মহাভারত:সভাপর্ব-০১৬--০২০

১৬.রাজসূয় যজ্ঞ প্রসঙ্গ
তবে রাজা যুধিষ্ঠির হৈয়ে হৃষ্টমন।
সহদেবে ডাকি আজ্ঞা করেন তখন।।
ধৌম্য-পুরোহিত-স্থানে জিজ্ঞাসহ আগে।
রাজসূয়-যজ্ঞেতে যতেক দ্রব্য লাগে।।
যা কিছু কহেন ধৌম্য কর সমাবেশ।
দ্বিগুণ করিয়া দ্রব্য করহ বিশেষ।।
পৃথিবীতে আছেন যতেক রাজগণ।
সবান্ধবে সকলে করহ নিমন্ত্রণ।।
দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র এই চারি জাতি।
নিমন্ত্রিতে দূতগণ যাউক ঝটিতে।।
ইন্দ্রসেন বিশোক ও অর্জ্জুনে-সারথি।
তিন জন সংগ্রহ করহ ভক্ষ্য-বিধি।।
ব্রাহ্মণগণের প্রিয়কার্য্য সাধিবারে।
আন ভাল ভাল বস্তু কাতারে কাতারে।।
চর্ব্ব চূষ্য লেহ্য পেয় কর বহুতর।
রস গন্ধ আগি যত জন-মনোহর।।
যখন যে ‍চাহে, তাহা না করিবা আন।
শীঘ্রগতি নিয়োজন কর স্থানে স্থান।।
দ্বিজগণে নিমন্ত্রিতে সত্যবতী-সুত।
রাজ্যে রাজ্যে প্রেরণ করুন নিজ দূত।।
সহদেবে অনুজ্ঞা দিলেন নরপতি।
পুনরপি কৃষ্ণে আনি জিজ্ঞাসে যুকতি।।
আপনি বুঝিয়া আজ্ঞা কর নারায়ণ।
কোন্ কোন্ জনেরে করিব নিমন্ত্রণ।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, হরিশ্চন্দ্রের যে যাগ।
তথা হৈতে বিশেষ করহ মহাভাগ।।
তাঁর যজ্ঞে আসে যে পৃথিবীর রাজন।
ত্রিভুবন লোক তুমি কর নিমন্ত্রণ।।
যম-ইন্দ্র-বরুণ-কুবের-আদি সুরে।
আর যত দেবগণ বৈসে সুরপুরে।।
পাতালেতে নাগরাজ শেষ বিষধর।
পৃথিবীতে বৈসে যত রাজ-রাজেশ্বর।।
যুধিষ্ঠির বলে, দেব কর অবধান।
কোন্ দূত নিমন্ত্রিতে যাবে ‍কোন্ স্থান।।
করিতে দেবেন্দ্র-আদি দেবে নিমন্ত্রণ।
স্বর্গেতে যাইতে শক্ত হৈবে কোন্ জন।।
গোবিন্দ বলেন, নাই অন্যের শকতি।
দেব নিমন্ত্রিতে যাবে ‍পার্থ মহারথী।।
অগ্নি-দত্ত রথ সেই কপিধ্বজ নাম।
শ্বেত চারি অশ্ব যার লোকে অনুপাম।।
সে রথের অগম্য নাহিক ত্রিভুবনে।
তিন লোক ভ্রমিবারে পারে এক দিনে।।
সেই রথে চড়ি পার্থ করহ গমন।
উত্তর দিকেতে গিয়া কর নিমন্ত্রণ।।
পর্ব্বতে যে আছে রাজা কানন-ভিতরে।
মনুষ্যের কি সাধ্য, যাইতে পক্ষী নারে।।
সে সকল রাজগণে করি নিমন্ত্রণ।
কৈলাস-পর্ব্বতে যাবে যথা বৈশ্রবণ।।
তাঁরে নিমন্ত্রিয়া তথা উপদেশ লবে।
মনুষ্য-অগম্য স্বর্গ কেমনেতে যাবে।।
ইন্দ্রসহ ইন্দ্রপুরে যত দেবগণ।
দেব-‌ ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি বৈসে যত জন।।
সবে নিমন্ত্রিয়া যাহ বরুণের পুরী।
তথা হৈতে যাহ যথা মৃত্যু-অধিকারী।।
তব ধর্ম্মে আসিবেক ত্রৈলোক্য-মণ্ডল।
বিশেষে তোমারে স্নেহ করে আখণ্ডল।।
শ্রুতিমাত্র যজ্ঞে করিবেন আগমন।
ইন্দ্র আইলে, না আসে নাহি হেন জন।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব দৈত্য স্দ্ধি সাধ্য ঋষি।
পর্ব্বত সমুদ্র যত অন্তরীক্ষবাসী।।
যারে দেখ তাহারে করিবা নিমন্ত্রণ।
লঙ্কা গিয়া বিভীষণে করিবা বরণ।।
পরম বৈষ্ণব হয় রাক্ষসের পতি।
মম ভক্ত অনুরক্ত ধার্ম্মিক সুমতি।।
বার্ত্তা পেয়ে সেইক্ষণে পাঠাইবে চর।
দূতমুখে নিমন্ত্রিলে আসিবে সত্বর।।
তথাপি যাইবে তুমি, অন্যে নাহি কাজ।
ইন্দ্রের সদৃশ গণি রাক্ষসের রাজ।।
নিমন্ত্রিয়া তাঁরে তুমি আইস সত্বর।
আর যত দুষ্টপনা করে নৃপবর।।
নিমন্ত্রণ পেয়ে যে না আসিবে হেথায়।
বন্ধন করিয়া শীঘ্র আনিবে তাহায়।।
আর তিন দিকেতে যাউক দূতগণ।
মহীপালগণেরে করুক নিমন্ত্রণ।।
এতেক বলিল যদি দেব দামোদর।
শীঘ্রগামী দূতগণে ডাকেন সত্বর।।
রাজগণে লিখিলেন যজ্ঞ-বিবরণ।
দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র আছে যত জন।।
নিজ নিজ রাজ্য হৈতে সকলে আসিবে।
রাজসূয়-যজ্ঞে আসি উৎসব দেখিবে।।
এইরূপে তিন দিকে পাঠাইয়া দূত।
উত্তরে করেন যাত্রা নিজে ইন্দ্রসুত।।
মহাভারতের কথা সুধার সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুন পুণ্যবান।।
১৭. রাজসূয়-যজ্ঞ আরম্ভ
পাইয়া রাজার আজ্ঞা মদ্রসুতা-সুত।
আনাইল শিল্পিগণ পাঠাইয়া দূত।।
নানারত্ন দিল তারে বিরচিতে ঘর।
কোটি কোটি শিল্পীগণ গড়ে নিরন্তর।।
দেবের মন্দির সম রত্নেতে নির্ম্মিত।
হেম-রত্ন মুকুতায় করিল মণ্ডিত।।
এক এক পুর-মধ্যে শত শত ঘর।
তাহাতে রাখিল ভোজ্য পেয় বহুতর।।
অশন-বসন শয্যা রাখে গৃহে গৃহে।
বাপী কূপ জলপূর্ণ, গন্ধে মন মোহে।।
কনক-রজত-পাত্রে করিতে ভোজন।
এক পুরে দূত নিয়োজিল শত জন।।
লক্ষ লক্ষ গৃহ কৈল মনোহর স্থল।
নানা বৃক্ষ রোপিল সহিত ফুল-ফল।।
ভিন্ন ভিন্ন কৈল গৃহ চারি জাতি-ক্রম।
অপূর্ব্ব নির্ম্মাণ কৈল লোকে অনুপম।।
পেয় ভোজ্য নিয়োজিল ইন্দ্রসেন-আদি।
অষ্ট দিক্ হৈতে দ্রব্য আসে নিরবধি।।
হস্তী উষ্ট্র বৃষভ-শকটে লক্ষ লক্ষ।
বৃষভে নৌকায় আসে যত দ্রব্য ভক্ষ্য।।
রাত্রি দিবা সায়ং প্রাতঃ নাহিক বিশ্রাম।
অনুক্ষণ আসিতেছে দ্রব্য অবিরাম।।
ময়-বিরচিত সভা অপূর্ব্ব-নির্ম্মাণ।
সুরাসুর মুনি করে যাহার বাখান।।
তথিমধ্যে ধর্ম্মরাজ যজ্ঞ আরম্ভিম।
দ্বিজ-মুনিগণ সবে দীক্ষা করাইল।।
আপনি ব্রহ্মত্ব করিলেন দ্বৈপায়ন।
সামগ হইল ধনঞ্জয় তপোধন।।
হইলেন হোতা পৈল আর দ্বিজগণ।
অন্য অন্য কর্ম্মে অন্য মুনি-নিয়োজন।।
নকুলেরে কহিলেন, ধর্ম্ম-নরপতি।
হস্তিনা-নগরে তুমি যাহ শীঘ্রগতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ জ্যেষ্ঠতাত বিদুর সহিত।
কৃপ অশ্বত্থামা দুর্য্যোধন সসুহৃদ।।
বাহ্লীক সঞ্জয় ভূরিশ্রবা সোমদত্ত।
শত ভাই কর্ণ সহ রাজা জয়দ্রথ।।
গান্ধারী প্রভৃতি রাজপত্নী সমুদয়।
আর যে আইসে স্নেহ করিয়া আমায়।।
শীঘ্রগতি গিয়া তুমি আনহ সবারে।
চলিল নকুল বীর হস্তিনা-নগরে।।
যজ্ঞের সংবাদ জানাইল সবাকারে।
বাল বৃদ্ধ নারী আদি যত কুরুপুরে।।
হৃষ্টচিত্ত হইয়া চলিল সর্ব্বজন।
দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র আদি প্রজাগণ।।
রাজসূয়-যজ্ঞ শুনি আনন্দিত হৈয়া।
চলিল সকল লোক হস্তিনা ছাড়িয়া।।
হস্তী রথ অশ্ব পত্তি করিয়া সাজন।
চতুরঙ্গ-দলেতে চলিল কুরুগণ।।
ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশিল নকুল সহিত।
দেখি যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন হিতাহিত।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর বাহ্লীক অন্ধরাজে।
আগুসরি আনিলেন আপন সমাজে।।
সবারে কহেন পার্থ বিনয়-বচনে।
এ কার্য্য ‍তোমার কহেন জনে জনে।।
পিতা মহে বলিলেন ধর্ম্মের তনয়।
আপনি বিধান বুঝি কর মহাশয়।।
যাহা হৈতে যেই কার্য্য হইবে সাধন।
স্থানে স্থানে তাহাদিগে কর নিয়োজন।।
যুধিষ্টির ভীষ্ম সহ করিয়া বিচার।
উপযুক্ত বুঝিয়া দিলেন কর্ম্মভার।।
কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য ভীষ্ম সহ করিয়া বিচার।
উপযুক্ত বুঝিয়া দিলেন কর্ম্মভার।।
কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য ভীষ্ম-দ্রোণে অধিকার।
দুর্য্যোধনে সমর্পিল সকল ভাণ্ডার।।
ভক্ষ্য-ভোজ্য অধিকার দেন দুঃশাসনে।
ব্রাহ্মণ-পূজার ভার গুরুর নন্দনে।।
