মহাভারত:সভাপর্ব-০২৬-০৩০

২৬. শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপা দর্শনে সকলের মূর্চ্ছা
তবে জন্মেজয় রাজা মুনিরে পুছিল।
কহ শুনি অনন্তর কি প্রসঙ্গ হৈল।।
মুনি বলে,শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
বিভীষণ সহ বসিলেন নারায়ণ।।
পথশ্রম হয়েছিল পদব্রজে চলি।
চতুর্দ্দিকে বিশেষে লোকের ঠেলাঠেলি।।
চৌদিকে অযুত ক্রোশ সভা-পরিসর।
ভ্রমিয়া দোঁহার শ্রম হৈল কলেবর।।
সিংহাসন উপরে বসিল দুইজন।
হেনকালে উপনীত মাদ্রীর নন্দন।।
গোবিন্দে দেখিয়া বীর কৈল নমস্কার।
তারে ডাকি কৃষ্ণ জিজ্ঞাসেন সমাচার।।
দুই তিন দিন নাহি রাজ-সম্ভাষণ।
কহ দেখি সহদেব সব বিবরণ।।
সহদেব বলে, শুন দেব দামোদর।
তুমি গেলে আসিলেন যতেক অমর।।
সকলের হইয়াছে রাজ-দরশন।
তব পদ দেখিবারে আছে সর্ব্বজন।।
দেববৃন্দ লইয়া আছয়ে দেবরাজ।
তুমি গেলে ভেটিবেক দেবের সমাজ।।
এত শুনি উঠিলেন শ্রীবৎস-লাঞ্ছন।
তাঁহার সহিত গেল নিকষা-নন্দন।।
সভামধ্যে প্রবেশের দেব নারায়ণ।
গোবিন্দেরে নিরখিয়া উঠে সর্ব্বজন।।
মণ্ডলী করিয়াছিল বেদীর উপরে।
কৃষ্ণে দৃষ্টিমাত্র সবে পড়ে বায়ুভরে।।
কত দূরে পড়ি গেল করি কৃতাঞ্জলি।
মহা-বাতাঘাতে যেন পড়িল কদলী।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব আর অপ্সর কিন্নর।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি রক্ষ খগবর।।
একজন বিনা আর যে ছিল যখায়।
কত দূরে পড়ি সবে হৈল নম্রকায়।।
শতেক সোপান উঠেন নারায়ণ।
বিশ্বরূপ প্রকাশেন দেব জনার্দ্দন।।
যে রূপ দেখিয়া মুগ্ধ হৈল পদ্মাসন।।
সহস্র মস্তকে শোভে সহস্র নয়ন।
সহস্র মুকুট মণি কিরীট-ভূষণ।।
সহস্র শ্রবণে শোভে সহস্র কুণ্ডল।
সহস্র নয়নে রবি সহস্র মণ্ডল।।
বিবিধ আয়ুধ শোভে সহস্রেক করে।
সহস্র চরণে শোভা কত শশধরে।।
সহস্র সহস্র যেন সূর্য্যের উদয়।
শ্রীবৎস-কৌস্তুভমণি-শোভিত হৃদয়।।
গলে দোলে আজানুলম্বিত বনমালা।
পীতাম্বর শোভে যেন মেঘেতে চপলা।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম আর শার্ঙ্গ ধনু।
নানাবর্ন মণিময় বিভূষিত তনু।।
সহস্র সহস্র শম্ভু আছে করযোড়ে।
কত শত মুখে তারা স্তুতি বাণী পড়ে।।
সহস্র সহস্র চক্ষু বুকে দিয়া হাত।
সহস্র সহস্র অংশু করে প্রণিপাত।।
বিশ্বরূপ বিশ্বপতি দেখি দেবগণ।
চকিত হইয়া সবে হৈল অচেতন।।
অন্তরীক্ষে থাকি ধাতা বিশ্বরূপ দেখি।
নিমিষে চাহিয়া মুদিলেন অষ্ট আঁখি।।
অজ্ঞান হইয়া ধাতা আপনা পাসরে।
করযোড় করি শেষে পড়ে কত দূরে।।
লুকায়ে ছিলেন শিব যোগীরূপে হৈয়ে।
চরণে পড়িল বিশ্বরূপ নিরখিয়ে।।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ হুতাশন।
চন্দ্র সূর্য্য খগ নাগ গ্রহ রাশিগণ।।
যেই যথা ছিল সব গেল ধরা পড়ি।
অচেতন হৈয়ে সবে যায় গড়াগড়ি।।
সকলে পড়িল যদি করি প্রণিপাত।
যুধিষ্ঠিরে চাহি কন দেব জগন্নাথ।।
করযোড় করি বলে দেব ভগবান।
পূর্ব্বভিতে মহারাজ কর অবধান।।
কমণ্ডলু জপমালা যায় গড়াগড়ি।
পড়িয়াছে চতুর্ম্মুখ অষ্টভুজ যড়ি।।
তাঁহার পশ্চাতে দেখ প্রজাপতি গণ।
কর্দ্দম কশ্যপ দক্ষ আদি যত জন।।
ব্রহ্মার দক্ষিণে দেখ যোগী মহাবেশ।
ত্রিলোচন পঞ্চানন প্রণমে মহেশ।।
কার্ত্তিক গনেশ দেখ তাহার পশ্চাৎ।
