ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত

পূর্বেবসুদেব দেবকদহিতা দেবোপমা দেবকীর পাণি গ্রহণ করে ছিলেন। দেবকীর পরিণয়াবসানে তাঁর ভ্রাতা কংস বসুদেবের সারথি হয়েছিলেন। একদা মহাত্মা বসুদেব স্বীয় পত্নী দেবকীর সাথে রথারূঢ় হলে কংস তাঁর রথ সঞ্চালন করতে প্রবৃত্ত হলেন। রথ চলতে শুরু করলে মেঘগম্ভীরনির্ঘোষে এরূপ আকাশ-বাণী হল যে- রে মুর্খ! তুমি পতিসমন্বিত যে রমণীরে বহন করছ তারই অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমার প্রাণ সংহার করবে।এরূপ আকাশ-বাণী শ্রবণ করে মহাবল পরাক্রান্ত কংস নিজ ভগিনীকে তরবারি দ্ধারা প্রাণ সংহার করতে উদ্যত হলো। তখন মহাত্মা বসুদেব তারে নিবারণ করে বললেন,” হে বীরবর! দেবকীকে হত্যা করা তোমার কতব্য নয়। তার গর্ভে যখন যে যে পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করবে আমি সাথে সাথে আপনার হাতে সমর্পণ করব। কংস তার গৌরব রক্ষা করার নিমিত্ত বসুদেবের প্রস্তাবে সম্মত হলো।
ঠিকঐ সময় ভগবতী বসুন্ধরা নিতান্ত ভারপীড়িত হয়ে সুমেরু পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে ভগবতী দেবগণকে নমস্কার করে দুঃখভারাক্রান্ত মনে করুণভাবে বলতে লাগলেন,” হে দেবগণ! অগ্নি সুর্বণের ও সূর্য লোকসমুহের গুরু। কিন্তু সর্বময় সনাতন বিষ্ণু আমাদিগকের সকলেরই গুরু ও পূজনীয়। তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা, কালাকাষ্ঠাদিনিমেষাত্মক কাল ও স্থূল সূক্ষ্মময় বলে অভিহিত হয়ে থাকেন। আমরা সলকেই তাঁর অংশ হতে উনপন্ন হয়েছি। আদিত্য, মরুৎ, সাধ্য, বসু, পিতৃ ও লোকবিধাতৃগণ এবং যক্ষ, রাক্ষস, দৈত্য, পিশাচ, উরগ, দানব, গন্ধর্ব্ব, অপসরা, গ্রহ, ঋক্ষ, তারকা, গগন, অগ্নি, জল ও বায়ু সকলই তাঁর রূপভেদমাত্র। আমি ও মৎসংক্রান্ত বিষয়ের সহিত তাঁর কিছুমাত্র প্রভেদ নেই। ইহাভিন্ন তাঁর যে কত রূপ জলধিতরঙ্গের ন্যায় দিবারাত্রি বাধ্যবাধকতা প্রাপ্ত হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা করা যায় না।
ভগবতী এভাবে বিষ্ণুর স্তব করে পুনরায় দেবগণকে সম্বোধন করে বললেন,” সম্প্রতি অরিষ্টধেনুক, কেশী, প্রলম্ব, নরক, স্বন্দ ও বলিপুত্র বাণ প্রভৃতি অসংখ্য অসুর মর্ত্য-লোকে জন্ম গ্রহণ করে লোকসমুদয়কে নিপীড়িত করছে। প্রজাগণ তাদের অত্যাচার সহ্য করতে পারছে না। ভগবান শ্রীবিষ্ণু দৈত্যকুলোদ্ভব কালনেমিরে বিনাশ করলে সেই দূরাত্মাই আবার উগ্রসেনের পুত্র কংসরূপে জন্ম গ্রহণ করেছে। ইহা ব্যতিত আর কত যে দূরাত্মা বিভিন্ন রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করেছে তা নিরূপণ করা যায় না। অধিক কি বলব দিব্য-মূর্ত্তি-ধারী মহাবল পরাক্রান্ত দর্পিত অসংখ্য অক্ষৌহিণী দৈত্যেন্দ্রগণ আমার উপরিভাগে বিচরণ করে থাকে। আর আমি ইহাদের ভার সহ্য করতে পারছিনা। স্বীয় আত্মাকেও ধারণ করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। অতএব আমি রসাতলগামিনী না হওয়ার পূর্বেই আপনার অনুগ্রহ করে আমাকে ভারবহন করুন।
