মহাভারত:বিরাটপর্ব-০১১-০১৫

১১. দ্রৌপদীকে দেখিয়া পুরজনের ভয়
বন্ধন হইতে মুক্ত কৈল বৃকোদর।
স্নানান্তে দ্রৌপদী যান আপনার ঘর।।
চতুর্দ্দিকে আছিল যতেক লোকজন।
কৃষ্ণারে দেখিয়া ভয়ে পলায় তখন।।
সিংহে দেখি যথা অজা ধায় দড়বড়ি।
একের উপরে ভয়ে কেহ যায় পড়ি।।
প্রাচীন অথর্ব্ব লোক যাইতে নারিল।
অধোমুখে ভুমি ধরি বস্ত্রে আচ্ছাদিল।।
সবে বলে, কেহ নাহি চাও উহা পানে।
এখনি গন্ধর্ব্ব-হাতে মরিবে পরাণে।।
এত বলি সব লোক করে কানাকানি।
হেথায় রন্ধনগৃহে গেল ‍যাজ্ঞসেনী।।
দাণ্ডাইয়া ছিল তথা বীর বৃকোদর।
প্রণাম করিল দেবী যুড়ি দুই কর।।
গন্ধর্ব্ব রাজার পায়ে মম নমস্কার।
যে মোরে সঙ্কট হৈতে করিল নিস্তার।।
ভীম বলে, যেই জন আশ্রিত যাহার।
অবশ্য করয়ে লোক তার প্রতিকার।।
তথা হৈতে নৃত্যশালা করিল গমন।
সৈরন্ধ্রীরে নিরখিয়া বলে কন্যাগণ।।
ভাল হৈল সবান্ধব মরিল দুর্ম্মতি।
যে তোমার করিলেক এতেক দুর্গতি।।
পার্থ বলিলেন, কহ অদ্ভুত কথন।
কিমতে গন্ধর্ব্ব কৈল কীচকে নিধন।।
কৃষ্ণা বলে, কি জানিবে ওহে বৃহন্নলা।
অহর্নিশি কন্যাগণ লয়ে কর খেলা।।
কিমতে জানিবে দুঃখ যতেক আমার।
হাসি হাসি জিজ্ঞাসিছ, কি বলিব আর।।
তথা হতে গেল সুদেষ্ণার অন্তঃপুরী।
কৃষ্ণারে দেখিয়া সব পলাইল নারী।।
দ্বারেতে কপাট কেহ দিল মহাভয়ে।
দেখিয়া দ্রৌপদী দেবী ডুবিল বিস্ময়ে।।
সহসা সুদেষ্ণা আসি নৃপ-পাটরাণী।
বিনয়পূর্ব্বক সৈরন্ধ্রীরে বলে বাণী।।
হেথা হৈতে বাছা তুমি করহ গমন।
যথা আছে গন্ধর্ব্বেরা তব পতিগণ।।
নৃপতির বড় ভয় হইল তোমারে।
কালরূপী জানি তোমা সর্ব্বলোকে ডরে।।
সর্ব্বনাশ হৈল মোর তোমার কারণ।
তোমা রাখি হত্যা কৈনু সহোদরগণ।।
এখন ক্ষমহ মোরে, করি পরিহার।
যথা ইচ্ছা তথাকারে কর আগুসার।।
দ্রৌপদী বলিল, দেবী কর অবধান।
তের দিন পরে আমি যাব জিন স্থান।।
তোমাতে গন্ধর্ব্বগণ বড় প্রীত হবে।
তের দিন উপরান্তে মোরে লবে যাবে।।
আমা হৈতে যত কষ্ট হইল তোমার।
ততেক সন্তোষ আমি করিব অপার।।
মরিল আপন দোষে কীচক দুর্ম্মতি।
বিনাদোষে কাহার না হিংসে মোর পতি।।
দেব-দ্বিজগণ প্রিয়, ভকতবৎসল।
নাহি করে তারা ধার্ম্মিকের অমঙ্গল।।
এখানে দেখিবে সেই মোর স্বামিগণে।
দেব দ্বিজগণ ভক্ত, বড় প্রিয় রণে।।
সুদেষ্ণা বলিল, দেখ দেখিয়া তোমারে।
নারী দূরে থাক, পুরুষ পলায় ডরে।।
তের দিন তুমি যদি থাকিবে হেথায়।
সত্য করি এক কথা কহ গো আমায়।।
স্বামী পুত্র ডরে মোর, রহিল বাহিরে।
অভয় করিলে সবে আসিবেক ঘরে।।
সবান্ধবে লইলাম তোমার শরণ।
গন্ধর্ব্বের ভয়ে তুমি করহ রক্ষণ।।
অভয় করিল কৃষ্ণা সৃদেষ্ণার বোলে।
এইমতে তথা কৃষ্ণা বঞ্চে কুতূহলে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
রহস্য বিরাটপর্ব্ব কীচকের বধে।
কাশীদাস কহে দ্বিজ চরণ-প্রসাদে।।
১২. পাণ্ডবদিগের অন্বেয়ণার্থ দুর্য্যোধনের চর প্রেরণ
অজ্ঞাতে বঞ্চেন হেথা পাণ্ডুর নন্দন।
হস্তিনাপুরেতে তথা রাজা দুর্য্যোধন।।
লক্ষ লক্ষ চরগণে ‍পাঠান ত্বরিত।
পাণ্ডবের অন্বেয়ণে যায় চতুর্ভিত।।
দুর্য্যোধন বলে, যেই পাণ্ডবে দেখিভে।
পাণ্ডবে দেখেছি বলি যে আসি বলিবে।।
ধন জন রাজ্য দিব,বহুত ভাণ্ডার।
রাজ্যভোগ ভুঞ্জিবেক সহিত আমার।।
এত বলি দূতগণে দিল বহু ধন।
পাঠাইল অষ্টদিকে লক্ষ লক্ষ জন।।
এক বর্ষ পাণ্ডবেরে খুঁজে সর্ব্বজন।
ভ্রমিয়া সকল দেশ আসে দূতগণ।।
নমস্কার করি নৃপে করযোড়ে কয়।
বহু খুঁজিলাম রাজা পাণ্ডুর তনয়।।
গ্রাম দেশ নগরাদি যত জনপদ।
তড়াগ নির্ঝর নদ নদী আর হ্রদ।।
পর্ব্বত কানন বৃক্ষ লতার ভিতর।
গহ্বর কন্দর গুহা অরণ্য সাগর।।
