বেদের শাখা-প্রশাখা

বেদ অপৌরুষেয় এবং অভ্রান্ত এ কথা সকল শাস্ত্রেই বলা হয়েছে। শ্রুতিরূপে এ বিদ্যা আমাদের কাছে এসেছে। এ জন্য ঋষিদের কাছে আমরা ঋণি। কিন্তু কালের কাছে আমাদের হার মানতে হয়েছে। বেদের অসংখ্যা শাখা-প্রশাখা রচিত হয়েছিল, বেদকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। ঋকবেদের ২১ শাখা (বর্তমানে শাকল নামে একটি শাখা আছে), যজুর্বেদের ১০৯ শাখা, সামবেদের ১০০০ শাখা এবং অথর্ববেদের ৫০ শাখাসহ মোট ১১৮০টি শাখা ছিল। কিন্তু ঐ যে কালের আবর্তে অধিকাংশ শাখা-প্রশাখা আজ বিলুপ্ত । তথাপিও যা আমাদের আছে তাও মহামূল্যবান। এক এক বেদের বিষয় পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করলে কোন বেদ কিভাবে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছিল তা উপলদ্ধি করা সহজ হবে। শাখা বলতে বেদের কোন অংশ বিশেষকে বুঝায় না। এক এক শাখা বলতে এক এক সংস্করণ বুঝায়। যে কোন বেদের একটি শাখা পড়লেই ঐ বেদের সম্পূর্ণ অংশই পঠিত হয়।

ঋকবেদ সংহিতা
ঋকবেদ সংহিতায় মন্ডল, অধ্যায়, সূক্ত, অষ্টক, বর্গ ও অনুবাক এ ছয়টি ভাগে বিভক্ত। এ বিষয়টি পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তথাপি আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে পুন: আলোচনা করা যেতে পারে। ঋকবেদের এক একটি শ্লোক বা মন্ত্রকেই ‘ঋক’ বলা হয়। কয়েকটি বেদমন্ত্র একত্রে মিলে একটি সূক্তের সৃষ্টি করে। ঐ সূক্তে এক একজন দেবতার স্তবস্তুতি করা হয়। আবার একই সূক্তে কয়েকজন দেবতার স্তুতিও দেখতে পাওয়া যায়। দশটি ঋক একত্র থাকলে তাকে মহাসূক্ত বলা হয়, পাঁটটি ঋক একত্র থাকলে তাকে ক্ষুদ্রসূক্ত বলা হয়। আবার পাঁচের অধিক এবং দশের বেশী নয় এমন মন্ত্র বিশিষ্ট ঋককে মধ্যম সূক্ত বলা হয়। যে ঋষি যে সূক্তের প্রবর্তক সে সূক্তে তার নাম জুরে দেয়া আছে। এ সূক্তগুলি আবার ঋষিসূক্ত, দেবতাসূক্ত ও ছন্দ:সূক্ত নামে অন্তর্ভূক্ত। যেমন-ঋষিসূক্ত বলতে বুঝায় সূক্তগুলি যে ঋষির নামে প্রবর্তিত। যেমন- ঋকবেদের প্রথম কয়েকটি সূক্তে মধুছন্দা খষির নাম দেখতে পাওয়া যায়। তার অর্থ হচ্ছে ঐ সূক্ত কয়টি ঋষিসূক্ত নামে অভিহিত। দেবতা-সূক্ত বলতে দেবতার স্তবস্তুতিমূলক কর্মকান্ড বুঝায়। যেমন- অগ্নিদেবতার স্তুতিমূলক সূক্ত আগ্নেয়-সূক্ত। ছন্দ:সূক্ত বলতে একসূত্রে একছন্দে বিরচিত পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত সূক্তকে বুঝায়। যেমন- ঋকবেদের ১ম মন্ডলে ৪র্থ হতে ৯ম সূক্ত কয়টি গায়ত্রীছন্দে বিরচিত। তাই ইহাকে ছন্দ:সূক্ত বলা হয়। কতকগুলো সূক্ত নিয়ে একটি ‘অনুবাক’এবং কয়েকটি অনুবাক নিয়ে একটি ‘মন্ডল’হয়। শাস্ত্রে আছে- তত্তদৃষিদৃষ্টাণাং বহুনাং সূক্তানামেকর্ষিকৃতঃ সংগ্রহো মন্ডলং। অর্থাৎ বহুসংখ্যক ঋষির পরিদৃষ্ট মন্ত্রসমূহ একজন ঋষি কর্তৃক একত্রে সংগৃহীত হয়ে এক একটি মন্ডলের সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ এক একজন ঋষিবংশের ঋকগুলি এক এক মন্ডলে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। যে দশজন ঋষি দশটি মন্ডল সংগ্রহ করেছিলেন আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে ঐ দশজন ঋষির নাম উল্লেখ আছে। বর্গ অর্থ স্বজাতীয়সমূহ বুঝায়। এর এরূপ অর্থ হতে পারে এক এক জাতীয় ঋকসমূহ এক এক বর্গের মধ্যে স্থান পেয়েছে। বেদের অধ্যায় ভাগে এক এক দেবতার স্তবস্তুতি পরিলক্ষিত হয়। ঋষিগণ আপন আপন কার্যসমূহ সম্পন্ন করার জন্য অধ্যয়ন ও অনুষ্ঠান ভেদে সমগ্র ঋকবেদকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। অধ্যয়নের সুবিধার্থে ঋকবেদকে ৮টি অষ্টক, ৬৪টি অধ্যায় ও ১০২৪টি বর্গে এবং অনুষ্ঠানের জন্য ১০টি মন্ডল, ১০১৭টি সূক্ত ও ১০৫৭২টি ঋকে বিভক্ত করেন। আধুনিককালে আমরা পুস্তকের যে বিভাগাদি (পরিচ্ছেদ, অধ্যায়, খন্ড ইত্যাদি) দেখতে পাই তা ঐ বেদের বিভাগেরই আদিরূপ বলে মনে করা হয়। শৌনক মুনির মতানুসারে ঋকবেদের ৫টি শাখা। যথা- আশ্বলায়ন, শাকল, বাস্কল, সাঙ্খ্যায়ন ও মান্ডুক। অতীব দু:খের বিষয় মানব সমাজের জন্য এই যে অধ্যাত্মিক সম্পদ আজ প্রায় বিলুপ্ত। এখন মাত্র ঋকবেদের একটি শাখাই আমাদের সম্পদ। তার নাম শাকল। শাকল শাখায় কবিতার সংখ্যা ১৫,৩৮১টি। ঋকবেদের মন্ত্র বা সংহিতা অংশ ব্যতীত ব্রাহ্মণ, আর‌ণ্যক ও উপনিষৎ অংশ রয়েছে। ঋকবেদের দুটি ব্রাহ্মণ। মহিদাস নামক জনৈক ঋষি ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং কুষিতক নামক ঋষি কৌষিতকি ব্রাহ্মণের প্রণেতা। তেমনি ঐতরেয় আরণ্যকও ঋকবেদের আরণ্যক এবং ঐতরেয় উপনিষৎও ঋকবেদের উপনিষৎ।

