মহাভারত:বনপর্ব-০০১-০০৫

১.পাণ্ডবদিগের বনবাস গমনে প্রজাগণের খেদ
জন্মেজয় বলে, কহ শুনি তপোধন।
পূর্ব্ব-পিতামহ কথা অদ্ভূত কথন।।
কিরূপে জিনিয়া তাঁর নিল রাজ্য ধন।
বহু ক্রোধ করাইল বলি কুচবন।।
কলহের পথ কুরু করিল সৃজন।
কহ শুনি কি করিল পিতামহগণ।।
ইন্দ্রের বৈভব সুখ সকল ত্যজিয়া।
কেমনে সহিল দুঃখ বনেতে রহিয়া।।
পতিব্রতা মহাদেবী দ্রুপদ নন্দিনী।
কিরূপে বঞ্চিল বনে কহ শুনি মুনি।।
কি আহার কি বিহার দ্বাদশ বৎসর।
কোন্ কোন্ গেল, কোন্ গিরিবর।।
বৈশম্পায়ন বলেন, শুনহ রাজন।
কপটে সকল নিল রাজা দুর্য্যোধন।।
ক্ষমা বন্ত দয়াবন্ত রাজা যুধিষ্ঠির।
হস্তিনা নগর হৈতে হলেন বাহির।।
নগর উত্তরমুখে চলেন পাণ্ডব।
চতুর্দ্দিকে ধাইল রাজ্যের প্রজা সব।।
যেই মত ছিল যেই ধাইল ত্বরিতে।
পাণ্ডবে বেড়িয়া সবে রহে চতুর্ভিতে।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য সকলের প্রতি।
ধিক্কার ও তিরস্কার করে নানাজাতি।।
ধৃতরাষ্ট্রে ভয় নাহি করে কেহ আর।
ক্রোধে গালিপাড়ে মুখে যা আসে যাহার।।
পাপিষ্ঠ রাজার রাজ্যে কি ছার বসতি।
সবে মেলি যাব মোরা পাণ্ডব সংহতি।।
যে দেশে শকুনি মন্ত্রী, রাজা দুর্য্যোধন।
তথায় বসতি নাহি করে সাধুজন।।
পাপিষ্ঠ হইলে রাজা, প্রজা সুখী নয়।
কুলধর্ম্ম ক্রিয়া তার সব নষ্ট হয়।।
মহাক্রোধী অর্থলোভী মানী কদাচারী।
নির্দ্দয় সুহৃৎ শত্রু মহাপাপকারী।।
হেন দুর্য্যোধন মুখ কভু না দেখিব।
চল সবে পাণ্ডবের সহিত রহিব।।
এত বলি প্রজাগণ কৃতাঞ্জলি করি।
সবিনয়ে বলে ধর্ম্মরাজ বরাবরি।।
আমা সবা ছাড়ি কোথা যাইবে রাজন।
তুমি যথা যাবে তথা যাব সর্ব্বজন।।
তোমায় সর্ব্বস্ব ছলে জিনিল কৌরব।
উদ্বিগ্ন হইয়া হেথা আসি মোরা সব।।
তব হিতে হিত মানি, তব দুঃখে দুঃখী।
তব সুখ হৈলে মোরা সবে হই সুখী।।
আমা সবাকারে নাহি কর নিবারণ।
তোমার সহিত মোরা সবে যাব বন।।
রাজ্যেতে হইল মহাপাপী অধিকারী।
এ কারণে মোরা সব হব বনচারী।।
জল ভূমি বস্ত্র তিল পবন যেমন।
পুষ্প সহবাসে ধরে সুগন্ধ মোহন।।
পাপীর সংসর্গে তেন পাপ বাড়ে নিতি।
পুণ্য বৃদ্ধি হয় পুণ্য জনের সংহতি।।
পুণ্য করিবার শক্তি নাহি মো সবার।
পুণ্যভাগী হব সঙ্গে থাকিলে তোমার।।
বহু পুণ্য করি দুর্য্যোধনের সংহতি।
তথাপি তাহার পাপে নাহি অব্যাহতি।।
রাজ পাপে প্রজাদের নাহিক মুকতি।
যাইব তোমার সঙ্গে, কি হেতু বসতি।।
দরশনে ‍পাপ হয়ে অশনে শয়নে।
ধর্ম্মাচার নষ্ট হয় এ রাজার সনে।।
যেমন সংসর্গ, ফল সেই মত হয়।
তেঁই সে আমরা বনে যাইব নিশ্চয়।।
সমস্ত সদগুণ করে তোমাতে নিবাস।
তেঁই সে আমরা বনে যাইব নিশ্চয়।।
সমস্ত সদগুণ করে তোমাতে নিবাস।
