর তনু অবনী লোটাই।কেবল আছেন রামকৃষ্ণ দুই ভাই।।শোকেতে আকুল হৈল দারুক সারথি।মূর্চ্ছিত হইয়া সেই পড়িলেক ক্ষিতি।।প্রবোধিয়া গোবিন্দ কহেন দারুকেরে।সত্বর দারুক যাহ হস্তিনানগরে।।আমার পরম বন্ধু পাণ্ডুর নন্দন।অর্জ্জুনে আনিতে শীঘ্র করহ গমন।।কৃষ্ণ আজ্ঞা পেয়ে চলে দারুক সারথি।হস্তিনানগরে গেল বিষাদিত মতি।।বলভদ্রে কহিলেন দেব নারায়ণ।অবধান কর দেব করি নিবেদন।এইখানে আপনি থাকহ একেশ্বর।দ্বারকা হইতে আমি আসি ত্বরাপর।।মাতা পিতা পরিজন না পায় বারতা।সবা সম্বোধিতে আমি যাই শীঘ্র তথা্যাবৎ না আসি আমি দ্বারকা হইতে।তাবৎ আপনি হেথা থাক এইমতে।।কৃষ্ণবাক্যে বলভদ্র করেন স্বীকার।তোমা বিনে গতি ভাই কে আছে আমার।।রামেরে রাখিয়া কৃষ্ণ করেন গমন।দ্বারকানগরে আসি দেন দরশন।।জনক জননী পুরনারীগণ যত।সবাকারে প্রবোধ করেন সমুচিত।পূর্ব্বে যত অমঙ্গল হইল অপার।প্রভাসে গেলাম করিবারে প্রতীকার।।স্নান করি একত্রে বসিল সর্ব্বজন।কথায় কথায় দ্বন্ধ করিল সৃজন।।সেই দ্বন্ধে মহাকোপ হয় সবাকার।আত্ম আত্ম যুদ্ধ করি হইল সংহার।।একজন যদুকূলে আর কেহ নাই।কেবল আছি যে রামকৃষ্ণ দুই ভাই।।শোকেতে আকুল রাম না আইসে ঘরে।তপ আচরেণ তিনি প্রভাসের তীরে।।আমিও শোকেতে প্রাণ ধরিতে না পারি।গৃহবাস ছাড়িলাম হব তপশ্চারী।।সংসার অসার মাত্র সব মায়াজাল।ইহাতে মোহিত হৈলে বৃথা যায় কাল।।এমতি সংসার ধ্বন্ধ দেখ ভাবি মনে।স্থিরমতি করি মন দেহ তত্ত্বজ্ঞানে।।বিষাদ ত্যজিয়া সবে ধর্ম্মে দেহ মন।এত বলি মেলানি মাগেন নারায়ণ।।সবার জীবন হরি নিল নারায়ণ।চিত্রের পুত্তলি প্রায় রহে সর্ব্বজন।।শ্বাসমাত্র শরীরে আছিল সবাকার।অবনী লোটায় লোক শবের আকার।।রামের নিকটে আসি শ্রীমধুসূদন।ভাই ভাই মিলিয়া করেন আলিঙ্গন।।প্রভাসের তীরে রাম যোগাসন করি।হৃদয়ে পরমব্রহ্ম জপে মন করি।।যুগল নয়নে হেরি কৃষ্ণের বদন।যোগে তনু ত্যজিলেন রোহিণীনন্দন।ভারত মুষলপর্ব্ব ব্যাস বিরচিত।কাশীরাম দাস কহে করিয়া সঙ্গীত।।০৭. শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগযদুবংশে অবতরি, বাসুদেব নাম ধরি,কৌতুকেতে অবনীবিহারী।যাঁহার কটাক্ষে হয়, সৃজন পালন লয়,ভকত-বৎসল চক্রধারী॥যাঁর নাম গুণ গাই, সর্ব্বপাপে ত্রাণ পাই,নাহি রহে ‘শমনের ভয়।