সামবেদ সংহিতা
সামবেদ সংহিতা সম্পর্কে মতান্তর আছে। অন্যান্য বেদের ন্যায় সামবেদের সহস্রাধিক শাখা ছিল। সামবেদের মন্ত্র গানাত্মক। অর্থাৎ রীতি অনুসারে যজ্ঞ সম্পাদনের সময় ঋক বা মন্ত্র উচ্চারণ না করে সুরাকারে গীত হতো। সাতটি শাখার নাম জানা যায়। যথা- কৌথুমী, রাণ্যায়ণ, শাট্যমুগ্র, কাপোল, মহাকাপোল, লাঙ্গালিক ও শার্দুলীয়। বর্তমানে কৌথুমী শাখা (যার প্রবর্ত্তক কৌথুম ঋষি) ও রাণ্যায়ণ শাখা (যার প্রবর্ত্তক রাণ্যায়ণী ঋষি) পরিচয় পাওয়া যায়। সামবেদের ব্রাহ্মণ ৮টি। যথা- সামবিধান, মন্ত্রমহাব্রাহ্মণ, আর্যেয়, বংশ, বেদতাধ্যায়, তলবকার, তান্ডব ও সংহিতোপনিষৎ। সামবেদের উপনিষৎ দুটি। যথা- ছান্দোগ্য ও কেন উপনিষৎ। সামবেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৮৯৩। সামবেদ আবার দুভাগে বিভক্ত। পূর্বার্চিক ও উত্তরার্চিক। পূর্বার্চিক আবার চার কান্ডে বিভক্ত। চারটি কান্ড ছয় প্রপাঠক বা পাঁচ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রপাঠকগুলি অর্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। একুশটি অধ্যায় নিয়ে উত্তরার্চিক গঠিত। এতে ৯টি প্রপাঠক আছে। প্রপাঠকগুলিতে অর্ধ প্রপাঠক আছে। কোন দশতি নেই কিন্তু সূক্ত আছে। সামবেদে সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব আলোচনা, আছে ব্রহ্ম বিষয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ও এর উত্তর।