মুনিমধ্যে মুনি হই ব্যাধমধ্যে ব্যাধ।
হস্তী সিংহ ব্যাঘ্র মধ্যে না গণি প্রমাদ।।
রাজগৃহে ধরিলাম সারথির বেশ।
উদাসীন হয়ে ভ্রমিলাম সর্ব্বদেশ।।
অযোধ্যা পাঞ্চাল কাশী দ্বারকা নগর।
ভ্রমিলাম চারি স্থানে গিয়া ঘর ঘর।।
কোথাও না দেখিলাম পাণ্ডুর নন্দন।
জীয়ন্তে থাকিলে হৈত অবশ্য দর্শন।।
জীবিত যদ্যপি থাকে, আছে সিন্ধুপার।
কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে নাহি তারা আর।।
নিশ্চয় নৃপতি এই কহিনু তোমায়।
যদি আজ্ঞা হয়, তবে যাই পুনরায়।।
এত বলি চরগণ নিবৃত্ত হইল।
দক্ষিণের দূত হবে কহিতে লাগিল।।
অদ্ভূত কথন এক শুন মহারাজ।
এক দিন ছিনু মোরা মৎস্যদেশ মাঝ।।
বিরাট শ্যালক জান কেকয়-কুমার।
কীচক নামেতে সহোদর শত তার।।
স্ত্রীর হেতু শত ভায়ে গন্ধর্ব্বে মারিল।
ত্রিগর্ত্তের রাজ্য যেই বলে লয়েছিল।।
দেখিনু শুনিনু যথা কহি মহারাজ।
আজ্ঞা কর, এবে মোরা করি কোন্ কাজ।।
চরগণ-বচনান্তে কহে দুর্য্যোধন।
আমার যে বাঞ্ছা, তাহা শুন সর্ব্বজন।।
ত্রয়োদশ বৎসর হৈল আসি শেষ।
আসিবে পাণ্ডবগণ পেয়ে বহু ক্লেশ।।
ক্রোধে মহাভয় দেখাইবে কুরুগণে।
ইহার উপায় এক লইতেছে মনে।।
পুনর্ব্বার চরগণ যাক খুঁজিবারে।
বহু ধন পাবে যদি দেখে পাণ্ডবেরে।।
শুনিয়া বলিছে কর্ণ সূর্য্যের নন্দন।
এ সকল থাক, যাক্ অন্য চরগণ।।
ছদ্মবেশে যাক্, যেই হয় বিচক্ষণ।
পণ্ডিত সুবুদ্ধি যেই অনুগত জন।।
দুঃশাসন বলে, ভাল কহ মহামতি।
পুনরপি দূতগণ যাক্ শীঘ্রগতি।।
পশুগণে ঘ্রাণে জানে বেদে দ্বিজবরে।
অন্য জন দৃষ্টে জানে, রাজা জানে চরে।।
ইহা বিনা অন্য কর্ম্ম ‍নাহিক রাজন।
আপন হিতের চর যাউক এখন।।
মরিলে তথাপি বার্ত্তা চাহি জানিবারে।
ব্যাঘ্রে সিংহে মারিল কি অরণ্য ভিতরে।।
অনাহারে কষ্টে ভীমসেন কি মরিল।
তাহার মরণ-শোকে সবে প্রাণ দিল।।
নিরন্তর বৃকোদর রাক্ষসেতে বাদী।
যার তার সহ দ্বন্দ্ব করে নিরবধি।।
বেড়িয়া রাক্ষস কিবা মারিল পাণ্ডবে।
নিশ্চয় মরিল তারা, চরে কোথা পাবে।।
এত শুনি বলিলেন, দ্রোণ মহামতি।
কুরু-পাণ্ডবের গুরু বুদ্ধে বৃহস্পতি।।
এরূপে পাণ্ডব যদি হইবে নিধন।
তবে লোকে ধর্ম্ম করে কিসের কারণ।।
অশক্ত অরণ্য মধ্যে ধর্ম্ম বলবান।
ধর্ম্ম যার আছে, তার সর্ব্বত্র কল্যাণ।।
পাণ্ডুপুত্রে পরাভব করিবেক রণে।
তিনলোক মধ্যে হেন না দেখি নয়নে।।
শুচি সত্যবাদী কৃতকর্ম্মা জিতেন্দ্রিয়।
ধর্ম্মজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ গুরু-দেব-দ্বিজ প্রিয়।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম-অবতার।
আর চারি সহোদর অনুগত তার।।
তাহার আপনদ হবে, নাহি দেখি আমি।
ছদ্মবেশে আছে তারা কাল অনুক্রমি।।
যে বিচার করিতেছ, করহ ত্বরিত।
পুনশ্চ যাউক চরগণ চতুর্ভিত।।
দ্রোণের বচন শুনি কহে ভীষ্মবীর।
সজল জলদ তুল্য বচন গম্ভীর।।
অকারণে চরেরে পাঠাবে আরবার।
ইহারা চিনিবে কোথা পাণ্ডুর কুমার।।
বেদবিজ্ঞ দ্বিজ হবে, সর্ব্বশাস্ত্র জানে।
সত্যবৃত্তি তপঃপর হবে যেই জনে।।
সেই সে চিনিতে পারে পাণ্ডপুত্রগণে।
মরিল বলিয়া কেন বল অকারণে।।
তের বর্ষ সুদারুণ তপস্যা করিল।
তার ফল ফলিবারে সময় হইল।।
যেই দেশে থাকিবেক পাণ্ডুর নন্দন।
তার চিহ্ন কহি এবে, শুন চরগণ।।
না ব্যাধি, না দুঃখ শোক, যে দেশের জনে।
দুষ্টের নিগ্রহ, শিষ্ট পালন যতনে।।
দানশীল দয়াশীল ক্ষমাশীল ধীর।
সেই দেশে থাকিবেক রাজা যুধিষ্ঠির।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির যথায় থাকিবে।
সুগন্ধি শীতল বায়ু তথায় বহিবে।।
উত্তম হইবে শস্য মেঘের পালন।
বহু ক্ষীরবতী হৈবে যত গবীগণ।।