স্তুতি করি নমে তোমা, ধন্য তুমি তাত।।
সহস্র নয়নে বহে ধারা অগণন।
হের দেখ প্রণমিছে সহস্র-লোচন।।
দ্বাদশ আদিত্য আর দেব শশধর।
কুব্জ বুধ আর গুরু শুক্র শনৈশ্চর।।
রাহু কেতু অগ্নি তারা বসু অষ্ট জন।
মেঘ বার তিথি যোগ ঋষি পক্ষগণ।।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি রাজ-ঋষিগণ।
প্রণাম করিছে সবে তোমার চরণ।।
যাম্যভিতে মহারাজ কর অবগতি।
প্রণাম করিছে পড়ি মৃত্যু-অধিপতি।।
পশ্চিমেতে অবধান কর নৃপবর।
করযোড়ে পড়িয়াছে জলের ঈশ্বর।।
সিন্ধুগণ সহ দেখ যত নদ-নদী।
যতেক দানব দৈত্য অমর-বিবাদী।।
হের দেখ মহারাজ সহস্র-সোদর।
সহস্র মস্তক ধরে শেষ বিষধর।।
প্রণাম করিছে তোমা ভূমিতলে পড়ি।
ধূলিতে সহস্র শির যায় গড়াগড়ি।।
উত্তরেতে মহারাজ কর অবধান।
প্রণাম করিছে তোমা যক্ষের প্রধান।।
গন্ধর্ব্ব ধবল অশ্ব দিয়া চারিশত।
ওই দেখ প্রণমিছে রাজা চিত্ররথ।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ অপ্সরী অপ্সর।
গড়াগড়ি যায় দেখ ভূমির উপর।।
তার বামভাগে দেখ রাক্ষসের শ্রেষ্ঠ।
শ্রীরামের মিত্র হয় রাবণ-কণিষ্ঠ।।
হের অবধান কর কুন্তীর কোঙর।
ছয় সহোদর দেখ খগের ঈশ্বর।।
ভীষ্ম দ্রোণ দেখ ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠতাত।
উগ্রসেন যজ্ঞসেন শল্য মদ্রনাথ।।
বসুদেব বাসুদেব আদি যত জন।
তব পদে প্রণাম করিছে সর্ব্বজন।।
পৃথিবীতে নাহি রাজা তোমার তুলনা।
কে করিতে পারে তব গুণের বর্ণনা।।
ব্রহ্মাণ্ড পূরিল রাজা তব কীর্ত্তি যশ।
তব গুণে মহারাজ হইলাম বশ।।
কৃষ্ণের বচন শুনি রাজা যুধিষ্ঠির।
ভয়েতে আকুল হয়ে কম্পিত শরীর।।
নয়ন-যুগলে পড়ে, শতধারা নীর।
মুহুমুহু অচেতন হয় পাণ্ডুবীর।।
ধৈর্য্য ধরি বলেন রাজা গদগদ-বচন।
আকিঞ্চন জনে প্রভু এত কি কারণ।।
তোমার চরণে মম অসংখ্য প্রণাম।
অবধানে নিবেদন শুন ঘনশ্যাম।।
তড়িত-জড়িত পীত কৌষবাস সাজে।
শ্রীবৎস-কৌস্তুভ-বিভূষিত অঙ্গ মাঝে।।
শ্রবণে পরশে চক্ষু পুণ্ডরীক-পাত।
বিষ্ণু বিশ্বরূপ প্রভু সর্ব্বলোক-নাথ।।
সংসারে আছেন যত পুণ্য-আত্মজন।
সতত বন্দয়ে প্রভু তোমার চরণ।।
তব পদ সবাকার বন্দিবারে আশা।
আকাঙ্কায় মাগিবারে না করি ভরসা।।
যদি বর দিবা, এই করি নিবেদন।
অনুক্ষণ বন্দি যেন তোমার চরণ।।
এ সব অনিত্য যেন বাদিয়ার বাজি।
তোমার বিষম মায়া কিবা শক্তি বুঝি।।
গোবিন্দ বলেন, রাজ সবে ক্ষম তুমি।
ভক্তিমূলে তোমাতে বিক্রীত আছি আমি।।
আমার নিয়মে বর্ত্তে, ভকত আমাতে।
সেইজন মুক্তি লভে এই সংসারেতে।।
ব্রহ্মা-আদি দেবরাজ সম নহে তার।
প্রত্যক্ষ দেখহ যত চরণে তোমার।।
তব তুল্য প্রিয় মম নাহিক ভুবনে।
আমিও প্রণাম করি ভক্তের চরণে।।
এত বলি জগন্নাথে পড়িয়া ধরণী।
করপুটে কহিলেন কত স্তুতি বাণী।।
মোহিলেন মায়বশে পুনঃ নারায়ণ।
যতেক দেখিল সবে হৈল পাসরণ।।
মাতুল-নন্দন হেন দেখিয়া অচ্যুতে।
সহদেব কৈল আজ্ঞা বলহ উঠিতে।।
সহদেব ডাকি বলে, উঠ নারায়ণ।
আজ্ঞা হৈল নিবেদন কর প্রয়োজন।।
আজ্ঞা পেয়ে গোবিন্দ উঠেন ততক্ষণ।
বুকে হাত দিয়া কৃষ্ণ কহেন বচন।।
বহুদিন হৈল আছে দেব খগনাথ।
আজ্ঞা হৈলে যায় সবে লৈয়ে যজ্ঞভাগ।।
ভারত-মণ্ডলে বৈসে যত নরপতি।
বহুদিন হৈল সবে দ্বারে করে স্থিতি।।
বিদায় হইয়া গেলে যত দেবগণ।
রাজগণ আসি তবে করিবে দর্শন।।
