বিরাট রাজ

বিরাটরাজ : তিনি মৎস্যদেশের রাজা। তার স্ত্রীর নাম সুদেষ্ণা। তার তিন পুত্র। শঙ্খ, শ্বেত ও ভূমিঞ্জর বা উত্তর। তার একটি কন্যা, নাম উত্তরা, তার স্বামী অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু। তিনি প্রচুর ধনরত্নের অধিকারী। গো-সম্পদের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। পান্ডবদের দ্বাদশ বৎসর বনবাস শেষ হলে এক বৎসর অজ্ঞাতবাস মৎস্যদেশের রাজা বিরাট রাজার প্রাসাদে ছদ্মনামে কর্মচারি হিসেবে কাজ করার জন্য সকলেই রাজী হন।

যুধিষ্ঠির কঙ্ক নাম ধারণ করে বিরাট রাজার সভাসদ হন, ভীম বল্লব নাম ধারণ করে পাকশালার পাচক হন, অর্জুন বৃহন্নলা নাম ধারণ করে নপুংসক সেজে নৃত্য-গীত শিক্ষক হন, নকুল গ্রন্থিক নাম ধারণ করে অশ্বরক্ষক হন, সহদেব তন্তিপাল নাম ধারণ করে গো-শালার রক্ষক হন এবং দ্রৌপদী বিরাট রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার সৈরিন্ধ্রী হন ( পরিচারিক, যিনি কেশ বিন্যাসে নিপুণ)। এভাবে চার মাস গত হলো। পান্ডবগন সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে পারদর্শীতা প্রমাণ করে বিরাট রাজার প্রিয়ভাজন হন।

একদিন বিরাট সেনাপতি ও সুদেষ্ণার ভ্রাতা কীচক বিরাট ভবনে দ্রৌপদীকে দেখে তাকে পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং দ্রৌপদীর রূপ দেখে রাজা বিরাট পাছে তার প্রতি আকৃষ্ট হন সে কারণে সুদেষ্ণাও কীচককে অনুপ্রাণিত করছিল। একদিন কোন এক পর্ব উপলক্ষে সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে কীচকের ভবনে প্রেরণ করলে কীচক দ্রৌপদীকে স্পর্শ করেন। দ্রৌপদী কীচকে সজোরে ধাক্কা মেরে বিরাটের রাজ সভায় উপস্থিত হন। সাথে সাথে কীচকও সভায় উপস্থিত হয়ে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে পদাঘাত করেন। কিন্তু বিরাট কীচকের ভয়ে ও পান্ডবদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরবতা পালন করেন। দ্রৌপদী এ অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভীমকে অনুপ্রাণিত করেন এবং ভীম কীচককে হত্যা করেন। কীচকের মৃত্যুতে বিরাট রাজা ভয় পেয়ে দ্রৌপদীকে চলে যাওয়ার জন্য তার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে বলেন।

এদিকে পান্ডবগণ অজ্ঞাতবাসে কোথায় আছে তা জানার জন্য চারিদিকে চর পাঠালে দুর্যোধন। বিশ্বস্থ সূত্রে দুর্যোধন জানতে পারলেন বিরাট রাজার সেনাপতি কীচকে অদৃশ্য গন্ধর্বরা হত্যা করেছে। ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা বিরাটের রাজ্য আক্রমন করার জন্য দুর্যোধনকে প্ররোচিত করেন। কারণ বিরাট রাজার অনেক ধন-সম্পদ ও গো-সম্পদ আছে। তা করায়ত্ত করতে পারলে পান্ডবদের সাথে যুদ্ধের সময় কাজে লাগবে। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস যেদিন পূর্ণ হলো সেদিনই ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা বিরাট রাজার গো-সম্পদ হরণ করল। দূত মারফত সংবাদ পেয়ে বিরাট রাজা তার ভাই শতানীক ও পুত্র শঙ্খসহ ছদ্মনামধারী পঞ্চ-পান্ডব সুশর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করলেন। দুদলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। সুশর্মা ও বিরাটে মধ্যে দ্বৈরত যুদ্ধ শরু হলো। এক পর্যায়ে সুশর্মা বিরাট রাজাকে পরাজিত করে বন্ধী করে হস্তিনাপুরের দিকে ছুটলেন। পথিমধ্যেই পঞ্চ-পান্ডবদের বাঁধার মুখে পড়েন সুশর্মা। ভীম সুশর্মার রথ ও সারথিকে হত্যা করলেন। তখন বিরাট সুশর্মার রথ থেকে নেমে তার হাত থেকে গদা কেড়ে নিয়ে যুবকের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। ভীম সুশর্মার চুল ধরে ভূমিতে ফেলে মাথায় আঘাত করে বন্ধী সুশর্মাকে বিরাটের কাছে নিয়ে গেলেন। বিরাটরাজ পান্ডবদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাজ্যে অর্পণ করতে চাইলে তারা তার বাক্যেই সন্তুষ্ট হন।

