মহাভারত:সভাপর্ব-০৩১-০৩৫

৩১. শিশুপাল বধ ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞ সমাপন
এত বলি শিশুপাল করিছে গর্জ্জন।
হাসিয়া বলেন তবে কমললোচন॥
সকল নৃপতিগণ শুন দিয়া মন।
যত দোষ করিয়াছে এই দুষ্ট জন॥
যাদবীর গর্ভে জাত এই দুরাচার।
নিরবধি করিয়াছে যাদব অপকার॥
এককালে আমি পুরী দ্বারকা হইতে।
প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরে গিয়াছিলাম দৈবেতে॥
এই দুষ্ট শুনিলেক আমি নাই ঘরে।
সসৈন্যেতে গেল দুষ্ট দ্বারকা-নগরে॥
উগ্রসেন রাজা ছিল রৈবত পর্ব্বতে।
মাতুলের উপরোধ না ধরিল চিতে॥
লুঠিয়া দ্বারকাপুরী গেল দুরাশয়।
কহ শুনি হেন কর্ম্ম কার প্রাণে সয়॥
তবে কত দিনে পিতা অশ্বমেধ কৈল।
সঙ্কল্প করিয়া যজ্ঞ তুরঙ্গ ছাড়িল॥
যদুগণে নিয়োজিল অশ্বের রক্ষণে।
ঘোড়া হরি লৈয়ে গেল এই ত দুর্জ্জনে॥
ইহার অন্তরে তবে শুন সর্ব্বজনে।
সৌবীরেতে মহোৎসব হৈল কত দিনে॥
বভ্রু নামে যাদবের ভার্য্যা গুণবতী।
তারে বলে হরি নিল এই পাপমতি॥
তদন্তরে শুন সবে এ দুষ্ট কাহিনী।
ভদ্রা নামে কন্যা ছিল যাদবনন্দিনী॥
বসুরাজে বরেছিল সেই ত কন্যায়।
তারে হরি নিল দুষ্ট প্রবন্ধ-মায়ায়॥
মাতুলের কন্যা হয় ভগিনী ইহার।
তারে হরি নিয়া গেল এই দুরাচার॥
ইত্যাদি যতেক দোষ কহিব কতেক।
সাক্ষাতে দেখিলে হয় বিদিত প্রত্যেক॥
করিলাম সে সকল দোষের মার্জ্জন।
কেবল পিতৃস্বসার সত্যের কারণ॥
সাক্ষাতে শুনিলে সবে যে মন্দ বলিল।
সর্ব্বজনে শুনিলে যে এই ভাল হৈল॥
পরোক্ষের কথা যত শুনিলে শ্রবণে।
প্রত্যক্ষের যত কর্ম্ম দেখ বিদ্যমানে॥
বহু সহিলাম আর সহিবারে নারি।
মৃত্যুপথ চাহে আজি এই পাপকারী॥
আর শুন রাজগণ এ দুষ্টের কথা।
লক্ষ্মীরূপা রুক্মিণী ভীষ্মক নৃপসুতা॥
বিবাহ করিতে তারে করিলেক মন।
শূদ্রে যেন চাহে বেদ করিতে পঠন॥
শিশু যেন চন্দ্রমারে ধরিবারে চায়।
হবির্ভাগ চণ্ডালেতে কভু নাহি পায়॥
এতেক বলেন যদি শ্রীমধুসূদন।
শিশুপালে নিন্দা করে যত রাজগণ॥
কৃষ্ণের বচন শুনি শিশুপাল হাসে।
গোবিন্দেরে নিন্দা করে অশেষ বিশেষে॥
নির্লজ্জ তোমারে আমি কি বলিব আর।
তোমার দুষ্কর্ম্ম যেন বিখ্যাত সংসার॥
ভীষ্মকের কন্যা মোরে করিল বরণ।
বহু দিন হয় নাহি জানে সর্ব্বজন॥
হরিয়া লইলি তারে রাজসভা হৈতে।
পুন সেই কথা কহ নির্লজ্জ মুখেতে॥
কহ কৃষ্ণ দেখিয়াছ শুনেছ ক্ষবণে।
বরপূর্ব্বা কন্যা হরিয়াছে কোন্‌ জনে॥
তোমা বিনা পৃথিবীতে ক্ষত্ত্রিয় ভিতরে।
কে করেছে নাম ধরি বলহ আমারে॥