রাজগণে পূজিবারে দিলেন সঞ্জয়ে।
দ্বিজেরে দক্ষিণা দিতে কৃপ মহাশয়ে।।
দান দিতে দিলেন বিদুরে অধিকার।
আপনি নিলেন কৃষ্ণ পরিচর্য্যা-ভার।।
ধৃতরাষ্ট্র সোমদত্ত প্রতীপ-কোঙর।
তিনজন গৃহকর্ত্তা হৈল সর্ব্বেশ্বর।।
সভা রাখিবারে দ্বারী কৈল নিয়োজন।
পূর্ব্ব-দ্বারে নিয়োজিল মহারথিগণ।।
সহস্র সহস্র রথী সঙ্গে তরবার।
মহাবীর ইন্দ্রসেন রাখে পূর্ব্বদ্বার।।
উত্তর-দ্বারেতে অনিরুদ্ধেনিয়োজিল।
ষাইট-সহস্র যোদ্ধা তার সঙ্গে ছিল।।
সাত্যকি দক্ষিণ-দ্বারে হৈল নিয়োজন।
বিংশতি-সহস্র রথী তাহার ভীড়ন।।
পশ্চিম-দ্বারেতে বীর ধৃতরাষ্ট্র-সুত।
তার সঙ্গে দিল রথী যুগল অযুত।।
হাতেতে নিগড় বেত্র লৈয়ে সর্ব্বজন।
নানা অস্ত্র লৈয়ে করে দ্বারের রক্ষণ।।
বলাবল বুঝিবারে রহে বৃকোদর।
এক লক্ষ রথী সঙ্গে ভ্রমে নিরন্তর।।
রাজগণ-আগমণ জ্ঞাত করিবারে।
অধিকার দিল দুই মাদ্রীর কুমারে।।
এই মত সবাকার করি নিয়োজন।
আরম্ভ করেন যজ্ঞ ধর্ম্মের নন্দন।।
দূত-মুখে নিমন্ত্রণ পেয়ে রাজগণ।
সসৈন্যে করিল তবে তথা আগমন।।
দ্বিজ ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র লয়ে চারি জাতি।
স্ব স্ব রাজ্য হৈতে যত আসে নরপতি।।
নানাবর্ণে নানারত্ন যে রাজ্যে যে হয়।
পাণ্ডবের প্রীতি হেতু সঙ্গে করি লয়।।
কেহ কেহ নিল রত্ন পৌরুষ কারণ।
ধর্ম্মযজ্ঞ বুঝি কেহ নিল বহু ধন।।
হস্তী উষ্ট্র বৃষভ শকট নৌকা পূরি।
নানাবর্ণ কত রত্ন লিখিতে না পারি।।
শ্বেত পীত লোহিত অমূল্য যত শিলা।
মাণিক্য বৈদুর্য্য মণি মরকত নীলা।।
প্রবাল মুকুতা হীরা সুবর্ণ বিশাল।
বিচিত্র বসন কত নানাবর্ণ শাল।।
কীটজ লোমজ নানাবর্ণে বিরচিত।
হস্তী অশ্ব রথ পত্তি গবী অগণিত।।
চতুর্দ্দোল করি নিল ‍দিব্য নারীগণ।
তরুণ-শ্যামল অঙ্গ কুরঙ্গ-লোচন।।
অগুরু-চন্দন-কাষ্ঠ কুঙ্কুম কস্তূরী।
নানাবর্ণ পক্ষী নিল পিঞ্জরেতে পূরি।।
এইমত কর লৈয়া যত রাজগণ।
দূত-মুখে শুনি শাত্র করেন গমন।।
উত্তরে হিমাদ্রি, পূর্ব্বে সমুদ্র অবধি।
দক্ষিণেতে লঙ্কা, পশ্চিমেতে সিন্ধুনদী।।
দিবানিশি পথ বহে না হয় বিরত।
পৃথিবীর সর্ব্বলোক একস্থানে স্থিত।।
হস্তী অশ্ব রথ পত্তি নানা বাদ্যধ্বনি।
ধ্বজ-ছত্র-পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।।
জল স্থল উচ্চ নীচ, নাহি দেখি ক্ষিতি।
দিবারাত্রি অবিশ্রাম লোক-গতাগতি।।
চতুর্দ্দিক হৈতে আসে যত ‍রাজগণ।
সভাদ্বারে উপনীত হৈল সর্ব্বজন।।
সবাকারে অভ্যর্থনা করি ধনঞ্জয়।
যথাযোগ্য রহিবারে দিলেন আলয়।।
হিমাদ্রি সমুদ্র-তটে যত দ্বিজ বৈসে।
লিখনে না যায়, কত অহির্নিশি আসে।।
রাজসূয়-যজ্ঞ-বার্ত্তা শুনিয়া শ্রবণে।
দেখিতে আইল কত বিনা নিমন্ত্রণে।।
জলবাসী স্থলবাসী পর্ব্বত-নিবাসী।
লক্ষ লক্ষ যোগী আসে আর সিদ্ধি ঋষি।।
দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা পূজে দ্বিজগণে।
দিব্য গৃহ রহিবারে দিল সর্ব্বজনে।।
এক কোটি দ্বিজ অশ্বত্থামা পরিবার।
দ্বিজগণে পূজে সবে দিয়া উপহার।।
অনেক আইল ক্ষত্র, বহু বৈশাগণ।
অনেক আইল শূদ্র শ্রেষ্ঠ যতজন।।
দুঃশাসন সহ থাকি বহু পরিবার।
রন্ধন করিল কোটি কোটি সূপকার।।
করয়ে পরিবেশন বহু সূপকার।
গৃহে গৃহে স্থানে স্থানে রন্ধন-ব্যাপার।।
স্থানে স্থানে ক্ষণে ক্ষণে ভ্রমে দুঃশাসন।
সামগ্রী যোগায় যত অনুচরগণ।।
পায়স পিষ্টক অন্ন ঘৃত দুগ্ধ দধি।
মনোহর পঞ্চাশ ব্যাঞ্জন যথাবিধি।।
চারি জাতি পৃথক পৃথক সবে ভুঞ্জে।
সুবর্ণের পাত্রে ভুঞ্জে যত নৃপ দ্বিজে।।