ইতিমধ্যে অবিলম্বে যাক নিজ দেশ।
বিদায় করহ শীঘ্র নাগরাজ শেষ।।
যজ্ঞস্থানে নাগরাজ আছে সাত দিন।
সপ্ত দিন হৈল সখা অন্নজল-হীন।।
না জানি না বুঝি নাগ কৈল অবিচার।
সখার উপরে দিল ধরণীর ভার।।
এতেক কহেন যদি দেব জগৎপতি।
লজ্জায় মলিনমুখ শেষ-অধিপতি।।
তবে অনুমতি কৈল ধর্ম্মের নন্দন।
যার যেই ভাগে লৈয়া গেলা দেবগণ।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
যাহার শ্রবণে হয় পাপের সংহার।।
২৭. রাজগণের যজ্ঞ-সভায় প্রবেশ
ধর্ম্মরাজ আজ্ঞা তবে কৈল ততক্ষণ।
চারিদ্বারে আছয়ে যতেক রাজগণ।।
সভামধ্যে সবাকারে আইসহ লৈয়া।
যত রত্ন ভাণ্ডারেতে সব সমর্পিয়া।।
আজ্ঞামাত্র আইলেন যত রাজগণ।
ধর্ম্মরাজে প্রণমিয়া রহে সর্ব্বজন।।
বসিবারে আজ্ঞা কৈল ধর্ম্মের নন্দন।
যথাযোগ্য স্থানে তবে বসে সর্ব্বজন।।
পৃথিবীর রাজগণ বসিল যখন।
ইন্দ্র-সভা হৈতে শোভা হইল তখন।।
নারদ দেখিয়া সভা হৃদয়ে ভাবিয়া।
কহিলেন ব্যাসদেবে একান্তে বসিয়া।।
যতেক দেখহ বসিয়াছে রাজগণ।
নিজে নিজে যুদ্ধ করি হইবে নিধন।।
অল্পদিনে খণ্ডিবেক পৃথিবীর ভার।
পরস্পর মারি সবে সবে হইবে সংহার।।
নারদের মুখে এত শুনিয়া বচন।
বিস্ময় মানিয়া চিত্তে চিন্তে তপোধন।।
হইবে অদ্ভুত হেন বিচারিল মনে।
দুই জন বিনা না জানিল অন্য জনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
২৮. শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দা
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
সুধারস রাজসূয়-যজ্ঞের কথন।।
যুধিষ্ঠির সমাপন করিলেন যাগ।
তুষ্ট করিলেন দিয়া যার যেই ভাগ।।
সাক্ষাতে লইল পূজা দেব পিতৃ ভূপে।
ব্রাহ্মণে দক্ষিণা দিতে কহিলেন কৃপে।।
ব্রাহ্মণেরে দিতে কৃপাচার্য্য কৃপাবান।
যতেক দক্ষিণা দিল নাহি পরিমাণ।।
যে রাজ্যে হইতে আসে যত দ্বিজগণ।
সে রাজ্যের রাজা এনেছিল যত ধন।।
তাহার দ্বিগুণ করি দক্ষিণা যে দিল।
আনন্দেতে দ্বিজগণ দেশেতে চলিল।।
এক দ্বিজ করি দক্ষিণা যে দিল।
আনন্দেতে দ্বিজগণ দেশেতে চলিল।।
এক দ্বিজ দুই চারি লইয়া রাখাল।
দেশেতে চালায়ে দিল গবী বৎসপাল।।
কেহ অশ্ব গজপৃষ্ঠে কেহ চড়ি রথে।
রত্নের শকট চালাইয়া দিল সাথে।।
দক্ষিণা পাইয়া দেশে গেল দ্বিজগণ।
ধর্ম্মপুত্রে চাহি ভীষ্ম বলেন বচন।।
বহুদূর হইতে আইল রাজগণে।
বৎসর হইল পূর্ণ তোমার ভবনে।।
সবাকারে পূজা কর বিবিধ বিধানে।
যজ্ঞ পূর্ণ হৈল সবে যাউক ভবনে।।
যথাযোগ্য জানি রাজা পূজ ক্রমে ক্রমে।
শ্রেষ্ঠ জন জানি আগে পূজহ প্রথমে।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির ভীষ্মের বচন।
ভাল বলি সহদেবে করেন স্মরণ।।
আজ্ঞামাত্র সহদেব তখনি আইল।
অর্ঘ্যপাত্র করে লৈয়ে সম্মুখে দাঁড়াল।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন কহ পিতামহ।
কাহাকে পূজিব আগে শ্রেষ্ঠ কেবা কহ।।
ভীষ্ম বলে বৃষ্ণিবংশে বিষ্ণু-অবতার।
উদ্দেশে মহেন্দ্র-আদি পূজা করে যাঁর।।
সর্ব্বাগ্রেতে অর্ঘ্য দেহ চরণে তাঁহার।
তারাগণ মধ্যে যেন চন্দ্রের আকার।।
ভকতবৎসল তিনি কৃপা-অবতার।
তাঁর অগ্রে অর্ঘ্য পায় হেন নাহি আর।।
তবে অর্ঘ্য দেহ বীর রাজগণ শিরে।
এত শুনি আনন্দিত সহদেব বীরে।।
অর্ঘ্য দিয়া গোবিন্দ-চরণ পূজা করে।