গোকুলে করিলি যত জানে সর্ব্বজনা।
হরিলা কি পরদার যত ব্রজাঙ্গনা॥
কিবা তোর ক্রিয়া কর্ম্ম কি তোর আচার।
সভামধ্যে কহ পুন করি অহঙ্কার॥
শিশুপালের দোষাদি ক্ষমিয়াছি আমি।
দোষ না ক্ষমিয়া মোর কি করিবা তুমি॥
ক্ষম বা করহ ক্রোধ যেই লয় মতি।
তোমার কি শক্তি যে করিবা আমা প্রতি॥
এতেক বলিল যদি চেদীর ঈশ্বর।
শুনি সুদর্শনে আজ্ঞা দিলেন শ্রীধর॥
সুদর্শন মহাচক্র অগ্নি যেন জ্বলে।
শিশুপাল শির কাটি ফেলে ভূমিতলে॥
বজ্রাঘাতে চূর্ণ যেন হৈল গিরিবর।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল সব ক্ষিতীশ্বর॥
শিশুপাল-অঙ্গতেজ হইয়া বাহির।
আকাশে উঠিল যেন দ্বিতীয় মিহির॥
একদৃষ্টে দেখিছেন সব রাজগণে।
পুন আসি প্রণমিল কৃষ্ণের চরণে॥
কৃষ্ণের চরণে লিপ্ত হৈল আচম্বিত।
তাহা দেখি সভাজন হইল বিস্মিত॥
বিনা মেঘে বরিষয় গগনেতে জল।
কম্পিত নির্ঘাত শব্দে বৈল চলাচল॥
আর যত রাজগণ গর্জ্জিবারে ছিল।
ভয়েতে আকুল হৈয়া সবে লুকাইল॥
অধর কামড়ে কেহ ঠারাঠারি করে।
কোন কোন রাজা স্তুতি করে গোবিন্দেরে॥
সহোদরগণে বলিলেন যুধিষ্ঠির।
সৎকার কর শিশুপালের শরীর॥
শিশুপালপুত্ত্রে করি চেদীর ঈশ্বর।
ধর্ম্মরাজে নিবেদিল যত নৃপবর॥
সম্পূর্ণ হইল যজ্ঞ সিদ্ধ হৈল কাজ।
লক্ষ রাজা উপরে হৈলে মহারাজ॥
তোমার মহিমা যত কহেছি বিশেষ।
আজ্ঞা কৈলে যাই সবে নিজ নিজ দেশ॥
রাজগণ বচন শুনিয়া ধর্ম্মরায়।
কহিলেন ভ্রাতৃগণে পূজহ সবায়।
যথাযোগ্য মান্য করি ভূমিপতিগণে।
অগ্রসরি কত পথ যাও জনে জনে॥
রাজার আজ্ঞায় নানাবিধ রত্ন দিয়া।
পাঠাইল রাজগণে সন্তোষ করিয়া॥
৩২. যজ্ঞান্তে দুর্য্যোধনের স্বগৃহে গমন
রাজগণ নিজরাজ্যে করিল গমন।
ধর্ম্মরাজে কহিলেন দেব নারায়ণ।।
আজ্ঞা কর দ্বারকায় যাই মহাশয়।
তব যজ্ঞ পূর্ণ হৈল, মম ভাগ্যোদয়।।
অপ্রমাদে রাজ্য কর, পাল প্রজাগণ।
সুহৃদ কুটুম্ব লোক করহ পালন।।
এত বলি ধর্ম্ম সহ দেব নারায়ণ।
কুন্তীস্থানে গিয়া করিলেন নিবেদন।।
আজ্ঞা কর, যাই আমি দ্বারকা-ভুবনে।
হইল সাম্রাজ্য-লাভ তব পুত্রগণে।।
কুন্তী বলিলেন, তাত এ নহে অদ্ভুত।
যাহারে কিঞ্চিৎ দয়া করহ অচ্যুত।।
এত বলি কৃষ্ণশিরে করেন চুম্বন।
প্রণাম করেন হরি ধরিয়া চরণ।।
দ্রৌপদী সুভদ্রা সহ করি সম্ভাষণ।
একে একে সম্ভাষেণ ভাই পঞ্চজন।।
শুভক্ষণে রথে চড়ি যান দ্বারাবতী।
কৃষ্ণের বিচ্ছেদে দুঃখী ধর্ম্ম-নরপতি।।
হেনমতে নিজদেশে গেল সর্ব্বজন।
ইন্দ্রপ্রস্থে রহিল শকুনি দুর্য্যোধন।।
