শ্রীমদ্ভগবত গীতা একাদশ অধ্যায়

একাদশ অধ্যায় - বিশ্বরূপ-দর্শন যোগ

|অর্জুন উবাচ |
মদনুগ্রহায় পরমং গুহ্যমধ্যাত্মসংজ্ঞিতম্ |
যত্ত্বয়োক্তং বচস্তেন মোহোহয়ং বিগতো মম || ১ ||
অর্থ:: অর্জুন বললেন- আমার প্রতি অনুগ্রহ করে তুমি সে অধ্যাত্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় পরম গুহ্য উপদেশ আমাকে দিয়েছ, তার দ্বারা আমার এই মোহ দূর হয়েছে।
ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্রুতৌ বিস্তরশো ময়া |
ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মাহাত্ম্যমপি চাব্যয়ম্ || ২ ||
অর্থ: হে পদ্মপলাশলোচন! সর্বভূতের উৎপত্তি ও প্রলয় তোমার থেকেই হয় এবং তোমার কাছ থেকেই আমি তোমার অব্যয় মাহাত্ম্য অবগত হলাম।
এবমেতদ্ যথাত্থ ত্বমাত্মানং পরমেশ্বর |
দ্রষ্টুমিচ্ছামি তে রূপমৈশ্বরং পুরুষোত্তম || ৩ ||
অর্থ: হে পরমেশ্বর ! তোমার সম্বন্ধে যেরূপ বলেছ, যদিও আমার সম্মুখে তোমাকে সেই রূপেই দেখতে পাচ্ছি, তবুও হে পুরুষোত্তম! তুমি যেভাবে এই বিশ্বে প্রবেশ করেছ, আমি তোমায় সেই ঐশ্বর্যময় রূপ দেখতে ইচ্ছা করি।
মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো |
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্ || ৪ ||
অর্থ: হে প্রভু! তুমি যদি মনে কর যে, আমি তোমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করার যোগ্য, তা হলে হে যোগেশ্বর! আমাকে তোমার সেই নিত্যস্বরুপ দেখাও।
| শ্রীভগবানুবাচ |
পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ |
নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনি চ || ৫ ||
অর্থ: শ্রীভগবান বললেন- হে পার্থ! নানা বর্ণ ও নানা আকৃতি-বিশিষ্ট শত শত ও সহস্র সহস্র আমার দিব্য রূপসমূহ দর্শন কর।
পশ্যাদিত্যান্ বসূন রুদ্রানশ্বিনৌ মরুতস্তথা |
বহূন্যদৃষ্টপূর্বাণি পশ্যাশ্চর্যাণি ভারত || ৬ ||
অর্থ:হে ভারত! দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় , ঊনপঞ্চাশ মরুত এবং অনেক অদৃষ্টপূর্ব আশ্চর্য রূপ দেখ।
ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং পশ্যাদ্য সচরাচরম্ |
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুমিচ্ছসি || ৭ ||
অর্থ: হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবিস্থত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যা কিছূ দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন কর।
ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুমনেনৈব স্বচক্ষুষা |
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্ || ৮ ||
অর্থ:কিন্তু তুমি তোমার বর্তমান চক্ষুর দ্বারা আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে না। তাই, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। তুমি আমার অচিন্ত্য যোগৈশ্বর্য দর্শন কর।
|সঞ্জয় উবাচ |
এবমুক্ত্বা ততো রাজন মহাযোগেশ্বরো হরিঃ |
দর্শয়ামাস পার্থায় পরমং রূপমৈশ্বরম্ || ৯ ||
অর্থ: সঞ্জয় বললেন- হে রাজন্! এভাবেই মহান যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন।
অনেকবক্ত্রনয়নমনেকাদ্ভুতদর্শনম্ |
অনেকদিব্যাভরণং দিব্যানেকোদ্যতায়ুধম্ || ১০ ||
দিব্যমাল্যাম্বরধরং দিব্যগন্ধানুলেপনম্ |
সর্বাশ্চর্য়ময়ং দেবমনন্তং বিশ্বতোমুখম‌্ || ১১ ||
অর্থ: অর্জুন সেই বিশ্বরূপে অনেক মুখ, অনেক নেত্র ও অনেক অদ্ভূদ দর্শনীয় বস্তু দেখলেন। সেই রুপ অসংখ্য দিব্য অলঙ্কারে সজ্জিত ছিল এবং অনেক উদ্যত দিব্য অস্ত্র ধারণ করেছিল। সেই বিশ্বরূপ দিব্য মালা ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত ছিল এবং তাঁর শরীর দিব্য গন্ধ দ্বারা অনুলিপ্ত ছিল। সবই ছিল অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, জ্যোতির্ময়, অনন্ত ও সর্বব্যাপী।
দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদযুগপদুত্থিতা |
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ দ্ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ || ১২ ||
অর্থ: যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ উদিত হয়, তা হলে সেই মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তূল্য হতে পারে।
তত্রৈকস্থং জগৎ কৃত্স্নং প্রবিভক্তমনেকধা |
অপশ্যদ্দেবদেবস্য শরীরে পান্ডবস্তদা || ১৩ ||
অর্থ: তখন অর্জুন পরমেশ্বর ভগবানের বিশ্বরূপে নানাভাবে বিভক্ত সমগ্র জগৎ একত্রে অবস্থিত দেখলেন।
ততঃ স বিস্ময়াবিষ্টো হৃষ্টরোমা ধঞ্জজয়ঃ |
প্রণম্য শিরসা দেবং কৃতাঞ্জলিরভাষত || ১৪ ||
অর্থ:তারপর সেই অর্জুন বিস্মিত ও রোমঞ্চিত হয়ে এবং অবনত মস্তকে ভগবানকে প্রণাম করে করজোড়ে বলতে লাগলেন।
| অর্জুন উবাচ |
পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান |
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থমঋষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্ || ১৫ ||
অর্থ:অর্জুন বললেন- হে দেব! তোমার দেহে দেবতাদের, বিবিধ প্রাণীদের, কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।
অনেকবাহূদরবক্ত্রনেত্রং পশ্যামি ত্বাং সর্বতোহনন্তরূপম্ |
নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ || ১৬ ||
অর্থ: হে বিশ্বেশ্বর! হে বিশ্বরুপ! তোমার দেহে অনেক বাহু, উদর, মুখ এবং সর্বত্র অনন্ত রুপ দেখছি। আমি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
কিরীটিনং গদিনং চক্রিণং চ তেজোরাশিং সর্বতো দীপ্তিমন্তম্ |
পশ্যামি ত্বাং দুর্নিরীক্ষ্যং সমন্তাদ্দীপ্তানলার্কদ্যুতিমপ্রমেয়ম্ || ১৭ ||
অর্থ:কিরীট শোভিত, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিমান, তেজ:পুঞ্জ-স্বরুপ, দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের মতো প্রভাবিশিষ্ট এবং অপ্রমেয় স্বরুপ তোমাকে আমি সর্বত্রই দেখছি।
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্ |
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে || ১৮ ||
অর্থ: তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি অব্যয়, সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত।
অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীর্যম অনন্তবাহুং শশিসূর্যনেত্রম্ |
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবক্ত্রং স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তম্ || ১৯ ||
অর্থ : আমি দেখছি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত নেই। তুমি অনন্ত বীর্যশালী ও অসংখ্য বাহুবিশিষ্ট এবং চন্দ্র ও সূর্য তোমার চক্ষুদ্বয়। তোমার মুখমন্ডলে প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতি এবং তুমি স্বীয় তেজে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করছ।
দ্যাবাপৃথিব্যোরিদমন্তরং হি ব্যাপ্তং ত্বয়ৈকেন দিশশ্চ সর্বাঃ |
দৃষ্ট্বাদ্ভুতং রূপমুগ্রং তবেদং লোকত্রয়ং প্রব্যথিতং মহাত্মন্ || ২০ ||
অর্থ:তুমি একাই স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষ ও দশদিক পরিব্যাপ্ত করে আছ। হে মহাত্মন্! তোমার এই অদ্ভূত ও ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ত্রিলোক অত্যন্ত ভীত হচ্ছে।
অমী হি ত্বাং সুরসঙ্ঘা বিশন্তি কেচিদ্ভীতাঃ প্রাঞ্জলয়ো গৃণন্তি |
স্বস্তীত্যুক্ত্বা মহর্ষিসিদ্ধসংঘাঃ স্তুবন্তি ত্বাং স্তুতিভিঃ পুষ্কলাভিঃ || ২১ ||