হৃষ্টচিত্ত হৈয়ে কৃষ্ণ লইলেন করে।।
কৃষ্ণে পূজি আনন্দিত পাণ্ডুপুত্রগণ।
সহিতে নারিল দমঘোষের নন্দন।।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত দিল ঢালি।
ভীষ্ম আদি সবাকারে ক্রোধে পাড়ে গালি।।
রাজসূয়-যজ্ঞ পূর্ণ কৈল কুরুবর।
দেখিয়া কৃষ্ণের পূজা চেদির ঈশ্বর।।
ক্রোধেতে অবশ অঙ্গ বলে বার বার।
ওহে ভীষ্ম এ তোমার কিমত বিচার।।
সভাতে আছেন রাজা রাজার কুমার।
পৃথিবীর যত রাজা দ্বারেতে তোমার।।
এ সব থাকিতে পূজ্য বৃষ্ণি-কৃলোদ্ভব।
সহজে বালক বুদ্ধি কি জানে পাণ্ডব।।
রাজসূয়-যজ্ঞ আগে পূজিবেক রাজা।
কোন্ রাজপুত্র কৃষ্ণ তারে কৈলা পূজা।।
কোন্ রূপে পূজাযোগ্য হয় দামোদর।
কহ শুনি ওহে ভীষ্ম সভার ভিতর।।
বড় দেখি পূজা যদি চাহ করিবারে।
দ্রুপদেরে ছাড়ি কেন পূজহ ইহারে।।
বিশেষ আছেন বসুদেব মহামতি।
পিতা স্থিতে পুত্রে পূজা কহ কোন্ রীতি।।
যদি বা পূজিবে ইথে আচার্য্যের ক্রমে।
দ্রোণে ত্যজি কৃষ্ণে কেন পূজিলে প্রথমে।।
ঋষিশ্রেষ্ঠ পূজিতে চাহ যদি রাজন।
গোপালে পূজহ কেন ত্যজি দ্বৈপায়ন।।
রাজক্রমে পূজিবারে চাহ নরবর।
দুর্য্যোধনে ত্যজি কেন পূজ নারায়ণ।।
প্রিয়শিষ্য শ্রীরামের কর্ণ মহাবীর।
ভুজবলে শাসিল নৃপতি পৃথিবীর।।
অশ্বত্থামা কৃপ শল্য ভীষ্মক নৃপতি।
আমা আদি করি রাজা আছে মহামতি।।
গণিলে কাহার মধ্যে এই গোপালেরে।
কি বুঝিয়া অর্ঘ্য দিলে সভার ভিতরে।।
প্রিয়বন্ধু বলি যদি কৃষ্ণে কৈলে পূজা।
তবে কেন নিমন্ত্রি আনিলে সর্ব্ব রাজা।।
ক্ষত্রিয় মধ্যেতে এই পৃথিবী ভিতরে।
এমন অমান্য কেহ কভু নাহি করে।।
অর্থ-গর্ব্বে ভুজ-গর্ব্বে কৈলে হেন বাসি।
ভয়ে কিম্বা লোভে মোরা কেহ নাহি আসি।।
ধর্ম্মবাঞ্ছা করিয়াছে ধর্ম্মের নন্দন।
ধর্ম্মকার্য্য হেতু মো সবার আগমন।।
নিমন্ত্রিয়া আনি শেষে কর অপমান।
এই হৈতে ধর্ম্ম তব হৈল সমাধান।।
হে গোপাল তব মুখে নাহি দেখি লাজ।
কেমনে লইলে অর্ঘ্য এ সবার মাঝ।।
এ সভায় তব পূজা হৈল বড় শোভা।
নপুংসক জনের হইল যেন বিভা।।
অন্ধ-স্থানে অন্ধ যেন জিজ্ঞাসয়ে পথ।
সভামাঝে তব পূজা হৈল সেই মত।।
দুষ্ট ভীষ্ম, দুষ্ট কৃষ্ণ, দুষ্ট এ রাজন।
দুষ্টের সভায় নাহি রহি কদাচন।।
যেই ছার সভায় সুজনে অপমান।
ক্ষণমাত্র তথায় না রহে জ্ঞানবান।।
এত বলি উঠিয়া চলিল শিশুপাল।
সঙ্গেতে চলিল দুষ্ট কতেক ভূপাল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
২৯. শিশুপালের প্রতি যুধিষ্ঠির
ও ভীষ্মের ‍বাক্য
শীঘ্রগতি যুধিষ্ঠির ত্যজি সিংহাসন।
শিশুপাল প্রতি কহে মধুর বচন।।
এ কর্ম্ম তোমার যোগ্য নহে চেদীশ্বর।
যজ্ঞ হৈতে লয়ে যাও সব নৃপবর।।
কি কারণে নিন্দা কর গঙ্গার নন্দনে।
আপনি দেখহ বড় বড় রাজগণে।।
কৃষ্ণের পূজায় কারো নাহি অপমান।
মুনিগণ আদি সবে আনন্দ-বিধান।।
পিতামহ জানেন যে গোবিন্দের তত্ত্ব।
প্রথমে পূজিয়া তাঁরে রাখেন মহত্ত্ব।।
ভীষ্ম বলিছেন, শুন ধর্ম্ম গুণাধার।
মান্যযোগ্য নহে দমঘোষের কুমার।।
কৃষ্ণপূজা করিবারে নিন্দে যেই জন।
সে জনারে মান্য না করিও কদাচন।।
দুষ্টবুদ্ধি শিশুপাল অল্প তার জ্ঞান।
রাজগণ মধ্যে না লিখিবা তার নাম।।
পূজা করে কৃষ্ণপদ ত্রৈলোক্য অবধি।
আমি কিসে গণ্য, যাঁরে পূজা করে বিধি।।
বহু বহু জ্ঞানী বৃদ্ধলোক-মুখে শুনি।
কৃষ্ণের মহিমা নাহি জানে পদ্মযোনি।।