ব্রহ্মশাপ লক্ষ্য করি, ক্ষিতিভার ত্রাণ করি,নিজ বংশ সব করি ক্ষয়॥এক জন নাহি শেষ, হৃদে চিন্তি হৃষীকেশ,নিজ দেহ ত্যজিতে বিচারি।প্রভাস তীর্থের তীরে, উঠিলেন শাখী পরে,বসিলেন শাখায় মুরারি॥বসিয়া বৃক্ষের পর, চিন্তিলেন চক্রধর,নিজ দেহ ত্যাগের কারণ।এক পদ তরু পর, আরোহিয়া গদাধর,নম্র করি দ্বিতীয় চরণ॥আপনা চিন্তিয়া মনে, বসি প্রভু শাখাসনে,মৌনেতে আছেন গদাধর।নম্রকায় মন্দগতি, ব্যাধ এল এক তথি,মৃগয়ার ছলে একেশ্বর॥জ্বরা ব্যাধ ধরে নাম, ধনুর্ব্বেদে অনুপম,হাতে ধরি দিব্য শরাসন।মৃগ মারিবার ছলে, ব্যাধ আসি সেই স্থলে,দেখিলেক কৃষ্ণের চরণ॥ধ্বজবজ্রাঙ্কুশপদ, রবিবিম্ব কোকনদ,শত পদ্ম যেন সুশোভন।রাতুল চরণ দেখি, ব্যাধসুত হৈল সুখী,মৃগকর্ণ হেন নিল মন।মুষলের শেষে পাই, যেন বাণ নিরামাই,দৈবে সেই বাণ নিল হাতে।টানিয়া ধনুকখান, সন্ধানিয়া মারে বাণ,চরণ ভেদিল জগন্নাথে॥বাণ মারি ব্যাধসুত, বৃক্ষতলে এল দ্রুত,অপূর্ব্ব দেখিয়া হৈল ভীত।কিরীট কুণ্ডল হার, নানা রত্ন অলঙ্কার,হৃদয়ে কৌস্তুভ সুশোভিত॥পাঞ্চজন্য সুদর্শন, পাদপদ্ম সুশোভন,চতুর্ভুজ গলে বনমালা।শ্রীবৎসলাঞ্ছন দেহে, মণি বিভূষণ তাহে,নবমেঘে যেমন চপলা॥অম্লান তুলসী-মাল, আকর্ণ-লোচন ভাল,অলকা তিলকা ভালে সাজে।পরিধান পীতবাস, মুখচন্দ্র সুপ্রকাশ,কত শোভা কত দ্বিজরাজে॥ভয়ার্ত্ত হইয়া ব্যাধ, মাগি নিজ অপরাধ,প্রণমিয়া প্রভুর চরণে।কৃপাময় অবতরি, অনাদি পুরুষ হরি,তুমি সার এ তিন ভুবনে॥আমি পাপী দুরাশয়, অজ্ঞানেতে মূর্ত্তিময়,অপরাধ করিনু গোঁসাই।শুন প্রভু চক্রপাণি, যে কর্ম্ম করিনু আমি,আমার নিষ্কৃতি কভু নাই॥শুনিয়া ব্যাধের বাণী, আশ্বাসেন চক্রপাণি,শুন ব্যাধ না করিহ ভয়।মম দেহ ত্যাগকালে, নয়নেতে নিরখিলে,স্বর্গে যাবে কহিনু নিশ্চয়॥রামচন্দ্র অবতারে, পিতৃসত্য পালিবারে,প্রবেশিনু অরণ্য ভিতর।সীতা নামে মম নারী, রাবণ লইল হরি,অন্বেষিতে দুই সহোদর॥সাক্ষৎ হইল বনে, আর চারি কপিসনে,সখা হৈল সহিত আমার।বধ করি বলিরাজা, সুগ্রীবে করিনু রাজা,ছিলে তুমি বালির কোঙর॥মারিয়া লঙ্কার পতি, উদ্ধারিনু সীতাসতী,দিতে বর যাচিনু তোমারে।পিতৃবৈরি মারিবারে, বর মাগি নিলা মোরে,আমিও ছিলাম অঙ্গীকার॥সেই প্রয়োজন ফলে, জন্ম হৈল ব্যাধকুলে,মুক্ত হ’য়ে যাহ স্বর্গপুরে।