শ্রীমদ্ভাগবত রচনার ইতিহাস ও রাজা পরীক্ষিতের ভাগবত শ্রবণ

মহামুনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বা ব্যাসদেব বেদ রচনার পূর্বে এগুলি মুনি-ঋষিদের স্মৃতিতে ছিল এবং এ বৈদিক মন্ত্রগুলি পয়ার আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। ব্যাসদেবই সর্বপ্রথম পঠনের উপযোগী করে এগুলি সংকলন করেন এবং বেদকে চারভাগে ভাগ করেন। বেদ অর্থ জ্ঞান। পারমার্থিক জ্ঞান। এ জ্ঞান ধারণ করতে পারলে পার্থিব বিষয় তুচ্ছ মনে হবে। ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য সবকিছুই বেদে আছে। অভাব শুধু আমাদের জ্ঞানের। অজ্ঞানকে নাশ করে বেদের দূরূহ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে আত্মাতে জ্ঞানের বর্তিকা জ্বালাতে পারলে আমাদের মানব জনম সফল হবে। ব্যাসদেব বেদ রচনা করা ছাড়াও মহাভারত নামে মহাকাব্য রচনা করেন। মহাভারতের কাহিনী এত বিচিত্র ও হৃদগ্রাহী যে ইহার ছন্দে ছন্দে আছে রাজনীতি, আছে ষঢ়যন্ত্র, আছে মুক্তির পথ, আছে দেহান্তর, আছে আত্মোপলদ্ধি, আছে দু:খ-বেদনা, হাসি-কান্না যা শ্রবণ করলে আমাদেরকে মোক্ষলাভের পথের দিকেই ধাবিত করে। সনাতন ধর্মকে জানা ও এর ব্যাপকতা কত বিশাল তা পরিমাপ করা আমাদের এক জনমে অত্যন্ত দূরূহ  ব্যাপার। জনমে জনমে আমাদের তা জানতে হবে। বৈদিক গ্রন্থাদি পাঠ করলে জানা যায় যারাই মোক্ষলাভ করেছেন তারা কখনই এক জনমে পারেনি। জনমে জনমে পূণ্য সঞ্চয় করে তারা ভগবত ধামে প্রবেশ করেছেন  অথবা নিত্যদেহ  লাভ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পার্ষদরূপে গণ্য হয়েছেন।
ব্যাসদেব আঠারটি পুরাণও রচনা করেছেন। পুরাণগুলিতে সনাতন ধর্মের জানা অজানা অনেক পৌরানিক কাহিনী ব্যাপৃত হয়েছে। পুরাণগুলিতে যেমন আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কথন, লীলার কথা তেমনি আছে দেবদেবীদের শক্তির বহি:প্রকাশ। 
ব্যাসদেবে জন্মকাহিনী:
বশিষ্ঠ মুনির পৌত্র পরাশর। পরাশরের মাতার নাম অদৃশ্যন্তী। পিতার নাম শক্তি। একদিন পরাশর মুনি নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। নৌকা চালনা করছেন এক নারী। তার নাম মৎস্যগন্ধা। তাকে দেখে পরাশর মুনির কামভাব হয় এবং তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বলেন। ঐ কন্যা জানান তিনি কুমারী। কিন্তু পরাশর মুনির বরে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি। তার গায়ের গন্ধও দূর হয়ে যায়। তাদের এক সন্তান হয় দ্বীপে। দ্বীপে জন্ম হয় বলে তার নাম ‘দ্বৈপায়ন’। তিনিই জগতে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব নামে পরিচিতি পান। আর ঐ মৎস্যগন্ধাই সত্যবতী নামে পরিচিতি পান এবং হস্তিনাপুরের রাজা শান্তুনু তাকে বিবাহ করেন। 
ব্যাসদেব যেভাবে ভাগবত রচনা করলেন:
ব্যাসদেব বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ, মহাভারত রচনা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। কিন্তু তারপরও তার মনে এক অতৃপ্ত বাসনা বিরাজ করছে। কিন্তু কি সে বাসনা তা তিনি হৃদঙ্গম করতে পারছেন না। একদিন তিনি তার আশ্রমে মৌন হয়ে বসে আছেন। এমন সময় মহর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি ব্যাসদেবকে এভাবে মৌন হয়ে বসে থাকতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। ব্যাসদেব জানান তিনি বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ ও মহাভারত রচনা করেছেন। কিন্তু তারপরও তার মনে অতৃপ্ত বাসনা বিরাজ করছে। ব্যাসদেবের অতৃপ্ত বাসনার কথা শ্রবণ করে নারদ তাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কর্ম, গুণ ও লীলা রচনা  করার জন্য উপদেশ দিলেন। তারপর ব্যাসদেব মহাভারতসহ পুরাণের সমস্ত সার সংকলিত করে শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেন। ব্যাসদেব তার পুত্র শোকদেবকে প্রথম শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করে শোনান। কিন্তু ব্যাসদেব ভাগবত প্রচারের কোন ব্যবস্থা করেননি। 
হস্তিনাপুরের রাজা পরীক্ষিত একদিন শিকারে বের হলেন। তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে জলের খুঁজে শমীক মুনির আশ্রমে প্রবেশ করলেন। মুনি তখন বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ধ্যানে মগ্ন। রাজা মুনিকে জল দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মুনি কোন উত্তর দিলেন না। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি একটি মৃত সাপ ধনকে করে   মুনির গলায় জড়িয়ে দিলেন। অদূরেই মুনি পুত্র শৃঙ্গী অন্য ঋষি পুত্রদের সাথে খেলা করছিল। পিতার এরম অবস্থা দেখে শৃঙ্গী ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাৎক্ষণিক ব্রহ্মশাপ দিলেন। সে ব্রহ্মশাপে রাজা পরীক্ষিতের সাত দিনের মধ্যে তক্ষক সর্প দংশনে মৃত্যু হবে। অভিশাপ শুনে শমীক মুনির ধ্যান ভঙ্গ হল। তিনি বিচলিত হলেন। তিনি জানেন রাজা পরীক্ষিত মৃত্যুবরণ করলে রাজ্যে বিশৃংখলা দেখা দিবে। তিনি এও জানেন মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেছিলেন। রাজার মৃত্যুকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। পুত্রকে অনেক বুঝালেন তার ব্রহ্মশাপ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন পুত্র পিতার অপমানের কারণে শাপ ফিরিয়ে নিবে না। উপায়ন্তর না দেখে রাজা পরীক্ষিতের মৃত্যু আসন্ন মনে করে তার নিকট সংবাদ পাঠালেন এবং তিনি যেন নিজেকে আত্মরাক্ষার জন্য তৈরী হন। সংবাদ শ্রবণ করে রাজা পরীক্ষিত ধীর শান্ত মনে সর্প দংশনে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। রাজা পরীক্ষিত পুত্র জন্মেজয়ের হাতে রাজ্য অর্পণ করে রাজকীয় ভোগ বাসনা ত্যাগ করে গঙ্গানদী তীরে অবস্থান করতে থাকেন। সেখানে তিনি সাত দিন ব্যাপী প্রায়োপবেশন করে ব্রহ্মশাপে দেহত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। রাজা পরীক্ষিতের প্রায়োপবেশনে দেহ ত্যাগের সংবাদ রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ে। তার এ মৃত্যুর দৃশ্য দেখার জন্য রাজা-প্রজা, ঋষি, ব্রাহ্মণ সবাই গঙ্গানদীর তীরে সমবেত হলে লাগলেন। আসলেন মহর্ষি নারদ, আসলেন মহর্ষি ব্যাসদেবও। পরীক্ষিত জানতেন এ ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হবার নয়। তাই তিনি এ মৃত্যুকে রোধ করার কোন ব্যবস্থাও করলেন না। তার শুধু ভাবনা একটিই জীবনের সাতটি দিন এমনভাবে কাটাতে চান যেন ধীর শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারেন। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে তিনি তা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় সবই সম্ভব। হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব তনয় জ্ঞানতাপস শুকদেব। সমবেত হাজার হাজার মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণগণ নড়েচড়ে বসলেন। রাজা পরীক্ষিত ষোড়শবর্ষীয় ব্যাসদেব তনয়ের চরণ ম্পর্শ করলেন। তিনি নিজে উপলব্দি করলেন হয়তো বা তার মনের আশা পূরণ হবে। নিশ্চিয় এখন তার মৃত্যুর পথ সুগম হবে। 
শোকদেব সংসার ত্যাগী। তার নিকট স্ত্রী-পুরুষ ভেদজ্ঞান নেই। তিনি কোন জায়গায় ক্ষণমাত্র অবস্থান করেন। কিন্তু গঙ্গা তীরে হাজার হাজার মুনি-ঋষি, ব্রহ্মাণ, রাজ-প্রজাকে অবলোকন করে তিনি অভিভূত হলেন। রাজা পরীক্ষিতের প্রার্থনায় সেখানে তিনি সাত দিন ধরে অবস্থান করতে সম্মত হলেন। রাজা পরীক্ষিত শোকদেবকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন- শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজের মন-প্রাণকে উৎসর্গ করে কিভাবে দেহত্যাগ করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর শ্রবণ করার জন্য উপস্থিত রাজা-প্রজা, মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণ সকলেই সকলেই অধীর হয়ে উঠলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে নিয়োজিত করার জন্য যে গীতার অবতারণা করেছিলেন তেমনি পরীক্ষিতের প্রশ্নই শ্রীমদ্ভাগবত সংহিতার জন্ম দিয়েছে। ব্যাসদেব ভাগবত রচণা করেছিল কিন্তু শোকদেবই সর্বপ্রথম তা সাধুজনের সম্মুখে আনয়ন করেন। 
দ্বাপরের শেষে কলিযুগের প্রারম্ভে পবিত্র গঙ্গানদীর তীরে শুক্লানবমী তিথি হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত একাধারে সাতদিন মহর্ষি শুকদেব রাজা পরীক্ষিতসহ অন্যান্য মুনি-ঋষিগণকে ভাগবতপুরাণ শুনিয়েছিলেন। ভাগবতের মূল উপজীব্য বিষয় ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণ, কর্ম ও লীলা। ভাগবতের সে অমৃতধারা শ্রবণ করে উপস্থিত সাধুজন পূণ্য লাভ করছেন, আনন্দ পাচ্ছেন, কিন্তু সাথেই সাথেই তা স্মৃতিতে স্মরণ রাখতে পারছেন না। শোকদেবও তা অনুধাবন করতে পারলেন। তিনি এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি তার স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারবে। অবশেষে তিনি সেই মুনিকে পেলেন। তিনি হচ্ছেন রোমহর্ষণ মুনির পুত্র সূত উগ্রশ্রবা। নৈমিষারণ্যে অনুষ্ঠিতব্য যজ্ঞে তিনি শৌনকাদি ঋষির নিকট ভাগবত পাঠ করতে সক্ষম হবেন। পববর্তী সময়ে শৌনকাদি ঋষিগণ নৈমিষারণ্যে এক যজ্ঞানুষ্ঠান করছিলেন। সে যজ্ঞানুষ্ঠানে রোমহর্ষণ পুত্র সূত উগ্রশ্রবা উপস্থিত ছিলেন। তিনিই শৌনকাদি ঋষিগণনের নিকট শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ বর্ণনা করেছিলেন। এভাবেই শ্রীমদ্ভাগবত সাধারণের মধ্যে প্রবিষ্ঠ হল। 






Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র