জন্ম হৈতে কৃষ্ণের মহিমা অগোচর।
আমি কি বলিব সব খ্যাত চরাচর।।
পূর্ব্বে সাধুজন সব করিয়াছে পূজা।
পৃথিবীর রাজমধ্যে শ্রেষ্ঠ এই রাজা।।
বিপ্রমধ্যে পূজা পায় জ্ঞানী বৃদ্ধগণ।
ক্ষত্রমধ্যে বলবানে করি যে পূজন।।
বৈশ্যমধ্যে পূজা আগে বহু ধান্য ধনে।
শূদ্রমধ্যে পূজা পায় বয়োধিক জনে।।
যত ক্ষত্রগণ আছে সভার ভিতরে।
কোন্ জন জ্ঞাত নহে দেব দামোদরে।।
কোন্ রূপে কৃষ্ণ ন্যূন এ সভার মাঝ।
কুলে বলে কৃষ্ণ তুল্য আছে কোন্ রাজ।।
দান যজ্ঞ ধর্ম্ম আর কীর্ত্তি সম্পদেতে।
সংসারের যত গুণ আছয়ে কৃষ্ণেতে।।
সংসারের যত কর্ম্ম যে জন করয়।
গোবিন্দেরে সমর্পিলে সর্ব্ব সিদ্ধ হয়।।
প্রকৃতি অব্যক্ত কৃষ্ণ আদি সনাতন।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে আছে সেই জন।।
আকাশ পৃথিবী তেজ সলিল মরুত।
সংসারে যতেক সব কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত।।
অল্পবুদ্ধি শিশুপাল কিছু নাহি জানে।
কৃষ্ণপূজা নিন্দা করে তাহার কারণে।।
এতেক বলেন যদি গঙ্গার নন্দন।
সহদেব বলিতে লাগিল ততক্ষণ।।
অপ্রমেয়-পরাক্রম যেই নারায়ণ।
হেন প্রভু পূজিবারে নিন্দে যেই জন।।
তাহার মস্তকে আমি বাম পদ দিয়া।
এ সভার মধ্যে তেঁই বলিব ডাকিয়া।।
রাজনীতি-বুদ্ধিবলে অধিক কে আছে।
কৃষ্ণ হৈতে এ সবার মধ্যে সবে পাছে।।
এতেক বলিল যদি মাদ্রীর নন্দন।
ঘৃত দিলে প্রজ্জ্বলিত যেন হুতাশন।।
শিশুপাল আদি করি যত নৃপগণ।
ক্রোধভরে গর্জ্জিয়া উঠিল ততক্ষণ।।
যজ্ঞ নাশ কর আর মারহ পাণ্ডব।
বৃষ্ণিবংশ মার আর মারহ মাধব।।
এত বলি রাজগণ মহা কোলাহলে।
প্রলয় সময়ে যেন সমুদ্র উথলে।।
রাজগণ-আড়ম্বর দেখি ধর্ম্মরায়।
ভীষ্মেরে বলেন কহ ইহার উপায়।।
রাজার সমুদ্র এই ক্রোধে উথলিল।
না দেখি কুশল বুঝি অনর্থ ঘটিল।।
ইহার বিধান আজ্ঞা কর মহাশয়।
রাজগণ রক্ষা পায় যজ্ঞ পূর্ণ হয়।।
ভীষ্ম বলিলেন, রাজা না করিহ ভয়।
প্রথমে কহেছি আমি ইহার উপায়।।
গোবিন্দেরে আরাধনা করে যেই জনে।
তাহার কাহারে ভয় এ তিন ভুবনে।।
এই সব ক্রুদ্ধ যত দেখ রাজগণ।
শৃগালের সম দেখে দেবকী-নন্দন।।
যতক্ষণ সিংহ নিদ্রা হৈতে নাহি উঠে।
গর্জ্জয়ে শৃগালগণ তাহার নিকটে।।
যতক্ষণ গোবিন্দ না করে অবধান।
ততক্ষণ গর্জ্জিবেক এ সব অজ্ঞান।।
শিশুপালের বুদ্ধিতে গর্জ্জে যত জন।
তাহারা যাইবে শীঘ্র যমের সদন।।
অগ্নি দেখি পতঙ্গ বিক্রম যত করে।
ক্ষণমাত্রে ভস্ম হয় পরশি অগ্নিরে।।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি যাঁহার স্বভাব।
মূঢ় শিশুপাল কিছু না জানে সে ভাব।।
ভীষ্মের বচন শুনি দমঘোষ-সুত।
কটু বাক্যে নিন্দা করি বলিল বহুত।।
বৃদ্ধ হৈলি নাহি লজ্জা কুলাঙ্গার ওরে।
বিভীষিকা প্রাণভয় দেখাও সবারে।।
বৃদ্ধ হৈলে প্রায় লোক মহিচ্ছন্ন হয়।
ধর্ম্মচ্যুত কথা তাই কহ দুরাশয়।।
কুরুগণ-মধ্যে তোমা দেখি এই মত।
অন্ধ যেন অন্ধ স্থানে জিজ্ঞাসয়ে পথ।।
কৃষ্ণের বড়াই নাহি কর বহুতর।
তাহার মহিমা যত কার আগোচর।।
তার আগে কহি, নাহি জানে যেই জন।
নারী পূতনায় দুষ্ট করিল নিধন।।
কাষ্ঠের শকটখান দিল ফেলাইয়া।
পুরাতন দুই বৃক্ষ ফেলিল ভাঙ্গিয়া।।
বৃষ অশ্ব মারিয়া হইল অহঙ্কার।
ইন্দ্রজাল করি কংসে করিল সংহার।।
সপ্ত দিন গোবর্দ্ধন ধরিল বলয়।