অর্থ:সমস্ত দেবতারা তোমার শরণাগত হয়ে তোমাতেই প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোড়ে তোমার গুণগান করছেন। মহর্ষি ও সিদ্ধেরা ' জগতের কল্যাণ হোক ' বলে প্রচুর স্তুতি বাক্যের দ্বারা তোমার স্তব করছেন।
রুদ্রাদিত্যা বসবো য়ে চ সাধ্যা বিশ্বেহশ্বিনৌ মরুতশ্চোষ্মপাশ্চ |
গন্ধর্বযক্ষাসুরসিদ্ধসংঙ্ঘা বীক্ষন্তে ত্বাং বিস্মিতাশ্চৈব সর্বে || ২২ ||
অর্থ: রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, সাধ্য নামক দেবতারা, বসুগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিকুমারদ্বয়, মরুতগণ, পিতৃগণ, গন্ধর্বগণ, যক্ষগণ, অসুরগণ ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্মৃত হয়ে তোমাকে দর্শন করছে।
রূপং মহত্তে বহুবক্ত্রনেত্রং মহাবাহো বহুবাহূরুপাদম্ |
বহূদরং বহুদংষ্ট্রাকরালং দৃষ্ট্বা লোকাঃ প্রব্যথিতাস্তথাহম্ || ২৩ ||
অর্থ: হে মহাবাহো! বহু মুখ, বহু চক্ষু, বহু বাহু, বহু উরু, বহু চরণ, বহু উদর ও অসংখ্য করাল দন্তবিশিষ্ট তোমার বিরাটরুপ দর্শন করে সমস্ত প্রাণী অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছে এবং আমিও অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছি।
নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্ |
দৃষ্ট্বা হি ত্বাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো || ২৪ ||
অর্থ: হে বিষ্ণু! তোমার আকাশস্পর্শী, তেজোময়, বিবিধ বর্ণযুক্ত, বিস্তৃত মুখমন্ডল ও উজ্জ্বল আয়ত চক্ষুবিশিষ্ট তোমাকে দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমি ধৈর্য ও শান্তি পাচ্ছি না।
দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্ট্বৈব কালানলসংনিভানি |
দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস || ২৫ ||
অর্থ: হে দেবেশ! হে জগন্নিবাস! ভয়ংকর দন্তযুক্ত ও প্রলয়াগ্নি তুল্য তোমার মুখমন্ডল দেখে আমার দিকভ্রম হচ্ছে এবং আমি শান্তি পাচ্ছি না। তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
অমী চ ত্বাং ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ সর্বে সহৈবাবনিপালসংঘৈঃ |
ভীষ্মো দ্রোণঃ সূতপুত্রস্তথাসৌ সহাস্মদীয়ৈরপি যোধমুখ্যৈ: || ২৬ ||
বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি দংষ্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি |
কেচিদ্বিলগ্না দশনান্তরেষু সংদৃশ্যন্তে চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ || ২৭ ||
যথা নদীনাং বহবোহম্বুবেগাঃ সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি |
তথা তবামী নরলোকবীরা বিশন্তি বক্ত্রাণ্যভিবিজ্বলন্তি || ২৮ ||
যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতংগা বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ |
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকাস্তবাপি বক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ || ২৯ ||
লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তাল্লোকান্ সমগ্রান্ বদনৈর্জ্বলদ্ভিঃ |
তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো || ৩০ ||
অর্থ: ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা, তাদের মিত্র সমস্ত রাজন্যবর্গ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং আমাদের পক্ষের সমস্ত সৈন্যরা তোমার করাল দন্তবিশিস্ট মুখের মধ্যে দ্রুতবেগে প্রবেশ করছে এবং সেই দন্তমধ্যে বিলগ্ন হয়ে তাদের মস্তক চূর্ণিত হচ্ছে। নদীসমূহ যেমন সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করে, তেমনই নরলোকের বীরগণ তোমার জলন্ত মুখব্বিরে প্রবেশ করছে। পতঙ্গগণ যেমন দ্রুত গতিতে ধাবিত হয়ে মরণের জন্য জলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, তেমনই এই লোকেরাও মৃত্যুর জন্য অতি বেগে তোমার মুখব্বিরে প্রবেশ করছে। হে বিষ্ণু! তুমি তোমার জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা সকল লোককে গ্রাস করছ এবং তোমার তেজোরাশি দ্বারা সমগ্র জগৎকে আবৃত করে সন্তপ্ত করছ।
আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপো নমোহস্তু তে দেববর প্রসীদ |
বিজ্ঞাতুমিচ্ছামি ভবন্তমাদ্যং ন হি প্রজানামি তব প্রবৃত্তিম্ || ৩১ ||
অর্থ: উগ্রমূর্তি তুমি কে, কৃপা করে আমাকে ভল। হে দেবশ্রষ্ঠ! তোমাকে নমস্কার করি, তুমি প্রসন্ন হও। তুমি হচ্ছ আদিপুরুষ। আমি তোমার প্রবৃত্তি অবগত নই, আমি তোমাকে বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
| শ্রীভগবানুবাচ |
কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ |
ঋতেহপি ত্বাং ন ভবিষ্যান্তি সর্বে যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ || ৩২ ||
অর্থ:শ্রীভগবান বললেন- আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল এবং এই সমস্ত লোক সংহার করতে এক্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছি। তোমরা (পান্ডবেরা) ছাড়া উভয়-পক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধারাই নিহত হবে।
তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব জিত্বা শত্রূন্ ভূঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্ |
ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্ || ৩৩ ||
অতএব, তুমি যুদ্ধ করার জন্য উত্থিত হও, যশ লাভ কর এবং শত্রু দের পরাজিত করে সমৃদ্ধশালী রাজ্য ভোগ কর। আমার দ্বারা এরা পূর্বেই নিতহ তয়েছে। হে সব্যসাচী! তুমি নিমিত্ত মাত্র হও।
দ্রোণং চ ভীষ্মং চ জয়দ্রথং চ কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান্ |
ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠা য়ুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান্ || ৩৪ ||
অর্থ : ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য যুদ্ধ বীরগণ পূর্বেই আমার দ্বারা নিহত হয়েছে। সুতরাং তুমি তাদেরই বধ কর এবং বিচলিত হয়ো না। তুমি যুদ্ধে শত্রু দের নিশ্চয়ই জয় করবে, অতএব যুদ্ধ কর।
| সঞ্জয় উবাচ |
এতচ্ছ্রুত্বা বচনং কেশবস্য কৃতাঞ্জলির্বেপমানঃ কিরীটী |
নমস্কৃত্বা ভূয় এবাহ কৃষ্ণং সগদ্গদং ভীতভীতঃ প্রণম্য || ৩৫ ||
অর্থ:সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন- হে রাজন্! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী শ্রবণ করে অর্জুন অত্যন্ত ভীত হয়ে কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলিপূটে প্রণাম করে গদ্গদ বাক্যে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন।
| অর্জুন উবাচ |
স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্যা জগৎ প্রহৃষ্যত্যনুরজ্যতে চ |
রক্ষাংসি ভীতানি দিশো দ্রবন্তি সর্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসংঘাঃ || ৩৬ ||
অর্থ:অর্জুন বললেন- হে হৃষীকেশ! তোমার মহিমা কীর্তনে সমস্ত জগৎ প্রহৃষ্ট হয়ে তোমার প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। রাক্ষসেরা ভীহ হয়ে নানা দিকে পলায়ন করছে এবং সিদ্ধরা তোমাকে নমষ্কার করছে। এই সমস্তই যুক্তিযুক্ত।
কস্মাচ্চ তে ন নমেরন্মহাত্মন্ গরীয়সে ব্রহ্মণোহপ্যদিকর্ত্রে |
অনন্ত দেবেশ জগন্নিবাস ত্বমক্ষরং সদসত্তত্পরং যৎ || ৩৭ ||
অর্থ: হে মহাত্ম! তুমি এমন কি ব্রহ্মা থেকেও শ্রেষ্ঠ এবং আদি সৃষ্টিকর্তা। সকলে তোমাকে কেন নমষ্কার করেবেন না। হে অনন্ত! হে দেবেশ! হে জগন্নিবাস! তুমি সৎ ও অসৎ উভয়ের অতীত অক্ষরতত্ত্ব ব্রহ্ম।
ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণস্ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্ |
বেত্তাসি বেদ্যং চ পরং চ ধাম ত্বয়া ততং বিশ্বমনন্তরূপ || ৩৮ ||
অর্থ: তুমি আদি দেব, পুরাণ পুরুষ এবং এই বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি সব কিছুর জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞেয় এবং তুমিই গুণাতীত পরম ধামস্বরুপ। হে অনন্তরূপ! এই জগৎ তোমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।
বায়ুর্যমোহগ্নির্বরুণঃ শশাঙ্কঃ প্রজাপতিস্ত্বং প্রপিতামহশ্চ |
নমো নমস্তেহস্তু সহস্রকৃত্বঃ পুনশ্চ ভূয়োহপি নমো নমস্তে || ৩৯ ||
অর্থ: তুমিই বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র, প্রজাপতি ব্রহ্মা ও প্রপিতামহ। অতএব, তোমাকে আমি সহস্রবার প্রণাম করি, পুনরায় নমস্কার করি এবং বারবার নমস্কার করি।
নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোহস্তু তে সর্বত এব সর্ব |
অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্ত্বং সর্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্বঃ || ৪০ ||
অর্থ: হে সর্বাত্মা! তোমাকে সম্মুখে, পশ্চাতে ও সমস্ত দিক থেকেই নমস্কার করছি। হে অনন্তবীর্যঙ! তুমি অসীম বিক্রমশালী। তুমি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত, অতএব তুমিই সর্ব-স্বরুপ।
সখেতি মত্বা প্রসভং যদুক্তং হে কৃষ্ণ হে যাদব হে সখেতি |
অজানতা মহিমানং তবেদং ময়া প্রমাদাৎ প্রণয়েন বাপি || ৪১ ||
যচ্চাবহাসার্থমসত্কৃতোহসি বিহারশয্যাসনভোজনেষু |
একোহথবাপ্যচ্যুত তত্সমক্ষং তত্ক্ষাময়ে ত্বামহমপ্রমেয়ম্ || ৪২ ||
অর্থ: তোমার মহিমা না জেনে, সখা মনে করে তোমাকে আমি প্রগল্ভাবে " হে কৃষ্ণ" " হে যাদব" " হে সখা" বলে সম্বোধন করেছি। প্রমাদবশত অথবা প্রণয়বশত আমি যা কিছু করেছি তা তুমি দয়া করে ক্ষমা কর। বিহার, শয়ন, উপবেশন ও ভোজনের সময় কখন একাকী এবং কখন বন্ধুদের সমক্ষে আমি যে তোমাকে অসম্মান করেছি, হে অচ্যুত! আমার সে সমস্ত অপরাধের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
পিতাসি লোকস্য চরাচরস্য ত্বমস্য পূজ্যশ্চ গুরুর্গরীয়ান্ |
ন ত্বত্সমোহস্ত্যভ্যধিকঃ কুতোহন্যো লোকত্রয়েহপ্যপ্রতিমপ্রভাব || ৪৩ ||
অর্থ: হে অমিত প্রভাব! তুমি এই চরাচর জগতের পিতা, পূজ্য, গুরু ও গুরুশ্রেষ্ঠ। ত্রিভূবনে তোমার সমান আর কেউ নেই, অতএব তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে?
তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং প্রসাদয়ে ত্বামহমীশমীড্যম্ |
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যু প্রিয়ঃ প্রিয়ায়ার্হসি দেব সোঢ়ুম্ ||৪৪ ||
অর্থ:তুমি সমস্ত জীবের পরমপূজ্য পরমেশ্বর ভগবান। তাই, আমি তোমাকে দন্ডবৎ প্রণাম করে তোমার কৃপাভিক্ষা করছি। হে দেব! পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রেমিক যেমন প্রিয়ার অপারাধ ক্ষমা করেন, তুমিও সেভাবেই আমার অপরাধ ক্ষমা করতে সমর্থ।
অদৃষ্টপূর্বং হৃষিতোহস্মি দৃষ্ট্বা ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে |
তদেব মে দর্শয় দেব রূপং প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস || ৪৫ ||
অর্থ:তোমার এই বিশ্বরূপ যা পূর্বে কখনও দেখিনি, তা দর্শন করে আমি আনন্দিত হয়েছি, কিন্তু সেই সংগে আমার মন ভয়ে ব্যথিত হয়েছে। তাই, হে দেবেশ! হে জগন্নিবাস! আমার প্রতি প্রসন্ন হও এবং পুনরায় তোমার সেই রুপই আমাকে দেখাও।
কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্তমিচ্ছামি ত্বাং দ্রষ্টুমহং তথৈব |
তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন সহস্রবাহো ভব বিশ্বমূর্তে || ৪৬||
অর্থ:হে বিশ্বমূতি! হে মহাবাহো! আমি তোমাকে পূর্ববৎ সেই কিরীট, গদা ও চক্রধারীরুপে দেখতে ইচ্ছা করি। এখন তুমি তোমার সেই চতুর্ভুজ রুপ ধারণ কর।
|শ্রীভগবানুবাচ |
ময়া প্রসন্নেন তবার্জুনেদং রূপং পরং দর্শিতমাত্মযোগাৎ |
তেজোময়ং বিশ্বমনন্তমাদ্যং যন্মে ত্বদন্যেন ন দৃষ্টপূর্ব্ || ৪৭ ||
অর্থ: শ্রীভগবান বললেন- হে অর্জুন! আমি প্রসন্ন হয়ে তোমাকে আমার অন্তরঙ্গা শক্তি দ্বারা জড় জগতের অন্তর্গত এই শ্রেষ্ঠ রুপ দেখালাম। তুমি ছাড়া পূর্বে আর কেউই এই অনন্ত, আদি ও তেজোময় রুপ দেখেনি।
ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্ন দানৈর্ন চ ক্রিয়াভির্ন তপোভিরুগ্রৈঃ |
এবংরূপঃ শক্য অহং নৃলোকে দ্রষ্টুং ত্বদন্যেন কুরুপ্রবীর || ৪৮ ||
অর্থ:হে কুরুশ্রেষ্ঠ! বেদ অধ্যায়ন, যজ্ঞ, দান, পূণ্যকর্ম ও কঠোর তপস্যার দ্বারা এই জড় জগতে তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার এই বিশ্বরূপ দর্শন করতে সমর্থ নয়।
মা তে ব্যথা মা চ বিমূঢ়ভাবো দৃষ্ট্বা রূপং ঘোরমীদৃঙ্ মমেদম্ |
ব্যপেতভীঃ প্রীতমনাঃ পুনস্ত্বং তদেব মে রূপমিদং প্রপশ্য || ৪৯ ||
অর্থ:আমার এই প্রকার ভয়ংকর বিশ্বরুপ দেখে তুমি ব্যথিত ও মোহাচ্ছন্ন হয়ো না। সমস্ত ভয় থেকে মুক্ত হয়ে এবং প্রসন্ন চিত্তে তুমি পুনরায় আমার এই চতুর্ভুজ রুপ দর্শন কর।
| সঞ্জয় উবাচ |
ইত্যর্জুনং বাসুদেবস্তথোক্ত্বা স্বকং রূপং দর্শয়ামাস ভূয়ঃ |
আশ্বাসয়ামাস চ ভীতমেনং ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা || ৫০ ||
অর্থ:সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন- মহাত্মা বাসুদেব অর্জুনকে এভাবেই বলে তাঁর চতুর্ভুজ রূপ দেখালেন এবং পুনরায় দ্বিভূজ সৌম্যমূর্তি ধারণ করে ভীত অর্জুনকে আশ্বস্ত করলেন।
| অর্জুন উবাচ |
দৃষ্ট্বেদং মানুষং রূপং তব সৌম্যং জনার্দন |
ইদানীমস্মি সংবৃত্তঃ সচেতাঃ প্রকৃতিং গতঃ || ৫১ ||
অর্থ:অর্জুন বললেন- হে জনার্দন! তোমার এই সৌম্য মানুষমূর্তি দর্শন করে এখন আমার চিত্ত স্থির হল এবং আমি প্রকৃতিস্থ হলাম।
| শ্রীভগবানুবাচ |
সুদুর্দর্শমিদং রূপং দৃষ্টবানসি যন্মম |
দেবা অপ্যস্য রূপস্য নিত্যং দর্শনকাঙ্ক্ষিণঃ || ৫২ ||
অর্থ:পরমেশ্বর ভগবান বললেন- তুমি আমার যে রুপ এখন দেখছ তা অত্যন্ত দুর্লভ দর্শন। দেবতারাও এই রূপের সর্বদা দর্শনাকাঙ্খী
নাহং বেদৈর্ন তপসা ন দানেন ন চেজ্যয়া |
শক্য এবংবিধো দ্রষ্টুং দৃষ্টবানসি মাং যথা || ৫৩ ||
অর্থ:তুমি তোমার দিব্য চক্ষুর দ্বারা আমার যেরূপা দর্শন করছ, সেই প্রকার আমাকে বেদ অধ্যয়ণ, তপস্যা, দান ও পূজার দ্বারা কেউই দর্শন করতে সমর্থ হয় না।
ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন |
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরংতপ || ৫৪ ||
অর্থ:হে অর্জুন! হে পরন্তপ! অনন্য ভক্তির দ্বারাই কিন্তু এই প্রকার আমাকে তত্ত্বত জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।
মত্কর্মকৃন্মত্পরমো মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ |
নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু য: স মামেতি পান্ডব || ৫৫ ||
অর্থ:হে অর্জুন! যিনি আমার অকৈতব সেবা করেন, আমার প্রতি নিষ্ঠাপরায়ণ, আমার ভক্ত, জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত এবং সমস্ত প্রাণীর প্রতি শক্রভাব রহিত, তিনিই আমাকে লাভ করেন।
ইতি-শ্রীমদ্ভগবতগীতার একাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র