মহাভারত:বনপর্ব-১১৬-১২০

১১৬. যুধিষ্ঠিরাদির শূরসেন বনে অবস্থিতি
মুনি বলে, শুন কথা কহিতে বিস্তর।
এইমত পঞ্চ ভাই সঙ্গে দামোদর।।
শূরসেন নামে বন যমুনার তটে।
উপনীত সর্ব্বজন তাহার নিকটে।।
জল স্থল দেখি সব বিচিত্র কানন।
বিশ্রাম করিতে বসিলেন সর্ব্বজন।।
শ্রীকৃষ্ণ কহেন, রাজা কর অবধান।
বনমধ্যে নাহি আর হেন রম্যস্থান।।
জল স্থল যথাযোগ্য বহু মৃগ পাখী।
ইহাতে আশ্রম কর পরম কৌতুকী।।
নাহিক ইহার চতুর্দ্দিকে রাজচয়।
সুখে থাক হৈয়া হেথা অন্তর নির্ভয়।।
কলিঙ্গ তৈলঙ্গ অঙ্গ বঙ্গ গুজরাট।
কম্বোজ কর্ণাট মদ্র বিভঙ্গ বিরাট।।
অযোধ্যা পাঞ্চাল কাশী কনখল দেশ।
সিদ্ধসেন ‍কাশী ভোজ কাশ্মীর বিশেষ।।
ইত্যাদি অনেক রাজ্য নিকটে আছয়।
কদাচিৎ নাহি ইথে কৌরবের ভয়।।
ইতিমধ্যে বাস কর যেই কোন দেশে।
এই বর্ষ অজ্ঞাতেতে রহ গুপ্তবেশে।।
তদন্তরে রাজ্যে গিয়া হইবে নৃপতি।
আমারে বিদায় কর যাই দ্বারাবতী।।
বিশেষ হইল তব অজ্ঞাত সময়।
এখন জনতা বেশী করা ভাল নয়।।
ধর্ম্ম বলিলেন, কৃষ্ণ কি কহিব আর।
তোমারে একান্ত লাগে পাণ্ডবের ভার।।
সহায় সম্পত্তি সখা বন্ধু মিত্র ভাই।
তোমা বিনা পাণ্ডবের আর কেহ নাই।।
পুনঃ পুনঃ ‍রাখিয়াছ বিষম সঙ্কটে।
অজ্ঞাতে রাখহ কৃষ্ণ দুষ্টের কপটে।।
গোবিন্দ কহেন, রাজা না করিহ ভয়।
যথা তুমি, তথা আমি জানিহ নিশ্চয়।।
যখন যে কার্য্য তব হবে উপস্থিত।
জ্ঞাতমাত্র আসি আমি করিব বিহিত।।
এত বলি যান কৃষ্ণ দ্বারকা নগর।
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে সবে দুঃখিত অন্তর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
১১৭. যুধিষ্ঠিরের পরীক্ষার্থে ধর্ম্মের মায়া-সরোবর
সৃজন ও ভীমের জল অন্বেষণে গমন
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়, কহ অতঃপর।
কি কি কর্ম্ম করিলেন পঞ্চ সহোদর।।
রহস্য শুনহ বলি, কহে মুনিবর।
তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে পঞ্চ সহোদর।।
বৃক্ষতলে বসি রাজা বলেন ভীমেরে।
জল কোথা আছে ভীম আনহ সত্বরে।।
আজ্ঞামাত্র বৃকোদর করেন গমন।
সে বনে না পায় জল করে অন্বেষণ।।
কোথায় পাইব জল চিন্তে মহামতি।
পবননন্দন যায় পবনের গতি।।
কতদূরে দেখে এক কুসুম কানন।
নানাবিধ ফল ফুলে অতি সুশোভন।।
অশোক কিংশুক জাতি টগর মল্লিকা।
চম্পক মাধবী কুরু ঝাঁটি শেফালিকা।।
পলাশ কাঞ্চন ইন্দ্রমণি নানা ফুল।
মধুলোভে উড়ে বসে মত্ত অলিকুল।।
খঞ্জন খঞ্জণী নাচে আপনার সুখে।
ময়ূর ময়ূরী নাচে পরম কৌতুকে।।
তথা হৈতে যায় বীর অতি মনোদুঃখে।
কোথায় পাইব জল, যাব কোন্ মুখে।।
চিন্তাকুল বৃকোদর করিছে গমন।
হেনকালে শুন রাজা অপূর্ব্ব কথন।।
জানিতে পুত্রের ধর্ম্ম, আসি ধর্ম্মরায়।
দিব্য এক সরোবর সৃজেন তথায়।।
আপনি মায়ায় বকপক্ষি রূপ ধরি।
রহিলেন সেই স্থানে ছদ্মবেশ করি।।
পাইয়া জলের তত্ত্ব বীর বৃকোদর।
ত্বরিতে আসেন তথা হরিষ অন্তর।।
জল দেখি তুষ্ট হয়ে পবননন্দন।