পৃথিবী ভীত হয়ে এরূপ বললে সর্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা সকল দেবগণকে সম্বোধন করে বললেন,” হে সুরগণ! বসুধা যা যা বললেন সবই সত্য। তুমি আমরা সকলই নারায়াত্মাক। সমস্ত পদার্থই তাঁর বিভূতির সমষ্টি হতে উৎপন্ন হয়েছে। কেবল বিভূতির আধিক্য ও নূন্যতানিবন্ধন পদার্থের বাধ্যবাদকতাগুণ উৎপন্ন হয়ে থাকে। অতএব এসো আমরা সকলই ক্ষীরোদসাগরের উত্তরকূলে উপস্থিত হয়ে সেই পরমারাধ্য বিষ্ণুর আরাধনা করে এ বিষয়টি অবগতি করি। তিনি সর্বদাই জগতের হিতসাধনের নিমিত্ত অংশাংশে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে পরম ধর্ম সংস্থাপন করে থাকেন।
ব্রহ্মা এরূপ বললে দেবগণ সম্মত হয়ে তাঁর সহিত ক্ষীরোদার্ণবের উত্তর কূলে উপস্থিত হলেন। তারপর ব্রহ্মা সনাতন বিষ্ণরে এরূপে স্তব করতে লাগলেন,” হে প্রভো! তুমি উভয় বিদ্যা, প্রকৃতি, পুরুষ, জীবাত্মা, পরমাত্মা, স্থূল-সূক্ষ্মময় এবং ঋগবেদ যজুর্বেদ ও সামবেদস্বরূপ। শিক্ষাকল্প, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ, ইতিহাস, পুরাণ, ব্যাকারণ, মীমাংসা, ন্যায় ও ধর্মশাস্ত্র সমুদয় ত্বৎস্বরূপ বলে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। দেহাত্মবাদীরা বিচার করে যে সমুদয় বাক্য বলে থাকে তাও তোমা হতে ভিন্ন নয়। তুমি অধ্যাত্ম, অব্যক্ত, অনির্দ্দেশ্য্, অচিন্তাত্মা, পাণিপাদবির্জ্জত এবং নাম বর্ণ ও রূপবিহীন। তোমার পরম পদ কোনকালে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। তুমি কর্ণবিহীন হয়েও শ্রবণ, নেত্রবিহীন হয়েও দর্শন, অদ্বিতীয় হয়েও বহুরূপ ধারণ, হস্তবিহীন হয়ে পদার্থ গ্রহণ এবং বিজ্ঞানবিহীন হয়েও সর্বজ্ঞান লাভ করে থাক। তুমি সূক্ষ্ম হতেও সূক্ষ্ম, ও সর্ববস্তুময়। তোমার সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারলে মনুষ্যের বিজ্ঞানের নিবৃত্তি হয়ে থাকে। তুমি ধীরগনের ধৈর্য্য ধারণ করে থাক। তুমি পরাৎপর, বিশ্বের আদি ও ভূবনের গোপ্তা। স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় ভূতই তোমার অন্তর্গত। তুমি সূক্ষ্ম হতে সূক্ষতর, প্রকৃতি, পুরুষ ও অদ্বিতীয়। তুমি একমাত্র অথচ চতুর্বিধ হুতাশন। তোমা হতে ভিন্ন নহে। তুমি বর্চ্চাস্বরূপ হয়ে জগতের সমুদয় বিভূতি প্রদান করে থাক। ব্রহ্মাণ্ডের সর্বস্থানেই তোমার চক্ষু বিদ্যমান রয়েছে। তোমারে অনন্তমূর্তি বলে নির্দেশ করা যায়। তুমি বামনরূপে ত্রিপদ ধারণ করেছিলে। যেমন বিকারশূন্য অনল বিকারভেদ দ্বারা বহুধা প্রজ্জ্বলিত হয়, তদ্রুপ তুমি নির্বিকার হয়েও অলক্ষিতরূপে সর্বভূতে অবস্থান পূর্বক অশেষরূপ প্রদর্শন করছ। তুমি একমাত্র প্রধান পুরুষ ও অনন্তমূর্তি। পণ্ডিতেরা তোমার পরম ধাম দর্শন করে থাকেন। ভুত ভবিষ্য সমুদয় পদার্থই তোমার স্বরূপ বলে নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। তোমা হতে পৃথগভূত কিছুই নেই। তুমি ব্যক্ত ও অব্যক্তস্বরূপ এবং সমষ্টি ও ব্যষ্টিরূপসম্পন্ন। তোমারে সর্বজ্ঞ, সর্বদৃক, সর্বশক্তিমান এবং সমদয় জ্ঞান বল ও ঐশ্বর্য্যযুক্ত বলে কীর্তন করা যায়। তুমি হ্রাসবৃদ্ধিবিহীন, স্বাধীনতাযুক্ত, অনাদি, জিতেন্দ্রিয়, ক্লমতন্দ্রা ও কামক্রোধাদি বিবর্জিত, নিরবদ্য, পরম পুরুষ সর্বময় ও সর্বেশ্বর। পণ্ডিতেরা তোমারে পরাধার, পরমধাম, অক্ষয়, সমদয় আবরণ হতে অতীত, নিরালম্বনের অবলম্বন, মহাবিভূতির সংস্থাপক ও পুরুষোত্তম বলে নির্দেশ করে থাকে। সামান্যকারণে তোমার দেহাবলম্বন দৃষ্টিগোচর হয় না। তুমি ধর্মত্রানের নিমিত্তই পৃথীতলে অবতীর্ণ হয়ে থাক।