বাঞ্ছা বড় ধর্ম্মরাজ-সভা দেখিবারে।
কত দিন বঞ্চে তথা কুরু নৃপবরে।।
শকুনি সহিত সভা নিত্য নিত্য দেখে।
দিব্য মনোহর সভা অনুপম লোকে।।
নানারত্ন বিরচিত যেন দেবপুরী।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন কুরু-অধিকারী।।
অমূল্য রতনে বিমণ্ডিত গৃহগণ।
এক গৃহ তুল্য নহে হস্তিনা-ভুবন।।
দেখি দুর্য্যোধনা রাজা অন্তরে চিন্তিত।
এক দিন দেখে তথা দৈবের লিখিত।।
মাতুল সহিত বিহরয়ে নরবর।
স্ফটিকের বেদী দেখে যেন সরোবর।।
জল জানি নরপতি গুটায় বসন।
পশ্চাতে জানিয়া বেদী লজ্জিত রাজন।।
তথা হৈতে কতদূরে গেল নরবর।
লজ্জায় মলিন মুখ কাপেঁ থর থর।।
স্ফটিক-মণ্ডিত বাপী ভ্রমে না জানিল।
স-বসন দুর্য্যোধন বাপীতে পড়িল।।
দেখিয়া হাসিল সবে যত সভাজন।
ভীম পার্থ আর দুই মাদ্রীর নন্দন।।
দেখিয়া দিলেন আজ্ঞা রাজা ভ্রাতৃগণে।
ধরিয়া তুলিল বাপী হৈতে দুর্য্যোধনে।।
সোদক বসন ত্যজি পরাইল বাস।
নিবৃত্ত করিল যত লোকজন হাস।।
অভিমানে কাপে দুর্য্যোধন-কলেবর।
বাহির হইব তব চিন্তিল অন্তর।।
ক্রোধেতে চলিল তবে গান্ধারী-কুমার।
ভ্রম হৈল দেখিবারে, না পায় দুয়ার।।
স্থানে স্থানে প্রাচীরেতে স্ফটিক-মণ্ডন।
দ্বার বোধে সেই দিকে চলে দুর্য্যোধন।।
ললাটে প্রাচীর বাজি পড়িল ভূতলে।
দেখিয়া হাসিল পুনঃ সভার সকলে।।
তাহা দেখি শীঘ্রগতি ধর্ম্মের কুমার।
নকুলে পাঠায়ে দিল দেখাইতে দ্বার।।
নকুল ধরিয়া হস্ত করিল বাহির।
অভিমানে দুর্য্যোধন কম্পিত শরীর।।
ক্ষণমাত্র তথায় না বিলম্ব করিল।
যুধিষ্ঠির-আজ্ঞা মাগি রথে আরোহিল।।
মাতুল সহিত তবে চলিল হস্তিনা।
ঘনশ্বাস হেঁটমাথা হইয়া বিমনা।।
যত যত শকুনি বলয়ে দুর্য্যোধনে।
উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞাসিল ততক্ষণে।।
সঘনে নিশ্বাস কেন মলিন বদন।
অত্যন্ত চিন্তিত চিত্ত কিসের কারণ।।
দুর্য্যোধন বলে, মামা করহ শ্রবণ।
হৃদয় দহিছে মম এই অপমান।।
পাণ্ডবের বশ হৈল পৃথিবী-মণ্ডলে।
এক লক্ষ নরপতি রহে ছত্রতলে।।
ইন্দ্রের বৈভব জিনি কুন্তীর কুমার।
কুবেরের কোষ জিনি পূর্ণিত ভাণ্ডার।।
এ সব দেখিয়া মোর শুকাইল কায়।
সরোবর-জল যেন নিদাঘে শুকায়।।
আর দেখ আশ্চর্য্য মাতুল মহাশয়।
কীর্ত্তিশ্রেষ্ঠ করিলেক কুন্তীর তনয়।।
শিশুপালে বিনাশ করিল নারায়ণ।
কেহ এক ভাষা না কহিল রাজগণ।।
দ্বন্দ্ব করিবারে সবে আছিল সংহতি।
সে মরিলে লুকাইল সব নরপতি।।
পাণ্ডবের তেজে ছন্ন হৈল রাজগণে।
ক্ষত্র হৈয়ে সহে হেন কাহার পরাণে।।
আর অপরূপ তুমি দেখিলেক চোখে।
কত রত্ন লৈয়ে দ্বারে রাজগণ থাকে।।
বৈশ্য যেন কর লৈয়ে থাকে দাণ্ডাইয়া।
পশিতে না দেয় দ্বারে রাখে আগুলিয়া।।
এ সব দেখিয়া মম চিত্ত নহে স্থির।
অভিমানে শীর্ণ হৈল আমার শরীর।।
ভাই হইয়া ক্ষম মম নহিল সে রূপে।
দহিছে মাতুল অঙ্গ আমার এ তাপে।।
নিশ্চয় করিয়া আমি কহি যে তোমারে।
কিবা জলে পশি কিবা অনল ভিতরে।।
অথবা মরিব আমি খাইয়া গরল।
সহিতে না পারি, অঙ্গদহে চিন্তানল।।
বৈরীর সম্পদ যদি হীনলোকে দেখে।
সেহ সহিবারে নারে সদা পোড়ে শোকে।।
আমি হেন লোক হৈয়ে সহিব কেমনে।
এরূপ শত্রুর বৃদ্ধি দেখিয়া নয়নে।।
বলাধিক যুধিষ্ঠির আমি হীনবল।
সাগরান্ত ধরা তার অধীন সকল।।
কি কহিব মাতুল সকল দৈববশ।
কি কহিব রূপ গুণ সৌভাগ্য পৌরুষ।।
বনে জন্ম হৈল পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
হস্তিনা আইল যেন বনবাসী জন।।
পিতৃহীন দুঃখিত বঞ্চিত মম ঘরে।
কতেক উপায় করিলাম মারিবারে।।
কিছু না হইল তার আমার মায়ায়।
দিনে দিনে বৃদ্ধি যেন পদ্মবন প্রায়।।
দেখহ মাতুল হেন দৈবের কারণ।
এত হীন হৈল ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ।।
পৃথার নন্দন হাসে আমাকে দেখিয়া।
কিমতে রাখিব তনু এ তাপ সহিয়া।।
এই সব কথা তুমি কহিও জনকে।
না যাইব গৃহে আমি, পশিব পাবকে।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
শকুনি বলিল, ক্রোধ কর নিবারণ।।
যুধিষ্ঠিরে কদাচিত না হিংসিবে মনে।
তব প্রীতি সদা বাঞ্ছে ধর্ম্মের নন্দনে।।
যে কিছু বিভাগ দিলে করি বিবেচন।
তাহাতে সন্তুষ্ট হৈল ধর্ম্মের নন্দন।।
উপায় কতেক তুমি করিলে মারিতে।
তারা ধর্ম্ম হৈতে মুক্ত হইল তাহাতে।।
জতুগৃহে মুক্ত হৈয়ে পাঞ্চালেতে গেল।
সভামধ্যে লক্ষ্য বিন্ধি দ্রৌপদী পাইল।।
সহায় দ্রুপদ হৈল ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।
রাজ-চক্রবর্ত্তী হৈল রাজা যুধিষ্ঠির।।
সসাগরা পৃথিবী খাটিল ছত্রতলে।
যতেক করিল সব নিজ ভুজবলে।।
ইথে কেন তাপ তুমি করহ হৃদয়।
তব অংশ হৈতে তারা কিছু নাহি লয়।।
অক্ষয় যুগল তূণ গাণ্ডীব ধনুক।
এ সব পাইল তৃপ্ত করিয়া পাবক।।
অগ্নি হৈতে ময়েরে করিল পরিত্রাণ।
সে দিলেক দিব্য সভা করিয়া নির্ম্মাণ।।
নিজ পরাক্রমেতে করিল ক্রতুরাজ।
তুমি কেন তাপ তাহে কর হৃদিমাঝ।।
তুমিহ করহ যজ্ঞ নিজ ভুজ জোরে।
তুমি কিসে অসমর্থ কহ দেখি মোরে।।
কহিলে যে, কেহ নাহি আমার সহায়।
তোমা অনুগত যত, কহি শুন রায়।।