এ সব তোমার চিত্তে মোর চিত্তে নয়।।
বল্মীকের ছত্র প্রায় লাগে মোর মনে।
বড় বলি কহে যত মূঢ় গোপগণে।।
সাধুজন সঙ্গে তোর নাহিক মিলন।
শুন আমি কহি যে কহিল সাধুজন।।
স্ত্রীলোক গো দ্বিজ আর অন্ন খাই যার।
এত জনে কদাচিৎ না করি প্রহার।।
স্ত্রীলোক পূতনা মারে, বৃষ মারে মাঠে।
কংসেরে মারিল যার অর্দ্ধ অন্ন পেটে।।
মাতুলহন্তা স্ত্রীঘাতী পাপী দুরাচার।
হেন জনে কর স্তুতি আরে কুলাঙ্গার।।
তোর কর্ম্মে পাণ্ডবের বড় হৈল তাপ।
ধর্ম্মচ্যুত হৈলি তুই দুষ্টমতি পাপ।।
আপনারে ধর্ম্মজ্ঞ বলিস্ লোকমাঝ।
ইহার যতেক কর্ম্ম শুন সর্ব্বরাজ।।
কাশীরাজ-কন্যা অম্বা শাল্বে বরেছিল।
এই দুষ্ট গিয়া তারে হরিয়া আনিল।।
বার্ত্তা জানি পুনঃ তারে করিল বর্জ্জন।
শাল্বরাজা শুনি তারে না কৈল গ্রহণ।।
তবে কন্যা প্রবেশিল অনল ভিতরে।
স্ত্রী বধিয়া মহাপাপী খ্যাত চরাচরে।।
আরে ভীষ্ম তোর ভাই স্বধর্ম্মেতে ছিল।
সুপথে বিচিত্রবীর্য্য জন্ম গোঁয়াইল।।
সে মরিল নিজ ভার্য্যা দিয়া অন্য জনে।
তুমি দুরাচর জন্মইলে পুত্রগণে।।
ব্রহ্মাচারী আপনারে বলাইস্ লোকে।
হেন ব্রহ্মচর্য্য করে বহু নপুংসকে।।
কোন রূপে তব শ্রেয় নাহি দেখি আমি।
দান যজ্ঞ ব্রহ ব্যর্থ কর অধোগামী।।
বেদপাঠ ধ্যান ব্রহ যোগযোগ দান।
ইহা সবে নাহি হয় অপত্য সমান।।
সর্ব্বদোষ কুলাঙ্গার আছে তোর স্থান।
অনপত্য বৃদ্ধ তোর কুপথ বিধান।।
পূর্ব্বে শুনিয়াছি আমি হংস-বিবরণ।
তাহার সদৃশ ভীষ্ম তোর আচরণ।।
হংস-যূথ মধ্যে এক বৃদ্ধ হংস থাকে।
ধর্ম্ম কর পুণ্য কর বলে সর্ব্বলোকে।।
অহর্নিশি হংসগণে ধর্ম্মকথা কয়।
ধার্ম্মিক জানিয়া সবে তার বাক্য লয়।।
হংসগণ যায় যদি আহার কারণে।
সবে কিছু কিছু আনে তাহার ভোজনে।।
আপন আপন ডিম্ব রাখিয়া তথায়।
বিশ্বাস করিয়া সবে চরিয়া বেড়ায়।।
ক্রমে ক্রমে ডিম্ব সব করিল ভক্ষণ।
দেখি শোকাকুল হৈল সব কংসগণ।।
এক হংস বুদ্ধিমন্ত তাহাতে আছিল।
বৃদ্ধ হংস ডিম্ব খায় প্রকারে জানিল।।
ক্রোধে সব হংস তারে করিল নিধন।
সেই হংস মত ভীষ্ম তব আচরণ।।
বৃদ্ধ হংসে হংস যথা করিল নিধন।
সেরূপে মারিবে তোরে যত রাজগণ।।
আরে ভীষ্ম জ্ঞানহারা হৈলি বৃদ্ধকালে।
যে গোপজাতির নিন্দা করয়ে সকলে।।
বৃদ্ধ হৈয়ে তারে তুই করিস্ স্তবন।
ধিক্ ক্ষত্র ভীষ্ম নাম ধর অকারণ।।
জরাসন্ধ রাজা চিল রাজচক্রবর্ত্তী।
কদাচিত না যুঝিল ইহার সংহতি।।
গোপজাতি বলি ঘৃণা কৈল নরবর।
তার ভয়ে রয়েছিল সমুদ্র-ভিতর।।
দেশের বাহিরে যেন শৃগাল-প্রকৃতি।
কপটে মারিল জরাসন্ধ নৃপবরে।
দ্বিজরূপে গেল দুষ্ট পুরীর ভিতরে।।
ইহার জাতির আমি না পাই নির্নয়।
কভু ক্ষত্র কভু গোপ কভু দ্বিজ হয়।।
কহ ভীষ্ম এই যদি দেব জগৎপতি।
তবে কেন ক্ষণে ক্ষণে হয় নানাজাতি।।
এই সে আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে মনে।
ধর্ম্মহীন অসম্ভব কথা বল কেনে।।
দুর্দ্দেব হইবে, যার তুমি বুদ্ধিদাতা।
তব বুদ্ধি-দোষে রাজসূয় হৈল বৃথা।।
শিশুপাল ভীষ্মে কটু বলিল অপার।
শুনি ক্রোধে জ্বলিলেন পবন কুমার।।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ দন্ত কটমটি।
সর্ব্বাঙ্গ ঘামিল ক্রোধে ললাটে ভ্রুকুটি।।
রক্তমুখ বিকৃতি অধরে দন্তচাপে।
সিংহাসন হৈতে বীর উঠে এক লাফে।।
যুগান্তের যম যেন সংহারিতে সৃষ্টি।