হেনকালে আচম্বিত, পুষ্পবৃষ্টি অপ্রমিত,রথ এল ব্যাধের গোচরে॥চাহিয়া গোবিন্দপদ, রথ আরোহিয়া ব্যাধ,স্বর্গপুরে করিল গমন।শ্রীমধুসূদন হরি, হৃদয়ে ভাবনা করি,নিজ দেহ ত্যাজেন তখন॥জ্যোতির্ম্ময় নিজ অঙ্গে, প্রবেশি পরম রঙ্গে,দেবগণ করে স্তুতিবাণী।দুন্দূভি-নিনাদ বাজে, অপ্সরী কিন্নরী নাচে,হুলাহুলি অমর রমণী॥পুষ্পবৃষ্টি করে সবে, পারিষদগণ সেবে,স্তুতি করে সুর মুনিগণ।চতুর্ম্মুখে বিধিবর, পঞ্চমুখে মহেশ্বর,করপুটে করয়ে স্তবন॥অখিল হইল দীপ্ত, ভুবন হইল তৃপ্ত,আনন্দিত যত দেবগণ।শুনরে ভকত ভাই, স্মরণেতে মুক্তি পাই,এড়াই শমন দরশন॥ভক্তবশ গুণনিধি, ভক্তবাঞ্ছা করে সিদ্ধি,নাহি আর ভক্তির সমান।কাশীদাস বলে যদি, পার হবে ভব-নদী,ভজ সেই দেব ভগবান॥০৮. অর্জ্জুনের দ্বারকায় আগমন এবংপ্রভাসে রামকৃষ্ণের মৃতশরীর দর্শনহস্তিনা নগরে এল দারুক সারথি।করজোড়ে কহে কথা ধর্ম্মরাজ প্রতি।।অবধান কর রাজা পাণ্ডুর নন্দন।কৃষ্ণ পাঠাইল মোরে তোমার সদন।।গোবিন্দের প্রিয়বন্ধু তোমা পঞ্চভাই।তোমার ভাবনা বিনে অন্য মনে নাই।।সে কারণে আমারে পাইলেন হেথা।দ্বারকা লইয়া যাইব পার্থ মহারথা।বহুদিন তাঁর সহ নাহি দরশন।হেই হেতু লইতে কহেন নারায়ণ।।তিলেক বিলম্ব রাজা না হয় বিচার।শীঘ্রগতি অর্জ্জুন করুন অগ্রসর।।কৃষ্ণের বচন শুনি পঞ্চ সহোদর।দারুকেরে বসাইয়া করিয়া আদর।।বসিয়া সুস্থির চিত্ত না হয় দারুক।হৃদয় দহিছে শোকে বৈসে হেঁটমুখ।দারুকের চিত্ত রাজা দেখি উচাটন।বিস্ময় ভাবিয়া মানিছেন মনে মন।।এইত দারুক হয় কৃষ্ণের সারথি,যেই কৃষ্ণ অনাদি পুরুষ লক্ষ্মপতী।।তাঁহার আশ্রিত জন কি দুঃখে দুঃখিত।ইহার কারণ কিছু না বুঝি কিঞ্চিৎ।।এত চিন্তি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।কিহেতু দারুক এত চিত্ত উচাটন।।কৃষ্ণের আশ্রিত জন কিবা তব দুঃখ।কি দুঃখে ত্রাসিত হৈলে কহত দারুক।।সাত্যকি প্রদ্যুম্ন শাম্ব যাদব সকল।কেমন আছেন অনুরুদ্ধ মহাবল।।কেমন আছেন সবে কহ সত্যবাণী।কহ দেখি কৃষ্ণের কুশলবার্ত্তা শুনি।তব চিত্ত উচাটন দেখিয়া নয়নে।প্রাণাধিক মিত্র মম ধৈর্য্য নাহি মানে।।কৃষ্ণের কুশল কহ দারুক সারথি।কেমন আছেন প্রিয়বর যদুপতি।।শুনিয়া দারুক কহে যোড়করি হাত।সে সকল অবগত হইবে পশ্চাত।ত্বরিত অর্জ্জুনে রাজা করহ বিদায়।