তেঁই তব সহিত থাকিতে করি আশ।।
প্রজাদের হেন বাক্য শুনি যুধিষ্ঠির।
কহিলেন মিষ্টবাক্য কোমল গভীর।।
ভাগ্যবন্ত বলি, মোরে জানিনু এখন।
সে কারণে এত স্নেহ কর সর্ব্বজন।।
আমি যাহা কহি, তাহা অন্য না করিও।
আমার সম্ভ্রম করি সকলে মানিও।।
পিতামহ ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠতাত।
কুন্তী মাতা, ইহারা করেন অশ্রুপাত।।
এই সবাকার শোক কর নিবারণ।
দেশে থাকি সবাকারে করহ পালন।।
যুধিষ্ঠির মুখে শুনি এতেক বচন।
হাহাকার করি নিবর্ত্তিল প্রজাগণ।।
অনগ্নি সাগ্নিক শিষ্য সহ দ্বিজগণ।।
পাণ্ডবের পাছু পাছু চলে সর্ব্বজন।।
সশস্ত্র পাণ্ডবগণ রথ আরোহণে।
প্রজাগণে প্রবোধিয়া চলিলেন বনে।।
উত্তর মুখেতে যান জাহ্নবীর তটে।
রম্যস্থান দেখিয়া রেহেন মহাবটে।।
দিনকর অস্ত গেল প্রবেশে শর্ব্বরী।
সেই রাত্রি নির্ব্বাহিল জলস্পর্শ করি।।
চতুর্দ্দিকে দ্বিজগণ অগ্নিহোত্র জ্বালি।
বেদধ্বনি পুণ্যরবে পূরে বনস্থলী।।
রজনী প্রভাব হৈলে উঠি সর্ব্বজন।
ঘোর বনে করিলেন গমন তখন।।
চতুর্দ্দিকে মুনিগণ চলিল সংহতি।
দেখিয়া বলেন তবে ধর্ম্ম নরপতি।।
রাজ্যহীন ধনহীন হইলাম আমি।
ফলমূলাহারী আমি হই বনগামী।।
আমা সনে বহু দুঃখ পাবে দ্বিজগণ।
বিশেষে বনেতে ভয়ঙ্কর পশুগণ।।
হবে যত ‍দুঃখ শুন তোমা সবাকার।
সে পাপে হইবে নষ্ট মম ধর্ম্মাচার।।
দ্বিজ কষ্টে দুঃখ পায় দেব আদি জন।
মনুষ্য কিসেতে গণি আমা আদি জন।।
নিবর্ত্তিয়া দ্বিজগণ চলহ নগরে।
আমার বিনয় এই তোমা সবাকারে।।
দ্বিজগণ বলে, কোথা যাইব নৃপতি।
তোমার যে গতি আমা সবার সে গতি।।
আমা সবা পোষণেতে ত্যজ ভয় মন।
মোরা আনি ফল মূল করিব ভক্ষণ।।
যুধিষ্ঠির বলে, আমি দেখিব কেমনে।
মম সহ রহি দুঃখ পাবে দ্বিজগণে।।
ধিক্ ধৃতরাষ্ট্র রাজা দুষ্ট পুত্রগণ।
এত বলি অধোমুখে রহেন রাজন।।
শৌনক নামেতে ঋষি বুঝান রাজারে।
বহু নীতি শাস্ত্র বলি বিবিধ প্রকারে।।
শোকস্থান সহস্র, শতেক ভয়স্থান।
তাহাতে মূর্চ্ছিত হয় মূর্খ যে অজ্ঞান।।
পণ্ডিত জনের তাহে নহে মুগ্ধ মন।
তুমি হেন লোক শোক কর কি কারণ।।
ধন উপার্জ্জয়ে লোক বন্ধুর কারণে।
বন্ধুতে রহিল ধন, কি কাজ বিমনে।।
অর্থ হেতু উদ্বেগ ত্যজহ নরপতি।
অনর্থের মূল অর্থ কর অবগতি।।
উপার্জ্জনে যত কষ্ট ততেক পালনে।
ব্যয়ে হয় যত ‍দুঃখ, ক্ষয়েতে দ্বিগুণে।।
অর্থ যার থাকে তার সদা ভীত মন।
তার বৈরী রাজা অগ্নি চোর বন্ধুজন।।
অর্থ হৈতে মোহ হয় অহঙ্কার পাপ।
অত্যন্ত উদ্বেগ হয়, সদা মনস্তাপ।।
এ কারণে অর্থচিন্তা ত্যজহ রাজন।
সর্ব্ব পূর্ণ হলে তৃষ্ণা নহে নিবারণ।।
যাবৎ শরীরে প্রাণ, তৃষ্ণা নাহি টুটে।
সাধুজন এই তৃষ্ণা জ্ঞান অস্ত্রে কাটে।।