পান করিবারে বীর নামিল তখন।।
মায়াপক্ষী বলে, শুন ওহে মতিমান।
সমস্যা পূরণ করি কর জলপান।।
নতুবা তোমার মৃত্যু হবে জলপানে।
সমস্যা পূরণ কর আমার বচনে।।
মহাভারতের কথা সুধা হৈতে সুধা।
কাশীদাস কহে, পানে খন্ডে ভব ক্ষুধা।।
প্রশ্নে-,শ্লোকঃ
‘‘কা চ বার্ত্তা কিমাশ্চর্য্যাং কঃ পন্থাঃ কশ্চ মোদতে
মমৈতাংশ্চতুরঃ প্রশ্নান্ কথয়িত্বা জলং পিব।।’’
অস্যার্থঃ।
কিবা বার্ত্তা, কি আশ্চর্য্য, পথ বলি কারে।
কোন্ জন সুখী হয় এই চরাচরে।।
পাণ্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি।
উত্তর করিয়া তুমি পান কর বারি।।
ক্রোধে ভীম বলে, আগে করি জলপান।
পশ্চাতে করিব তব উত্তর প্রদান।।
তৃষ্ণায় আকুল ভীম, অহঙ্কার মনে।
জলস্পর্শ মাত্র বীর মরে সেইক্ষণে।।
১১৮. ভীমান্বেষণে অর্জ্জুনের গমন
হেথায় চিন্তিত রাজা আশ্রমে বসিয়া।
ধীরে ধীরে কহিলেন অর্জ্জুনে চাহিয়া।।
শুন ভাই ধনঞ্জয় না বুঝি কারণ।
ভীমের বিলম্ব কেন হয় এতক্ষণ।।
শীঘ্রগতি বৃকোদরে কর অন্বেষণ।
বুঝি ভীম কার সনে করিতেছে রণ।।
আজ্ঞামাত্র পার্থবীর উঠিয়া সত্বর।
নিলেন গাণ্ডীব হাতে তূণ পূর্ণ শব।।
প্রণাম করিয়া বীর ধর্ম্মের চরণে।
চলিলেন ধনঞ্জয় ভীম অন্বেষণে।।
ঘোর বনে প্রবেশিয়া পার্থ বীরবর।
চলিলেন দ্রুতগতি নির্ভয় অন্তর।।
বসন্ত সময়, তাহে কোকিল কুহরে।
মকরন্দে অলিকুল সদা কেলি করে।।
কুহু কুহু রবে পিক করিতেছে গান।
স্বচ্ছন্দ গমনে বীর সরোবরে যান।।
কতক্ষণে উত্তরিলা মায়া সরোবরে।
তৃষ্ণার্ত্ত হইয়া যান জলপান তরে।।
হেনকালে বকরূপী কন ধর্ম্মরায়।
প্রশ্ন পূরি জলপান কর ধনঞ্জয়।।
প্রশ্ন না পূরিয়া যদি কর জল পান।
পরশ করিবামাত্র যাবে যমস্থান।।
ধর্ম্মবাক্য ধনঞ্জয় না শুনি শ্রবণে।
আপনার দম্ভে চলিলেন বারি পানে।।
পড়ি আছে বৃকোদর জলের উপর।
দেখি শোক করিলেন মনে বীরবর।।
এই জল হৈতে হৈল ভ্রাতার নিধন।
কোন্ লাজে আমি আর রাখিব জীবন।।
মায়াজল স্পর্শমাত্র বীর ইন্দ্রসুত।
শরীর হইতে তার গের পঞ্চভূত।।
এখানে চিন্তিত অতি রাজা যুধিষ্ঠির।
দোঁহার বিলম্ব দেখি হলেন অস্থির।।
নকুলেরে কহিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
ভীমার্জ্জুন অন্বেষণে যাও শীঘ্রগতি।।
১১৯. ভীমার্জ্জুনের অন্বেষনে নকুলের গমন
নকুলের প্রতি, কহেন ভূপতি,
শুনহ আমার বাণী।
ভাই দুই জন, জলের কারণ,
গেল কোথা নাহি জানি।।
কর অন্বেষণ, গহন কানন,
জল আন শীঘ্রগতি।
দারুণ তৃষ্ণায়, প্রাণ ফাটি যায়,
শুন ভাই মহামতি।।
রাজ আজ্ঞা শুনি, চলিল তখনি,
মাদ্রীর তনয় ধীর।
মহা-সত্ত্বোদয়, নির্ভয় হৃদয়,
মনে মনে ভাবে বীর।।
দেখিতে সুন্দর, সেই ত কানন,
পশু পক্ষী আদি কত।।
দেখিয়া কানন, আনন্দিত মন,
চলিল সত্বরে ধীর।
কতক্ষণ পরে, মায়া সরোবরে,
আসিল নকুল বীর।।
দেখি সরোবর, হরিষ অন্তর,
বিহরে কত বিহঙ্গ।
দেখে লাখে লাখ, হংষ চক্রবাক,
বিরাজে রমণী সঙ্গ।।
নকুল হেরিয়া, ব্যাকুল হইয়া,