বন্ধুজন দেখিতে চাহেন যদুরায়।।শুনি অনুমতি দেন পাণ্ডুবংশপতি।সুসজ্জ হইয়া পার্থ যান শীঘ্রগতি।।ত্বরিত গমনে পার্থ দ্বারকানগরী।বিস্ময় মানেন সেই দ্বারাবতী হেরি।।পূর্ব্বরূপ শোভা কিছু না সেখানে আর।শূন্যাকার পুরীখান দিনে অন্ধকার।।পুরেতে পুরুষ নাহি কেবল রমণী।।চিত্র-পুত্তলিকা প্রায় আছে অনুমানি।।শুষ্ক ওষ্ঠ শুষ্ক মুখ শুষ্ক সর্ব্ব অঙ্গ।না হয় আনন্দ বাদ্য নৃত গীত রঙ্গ।।মনুষ্যের শব্দ নাহি দ্বারকানগরে।কপোত পেচক শিবা চৌদিকে বিহরে।।গৃধ্র কঙ্ক নানা পক্ষী উড়ে বসে পালে।ঘোরতর শব্দ করি উঠে বসে চালে।।এত সব দেখি পার্থ হইয়া চিন্তিত।চক্ষেতে পড়য়ে জল চিত্ত বিকলিত।।বসুদেব দৈবকী রোহিণী তিনজন।প্রাণহীন জন যেন ভূমিতে শয়ন।।প্রণমিয়া জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুন-বারতা।শুষ্কতনু সবার বদনে নাহি কথা।।পুনঃ পুনঃ পার্থ বীর করেন জিজ্ঞাসা।হরি বলি কান্দে সবে নাহি অন্য ভাষা।।কৃষ্ণ বিনা প্রাণ নাহি বলে সর্ব্বজন।চিন্তাম্বিত হইলেন কুন্তীর নন্দন।।দারুক বলেন পার্থ কি কর ভাবনা।প্রভুরে দেখিবা যদি চল সর্ব্বজনা।।প্রভাসের তীরেতে আছেন তথাই।।এতবলি সত্বরে চলিল দুইজন।শূন্যময় হৈল পুরী দ্বারকা ভুবন।।পথ বিহরণে সবে যায় ধীরে ধীরে।আসিয়া মিলিল সবে প্রভাসের তীরে।।তথায় দেখিয়া যদুকুলের সংহার।ভূমে গড়াগড়ি যায় অঙ্গ সবাকার।।হাহা রবে কান্দিলেন ইন্দ্রের নন্দন।করেন বিলাপ বহু মহাশোক মন।।রামের শরীর দেখি প্রভাসের তীরে।বিলাপ করেন পার্থ লুন্ঠিত শরীরে।।হায় যদুকুলপতি বীর হলধর।মুষল লাঙ্গল কেন ভূমির উপর।।সকল ত্যজিয়া প্রভু যোগে দিলা মন।দুষ্ট দৈত্য বিনাশ করিবে কোন্ জন।।ভারাবতরণ হেতু আসি ক্ষিতিতলে।পৃথিবীর ভার হরি যোগ আচরিলে।।বারেক উত্তর দেহ রেবতীরমণ।কান্দিয়া আকুল তব বন্ধু পরিজন।।তবে ধনঞ্জয় যায় বৃক্ষের তলায়।প্রাণনাথ কৃষ্ণদেহ দেখিয়া তথায়।।কৃষ্ণদেহ কোলে করি কান্দিছেন বীর।পৃথিবী তিতিল তাঁর নয়নের নীর।মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।০৯. অর্জ্জুনের বিলাপহায় কৃষ্ণ প্রাণধন, বন্ধুরূপে নারায়ণ,করুণা সাগর অবতার।পাণ্ডবের প্রাণধন, সব হৈল অকারণ,তোমা বিনা দিবসে আঁধার।।করুণা নিদান হরি, বৃষ্ণিকুলে অবতরি,দুষ্ট নাশি শিষ্টের পালন।