মহাভারত:শান্তিপর্ব-০০৬-০১০

০৬. জড়ভরত উপাখ্যান
তবে জন্মেজয় কহে, শুন তপোধন।
তার পরে কি হইল, কহত এখন।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
তার পর যা হইল, কহি বিবরণ।।
ব্যাস বলে, শুন এবে ধর্ম্মের নন্দন।
চিত্ত শান্ত করি শুন, ত্যজ শোক-মন।।
উত্তানপাদ রাজা সেই পূর্ব্বেতে আছিল।
ধ্রুবে রাজ্য দিয়া রাজা তপস্যায় গেল।।
সরয়ূর তীরে সেই বৈসে কুতূহলে।
মন্ত্র জপ করে সেই, পূজে ফল-ফুলে।।
ধ্যান করি মহারাজ, নিজ মন্ত্র জপে।
হরিপদে চিত্ত, মহাতেজ হৈল ভূপে।।
হেনকালে মৃগী এল জল খাইবারে।
আচম্বিতে সিংহনাদ হৈল তথাকারে।।
গর্ভবতী হরিণীর হৈল গর্ভপাত।
প্রসব করিয়া মৃগী হইল নিপাত।।
হরিণী মরিল যদি হরিণীর শিশু।
ধীরে ধীরে আসিলেক নৃপ পিছু পিছু।।
হরিণীর শিশু রাজা করিলেন কোলে।
তপস্যা ছাড়িয়া রাজা হরিণকে পালে।।
তপ জপ গেল রাজা পালে মৃগশিশু।
এইরূপে পালন করয়ে সেই পশু।।
নবীন নবীন দূর্ব্বা তাহারে ভুঞ্জায়।
হরিণীর সেই শিশু পিছে পিছে যায়।।
সদাই করেন রাজা হরিণে পালন।
রাজার হরিণ বিনা অন্যে নাহি মন।।
এইরূপে দিন যায়, শুন তার পর।
দূর বনে হরিণ চলিল অতঃপর।।
একদিন সিংহ তারে করিল ভক্ষণ।
দূরে থাকি মহারাজ দেখিল তখন।।
মৃগের মরণে রাজা বড় দুঃখ পেল।
হরিণ হরিণ করি শোকে রাজা মৈল।।
হরিণীর গর্ভে হৈল রাজার জনম।
যেই যাহা ভাবি মরে, হয় তার সম।।
হরিণ জনম যদি পাইল রাজন।
জাতিস্মর হৈল রাজা, শুনহ কারণ।।
তারপরে গেল রাজা যমুনার তীর।
জলপান করি শেষে ত্যজিল শরীর।।
পুনর্জ্জম হৈল তার ব্রাহ্মণের ঘরে।
জাতিস্মর হইল ভরত নাম ধরে।।
তার সাত ভাই পরে পরম যোগ্যতা।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ জানে সর্ব্বকথা।।
ভরত সুস্থির বড় হরিপদে মন।
নাম তার হৈল জড়ভরত তখন।।
কোন কর্ম্ম নাহি করে, সদা হরি বলে।
হরিকথা বিনা মুখে অন্য না নিকলে।।
দেখি তার ভাই সব হইল দুঃখিত।
খাইতে না দেয় তারে, করয়ে উৎপাত।।
পোড়া অন্ন, ব্যঞ্জন সে খায় অবশেষ।
তাহা খেয়ে জপে হরি, নাহি দুঃখ লেশ।।
পোড়া অন্ন বিনা সেই ভাল নাহি পায়।
তাহা খেয়ে তুষ্ট হয়ে হরিগুণ গায়।।
সে বিপ্রের পাকা ধান্য ক্ষেতে সমুদায়।
শূকরে খাইয়া যায়, রক্ষা নাহি পায়।।
দেখিয়া সকল ভাই দুঃখিত হইল।
ধাণ্যের প্রহরী করি ভরতেরে দিল।।
ভরত ধান্যের রক্ষা করে এইমতে।
ধান্য রাখে নিরন্তর ফিরে চারিভিতে।।
দিবানিশি ফিরে সেই হরি হরি বলি।
নৃত্য করি ফিরে সেই দিয়া করতালি।।
দিবসে বায়স রাখে, রাত্রিতে শূকর।
এই মত ধান্য কৃষি রাখে নিরন্তর।।
আর দিন কহি কথা, শুনহ রাজন।
যেরূপে প্রকাশ হৈল দ্বিজের নন্দন।।
সুবাহু নামেতে রাজা রাজ্যের ঈশ্বর।
জ্ঞান শিখিবারে গেল কপিলের ঘর।।
দোলায় চড়িয়া রাজা চলে ততক্ষণ।
বাহক চলিতে নারে তার একজন।।
বেগার চাহিয়া ফিরে নৃপতির লোকে।
কেহই চলিতে নারে, পড়িল বিপাকে।।
পাইল ধান্যের ক্ষেত্রে জড়ভরতের।
হৃষ্ট পুষ্ট দেখিয়া ধরিয়া আনে তারে।।
ধরিয়া লইয়া গেল রাজার গোচর।
রাজা বলে, কার্য্য সিদ্ধ হইল আমার।।
বেগার দেখিয়া রাজা দোলায় চলিল।
দোলা কান্ধে কর তুমি, মহারাজ কৈল।।
শুনিয়া রাজার বাক্য উঠি শীঘ্রগতি।
দোলা কান্ধে করি তবে লইল সম্প্রতি।।
সাবধানে চলিলা ভরত মহাশয়।
পিপীলিকা পাছে পদাঘাতে নষ্ট হয়।।
সতর্কে ভরত যায়, প্রাণী পাছে মরে।
প্রাণী মৈলে হবে বাস নরক ভিতরে।।
টলমল করে দোলা, রাজা তারে বলে।
কিরূপে চালাও দোলা, যাই কি প্রকারে।।
তবে বলে, মহারাজ করি নিবেদন।
দোলা টলমল করে যাহার কারণ।।
দুল্যা বলে, এই জন চলিতে না পারে।
বেগার বহিছে, তাই টলমল করে।।
ফিরিয়া রাজন তারে করে নিরীক্ষণ।
হৃষ্টপুষ্ট বহে দোলা, না কহে বচন।।
ভাল করি বহ মোরে, কহে মহাশয়।
ভরত বলিল, রাজা কেবা কারে বয়।।
পৃথিবীই বহে পদ, পদ বহে জানু।
জানু বহে ঊরুদেশ, ঊরু বহে তনু।।
