অভিমন্যু

অভিমন্যু: অভিমুন্য মহাভারতের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। নির্ভীক ও এক অসীম সাহসহী বীর। অর্জুন ও সুভদ্রার পুত্র। সুভদ্রা কৃষ্ণের ভগিনী। অভিমন্যু মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের কন্যা উত্তরাকে বিবাহ করেন। অভিমুন্য ছোট বেলা থেকেই ক্রোধী ও তেজস্বী ছিলেন। শৌর্য বীর্যে তিনি ছিলেন পিতা অর্জুন ও পিতামহ ইন্দ্রের সমতুল্য। এ জন্য তার নাম হয় অভিমন্যু। তার দেহগঠন ছিল অপূর্ব। বাহুযুগল ছিল দীর্ঘ, বিশিাল বক্ষ,নয়ন দুটি আকর্ণ বিস্তৃত। পিতা অর্জুনের নিকট হতে অল্প বয়সেই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করে একজন অস্ত্রবিশারদ হিসেবে খ্যতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে পান্ডবগণের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের কারণে অভিমন্যু তাঁর বাল্যকাল দ্বারকায় মাতুলালয়ে অতিবাহিত করেন। সেখানে কৃষ্ণ ও বলরামের অভিভাবকত্বে তিনি কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন এবং যাদববীর কৃতবর্মা ও সাত্যকীর নিকট অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন।

কুরুক্ষেত্রের প্রথম দিনের যুদ্ধেই মহামহিম ভীষ্মর রথের ধ্বজা কেটে দেন এবং অসংখ্য কুরু সৈন্য নিহত করেন। ভীষ্ম অভিমন্যুর বীরত্ব দেখে দেখে উচ্চসিংত প্রশংসা করেন। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে অভিমন্যু দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণকে বধ করেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তের দিবস। কৌরবেরা (দ্রোণাচার্য কর্তৃক ব্যুহ রচনা) লুতাতন্তু অর্থাৎ মাকড়সার জালের মত এক দূর্ভেদ্য ব্যুহ রচনা করেন। ব্যূহের ভিতর কৌরবেরা সকলে অবস্থান নিলেন। ব্যূহ রক্ষার জন্য সম্মুখে জয়দ্রথ, তার পশ্চাতে দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা ও কর্ণ পার্শ্বস্থ রক্ষার জন্য, কৃপ, শাল্য ও ভগদত্ত ব্যূহের পশ্চাদ্ভাগ রক্ষার জন্য নিয়োজিত থাকলেন। কৌরব-পান্ডবদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। দ্রোণাচার্যের শরনিক্ষেপে পান্ডব সৈন্য সম্মুখ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। সৈন্যগণ সামনে অগ্রসর হতে পারছে না। ইহা দর্শন করে যুধিষ্ঠির চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে দ্রোণাচার্যের চক্রব্যুহ ভেদ করার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং এও জানালেন তুমি, শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন ব্যতীত কেহ এ ব্যুহ ভেদ করতে সমর্থ নয়। অভিমন্যু বললেন,“আপনি আমাকে এ অভেদ্য ব্যুহ ভেদ করার জন্য আজ্ঞা করছেন? এ সংকটময় মুর্হুতে আমি কি করে অগ্রসহ হতে পারি?” যুধিষ্ঠির বললেন,“তুমি শুধু আমাদের জন্য পথ করে দাও। তারপর আমি, ভীম ও অন্যান্য বীরেরা তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করব।” কিন্ত চক্রব্যুহ ভেদ করতে অভিমন্যুর মন সায় দিচ্ছিল না। জ্যেষ্ঠতাত যুধিষ্ঠির আদেশ ও উৎসাহে অভিমন্যু কৌরব সৈন্য ধ্বংস করার প্রয়াসে অগ্রসর হলেন। অভিমন্যু বললেন.“পতঙ্গ যেমন জলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, আমি সুভদ্রার পুত্র, শক্রকে অবশ্যই জয় করব। যদি শক্র সংহার করতে না পারি তবে অর্জুনের পুত্র বলে পরিচয় দেব না।” তারপর সারথিকে ব্যুহের মধ্যে প্রবেশের আদেশ দিলেন। পশ্চাতে পান্ডবপক্ষীয় সেনারা অভিমন্যুকে সাহায্য করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন কিন্তু জয়দ্রথ তাদেরকে প্রতিরোধ করাতে তারা অগ্রসর হতে পারছিলেন না। অভিমন্যু একাকী যুদ্ধ করে অসংখ্য কৌরব সেনা নিহত করলেন। তার শরাঘাতে শক্র সৈন্য বিচলিত হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল। কিন্তু অভিমন্যুর ব্রজসম শরাঘাতে কৌরব পক্ষীয় দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, ভুরিশ্রবা, কৃতবর্মা, বৃহদ্বল শকুনি সোমদত্ত কেহই তার নিকট দাড়াতে পারছিলেন না। সবাই রণে ভঙ্গ দিয়ে বুহ্য মধ্যে প্রবেশ করলেন। অভিমন্যু দ্রোণাচার্যের অভিমুখে রথ চালন করলেন কিন্তু কর্ণের সহিত তার যুদ্ধ শুরু হলো। অভিমন্যুর শরাঘাতে কর্ণের শরীর ক্ষত বিক্ষত হলো। কর্ণের এক ভ্রাতাও নিহত হলেন। শরের আঘাতে কর্ণকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে দূর করলেন।