অন্যদিকে বিরাট যখন সুশর্মার সাথে ত্রিগর্তসেনাদের সাথে যুদ্ধরত সে সময় ভীষ্ম, দ্রোণ ও দুর্যোধন মৎস্যদেশে উপস্থিত হয়ে ষাট হাজার গো হরণ করেন। গোপালকগণ বিরাটের পুত্র ভূমিঞ্জয় বা উত্তরকে সংবাদ দেন। উত্তর তখন উত্তরার অনুরোধে বৃহন্নলা(অর্জুন)কে সারথি নিয়ে কৌরবদের সাথে যুদ্ধ করতে গেলেন। বিশাল কৌরব বাহিনী দেখে উত্তর ভয়ে পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করলেন। তখন অর্জুন তাকে সারথি বানিয়ে নিজেই যুদ্ধে নামলেন। মৎস্যদেশে অর্জুনের সাথে কৌরবদের যে ‍যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তাও যেন ছোটখাটো একটি মহাভারতের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্যর রথি-মহারথিরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন কিন্তু কৌরবগন পরাজিত হয়ে নতশিরে হস্তিনাপুরে গমন করেন।

তখন অর্জুন উত্তরকে রাজধানী ফিরে গিয়ে বিরাটরাজকে সুখবর দেয়ার জন্য এবং তিনি নিজেই যুদ্ধ করেছেন তা যেন বলেন, তার পরিচয় না দেয়ার জন্যও বলেন। এদিকে রাজ্যবাসী সবাই জানল উত্তর বিশাল কৌরব বাহিনীকে পরাজিত করেছে। বিরাটের রাজ্যে আনন্দের মহা-উৎসব হচ্ছে। আনন্দে বিরাটরাজ যুধিষ্ঠিরের সাথে দ্যুতক্রীড়ায় বসলেন এবং হাসতে হাসতে বললেন,“আমার পুত্র বিশাল কৌরব বাহিনীকে পরাজিত করেছে। যুধিষ্ঠির বলেন,“ বৃহন্নলা সরাথি ছিল বলেই জয়ী হওয়া গেছে।” এতে বিরাট রাজ অখুশী হলেন। তিনি বলেন,“ তুমি আমার পুত্রকে একজন নপুংসকের সাথে তুলনা করছ? একজন নপুংসক কি ভীষ্ম-দ্রোণাদিকে কি পরাজিত করতে পারে?” তখন যুধিষ্ঠির আবার বললেন,“মহারাজ! ভীষ্ম-দ্রোণাদির সাথে বৃহন্নলা ব্যতীত আর কে যুদ্ধ করতে পারে?” বিরাটরাজ অগ্নিশর্মা হয়ে পাশা দিয়ে যুধিষ্ঠির মুখে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। যুধিষ্ঠিরের ইশারায় তখন দ্রৌপদী একটি স্বর্ণপাত্র এনে ধরলেন যাতে রক্ত মাটিতে না পড়ে। ঠিক তখনই দ্বারপাল এসে জানাল উত্তর ও বৃহন্নলা দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে। যুধিষ্ঠির জানতেন অর্জুনের একটি প্রতিজ্ঞা ছিল যে যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোন কারণে যদি কেহ তাকে রক্তপাত ঘটায় তবে সে জীবিত থাকবে না। তাই যুধিষ্ঠির চালাকি করে দ্বারপালকে শুধু উত্তরকে নিয়ে আসার জন্য বললেন।

। উত্তর এসে দেখলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নাকে রক্ত পাশে দ্রৌপদী বসে আছেন। উত্তর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,“মহারাজ! কে এমন পাপ কার্য করেছে?” বিরাট বলল,“আমি করেছি। তোমার প্রশংসা শোনে সে একজন নপুংসকে প্রশংসা করছিল। তাই আমি থাকে আঘাত করেছি।” উত্তর বলল,“মহারাজ! মহাভুল করেছেন। আপনি অনর্থ কার্য করেছেন। উনাকে প্রসন্ন করুন। ব্রহ্মশাপে যদি না আপনার বংশ বিনাশ করেন।” পুত্রের বাক্য শুনে বিরাট হতবম্ব হয়ে যান এবং করজোরে যুধিষ্ঠিরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বৃহন্নলা বেশী অর্জুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরাট ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্যর রথি-মহারথিদের পরাজিত করার জন্য পুত্র ‍উত্তরের উচ্ছসিত প্রশংসা করছিলেন এবং প্রশ্ন করছিলেন এদের সাথে সে কি করে যুদ্ধ করল। উত্তরে উত্তর বলল,“মহারাজ! আমি যুদ্ধ করেনি। একজন দেবদূত এসে যুদ্ধ করেছে। তিনি কাল বা পরশু আসবেন।” পরদিন রাজ সভায় বিরাটতনয় উত্তর একে একে পান্ডবদের পরিচয় করিয়ে দেন। তখন বিরাট তার কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের সাথে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে অর্জুন তার পুত্র অভিমন্যুর জন্য উত্তরাকে পুত্রবধূ হিসেবে প্রার্থনা করেন।

মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরাট রাজার নিজস্ব কোন উল্লেখযোগ্য ভূমি না থাকলেও তার নামে বিরাট পর্ব। কারণ এ পর্বের মধ্যেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অনেক কাহিনী বিন্যাস সন্নিবেশিত আছে। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের এক বছর তারা এ বিরাট ভবনে কাটিয়েছেন। পান্ডবদের বিশ্বস্থতা বিরাটরাজকে মুগদ্ধ করেছে। বিরাটরাজও পান্ডবদের সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকরা করেনি।

পঞ্চদশ দিবসে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল ‍যুদ্ধ শুরু হলো। তখন দ্রোণের ভল্লের আঘাতে বিরাট নিহত হলেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র