তনু বহে বক্ষঃস্থল, বক্ষ বহে গ্রীবা।
গ্রীবাই মস্তক বহে কারে বহে কেবা।।
তুমি ত দোলায় আছ, জান নৃপবর।
তোমাকে বহিব কেন, শুন নরেশ্বর।।
ইহা শুনি নরপতি বিস্মিত হইল।
দোলা হৈতে মহারাজ তখনি নামিল।।
রাজা বলে, তবে আমি যাব কোথাকারে।
কোন মহাশয় বিধি মিলাইল মোরে।।
তবে রাজা দণ্ডবৎ করে ভূমে পড়ি।
অনেক স্তবন করে দুই হাত যুড়ি।।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি মহাশয়।
বহু পাপ কৈনু আমি, জানিনু নিশ্চয়।।
মোরে কৃপা করি যদি দেহ উপদেশ।
তোমার কৃপায় পাই পথের উদ্দেশ।।
ভরত ঠাকুর তবে তারে মন্ত্র দিল।
সেবক লইয়া রাজা দোলা চাপি গেল।।
তবে ত ভরত সেই এই মতে ফিরে।
কৃষ্ণ বিনা মুখে তার কিছু নাহি স্ফুরে।।
বীরবাহু নামে এক আছে মহারাজা।
সুবর্ণ-মন্দিরে করে অম্বিকার পূজা।।
এক সৎবৎসর রাজা মেরুয়াকে পোষে।
বৎসর অন্তর কাটে দেবীর উদ্দেশে।।
বৎসর হইল পূর্ণ, পূজার সময়।
পলাইয়া যায় সেই শুন ধর্ম্মরায়।।
দেবালয়ে কোটালের রক্ষী যত জন।
বিস্তর করিল সেই মেরুয়ার অন্বেষণ।।
সকল কোটাল ফিরে একত্র হইয়া।
পোষা মেরুয়া কোথা গেল পলাইয়া।।
এই মতে ফিরে তারা মেরুয়া চাহিয়া।
জড়ভরতের তারা পাইলেক গিয়া।।
তাহারে ধরিয়া আনে কোটালের গণ।
ভরতে লইয়া তারা করিল গমন।।
হৃষ্টপুষ্ট দেখি অতি শরীর-সুন্দর।
সুবর্ণ-সদৃশ রূপ অতি-মনোহর।।
দেখিয়া কোটাল তবে আনন্দিত মন।
তাহারে লইয়া দিল রাজার সদন।।
ভরতে দেখিয়া রাজা সন্তুষ্ট হইল।
দেবীপূজা দিতে রাজা উদযোগ করিল।।
নারীগণ আভরণে ভূষিত হইয়া।
দেবীপূজা দেখিবারে আইল চলিয়া।
বাল বৃদ্ধ যুবা আসে পূজা দেখিবারে।।
নানা বাদ্য ভেরী বাজে দেবীর মন্দিরে।
পুরোহিত দ্বিজগণ পূজে বিধিমতে।।
দধি দুগ্ধ চিনি মধু রম্ভা আর ঘৃতে।
নানা উপচার যত করি রাশি রাশি।।
অম্বিকা পূজয়ে রাজা দেবীপাশে বসি।।
তার পর রাজা বলি আনিয়া তখন।
ছাগ মেঘ মহিষাদি দিলেক রাজন।।
এইমত আর সব দিল বলিদান।
অবশেষে বলে রাজা নরবলি আন।।
নরবলি আনিবারে বলিল রাজন্।
ভরতেরে স্নান করাইল ততক্ষণ।।
দিব্য বস্ত্র পরাইল, দিল বনমালা।
চন্দনে ভূষিত করি অলঙ্কার দিলা।।
দেবগণ বলে, ধন্য রাজার জীবন।
হেন মহাজনে রাজা করিল পূজন।।
তবে ভরতেরে রাজা করিল পূজন।
তবে ভরতেরে রাজা উৎসর্গ করিল।।
বলি দিতে হস্তে খড়্গ নৃপতি লইল।
কাটিবারে উঠে রাজা হাতে খড়্গ ধরি।।
নরবলি দিতে রাজা হৈল ত্বরাত্বরি।
আর সব বলি কাটে খড়্গধারিগণ।।
নরবলি নিজ হস্তে কাটয়ে রাজন।
মনে মনে মহাদেবী ভাবয়ে তখন।।
মোর ভাগ্য ভরতের হৈল দরশন।
রাজা নাহি জানে এই হয় কোন জন।।
এতেক ভাবিয়া দেবী নিকলে তখন।
পাষাণ প্রতিমা হৈতে বাহির হইয়া।।
রাজার হাতের খড়্গ লইলা কাড়িয়া।
দেবল কোটাল আর রক্ষী যত জন।।
সবাকারে ধরি দেবী করিলা ভক্ষণ।
সবাকার রক্ত-মাংস করিলা ভোজন।।
দেখিয়া নৃপতি হৈল বিস্ময় বদন।
দেবীকে কহেন রাজা করি যোড় হাত।।
নিবেদন করি মাতা, করি প্রণিপাত।
জননি এই যে বলি হয় কোন্ জন।।
ইহার বৃত্তান্ত মাতা কহিবে এখন।
দেবী বলে, শুন রাজা আমার বচন।।
পরম বৈষ্ণব এই সাধু মহাজন।
ইহার দর্শনে হয় পাপের বিনাশ।।
দেহে যার সদা হরি করেন বিকাশ।
হেন জনে আন তুমি কাটিতে হেথায়।।
দোষ মাগি লহ রাজা পড়ি তার পায়।
তবে রাজা বলে জড়ভরতেরে দেখি।।
অপরাধ ক্ষম মোর, হই আমি সুখী।
আপনি পরম সাধু, হও মহামতি।।
কাটিতে নারিনু তোমা, রাখিলা পার্ব্বতী।
জড়ভরত বলে, রাজা শুনহ বচন।
সকলের সার হরি, না জান কারণ।।
কেবা কারে মারে ইথে কেবা কারে রাখে।
মারেন রাখেন হরি, আপনার সুখে।।
যাহারে মারেন হরি, রাখে কোন জন।
কৃষ্ণ বিনা ত্রিভুবনে নাহিক তারণ।।
তবে রাজা সিংহাসন দিয়া ভরতেরে।
কহিলেক বৈস সিংহাসনের উপরে।।
ভরত বলেন, রাজা মোর কথা শুন।
না বুঝহ রাজা তুমি, বলি পুনঃ পুনঃ।।
কি নিকৃষ্ট, কি উৎকৃষ্ট আর সিংহাসনে।
সমান জানিহ রাজা আমার জীবনে।।
এইরূপ কহিল অনেক নীতিকথা।
দীক্ষামন্ত্র রাজারে ভরত দিল তথা।।
রাজা শিষ্য হৈল তবে ভরতের স্থানে।
এই ত কহিনু জড়ভরত-কথনে।।
ইহার শ্রবণে লোক পায় দিব্য জ্ঞান।
পৃথিবীতে নাহি সুখ ইহার সমান।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।
০৭. হরিণের মৃত্যু-বিবরণ
ব্যাসের বচন শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
নিঃশব্দে রহিল যুধিষ্ঠির মহামতি।।
কৃষ্ণকে কহিল তবে বীর ধনঞ্জয়।
যত দুঃখ পাইল তাহা কহনে না যায়।।
জ্ঞাতিশোকে সন্তপ্ত নৃপতি যুধিষ্ঠির।
বিশেষে পুত্রের শোকে দহিছে শরীর।।
কোনমতে শান্ত হবে কহ ভগবান।
রাজার সন্তাপ শোক কর সমাধান।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি উঠি নারায়ণে।
উক্তি করি নৃপস্থানে চলিলা আপনে।।
নৃপতির হাতে ধরি বলে নারায়ণ।
শোক পরিহর রাজা ধর্ম্মে দেহ মন।।
শোক পরিহর রাজা বৈসহ সন্তোষে।
অকারণে শরীরেতে কেন দেহ ক্লেশে।।
যতেক পড়িল রণে জ্ঞাতি-বন্ধুগণ।
তার লাগি শোক তুমি কর অকারণ।।
সম্মুখ সমরে তারা গেল স্বর্গবাস।
প্রজা পাল ধর্ম্মরাজ শোক কর নাশ।।
দিব্য রথে চড়ি সবে স্বর্গপুরে যায়।
তার হেতু শোক তব নাহিক যুয়ায়।।
ভরত-আখ্যান রাজা শুনিলে শ্রবণে।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে ব্যাসের বচনে।।
কৃষ্ণের অনন্ত কথা নারদ কহিল।
ব্যাস যে কহিল তাহা সাক্ষাতে শুনিল।।
তবে জন্মেজয় বলে, শুন তপোধন।
উত্তানপাদের কথা করিনু শ্রবণ।।
মরণ সময় দেখ যেই ধ্যান করে।
সেইমত জন্মে সেই ভ্রময়ে সংসারে।।
ঈশ্বর আরাধি মৈলে দিব্য গতি হয়।
পৃথিবীতে আসি সেই মহা সুখ পায়।।
বিবরিয়া কহ গোসাঞি করি নিবেদন।
হরিণ কিসের হেতু হইল ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ-ঘরেতে কেন জনম হইল।
শুনিয়া রাজার বাক্য ঋষিরাজ বৈল।।
কুরঙ্গ ভাবিয়া মৈল হইল কুরঙ্গ।
শুন রাজা বলি তবে তাহার প্রসঙ্গ।।
কুরঙ্গ চিন্তিয়া মৈল মরণ-সময়।
হরিণীর গর্ভে জন্ম তেকারণে হয়।।
জাতিস্মর হৈয়া রাজা ভ্রমে বনে বন।
মরণ-সময় রাজা ভাবিল তখন।।
বন ছাড়ি নগরেতে করিল প্রবেশ।
হরিণ দেখিয়া লোক ধায়ত বিশেষ।।
তবেত হরিণ তথা ভাবে মনে মন।
মরণ নিকট দেখি স্মরে নারায়ণ।।
পিছু পিছু লোক সব ধাইয়া চলিল।
যমুনার জলে গিয়া হরিণ পড়িল।।
জলে পড়ি নিজ প্রাণ তেজিল তখন।
তার পরে তুলি আনে নগরিয়াগণ।।
শুনিয়া এসব কথা শোক পরিহর।
ব্যাসদেব বৈল তবে এইত উত্তর।।
তার পরে ব্যাসদেব বলে বার বার।
শোক পরিহর রাজা ধর্ম্মের কুমার।।
অধর্ম্ম করিলে হয় সর্ব্ব নিপাতন।
তার কথা কহি আমি শুনহ রাজন।।
তবে রাম অযোধ্যা হইতে বনে গেল।
নানামত দুঃখ পায়্যা অনেক ভ্রমিল।।
তার পর রাবণে হরিয়া নিল সীতা।
তার হেতু সুগ্রীবের করিলেন মিতা।।
বালি মারি সুগ্রীবের দিলা রাজ্যভার।
তদন্তরে সিন্ধু বান্ধি হইলেন পার।।
ক্রমে ক্রমে মারিলেন নিশাচরগণ।
লঙ্কায় নাহিক বীর বিনা দশানন।।
হেনকালে মন্দোদরী বলে লঙ্কেশ্বরে।
মহী পুত্র আছে তব পাতাল ভিতরে।।
তাহারে স্মরহ তুমি শুনহ রাজন।
মহী আইলে দুঃখ সব হৈবে বিমোচন।।
তার সম বীর নাহি এ তিন ভুবনে।
সর্ব্বকার্য্য সিদ্ধ হবে তাহার গমনে।।
তবেত রাবণ তারে করিল স্মরণ।
রাবণ স্মরণে নড়ে মহির আসন।।
ধ্যান করি জানে মহী সব সমাচার।
জানিল মনেতে লঙ্কা হয়েছে সংহার।।
রাম-লক্ষ্মণ আসিয়াছে সঙ্গে কপিগণ।
সকল রাক্ষস-বংশ হয়েছে নিধন।।
তেকারণে পিতা মোরে করিল স্মরণ।
অবশ্য পিতার বাক্য করিব পালন।।
যাইব লঙ্কাতে আমি নাহিক বিলম্ব।
মারিব শ্রীরাম লক্ষ্মণ করিয়া প্রবন্ধ।।
যাত্রা কৈল মহীবীর নাকে দিয়া হাত।
স্মরিয়া শঙ্কর-পদ দেব বিশ্বনাথ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
০৮. মহীরাবণের উপাখ্যান
তবে বীর মহাকায়, লঙ্কা প্রবেশিতে চায়,
ভল্লুক বানর গড়-দ্বারে।
মন্ত্রেতে মৃত্তিকা কাটে, যেন কাদম্বিনী উঠে,
তাহাতে সুড়ঙ্গ হৈল দ্বারে।।
তবেত রাক্ষস মহী, মহাক্রোধ-মূর্ত্তি হই,
ছাড়ে বীর মহা হুহুঙ্কার।
চতুর্দ্দিকে কপিগণ, মধ্যখানে নারায়ণ,
পরি বসিয়াছে মৃগাম্বর।।
সম্মুখে কোদণ্ড বাণ, বসিয়া অনুজস্থান,
করযোড়ে বীর হনূমান।
অঙ্গদ বালির বেটা, লইয়া বানর ঘটা,
কত বীর নাহি পরিমাণ।।
অষ্ট অঙ্গে হনুবীর, রামপদে নতশির,
শ্রীরাম-লক্ষ্মণ প্রতি বলে।
আজ্ঞা কর গদাধর, ভাঙ্গি লঙ্কা পাটোয়ার,
রাবণেরে ধরি আনি চুলে।।
আর যত কপিগণ, সিংহ সম সর্ব্বজন,
গাছ পাথর করি নিল হাতে।
নিদ্রা নাহি রাত্রি-দিনে, রাবণের নাশ বিনে,
সবে রহে যুদ্ধ হেতু পথে।।
বিভীষণ মহাশয়, শ্রীরাম নিকটে রয়,
লয় সব লঙ্কার সন্ধান।
হেনকালে মহীবীর, দেখে চক্ষু করি স্থির,
বহু সৈন্য রহে বিদ্যমান।।
সবাকারে নিরখিল, মনেতে বিস্ময় হৈল,
বিভীষণে দেখে তার মাঝ।
অসম্ভব দেখি বীর, মনেতে করিল স্থির,
এই হেতু হৈয়াছে অকাজ।।
বানরের মধ্যখান, খুড়া কেন বিদ্যমান,
কোন হেতু ইহার ভিতরে।
বুজিলাম অনুমানে, পাইলা মোর সন্ধানে,
খুড়া হেতু সর্ব্ব সৈন্য মরে।।
খুড়া যেই কর্ম্ম করে, জ্ঞাতি-বন্ধু সবে মরে,
বুঝি রামের লয়েছে শরণ।
মোর মনে হেন লয়, জানিলাম সুনিশ্চয়,
খুড়া হেতু সবার নিধন।।
ইন্দ্র চন্দ্র দেবগণ, যারে ডরে সর্ব্বজন,
তার পুরে প্রবেশে বানর।
ব্রহ্মা আদি করে ডর, তার পুরে নাহি ঘর,
আনন্দেতে গর্জ্জে পশুবর।।
বুঝিলাম এই হৈল, খুড়া হেতু সব মৈল,
ভেদ করি কৈল সর্ব্বনাশ।
আগে যাই পিতা স্থানে, বিশেষিয়া শুনি কাণে,
তবে পাঠাইব যমপাশ।।
দেখি আগে নৃপমণি, আগে সব কথা শুনি,
তবেত করিব মনে যাহা।
না রাখিব কারো তরে, পাঠাইব যমঘরে,
রাক্ষসেরা করে যেন আহা।।
মারিয়া বানরগণ, লব সবার জীবন,
নর-বানর কিবা জানে সন্ধি।
ধরিয়া মায়ার বলে, লইয়া যাব পাতালে,
মোর ঘরে লৈয়া করি বন্দী।।
এত অনুমানি মনে, চলিল বাপের স্থানে,
দণ্ডবৎ করিল চরণে।
উঠিয়াত লঙ্কেশ্বরে, চুম্বন করিল শিরে,
কোলে করি করে আলিঙ্গনে।।
জিজ্ঞাসিল বাপস্থানে, খুড়া রামস্থানে কেনে,
কিবা হেতু দেখিল তাহাকে।
রাবণ বলিল তারে, এই দুঃখ কব কারে,
যত হৈল বিভীষণ পাকে।।
সেইত করিল এত, রাক্ষস করিল হত,
এত দুঃখ তাহার কারণ।
সেই কৈল সঙ্গী জনা, বসাইল বানর-থানা,
রক্ষকুল করিল নিধন।।
সেই মোর কাল হৈল, রামের শরণ লৈল,
সেই এত করিল জঞ্জাল।
মহী বলে কহি আমি, রামেরে বধিবে তুমি,
কেনে আইল লঙ্কার মাঝার।।
শুনি কহে দশানন, শুন পুত্র বিবরণ,
যে কারণে এত দ্বন্দ্ব হৈল।
অযোধ্যার দশরথ, তার পুত্র রঘুনাথ,
সীতার সহিত বনে আইল।।
শুনিয়া বাপের বাণী, কহে মহী যুড়ি পাণি,
নিশ্চিন্তে থাকহ পিতা ঘরে।
আগে খুড়া বিনাশিব, তবে সৈন্য সংহারিব,
পশ্চাতে মারিব রঘুবীরে।।
এত বলি মহীবীর, ক্রোধে কম্পয়ে শরীর,
গড়ের বাহির শীঘ্র হৈল।
ভারত অমৃত-কথা, দীর্ঘ ছন্দ যাহে গাঁথা,
কাশীরাম দাস বিরচিল।।
০৯. মহীরাবণ বধ
জন্মেজয় বলে, মুনি করি নিবেদন।
তার পর কিবা হৈল কহ তপোধন।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
তদন্তরে যেই হৈল শুনহ কারণ।।
মহীরাবণ বীর তবে করিল গমন।
দেখিলা রামের সৈন্য বহু বীরগণ।।
বড় বড় বীর দেখে পর্ব্বত আকার।
দেখিয়া ত মহীরাবণের চমৎকার।।
কিরূপে করিব রণ না দেখি উপায়।
কোনরূপে জিনি রণ চিন্তিল তথায়।।
তবে মহী ভাবিলেন আপন অন্তরে।
যুদ্ধে কার্য্য নাহি মোর এই কার্য্য সারে।।
যুদ্ধ না করিব, না হইব প্রচারণ।
নিশিতে লইয়া যাব শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
এত ভাবি নিশিতে ধরিয়া বেশান্তর।
বানর হইয়া রহে বানর ভিতর।।
তবে আসি মহী দশরথ রূপ ধরি।
দেখে গিয়া দ্বারে হনুমানেরে প্রহরী।।
মায়া করি বলে হনুমান বিদ্যমান।
শ্রীরামের পিতা আমি দশরথ নাম।।
বহুদিন দেখি নাই শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
দ্বার ছাড়ি দেহ করি রাম দরশন।।
এত শুনি হনূমান বলেন বচন।
হেথা এস করাইব রাম-দরশন।।
রাম জয় করিয়া আইসে বিভীষণ।
দেখি ভয়ে পলাইল রাবণ-নন্দন।।
এইমত আসে যায় নানা বেশ ধরি।
গড়ে প্রবেশিতে নারে হনূ ত প্রহরী।।
তার পরে বিভীষণের মূর্ত্তি ধরি আসি।
গড়ে প্রবেশিতে সেই মনে অভিলাষী।।
দুই ভাই লয়ে তবে প্রবেশে পাতাল।
রাম-লক্ষ্মণেরে লয়ে চলিল ভূপাল।।
নিগড়ে বন্ধন করি রাখিল নির্জ্জনে।
পাথর চাপায়ে বুকে রাখে দুইজনে।।
রামে না দেখিয়া হেথা কান্দে কপিগণ।
হনূমান নল নীল কান্দে বিভীষণ।।
এইমত কান্দয়ে যতেক কপিগণ।
সবাকারে চাহি বলে রাজা বিভীষণ।।
বিভীষণ বলে, শুন পবন-নন্দন।
মহী হরি লৈয়া গেল শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।।
তারপর কহি কথা কর অবধান।
সুড়ঙ্গের দ্বার তবে দেখে হনূমান।।
সেই দ্বারে হনূমান প্রবেশ করিল।
রাম রাম জপিয়া পাতালে চলি গেল।।
প্রবেশিয়া পাতালে দেখিল আদি গড়।
লম্ফ দিয়া ছাড়াইল পবন-কোঙর।।
তবে উত্তরিল গিয়া পুরীর ভিতর।
মায়া করি ফিরে হনূ পুরীর মাঝার।।
সরোবর তীরে এক দেখে তরুবর।
চড়িয়া বসিল বীর তাহার উপর।।
মরকট-বেশে হনূ রহেন তথায়।
নারীগণ জল নিতে তথাকারে যায়।।
হণূমানে দেখে তবে যত নারীগণ।
পাতালে বানর আইল কিসের কারণ।।
সেই সঙ্গে বুড়ী এক ছিল তার মাঝ।
সেই বুড়ি বলে হৈল বড়ই অকাজ।।
নর-বানর যবে এথা একত্র হইবে।
নিশ্চয় জানিহ মহী অবশ্য মরিবে।।
নররূপ দুই শিশু ধরিয়া আনিল।
তারপর দেখ এই বানর আইল।।
নর-বানর দুই দেখ হৈল এক ঠাঁই।
বুঝিলাম মহীর নিস্তার আর নাই।।
বুড়ীর বচন শুনি হনূ আনন্দিত।
গাছ হৈতে নামি বীর চলিল ত্বরিত।।
শ্বেত মাছি হৈয়া বৈসে কলসী-উপর।
তবে হনূমান গেল দেবীর গোচর।।
দেবীকে দেখিয়া হনূ বলয়ে বচন।
তুমি বলি লবে বুঝি শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।।
এত শুনি মহাদেবী হৈলা চমৎকার।
দেবী বলে, শুন বাছা পবন-কুমার।।
কার শক্তি মারিবেক শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।
এত শুনি চলি গেলা বীর হনূমান।।
কর্ম্মকার ঘরে গেলা পবন-নন্দন।
কর্ম্মকার ঘরে দেখে খড়্গ দেয় শাণ।।
তথা হৈতে উঠিয়া চলিল হনূমান।
তবে বীর উপনীত মালাকার-স্থান।।
মালা গাঁথে কান্দে আর রাম রাম বলে।
এইমত মালাকার কান্দয়ে সকলে।।
তারে তবে পুছিলেন পবন-তনয়।
কেনে বা রোদন কর কোন্ দুঃখ হয়।।
তোমার রোদনে মোর স্থির নহে হিয়া।
দেখিয়া রোদন চিত্তে ব্যাকুলিতে হৈয়া।।
মালাকার বলে, শুন বৃদ্ধ কলেবর।
দুই যে বালক আনে পাপী দুরাচার।।
তারে বলি দিবে এই মনেতে ভাবিয়া।
তার লাগি কান্দি, মোর স্থির নাহি হিয়া।।
হনূমান বলে, মহী মরিবে কিমতে।
মালী বলে, মহীমৃত্যু হনূমান হাতে।।
এত শুনি হনূমান তার তরে কয়।
তোরে রাজা করি মহ মারিব নিশ্চয়।।
পুনঃ হনূমান বীর মাছিরূপ ধরে।
প্রবেশ করিল হনূ মহী-অন্তঃপুরে।।
যেই ঘরে বান্ধা আছে ভাই দুইজন।
তথাকারে হনুমান করিল গমন।।
মহী হরি আনিয়াছে পাতাল-ভুবন।
এত শুনি মূর্চ্ছিত হৈল দুইজন।।
এখন কি করিব বলহ হনূমান।
কেমনে রাক্ষস হতে পাই পরিত্রাণ।।
তবে হনূমান বলে যোড় করি হাত।
আমি যে কহিয়ে তাহা শুন রঘুনাথ।।
তারপরে দোঁহারে শিখায় হনূমান।
যখন বলিবে তোমা করিতে প্রণাম।।
বলিবে রাজার পুত্র প্রণাম না করি।
আপনি দেখাও যদি মোরে কৃপা করি।।
ইহা বলি হনূমান শিখাইল বাণী।
তথা হৈতে গমন করিল বীরমণি।।
রামের চরণে বীর করিল প্রণাম।
দেবীর সদনে আসি রহে হনূমান।।
রজনী প্রভাত হৈল প্রত্যূষ বিহার।
আনন্দিত মহীবীর করে স্নান দান।।
বিপ্রগণ বসি পূজে দেবীর চরণ।
রাজা আসি পূজাতে বসিলা ততক্ষণ।।
সুগন্ধি চন্দন দেয় নানা উপহারে।
নানা পুষ্পগণ দেয় ঘটের উপরে।।
নহূমান ঘটে আসি অধিষ্ঠান হৈল।
ঘন ঘন ঘট নড়ে পড়ে পুষ্পজল।।
মহী বলে দেবী আসি হৈলা অধিষ্ঠান।
শীঘ্রগতি আনাইল নর-বলিদান।।
স্নান করাইয়া তবে আনে দুই ভাই।
রূপের তুলনা দিতে ত্রিভুবনে নাই।।
দিব্য বস্ত্র পরাইল মালা দিল গলে।
শত কোটী চন্দ্রোদয় বদন কমলে।।
রামের রূপেতে চক্ষু পালটিতে নারি।
ভয়ে কালী-প্রতিমা কাপঁয়ে থরথরি।।
এত দেখি মহী তবে শ্রীরামের বলে।
মনঃসিদ্ধ হয় তবে দেবীরে পূজিলে।।
শীঘ্রগতি দণ্ডবত করহ দেবীরে।
ইহারে পূজিয়া ইন্দ্র স্বর্গভোগ করে।।
এ কথা শুনিয়া রাম লক্ষ্মণেরে চাই।
লক্ষ্মণ বলেন, কভু প্রণাম না হই।।
যেমত প্রকারে লোক দণ্ডবত করে।
তেমত প্রকারে তুমি দেখাহ আমারে।।
এত শুনি মহীবীর মনে মনেহাসে।
নহে কেন দশরথ দিবে বনবাসে।।
তবে মহী মাথাপাড়ে ভূমির উপরে।
সেইক্ষণে হনূমান নিজ মূর্ত্তি ধরে।।
যেই খড়্গ ছিল দেখ মহী বিদ্যমান।
যেই খড়্গ হাতে নিল বীর হনূমান।।
দেবীরে চাহিয়া বীর তবে বলে বাণী।
আপনার বলিদান লহত আপনি।।
খড়্গ হাতে হনূমান শুন তার কথা।
এক চোটে কাটি পাড়ে মহীবীর মাথা।।
পড়িল ত মহীবীর হইল সংহার।
শুনিয়া তাহার নারী আইল যুঝিবার।।
হাতে ধনু করি আইল হনূর গোচর।
নানাজাতি বাণ মারে হনূর উপর।।
মহাক্রোধে হনূ মারে মুষ্টিকের ঘাত।
মুষ্টিকের ঘাতে রাণীর হৈল গর্ভপাত।।
সেই গর্ভে জন্মে বীর তার অহি নাম।
হাতে ধনু করি আইল করিতে সংগ্রাম।।
ক্ষণে ক্ষণে বাণ মারে হনূর উপর।
বাণে বাণে হনূমানে কৈল জরজর।।
তবে হনূমান তারে সাপটিয়া ধরে।
ধরিতে না পারে সেই পিছলিয়া পড়ে।।
তবে বীর হনূমান ভাবে মনে মন।
পিতা পবনেরে তবে করিল স্মরণ।।
পুত্র হেতু পবন করিলা মহারোষ।
মহাক্রোধে কৈল দেব দারুণ বাতাস।।
ধূলা উড়াইয়া দিল তাহার উপরে।
তবে হনূমান তারে ধরিল সত্বরে।।
চরণে ধরিয়া তারে ঘন দেয় পাক।
পাকে পাকে ফিরে যেন কুমারের চাক।।
আছাড়িয়া ফেলে তারে ভূমির উপরে।
মরিল মহীর পুত্র গেল যমঘরে।।
তার পরে রাজ্যে রাজা হৈল দ্বিজবর।
পাত্র করি সেই রাজ্যে দিল মালাকার।।
রাম আজ্ঞা বিপ্র রাজা পাত্র মালাকার।
কর্ম্মকারে হনুমান দিল ঘমঘর।।
পাতাল হইতে তব বীর হনুমান।
রাম-লক্ষ্মণ কান্ধে করি করিল পয়াণ।।
হেনকালে ভদ্রকালী বলেন বচন।
আমারে লইয়া চল পবন-নন্দন।।
এতেক শুনিয়া হনু হাসিয়া তখন।
মাথে করি ভদ্রকালী কান্ধে দুইজন।।
লঙ্কাতে আইলা রাম-লক্ষ্মণের সহিত।
দেখিয়া সকল সৈন্য হৈল আনন্দিত।।
তবে বীর হনুমান দেবীরে লইয়া।
ক্ষীরগ্রামে রাখে তারে স্থাপন করিয়া।।
তবে হনুমান আইলা লঙ্কার ভবন।
রামজয় বলি ডাকে যত কপিগণ।।
সিংহনাদ করি সবে বলে রামজয়।
শুনিয়া রাবণ রাজা কম্পিত হৃদয়।।
এইমতে রাম-লক্ষ্মণ লঙ্কাতে আইলা।
শুনিয়া রাবণ রাজা প্রমাদ গণিলা।।
জানিল নিশ্চয় মহী ত্যজিল জীবন।
পুত্রশোকে দশানন করয়ে রোদন।।
তবে ত রাবণ রাজা ভাবে মনে মনে।
মহী পুত্র মৈল আর জয় নাহি রণে।।
যেন মহী অধর্ম্ম করিল বহুতর।
তেমতি মরিয়া গেল শমনের ঘর।।
সেই মত দুর্য্যোধন তোমারে হিংসিল।
হিংসার কারণে সেই সবংশে মরিল।।
তোমার নাহিক দোষ হিংসার কারণ।
বংশের সহিত কুরু হইল নিধন।।
চিত্ত স্থির কর রাজা না কর রোদন।
ত্যজহ সন্তাপ, শুন আমার বচন।।
মহীর আখ্যান আমি কহিনু তোমারে।
সেইমত দুর্য্যোধন অধর্ম্মেতে মরে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভব তরি।।
মস্তকে বন্দিয়া দ্বিজগণ পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।
১০. ব্যাসদেশে পাণ্ডবগণের ভীষ্মসমীপে গমন
তবে জন্মেজয় বলে, শুন তপোধন।
তদন্তরে কোন্ কর্ম্ম কৈলা মহাজন।।
মুনি বলে, জন্মেজয় কহিয়ে তোমারে।
যেইমতে সান্ত্বনা হইল যুধিষ্ঠিরে।।
ব্যাসবাক্য শুনি রাজা মন কৈল স্থির।
ব্যাস বৈলা শোকচিত্ত নহ যুধিষ্ঠির।।
নানামত প্রসঙ্গ বুঝান ব্যাসদেব।
অনেক প্রকার করি বুঝাইল তবে।।
শুনিলা অনেক শাস্ত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
ব্যাস বলে, শোক ত্যজে ধর্ম্মে কর স্থির।।
ধর্ম্মকথা শুনিবারে যদি আছে মন।
মন দিয়া শুন গিয়া ভীষ্মের বচন।।
বৃহস্পতি আদি করি যত মুনিগণে।
নীতি শাস্ত্র বুঝাইলা বিবিধ বিধানে।।
ত্রিভুবনে প্রতিষ্ঠিত কর ধর্ম্মপদ।
ব্রহ্ম ঋষি আদি ছিল যার সভাসদ।।
মহা ধর্ম্মশীল ভীষ্ম বীর মহাশয়।
ঘুচাইবে তেঁই তব চিত্তের সংশয়।।
আনন্দিত ধর্ম্মরাজ ব্যাসবাক্য শুনি।
আনন্দিত চারি ভাই দেব চক্রপাণি।।
ধৃতরাষ্ট্রে আগে করি পাণ্ডুর নন্দন।
ভীষ্মের সমীপে সবে করিল গমন।।
চারিদিকে বসিয়া যতেক মুনিগণ।
ধৃতরাষ্ট্র বসিলেন, দেব নারায়ণ।।
করযোড় করিয়া বলেন যুধিষ্ঠির।
আমা হেন পাপী নাহি সংসার ভিতর।।
জ্ঞাতি বন্ধু আদি মুঞি মরিনু যতেক।
লিখিতে না পারি যত করিনু পাতক।।
রাজ্যপদ লাগিয়া করিনু বহু পাপ।
ভীষ্মদেবে মারিয়া পাইনু বহু তাপ।।
এত শুনি বলে ভীষ্ম শুন যুধিষ্ঠির।
হিত উপদেশ কহি মন কর স্থির।।
ত্রিদশের নাথ হরি দেব নারায়ণ।
একমন হৈয়া চিন্ত তাঁহার চরণ।।
হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা পুরুষ পুরাতন।
কি করিতে তোমরা আইলে মোর স্থান।।
আমার ভাগ্যের সীমা কহিতে না পারি।
কৃপা করি আইলেন আপনি শ্রীহরি।।
ত্রিভুবন মধ্যে সার দেব নারায়ণ।
অন্তকালে পাই যেন তোমার চরণ।।
জগতের কর্ত্তা তুমি দেব জগন্নাথ।
কি বলিতে জানি আমি তোমার সাক্ষাৎ।।
তুমি যাহা মনে কর সেইরূপ হয়।
সকল সংসার প্রভু তোমার লীলায়।।
কিবা না করিতে পার আপনি শ্রীহরি।
নাশিলে সে দুষ্টগণ ক্ষিতি ছিল ভারী।।
আদিও অনাদি তুমি সর্ব্বেশ্বর কর্ত্তা।
অনাথের নাথ তুমি সর্ব্বফলদাতা।।
তুমি সর্ব্বময় প্রভু তুমি নিরঞ্জন।
তুমি সর্ব্বপ্রাণ হেতু তুমি সে জীবন।।
দুষ্টে নাশ কর তুমি শিষ্টের পালন।
তুমি সে করুণাময় জগৎ তারণ।।
তুমি ‍সৃষ্টি কর প্রভু সংহারহ তুমি।
চারি বেদ নাহি পারে কী বলিব আমি।।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্ত্য তুমি সে পাতাল।
সংসারেতে আছে যত তব ঠাকুরাল।।
তুমি ইন্দ্র তুমি চন্দ্র তুমি নারী নর।
তোমার অধিক নাহি সংহার ভিতর।।
আদি নিরঞ্জন তুমি আব্রহ্ম স্বরূপ।
কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড তব এক লোমকূপ।।
করূণা করিয়া তুমি তরাও যাহারে।
সেই সে তোমর ভক্ত জানিবারে পারে।।
তোমারে জানিবে হেন আছে কোনজন।
ভক্ত বিনে তোমারে না জানে অন্য জন।।
তব কথা শুনিয়াছি পূর্ব্বে মুনিস্থানে।
যেমত করিলে তুমি কহি বিদ্যমানে।।
পূর্ব্বে এক বিপ্র ছিল পরম ভকত।
তোমা বিনা অন্যে তার নাহি ছিল চিত্ত।।
কৃশানু তাহার নাম ছিল দ্বিজবর।
তোমার ভজন সেই করে নিরন্তর।।
রন্ধন করিয়া বিপ্র তোমা ধ্যান করে।
ভোজন করহ তুমি আনন্দ অন্তরে।।
দ্বিজে প্রবঞ্চনা করি করহ ভোজন।
অন্ন খাও দ্বিজে নাহি দেহ দরশন।।
আর দিন সেই বিপ্র রন্ধন করিয়া।
ধ্যান করে দ্বিজবর যোগাসন হৈয়া।।
কুকুর-মূরতি তুমি ধরিয়া তখন।
অন্ন খেতে বিপ্র তোমা দেখে নারায়ণ।।
বিপ্রকে দেখিয়া পলাইয়া ত আপনে।
পিছে পিছে ধায় তব সেই ত ব্রাহ্মণে।।
তোমাকে প্রতীত করি বলেন বচন।
কেন পলাইয়া যাহ না করি ভোজন।।
মোর দোষ ক্ষমা কর মোর অন্ন খাহ।
মোর দিব্য লাগে যদি পলাইয়া যাহ।।
অন্না আসি খাও তুমি না করিহ ডর।
ঈশ্বর বিরাজে সদা তোমার অন্তর।।
তোমাতে আছেন হরি শুন মহাশর।
অন্ন খেয়ে পূর্ণ কর আমার হৃদয়।।
এইমত কহি ধরে কুক্কুর-চরণ।
দ্বিজমূর্ত্তি হৈয়া হরি দিলা দরশন।।
দিব্যমূর্ত্তি হইলেন চতুর্ভুজধারী।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হইল শ্রীহরি।।
দ্বিজবরে বিস্তর করিলে আশ্বাসন।
প্রতিদিন খাব অন্ন তোমার সদন।।
তোমার অধীন আজি হইনু ব্রাহ্মণ।
তোমারে ছাড়িতে আমি নারিব কখন।।
সেই হেতু তোমারে পরীক্ষা আমি কৈনু।
এত দুঃখ তোমারে ছাড়াতে নারিনু।।
নিশ্চয় বলহ প্রভু শুনহ বচন।
সর্ব্বমতে আমি তোমা করিব রক্ষণ।।
সেই মতে অন্ন খাই বুঝিল ধারণে।
কদাচিত যুধিষ্ঠির হয় সে ব্রাহ্মণে।।