খাও খাও, লও লও, একমাত্র শুনি।
কার মুখে নাহি সরে অন্য কোন বাণী।।
বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা, বসিতে আসন।
কুঙ্কুম কস্তূরী মাল্য অগুরু চন্দন।।
কর্পূর তাম্বূল আর যার যাহে প্রীত।
কোথা হৈতে কেবা আনি দেয় আচম্বিত।।
স্বর্গে ইন্দ্র-সহ আছে যত দেবগণ।
পাতালে ভুজঙ্গ-রাজ আর বিভীষণ।।
দেব দৈত্য দানব গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ।
সিদ্ধ সাধ্য ভুজঙ্গ পিশাচ প্রেতপক্ষ।।
কিন্নর বানর নর যত বৈসে ক্ষিতি।
যজ্ঞের সদনে সবে আসে দিবারাতি।।
অদ্ভুত দ্বাপর-যুগে যজ্ঞ আরম্ভিল।
না হইবে ক্ষিতি-মাঝে পূর্ব্বে না হইল।।
সময় বুঝিয়া কৃষ্ণ কহেন বচন।
রাজ-অভিষেক-কর্ম্ম কর মুনিগণ।।
কৃষ্ণের বচন শুনি উঠে মুনিগণ।
নানা তীর্থজল লৈয়া ধৌম্য দ্বৈপায়ন।।
অসিত দেবল জামদগ্ন্য পরাশর।
স্নানমন্ত্র পড়ে আর যত দ্বিজবর।।
স্নান করালেন ব্যাস শুভক্ষণ জানি।
অম্লান-বসন দিল চিত্ররথ আনি।।
শিরেতে ধবল ছত্র সাত্যকি ধরিল।
চেদীপতি রতন মুকুট পরাইল।।
বৃকোদর পার্থ দোঁহে করেন ব্যজন।
চামর ঢুলায় দুই মাদ্রীর নন্দন।।
অবন্তীর রাজা চর্ম্ম-পাদুকা লইল।
খড়্গ-ছুরি লৈয়ে শল্য অগ্রে দাণ্ডাইল।।
চিকেতান শর তূণ লইয়া বামেতে।
কাশীর ভূপাল ধনু লৈয়ে দক্ষিণেতে।।
নারদাদি-মুনি-মুখে বেদ-উচ্চারণ।
দ্বিজগণ-স্বস্তি-শব্দ পরশে গগন।।
গন্ধর্ব্বেতে গীত গায়, নাচয়ে অপ্সরী।
পাঞ্চজন্য বাজালেন আপনি শ্রীহরি।।
শঙ্খের নিনাদ গিয়া গগন পূরিল।
সভাতে যতেক ছিল ঢলিয়া পড়িল।।
বাসুদেব পাণ্ডবেরা পাঞ্চাল-নন্দন।
সাত্যকি সহিত এই ছাড়ি অষ্টজন।।
শঙ্খনাদে মোহ হৈয়ে পড়িল ঢলিয়া।
ধর্ম্মপুত্র নিবারণ করেন দেখিয়া।।
দ্বৈপায়ন-আদি মুনি ধৌম-পুরোহিত।
অভিষেক করিলেন বেদের বিহিত।।
সভাপব্বে সুধারস রাজসূয়-কথা।
কাশীরাম দাস কহে, ভারতে এ গাথা।।
১৮. দেবগণকে নিমন্ত্রণ করিতে অর্জ্জুনের যাত্রা
জন্মেজয় বলে, শুনি যজ্ঞ-বিবরণ।
কোন্ দিক হৈতে এল কোন্ কোন্ জন।।
কত সৈন্য সঙ্গে আসে কত কর লৈয়া।
পিতামহে কোন্ রূপে ভেটিল আসিয়া।।
দেব-নিমন্ত্রিতে পার্থ করিলেন গতি।
কিরূপে আইল তথা দেব পশুপতি।।
বিস্তারিয়া কহ মুনি, ভাঙ্গ মনো-ধন্ধ।
পিতামহগণ-কথা যে মকরন্দ।।
মুনি বলে, নরপতি কর অবধান।
কিছু অল্প কহি, শুন প্রধান প্রধান।।
কপিধ্বজ-রথে পার্থ কৈল আরোহণ।
পবনের বেগ জিনি চলে অশ্বগণ।।
যতেক পর্ব্বত-পৃষ্ঠে যত রাজা বৈসে।
সবা নিমন্ত্রিয়া যান পর্ব্বত কৈলাসে।।
কুবেরেরে কহেন সকল বিবরণ।
ধর্ম্ম-রাজসূয়-যজ্ঞে করিবা গমন।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব কিন্নর আদি করি।
আর যত মহাজন বৈসে এই পুরী।।
প্রত্যক্ষে সবারে আমি কৈনু নিমন্ত্রণ।
সবে লয়ে যজ্ঞস্থানে করিবা গমন।।
কুবের স্বীকার করে অর্জ্জুন-বচনে।
যাইব তোমার যজ্ঞে সহ নিজগণে।।
কুবেরের বাক্যে প্রীত হইয়া অর্জ্জুন।
সবিনয়ে কৃতাঞ্জলি কহিছেন পুন।।
ইন্দ্রলোকে যাব ইন্দ্রে করিতে বরণ।
কোন্ পথে যাব, সঙ্গে দেহ জ্ঞাত জন।।
কুবের করিল আজ্ঞা চিত্রসেন প্রতি।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যাহ কথা সুরপতি।।
আজ্ঞামাত্র চিত্রসেন চলে শীঘ্রগতি।
কপিধ্বজ-রথে বৈসে হইয়া সারথি।।
সেখান হইতে যান ইন্দ্রের নন্দন।
কত দূরে দেখিলেন হরের ভবন।।
জিজ্ঞাসেন ধনঞ্জয় এ কাহার পুরী।
চিত্রসেন বলে হেথা বৈসে ত্রিপুরারি।।