চলে সরোবর তীর।
কহে এ সময়, ধর্ম্ম মহাশয়,
শুন হে নকুল বীর।।
প্রশ্নোত্তর দাও, তবে জল খাও,
নহে যাবে যমপুরে।
তৃষ্ণায় আকুল, হইয়া নকুল,
সে কথা অগ্রাহ্য করে।।
জলপান তরে, চলিল সত্বরে,
সেই মায়া সরোবরে।
বিধির ঘটন, কে করে খণ্ডন,
পরশন মাত্র মরে।।
হেথা রাজা বসি, হইল হতাশী,
বিলম্ব দেখিয়া অতি।
দুঃখযুক্ত মন, চিত্ত উচাটন,
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মতি।।
অরণ্যের কথা, সুখ মোক্ষদাতা,
রচিলেন মুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে, মনোহর ছন্দে,
বিরচিল কাশীদাস।।
১২০. ভীম, অর্জ্জুন ও নকুলের
অন্বেষণে সহদেবের গমন
যুধিষ্ঠির রাজা অতি ব্যাকুলিত মনে।
সহদেবে কহিলেন মলিন বদনে।।
আমার বচন ভাই কর অবধান।
তিন জনে না দেখিয়া বাহিরায় প্রাণ।।
অস্থির আমার মন হয় কি কারণে।
কার সনে বনে যুদ্ধ করে তিন জনে।।
যাত সহদেব জল আনহ সত্বরে।
অন্বেষণ কর আর তিন সহোদরে।।
এত শুনি সহদেব চলেন সত্বর।
প্রবেশ করেন গিয়া কানন ভিতর।।
দেখিয়া বনের শোভা হরষিত মন।
চতুর্দ্দিকে দেখে বহু কুসুম-কানন।।
নির্ভয় শরীর বীর করিল গমন।
কত শত শোভা দেখে, কে করে গণন।।
জন্মেজয় রাজা বলে, কহ মুনিবর।
বিস্মিত হইল কিছু আমার অন্তর।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির বুদ্ধির সাগর।
পৃথিবীতে নাহি তাঁর তুল্য কোন নর।।
সসাগরা রাজ্য পালে যেই মহামতি।
বুদ্ধিতে নাহিক সম শুক্র বৃহস্পতি।।
বুদ্ধির সাগর রাজা বুদ্ধি গেল কোথা।
বিশেষ করিয়া মুনি কহ এই কথা।।
সহদেবে জিজ্ঞাসিত যদি নৃপমণি।
সকল কহিত তাঁরে ভবিষ্য-কাহিনী।।
সহদেব স্থানে সব পাইলে সংবাদ।
তবে না হইত ‍মুনি এতেক প্রমাদ।।
মুনি বলে, অবধান কর মহামতি।
দৈব খণ্ডাইতে কারো নাহিক শকতি।।
মায়া করি ধর্ম্ম তাঁর বুদ্ধি নিল হরি।
এজন্য বলিল রাজা, আন গিয়া বারি।।
হেথা সহদেব রাজা, আন গিয়া বারি।।
হেথা সহদেব বীর বনের ভিতর।
মনের আনন্দে যান নির্ভয় অন্তর।।
বনমধ্যে তিন জনে করে অন্বেষণ।
ভ্রমণ করেন বহু গহন কানন।।
ভীমের দেখিল চিহ্ন অরণ্যেতে আছে।
পদাঘাতে গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ করি গেছে।।
চিহ্ন দেখি সেই পথে যান মহাবীর।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল সরোবর তীর।।
সরোবর দৃষ্টিমাত্র মাদ্রীর তনয়।
তৃষ্ণায় আকুল হইল ধর্ম্মের মায়ায়।।
জলপান করিবারে যান সরোবরে।
বকরূপী ধর্ম্মরাজ কহেন তাহারে।।
চারি প্রশ্ন পূরি তবে কর জলপান।
অগ্রে যদি পান কর, যাবে যমস্থান।।
ধর্ম্মবাক্য সহদেব না শুনি শ্রবণে।
তৃষ্ণায় আকুল হয়ে যান বারি পানে।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কেবা খণ্ডিবারে পারে।
পরশ করিবামাত্র সহদেব মরে।।
সুন্দর কমল তুল্য ভাসিতে লাগিল।
হেথা যুধিষ্ঠির মনে চিন্তা উপজিল।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র