ভগবান ব্রহ্মা এভাবে স্তুতিবাদ করলে সনাতন বিষ্ণু বিশ্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাকে বললেন,” হে ব্রহ্মণ! তুমি দেবগণে বেষ্টিত হয়ে যা যা প্রার্থনা করেছ তা প্রকাশ কর। আমা হতেই অবশ্যই তোমাদের বাসনাপূর্ণ হবে। ভগবান বিষ্ণু এরূপ বললে দেবগণ তাঁর সেই বিশ্বরূপ দর্শনে নিতান্ত ভীত হলেন। আমরা সকলেই তোমার প্রসাদলাভের আকাঙ্খায় অগমন করেছি। এক্ষণে বসুন্ধরা অসুরগণ কর্তৃক নিতান্ত নিপীড়িত হয়ে তোমার শরণাপন্ন হয়েছে। ইন্দ্র, নাসত্য, দশ্র, বরুণ, বায়ু, অনলও আমি এবং আদিত্য, রুদ্র ও বসুগণ প্রভৃতি আমরা সকলেই তোমার নিকট উপস্থি হয়েছি। তুমি আমাদেরকে যা আজ্ঞা করবে আমরা তৎক্ষণাৎ তা প্রতিপালন করব।
সর্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা পুরুষোত্তম ভগবান বিষ্ণুর এরুপ স্তব করলে তিনি স্বীয় শুক্ল ও কৃষ্ণ বর্ণ কেশদ্বয় উদ্ধৃত করে দেবগণকে মম্বোধন করে বললেন,” হে সুরগণ! আমার এ কেশদ্বয় বসুধাতলে অবতীর্ণ হয়ে ভূমির ভার হরণ করবে। এক্ষণে তোমরা স্বীয় স্বীয় অংশে ভূমন্ডলে জন্ম গ্রহণ করে সেই উন্মত্ত মাহসুরগণের সহিত যুদ্ধ করতে প্রবৃত্ত হও। তারা আমার দৃষ্টিপাতে চূর্ণীকৃত হয়ে অবিলম্বেই ক্ষয় প্রাপ্ত হবে এবং আমার এ কেশও মহাত্মা বসুদেবের পত্নী দেবোপমা দেবকীর অষ্টম গর্ভে সমুৎপন্ন হয়ে মহাসুর কংসকে নিপাতিত করবে সন্দেহ নেই। এ বলে তিনি দেবগণের সম্মুখেই অন্তর্হিত হলেন।
দেবগণ সেই মহাত্মা বিষ্ণুর প্রতি নমস্কার জ্ঞাপন করে সুমেরু পর্বতে আগমন পূর্বক ক্রমে ক্রমে ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হলেন। তারপর একদা দেবর্ষি নারদ ভোজপতি কংসের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন “ মহারাজ! আপনার ভগিনী দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত পুত্র পৃথিবীর অধিকারী হবে। দেবর্ষি নারদের মুখে এ বাক্য শ্রবণ করামাত্রই কংস নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হয়ে বসুদেব ও দেবকীরে গৃহমধ্যে রুদ্ধ করে রাখল। সেই দেবকীর গর্ভে যে সময়ে যে যে পুত্র উৎপন্ন হয়েছিল মহাত্মা বসুদেব পূর্বনিয়মানুসারে সেই সেই পুত্রকে তার হাতে সমর্পণ করেছিলেন।
হিরণ্যকশিপুর যে ছয় পুত্র জন্ম হয়েছিল, মহামায় যোগনিদ্রাই বিষ্ণূ কর্তৃক প্রেরিত হয়ে তাদেরকে দেবকীর গর্ভে আনয়ন করেন। ভগবান বিষ্ণু জগন্মোহকারিণী বৈজ্ঞবী যোগনিদ্রারে সম্বোধন করে বললেন,” হে যোগনিদ্রে! তুমি পাতালতলে গমন করে হিরণ্যকশিপুর ছয় পুত্রকে একে একে দেবকীর জঠরে সমানীত কর। সে দেবকীর গর্ভজাত ছয় পুত্র কংস কৃর্তক নিপাতিত হলে আমার অংশাংশে দেবকীর গর্ভে সপ্তম পুত্র উৎপন্ন হবে। তারপর তুমি সে গর্ভস্থ বালককে আকর্ষণ করে গোকুলবাসিনী রোহিণীর গর্ভে আনয়ন করবে। দেবকীর সপ্তম পুত্র এরুপে রোহিণীর গর্ভে অধিষ্ঠিত হলে লোকসমাজে এরুপ প্রচার হবে যে ভোজরাজ কংসের ভয়ে দেবকীর সপ্তম গর্ভ পতিত হয়েছে। এরুপ শ্রুতির পর রোহিণীর গর্ভ হতে শ্বেতাচলসন্নিভ এক বীর পুত্র জন্ম গ্রহণ করে যোগনিদ্রার আকর্ষণনিবন্ধন সংকর্ষণ নামে বিখ্যাত হবে।