শরীরে জন্ময়ে ব্যাধি, সে করে বিপদ।
বন্ধু হয়ে হিত করে বনের ঔষধ।।
পর হয়ে বন্ধু হয়, যদি হিত করে।
জ্ঞাতি হয়ে শত্রু হয়, অধর্ম্ম আচরে।।
সেইমত দেখি দুর্য্যোধনের আচার।
পাণ্ডবের হাতে হবে সবংশে সংহার।।
আমার এতেক বলা নাহি প্রয়োজন।
সমান আমার কুরু পাণ্ডুর নন্দন।।
কিন্তু আর চর পাঠাইবে কি কারণ।
শীঘ্রই নিকটে আসিবেক পঞ্চ জন।।
ত্রয়োদশ বর্ষ এই হৈল আসি শেষ।
নিজ রাজ্যে না আসিয়া যাবে কোন্ দেশ।।
আসি মহাভয় দেখাইবে সর্ব্বজনে।
যেরূপে বাহির কৈলে, সবে জানে মনে।।
বিস্তর কহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
যথা ধর্ম্ম তথা জয়, বেদের বচন।।
ভীষ্মনীতি বুঝিয়া সাধহ হিতকার্য্য।।
দ্রোণ ভীষ্ম যে কহিল, নাহি হবে ‍আন।
গুপ্তবেশে রহিয়াছে পাণ্ডব ধীমান।।
হইল সময় শেষ, কাল দেখা দিল।
আপায় করহ শীঘ্র, কর্ণ যা কহিল।।
চরগণে খুঁজিতে পাঠাও দেশাদেশ।
হেথায় করহ শীঘ্র সৈন্য সমাবেশ।।
ভাণ্ডারের ধন দেখ, দেখ নিজ বল।
পরাপর প্রীতি কর নৃপতি সকল।।
তোমার অহিত কভু পাণ্ডুপুত্র নয়।
এক এক পাণ্ডব যে ইন্দ্রে করে জয়।।
শরদ্বান্-মুনিপুত্র কহি নিবর্ত্তিল।
সভাতে সুশর্ম্মা রাজা বসিয়া আছিল।।
কহিব বলিয়া পূর্ব্বে বিচারিয়া ছিল।
কর্ণ বীর কৈল, তাই কহিতে নারিল।।
সভায় কহিল এবে ত্রিগর্ত্ত রাজন।
মোর এক নিবেদন, শুন সভাজন।।
বিরাটের সেনাপতি কীচক প্রবল।
সসৈন্যে আসিয়া মম রাজ্য আক্রমিল।।
বলেতে আমার রাজ্য নিলেক সকল।
কীচক মরিল এবে হইল মঙ্গল।।
সবান্ধবে মোরে জিনি করেছিল গর্ব্ব।
এখন শুনি যে তারে মারিল গন্ধর্ব্ব।।
কীচক মরিল যবে, হৈল বড় কার্য্য।
বিরাটে বান্ধিয়া এবে লব নিজ রাজ্য।।
ধন রত্ন পূর্ণ, তার গবী অপ্রমিত।
এ সময়ে তাতে তব হবে বড় হিত।।
হীনবীর্য্য বিরাটেরে জিনিব কৌতুকে।
বিচারে আইসে যাহা, আজ্ঞা দেহ মোকে।।
কর্ণ বলে, ভাল বলে সুশর্ম্মা নৃপতি।
মৎস্যদেশে যাব, সৈন্য সাজ শীঘ্রগতি।।
পাণ্ডবের হেতু চিন্তা কর অকারণ।
কোথায় মরিয়া গেল বৃথা অন্বেষণ।।
জীয়ন্তে থাকিলে তবে,আসিবে হেথায়।
ধনহীন বন্ধুহীন ক্লেশে ক্লিষ্ট কায়।।
মম বল বীর্য্য তারা ভালমতে জানে।
পুনঃ হেথা পাণ্ডব না আসিবে কখনে।।
এক্ষণে চলহ সবে, যাব মৎস্যরাজ্য।
ধন রত্ন পাব বহু, হবে বড় কার্য্য।।
কর্ণের বচন শুনি বলেন বিদুর।
নিশ্চয় সবার চিত্ত যেতে মৎস্যপুর।।
সবাকার মন হৈল নিষেধিতে দোষে।
রত্ন গাভী উপার্জ্জন হ বড় ক্লেশে।।
কহিলেক চর মৎস্যদেশ-সমাচার।
দুর্জ্জয় কীচক গেল স্ত্রীর হেতু মার।।
অদ্যাপি নাহি দেখি, নাহি শুনি কানে।
গন্ধর্ব্ব নিবাস করে মনুষ্য ভবনে।।
গন্ধের্ব্বর স্ত্রীর সহ কীচকের কথা।
অনুমানে বুঝিতেছি সকল বারতা।।
বুঝিয়া করিবে কার্য্য, যাইবে নিশ্চয়।
গন্ধর্ব্ব সহিত যেন বিবাদ না হয়।।
বিদুর বচন শুনি হাসে দুর্য্যোধন।
শক্তিমত কহে যুক্তি যাহার যেমন।।
যত শক্তি আপনার, ততেক মন্ত্রণা।
না বুঝি আমার শত্রু আছে কোন্ জনা।।
গন্ধর্ব্ব কি গণি, যদি আসে দেবগণ।
ইন্দ্রসহ সাজি আসে তিন ‍ভুবন।।
কার শক্তি আসি মোর সম্মুখীন হয়।
তোমারে না ডাকি সঙ্গে, কেন কর ভয়।।
এত বলি সৈন্যে আজ্ঞা দিল কুরুপতি।
চতুরঙ্গ দল সজ্জা কর শীঘ্রগতি।।
সুশর্ম্মা নৃপতি যাক পুনঃ কহে আগে।
আপনার রাজ্য গিয়া নিক যাম্যভাগে।।
সৈন্য সহ যাব আমি করিবারে রণ।
শূন্যরাজ্যে গিয়া আমি হরিব গোধন।।
একদিন আগে যাও সুশর্ম্মা রাজন।
পশ্চাৎ সসৈন্যে আমি করিব গমন।।
১৩. নিজ রাজ্যে সুশর্ম্মা যাত্রা ও 
বিরাটের দক্ষিণ গো-গৃহ আক্রমণ