শত ভাই তোমার প্রচণ্ড মহারথা।
শত পুত্র প্রতাপের কি কহিব কথা।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা মহাবীর।
ভূরিশ্রবা সোমদ্ত্ত প্রতাপে মিহির।।
জয়দ্রথ বাহ্লীক ও আমরা থাকিতে।
তোমারে বধিতে কেবা আছে পৃথিবীতে।।
তুমিও পৃথিবী শাসি সঞ্চহ রতন।
কোন কর্ম্মে হীন তুমি, চিন্ত সে কারণ।।
দুর্য্যোধন বলে, আগে জিনিব পাণ্ডব।
পাণ্ডব জিনিলে মম বশ হৈবে সব।।
শকুনি বলিল, ভাল বিচারিলা মনে।
সংগ্রামে কে জিনিবেক পাণ্ডু-পুত্রগণে।।
পুত্র সহ দ্রুপদ সহায় নারায়ণ।
ইন্দ্র নারে জিনিবারে পাণ্ডুর নন্দন।।
জিনিবারে এক বিদ্যা আছে মম স্থান।
জিনিবারে চাহ যদি, লহ সেই জ্ঞান।।
দুর্য্যোধন বলে, কহ মাতুল সুমতি।
হেন বিদ্যা আছে যদি, দেহ শীঘ্রগতি।।
বিনা অস্ত্র প্রহারি পাণ্ডবদিগে জিনি।
কহ শীঘ্র মাতুল আনন্দ হৌক শুনি।।
শকুনি বলিল, এই শুন দুর্য্যোধন।
পাশায় নিপুণ নহে ধর্ম্মের নন্দন।।
তথাপিহ ইচ্ছা বড় পাশা খেলিবারে।
মোর সহ খেলি জিনে নাহিক সংসারে।।
ক্ষত্রনীতি আছে হেন যদ্যপি আহবয়।
কিবা দ্যূতে কিবা যুদ্ধে বিমুখ না হয়।।
কদাচিৎ যুধিষ্ঠির বিমুখ না হৈবে।
খেলিলে তোমার জয় অবশ্য হইবে।।
পিতারে এ সব কথা কহ গিয়া রেগে।
মম শক্তি নহিবে কহিতে তাঁর আগে।।
এইরূপ বিচার করিয়া দুই জনে।
হস্তিনা নগরে প্রবেশিল কতক্ষণে।।
ধৃতরাষ্ট্র-চরণে করিল নমস্কার।
আশিস্ করিয়া জিজ্ঞাসিল সমাচার।।
নিঃশব্দেতে রহিল নৃপতি দুর্য্যোধন।
কহিতে লাগিল তবে সুবল-নন্দন।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র তব রায় সর্ব্বগুণবান।
হেন পুত্রে কেন তব নাহি অবধান।।
দিনে দিনে ক্ষীণ হয়, জীর্ণ শীর্ণ অঙ্গ।
রক্তহীন দেখি যে শরীর-বর্ণ পিঙ্গ।।
কি কারণে নাহি বুঝি হেন মনস্তাপ।
সঘনে নিশ্বাস, যেন দণ্ডাহত সাপ।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, কহ শুনি দুর্য্যোধন।
অঙ্গ তব হীনবল কিসের কারণ।।
শকুনি বলিল যত, শুনিনু শ্রবণে।
কি দুঃখ তোমার, নাহি লয় মোর মনে।।
কে আছে তোমার শত্রু, কার এত বল।
কোন সুখে হীন তুমি হইলে দুর্ব্বল।।
ধনে জনে সম্পদেতে কে আঁটে তোমায়।
কোনজন আছে হেন বীর বসুধায়।।
দিব্য ভক্ষ্য, দিব্য বস্ত্র, দিব্য আভরণ।
মনোহর গৃহ সব মণ্ডিত রতন।।
কি তব অসাধ্য, অনুশোচ কি কারণ।
এত শুনি কহিতে লাগিল দুর্য্যোধন।।
যে সকল ভুঞ্জি আমি ভোগের কারণ।
এত শুনি কহিতে লাগিল দুর্য্যোধন।।
সে সকল ভুঞ্জি আমি ভোগের কারণ।