অঙ্গীকার কৈলা সত্য পালন করিতে।
সেই এই যুধিষ্ঠির লয় মোর চিতে।।
সেই হেতু কৈলা দুষ্ট দুর্য্যোধনে নাশ।
আজি সে জানিল তাহা শুন শ্রীনিবাস।।
তোমা বিনে আর মোর নাহি সৃষ্টিকর্ত্তা।
আর যত আছে সব তোমার রক্ষিতা।।
কৃপা করি কর প্রভু মোর পরিত্রাণ।
উদ্ধার করিয়া মোরে লহ নিজস্থান।।
পূর্ব্বেতে গয়ায় এক ছিল দ্বিজবর।
অনাচার বৃত্তি সেই করে নিরন্তর।।
হরিতে ভজনা, সদা নীচ কর্ম্ম করে।
নীচ কর্ম্ম করি সেই দেহ মাত্র ধরে।।
পাদুকা-ব্যাপার করে ব্রাহ্মণ হইয়া।
চর্ম্মের পাদুকা বেচে দোকান করিয়া।।
তাহাতে বসিয়া সেই সদাকাল থাকে।
পাদুকা ঝাড়য়ে সদা ফুক দেয়মুখে।।
চর্ম্মের ব্যাপার করে মুচিসঙ্গে থাকে।
চর্ম্মের যতেক ধূলা লাগে তার মুখে।।
মুচির সঙ্গেতে তার সঙ্গ সর্ব্বক্ষণ।
আপনার ধর্ম্ম কর্ম্ম না করে ব্রাহ্মণ।।
সন্ধ্যা-গায়ত্রী হীন মুচিসঙ্গে রয়।
সর্ব্ব দিন গেলে সেই সন্ধ্যাকালে খায়।।
রন্ধন করিয়া তোমা কেরে সমর্পণ।
তবে ত তাহার পরে করয়ে ভক্ষণ।।
দিন গেলে একবার তব নাম লয়।
অন্যান্য সময় নহে সন্ধ্যার সময়।।
আর দিন নাম লৈয়া করিল শয়ন।
দৈবে সর্পাঘাতে দ্বিজ ত্যজিল জীবন।।
মরিলে যমের দূতে বান্ধি লৈয়া যায়।
বিষ্ণুদূত আসি তার বন্ধন খসায়।।
বিষ্ণুদূতে লৈয়া গেল বিষ্ণুর নগরে।
তবে যমদূত গেলা যমের গোচরে।।
ফেলিল হাতের পাশ ধর্ম্ম বরাবরে।
কহয়ে ধর্ম্মের আগে করি যোড় করে।।
তোমার স্থানেতে মোর নাহি প্রয়োজন।
এতেক শরীরে দুঃখ না যায় কথন।।
এতকাল চর্ম্ম বেচে ধর্ম্ম কর্ম্ম নাই।
মোরে মারি তারে লৈয়া যায় অন্য ঠাঁই।।
তপ-জপ-হীন বিপ্র নীচকর্ম্ম করে।
তবে কেন লৈয়া যায় বিষ্ণুর গোচরে।।
তোমার রহিল আর কিসে অধিকার।
আমরা আনিব কারে সংসার ভিতর।।
ধর্ম্ম বলে, কহ চিত্রগুপ্ত মহাশয়।
কোন কর্ম্ম করে বিপ্র কহত নিশ্চয়।।
চিত্রগুপ্ত বলে, ধর্ম্ম নাহি ত লিখন।
শয়নেতে হরিনাম করিত স্মরণ।।
শয়নে মরণে যেই হরিনাম লয়।
তারে তোর আনিতে উচিত নাহি হয়।।
শয়নে লইল নাম সেই ত ব্রাহ্মণ।
তবে কেন দূত যায় তাহার সদন।।
শয়নে মরণে যেই হরিনাম লয়।
মোর অধিকার তারে নাহিক নিশ্চয়।।
যম বলে, শুন দূত বচন আমার।
এই এই জনে মোর নাহি অধিকার।।
এক দিন যেই জন হরিনাম লয়।
তারে তুমি নাহি আন আমার আলয়।।
হরিনাম লৈয়া যেই জন মৃত্যু হয়।
কদাচিত নাহি যাহ তাহার আলয়।।
মরণ-সময়ে যেই জনে গঙ্গা পায়।
তথা হইতে ফিরি তোরা আসিবি নিশ্চয়।।
যার গলে রুদ্রাক্ষ তুলসী মালা থাকে।
কভু নাহি যাবি তোরা তাহার সম্মুখে।।
কবচ থাকিবে যার হরি-হর নামে।
কদাচিত তোমরা না যাবে তার ধামে।।
গঙ্গার মৃত্তিকা থাকে যাহার ললাটে।
কদাচ না যাবি তোরা তাহার নিকটে।।
তুলসীবেদীর মাটী তুলসীর পাত।
কভু নাহি যাবি তোরা তাহার সাক্ষাৎ।।
গোরজ গোময় মূত্র থাকে যার শিরে।
তাহে নাহি ছুঁবি তোরা কহিনু সবারে।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি যেবা ত্যজয়ে জীবন।
তার তরে তোরা নাহি ছুঁবি কদাচন।।
মরণকালেতে গুরুদরশন পায়।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠেতে যায়।।
যাহার উপরে আছে মোর অধিকার।
তাহা যে বলিব সবে শুন সারোদ্ধার।।
পৃথিবীতে জন্মি যেই পরহিংসা করে।
গুরুভক্তি চিন্তা নাহি যাহার অন্তরে।।
বিপ্র দেখি প্রণাম না করে যেই জন।
মিথ্যা বাক্য কহে আর কর্কশ বচন।।
পরদ্রব্য লয় আর পরদার হরে।
দ্বিজভূমি হরে আর পরছিদ্র ধরে।।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় আর প্রবঞ্চনা করে।
দান দিয়া যেই জন ভাবয়ে অন্তরে।।
দেখিয়া পরের দুঃখ সুখ পায় মনে।
এই মত কত আছে অনেক কথনে।।
এইমত ধর্ম্মরাজ কহিল দূতেরে।
এই সব পাপী আন ডাঙ্গশ প্রহারে।।
সুদৃঢ় বন্ধন করি আন মোর হেথা।
মারিয়া ডাঙ্গশ বাড়ি ভাঙ্গি তার মাথা।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র