হলধর সহ লীলা, করিলে অনেক খেলা,দেবকার্য্য করিলে সাধন।।ধরণীর ভার হরি, ধর্ম্মের স্থাপন করি,বসুমতী করিলে তোষণ।অনাথ পাণ্ডবগণে, কৃপা কৈলে নিজগুণে,বন্ধুরূপে করিলে পালন।।আমি সখা প্রিয়তম, সারথ্য করিলে মম,নাম হৈল অর্জ্জুন-সারথি।ওহে প্রভু কৃপাসিন্ধু, পাণ্ডবগণের বন্ধ,দ্বারকা-নিবাসী যদুপতি।।পূর্ব্বে যে কহিলে তুমি, এক আত্মা তুমি আমি,কৃষ্ণ ধনঞ্জয়ে নাহি ভেদ।পাণ্ডুপুত্র পঞ্চজনে, ভেদ নাহি মম সনে,অজ শিব জানে চারি বেদ।।নিজ চন্দ্রানন বাণী, বিস্মরিলে যদুমণি,ভ্রাতৃগণে না কর স্মরণ।চারি বেদে গায় তোমা, গুণের নাহিক সীমা,কৃপাসিন্ধু ভক্তের জীবন।।অনাথ দুর্ব্বল জনে, তুমি নাথ অনুক্ষণে,বিষম সঙ্কটে কর পার।যেই জন ভক্ত হয়, চরণে শরণ লয়ষ,তিন লোকে সম নয় তার।।মোরা সব অল্পমতি, না করিনু ভক্তি স্তুতি,না ভজিনু তোমার চরণ।তোমা হেন ধন পেয়ে, পাপ চক্ষে নাহি চেয়ে,বন্ধুরূপে কৈনু সম্ভাষণ।।কৃপায় আপন গুণে, আমা ভাই পঞ্চজনে,সঙ্কটে রাখিলে বারে বার।অনাথ পাণ্ডবগণে, কি করিবে তোমা বিনে,বন্ধুরূপে কে রাখিবে আর।।রাজ্য ধন বন্ধু জায়া, ত্যজিয়া সকল মায়া,নিজস্থানে করিলে গমন।এমত করিবে যদি, মো সবারে গুণনিধি,না কহিলে কিসের কারণ।।মুষলপর্ব্বের কথা, বিচিত্র ভারত গাথা,সর্ব্বদুঃখ শ্রবণে বিনাশ।কমলাকান্তের সুত, হেতু সুজনের প্রীত,বিরচিল কাশীরাম দাস।।১০. অর্জ্জুন কর্ত্তৃক শ্রীকৃষ্ণাদিরঔর্দ্ধদেহিক কার্য্য সম্পাদনকৃষ্ণের শরীর পার্থ কোলেতে করিয়া।বিলাপ করেন বহু কান্দিয়া কান্দিয়া।।কৃষ্ণ প্রাণ, কৃষ্ণ নাথ, কৃষ্ণ ধন জন।কৃষ্ণ বিনা পাণ্ডবের আছে কোন জন।।এত দিনে পাণ্ডবেরে বঞ্চিলেন বিধি।কোন্ দোষে হারাইনু কৃষ্ণ গুণনিধি।।এই দ্বারাবতী আমি পূর্ব্বে আসিতাম।আমারে পাইলাম কত পাইতে আরাম।।সখা সখা বলি মোরে করি সম্বোধন।ভুজ প্রসারিয়া আসি দিতে আলিঙ্গন।।পূর্ব্বেতে কহিলে তুমি সবার ভিতর।কৃষ্ণার্জ্জুন এক তনু নহে ভিন্ন পর।।পাণ্ডুপুত্রগণ মোর প্রাণের সমান।পাণ্ডবের কার্য্যেতে বিক্রীত মম প্রাণ।।সারথিত্ব করিয়া সঙ্কটে কৈলে পার।দুর্য্যোধন-ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার।।আমি তব সখা, প্রাণসখী যাজ্ঞসেনী।পরম বান্ধবরূপে রাখিলে আপনি।।পাখা যেন রক্ষা করে পক্ষীর জীবন।