তারপর আমি দেবকীর পবিত্র জঠরে জন্ম গ্রহণ করব। তুমিও ঐ সময়ে গোকুলে যশোদার গর্ভে আবির্ভূত হবে। তৎপরে প্রাবৃটকালে(বর্ষাকালে) নভোমণ্ডল ঘনঘটায় সমাচ্ছন্ন হলে কৃষ্ণপক্ষীয় অষ্টমী তিথিতে অর্দ্ধরাত্রী সময়ে আমি দেবকীর গর্ভ হতে ভুমিষ্ট হব। তুমিও সে রাত্রিতে নবমী তিথির সঞ্চার হলে যশোদার জঠর হতে জন্ম গ্রহণ করবে। এরূপে আমাদের জন্ম হলে মহাত্মা বসুদেব আমারে যশোদার কাছে এবং তোমাকে দেবকীর ক্রোড়ে রেখে আসবে। পরে ভোজরাজ কংস তোমাকে গ্রহণ করে শিলাতলে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু তুমি সে শিলায় নিপতিত না হয়ে অন্তরীক্ষে অবস্থিত হবে। অতঃপর দেবরাজ আমার গৌরবনিবন্ধন নমস্কার করে তোমাকে ভগিনীরুপে গ্রহণ করিব। তৎপর তুমিও শুম্ভ নিশুম্ভ প্রভৃতি অসংখ্য দৈত্যগণকে হত্যা করে পৃথিবীর নানাস্থানে নিরুপদ্রব করবে। তোমা হতে পৃথিবীর উৎপাতশান্তি হলে লোকে তোমাকে ভূতি, সন্ততি, কীর্তি, ক্ষান্তি, পৃথিবী ও স্বর্গস্বরূপা এবং ধৃতি, লজ্জা ও পুষ্টি প্রভৃতি বিবিধ নামে স্তব করবে। যারা প্রাতকালে ও সায়াহ্নকালে আর্যা, দূর্গা, বেদগর্ভা, অম্বিকা, ভদ্রা, ভদ্রকালি, ক্ষেমা ও ক্ষেমঙ্খরী নাম উচ্চারণ পূর্বক তোমার স্তব করবে আর আমরা প্রসাদে তাদের মনোরথ কখনই বিফল হবে না। এবার আমার উপদেশামতে কার্য করতে প্রবৃত্ত হও।
সনাতন বিষ্ণু যোগনিদ্রাকে এরূপ উপদেশ প্রদান করলে তিনি হিরণ্যকশিপুর ছয় পুত্রকে ক্রমে ক্রমে দেবকীর গর্ভে আনয়ন করলেন। কংস কর্তৃক ঐ পুত্রগণের বিনাশ সাধন হলে সেই দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান তৎকর্তৃক আকির্ষিত হয়ে রোহিণীর গর্ভে সংস্থাপিত হলো। তারপর ঐ পুত্র রোহিণীর গর্ভ হতে উৎপন্ন হলে ভগবান হরি লোকত্রয়ের উপকারার্থ দেবোপমা দেবকীর জঠরে প্রবেশ করলেন। ঐ দিন তাঁর উপদেশানুসারে যশোদার গর্ভে যোগনিদ্রাও জন্ম নিলেন। ভগবান বিষ্ণু এরুপে দেবকীর গর্ভে অবতীর্ণ হলে গ্রহগণ সুচারুরূপে আকাশে বিচরণ করতে লাগল। ঋতুসমুহের আর কোন বৈপরীত্য রইল না। দেবোপমা দেবকী বিষ্ণুরে গর্ভে ধারণ করাতে এরূপে তেজস্বিনী হলেন যে কেহই তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে সমর্থ হল না। কিন্তু সকলেরই অন্তঃকরণ তাঁরে দর্শন করতে লাগল।
দেবকী সনাতন বিষ্ণুরে এরুপে গর্ভে ধারণ করার পর দেবগণ তাঁরে স্তব করতে আরম্ভ করল। হে দেবী! তুমি পরা প্রকৃতি। পূর্বে তুমি ব্রহ্মারে গর্ভে ধারণ করেছিলে। তারপর বাণীস্বরূপা হয়ে এ জগতকে ধারণ পূর্বক বেদসমুহ উৎপাদন করেছ। তুমি সৃজ্যস্বরূপা, সৃষ্টিভূতা, সনাতনী সকলের বীজভূতা যজ্ঞগর্ভা ও ত্রয়ীস্বরূপা বলে অভিহিত হয়ে থাক। তুমি ফলগর্ভা ইজ্যা, বহ্নিগর্ভা অরণি, দেবগর্ভা অদিতি, দৈত্যগর্ভা দিতি, রসগর্ভা জ্যোৎস্না, জ্ঞানগর্ভা সন্নতি, নয়গর্ভা নীতি, প্রশ্রয় গর্ভা লজ্জা, কামগর্ভা ইচ্ছা, তোষগর্ভা তুষ্টি, মেধগর্ভা মেধা, ধৈর্যগর্ভা ধৃতি এবং গ্রহ ঋক্ষ ও তারকাদিসম্বলিত নভোমণ্ডলস্বরূপ। তোমা হতেই এ সমুদয় এবং অন্যান্য অসংখ্য বিভূতি সমুহ উপৎপন্ন হয়ে থাকে। এখন তোমার গর্ভে যে কত বিভূতি অবস্থিত রয়েছে কেহই তা ইয়ত্তা করতে পারবে না। সমুদ্র পর্বত নদী দ্বীপ বন ও পত্তনবিভূষিত গ্রাম্যাদিযুক্ত সমুদয় পৃথিবী, বহ্নি জল ও সমীরণ সমুদয়, গ্রহ ঋক্ষ ও তারকাদিসমন্বিত বিমানশতসংকুল নভোমণ্ডল, ভূর্লোক, ভূবর্লোক, স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক তপোলোক ও সত্যলোকসম্বলিত অখিল ব্রহ্মাণ্ড এবং ঐ সমুদয় লোকবাসী দেব দৈত্য গন্ধর্ব্ব, বারণ, মহোরগ, যক্ষ, রাক্ষস, প্রেত, গুহ্যক, মনুষ্য ও পশু পক্ষ্যাদি প্রাণিগণ যাঁতে অবস্থিত রয়েছে, সেই সর্বভাবন সনাতন বিষ্ণু এক্ষনে তুমি প্রসন্ন হয়ে জগতের হিত সাধনার্থ অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর ভগবান নারায়ণকে গর্ভে ধারণ পূর্বক আমাদের প্রীতি উৎপাদন করুন। ভগবতী দেবকী দেবগণ কৃর্তক এভাবে স্তুত হয়ে জগতত্রানকর্তা পুণ্ডরীকাক্ষ ভগবান নারায়ণকে গর্ভে ধারণ করে রাখলেন। তারপর নিয়মিত কাল উপস্থিত হলে অচ্যুতরূপ ভানু দেবকীরূপ পূর্বসন্ধ্যাতে আবির্ভূত হয়ে অখিল জগত পদ্ম প্রকাশিত করলেন। ভগবান বিষ্ণু এরূপে অবতীর্ণ হলে জগত আনন্দময় হয়ে উঠল। চন্দ্রোদয় হলে যেমন চন্দ্রিকা প্রাকশিত হয় তদ্রূপ বিষ্ণু অবতীর্ণ হলে লোকসমুদয়ের পরম প্রীতি উৎপন্ন হলো। বেদগান করে যত মুনিগণ। পদ্মযোনি সুরগণসহ স্তবস্তুতি করতে লাগল। গন্ধর্বেরা সুস্বরে সংগীত করে, অপ্সরা তান্ডব নৃত্য করে, দেবগণ পূষ্পবৃষ্টি করে, হাতির উপর ইন্দ্র নাচে, হংসের উপর নৃত্য করে পদ্মাসন, মহাদেব নৃত্য করে বৃষের উপর, মহিষের উপর নৃত্য করে নরকের পতি যম, মূষিকের উপর চড়ে নৃত্য করে গনেশ, ময়ুরের চড়ে নৃত্য করে কার্ত্তিক। আর অন্যান্য দেবতাগণ যার যার বাহনে চড়ে নৃত্য করে। চারিদিকে পাখিরা মধুর সুরে ডাকে, মন্দ মন্দ সুশোভিত বাতাস বহে, ষড়ঋতু-ফলফুল ফুটে সারি সারি, বাতাসে কি সুগন্ধ। পুলকিত ত্রিভূবন। ঐ সময়ে প্রভূ নিরঞ্জন ভূমিষ্ঠ হন।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী, ধ্বজবজ্রাঙ্কুশচিহ্ন চরণ কমলে, কটিতটে পীববাস, গলদেশে বনমালা, কোটি সূর্য্য যেন অঙ্গ আভা টলমল, বক্ষস্থলে ভৃগুমুনি-পদচিহ্ন, মস্তক উপর চূড়া বান্ধা, কটিতে কিঙ্কণী, চরম কমলে নূপুর। এমন ভূবনমোহিনীরূপ দেখে বিমোহিল দেবকীর মন। তখন দেবকী বসুদেবকে ডেকে বলেন, “ উঠ উঠ প্রাণনাথ! দেখ কেমন সুন্দর পুত্র জন্মেছে আমাদের। কালোরূপে কারাগার আলোকিত হয়েছে। এমন রূপ আমি কভু কখনও দেখেনি। বসুদেব চতুর্ভুজ ভগবান বিষ্ণুর অপূর্বরূপ দর্শন করে বললেন,” হে ভগবন! তুমি যে শঙ্কচক্রগদাধারী বিষ্ণু আমি তা জ্ঞাত হয়েছি। এখন তুমি প্রসন্ন হও প্রভু। তোমার এ দিব্যরূপ সংবরণ কর। তুমি আমার মন্দিরে অবতীর্ণ হয়েছ শ্রবণ করা মাত্রই দুরাত্মা কংস তোমাকে নিধন করতে আসবে।
বসুদেব এরূপ স্তুতিবাক্য করলে দেবকীও বিষ্ণুর সেরূপ দর্শন করে বলতে লাগল,” হে প্রভু! তুমি অখিলব্রহ্মাণ্ডরূপী অনন্ত, সর্বাত্মা ও সর্বময়। তুমিই গর্ভবাসকালেই লোকসমুহে রক্ষা কর। স্বীয় মায়াবলেই তোমার বালকরূপ প্রকাশিত হয়েছে। এখন তুমি এ চতুর্ভূজ মূর্তি সংবরণ কর। দুরাত্মা কংস এখনই সংবাদ পেয়ে তোমাকে হত্যা করতে আসবে। তখন শ্রীহরি বললেন,” আমাকে তোমরা রেখে আস নন্দের আলয়ে। যশোদা আমাকে পালন করবে। যশোমতি হন নন্দ ঘোষের গৃহিনী। তিনিও প্রসব করেছেন এক রূপরী কন্যা। নিদ্রাঘোরে সে অচেতন থাকবে। তার ছেলে না কন্যা সন্তান হয়েছে তা সে জানবে না। আমাকে নিয়ে যশোদার ক্রোড়ে রেখে আস। আর কন্যা সন্তানকে নিয়ে আস। আর তাহলে আমার চতুর্ভূজন মূর্তি থাকবে না। পূর্বে তুমি পুত্রার্থিনী হয়ে আমার বিস্তর স্তব করেছিলে। সে পূণ্যে আমি তোমার উদরে জন্ম গ্রহণ করেছি। এ বলিয়া তিনি বালকভাবে প্রাপ্ত হলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেবও সে রাত্রে তাঁরে গ্রহণ করে গৃহ হতে প্রস্থান করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যোগনিদ্রার প্রভাবে মথুরার রক্ষক ও দ্বারপালগণ বিমোহিত হল। তখন বাসুদেব শ্রীহরিকে কোলে লয়ে নিঃশব্দে বের হলেন। বাহিরে মৃদুমন্দ বাতাস ও বারি ঝরছে। প্রভুর অঙ্গে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি পড়ছে। অনন্তদেব তা দেখে মনে মনে ভাবে এতদিন বৃথা ফণাভার বয়েছি। প্রভুর দেহে বৃষ্টি পড়ছে তা নিবারণ করি। বসুদেব তা লক্ষ করেনি। ভাবে বৃষ্টি থেমে গেছে। বসুদেব কৃষ্ণরে লয়ে গোকূলে যায় অনন্ত অসংখ্য চোখে হরির দিকে চায়। বসুদেবে দক্ষিণ বাহুতে আছে শ্রীহরির যুগল চরণ। চরণেন প্রতি বসুদেব বার বার চেয়ে থাকে। তা দেখে অনন্ত আপন মনে ভাবে,” যে চরণের জন্য শিব শ্মশানে পড়ে থাকে। যে চরণ পাবার জন্য ঋষিগণ সদাই চিন্তায় থাকে। যে চরণ পাবার জন্য সাদাই চিন্তা করে পদ্মাসন। যে চরণ হতে মা গঙ্গার উদ্ভব। আর যে চরণ পবার জন্য আমি বহি বিশ্বভার। সে চরফ বাসুদেব পায় অতি অনায়াসে। পূর্বজন্মে না জানি কত পূণ্য করেছিল। বসুদেব ধীরে ধীরে যমুন কূলে উপস্থি হলেন। শ্রীহরিকে দেখে যমুনা আনন্দে আত্মহারা হন। কল কল করে বিপুল তরঙ্গ উঠে। অতিবেগে স্রোত বহে।
এদিকে যোগমায়া জগত জননী চিন্তা করতে লাগলেন। আজ প্রভু আসার কথা। কিন্তু এখনও আসছেন না। প্রভুর অদর্শনে যোগমায়া জ্ঞানহারা যশোদার ক্রোড়ে রহিলেন। আর শিবানী হলেন অন্য অংশ মায়ারছলে। গিয়ে দেখেন বসুদেব শ্রীহরিকে নিয়ে অপর পারে দাড়ায়ে আছ। তখন মহামায়া শিবারূপ ধারণ করে অবলিক্রমে যমুনা পাড় হয়ে যাচ্ছে। তা দেখে বসুদেব ভাবল শৃগাল যমুনা পাড় হয়ে যাচ্ছে। যমুনার জল এক কম। তবে আমি কেন পারব না। তখন বসুদেব যমুনাতে নামেন। আর দিকে যমুনা মনে মনে ভাবে “ আমার উপর দিয়ে তুমি অনায়াসে যাবে জনার্দন। কিছুক্ষণ আমার এখানে অবস্থান কর প্রভু। আমার মনের বাসনা পূরণ কর। অন্তর্যামী শ্রীহরি সব জানলেন। বসুদেব মধ্য যমুনাতে আসা মাত্রই প্রভু ইচ্ছে করেই যমুনাতে পতিত হন। বসুদেব ‘হায় হায়’ করে রোদন করতে লাগল। যমুনার নীলজলে নীলকান্তমণি নিজে ভাসাল। তখনই যমুনার অপরুপ শোভা হল। যমুনা মনোবাঞ্ছা পুরণ হল। বসুদেব বুকে করাঘাত করে আর কান্দে। যে কংসের ভয়ে পুত্রকে নিয়ে যাচ্ছে সে ভয়ই তার পুত্রের ঘটিল। তখন জানার্দন যমুনারে বলে “ আমার পিতা শোকে কাতর হয়েছেন। তাকে আর কষ্ট দেয়া যাবে না। এখন তুমি তোমার বর চাহ।” যমুনা বলে,” প্রভু বর যদি দাও এমন বর দাও, বৃন্দাবনে পরে যত লীলা তোমার হবে, তা যেন হয় প্রভু আমার তীরেতে। আমি প্রাণ ভরে তোমার লীলা দর্শন করব।” যমুনা বাক্য শুনি দেব চক্রপাণি ”তথাস্তু” বলে বর প্রদান করলেন। আর বললেন,” ব্রজপুরে তোমার কাছে থাকব। নিয়তই তুমি আমার দেখা পাবে।” আর এদিকে পুত্রকে না পেয়ে বসুবেদ পাগল প্রায়। “ হায় হায়” করে বিলাপ করতে লাগল। আর পুত্রকে যমুনাা জলে খুঁজতে লাগল। হাঠৎ করে চরণে ঠেকিল। তাড়াতাড়ি পুত্রকে ঝাপিতে লইল। পুত্রকে পেয়ে আনন্দিত বসুদেব পায়ে ধরে মাথায় রেখে পাক খাওয়ালেন। মনে মনে ভাবেন না জানি পুত্র তার কত জল খেয়েছে। আর তা দেখে মনে মনে হাঁসেন ভগবান।
ক্রমে ক্রমে বসুদেব নন্দালয়ে উপস্থিত হলেন। সূতিকা গৃহে প্রবেশ করে যশোদার কোলে শুয়ে আছে কন্যা তনয়। তখন তাঁর পুত্রধনকে তথায় রেখে কন্যা সন্তানকে আপন কোলে তুলে নিলেন। কন্যার প্রতি চেয়ে বসুদেব করেন রোদন। আর বলেন,” আহা মরি এমন রূপ আমি কখনও দেখিনি। এ কন্যাকে কেমন করে কংসের হাতে তুলে দেব। কেন তোরা দুজন মন্ত্রণা করে আমার ঘরে এসেছিস। কারাকাগারে চতুর্ভুজ মুর্তি দর্শন করেছি। এখন এখানে ত্রিনয়না তনয়া দর্শন করছি।” বসুদের অবস্থা দেখে যোগমায় ও বিশ্বপতি হাস্য করেন। হরির বিচিত্র লীলা কে বুঝতে পারে। অবশেষে কন্যা সন্তানকে কোলে তুলে লয়ে সেই নিশাকালে যমুনা পার হয়ে কারাগারে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করা মাত্রই কারাগারের দ্বার বন্ধন হয়ে গেল। যে ভাবে তারা কারাগাবে আবদ্ধ ছিল সেইভাবে আবদ্ধ হয়ে রইল। কন্যা সন্তানকে দেখে দেবকীর মন হরষিত হল। মুখে ঘন ঘন চুম্বন দেন। মুখে স্তন দিতে যায় দেবকী। এমনি কন্যা ছল করে উচ্চম্বরে বোদন করে উঠে। বোদনের শব্দে কারারক্ষিগণ চমকিয়া উঠেন। রোদন শুনে তারা অনুমান করেন দেবকী সন্তান জন্মেছে। কারারক্ষিগণ তাড়াতাড় কংসের কাছে সংবাদ দেয়া দেবকীর সন্তান হয়েছে। ইহা শুনে কংস দ্রুত গতিতে যায় এবং কারারক্ষিদের তাড়াতাড়ি দ্বার খুলার জন্য বলে। কংসরাজ কারাগারে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণ কারাগার মায়ার রূপেতে আচ্ছন্ন ছিল। কংস বলল,” কোথায় তোমার সন্তান? আমাকে দাও। আমি তাকে শিলাতে ফেলে বধ করব। শুনে দেবকী ক্রন্দন করতে করতে বলল,” এই দেখ আমার এবার পুত্রের জন্ম হয়নি হয়েছে রুপবতী কন্যা সন্তান। পূর্বে তুমি একে একে আমার ছয়টি সন্তান হত্যা করেছ। তুমি তাকে বধ করো না। আমাকে মা বলে এ কন্যা সন্তান ডাকবে। তুমি দৈব বাণী স্মরণ কর। আমার পুত্র সন্তান তোমাকে হত্যা করবে। ইহাতে তোমার কোন ভয় নেই।” কিন্তু পাষাণ কংস ভগ্নীনির কোন কথাই কর্ণপাত করল না। কংস বলে,” তোমার কোন কথা শুনিতে চাই না। এক্ষনি তাকে আমি শিলাতে ফেলি হত্যা করব।” এ কথা বলে কংস ভয়ানক ক্রোধে কন্যাকে চরণে ধরে টানাটানি করে। শশীর কিরণের মত শীতল চরণ যার। যে চরণে হয় সূর্য-চন্দ্রের প্রকাশ। যার চরণে পদ্মের সমান আলোর প্রকাশ। যে চরণ পাওয়ার আশায় যোগীগণ যোগ সাধনা করে। সে চরণ নিয়ে পাষণ্ড কংস টানাটানি করে। চরণে ধরে যেই আছার মারতে উদ্যত হল পাষণ্ড কংস ঠিক তখনি জননী তার হাত