যজ্ঞ-হেতু ‍নিমন্ত্রণ কর ত্রিলোচনে।
সর্ব্বকার্য্যে সিদ্ধ হৈবে হরের গমনে।।
এত শুনি ধনঞ্জয় নামি রথ হৈতে।
উপনীত হন গৌরী-শঙ্কর অগ্রেতে।।
গৌরী প্রণমিয়া হরে করেন স্তবন।
হর বলিলেন, বর মাগ যাহে মন।।
অর্জ্জুন বলে, দেব ধর্ম্মের নন্দন।
তাঁর রাজসূয়-যজ্ঞে করিবা গমন।।
হাসিয়া শঙ্কর-গৌরী করেন স্বীকার।
নিশ্চয় যাইব মোরা যজ্ঞেতে তোমার।।
শঙ্কর বলেন, গিয়া হইব সহায়।
নির্ব্বিঘ্নে তোমার যজ্ঞ সাঙ্গ যেন হয়।।
পার্ব্বতী বলেন, যাব যজ্ঞের সদনে।
যজ্ঞেতে আসিবে যত রহে ত্রিভুবনে।।
সবে সুখী হইবেক প্রসাদে আমার।
অন্নপূর্ণা নাম মম বিখ্যাত সংসার।।
এই নাম লৈয়ে তব সূপকারগণ।
অল্প দ্রব্যে সুতৃপ্ত করুক বহু জন।।
অক্ষয় অব্যয় হৈবে অমৃত-সমান।
আর যার যাহে প্রীতি পাবে বিদ্যমান।।
হর-পার্ব্বতীর বর পেয়ে ধনঞ্জয়।
প্রণমিয়া চলিলেন সানন্দ-হৃদয়।।
চিত্রসেন বাহে রথা পবন-গমনে।
ক্ষণমাত্রে উপনীত ইন্দ্রের ভবনে।।
প্রণাম করেন পার্থ ভূমিষ্ঠ হইয়া।
ইন্দ্র পার্থে আলিঙ্গন দিলেন উঠিয়া।।
আপনার কোলে বসাইয়া দেবরাজ।
জিজ্ঞাসেন, কহ তাত কি তোমার কাজ।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব তোমাতে গোচর।
রাজসূয় করিছেন ধর্ম্ম-নরবর।।
যেই যজ্ঞে অধিষ্ঠান হইবা আপনি।
আর যত স্বর্গ বৈসে সুর সিদ্ধ মুনি।।
ইন্দ্র কহেন, যজ্ঞে করিব আগুসার।
তুমি না আসিতে পূর্ব্বে করেছি বিচার।।
এই দেখ সুসজ্জিত যত দেবগণ।
চারি মেঘ, অষ্ট হস্তী, সকল পবন।।
স্বর্গের যতেক দ্রব্য পৃথিবী দুর্ল্লভ।
তব যজ্ঞ হেতু দেখ সাজাইল সব।।
এই আমি চলিলাম যজ্ঞের সদন।
তুমি যাহ অন্য জনে কর নিমন্ত্রণ।।
ইন্দ্রমুখে শুনি পার্থ আনন্দিত মন।
প্রণমিয়া অন্য দিকে করেন গমন।।
পৃথিবী দক্ষিণে সূর্য্য-সুতের ভবন।
তথাকারে চলিলেন ইন্দ্রের নন্দন।।
চিত্রসেন বাহে রথ পবনের গতি।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল যথা প্রেতপতি।।
প্রণমিয়া বসিলেন অর্জ্জুন সভায়।
আশিস্ করিয়া যম জিজ্ঞাসেন তায়।।
কোন্ হেতু হেথা তব হৈল আগমন।
কি করিব প্রিয় কহ ইন্দ্রের নন্দন।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব কর অবধান।
রাজসূয়-যজ্ঞস্থলে হৈবে অধিষ্ঠান।।
তোমার পুরীতে নিবসয়ে যত জন।
সবাকারে লৈয়া যজ্ঞে করিবা গমন।।
স্বীকার করেন যম পার্থের বচনে।
পুনরপি জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুন শমনে।।
নারদ কহেন তব সভার কথন।
নিবসে এখানে, মর্ত্ত্যে মরে যত জন।।
শুনি দেবঋষি-মুখে পিতৃ-বিবরণ।
সেই বার্ত্তা পেয়ে রাজসূয়-আরম্ভণ।।
এখন সে সবে জনে না করি দর্শন।
কোথায় আছেন বল পিতা আদি জন।।
হাসিয়া বলেন যম তবে অর্জ্জুনেরে।
মৃতজনে দেখিবারে পাবে কি প্রকারে।।
জীয়ন্ত মৃতেতে হেথা নাহি দরশন।
শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন পাণ্ডুর নন্দন।।
যমে নিমন্ত্রিয়া বীর মাগিল মেলানি।
বরুণ-আলয়ে যান বীর-চূড়ামণি।।
পশ্চিম-দিকেতে জলপতির আলয়।
তথাকারে চলিলেন বীর ধনঞ্জয়।।
বরুণেরে কহেন যজ্ঞের বিবরণ।
ধর্ম্ম-যজ্ঞ-স্থানে তুমি করিবা গমন।।
তোমার পুরেতে আর যত জন বৈসে।
সবারে লইয়া সঙ্গে যাবে মম বাসে।।
বরুণ বলিল, যজ্ঞে করিব গমন।
যজ্ঞেতে লইব পুরে আছে যত জন।।
কেবল দানব দৈত্যে নাহি অধিকার।
যত যত জন আছে আলয়ে আমার।।
তাহা সবা লইবারে যদি আছে মন।
আপনি তথায় গিয়া কর নিমন্ত্রণ।।
বরুণ-বচনে তবে যান ধনঞ্জয়।