যজুর্বেদ সংহিতা
মন্ত্রভাগ ও ব্রাহ্মণভাগ মিলে যজুর্বেদে মোট ১৮,০০০ মন্ত্র আছে । সমগ্র যজুবেদ ৪০টি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং ২৮৬টি অনুবাক এবং অনেক কান্ডিকা আছে। যজুর্বেদ দুটি ভাগে বিভক্ত। কৃষ্ণ-যজুর্বেদ ও শুক্ল-যজুর্বেদ। কৃষ্ণ-যজুর্বেদকে ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ও শুক্ল-যজুর্বেদকে ‘বাজসনেয়ী সংহিতা’নামে অভিহিত করা হয়। যজুর্বেদেরও অনেক শাখা ছিল। বেশীর ভাগই আজ বিলুপ্ত (কারো মতে ১০৯, কারো মতে ১০০ আবার কারো মতে ৮৬ টি শাখা ছিল)। যজুর্বেদের মন্ত্রভাগ তৈত্তিরীয় সংহিতা নামে পরিচিত। ইহাতে সাতটি অষ্টক আছে । প্রতি অষ্টকে পাঁচ হতে আট পর্যন্ত অধ্যায় আছে। প্রতি অধ্যায়ে বহু অনুবাক আছে। অনুবাকের সংখ্যাও প্রায় ৬০০ অধিক। কান্ড এবং প্রশ্ন অনুসারে যজুর্বেদ দুই ভাগে বিভক্ত। যজুর্বেদে অষ্টকের পরিবর্তে কান্ড এবং অধ্যায়ের পরিবর্তে প্রশ্ন আছে। বর্তমানে মাত্র ৩টি শাখা প্রচলিত আছে। তৈত্তিরীয়, মাধ্যন্দিন ও কাণ্ব শাখা। তৈত্তরীয় সংহিতার চারটি ব্রাহ্মণ। যথা- তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, বল্লভী ব্রাহ্মণ, সত্যায়ণী ব্রাহ্মণ ও মৈত্রায়ণীয় ব্রাহ্মণ। ইহার আরণ্যকের নাম হচ্ছে তৈত্তিরীয় আরণ্যক। তৈত্তরীয় আরণ্যকের বেশ কয়েকটি উপনিষৎ আছে। যথা- তৈত্তরীয় উপনিষৎ, নারায়ণী উপনিষৎ, কঠ উপনিষৎ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ব্রহ্মোপনিষৎ ও কৈবল্য উপনিষৎ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে শুক্ল-যজুর্বেদ সংহিতাকে বাজসনেয়ী সংহিতা নামে অভিহিত করা হয়। ইহার দুটি শাখা- মাধ্যন্দিন ও কাণ্ব। ইহা ব্যতীত আরও কয়েকটি শাখা আছে। শৃক্ল-যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম শতপথ ব্রাহ্মণ। ইহার প্রণেতা যাজ্ঞবল্ক্য মুনি। ইহাই সমধিক প্রসিদ্ধ। ইহার আরণ্যকের নাম হচ্ছে শতপথ আরণ্যক। ইহার উপনিষৎ হচ্ছে দুটি। যথা- বৃহদারণ্যক ও্র ঈশ উপনিষৎ। যজুর্বেদ প্রধানত: যাগ-যজ্ঞের কর্মকান্ড নির্ভর। অশ্বমেধ যজ্ঞ, পুরুষমেধ যজ্ঞ, পিতৃমেধ যজ্ঞ, রাজসূয় যজ্ঞ, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞের পরিচয় পাওয়া যায়।

অথর্ববেদ সংহিতা
ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ হতে অথর্ববেদ কিছুটা ভিন্নতর। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে ঋক বা মন্ত্রসমূহ যজ্ঞে ব্যবহৃত হয় না, সেই মন্ত্রগুলিকে অথর্ববেদে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কারো মতে অথর্ব ও অঙ্গিরা ঋষির বংশধর এ কাজটি করেছিলেন। কারো মতে ভৃগু মুনি বংশধরগণ এ কাজটি করেছিলেন। অথর্বেদের শাখা সম্পর্কে মতান্তর লক্ষ্যনীয়। কারো মহত পঞ্চাশটি শাখা, কারো মতে নয়টি শাখা আবার কারো মতে পাঁচটি শাথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে শৌনক শাখা ব্যতীত আর কোন শাখার পরিচয় পাওয়া যায়নি। অথর্বেদের মাত্র গোপথ নামে একটি ব্রাহ্মণ আছে। অথর্বেদের উপনিষৎ এর নাম মুন্ডক, মান্ডুক্য ও প্রশ্ন। অথর্বেদে বিশটি কান্ড আছে। কান্ডগুলি ৩৪৯টি প্রপাঠকে বিভক্ত। এতে ১১১টি অনুবাক, ৭৭টি বর্গ ও ৭৩১টি সূক্ত আছে। এতে ৫৮১৫টি ঋক বা মন্ত্র আছে (চলবে)।

ConversionConversion EmoticonEmoticon

:)
:(
=(
^_^
:D
=D
=)D
|o|
@@,
;)
:-bd
:-d
:p
:ng

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র