দুর্য্যোধন আজ্ঞা পেয়ে সুশর্ম্মা নৃপতি। আপন বাহিনী সাজাইল শীঘ্রগতি।। আষাঢ়ের সিতপক্ষে পঞ্চশী দিবসে। সুশর্ম্মা নৃপতি চলি গেল মৎস্যদেশে।। শঙ্খ ভেরী আদি করি নানা বাদ্য বাজে। বাদ্যের শব্দেতে কম্প হৈল মৎস্যরাজে।। প্রবেশিয়া মৎস্যদেশে সুশর্ম্মা নৃপতি। ধরহ গোধনে, আজ্ঞা দিল সৈন্য প্রতি।। হয় হস্তী গবী আর নানা রত্ন ধন। লুঠিতে লাগিল চতুর্দ্দিকে সর্ব্ব জন।। গোধন রক্ষণে যত ছিল গোপগণ। ধাইয়া রাজারে বার্ত্তা কহিল তখন।। সভাতে বসিয়াছিল বিরাট নৃপতি। ঊর্দ্ধশ্বাসে কহে গোপ প্রণমিয়া ক্ষিতি।। সকল মজিল মৎস্যদেশে নৃপবর। সকল হরিয়া নিল ত্রিগর্ত্ত-ঈশ্বর।। রক্ষা করিবেক রাজা যদি আছে মন। বিলম্ব না কর, শীগ্র চলহ রাজন।। দূতমুখে হেন বার্ত্তা পাইয়া নৃপতি। চতুরঙ্গ সেনা লজ্জা করে শীঘ্রগতি।। শতানীক মদিরাক্ষ দুই সহোদর। শ্বেত শঙ্খ দুই ভাই রাজার কোঙর।। পাত্রমিত্রগণ যোদ্ধা সাজিল সকল। বিবিধ বাজনা বাজে, সৈন্য কোলাহল।। শতানীকে আজ্ঞা দিল বিরাট নৃপতি। দিব্য অস্ত্র ধনু দেহ চারি জন প্রতি।। শ্রীকঙ্ক বল্লব অশ্বপাল ও গোপাল। মহাবীর্য্যবন্ত যুদ্ধ করিবে বিশাল।। দেবতার প্রায় সব দেখি সে সাক্ষাতে। অবশ্য যুদ্ধের কার্য্য হবে সবা হৈতে।। দিব্য ধনুর্গুণ দিল রথ তুরঙ্গম। মুকুট কুণ্ডল দিল, কবচ উত্তম।। পরিলা উত্তম বাস অতি মনোহর। শরতে উদয় যেন হৈল শশধর।। সাজিয়া পাণ্ডব রথে করে আরোহ। স্বর্গ হৈতে আসে যেন দিক্পালগণ।। চলিল বিরাট রাজা মীনধ্বজ রথে। চারি ভাই চলিলেন রাজার পশ্চাতে।। রথ চালাইয়া দিল রথের সারথি। পশ্চাতে মাহুতগণ চালাইল হাতী।। পদধূলি ঢালিলেক দেব দিবাকরে। ঘোর অন্ধকার হৈল দিবস দুপুরে।। শূণ্য হৈতে পক্ষিগণ ভূমিতে পড়িল। হেনমতে দুই সৈন্যে ক্রমে দেখা হৈল।। রথীকে ধাইল রথী, গজ ধায় গজে। অশ্বারোহী, অশ্বারোহী, পত্তি পত্তি যুঝে।। মল্লে মল্লে, গজে গজে, ধানুকী ধানুকী। খড়্গে খড়্গে, শূলে শূলে, তবকী তবকী।। হইল দারুণ যুদ্ধ মহাভয়ঙ্কর। পূর্ব্বে যথা দেবাসুরে হইল সমর।। সিংহনাদ মুহুমুর্হুঃ গর্জ্জে সৈন্যগণ। ধনুর নির্ঘোষ ঘন, শঙ্খের নিঃস্বন।। বিবিধ বাদ্যের শব্দ, কর্ণে লাগে তালি। অন্ধকার হৈল সব, আচ্ছাদিল ধূলি।। বাণের আগুন মাত্র ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে। অন্ধকার রাত্রে যেন খদ্যোত উজলে।। শেল শূল ভল্ল চক্র মুষল মুদগর। পরশু পট্টিশ জাঠি ভিন্দিপাল শর।। পড়িল অনেক সৈন্য পৃথিবী আচ্ছাদি। ধূলি অন্ধকার কৈল, রক্তে বহে নদী।। মুকুট কুণ্ডল মুণ্ড যায় গড়াগড়ি। বুকে শেল বাজি কেহ ভূমিতলে পড়ি।। সব্য হস্ত খড়্গ সহ পড়িল ভূতলে। পদ কাটা গেল কার গড়াগড়ি বুলে।। পর্ব্বত-আকার গজ ভূমে দন্ত দিয়া। পড়িল দুভিতে সৈন্য অনেক দলিয়া।। হেনমতে যুদ্ধ হৈল দ্বিতীয় প্রহর। কেহ পরাজিত নহে, একই সোসর।। ক্রোধে শতানীক বীর সমরে প্রবেশে। এক শত রথী মারে চক্ষুর নিমিষে।। মদিরাক্ষ মারিলেক শত সেনাপতি। শত শত মারে সৈন্য বিরাট নৃপতি।। বিরাট নৃপতি দেখি সুশর্ম্মা ধাইল। দুই মত্ত ব্যাঘ্র যেন একত্র মিলিল।। ক্রোধেতে বিরাট রাজা মারে দশ শর। চারি অশ্বে চারি, দুই সারথী উপর।। রথধ্বজে দুই, দুই সুশর্ম্মা উপরে। সুশর্ম্মা কাটিয়া অস্ত্র ফেলে কত দূরে।। পঞ্চদশ বাণ মারে বিরাট উপর। কাটিয়া ফেলিল তাহা মৎস্যের ঈশ্বর।। দেখিয়া ত্রিগর্ত্তপতি অতি ক্রোধগতি। লাফ দিয়া ভূমিতলে নামে শীঘ্রগতি।। হাতে গদা লৈয়া বীর ধায় বায়ুবেগে। সিংহ যথা ধরিবারে যায় মত্ত মৃগে।। চারি অশ্ব বিনাশিল মারি গদা বাড়ি। সারথির কেশে ধরি ভূমিতলে পাড়ি।। জীবগ্রাহ করিয়া বিরাট নৃপবরে। ত্বরা করি তুলি লয় নিজ রথোপরে।। রাজা বন্দী হৈল, সৈন্য হৈল ভঙ্গীয়ান। চতুর্দ্দিকে পলাইল লয়ে নিজ প্রাণ।। বড় বড় যোদ্ধাধন ত্যজি ধনুঃশর। আপনি চালায় রথ পলায় সত্বর।। ঊর্দ্ধলেজ মত্তগজ গর্জ্জিয়া পলায়। অশ্বারোহী পদাতিক পাছু নাহি চায়।। পলাইল সর্ব্ব সৈন্য, কেহ নাহি আর। রাখিতে না পারে সৈন্য বিরাট কুমার।। রণজয় করি পরে ত্রিগর্ত্ত নৃপতি। বিরাটে লইয়া তবে চলে হৃষ্টমতি।। জয়ধ্বনি বাদ্যধ্বনি হয় অনুক্ষণ। মৎস্যরাজ সৈন্যমধ্যে উঠিল রোদন।। সন্ধ্যাকাল হৈল, সূর্য্য ক্রমে অস্ত গেল। কাহারে না দেখি, কেবা কোথায় রহিল।। দেখিয়া কহেন ভীম ধর্ম্ম নরবর। দাণ্ডাইয়া কি দেখহ, ভাই বৃকোদর।। বহু উপকারী এই বিরাট নৃপতি। বর্ষেক অজ্ঞাতে গৃহে করিনু বসতি।। যার যে কামনা মত পাইনু যে স্থান। তাঁহারে লইয়া যায় আমা বিদ্যমান।। দাণ্ডাইয়া দেখ ইহা, নহে ক্ষত্রধর্ম্ম। বিশেষ আমার এই অনুগত কর্ম্ম।। শীঘ্র কর বিরাটের বন্ধন মোচন। যাবৎ শত্রুর হাতে না হয় নিধন।। এত শুনি বলে ভীম যোড় করি ‍পাণি। পালিব তোমার আজ্ঞা, ওহে নৃপমণি।। এখন আমার কর্ম্ম দেখ দাণ্ডাইয়া। বিরাটে আনিয়া দিব সুশর্ম্মা মারিয়া।। এই যে দেখহ শাল সুদীর্ঘ বিস্তার। আমার হাতের যোগ্য গদার আকার।। ওই বৃক্ষাঘাতে আমি বধিব সকল। নিঃশেষ করিব আজি ত্রিগর্ত্তের দল।। এত বলি বৃক্ষ উপাড়িতে ধায় বীর। দেখিয়া কহেন পুনঃ রাজা যুধিষ্ঠির।। হেন কর্ম্ম না করিহ ভাই বৃকোদর। লোকে জ্ঞাত হৈবে উপাড়িলে বৃক্ষবর।। অজ্ঞাত বৎসর যদি পূর্ণ নাহি হয়। ততদিন হেন কর্ম্ম শোভা নাহি পায়।। মানব ধনুক অস্ত্র লয়ে কর রণ। মানুষের মত কর রথে আরোহণ।। দু-পাশে থাকুক তব দুই সহোদর। শীঘ্র আন ছাড়াইয়া মৎস্যের ঈশ্বর।। আমিহ তোমার পাশে সর্ব্বসৈন্য লয়ে। বিরাট রক্ষার হেতু যাইব চলিয়ে।। ভীম বলে, নরপতি ইহা কেন কহ। মুহূর্ত্তেকে বিরাটেরে আনি দিব, লহ।। আপনি করিবে শ্রম কিসের কারণ। ত্রিগর্ত্ত সহিত করি সমর বিষম।। কোন্ হেতু যাবে দুই মাদ্রীর নন্দন। কি কারণে লব আর বহু সৈন্যগণ।। বৃক্ষ নিতে নিষেধিলে, বৃক্ষ নাহি লব। রিক্তহস্তে গিয়া আমি বিরাটে আনিব।। তৃণ হেন গণি আমি ত্রিগর্ত্ত রাজনে। সৈন্য সাথী অস্ত্র লৈব কিবা প্রয়োজনে।। এত বলি বৃকোদর ধায় শীঘ্রগতি। চলিতে চরণভরে কম্পে বসুমতী।। রজনী সম্মূখ হৈল, ঘোর অন্ধকার। বায়ুবেগে ধায় ভীম, বলে মার মার।। মহাভারতের কথা পুণ্যের কথন। রচেন ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।। ১৪. ভীম কর্ত্তৃক সুশর্ম্মার পরাজয়
ও বিরাটের বন্ধন মোচন
হেথায় ত্রিগর্ত্ত রাজা সংগ্রামে জিনিয়া। কৃষ্ণানামে নদীতীরে উত্তরলি গিয়া।। যুদ্ধশ্রমে সর্ব্বসৈন্য ক্ষুধায় আকুল। রন্ধন ভোজন করে নদীর দুকূল।। বসন-গৃহেতে কেহ করিল শয়ন। কেহ স্নানে, কেহ পানে আসন ভোজন।। বিরাটে করিয়া বন্দী সুশর্ম্মা হরিষে। বসিয়া সভার মধ্যে কহে পরিহাসে।। কোথায় শ্যালক তব বিরাট নৃপতি। যার ভুজবলে ভোগ কৈলি মোর ক্ষিতি।। ভাগ্যবলে শ্যালকেরে পেয়েছিলে তুমি। যার তেজে কাড়িয়া লইয়া মোর ভূমি।। এক্ষণে তোমার কিবা আছে হে উপায়। নাহি দেখি কেহ আছে তোমার সহায়।। নিশ্চয় তোমার মৃত্যু হৈল মম হাতে। শৃগাল হইয়া বাদ সিংহের সহিতে।। কেহ বলে, ইহারে না রাখ এক দণ্ড। কেহ বলে, খড়্গে কাটি কর খণ্ড খণ্ড।। কেহ বলে, নিগড়েতে করহ বন্ধন। দুর্য্যোধন আগে লয়ে করিব নিধন।। এমত বিচারে আছে তথা সর্ব্ব জন। হেনকালে উপনীত পবন-নন্দন।। দুই ভিতে বৃক্ষে ভাঙ্গে, শুনি মড় মড়। নাসায় নিশ্বাস বহে প্রলয়ের