সলিল রক্ষিত যেন মৎস্য আদি গণ।।সেইরূপ পাণ্ডব রক্ষিত নারায়ণ।তোমা বিনা কোন মতে রহিবে জীবন।।দয়াময় কৃষ্ণ নীরব কিবা কারণে।কোন্ দোষে দোষী হৈনু তোমার চরণে।।তব প্রিয়সখা আমি সেই ধনঞ্জয়।সখারে বিমুখ কেন হৈলে দয়াময়।।একবার চাহ প্রভু মেলিয়া নয়ন।সখা বলি বারেক করহ সম্বোধন।।বারেক দেখাও চাঁদমুখের সুহাস।বারেক বদনচাঁদে কহ সুধাভাষ।।রত্ন-সিংহাসন ত্যজি ভূমিতে শয়নে।চাঁদমুখ শুখাইল রবির কিরণে।।কোন্ মুখে যাব আমি হস্তিনা নগরে।কি বলিব গিয়া আমি রাজা যুধিষ্ঠিরে।।ভাইগণে কি বলিব দ্রৌপদীর তরে।কেমনে ধরিবে প্রাণ ধর্ম্ম নৃপবরে।।হায় বিধি এত দিনে করিলে বিনাশ।কোন্ দোষে হারাইনু বন্ধু শ্রীনিবাস।।বিস্মরিলে সব কথা স্বীকার করিয়া।সঙ্গে নিলে নিজ জনে পাণ্ডবে ত্যজিয়া।।ভাগ্যবন্ত যদুকুল নাহি পুণ্য সীমা।ইহলোকে পরলোকে পাইলেন তোমা।।আমা সম হতভাগ্য পাপিষ্ঠ দুর্ম্মতি।কোন্ গুণে পাব সেই কৃষ্ণপদে মতি।।হা কৃষ্ণ কমলাকান্ত করুণানিদান।তোমা বিনা রহে মম হৃদয় পাষাণ।।কি বুদ্ধি করিব আমি, কোথাকারে যাব।আর কোথা সে চাঁদবদন দেখা পাব।।শিরেতে হানিয়া ঘাত কান্দিয়া অধীর।ভূমে গড়াগড়ি যান পার্থ মহাবীর।।দারুক সারথি বোধ করায় অর্জ্জুনে।স্থির হও ধনঞ্জয়, শোক ত্যজ মনে।।অকারণে শোক কৈলে কি হইবে আর।আমি যাহা কহি, তাহা শুন সারোদ্ধার।।বিধি নীতি আছে যেই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।আপনি সবার শীঘ্র কর প্রেতকর্ম্ম।।পূর্ব্বেতে আমারে কহিলেন গদাধর।সবা হৈতে বড় প্রিয় পার্থ ধনুর্দ্ধর।।যোগ আচরিয়া পিছে পাইবে আমারে।এই কথা দারুক কহিবে পাণ্ডবেরে।।সে কারণে এই কর্ম্ম হয়ত বিহিত।সবার সৎকার কর্ম্ম করিতে উচিত।।এমত সান্ত্বনা করে দারুক অর্জ্জুনে।সৎকার করিতে পার্থ চিন্তিলেন মনে।।চন্দনের কাষ্ঠ তথা আনি রাশি রাশি।জ্বালিলেন চিতা-অগ্নি গগন পরশি।।দেবকী রোহিণী বসুদেবের সহিত।অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করিলা হরষিত।।রেবতী রামের সঙ্গে পশে হুতাশন।অগ্নিকার্য্য সবাকার করেন অর্জ্জুন।।সবাকার অগ্নিকার্য্য করি সমাপন।বিধিমতে করিলেন শ্রাদ্ধাদি তর্পণ।।কৃষ্ণলীলা কেবা বুঝে মহিমা অপার।কাশী বলে, শুন জীব, হবে ভব পার।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon