মহাভারত:ঐষিকপর্ব-০০১-০০৩

০১. পঞ্চপুত্রের মৃত্যু শ্রবণে যুধিষ্ঠিরাদির খেদ
জন্মে বলিলেন কহ তপোধন।
ধৃষ্টদ্যুন্নে বধি গের দ্রোণের নন্দন।।
শুনিয়া কি করিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
বিস্তারিয়া সেই কথা কহ তপোধন।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের তনয়।
সর্ব্ব সৈন্য বধি গেল রজনী সময়।।
শোকাবেশে রজনী হইল সুপ্রভাত।
ডাকে কাক কোকিল উদয় দীননাথ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সারথি আছিল নিশাকালে।
জীবন রাখিয়াছিল মড়ার মিশালে।।
প্রলয় মানিয়া মনে পাইল তরাস।
দেখিল নিভৃতে রহি সকল বিনাশ।।
রবির প্রকাশে নিশা প্রসন্ন দেখিয়া।
যুধিষ্ঠিরে বার্ত্তা দিতে চলিল ধাইয়।।
আছে বা না আছে ধর্ম্ম মনের ভাবনা।
উরুতে চাপড় মারে রোদন বিমনা।।
কান্দিতে কান্দিতে গেল যথা ধর্ম্মরাজ।
উপনীত হইয়া কহিছে সভামাঝ।।
অবধান কর রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
নিশাকালে বধি গেল সব সেনাগণ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি করি যত বীর ছিল।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সহিত মারিল।।
নিশাতে আসিয়া দুষ্ট দ্রোণের নন্দন।
অকস্মাৎ শিবিরেতে করিল গমন।।
নিদ্রায় কাতর ছিল যত সেনাগণ।
একে একে মারিলেক নাহি একজন।।
মৃত সঙ্গে ছিনু আমি করিয়া প্রকার।
বার্ত্তা দিতে আসিয়াছি অগ্রেতে তোমার।।
শুনিয়া করেন খেদ ধর্ম্মের নন্দন।
সকলি করিল নষ্ট দ্রৌণি দুষ্টজন।।
কিরূপে এমন যুদ্ধ হৈল কহ শুনি।
সূতপুত্র বলে অবধান নৃপমনি।।
ইহার বৃত্তান্ত রাজা কি বলিব আর।
কালি নিশাকালে সৈন্য করিল সংহার।।
কোন দেবে সহায় করিয়া কি আইল।
কোন দেবতায় সাধি এ বর পাইল।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখন্ডী প্রভৃতি বীরবর।
সংগ্রামের পরিশ্রমে শ্রান্ত কলেবর।।
শিবিরে নিশায় সবে আছিল শয়নে।
আসিয়া দ্রোণের পুত্র বধিল জীবনে।।
যার যত সেনা ছিল সুহৃদ বান্ধব।
একাকী বধিয়া গেল দেখি অসম্ভব।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সবার জীবন।
নিদ্রায় কাটিল শির দ্রোণের নন্দন।।
সংহতি বাহিনী যত ছিল সন্বোধিতে।
সকল মারিল শেষ জান নরপতে।।
রমনী আছিল যত যাহার সংহতি।
অঙ্গ ভঙ্গ করিয়া রাখিল মারি লাথি।।
অশ্বথামা দুর্ম্মতির দয়া নাহি প্রাণে।
কাতরে চরণে পড়ে তবু শিরে হানে।।
অস্ত্র শস্ত্র বিবর্জ্জিত ছিল যত সেনা।
কেহ বা শয়নে ছিল হয়ে অচেতনা।।
কেশে ধরি আনি তার শির ফেলে কাটি।
নিদ্রায় কাতর অতি করে ছটফটি।।
তোমাকে কহিতে বিধি রাখিল আমায়।
যে ছিল মরিল সবে শুন ধর্ম্মরায়।।
শুনি রাজা ভূমিতে পড়েন অচেতনে।
যেমন পড়য়ে বৃক্ষ মূলের ছেদনে।।
সন্বিত পাইয়া রাজা করেন বিলাপ।
কি করিতে কি হইল কত ছিল পাপ।।
এখন কি করি আর লইয়া ভুবন।
সর্ব্ব শূন্য দেখি এবে সব অকারণ।।
মুনিগণ সহ ভাল ছিলাম কাননে।
পাপভোগ হয় মম রাজ্যের কারণে।।
জ্ঞাতি বন্ধুগণ যত শ্বশুর মাতুল।
মায়া হেতু আসি সবে হয় অনুকূল।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি হেন সহায় আমার।
কোথায় শিখন্ডী সখা না দেখিব আর।।
কুটুম্ব প্রধান মম হিতকারী জন।
বলিষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ছিল দুষ্টের দমন।।
পুত্র পৌত্র সঙ্গে করি পরম উল্লাস।
আসিয়া আমার কার্য্যে হইল বিনাশ।।
বুদ্ধিমন্ত মহারাজ অতুল পৌরুষে।
ক্ষিতিতে প্রধান ইন্দ্র গণি যে বিশেষে।।
সাধিয়া আপন কার্য্য স্বচ্ছন্দ শয়নে।
গুরুপুত্র আসি নাশে ধর্ম্ম নাহি মানে।।
নাম ধার কত রাজা করেন বিলাপ।
স্বকার্য্য সাধনে মম হৈল মনস্তাপ।।
অভিমন্যু মরে রণে মহাযুদ্ধ করি।
সেই মহাশোক আমি পাসরিতে নারি।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র নিদ্রায় আছিল।
মুঢ়মতি অশ্বথামা সবারে মারিল।।
আমার হিতের হেতু ছিল যত জন।
গৃহেতে না গেল সবে হইল নিধন।।
জননী রমনী যারা আছয়ে আলয়।
কান্দিয়া কতেক নিন্দা করিবে আমায়।।
এ সব ‍ভাবিয়া মম স্থির নহে মন।
এমন হইল দশা দৈবের ঘটন।।
বীরশূন্য হইলাম নাহি কিছু সেনা।
বৃথা রাজ্যে কার্য্য নাহি সংসার বাসনা।।
বাঞ্ছা করি পুনঃ গিয়া বনবাস করি।
তপ আচরণ করি হৈয়া ব্রক্ষচারী।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ মদ্রপতি আদি।
এক এক বীর জিনে পৃথিবী অবধি।।
সবারে করিনু জয় কৃষ্ণ সহকারে।
কে জানে দুর্দ্দশা শেষে ঘটিবে আমারে।।
রাজার বিলাপ শুনি কান্দে সর্ব্বজন।
দ্রৌপদী কান্দিয়া বলে করুণ বচন।।
পিতৃ ভ্রাতৃ আদি করি যত বন্ধুগণ।
এককালে অকস্মাৎ হইল নিধন।।
শুনিয়া নিষ্ঠুর বাক্য হরিল চেতনা।
মস্তক উপরে যেন পড়িল ঝনঝনা।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দেবী পড়ে অশ্রুজল।
ভাই ভাই বলি কান্দে হইয়া বিকল।।
জয় হেন মানি চিত্তে আনন্দ বিশাল।
তার বিপরীত আজি ঘটাইল কাল।।
যেমন আনন্দ হৈল তেন নিরানন্দ।
ভাবিয়া কি হবে এবে বিধি কৈল মন্দ।।
এমত করিবে বিধি জানিব কেমনে।
কৌরব সহিত দ্বন্দ্ব হইল যখনে।।
সকল করিয়া নাশ আপনি বিনাশ।
পাপ রাজ্যে কার্য্য নাহি যাব বনবাস।।
উজ্জ্বল হইয়া দীপ্তি হইল নির্ব্বাণ।
আমার বৈভব লাভ তাহার সমান।।
সেইরূপ সৈন্য ছিল যামিনী শোভনে।
সকল বিনাশ হৈল নাহি দেখি দিনে।।
এককালে নানা শোক উপজিল আসি।
শোকসিন্ধু মধ্যে আমি তৃণ হেন ভাসি।।
কষ্টভাগ্যে কষ্ট হয় নাহি হয় দূর।
স্বয়ন্বয়ে পাই দুঃখ দ্রুপদের পুর।।
লক্ষ রাজা স্বরন্বরে করিল গমন।
লক্ষ্য বিন্ধি প্রাপ্ত হইল ইন্দ্রের নন্দন।।
তাহাতে অনেক কষ্ট পাইনু অপার।
কৃষ্টের কৃপায় তাহা হইল নিস্তার।।
ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হইলেন ধর্ম্মরাজ।
ভুবনে বিখ্যাত হৈল রাজসূয় কাজ।।
ত্রিভুবনে নিমন্ত্রণ হইল সবারে।
কত শত রাজা আসি রহিল দুয়ারে।।
কুবের সম্পদ জিনি হইল বৈভব।
পৃথিবীতে একচ্ছত্র হইল পান্ডব।।
জনে জনে বিষয় দিলেন যুধিষ্ঠির।
সম্পদের সংখ্যা নাহি পূর্ণিত মন্দির।।
দেখি দুর্য্যেধন রাজা করিল মন্ত্রণা।
শকুনি পাপিষ্ঠে আনি দিলেক যন্ত্রণা।।
পাশা খেলি রাজ্যধন হরিয়া লইল।
সভামধ্যে আমার যে চুলেতে ধরিল।।
বস্ত্রহরণের কষ্ট দিল দুঃশাসন।
কতেক কহিব তাহা না যায় কথন।।
আকর্ষন করি কেশ টানে পুনঃ পুনঃ।
কেহ কিছু নাহি বলে সকলি বিগুণ।।
দুর্য্যোধন পাপমতি দেখাইল উরু।
এ কারণে ভাঙ্গে ভীম মারি গদা গুরু।।
কর্ণ দুষ্ট আমারে বলিল কুবচন।
মরণ অধিক হৈল না যায় কথন।।
যে কষ্ট হইল তাহা নারি কহিবারে।
অমঙ্গল দেখি অন্ধ চিন্তিল বিচারে।।
আমারে ডাকিয়া অন্ধ দিল বরদান।
ধন ‍রাজ্য দিয়া পুনঃ করিল সম্মান।।
বর পেয়ে নিজ রাজ্যে করিণু গমন।
পুনঃ পাশা খেলি দুষ্ট পাঠায় কানন।।
বনবাসে নানা কষ্ট হইল ভুগিতে।
কত দিনে দুর্য্যোধন বিচারিল চিতে।।
দুর্ব্বাসা মুনিরে পাঠাইল সেই বন।
শিষ্য ষাটি সহস্র লইয়া তপোধন।।
তবে কত দিনে জয়দ্রথে পাঠাইল।
আসিয়া আমার বাসে অতিথি হইল।।
শূন্যঘর দেখি দুষ্ট হরিল আমায়।
ধর্ম্ম রক্ষা করিলেন আমারে সে দায়।।
অনন্তরে গিয়া আমি বিরাট আলয়।
সৌরিন্ধ্রী হইয়া দুঃখ ভুগিলাম তায়।।
তবে কত দিনে দুষ্ট কীচক দুর্ম্মতি।
আমাকে দিলেক দুঃখ অতি পাপমতি।।
প্রকারে মারিল ভীম রজনী সময়।
তবে পাইলাম রক্ষা কৃষ্ণের কৃপায়।।
না জানি কি আছে আর বিধাতার মনে।
জটাসুর দিল দুঃখ কাম্যক কাননে।।
বলে লয়ে যায় দুষ্ট পৃষ্ঠেতে করিয়া।
তাহাকে মারিল ভীম গদা আস্ফালিয়া।।
তাহাতে পাইনু রক্ষা কৃষ্ণের কৃপায়।
কত দুঃখ কব আর কহা নাহি যায়।।
এই সব দুঃখ স্মরি জ্বলে বহ্নিজ্বালা।
কত আর নিভাইব হইয়া অবলা।।
এবে শত্রু বিনাশিয়া মনে হৈল আশ।
গত নিশি আমার ঘটিল সর্ব্বনাশ।।
এখন জীবন ধরে এই পাপ তনু।
আমার উচিত হয় পশিতে কৃশানু।।
পিতৃ ভ্রাতৃ পুত্রশোকে জ্বলে কলেবর।
যেমন গরল জ্বালা জ্বলিছে অন্তর।।
কান্দিয়া শত্রুর নারী মনে পায় ব্যথা।
তাহার অধিক মোর করিল বিধাতা।।
দ্রৌপদী ক্রুন্দন শুনি ভীম ধনঞ্জয়।
অবসন্ন বিষন্ন দেখেন শুন্যময়।।
বিহবল হইয়া পড়ে মাদ্রীর নন্দন।
দ্রৌপদী হইতে করে অধিক ক্রন্দন।।
কোপেতে আকুল হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।
শিবির দেখিতে রাজা করেন গমন।।
কাক চিল উড়ে পড়ে শিবা কঙ্ক আদি।
খরস্রোতে বহিতেছে শোণিতের নদী।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।
০২. অশ্বথামার মুন্ডচ্ছেদনার্থ ভীমের যাত্রা
শিবির দেখিয়া রাজা দুঃখ অসম্ভব।
অশ্রু বহে নেত্রে কান্দে যতেক পান্ডব।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি হত দেখি যুধিষ্ঠির।
বিলাপ করেন কত নেত্রে বহে নীর।।
সকল মরিল রাজ্যে কিবা প্রয়োজন।
বৃথা করিলাম এত অসাধ্য সাধন।।
ভীম বলে রাজা শোক কর অনুচিত।
আপনার কর্ম্মভোগ কে করে খন্ডিত।।
আপনি থাকিলে সর্ব্ব পাবে মহাশয়।
অকারণে কর শোক ইতরের প্রায়।।
কর্ম্মবশে জন্ম মৃত্যু হয় পুনঃ পুনঃ।
কোথা ছিলে কোথা যাবে তাহা নাহি গণ।।
কর্ম্মবশে আসি মিলে কেহ নহে কার।
জন্মিলেই মৃত্যু আছে নহে খন্ডিবার।।
যে মরিল সে চলিল যথা কর্ম্মভোগ।
কেবল শরীর ছাড়ে দৈবের সংযোগ।।
কালপূর্ণ হৈলে পরে কে রাখিতে পারে।
কত শত মহারাজ পুনঃ পুনঃ মরে।।
অষ্টাদশ দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে।
সকলে জিনিয়া মৃত্যু হৈল নিশাকালে।।
কালপূর্ণ হৈলে নরে বিধির নির্ব্বন্ধ।
কালেতে সংহার করে শাস্ত্রীয় প্রবন্ধ।।
ইথে শোক অনুচিত ভাবিয়া কি কার্য্য।
শাস্ত্রবিজ্ঞ হয়ে হও শোকেতে অধৈর্য্য ।।
অতঃপর দ্রৌপদী কহেন শোকাবেশে।
অশ্বথামা মুন্ড আনি দেহ মম পাশে।।
দ্রৌণির মস্তকে বদ্ধ আছে এক মণি।
মুন্ড কাটি সেই মনি যদি দেহ আনি।।
তবে শোক নিবারণ হয়তো আমার।
নহে ভাতৃ পুত্রশোকে না বাঁচিব আর।।
শুন ভীম মহাবীর তোমা সম নাই।
বিক্রমে বিশাল তোমা করিল গোঁসাই।।
সুগন্ধি কুসুমোদ্যানে জিনি যক্ষরাজ।
হিড়িম্বে মারিলে তুমি অরণ্যের মাঝে।।
ব্রাক্ষ্মণ রক্ষনে বকে করিলে বিনাশ।
কির্ম্মীরে বধিয়া কৈলে কাননে নিবাস।।
জয়দ্রথ ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার।
কীচকে বধিয়া মান রাখিলে আমার।।
এখন এ শোকসিন্ধু মধ্যে ডুবে মরি।
রক্ষা কর আমারে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি।।
দুঃশাসন রক্তপান কৈলে রণমাঝে।
উরুভাঙ্গি ভুমেতে পাড়িলে কুরুরাজে।।
প্রতিজ্ঞা পূরণে গদাঘাত কৈলে শিরে।
সমুদ্র তরিয়া মরি গোক্ষুরের নীরে।।
আমার বচন ধর বধ অশ্বথামা।
সকল নিষ্ফল হৈল তোমার মহিমা।।
এখন উচিত হয় এই সব কথা।
শ্রীঘ্র মোরে আনি দেহ দ্রোহপুত্র-মাথা।।
ব্রাক্ষ্মণ হইয়া রাক্ষসের কর্ম্ম করে।
নিদ্রাগত পেয়ে দুষ্ট সকলে সংহারে।।
তাহার বিনাশে নাহি ব্রক্ষ্মবধ ভয়।
অধর্ম্ম করিল সেই দুষ্ট দুরাশয়।।
কান্দিতে কান্দিতে এত দ্রৌপদী কহিল।
অনুমতি হেতু ভীম ধর্ম্মে জানাইল।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন এই সে উচিত।
কর্ম্ম অনুসারে শাস্তি শাস্ত্রের বিহিত।।
এত শুনি ভীমবীর রথ আরোহিয়া।
নকুলে সারথি করি চলিল ধাইয়া।।
ভীমের এতেক সজ্জা আরম্ভ দেখিয়া।
গোবিন্দ বলেন ধর্ম্মরাজ সম্বোধিয়া।।
অশ্বথামা বিনাশে পাঠাও বৃকোদরে।
বিচার না করি রাজা যুক্তি দিলে তাঁরে।।
অসাধ্য সাধন তেই সিদ্ধি অসম্ভব।
সংসার বিজয়ী সে, কে করে পরাভব।।
পরাক্রম তাহার কি না আছ বিদিত।
না বুঝিয়া হেন কর্ম্ম কর বিপরীত।।
ত্রিলোকেতে সেই একা মহাধনুর্দ্ধর।
পরাক্রম করি জিনে সব চরাচর।।
কি করিবে ভীম তার করি মহারণ।
ভীম হৈতে না হইবে তাহার দমন।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কহি, যবে ছিলা বনে।
অম্বথামা নিরবধি ভ্রমিত কাননে।।
দৈবে একদিন গেল দ্বারকা ভুবনে।
দেখিয়া বান্ধবগণ হরষিত মনে।।
বিক্রম করিয়া বলে আমার সাক্ষাতে।
ব্রক্ষ্মশির অস্ত্র আমি জানি ভালমতে।।
তাহা লৈয়া চক্র মোরে দেহ চক্রপাণি।
ত্রৈলোক্য জিনিতে পারি হেন অস্ত্র জানি।।
অব্যর্থ আমার অন্ত্র জানে ত্রিভুবন।
ইহা লৈয়া চক্র মোরে দেহ নারায়ণ।।
উপরোধ হেতু আর দেরী না করিয়া।
দ্রৌণিকে দিলাম চক্র তখনি আনিয়া।।
তুলিতে নহিল শক্ত রাখি চক্রধর।
কহিল না লব চক্র রাখ চক্রধর।।
ইহার অধিক নম আছে ব্রক্ষ্মশির।
বজ্রদন্ডে জিনি আমি শুন যদুবীর।।
পৃথিবী সংহার দেব কর এই বাণে।
কাহারে না দিয়া অস্ত্র দিল মম স্থানে।।
করিলাম জিজ্ঞাসা সে দ্রোণের নন্দনে।
তবে চক্রচাহ কেন আমার সদনে।।
অশ্বথামা বলে তোমা জিনিবার মনে।
অস্ত্র হৈতে শ্রেষ্ঠ চক্র জানিনু এক্ষনে।।
কার্য্য নাহি তোমা সহ বিবাদে আমার।
এত বলি তথা হৈতে কৈল আগুসার।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই শুন মহাশয়।
বুঝিয়া করিবা কার্য্য যেবা মনে লয়।।
দ্রোণপুত্র দুরাত্মা সে ক্রোধন চঞ্চল।
ব্রক্ষ্মশির অস্ত্র তার সদা করতল।।
আমার বচনে তুমি ‍রাখ ভীম বীরে।
শুনিয়া চিন্তিত বড় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
সকল মজিল রাজ্য কি কার্য্য বিশেষ।
নিশ্চয় মরিব আমি শুন হৃষীকেশ।।
অগ্রে ভীম চলি গেল না শুনি বারণ।
এখন উচিত যাহা কর নারায়ণ।।
তোমা বিনা গতি আর নাহি ত্রিভুবনে।
বল বুদ্ধি পরাক্রম নাহি তোমা বিনে।।
যে হয় উপায়ে এবে করহ উচিত।
তোমার বিনা পান্ডবের অন্য নাহি স্থিত।।
গোবিন্দ বলেন চল ভীমের পশ্চাৎ।
বিলম্ব না কর আর শুন নরনাথ।।
অর্জ্জুন সহিত হরি করিলা গমন।
তাহার পশ্চাতে যান ধর্ম্মের নন্দন।।
রথ রথী পদাতিক চলিল অপার।
নানা বাদ্য কোলাহল হৈল আগুসার।।
অশ্বথামা সর্ব্বসৈন্য করিয়া বিনাশ।
ভয়ে পলাইয়া রহে যথা মুনি ব্যাস।।
তথা উপনীত হৈল ভীম মহাবাহু।
অশ্বথামা দেখি যেন চন্দ্রে গিলি রাহু।।
বাদ্য শব্দে অশ্বথামা কম্পিত হইল।
ভীমের গর্জ্জন শুনি বিস্ময় মানিল।।
ভীমে দেখি অশ্বথামা করিল সাহস।
মরণ চিন্তিল মনে রাখিবারে যশ।।