ঝড়।। মার মার শব্দ করি, আসি উপনীত। দেখিয়া ত্রিগর্ত্ত সৈন্য হৈল মহাভীত।। কেহ বলে, রাক্ষস কি যক্ষ বিদ্যাধর। হিমগিরি শৃঙ্গ সম ভীম কলেবর।। পলায় সকল সৈন্য গণিয়া প্রমাদ। হস্তিগণ ধায় সবে করি ঘোর নাদ।। শীঘ্রগতি হস্তী পৃষ্ঠে চড়িয়া মাহুত। বৃকোদরে বেড়িল যে হস্তী যূথ যূথ।। রথিগণ রথ সাজি আরূঢ় হইয়া। লক্ষ লক্ষ চতুর্দিকে বেড়িল আসিয়া।। শেল শূল শক্তি জাঠি ভূষণ্ডী তোমর। চতুর্দ্দিকে মারে সবে ভীমের উপর।। মহাবল ভীমসেন ভীম-পরাক্রম। রণস্থল মধ্যে যেন যুগান্তের যম।। ধরিয়া কুঞ্জর শুণ্ড শুণ্ডে বুলাইয়া। মারিল কুঞ্জরবৃন্দ প্রহার করিয়া।। রথধ্বজ ধরি বীর মারে রথোপরে। সহস্র সহস্র রথ ভাঙ্গে একেবারে।। অশ্বগণ ধরি বীর মারে অশ্বগণে। পদাতি পদাতি মারে ধরিয়া চরণে।। তাহারে ধরিয়া মারে যে পড়ে সম্মূখে। রথ অশ্ব হস্তী পত্তি পড়ে লাখে লাখে।। পলায় সকল সৈন্য, পাছু নাহি চায়। সিংহের গর্জ্জনে যথা শৃগাল পলায়।। পলাহ পলাহ বলি, হৈল মহাধ্বনি। আইল আইল সৈন্যে, এইমাত্র শুনি।। ঊর্দ্ধশ্বাসে দূত গিয়া কহে সুশর্ম্মারে। বসিয়া কি কর রাজা পলাহ সত্বরে।। আচম্বিতে সৈন্যমধ্যে আসে একজন। রাক্ষস গন্ধর্ব্ব কিবা, না জানি কারণ।। মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, না জানি কি রঙ্গ। প্রকাণ্ড শরীর, যেন হিমালয় শৃঙ্গ।। মারিল অনেক সৈন্য, যে পড়ে সম্মুখে। সুশর্ম্মা সুশর্ম্মা বলি, ঘন ঘন ডাকে।। বুঝিয়া করহ কার্য্য, যে হয় বিচার। তার আগে পড়িল না দেখি রক্ষা কার।। কত সৈন্য পড়িয়াছে নাহি তার অন্ত। নাহি জানি হেথা আছে এমন দুরন্ত।। পলাহ নৃপতি শীঘ্র প্রাণ বড় ধন। ওই দেখ আসিতেছে ভীষণ-দর্শন।। এত বলি ধায় দূত পাছু ‍নাহি চায়। হেনকালে উপনীত ভীম মহাকায়।। ভীমের শরীর দেখি অতি ভয়ঙ্কর। ভয়েতে কম্পিত সুশর্ম্মার কলেবর।। পলাইল সর্ব্বসৈন্য, রাজা মাত্র আছে। ভয়েতে বিহ্বল হৈল ভীমে দেখি কাছে।। শীঘ্রগতি উঠি রাজা ভয়ে রড় দিল। কেশে ধরি বৃকোদর ভূমিতে পাড়িল।। দৃঢ়মুষ্টি করি কেশ ধরি বাম হাতে। দক্ষিণ করেতে ধরি নিল মৎস্যনাথে।। দুই করে ধরি দুই নৃপতির কেশে। বায়ুবেগে ধায় বীর ভয়ঙ্কর বেশে।। মুহূর্ত্তেকে উপনীত যথা ধর্ম্মরায়। চরণে ফেলিয়া ভীম অন্তরে দাঁড়ায়।। কেশ আকর্ষণে দোঁহে ছিল অচেতন। কতক্ষণে সচেতন হয় দুই জন।। মাথা তুলি মৎস্যরাজ দেখি সভাসদে। কতক আশ্বস্ত চিত্তে কহে সে বিপদে।। কহ ভট্ট কঙ্ক, ভাগ্যে দেখিনু তোমায়। আমা দোঁহে ফেলি গেল গন্ধর্ব্ব কোথায়।। ভাগ্যেতে রহিল প্রাণ গন্ধর্ব্বের হাতে। চল যাব শীঘ্রগতি, পশিব সৈন্যেতে।। পুনর্ব্বর আসি যদি গন্ধর্ব্বেতে ধরে। এবার না জীব আমি দেখিলে তাহারে।। ধর্ম্ম বলিলেন, ভয় না কর নৃপতি। গন্ধর্ব্ব ‍রাজার বড় স্নেহ তোমা প্রতি।। সে কারণে শত্রু তব আনিলেক ধরি। শত্রু হৈতে তোমাকে যে দিল মুক্ত করি।। গন্ধর্ব্বের ভয় নাহি করিও কখন। কার্য্য করি নিজস্থানে করিল গমন।। সুশর্ম্মার ডাকি তবে কহে ধর্ম্মরায়। হেথায় আসিতে বুদ্ধি কে দিল তোমায়।। কীচক মরিল, বলি পাইলে ভরসা। না জান গন্ধর্ব্ব হেথা করিয়াছে বাসা।। ভাগ্যেতে গন্ধর্ব্ব তোমা না মারিল প্রাণে। পূর্ব্ব পুণ্যফলে প্রাণ পেলে তার স্থানে।। আজ্ঞা কর মৎস্যরাজ সুশর্ম্মার প্রতি। ক্ষমহ সকল দোষ, ছাড় শীঘ্রগতি।। সংগ্রামে হারিয়া তবে ত্রিগর্ত্ত নৃপতি। ভগ্নসৈন্য নিরুৎসাহ অতি দীনমতি।। সৈন্যগণ পলাইল একামাত্র আছে। করহ প্রসাদ রাজা, যদি মনে ইচ্ছে।। বিরাটী কহিল, যাহা তব অনুমতি। যাউক আপন রাজ্যে সুশর্ম্মা নৃপতি।। দিব্য রথ দিল এক করিয়া সাজন। সুশর্ম্মা চড়িয়া তাহে করিল গমন।। ধর্ম্মরাজ বলিলেন বিরাটের প্রতি। নগরেতে দূত রাজা যাক্ শীঘ্রগতি।। তোমারে শুনিলে বন্দী রাজ্যে হবে ভয়। রাণীগণ দুঃখী হবে, ভাল কর্ম্ম নয়।। শীঘ্রগতি বার্ত্তা দূত দিউক অন্দরে। বিজয় ঘোষণা হোক রাজ্যের ভিতরে।। ধর্ম্মের বচনে আজ্ঞা দেন মৎস্যরাজ। শীঘ্রগতি দূত পাঠাইল পুরীমাঝ।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।। ১৫. উত্তর গো-গৃহে কুরুসৈন্য কর্ত্তৃক গো-হরণ হেথায় উত্তরভাগে রাজা দুর্য্যোধন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ গুরুর নন্দন।। দুর্ম্মুখ দুঃসহ দুঃশাসন মহাবল। রথ রথী গজ বাজী চতুরঙ্গ দল।। বেড়িল আসিয়া মৎস্যরাজের গোধন। যুদ্ধ করি মারি লইলেক গোপগণ।। পলাইল গোপগণ গোধন ছাড়িয়া। ষষ্টি লক্ষ গোধনেরে দিল চালাইয়া।। শীঘ্রগতি গোপগণ রথ আরোহণে। জানাইতে গেল মৎস্যরাজার ভবনে।। উত্তর নামেতে পুত্র বিরাট রাজার। প্রণাম করিয়া দূত কহে সমাচার।। অবধান মহাশয় বিরাট-নন্দন। গোধন তোমার সব নিল কুরুগণ।। যতেক রক্ষক গোপগণেরে মারিয়া। গোধন তোমার সবে যেতেছে লইয়া।। শীঘ্রগতি উঠি রথে করি আরোহণ। কুরুগণে জিনি নিজ রাখহ গোধন।। নানা অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা, লোকে তুমি খ্যাত। জানি দেশ রক্ষা হেতু রাখিলেক তাত।। তোমার সংগ্রামে স্থির হবে কোন্ জনা। তৃণসম মুহূর্ত্তেকে নাশ কুরুসেনা।। উঠ শীঘ্র, বসিলে না হবে কোন কার্য্য। গোধন লইয়া তারা যাবে নিজ রাজ্য।। দৈত্য জিনি ইন্দ্র যথা রাখে সুরপুর। সেইমত রক্ষা কর মৎস্যের ঠাকুর।। স্ত্রীবৃন্দের মধ্যে গোপ এতেক কহিল। শুনিয়া বিরাট পুত্র উত্তর করিল।। কি কহিব গোপগণ কহনে না যায়। রাজ্যরক্ষা হেতু তাত রাখিল আমায়।। এক গুটি সঙ্গে নাহি আমার সারথি। সারথি থাকুক দূরে, নাহিক পদাতি।। মম পরাক্রম মত পাইলে সারথি। মুহূর্ত্তেকে জিনিবারে পারি কুরুপতি।। মৃগগণে একা যথা মারয়ে কেশরী। দৈত্যগণে দলে যথা একা বজ্রধারী।। সেইমত দলি আমি কুরুসৈন্যগণ। এইক্ষনে ফিরাতাম আপন গোধন।। রাজ্য মম বীর শূন্য জানিলেক মনে। দ্বিতীয় শমন আছে বলিয়া না জানে।। জনৈক সারথি যদি মম যোগ্য হয়। এক রথে করিব সে কুরু পরাজয়।। ধনঞ্জয় বীর যথা দলি দেবগণ। একেশ্বর করিলেক খাণ্ডব দাহন।। পার্থসম বীরকর্ম্ম আজি সে করিব। একেশ্বর সর্ব্বসৈন্য নিমিষে মারিব।। স্ত্রীগণের মধ্যে যদি এতেক কহিল। পার্থপ্রিয়া যাজ্ঞসেনী তথায় আছিল।। রাখিব বিরাট লক্ষ্মী বিচারিলা মনে। শীঘ্রগতি উঠি গেলা অর্জ্জুনের স্থানে।। নৃত্যশালে পার্থ সহ সব কন্যাগণ। সঙ্কেতে দ্রৌপদী তাঁরে বলেন বচন।। বিরাটের রাজ্য ভাঙ্গি যতেক গোধন। বলেতে লইয়া যায় কুরু-সৈন্যগণ।। ইহার উপায় তুমি চিন্তহ আপনি। রাখহ বিরাট গবী কুরুগণে জিনি।। অর্জ্জুন বলেন, দেবি কিমতে এ হয়। যত দিন ধর্ম্মরাজ, অনুমতি নয়।। কুরুসৈন্য মধ্যে গেলে হইবেক খ্যাত। না জানি কি কহিবেন পাণ্ডুকুলনাথ।। দ্রৌপদী কহিল, গবী কুরুগণে নিলে। অধর্ম্মী হইবে তুমি বসিয়া দেখিলে।। বিরাট নৃপতি হন বহু উপকারী। উপকারী জনে আমি হইলাম বৈরী।। সহায় বলিষ্ঠ তাঁর কীচক মরিল। তোমা সবে দিয়া স্থান বিপাকে মজিল।। এত শুনি ধনঞ্জয় করে অঙ্গীকার। রাখিব বিরাট ধেনু বাক্যেতে তোমার।। প্রকাশ করিয়া গিয়া জানাহ উত্তরে। সারথি করিয়া মোরে যুদ্ধে যেন বরে।। এত শুনি হৃষ্ট হয়ে গেলা যাজ্ঞসেনী। সব কহি পাঠাইলা উত্তরা ভগিনী।। ভ্রাতৃস্থানে কহে গিয়া বিরাট-নন্দিনী। শুন ভাই কহিল সৈরন্ধ্রী সুবদনী।। সারথির হেতু তুমি হয়েছ চিন্তিত। সে কারণে হেথা মোরে পাঠায় ত্বরিত।। নর্ত্তকী যে বৃহন্নলা আছয়ে আমার। সৈরন্ধ্রী কহিল সব পরাক্রম তার।। খাণ্ডব দহিয়া পার্থ তুষিল অনলে। বৃহন্নলা সারথি যে ছিল সেই কালে।। সৈরন্ধ্রী পাণ্ডবগৃহে আছিল যখন। বৃহন্নলা পরাক্রম দেখেছে তখন।। বৃহন্নলা সহায়েতে ধনঞ্জয় বীর। এক রথে শাসিলেন নৃপ পৃথিবীর।। আজ্ঞা যদি হয় ভাই, লয় তব মন। সারথি করিয়া বৃহন্নলা কর রণ।। উত্তর বলিল, তুমি আনহ তাহারে। সারথি হইল যোগ্য যাইব সমরে।। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃ-বচনেতে চলে নৃপসুতা। কাঞ্চনের মালা গলে বিচিত্র মুকতা।। রূপেতে কমলা সমা কমলগামিনী। আনন্দিতা সিংহমধ্যা মরালগামিনী।। জিজ্ঞাসিল পার্থ কেন গতি শীঘ্রতর। শুনিয়া বিরাটপুত্রী করিল উত্তর।। মোর ‍পিতৃ-গোধনেরে হরে কুরুগণে। জানিয়া রক্ষার্থে মোর ভাই যাবে রণে।। সারথির হেতু চিন্তা হয়েছে তাঁহার। সৈরন্ধ্রী কহিল গুণ সকল তোমার।। অবশ্য তথায় তুমি করিবে গমন। আনহ গোধন তুমি জিনি কুরুগণ।। না গেলে তোমার আগে ত্যজিব জীবন। শুনিয়া উঠিয়া পার্থ করেন গমন।। উত্তরা সহিত যান যথায় উত্তর। বৃহন্নলায় উত্তর করিল সত্বর।। পূর্ব্বে তুমি অর্জ্জুনের আছিলে সারথি। তোমার সাহায্যে জিনিলেক সুরপতি।। সারথি যতেক খ্যাত আছে ত্রিভুবনে। ইন্দ্রের সারথি শ্রেষ্ঠ সর্ব্বলোকে জানে।। বিষ্ণুর দারুক আর সূর্য্যের অরুণ। দশরথ নৃপতির সুমন্ত্র নিপুণ।। সকল সারথি হৈতে তোমা বাখানিল। তোমা সম কেহ নহে সৈরন্ধ্রী কহিল।। এ হেতু তোমারে আমি আনিনু ডাকায়ে। চল শীঘ্র, গবী আনি কৌরবে জিনিয়ে।। অর্জ্জুন বলেন, আমি এ সব না জানি। নৃত্যগীত জানি আর তাল বাদ্যধ্বনি।। কভু আমি নাহি দেখি সমর কেমন। শুনিয়া বলিল তবে বিরাট নন্দন।। নর্ত্তনে গায়নে তুমি সর্ব্বত্র বিখ্যাত। সৈরন্ধ্রীর মুখে তব গুণ হৈল খ্যাত।। সৈরন্ধ্রীর বাক্য মিথ্যা নহে কদাচন। উঠ শ্রীঘ্র মোর রথে কর আরোহণ।। অর্জ্জুন বলেন, মানি তোমার বচন। সারথি নহি যে, তবু করিব গমন।। কেবল আমার এক আছয়ে নিয়ম। যথা যাই শত্রু যদি হয় যম সম।। না জিনিয়া বাহুড়ি না আসে মম রথ। সর্ব্বথা প্রতিজ্ঞা মম জানিবে এমত।। স্ত্রীগণের আগে তুমি যা কিছু বলিলে। রথ না বাহুড়ে মম, তাহা না কহিলে।। যথায় কহিবে, রথ তথাকারে লব। রথসজ্জা দেহ, রথ সাজন করিব।। এত শুনি উত্তরের আনন্দিত মন। মোর মনোমত যোগ্য তুমি বিচক্ষণ।। এত বলি গলা হৈতে দিল রত্নমালা। বড় ভাগ্যবশে তোমা পাই বৃহন্নলা।। রাজপুত্র প্রসাদ না নিলে অনুচিত। প্রসাদ লইতে পার্থ হৈলেন লজ্জিত।। রথের সাজন করিলেন ধনঞ্জয়। দেখিয়া উত্তর মনে মানিল বিস্ময়।। বীরবেশে বীরসজ্জা করি রাজসুত। রথে আরোহণ করে অশ্বগণযুত।। চতুর্দ্দিকে নারীগণ করয়ে মঙ্গল। হেনকালে উত্তরাদি বালিকা সকল।। বৃহন্নলা প্রতি চাহি বলে ততক্ষণ। শুনহ বৃহন্নলা আমাদের বচন।। ভীষ্ম দ্রোণ আদি করি জিনি বীরগণ। সবাকার অঙ্গ হৈতে আনিবে বসন।। পুত্তলী খেলিব মোরা যত কন্যাগণ। মোদের এ বাক্য তুমি রাখিও স্মরণ।। কহেন ঈষৎ হাসি ‍পার্থ ধনুর্দ্ধর। সংগ্রাম জিনিবে যবে তব সহোদর।। আনিব বসন রত্ন তোমার বাঞ্ছিত। এত বলি রথমধ্যে বসেন ত্বরিত।। হেনকালে অন্তঃপুরে যত নারীগণ। অর্জ্জুনে চাহিয়া বলে করুণ বচন।। খাণ্ডব দাহনে যথা জিনি পুরন্দরে। সহায় ইয়া জয় দিলে পার্থ বীরে।। সেমত ত্বরায় জিনি যত কুরুগণে। উত্তর কুমারে লয়ে আসিবে কল্যাণে।। মহাভারতের কথা অমৃত-সমান। কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র