কত দূরে ভেটিল দানব-রাজ ময়।।
ময় জিজ্ঞাসিলে পার্থ কহেন সকল।
পূর্ব্ব-উপকার স্মরি স্বীকার করিল।।
হেথায় নিবসে যত দৈত্যাদি দানব।
বলেন আমার যজ্ঞে লৈয়ে যাবে সব।।
এত শুনি ময় তাঁরে বলিল বচন।
সবারে লইয়া যজ্ঞে করিব গমন।।
তুমি চলি যাহ যথা আছে প্রয়োজন।
শুনিয়া অর্জ্জুন করিলেন আলিঙ্গন।।
তথা হৈতে যান পার্থ পৃথিবী দক্ষিণে।
লঙ্কাপুর নিমন্ত্রিতে রাজা বিভীষণে।।
রথ চালাইয়া দিল তারা যেন ছুটে।
কতক্ষণে উত্তরিল লঙ্কার নিকটে।।
ইন্দ্র-যম-পুরী যেন বিচিত্র নির্ম্মাণ।
রাক্ষসের লঙ্কাপুরী তাহার সমান।।
পুরী দেখি বড় প্রীত বীর ধনঞ্জয়।
চলিলেন যথা বিভীষণের আলয়।।
সিংহাসনে বসেছিল রাক্ষস-ঈশ্বর।
প্রণাম করেন গিয়া ইন্দ্রের কোঙর।।
জিজ্ঞাসেন বিভীষণ, তুমি কোন্ জন।
প্রত্যক্ষে সকল কথা কহেন অর্জ্জুন।।
রাজসূয়-যজ্ঞ করিছেন যুধিষ্ঠির।
তোমা নিমন্ত্রিতে কহিলেন যদুবীর।।
অর্জ্জুনের মুখে শুনি হৃষ্টচিত্ত হৈয়ে।
বসাইল ধনঞ্জয়ে আলিঙ্গন দিয়ে।।
তব যজ্ঞে যাইব, দেখিব নারায়ণ।
সঙ্গেতে লইব পুরে আছে যত জন।।
তুমি যাহ, যথা তব থাকে প্রয়োজন।
এই আমি চলিলাম যজ্ঞের সদন।।
বিভীষণে নিমন্ত্রিয়া ইন্দ্রের কুমার।
ইন্দ্রপ্রস্থে নিজপুরে যান পুনর্ব্বার।।
রাজগণ-নিমন্ত্রণে দূতগণ গেল।
শ্রুতমাত্র নৃপগণ সকলে আসিল।।
দূতবাক্য হেলা করি না আসে যে জন।
অর্জ্জুন আনেন তারে করিয়া বন্ধন।।
সভাপর্ব্ব সুধা-রস রাজসূয়-কথা।
কাশীরাম দাস কহে, সুধাসিন্ধু গাথা।।
১৯.বাসুকি নিমন্ত্রণে অর্জ্জুনের পাতালে প্রবেশ
জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুনেরে দেব নারায়ণ।
কহ কারে কারে তুমি কৈলা নিমন্ত্রণ।।
শুনিয়া অর্জ্জুন নিবেদিলেন যতেক।
পুস্তক বাহুল্য হয় লিখিলে ততেক।।
করিলেন কুবেরাদি সবে নিমন্ত্রণ।
প্রত্যেক বৃত্তান্ত সব কহেন তখন।।
গোবিন্দ বলেন, যাহ পাতাল-ভবন।
শেষ-নাগরাজে গিয়া কর নিমন্ত্রণ।।
স্বর্গে ইন্দ্র দেবরাজ, পাতালে বাসুকি।
তোমা বিনা অন্যে যায়, এমন না দেখি।।
বাসুকি আইলে যজ্ঞ হইবে সম্পূর্ণ।
বিলম্ব না কর সখা, যাহ তুমি তূর্ণ।।
গোবিন্দের বচনেতে বিলম্ব না করি।
পাতালে গেলেন পার্থ দিব্য রথে চড়ি।।
উপস্থিত হইলেন নাগের আলয়।
চৌদিকে বেষ্টিত ফণী শেষ মহাশয়।।
দশ শত ফণা ধরে মস্তক-উপর।
তিন শত ফণাতে শোভিত চরাচর।।
কূর্ম্মপৃষ্ঠে উপবিষ্ট বেষ্টিত রতন।
উপনীত হন তথা পাণ্ডুর নন্দন।।
নাগরাজে প্রণাম করেন ধনঞ্জয়।
করযোড় করিয়া কহেন সবিনয়।।
শেষ জিজ্ঞাসেন, তব কেন আগমন।
প্রত্যক্ষে কহেন পার্থ সর্ব্ব বিবরণ।।
রাজসূয় নিমিত্ত তোমার নিমন্ত্রণ।
সুরাসুর সহ দেব যাবে সর্ব্বজন।।
ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র-আদি যত দিকপতি।
সেই যজ্ঞে অধিষ্ঠান হৈবেন সম্প্রতি।।
সেই হেতু আইলাম তোমার ভবন।
রাজসূয়-মহাযজ্ঞে করিবা গমন।।
হাসিয়া কহেন শেষ, শুন ধনঞ্জয়।
তব যজ্ঞে আছেন গোবিন্দ মহাশয়।।
র্হ্ত্তা কর্ত্তা সেই প্রভু বিধি বিধাতার।
সর্ব্ব-যজ্ঞ-ফল পায় দরশনে যাঁর।।
যথা কৃষ্ণ বিদ্যমান তথা সর্ব্বজন।
ব্রহ্মা-শিব-আদি যত দিক্পালগণ।।
অকারণ আমা সবাকারে নিমন্ত্রণ।
সেই কৃষ্ণে ভালমতে করহ অর্চ্চন।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে আছে কত শত প্রাণী।
কত ব্রহ্মা শিব ইন্দ্র কত শেষ ফণী।।
সকলে হইবে তুষ্ট তাঁরে তুষ্ট কৈলে।
শাখা-পত্র তুষ্ট যেন মূলে জল দিলে।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব কর অবধান।