হতে ফসকে আকাশের দিকে উঠে গেল। আকাশে উপরি মহামায়া অষ্টভূজা রূপ ধারণ করল। দেবগণ পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগল। তাঁর দেহের বরণ ছিল অতসী-পুষ্পের মত। সারা শরীরে ছিল রত্ন-বিভূষণ। আকাশে যেন বিদ্যুৎ বিচ্ছুরিত হলো। আকাশে চেয়ে কংস জননীকে দেখিল। কংসাসুরকে ডেকে মহামায়া বলল,” শোন দুরাত্মা আমার বাণী। ভেবেছিলে আমাকে তুমি বধ করবে। তোকে যে বধ করবে সে জন্মেছে অন্য স্থানে।” এ কথা বলে জগৎমাতা অন্তর্ধান হলেন। মহামায়ার এ কথা শুনার পর কংসের মন ভয়ে ব্যাকুলিত হয়ে উঠে। কংস কহে,” শুনতে পেলে তোমরা।” মন্ত্রীগণ কহে,” শুনেছি আমরা নিজ কর্ণে।” তখন অমাত্যেরা কহে,” মহারাজ বিস্ময় এ জন্ম।” তখন কংস তাড়াতাড়ি করে কারাগারে যায়। মৃদুভাবে বসুদেবকে বলে,” আমার দোষ তুমি ক্ষমা কর। আমি তোমাদের ছয়টি সন্তান হত্যা করেছি। দেবতার মিথ্যা কথা বলে তা আগে জানতাম না। না বুঝে তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।” তারপর বসুদেব ও দেবকীর বন্ধন খুলে দিল। রাজ ভবনে ফিরে এসে মন্ত্রীগণকে বলে,” আমার কথা শুন। পূর্বে আকাশ বাণী হয়েছিল। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু অষ্টম গর্ভে পুত্র সন্তান না হয়ে হয়েছে এক কন্যা সন্তান। তাঁরে বধ করতে শিলাতলে ফেলি দেখি সে বিদ্যুতের আভা সৃষ্টি করে আকাশে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল,” আমাকে যে বধিবে সে নাকি অন্যস্থানে জন্ম নিয়েছে। কার কথা সত্য। কি করব বুঝতে পারছিনা। বল মন্ত্রীগণ কি উপায় হবে।” তখন মন্ত্রীগণ বলেন,” নিবেদন করি মহোদয়, মিথ্যা কথা বলেছে সুরগণ। শত্রু হয়ে আসবে এমন দেবতা তো দেখছি না। দেবতার দেবতা তো শূলপাণি। তিনি তো শ্মশানে পড়িয়া থাকেন ভবানীর সহিত। তিনি আপনাকে কেন বধ করতে আসবেন? সব সময় ধ্যানে মগ্ন থাকেন পদ্মাসন। সৃষ্টির পালন কারণ নিয়ে তিনি শুধু চিন্তা করেন। আপনাকে বধ করতে তিনিও আসবেন না। দেবরাজ ইন্দ্র আপনার থেকে বলবান নয়। অন্য দেবতারা তো তুচ্ছ। কেন অকারণে আপনি ভয় করছেন? কুচক্রী হয় সেই চক্রপাণি। কোথায় সে জন্ম গ্রহণ করেছে তার অন্বেষণ করতে হবে। শুনে কংস মহারাজ কহে,” কিভাবে সে হরি মরে তার যুক্তি তোমরা কর।” তখন তৃণাবর্ত্ত কহে,” মহারাজ সে হরি যজ্ঞাহুতি লয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে। তাই যাগযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। দ্বিজ মুখে সে হরি করে আহারে। তাই বিপ্রকে বিনাশ করতে হবে। দুগ্ধবতী যত গাভী আছে তা বধ করতে হবে। যাতে ক্ষীর সর ননী তৈরী না হয়। তবেই হরি আর খেতে পারবে না। শুনে কংস কহে,” তবে তোমরা সকলেই তাই কর। দৈব বাণী মতে কোথায় শত্রু জন্মিল তা খুঁজে বের কর।” শুনে পুতনা কহে,” এখানে কোথায় শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে। দশ দিনের মধ্যে যত কন্যা জন্ম নিয়েছে তা খুঁজে বের করতে। আর দশ দিন পর যত সন্তান জন্ম গ্রহণ করিবে আমি তাদের বধ করব।” মন্ত্রিগণ সকলই এ মন্ত্রণায় সায় দিলেন। (বিষ্ণুপুরান ও শ্রীমদ্ভাগবত অনুসরনে)
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র