সন্তোষ সাধুর অস্ত্র তৃষ্ণা নিবারণ।
ইন্দ্রসম অর্থে তুষ্ট নহে জ্ঞানীজন।।
অনিত্য এ ধন জন অনিত্য সংসার।
ইহার মায়াতে ডুবি ক্লেশমাত্র সার।।
এই সব স্নেহেতে মোহিত যত জন।
অচিন্তিত কোথা দেখিয়াছ হে রাজন।।
ধর্ম্ম করিবারে যদি উপার্জ্জয়ে ধন।
বিচলিত হয় মন ধনের কারণ।।
মহারাজ জান ধন পাপ পঙ্কবৎ।
পঙ্কেতে নামিলে তনু হয় পঙ্কাবৃত।।
নিশ্চয় হইবে দুঃখ সে পঙ্ক ধুইতে।
সাধু সেই, যে নাহি যায় সে পঙ্কেতে।।
ধর্ম্মে যদি প্রয়োজন থাকয়ে রাজন।
এ সকল পাপ তৃষ্ণা করা কি কারণ।।
শৌনক বচন শুনি কহে নরপতি।
মম কিছু তৃষ্ণা নাহি রাজ্য ধন প্রতি।।
বিপ্রের ভরণ হেতু চিন্তা করি মনে।
গৃহাশ্রমে অতিথি না পূজিব কেমনে।।
গৃহাশ্রমী হইয়া বঞ্চিবে যেই জন।
অতিথি যা মাগে তাহা দিবে ততক্ষণ।।
তৃষ্ণার্ত্তকে জল দিবে ক্ষুধিতে ভোজন।
নিদ্রার্থীর শয্যা দিবে শ্রান্তকে আসন।।
অতিথি আসিলে দ্বারে করিবে যতন।
কত দূরে উঠিয়া করিবে সম্ভাষণ।।
যে জন না করে ইহা গৃহস্থ হইয়া।
বৃথা হয় দান যজ্ঞ ধর্ম্ম আদি ক্রিয়া।।
আমি হেন লোক ইথে বাঁচিব কেমনে।
এই হেতু মহাতাপ পাই ‍আমি মনে।।
শৌনক বলিল, রাজা চিন্তা দূর কর।
ধর্ম্মকে শরণ লহ শুন নৃপবর।।
ইন্দ্র চন্দ্র আদিত্য অপর দিকপালে।
ত্রৈলোক্য জনেরে তাঁরা ধর্ম্মবলে পালে।।
তুমিহ করহ রাজা তপ আচরণ।
তপোবলে দ্বিজগণে করহ পালন।।
এত ‍শুনি যুধিষ্ঠির চিন্তিত হৃদয়।
ধৌম্য পুরোহিতে ডাকি কহে সবিনয়।।
দ্বিজগণ চলিলেন আমার সংহতি।
কেমনে ভরণ হবে কহ মহামতি।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া কহে ধৌম্য তপোধন।
ত্যজ ভয় কর রাজা সূর্য্যের সেবন।।
সংসার পালনকর্ত্তা দেব দিবাকর।
সূর্য্যের প্রসাদে কার্য্য হবে নৃপবর।।
এত বলি দীক্ষা দিয়া ধৌম্য তপোধন।
অষ্টোত্তর শত নাম করান শ্রবণ।।
মহাভারতের কথা অতুল ভূতলে।
শুনিলে আশ্রয় লভে কৃষ্ণ পদতলে।।
০২. যুধিষ্ঠিরের সূর্য্য আরাধনা ও বরলাভ
যুধিষ্ঠির মহারাজ সেবেন ভাস্কর।
ব্রতী হয়ে নানাপুষ্পে পূজেন বিস্তর।।
অষ্টোত্তর শতনাম জপেন ভূপতি।
দণ্ডবৎ প্রণমিয়া করে নানা স্তুতি।।
তুমি প্রভু লোকপাল লোকের পালন।
চতুর্দ্দিকে দীপ্ত দীপ তোমার কিরণ।।
অমর কিন্নর নর রাক্ষস মানুষে।
সর্ব্বস্দ্ধি হয় দেব তব কৃপাবশে।।
ইত্যাদি অনেক স্তব করেন রাজন।
আসিলেন তথা মূর্ত্তিমান বিকর্ত্তন।।
বলিলেন, চিন্তা ত্যাজ ধর্ম্মের নন্দন।
সিদ্ধ হবে নরপতি যে তোমার মন।।
এয়োদশ বৎসর যাবৎ রাজ্য হীনে।
যত অন্ন চাহ পাবে মোর বরদানে।।
ফল মূল শাক আদি যে কিছু আনিবে।
অল্পমাত্র রন্ধনেতে অব্যয় হইবে।।
দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা লক্ষ্মী অবতরি।