যতেক কহিলা তুমি বেদের প্রমাণ।।
নিজ বশ নহি সবে তাঁর মায়াবন্ধ।
জানিয়া শুনিয়া পুনঃ হয় মায়াধন্দ।।
পুনঃ নাগরাজ বলে অর্জ্জুনে, চাহিয়া।
আসিলে আমারে নিতে কিছু না জানিয়া।।
মস্তক-উপরে আমি ধরি যে সংসার।
আমি গেলে যজ্ঞে, কে ধরিবে ক্ষিতিভার।।
অর্জ্জুন বলেন, কৃষ্ণ কহেন আমারে।
যজ্ঞ পূর্ণ হৈবে, তুমি গেলে তথাকারে।।
ক্ষিতিভার হেতু যদি করহ বিচার।
তুমি যাহ আমি লৈব পৃথিবীর ভার।।
এত শুনি বিস্ময় মানিয়া বিষধর।
হাসিয়া অর্জ্জুন প্রতি করিল উত্তর।।
পৃথিবী ধরিবে হেন করিলে স্বীকার।
পৃথিবী ছাড়িনু, বাক্য পাল আপনার।।
এত শুনি ধনঞ্জয় লইয়া গাণ্ডীব।
করযোড়ে প্রণমিয়া শিবদাতা শিব।।
ভক্তিভাবে কৃষ্ণনাম করিয়া স্মরণ।
শিরে দ্রোণাচার্য্য-পদ করিয়া বন্দন।।
অদ্ভুত স্তম্ভন-অস্ত্র তূণ হৈতে নিয়া।
জুড়েন গাণ্ডীবে ক্ষিতি-অস্ত্র বসাইয়া।।
ধরেন ধরণী, শেষ স্বতন্ত্র হইল।
দেখিয়া সকল নাগ অদ্ভুত মানিল।।
তবে শেষ, যত নাগ লইয়া সংহতি।
রাজসূয়-যজ্ঞ-স্থানে গেল শীঘ্রগতি।।
বাসুকি আসিল আর তক্ষক কৌরব।
নহুষ কর্কট ধৃতরাষ্ট্র জরদগর।।
কোপন কালিয় ত্রিকপূর্ণ ধনঞ্জয়।
অজ্যক উগ্রক দুষ্ট রুষ্ট মহাশয়।।
নীল শঙ্খমুখ শ্ঙ্খপিণ্ড বক্রদন্ত।
কলিচূড় পিঙ্গচক্ষু কালমহাবন্ত।।
পুত্র-পৌত্র সংহতি চলিল লক্ষ লক্ষ।
দেখিয়া সকল লোক মানিল অশক্য।।
পাচঁ সাত শির কার, ষট্ সপ্ত শত।
সহস্র মস্তক কার আকার পর্ব্বত।।
নিজ পরিবারে মিলি চলে ফণিরাজ।
হেথায় সুরেন্দ্রালয়ে দেবের সমাজ।।
ঐরাবত-আরোহণে বজ্র শোভা করে।
মাতলি ধরয়ে ছত্র মস্তক-উপরে।।
অষ্টবসু নবগ্রহ অশ্বিনী-কুমার।
দ্বাদশ অদিত্য রুদ্র একাদশ আর।।
ঊনপঞ্চাশ বায়ু, সাতাশ হুতাশন।
যজ্ঞ মন্ত্র দক্ষিণা পুরোধা দণ্ড ক্ষণ।।
যোগ তিথি কারণ নক্ষত্র রাশিগণ।
চারি মেঘ বিদ্যুৎ সহিত সৈন্যগণ।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যত অপ্সরী অপ্সর।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি চলিল বিস্তর।।
বশিষ্ঠ পৌলস্ত্য ভৃগু পুলহ অঙ্গিরা।
পরাশর ক্রুতু দক্ষ লোমশ সুধীরা।।
অসিত দেবল কৌণ্ড শুক সনাতন।
মার্কণ্ড মাণ্ডব্য ধ্রুব জয়ন্ত কোপন।।
ইত্যাদি যতেক ঋষি ইন্দ্রপুরে থাকে।
ইন্দ্রসহ যজ্ঞস্থানে চলে লাখে লাখে।।
চড়িয়া পুষ্পক-রথে ধনের ঈশ্বর।
সঙ্গেতে চলিল যক্ষ গন্ধর্ব্ব কিন্নর।।
চিত্ররথ তুম্বুরু অঙ্গিরা গুণনিধি।
বিশ্বাবসু মহেন্দ্র মাতঙ্গ সুর আদি।।
ফলকর্ণ ফলোদক চিত্রক লোত্রক।
লিখনে না যায় যত চলিল গুহ্যক।।
ঘৃতাচী ঊর্ব্বশী চিত্রা রম্ভা চিত্রসেনী।
চারুনেত্রা মিশ্রকেশী বুদবুদা মোহিনী।।
চিত্ররেখা অলম্বুষা সুরভি সমাচী।
পোণিকা কদম্বা অর্ম্মা শূদ্রা রুচি শুচি।।
লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী নৃত্য-গীত-নাদে।
কুবেরের সহ সবে চলিল আহ্লাদে।।
যজ্ঞ দেখিবারে চলে যত মহীধর।
হিমাদ্রি কৈলাস শ্বেত নীল গিরিবর।।
কালগিরি রামগিরি গোবর্দ্ধন শাখ।।
চিত্রকূট বিন্ধ্যা গন্ধমাদন সুবল।
ঋষ্যশৃঙ্গ শতশৃঙ্গ মহেন্দ্র ধবল।।
রৈবতক যত গিরি গিরি মুনিশিল।
কামগিরি খণ্ডগিরি গিরিরাজ নীল।।
লক্ষ লক্ষ গিরিবর দেবরূপ ধরি।
যক্ষরাজ সহ গেল যজ্ঞ-অনুসরি।।
বরুণ চলিল নিজ অমাত্য সহিত।
মূর্ত্তিমন্ত সপ্তসিন্ধু যতেক সরিত।।
গঙ্গা সরস্বতী শোণ দিনকরসুতা।
চিত্রোৎপলা প্রেতা বৈতরণী পুণ্যযুতা।।
