শ্রীমদ্ভগবতগীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

শ্রী ভগবান বললেন- যিনি কর্মফলের আশা না করে নিত্য নৈমিত্তিক কর্তব্য কাজের অনুষ্ঠান করেন তিনিই সন্ন্যাসী এবং তিনিই যোগী। তাকে কখনও নিরগ্নি বা নিষ্ক্রিয় করা যেতে পারে না। হে পান্ডুপুত্র! পন্ডিতগণ যাকে সন্ন্যাস বলে স্থির করেছেন তাহাই যোগ। কেননা সংকল্প ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না। যে মুনি যোগারূঢ় হতে ইচ্ছুক, তার পক্ষে কর্মানুষ্ঠাই উৎকৃষ্ট সাধন। আর যিনি ইতোমধ্যেই যোগারূঢ় হয়েছেন তাঁর পক্ষে কর্মসন্ন্যাই (কর্মত্যাগ) পরম সাধন। যখন মানুষ সকল সংকল্প বিষয় পরিত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং কর্মসমূহের (সকাম কর্ম) প্রতি আসক্তি রহিত হন, তখন তাকে যোগারূঢ় বলা হয়।
মানুষের কর্তব্য তার বিবেকযুক্ত মন দ্বারা নিজেকে জড় জগতের সংসার বন্ধন হতে উদ্ধার করা, আত্মাকে কখনও অধ:পতিত করা উচিৎ নয়। কেননা আত্মাই আত্মার সুহৃৎ, আত্মাই আত্মার শত্রু। যে আত্মা আত্মাকে জয় করেছে অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সকল আত্মার বশীভূত হয়েছে, সেই আত্মার আত্মাই বন্ধু; আর যে আত্মার ইন্দ্রিয় বশীভূত নয়, সেই আত্মাই আত্মার পরম শক্র। শীত, উষ্ণ, সুখ, দু:খ, মান ও অপমান সমান জ্ঞান করে যে আত্মা জিতাত্মা ও প্রশান্ত হয়েছেন, সেই আত্মাতেই পরমাত্মা সমাহিত অর্থাৎ নিশ্চলভাবে বিরাজিত থাকেন।
যার চিত্ত জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিতৃপ্ত, যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ও জিতেন্দ্রিয় এবং মৃৎখন্ড, শিলা ও সুবর্ণে যাঁর সমান জ্ঞান, সেই যোগী পুরুষই যোগারূঢ় বলে কথিত হন। যিনি সুহৃদ, মিত্র, অরি, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য,বন্ধু, সাধু, অসাধু ও অন্যান্য সকল প্রাণিকেসমজ্ঞান করেন, তিনিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যোগারুঢ় ব্যক্তি নিরন্তর একাকী নির্জন স্থানে থেকে দেহ ও অন্ত:করণের সংযম এবং আশা ও পরিগ্রহ রহিত হয়ে চিত্তকে সমাহিত করবেন। কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন ও বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সে আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করবেন। সেখানে আসনে বসে চিত্ত, ইন্দ্রি ও ক্রিয়া সংযমপূর্বক মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন। যোগাভ্যাসকারী ব্যক্তি শরীর, মস্তক গ্রীবা সমান ও অচলভাবে রেখে স্থিরতার সহিত অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দর্শন করবে। তারপর প্রশান্তাত্মা, ভয়বর্জিত ও ব্রহ্মচর্যশীল, নিগৃহীতমনা:, মদগতচিত্ত ও মৎপরাণ হয়ে যোগাভ্যাসী পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে সমাধিতে অবস্থান করবেন। এভাবে সংযতচিত্ত যোগাভ্যাসী পুরুষ সর্বদা মন নিরোধ করে নির্বাণরূপ পরশ শান্তি লাভ করে থাকেন।
হে অর্জুন! যে ব্যক্তি অধিক ভোজনকারী বা নিতান্ত অনাহারী, যে ব্যক্তি অধিক নিদ্রালু বা অধিক নিদ্রাভ্যাসী সে ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়। যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, প্রণব জপাদিতে যাঁর চেষ্টা নিয়মিত, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দু:খের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন। যখন চিত্ত বা মন আত্মাতে স্থিত হয়, কোন বিষয়েই যখন স্পৃহা থাকে না তখনই যোগী যোগসিদ্ধ হয়েছেন বলে বলা হয়। বায়ুবিহীন স্থানে দীপশিখা যেমন প্রকম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগী ব্যক্তির চিত্তও তদ্রুপ অবিচলিত থাকে। যে অবস্থায় যোগাভ্যাসের দ্বারা চিত্ত নিরুদ্ধ হয়ে উপশম প্রাপ্ত হয়, যে অবস্থায় বিশুদ্ধ অন্ত:করণ দ্বারা আত্মাকেই অবলোকন করে আত্মাতে পরিতৃপ্ত হয় (ইহাই যোগ)। যে অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অতীত ও কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য অত্যন্ত সুখের অনুভব করেন এবং যে অবস্থায় স্থিত হলে যোগী আত্মস্বরূপভাব হতে কিছুতেই বিচলিত হন না। যে অবস্থা লাভ করে যোগী অন্য কোন লাভকে অধিক বলে বোধ করেন না এবং এ অবস্থায় অবস্থিত হলে কোন দু:খেই বিচলিত হন না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দু:খ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরুপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহেকে সর্ব বিষয় হতে নিবৃত্ত করে যোগ অভ্যাস করা কর্তব্য। ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং মনকে আত্মাতে নিহিত করে আর অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়। স্বভাবগত কারণে মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়ে সে সে বিষয় হতে যত্নপূর্বক চিত্তকে নিবৃত্ত করে আত্মাতেই বশীভূত করে রাখতে হবে। যখন যোগী রজস্তমোগুণাদি প্রশমিত, প্রশান্ত চিত্ত, ব্রহ্মত্বপ্রাপ্ত হন তখন তিনি পরম সুখ লাভ করে থাকেন। এভাবেই আত্মসংযমী যোগী নিজ মনকে সর্বদা বশীভূত করে অনায়াসে ব্রহ্মরূপ অবিচ্ছিন্ন সুখ অনুভব করেন। এভাবেই নিষ্পাপ যোগী নিজ মনকে সর্বদা বশীভূত করে অনায়াসে অবিচ্ছিন্ন সুখ আস্বাদন করেন।
সর্বত্র সমদর্শী যোগযুক্তত্মা ( যোগ নিরত পরুষ) পুরুষ সর্বভূতে আত্মাকে এবং আত্মাতে সর্বভূত দর্শন করেন। যিনি সর্ব প্রপঞ্চ মধ্যে আমাকে দর্শন করেন এবং আমার মধ্যে সমস্ত প্রপঞ্চকে দর্শন করেন, আমি কখনও তার দৃষ্টির আড়াল হইনা এবং সেও আমার দৃষ্টির আড়াল হয় না। যে যোগী পুরুষ সর্বভূতস্থিত আমাকে আপনার সহিত অভিন্নরূপে জেনে বা জ্ঞান করেন, সে যোগী পুরুষ যে কোন প্রকারে যে অবস্থায় থাকুন না কেন, তিনি আমাতেই অভেদ স্বরূপে অবস্থান করেন। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি নিজের সুখ ও দু:খকে অন্যের সুখ ও দু:খের ন্যায় মনে করেন আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
অর্জুন বললেন- হে মধুসূধন! তুমি সর্বাবস্থায় সমদর্শনরূপ যে যোগতত্ত্ব উপদেশ করলে, মন যেরূপ চঞ্চল তাতে আমি দীর্ঘকাল এর স্থায়ী স্থিতি লক্ষ্য করছি না। হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই সেই মনকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি। ভগবান বললেন- হে মহাবাহো! মন যে দুর্নিগ্রহ ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে নিগৃহীত করা যায়। অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে এরূপ যোগ দুষ্প্রাপ্য (আত্ম-উপলদ্ধি)। কিন্তু যার মন যত্নশীল ও যার চিত্ত বশীভূত হয়েছে তিনিই সদুপায় দ্বারা সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। সেটিই আমার অভিমত।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যিনি শ্রদ্ধাপূর্বক যোগ সাধনে প্রবৃত্ত হয়েও যোগ সাধনে বিশেষ যত্নশীল হননি অথবা চিত্ত চাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়েছেন, সেই যোগীর কি প্রকার গতি হবে? হে মহাবাহো! তত্ত্বজ্ঞানবিমূঢ় এবং কর্ম ও যোগ উভয় হতেই ভ্রষ্ট ব্যক্তি কি আশ্রয়হীন হয়ে ছিন্ন মেঘের মত বিনষ্ট হয়ে যাবে? হে কৃষ্ণ! আমার এ সংশয় কেবল তুমিই সর্বতোভাবে দূর করতে সমর্থ, কেন না তুমি ভিন্ন আমার এ সংশয় আর কেহই ছেদন করতে পারবে না। পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে বা পরলোকে বিনষ্ট হন না। হে তাত! শাস্ত্রবিহিতকার্য্যের অনুষ্ঠানকারী কোন ব্যক্তির কোন দূর্গিত হয় না। যোগভ্রষ্ট পুরুষ পূণ্যকারীদের প্রাপ্য লোকসমূহ লাভ করে বহুকাল সেখানে বাস করে তারপর পৃথিবীতে পবিত্র শ্রীমন্তের(ধনবানদের) গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ যোগনিষ্ঠ জ্ঞানবান বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এরূপ জন্ম এ জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ। হে কুরুনন্দন! যোগভ্রষ্ট পুরুষ জন্মগ্রহণ করে তাঁর পূর্বদেহের সংস্কারানুরূপ বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে মুক্তির নিমিত্ত অধিকতর যত্নশীল হন। যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি যত্ন না করলেও পূর্বজন্মজাত সংস্কারবশত: তার প্রবৃত্তি হয়ে থাকে। তিনি আত্মজ্ঞানের জিজ্ঞাসু হলেও বেদোক্ত কর্মফলের অপেক্ষা অধিকতর ফল লাভ করে থাকেন। যে যোগী পুরুষ পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিক যত্ন করে নিষ্পাপ হয়ে জন্মজন্মান্তরীয় পূণ্যফলে ঐরূপ জন্ম গ্রহণ করেন এবং সাধনপরিপাকদ্বারা মুক্তি লাভ করেন। তত্ত্ববেত্তা যোগী তপস্বিগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কর্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। এ আমার অভিমত। সুতরাং হে অর্জুন! তুমি যোগী হও। যোগীগণের মধ্যে যিনি মদগতচিত্ত হয়ে কেবলমাত্র আমার আরাধনা করেন, তিনিই সকল যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এটিই আমার অভিমত।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র