রন্ধন পাত্র ভাণ্ড সদা থাকিবে ভরি।।
কিন্তু এক বাক্য কহি শুন সর্ব্বজনে।
সকলে সন্তোষ হবে তাহার রন্ধনে।।
তাহার পাকের দ্রব্য অব্যয় হইবে।
যত চাহ তত পাবে কিছু না টুটিবে।।
তাহার প্রমাণ কহি শুন সাবধানে।
আনন্দে সকল লোক থাকিবে কাননে।।
যাবৎ দ্রৌপদী দেবী না করে ভক্ষণ।
শূন্য না হৈবে রন্ধন পাত্র ততক্ষণ।।
নিয়মের কথা এই কহিনু তোমারে।
সকল সম্পূর্ণ দ্রব্য হবে মোর বরে।।
এত বলি অন্তর্হিত হন দিনকর।
হৃষ্ট হয়ে সবারে বলেন নৃপবর।।
এমতে পাইল বর সূর্য্যের সেবনে।
বনে যান ধর্ম্মরাজ সঙ্গে দ্বিজগণে।।
কাম্যক বনেতে প্রবেশিলেন ভূপতি।
ভ্রাতৃ পুরোহিত পুর লোকের সংহতি।।
ভারত পর্ব্বের কথা পাপের বিনাশ।
বনপর্ব্বে যত্নেতে রহিল কাশীদাস।।
০৩. ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক বিদুরের অপমান
ও যুধিষ্ঠিরের নিকটে বিদুরের গমন
বনে চলিলেন পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন। চিন্তাকুল অন্ধরাজ, স্থির নহে মন।। মন্ত্রিরাজ বিদুরে আনিল ডাক দিয়া। জিজ্ঞাসিল ধৃতরাষ্ট্র মধুর বলিয়া।। বিচারে বিদুর তুমি ভার্গবের প্রায়। পরম ধরম বুদ্ধি আছয়ে তোমায়।। কুরুবংশ তোমার বচনে সবে স্থিত। কহ শুনি বিচারিয়া যাতে মম হিত।। অরণ্যেতে গেল পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন। যাহে শ্রেষ্ঠ যুক্তি হয় করহ এখন।। যেমতে আমার বশ হয় সর্ব্বজন। যেরূপে স্বচ্ছন্দে বিহরয়ে পুত্রগণ।। বিদুর বলেন, রাজা কর অবধান। ধর্ম্ম হতে বিজয় হইবে সর্ব্বজন।। নিবৃত্তিতে পাই ধর্ম্ম, ধর্ম্মে সব পাই। ধর্ম্মসেবা কর রাজা, কোন চিন্তা নাই।। তোমার উচিত রাজা এ কর্ম্ম এখন। নিজপুত্র ভ্রাতৃপুত্র করহ পালন।। সে ধর্ম্ম ডুবিল রাজা তোমার সভায়। দুষ্টমতি দুর্য্যোধন শকুনি সহায়।। সত্যশীল যুধিষ্ঠিরে কপটে জিনিল। বিবসনা কুলবধূ সভাতে করিল।। তুমি ত তখন নাহি করিলে বিচার। এবে কি উপায় বলি না দেখি যে আর।। আছে যে উপায় এক যদি কর রায়। সগর্ব্বে সবংশে থাক বলি হে তোমায়।। পাণ্ডবের যত কিছু নিলে রাজ্যধন। শ্রীঘ্রগতি আনি তারে দেহ এইক্ষণ।। দ্রৌপদীরে দুঃশাসন কৈল অপমান। বিনয় করিয়া চাহ ক্ষমা তার স্থান।। কর্ণ দুর্য্যোধন কর পাণ্ডবের প্রীত। এই কর্ম্ম হয় প্রীত দেখি তব হিত।। তুমি কৈলে যদি নাহি মানে দুর্য্যোধন। তবেত তাহারে রাখ করিয়া বন্ধন।। পূর্ব্বে যত বলিলাম করিলে অন্যথা। এখন যে বলি রাজা রাখ এই কথা।। জিজ্ঞাসিলে সেই হেতু কহি এ বিচার। ইহা ভিন্ন অন্য নাই উপায় ইহার।। বিদুর বচন শুনি অন্ধ ডাকি কয়। যতেক কহিলে তাহা কিছু ভাল নয়।। আপনার হিত হেতু চিন্তিলাম