অম্বথামা অস্ত্র ধনু নাহি ধরে করে।
মুষ্টি করি লইল ঈষিকা সব্যকারে।।
মন্ত্র পড়ি ছাড়িলেক দিয়া হুহুঙ্কার।
নিষ্পান্ডবা ক্ষিতি করে প্রতিজ্ঞা তাহার।।
ক্রোধ করি অস্ত্র ছাড়ি করিল গর্জ্জন।
বাণের মুখেতে অগ্নি হয় বরিষণ।।
হেনকালে তথা পার্থ গোবিন্দ আসিয়া।
প্রলয় অনল উঠে সম্মূখে দেখিয়া।।
পার্থেরে কহেন কৃষ্ণ কি দেখহ আর।
ক্ষণেক থাকিলে সর্ব্ব করিবে সংহার।।
সন্বরণ অস্ত্র জান দ্রোণ-উপদেশে।
সত্বরে সন্ধান পূর অস্ত্রের বিনাশে।।
ক্ষণেক থাকিলে হবে অসাধ্য হে সখা।
প্রলয় অনল উঠে নাহি যাবে রাখা।।
অর্জ্জুন শুনিয়া আইলেন ক্রোধভরে।
করতলে ধরি অস্ত্র সাহসী অন্তরে।।
আগু হৈয়া রথ হৈত নামি ধনঞ্জয়।
দান্ডাইয়া রহিলেন কারে নাহি ভয়।।
যোড়হস্তে গুরুপদে করি নমষ্কার।
ধনুক টঙ্কার দেন লোকে চমৎকার।।
এড়িলেন একবাণ উঠিল আকাশে।
গর্জ্জন করিয়া যায় দ্রোণপুত্র নাশে।।
তন্ত্রে মন্ত্রে বাণ এড়িলেক ধনঞ্জয়।
হইল প্রলয় যুদ্ধ দোঁহেতে দুর্জ্জয়।।
তিনলোক শব্দে কাঁপে, কাঁপে চরাচর।
যেন কালদন্ড বাণ জ্বলে বৈশ্বানর।।
উল্কাপাত নির্ঘাত সে বাণ হৈতে খসে।
হইল প্রলয় বড় পৃথিবী বিনাশে।।
ঝাঁকে ‍ঝাঁকে অগ্নিবৃষ্টি হয় ঘনে ঘন।
প্রলয় দেখিয়া স্থান ছাড়ে দেবগণ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল কাঁপিল সর্ব্বলোক।
মহাশব্দে বন যেন পোড়ায় পাবক।।
দুই অস্ত্র সম দেখি কেহ নহে উন।
মহাবীর দুইজন কেহ নহে ন্যুন।।
গিরি বৃক্ষ পোড়ে তাহে প্রাণী কিসে গণি।
অকালে প্রলয় হয় মানে সর্ব্ব প্রাণী।।
মহাশব্দে পুড়ি যায় সব অগ্নিময়।
সমুদ্র মন্থনে যেন বিষের উদয়।।
দ্বাদশ সূর্য্যের দীপ্তি প্রলয়ের কালে।
সেইমত দোঁহে শত শত অস্ত্র ফেলে।।
জল স্থল পুড়ি যায় যেমত ঝঞ্ঝনা।
মহা অস্ত্র দোঁহে নাহি সন্বরে আপনা।।
সর্ব্ব সৃষ্টিনাশ যায় দেখি লাগে ত্রাস।
হেনকালে আইলা নারদ আর ব্যাস।।
দুই বাণ মধ্যে রহিলেন দুই মুনি।
জগতের নিতান্ত বিনাশ অনুমানি।।
দোঁহারে বলেন ডাকি দুই তপোধন।
সৃষ্টিনাশ কর কেন কর সন্বরণ।।
উভয়ে বিবাদে কেন দৃষ্টি কর নাশ।
কিবা মনে করিয়াছ কহ এক ভাষ।।
শুনিয়া দোঁহার বাক্য অর্জ্জুন তখন।
করিলেক আপনার অস্ত্র সম্বরণ।।
দ্রৌণি ডাকে কহে শক্য নহে নিবারণ।
ক্রোধে অস্ত্র ছাড়িলাম কি করি এখন।।
উপরোধ রাখি যদি তোমা দোঁহাকার।
পান্ডবে মারিয়া অস্ত্র আসুক আমার।।
তবে যদি ক্ষমা করি দোঁহা উপরোধে।
উত্তরার গর্ভপাত করিব বিবাদে।।
যেই পুত্র আছে উত্তরার গর্ভবাসে।
চলিল আমার অস্ত্র তাহার বিনাশে।।
অর্জ্জুন বলেন কাটি দ্রোণপুত্র শির।
নহিলে না হবে ক্ষমা শুন যদুবীর।।
ব্যাস বলিলেন শুন বীর অশ্বথামা।
শিরোমণি দিয়া পার্থে চাহ তুমি ক্ষমা।।
তব বাণে মরে যদি শিশু গর্ভবাসে।
তারে জীয়াইব আমি চক্ষুর নিমিষে।।
মণি দিলে শির ক্ষত হইবে তোমার।
বৎসর সহস্র তৈলে নহে প্রতীকার।।
শিরের পীড়ায় তুমি করিবা ভ্রমণ।
যেমন তোমার কর্ম্ম হইল তেমন।।
এত ‍শুনি অশ্বথামা করিয়া ছেদেন।
শিরোমণি ধনঞ্জয়ে করে সমর্পণ।।
হেথা দ্রৌণি বাণ বেগে জটীল আকাশে।
বায়ু বেগে উত্তরার গর্ভেতে প্রবেশে।।
গর্ভে প্রবেশিয়া গর্ভ করিল নিধন।
প্রবেশ করেন গর্ভে কৃষ্ণ সেইক্ষণ।।
গর্ভ বিনাশিয়া বাণ বেগে উটীল আকাশে।
বায়ুবেগে উত্তরায় গর্ভেতে প্রবেশে।।
গর্ভে প্রবেশিয়া গর্ভ করিল নিধন।
প্রবেশ করেন গর্ভে কৃষ্ণ সেইক্ষণ।।
গর্ভ বিনাশিয়া ‍বান হইল বাহির।
পুনঃ গর্ভ জীবিত করেন যদুবীর।।
এই মতে শান্ত হৈল অস্ত্র বরিষণ।
জলেতে নিবৃত্ত যেন হয় হুতাশন।।
মাহভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনিলে হইবে ভবপার।।
০৩. অশ্বথামার শিরোমণি পাইয়া দ্রৌপদীর সন্তোষ
মস্তক জ্বলনে দুঃখ অশ্বথামা পায়।
দেখি মুনি ব্যসদেব কহিলেন তায়।।
যাবৎ তোমার দেহে থাকিবে জীবন।
শিরোমণি তোমার না হবে কদাচন।।
পৃথিবীতে নর তৈল মাখিবার কালে।
তব নামে তিনবার আগে দিবে ফেলে।।
সেই তৈল পড়িবেক পৃথিবী উপরে।
তোমার মস্তকেতে পড়িবে মম বরে।।
তাহাতে নিবৃত্ত হবে তোমার জ্বলনি।
নিজস্থানে যাহ, ভয় না করিহ দ্রৌণি।।
তব নামে অগ্রে তৈল যে জন না দিবে।
ব্রক্ষ্মবধ পাতক তাহাকে পরশিবে।।
এইরূপে অশ্বথামা দিয়া মণিবর।
বিমনা হইয়া গেল আপনার ঘর।।
ব্যাস নারদেরে লয়ে পান্ডুপুত্রগণ।
বৃষ্ণ সহ করিলেন শিবিরে গমন।।
পুনর্জন্ম হৈল মনে করে ভীমবীর।
গোবিন্দের সাহায্যে সুস্থির যুধিষ্ঠির।।
জানিলেন কৃষ্ণ হৈতে তরিনু সঙ্কটে।
সতত রাখেন কৃষ্ণ বিঘ্ন যদি ঘটে।।
দ্রৌণির মস্তক মণি লইয়া সত্ত্বর।
দ্রৌপদীর নিকটে গেলেন কৃকোদর।।
অগ্রে শিরোমণি রাখি কহেন বৃত্তান্ত।
ভাগ্যে রক্ষা পাইলাম এবার নিতান্ত।।
দ্রৌপদী বলেন মম গেল পরিতাপ।
দুঃখের কারণ মম ছিল পূর্ব্ব পাপা।।
মণি আনি দিয়া তুষ্ট করিলে আমারে।
আমা প্রতি মন আছে কহিনু তোমারে।।
এই মণি মহারাজ করুক ধারণ।
তবে ভীম আরো মম তুষ্ট হয় মন।।
দ্রৌপদীর অভীষ্ট জানিয়া ধর্ম্মরায়।
করিলেন স্বমস্তক ভূষিত তাহায়।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেন নারায়নে।
অন্তর্য্যামী ভগবান জানহ আপনে।।
না হইল না হইবে এমন মন্ত্রণা।
তোমার রক্ষিত আমি জানে সর্ব্বজনা।।
কার বরে দ্রোণপুত্র রাত্রিতে আসিয়া।
একাকী সকল সৈন্য গেল বিনাশিয়া।।
পূর্ব্বে যদি জনার্দ্দন হইত এমন।
সংহার করিত দ্রৌণি সব সৈন্যগণ।।
কহ শুনি জগন্নাথ ইহার কারণ।
কি কারণে অশ্বথামা করিল এমন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন রাজা জানিলে কি হয়।
কালে করে কারে হরে কাল সর্ব্বময়।।
পরাক্রমে দ্রোণপুত্র পারে কি তোমায়।
সাধিল দুষ্কর কার্য্য শিবের কৃপায়।।
ভক্তি হেতু মহাদেব অর্জ্জুনের বশ।
সব রক্ষা করিলেন দিন অষ্টাদশ।।
ক্ষয়কালে উপনীত দ্রোণের নন্দন।
পাইল শিবির দ্বারে শিব দরশন।।
ভক্তিভাবে স্তব করে দেব মহেশ্বরে।
বর পাইলেক দ্রোণি যা ছিল অন্তরে।।
দয়ার সাগর হর না ভাবি বিষাদ।
দ্রৌণিরে আপন খড়গ দিলেন প্রসাদ।।
বর দিয়া শঙ্কর গেলেন নিজালয়।
বধিল সকল সেনা দ্রোণের তনয়।।
পরম দয়ালু হর দেবের দেবতা।
সংহার কারণে রুদ্র প্রলয় বিধাতা।।
পূর্ব্বে দক্ষযজ্ঞ নষ্ট করেন মহেশ।
পুনঃ বর দেন তুষ্ট হয়ে ব্যোমকেশ।।
ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু অগ্নি আদি দেবগণ।
শিব সেবি সব কার্য্য করিল সাধন।।
যাহার আজ্ঞায় জয় হয় ত্রিভুবনে।
ভক্ষণ করিল বিষ সমুদ্র মন্থনে।।
শিব বরে দ্রৌণি সব করিল বিনাশ।
নহিলে কাহার শক্তি হেন করে আশ।।
সৃষ্টির সংহার কর্ত্তা সেই দেবরাজ।
তাঁর আজ্ঞা বিনা কেহ নাহি করে কাজ।
জন্মাইয়া ত্রিজগৎ করেন পালন।
কার পরিপূর্ণ হলে আপনি নিধন।।
আদ্যদেব মহাগুরু সব্বদেব গুরু।
ভক্তের অধীন সদা বাঞ্ছাকল্পতরু।।
এতেক মহত্ত্ব তব শিব প্রসাদাৎ।
অর্জ্জুনে তোষেন দেব হইয়া কিরাত।।
যত বীর মরিলেন ভারত সমরে।
কুরুক্ষেত্রে পড়িয়া চলিল স্বর্গপুরে।।
তুমি আমি যথাকালে যাব অনায়াসে।
পূর্ব্বাপর আছে হেন শাস্ত্রেতে বিশেষে।।
এত শুনি ধর্ম্মরাজ বলেন বচন।
বুঝিলে না বুঝে মন মায়ার কারণ।।
তোমা বিনা নাই গতি শুন পরমেশ।
সর্ব্ব শূন্য দেখি আমি না পাই উদ্দেশ।।
দৈব হেতু সব হয় কে খন্তিতে পারে।
কর্ম্মবশে গতায়ত প্রাণী সদা করে।।
তথাপি তোমারে কহি মনের মানসে।
জয় পরাজয় হয় স্ব স্ব কর্ম্মবেশে।
দেখহ গোবিন্দ মম অতি অমঙ্গল।
গেল বন্ধু বান্ধবাদি তনয় সকল।।
বংশে বাতি দিতে আর না রহিল কেহ।
কি সুখে রহিব বল, চাহি নাক গেহ।।
বিলাপ করুণা যত কি করি এখন।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি বিধির লিখন।।
তোমার চরণে মতি রহে অনিবার।
জীবন যৌবন ধন মিথ্যা পরিবার।।
গোবিন্দ বলেন রাজা ত্যজ শোক মন।
রাজধর্ম্ম সদাচার কর অনুক্ষণ।।
যুদ্ধে মৃত্যু ক্ষত্রকুলে প্রধান এ কার্য।
প্রজার পালন কর পৃথিবীর মাঝ।।
জয় পরাজয় হয় নাহিক এড়ান।
পূর্ব্বাপর সংসারেতে আছে এ বিধান।।
কৃষ্ণের বচনে রাজা স্থির কর মন।
দ্রৌপদী সুস্থিরা হয়ে চিন্তে নারায়াণ।।
গোবিন্দ কৃষ্ণ নাম জপিতে লাগিল।
সকল আপদ খন্ডে জন্মে দিবজ্ঞান।
ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।
মহাাভারতের কথা কাশী বিরচিল।
এইত ঐষিকপর্ব্ব সমাপ্ত হইল।।
ঐষিকপর্ব্ব সমাপ্ত।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র