চন্দ্রভাগা গোদাবরী সরযূ লোহিতা।
দেবনদী মহানদী মহাশ্বী সবিতা।।
ভৈরবী ভার্গবী নদী ভদ্রা বসুমতী।
মেঘবতী গোমতী আরো সৌরবতী।।
নর্ম্মদা অজয় ব্রাহ্মী ব্রহ্মপুত্র কংস।
তমল কমলা শিবা কোলামুখ বংশ।।
গণ্ডকী নর্ম্মদা ফল্গু সিন্ধু করতোয়া।
স্বর্ণরেখা পদ্মাবতী শতনেত্রা জয়া।।
ঝুমঝুমি কালিন্দী দামোদর গিরিপুরী।
সিন্ধুকা কাবেরী ভদ্রা নদা গোদাবরী।।
ইত্যাদি অনেক নদী নদ সরোবর।
বাপী হ্রদ তড়াগাদি ধরি কলেবর।।
যজ্ঞস্থানে গেল সবে বরুণ সংহতি।
মহিষ-বাহনে চড়ি যান প্রেতপতি।।
পিতৃগণ দূতগণ দণ্ড মৃত্যুপাশ।
আইল অমর-বৃন্দ জুড়িয়া আকাশ।।
অদ্ভুত দ্বাপর-যুগে হৈল যজ্ঞরাজ।
না হইলু কভু যাহা অবনীর মাঝ।।
মনু আদি করি রাজা না যায় লিখন।
যযাতি নহুষ রঘু মান্ধাতা ভুবন।।
দিলীপ সগর ভগীরথ দশরথ।
কৃতবীর্য্য কার্ত্তবীর্য্য সুরথ ভরত।।
ইত্যাদি অনেক হৈল চন্দ্র-সূর্য্য-কুলে।
রাজসূয় অশ্বমেধ করিল বহুলে।।
উদ্দেশেতে যেই দেবে করে আরাধন।
কর লৈয়ে আইলেন সেই দেবগণ।।
মহেশ পার্ব্বতী দোঁহে করেন গমন।
অলক্ষিতে রূপ নাহি দেখে কোন জন।।
দক্ষিণে ত্রিশূল শোভে জটাভার শিরে।
চরণ পরশে দাড়ি শিঙ্কা বাম করে।।
এইরূপে সদাশির সবাকারে রাখে।
যতদূর যজ্ঞস্থল সব ঠাঁই থাকে।।
যত যত জন আসে যজ্ঞের সদনে।
ছায়ারূপে অন্নদা তোষেন সর্ব্বজনে।।
যার যেই বাঞ্ছা তারে আপনি যোগায়।
যে দ্রব্য যে ইচ্ছে তাহা সেইক্ষণে পায়।।
অশ্ব-আরোহণে, করে খর করবাল।
ঊনকোটি দানা লৈয়ে আসে ক্ষেত্রপাল।।
শতকোটি দৈত্য লয়ে আসে দৈত্য ময়।
ছয় সহোদর আসে বিনতা-তনয়।।
দেব দৈত্য নাগ যক্ষ আসে সর্ব্বজনে।
প্রজাপতি আসিলেন হংস-আরোহণে।।
অন্তরীক্ষে থাকিয়া দেখেন চতুর্ম্মুখ।
প্রজাপতিগণ সহ যজ্ঞের কৌতুক।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবাণ।।
২০.দ্রুপদ রাজার আগমন
দূত মুখে বার্ত্তা পেয়ে পাঞ্চালাধিকারী।
দুহিতা হইবে মম রাজ্য-পাটেশ্বরী।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখণ্ড্যাদি হৈয়ে হৃষ্টচিত।
যজ্ঞ-অঙ্গ-দ্রব্য সব সাজায় ত্বরিত।।
চতুর্দ্দশ-সহস্র সেবকী মনোরমা।
সুধাংশুবদনী পদ্মনয়নী সুশ্যামা।।
অনেক লইল দাস দাসী সমুদয়।
সহস্রেক গাভী নিল মনোরম কায়।।
যুগল সহস্র বাজী, গতি বায়ু সম।
বহু বহু দ্রব্য নিল বাছিয়া উত্তম।।
সর্ব্বরাজ্য দিব, হেন বিচারিল মনে।
সহ দ্বারা চলে রাজা যজ্ঞের সদনে।।
চতুরঙ্গ-দলে আর প্রজা চারি জাতি।
নানাবাদ্য শব্দে যার কাঁপে বসুমতী।।
ইন্দ্রপ্রস্থে উপনীত হৈল পূর্ব্ব-দ্বারে।
বেত্র দিয়া ইন্দ্রসেন রাখিল তাহারে।।
রহ রহ ক্ষণেক পাঞ্চাল-অধিকারী।
রাজাজ্ঞা পাইলে দ্বার ছাড়িবারে পারি।।
এক্ষণে আসিবে সহদেব ধনুর্দ্ধর।
তার হাতে বার্ত্তা দিব রাজার গোচর।।
ইন্দ্রসেন বচনেতে রহে নৃপবর।
হেনকালে আইলেন মাদ্রীর কোঙর।।
দ্রুপদে দেখিয়া গেল রাজার গোচর।
ধর্ম্মরাজে জানাইল শিরে দিয়া কর।।
দাস দাসী আর আনে রত্ন অগণন।
অশ্ব হস্তী আনে সবে বিবিধ বরণ।।
আজ্ঞা পেলে আসি হেথা করে দরশন।
শুনিয়া দিলেন আজ্ঞা ধম্মের্র নন্দন।।
হস্তী অশ্ব পশু আদি যত রত্ন ধন।
দুর্য্যোধন-ভাঞ্চারীরে কর সমর্পণ।।
দাস দাসী সমর্পহ দ্রৌপদীর স্থানে।
পুত্র সহ হেথা লৈয়া আইস রাজনে।।
আজ্ঞা পেয়ে সহদেব করিল তেমনি।
যেই মত আজ্ঞা করিলেন তেমনি।।
সপুত্র ভিতরে গেল পাঞ্চাল-ঈশ্বর।
সঙ্গেতে চলিল কত শত নৃপবর।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র