শিশুপাল উপরে ধাইল ক্রোধদৃষ্টি।।
দুই হস্ত ধরে তার গঙ্গার নন্দন।
কার্ত্তিকে ধরিল যেন দেব ত্রিলোচন।।
বহু বহু মিষ্টভাষে ভীমে নিবারিল।
সমুদ্র-তরঙ্গ যেন কূলে লুকাইল।।
না পারিল ভীম, হস্ত করিতে মোচন।
জলে নিবারিল য্নে দীপ্ত হুতাশন।।
দুষ্ট শিশুপাল তবে অল্পজ্ঞান করি।
ক্ষুদ্র মৃগ দেখি যেন হাসয়ে কেশরী।।
ডাকি বলে, আরেরে রহিলি কি কারণ।
হস্ত ছাড় ভীষ্ম কেন কর নিবারণ।।
কৌতুক দেখুক যত নৃপতি সকলে।
পতঙ্গের মত যেন দহিব অনলে।।
ভীমে নিবারিয়া কহে গঙ্গার নন্দন।
এই শিশুপালের শুনহ বিবরণ।।
৩০. ভীষ্ম কর্ত্তৃক শিশুপালের জন্ম-বৃত্তান্ত
কথন ও শিশুপালের ক্রোধ
চেদিরাজ-গৃহে জন্ম হইল যখন।
চারি গোটা হস্ত আর হৈল ত্রিলোচন।।
জন্মমাত্রে ডাকিলেক গর্দ্ধভের প্রায়।
বিপরীত দেখি কম্প লাগে বাপ মায়।।
জাতমাত্র ত্যজিবারে কৈল তারা মন।
আচম্বিতে শুনে শূন্যে আসুরী-বচন।।
শ্রীমন্ত বলিষ্ঠ এই হইবে নন্দন।
না করিহ ভয়, কর ইহারে পালন।।
বিপরীত দেখি যদি চিন্তা কর মনে।
ইহার কারণ কিছু শুন সাবধানে।।
দুই ভুজ চক্ষু যাবে পরশনে যার।
সেই জন এই শিশু করিবে সংহার।।
চতুর্ভুজ হয়েছিল চেদীর নন্দন।
রাজ্যে রাজ্যে শুনিল যতেক রাজগণ।।
আশ্চর্য্য শুনিয়া সবে যায় দেখিবারে।
দশ বিশ রাজা নিত্য যায় তার পুরে।।
সবাকারে দমঘোষ করয়ে অর্চ্চন।
সবাকার কোলে দেয় আপন নন্দন।।
তবে কত দিনে শুনি হেন বিবরণ।
দেখিতে গেলেন তথা রাম নারায়ণ।।
গোবিন্দের পিতৃষ্বসা ইহার জননী।
তার গৃহে উপস্থিত রাম যদুমণি।।
দিখি পিতৃষ্বসা করে বহু সমাদর।
হৃষ্টচিত্তে ভুঞ্জাইল দুই সহোদর।।
স্নেহেতে বালক লৈয়ে দিল কৃষ্ণকোলে।
দুই হস্ত খসি পড়ে অমনি ভুতলে।।
কপালের নয়ন কপালে লুকাইল।
দেখিয়া ইহার মাতা সশঙ্কা হইল।।
করযোড় করি বলে দেব দামোদরে।
এক বর মাগি বাপু আজ্ঞা কর মোরে।।
তুমি ভয় ভাঙ্গিলে যে দেহ হয় স্থির।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মাতা না ভাবিও মনে।
কোন বর আজ্ঞা কর দিব এইক্ষণে।।
মহাদেবী বলে মোরে এই বর দিবা।
এ পুত্রের অপরাধ শত যে ক্ষমিবা।।
বহু অপরাধ এই করিবে তোমার।
মোরে দেখি অপরাধ ক্ষমিবা ইহার।।
কৃষ্ণ বলে, না লঙ্ঘিব বচন তোমার।
শত অপরাধ আমি ক্ষমিব ইহার।।
অবশ্য ক্ষমিব দোষ একশত ইহার।।
অবশ্য ক্ষমিব দোষ একশত বার।
তোমার অগ্রেতে মাতা করি অঙ্গীকার।।
পূর্ব্বে হইয়াছে এই রূপেতে নির্ব্বন্ধ।
মূঢ় শিশুপাল দুই চক্ষু স্থিতে অন্ধ।।
তোমারে ডাকিছে দুষ্ট যুদ্ধের কারণ।
তব কর্ম্ম নহে ইহা কুন্তীর নন্দন।।
শ্রীকৃষ্ণের অংশ কিছু আছয়ে ইহায়।
সে কারণে ইহা সহ যুদ্ধ না যুয়ায়।।
হেন জন কেবা আছে সংসার ভিতরে।
কাহার শকতি মোরে গালি দিতে পারে।।
কু-বচন বলিল যে এই কুলাঙ্গারে।
হীনবীর্য্য হৈলে সেহ নারে সহিবারে।।
বিষ্ণু অংশ লইবারে চাহে নারায়ণ।
তোর যত গালি সহি তাহার কারণ।।
ভীষ্মের এতেক বাক্য শুনি চেদীশ্বর।
হাস্য পরিহাস্য করি বলয়ে উত্তর।।
ভাল হৈল শত্রু মোর নন্দের নন্দন।
তোর এত স্তুতি তারে কিসের কারণ।।
লোকের বর্ণনা যথা করে ভ্ট্টগণ।
এত যদি কর তুমি পরের স্তবন।।
যত স্তুতি কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।
অন্য জনে কৈলে বর পেতে এতক্ষণে।।
বাহ্লীক রাজার যদি করিতে স্তবন।