জয়দ্রথ শিবের বরে অজেয় হয়ে পান্ডব বাহিনীকে প্রতিহত করলেন। অভিমন্যু কৌরব বাহিনীকে পরাজিত করে বুহ্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন কিন্তু জয়দ্রথের প্রভাবে পান্ডব বাহিনী অভিমন্যুকে অনুসরণ করতে পারলেন না। জয়দ্রথ যুধিষ্ঠির, ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ ও শিখন্ডী প্রভৃতির উপর শর বর্ষণ করতে লাগলেন। অভিমন্যু ব্যুহের মধ্যে প্রবেশের যে পথ তৈরী করেছিলেন জয়দ্রথ তা রূদ্ধ করে দিলেন। ফলে পান্ডবপক্ষীয় সেনারা ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলেন না।

কুরু সৈন্য বেষ্ঠিত হয়ে একাই অভিমন্যু কৌরব বাহিনীর সহিত মরণপন যুদ্ধ করতে লাগলেন। চক্রবুহ্যের যুদ্ধে অভিমন্যুর হাতে দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণ, শল্যপুত্র রুক্ষ্মরথ নিহত হলেন। পুত্র শোকে দুর্যোধন চিৎকার করে স্বপক্ষীয় যোদ্ধাদের বললেন.“আপনার অভিমন্যুকে বধ করুন।” মগধ-পুত্র শ্বেতকেতু, অশ্বকেতু, কুঞ্জরকেতুকে ধরাশায়ী করে দু:শাসন পুত্র উলূককে বধ করেন। এ সময় মদ্ররাজকেও পরাজিত করেন। শক্রঞ্জয়, চন্দ্রকেতু, মহামেঘ, সূবর্চ্চা ও সূর্য্যভাম নামে পঞ্চ বীরকেও নিহত করেন। আরও অনেক মহারথীরাও নিহত হন। ভূতলে অসংখ্য মৃত দেহ এবং এদের রক্তে ভূতল কর্দমাক্ত হয়ে উঠল। ইহা দর্শন করে কৌরব সৈন্যগণ ভীত হলেন। তখন কর্ণ দ্রোণাচার্যকে অভিমন্যু বধের উপার বের করার জন্য বলেন। দোণাচার্য বললেন,“ অর্জুনকে যে অভেদ্য কবচ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল; পিতার নিকট হতে অভিমন্যু তা শিক্ষা করে অজেয় হয়েছে। তাই অভিমন্যুকে বধ করতে হলে পূর্বে তার রথের সারথী ও অশ্বকে নিহত করতে হবে।” দ্রোণের পরামর্শ মত কর্ণ অভিমন্যুর ধনুক ছেদন করলেন, ভোজ অশ্বকে নিহন করলেন, কৃপ সারথির মস্তক ছেদন করলেন। বালক অভিমন্যু একাই রথ শুন্য হয়ে কৌরব সৈন্যগণের সহিত যুদ্ধ করতে লাগলেন।

দ্রোণাচার্য, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এ ছয় জন বীর অভিমন্যুকে বেষ্ঠন করেন। কোশলরাজ বৃহদ্বল আরও রাজা অভিমন্যুর হাতে নিহত হন। তখন কেহ একাকী অভিমন্যুর সহিত যুদ্ধ করতে সাহসী হলেন না। অবশেষে যুদ্ধের রীতি-নীতি বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে দ্রোণ, কৃপ, কণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও শকুনি এ ছয় যুদ্ধা যুগপৎ অভিমন্যুকে আক্রমণ করে অভিমন্যুর উপর শরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল। তাদের অসংখ্য শরের আঘাতে অভিমন্যুর দেহে হতে স্রোতের মত রক্ত প্রবাহিতে হলে লাগল। অভিমন্যু খড়গ ও চর্ম নিয়ে রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। দ্রোণ ক্ষুরপ্র অস্ত্রে অভিমন্যুর খড়গের মুষ্ঠি কেটে ফেললেন। অভিমন্যু চক্র নিয়ে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। চক্র ছিন্ন হলে গদা নিয়ে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। এতে অনেক কৌরব সেনা নিহত হলো। সবশেষে অভিমন্যুর সহিত দু:শাসন তনয়ের গদা যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ অভিমন্যুর পায়ের ভারসাম্য না রাথে পেরে ভূতলে পড়ে যান। ভূতল হতে উঠার মুর্হুতেই দু:শাসন পুত্র তার মস্তকে গদা দ্বারা সজোরে আঘাত করে, সে আঘাতেই অকুতোভয় অভিমন্যু ভূতলে পতিত হলেন। পিপাসার্ত, ক্লান্ত দেহ, অস্ত্রঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে বালক অভিমন্যু, বীর অভিমন্যু, নির্ভীক অভিমন্যু, সাহসী যুদ্ধা অভিমন্যু, অর্জুন-তনয় অভিমন্যু আর উঠলেন না। অন্যায় যুদ্ধে একজন বীরের মুত্যু হলো। পাপিষ্টরা আনন্দে অবগাহন করল। তবে অভিমন্যুর মৃত্যুতে গুরু দ্রোণাচার্য ও অঙ্গরাজ কর্ণকে ব্যাথিত করেছিল। কর্ণ অভিমন্যুকে যথার্থ মহাবীর বলে মনে করেন। অভিমন্যু আমৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন এবং অস্ত্র ত্যাগ করেননি। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর উত্তরার গর্ভে পরীক্ষিতের জন্ম হয়।
সূত্র: মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক উপাখ্যান

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র