নীত। তুমি যত বল, তাহা পান্ডবের হিত।। আপনার মূর্ত্তিভেদ আপন নন্দন। তারে দুঃখ দিব পর পুত্রের কারণ।। এবে জানিলাম তব কুটিল বিচার। তোমারে বিশ্বাস আর নাহিক ‍আমার।। অসতী নারীরে যদি করয়ে পালন। বহুমতে রাখিলে সে না হয় আপন।। পাণ্ডবের হিত তুমি করহ এখন। যাহ বা থাকহ তুমি যাহা লয় মন।। এত শুনি উঠিল বিদুর মহাশয়। ডাকি বলে, কুরুবংশে মজিল নিশ্চয়।। শুন ওহে মহারাজ বচন আমার। অহিত আমারে জ্ঞান হইল তোমার।। পশ্চাতে জানিবে রাজা এ সব বচন। ঠেকিবে যখন দায়ে, জানিবে তখন।। এত বলি শীঘ্র করি বিদুর চলিল। আর দুই এক বাক্য ক্রোধেতে বলিল।। চিত্তে মহাতাপ হেতু না গেল মন্দির। হস্তিনা নগর হৈতে হইল বাহির।। যথা বনে আছে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন। শীঘ্রগতি তথাকারে করিল গমন।। যুধিষ্ঠির ছিল কাম্য কানন ভিতর। মৃগচর্ম্ম পরিধান সঙ্গে সহোদর।। চতুর্দ্দিকে সহস্র সহস্র দ্বিজগণ। ইন্দ্রেরে বেড়িয়া যেন আছে দেবগণ।। কতদূরে বিদুরে দেখিয়া কুরুনাথ। ভ্রাতৃগণে বলে ঐ আইল খুল্লতাত।। কি হেতু বিদুর আইল না বুঝি বিচার। পুনঃ কি বিচার কৈল সুবল কুমার।। পুনঃ কিবা পাশা হেতু দিল পাঠাইয়া। রাজ্য হতে আমি কিছু না আসি লইয়া।। কেবল আয়ুধমাত্র আছয়ে আমার। আয়ুধ জিনিয়া নিতে করেছে বিচার।। পঞ্চ ভাই করিছেন বিচার এমত। হেনকালে উপনীত বিদুরের রথ।। যথাযোগ্য পরস্পর করি সম্ভাষণ। জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির কুশল বচন।। আমরা আইলে বনে অন্ধ কি কহিল। বিদুর কহিল, শুনে যে কথা হইল।। কুরবংশহিত হেতু জিজ্ঞাসেন মোরে। সেই মত সুযুক্তি দিলাম আমি তাঁরে।। যতেক কহিনু আমি সবাকার হিত। অন্ধ রাজা শুনি তাহা বুঝে বিপরীত।। রোগীজনে যথা দিব্য পথ্য নাহি রুচে। যুব নারী বৃদ্ধস্বামী যথাা নাহি ইচ্ছে।। ক্রুদ্ধ হয়ে আমারে বলিল কুবচন। যাহ বা থাকহ তুমি নাহি প্রয়োজন।। সে কারণে তারে ত্যজি আইলাম বন। তোমা সবাকারে বনে করিতে ‍ালন।। ভাল হৈল অন্ধরাজ ত্যজিল আমারে। তোমা সবা সহ বনে রহিব বিহারে।। তবে ত বিদুর বহু করিল সুনীত। যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই লইয়া ত্বরিত।। বনপর্ব্ব অপূর্ব্ব রচিলেন অমৃত। কাশীদাস কহে সাধু, পিয়ে অনুব্রত।। ০৪. ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরের পুনর্মিলন এবং
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ব্যাসদেবের উপদেশ দান
হস্তিনা ত্যজিয়া ক্ষত্তা গেল বনমাঝ। শুনিয়া আকুল চিত্ত হৈল অন্ধরাজ।। নাহি রুচি অন্ন জল অশন শয়ন। অতিবেগে সভামদ্যে করেন গমন।। নিকটেতে গিয়া মূর্চ্ছা হইয়া পড়িল। সঞ্জয় প্রভৃতি সবে ধরিয়া তুলিল।। চেতন পাইয়া বলে সঞ্জয়ের প্রতি। বিদুর আছয়ে কোথা আন শীঘ্রগতি।। পরম ধার্ম্মিক ভাই মম হিতে রত। তাহার বিচ্ছেদে আমি ‍আছি মৃতবত।। কুবচন বলিলাম আমি পাপমুখে। এতক্ষণ প্রাণ সে ত রাখে বা না রাখে।। শীঘ্রগতি যাও নাহি বিলম্ব করহ। বিদরে হৃদয় মম ত্বরিত আনহ।। এত শুনি সঞ্জয় চলিল সেইক্ষণ। যথা বনে আছে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।। যথোচিত পূজা করি সবাকার প্রতি। বিদুরে চাহিয়া তবে বলিছে ভারতী।। শুনহ আমার বাক্য বিদুর সুমতি। হস্তিনা নগরে তুমি চল শীঘ্রগতি।। শীঘ্র চল এইক্ষণে বিলম্ব না সয়। তোমা বিনা অন্ধরাজ জীবন সংশয়।। এত শুনি যুধিষ্ঠির করেন সম্প্রীত। রথে চড়ি দুইজন চলিল ত্বরিত।। বিদুর আইল পুনঃ শুনিল রাজন। শিরেতে চুম্বন করি দিল আলিঙ্গন।। বলিল পূর্ব্বের দোষ ক্ষমহ আমার। এত বলি অনেক করিল পুরষ্কার।। বিদুর বলেন, রাজা হইলাম ক্ষান্ত। আপনি আমার গুরু পরম সম্ভ্রান্ত।। আপনি করিলে ক্ষমা ইহা আমি চাই। আজ্ঞা ‍ছাড়া হতে কভু মম শক্তি নাই।। যেমত আমার পুত্র পাণ্ডব তেমন। কিন্তু এরা দুঃখী মম ইথে পোড়ে মন।। বিদুর আইল শুনি রাজা দুর্য্যোধন। ডাকাইয়া আনাইল কর্ণ দুঃশাসন।। শকুনি সহিত তবে সভায় বসিল। কতক্ষণে দুর্য্যেধন কথা যে কহিল।। অন্ধ ভূপতির মন্ত্রী পাণ্ডবের হিত। বিদুর আইল দেখ মন্ত্রণা পণ্ডিত।। যাবত বিদুর না আকর্ষে তাঁর মন। পাণ্ডবে ‍আনিতে আজ্ঞা না দেন রাজন।। তাবত মন্ত্রণা কর ইহার উপায়। যে মতে কুন্তীর পুত্র আসিতে না পায়।। পুনঃ যদি হস্তিনায় দেখিব পাণ্ডব। নিশ্চিত আমার বাক্য কহি শুন সব।। গরল খাইব কিম্বা প্রবেশিব জলে। নিতান্ত ত্যজিব প্রাণ অস্ত্রে বা অনলে।। শকুনি বলিল, শুন আমার বচন। কদাচিত না আসিবে পাণ্ডুপুত্রগণ।। সত্যবাদী যুধিষ্ঠির করেছে সময়। এয়োদশ বৎসর যাবৎপূর্ণ নয়।। তাবৎ হস্তিনা না আসিবে কদাচন। না শুনিবে তারা ধৃতরাষ্ট্রের বচন।। শুনিয়া বৃদ্ধের বাক্য যদি পুনঃ আইসে। আমরা করিব পুনঃ সেই পণ শেষে।। কর্ণ বলে, মম চিত্তে এই যুক্তি আসে। দুঃখিত পাণ্ডবগণ আছে বনবাসে।। জটা চীর বন ক্লেশ শোকেতে কাতর। সহায় সম্পদগণ আছে যে অন্তর।। চতুরঙ্গ দলে গিয়া বেড়িব পাণ্ডবে। এ সময় মারিলে সকল রিষ্টি যাবে।। দুর্য্যোধন বলে, সাধু মন্ত্রণা তোমার। করিল মন্ত্রণা এক সংসারের সার।। আজ্ঞা দিল নরপতি সাজিতে সবারে। রথ গজ তুরঙ্গম চলিল সত্বরে।। সাজিয়া সকল সৈন্য কৌরব চলিল। অন্তর্য্যামী ব্যাসের সে গোচর হইল।। হস্তিনা নগরে মুনি করেন গমন। পথে দুর্য্যোধন সহ হইল মিলন।। বাহুড়িয়া চল বলি আজ্ঞা দেন মুনি। দুর্য্যোধন বাহুড়িল মুনি বাক্য শুনি।। ধৃতরাষ্ট্র নিকটেতে যান দ্বৈপায়ন। যথোচিত পূজা তাঁর করিল রাজন।। মুনি বলে, ধৃতরাষ্ট্র করিলে কি কর্ম্ম। বৃদ্ধ হইয়া আচর এমত অধর্ম্ম।। মন্দবুদ্ধি তব পুত্র দুষ্ট দুরচারী। রাজ্যলোভে হইল সে পাণ্ডবের বৈরী।। পাণ্ডব সহায় যেই, জান ভাল মতে। বিধাতার ধাতা হর্ত্তা কর্ত্তা ত্রিজগতে।। তাঁরে না চিন্তি না ভাবি নিজ হিত চিত্তে। বনবাসে পাঠাইয়া দিলে পাণ্ডুসুতে।। আপনার হিত যদি চাহ রাজ মনে। পাণ্ডবের নিকটে পাঠাও দুর্য্যোধনে।। একাকী পাণ্ডব সহ ভ্রমুক কাননে। মন্দ চিন্তা না করুক, না হিংসুক মনে।। ইহাতে পাণ্ডব যদি হয় প্রীতিমান। তবে তব শত পুত্রের হৈবে কল্যাণ।। ধৃতরাষ্ট্র বলে, দেব কহিলে উত্তম। আমারে না রুচে যত করিল অধম।। ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর গান্ধারী আদি করি। কাহারও না শুনে বাক্য দুষ্ট দুরাচারী।। দুর্য্যোধন স্নেহ আমি না পারি ছাড়িতে। তেঁই হেন কর্ম্ম করি কালবশ হৈতে।। মুনি বলে, নহে ইহা ধর্ম্মের আচার। এরূপ কর্ম্মেতে নহে আমার বিচার।। পুত্র সম স্নেহ রাজা নাহিক সংসারে। বিশেষ দুর্ব্বল পুত্রে বড় স্নেহ করে।। তুমি যেন মম পুত্র, পাণ্ডুও তেমন। যুধিষ্ঠির যেমন, তেমন দুর্য্যোধন।। পাণ্ডবের বিশেষতঃ বহু স্নেহ হয়। পিতৃহীন সদা পায় দুঃখ অতিশয়।। পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কথা শুনহ রাজন। সুরভি গোমাতা আর সহস্রলোচন।। সুরভি রোদন করে হইয়া বিহ্বল। এস্ত হয়ে তারে জিজ্ঞাসিল আখণ্ডল।। কহ কি কারণে মাতা করহ রোদন। দেবে নরে কিম্বা নাগে আপন ঘটন।। সুরভি কহিল নাই আপদ কাহার। শুন যেই হেতু দুঃখ হইল আমার।। দুর্ব্বল আমার পুত্রে যুড়ি লাঙ্গলেতে। হীনশক্তি রুগ্ন বড় না পারে চলিতে।। মারিছে কৃষক বড় পুচ্ছমূল মোড়ে। আর গুটি বলিষ্ঠ যাইছে উভরড়ে।। তার সঙ্গে শক্তি নাহি যাইতে ইহার। কৃষক পাপিষ্ঠ বড় করিছে প্রহার।। এই হেতু রোদন যে করি নিরন্তর। শুনিয়া উত্তর করিলেন পুরন্দর।। এই হেতু দেবী তুমি করিছ রোদন। কিন্তু দেখ স্থানে স্থানে লক্ষ বৃষগণ।। বৃষকে কৃষকগণ করয়ে প্রহার। তা সবারে স্নেহ কেন না হয় তোমার।। সুরভি বলেন এই অশক্ত দুর্ব্বল। ইহা দেখি চিত্ত মোর হইল বিকল।। এত শুনি দেবরাজ মেঘে আজ্ঞা দিল। জল বৃষ্টি করি সব পৃথিবী পূরিল।। কৃষক ত্যজিল কৃষি করিল গমন। সুরভি বলেন সাধু সহস্রলোচন।। এইমত পালন করহ সবাকারে। বনবাসে হইল দুর্ব্বল কলেবরে।। শুন রাজা পূর্ব্বে হেন হয়েছে বিধান। তবে ধর্ম্ম রহে সব দেখিলে সমান।। যদি ধর্ম্ম চাহ, রাখ আমার বচন। পাণ্ডবেরে সমভাবে করহ পালন।। ০৫. মৈত্রেয় মুনির আগমন ও
দুর্য্যোধনকে অভিশাপ প্রদান
ধৃতরাষ্ট্র বলে, মুনি করি নিবেদন। মোরে যদি স্নেহ হয়, শুন তপোধন।। আপনি বুঝাও দুষ্টমতি দুর্য্যোধনে। ব্যাস বলে, আমি না কহিব কদাচনে।। এইক্ষণে আসিবে মৈত্রেয় তপোধন। সকল কহিবে হিত শুনহ রাজন।। তব হিত তিনি বুঝাইবেন আপনি। তাঁরে প্রীত না করিলে শাপ দিবে মুনি।। এত বলি ব্যাস চলিলেন নিজালয়। উপনীত হইল মৈত্রেয় মহাশয়।। যথোচিত পূজা তাঁর ধৃতরাষ্ট্র কৈল। সুস্থ হয়ে বসিয়া কুশল জিজ্ঞাসিল।। ঋষি বলে, বহু তীর্থ করিনু ভ্রমণ। দেখিনু কাম্যক বনে পাণ্ডু-পুত্রগণ।। জটা চীর বিভূষিত ভক্ষ্য ফলমূল। তপস্বীর বেশ, সঙ্গে তপস্বী বহুল।। তথায় শুনিনু এই সব সমাচার। তব পুত্র দুর্য্যোধন কৈল কদাচার।। এই হেতু শীঘ্র আইলাম হেথাকারে। কুরুবংশ হেতু কিছু বুঝাব তোমারে।। ভীষ্ম আর তুমি কুরুবংশের প্রধান। হেন কর্ম্ম কেন হয় তোমা বিদ্যমান।। কুরুবংশে সদাকাল স্বধর্ম্ম সুকৃতি। হেন বংশে অপযশ করিল দুর্ম্মতি।। এই হেতু সভা তব না শোভে রাজন। এত বলি কহে মুনি চাহি দুর্য্যোধন।। মূর্খ নহ দুর্য্যোধন বড় কুলে জন্ম। তবে কেন হেনরূপ করিলে অধর্ম্ম।। পাণ্ডবের হিংসা কর হইয়া অজ্ঞান। না জানহ সখা যার পুরুষ প্রধান।। কহ শুনি কিসে হীন পাণ্ডুপুত্রগণে। ধনে জনে কর্ম্মে সবে বিজয়ী ভুবনে।। অযুত কুঞ্জর বল ধরে ভীমনাথ। হিড়িম্বক- বধ আদি করিল নিপাত।। কির্ম্মীরে মারিল ভীম পশিতে কাননে। ইন্দ্রে পরাজয় কৈল খাণ্ডব দাহনে।। হে জন সহ তুমি করহ বিরস। মম ‍বাক্যে কর প্রীতি নহে মৃত্যুবশ।। মুনির এতেক কথা শুনি কুরুনাথ। অভিমানে ঊরুদেশে করে করাঘাত।। মৌনেতে থাকিয়া ভূমি করে নিরীক্ষণ। উত্তর না পেয়ে ক্রোধে কহে তপোধন।। অরে দুষ্ট মম বাক্য করিলি হেলন। ইহার উচিত ফল শুনহ রাজন।। যে ঊরুতে অভিমানে কৈলি করাঘাত। ইথে গদা মারি ভীম করিবে নিপাত।। শুনিয়া ব্যাকুল হল অন্ধ নরপতি। মুনির চরণ ধরি করিল মিনতি।। আজ্ঞা কর মুনিরাজ, নহুক এমন। সদয় হইয়া তবে বলে তপোধন।। এয়োদশ বৎসরান্তে তব পুত্রগণ। রাজ্য দিয়া ভজে যদি ধর্ম্মের নন্দন।। তবে হেন নহিবেক, শুনহ রাজন। না করিলে মম বাক্য নহিবে লঙ্ঘন।। তবে ধৃতরাষ্ট্র হৈল মলিন বদন। জিজ্ঞাসিল কহ শুনি কির্ম্মীর নিধন।। কিরূপে পাণ্ডুর সুত মারিল কির্ম্মীরে। কোথায় বসতি তার কত বল ধরে।। মুনি বলে, আমি আর না বসি হেথায়। দুর্য্যোধন সুধী নহে আমার কথায়।। শুনিবারে ইচ্ছা যদি আছয়ে তোমার। বিদুরে জিজ্ঞাস পাবে সব সমাচার।। এত বলি মহামুনি করিল গমন। বিদুরে জিজ্ঞাসে তবে অম্বিকা নন্দন।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র