যত স্তুতি কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।।
অন্য জনে কৈলে তুমি নন্দের নন্দনে।
অন্য জনে কৈলে বর পেতে এতক্ষণে।।
বাহ্লীক রাজার যদি করিতে স্তবন।
মনোমত বর তবে পাইতে এক্ষণ।।
মহাদাতা কর্ণবীর বিখ্যাত সংসারে।
জরাসন্ধ রাজা যারে হারিলা সমরে।।
শ্রবণে কুণ্ডল যার দেবের নির্ম্মাণ।
অভেদ্য কবচ অঙ্গে সূর্য্য-দীপ্তিমান।।
অঙ্গ-রাজ্যেশ্বর সেই দানে অকাতর।
কর্ণে স্তুতি করিলে যে পেতে ভাল বর।।
দ্রোণ দ্রৌণি পিতা পুত্র বিখ্যাত সংসারে।
মুহূর্ত্তেকে ভূমণ্ডল পারে জিনিবারে।।
রাজগণ মধ্যে দুর্য্যোধন মহাবল।
সাগরান্ত পৃথিবী যাহার করতল।।
ভগদত্ত জয়দ্রথ ভীষ্মক দ্রুপদ।
রুক্মী দন্তবক্র মৎস্য কলিঙ্গ কামদ।।
বৃষসেন বিন্দ অনুবিন্দ কৃপাচার্য্য।
এ সবার স্তুতি কৈলে হৈত বড় কার্য্য।।
ধিক্ ধিক্ বুদ্ধি তব কি বলিব আর।
ভূলিঙ্গ পক্ষীর সম চরিত্র তোমার।।
ভূলিঙ্গ বলিয়া পক্ষী হিমাদ্রিতে থাকে।
তাহার সংবাদ শুনিয়াচি লোকমুখে।।
সব পক্ষিগণে সেই উপদেশ কয়।
সাহসিক কর্ম্ম ভাই কভু ভাল নয়।।
সাহসিক কর্ম্মে ভাই দুঃখ হয় পাছে।
মোর কথা নয় ইহা শাস্ত্রে হেন আছে।।
হেনরূপ পক্ষিগণে কহে অনুক্ষণ।
তাহার যে কর্ম্ম তাহা শুন সর্ব্বজন।।
আহার করিয়া সিংহ থাকয়ে শুইয়া।
ভূলিঙ্গ থাকয়ে তার নিকটে বসিয়া।।
কতক্ষণে হাই উঠে সিংহের মুখেতে।
ভক্ষ্য-মাংস লাগি থাকে তাহার দন্তেতে।।
অতি শীঘ্র সেই মাংস কাড়ি লৈয়ে খায়।
নিজকর্ম্ম এইরূপ অন্যেরে শিখায়।।
সিংহের কৃপাতে রহে ভূলিঙ্গ-জীবন।
ইঙ্গিতে মারিতে পারে যদি করে মন।।
সেইমত রাজগণ ক্ষমিছে তোমারে।
ক্রোধ কৈলে তখনি পাঠাত যমঘরে।।
অসহ্য এই কটুবাক্য শুনি ভীষ্মবীর।
কহেন কম্পিত অঙ্গ হইয়া অস্থির।।
আরে মূর্খ দুরাচার শুন ক্রূরমন।
কৃষ্ণে স্তুতি করি হেন বলিলি বচন।।
চতুর্ব্বেদ চতুর্ম্মুখ সীমা নাহি পায়।
পঞ্চমুখে ভোলানাথ যার গুণ গায়।।
সহস্র বদনে শেষ যারে করে স্তুতি।
চরাচরে আর যত বৈসে মহামতি।।
যাহার জিহ্বাতে নাহি কৃষ্ণ গুণগান।
সংসারেতে পাপতনু ধরে অকারণ।।
ক্ষুদ্র যে মনুষ্য আমি হই অল্পমতি।
আমি কি করিতে পারি কৃষ্ণ-গুণ স্তুতি।।
আরে পাপ বলিলি ক্ষমিছে রাজগণ।
সে কারণে রহিয়াছে তোমার জীবন।।
এ সভার মধ্যে যত দেখি রাজগণ।
তৃণবৎ হেন আমি করি যে গণন।।
এ প্রকার বলিলেন গঙ্গার নন্দন।
ক্রোধেতে নৃপতি সব করিছে গর্জ্জন।।
সাধু রাজগণ শুনি হইল হরষ।
দুষ্ট রাজগণ সব বলয়ে কর্কশ।।
গর্ব্বিত দুর্ম্মতি এই ভীষ্ম পাপাচার।
পশুর মতন এরে করহ সংহার।।
কেহ বলে ইচ্ছামৃত্যু অহঙ্কার ধরে।
বান্ধিয়া অনলে লৈয়ে পোড়াও ইহারে।।
হাসিয়া বলেন ভীষ্ম, শুন রাজগণ।
মুখেতে গর্জ্জন কর সব অকারণ।।
পদ দিয়া কহি আমি সবাকার শিরে।
যার মৃত্যু ইচ্ছা আছে আইস সমরে।।
কেবল না ডাকি রণে দৈবকী-নন্দন।
সমরে ডাকুক যার নিকট মরণ।।
গোবিন্দের অংশ আছে শিশুপাল-দেহে।
সেই অংশ শ্রীগোবিন্দ যাবত না লহে।।
তাবৎ পর্য্যন্ত সবে হয়ে থাক স্থির।
পশ্চাতে পাঠাব সব যমের মন্দির।।
ভীষ্মের বচনে ক্রুদ্ধ হয়ে শিশুপাল।
ক্রোধে ডাক দিয়া বলে আরেরে গোপাল।।
তোর সহ বিনাশিব পাণ্ডুর নন্দনে।
তোরে পূজা কৈল কেন ত্যজি রাজগণে।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র