অতি হীন জনের তা ভোগের বিধান।।
এই মনস্তাপ পিতা কর অবধান।
মৃত্যু নাহি, জিয়ে আছি, কঠিন পরাণ।।
শত্রুর সম্পদ পিতা দেখিয়া নয়নে।
নাহি হয় দেহ পুষ্ট, না তৃপ্তি ভোজনে।।
পাণ্ডবের লক্ষ্মী যেন দীপ্ত দিনকর।
সেই তাপে দহিতেছে মম কলেবর।।
পাণ্ডব-সম্পদ তুল্য নাহি দেখি শুনি।
কহিতে না পারি পিতঃ তাহার কাহিনী।।
অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ নিত্য ভুঞ্জে গৃহে।
সুবর্ণের পাত্রে ভুঞ্জে, সুর মন মোহে।।
পৃথিবীর রাজগণ নানারত্ন লৈয়ে।
বৈশ্যগণ প্রায় থাকে দ্বারে দাণ্ডাইয়ে।।
এত রাজা রাজসূয় করিল যখন।
না জানি যে কত দ্বিজ করয়ে ভোজন।।
মুহূর্ত্তেকে পিতা এক লক্ষ দ্বিজ ভুজে।
এক লক্ষ পূর্ণ হৈলে এক শঙ্খ বাজে।।
হেনমতে মুহুমুর্হু বাজে শঙ্খগণ।
অহর্নিশি শঙ্খ বাজে, না যায় গণন।।
শঙ্খ-শব্দ শুনি মম চমকিত মন।
ধনের কতেক পিতা করিব বর্ণন।।
সে সব দেখিয়া চমৎকার লাগে মনে।
ইহার উপায় পিতা করহ আপনে।।
পাণ্ডবেরে জিনি, হেন যে থাকে উপায়।
বিনা দ্বন্দ্বে পারি, যদি আজ্ঞা কর রায়।।
পাশাক্রীড়া জানে ভাল মাতুল শকুনি।
পাশায় পাণ্ডব-লক্ষ্মী সব লৈব জিনি।।
এতেক শুনিয়া কহে অন্ধ নৃপবর।
বিদুরে জিজ্ঞাসি আমি কহিব উত্তর।।
বুদ্ধিদাতা বিদুর সে মন্ত্রী-চূড়ামণি।
মম অনুগত বড়, কহে হিতবাণী।।
তাঁরে না জিজ্ঞাসি আমি কহিবারে নারি।
করিবারে যদি হয়, তাঁর বাক্যে পারি।।
দুর্য্যোধন বলে, পিতা বিদুরে না কবে।
বিদুর শুনিলে সে এখনি নিবারিবে।।
তাঁর বাক্য শুনি তুমি করিবে অন্যথা।
আমার মরণ ইথে হইবে সর্ব্বথা।।
আমি মরি, বঞ্চ সুখে বিদুর সহিত।
পুত্র-বাক্যে অন্ধ রাজা হইল দুঃখিত।।
দুর্য্যোধন-মন বুঝি আশ্বাস করিল।
খেল পাশা, বলি তারে অন্ধ আজ্ঞা দিল।।
বহু স্তম্ভে বহু রত্নে কর এক ঘর।
চারি গোটা দ্বার তার কর পরিসর।।
নির্ম্মাণ করিয়া গৃহ কহিবে আমারে।
এত বলি শান্ত রাজা করিল পুত্রেরে।।
মহাবিচক্ষণ হয় বিদুর সুমতি।
জানিয়া অন্ধের স্থানে গেল শীঘ্রগতি।।
বিদুর বলিল, রাজা কি কর বিচার।
শুনি আজ্ঞা তব রহিতে নারিনু আর।।
পুত্রে পুত্রে ভেদ না করিহ কদাচন।
সর্ব্বনাশ করে দ্যূতে, জানে সর্ব্বজন।।
দৈবে যাহা করে, তাহা কে খণ্ডিতে পারে।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, কিছু না বল আমারে।।
ভীষ্ম আর আমি থাকি ন্যায় বিচারিব।
কদাচিত পুত্রে পুত্রে দ্বন্দ্ব না করাব।।
পশ্চাৎ হইবে যেই আছয়ে নিয়ত।
দৈব বলবান যে না করে হেন মত।।
এখনি ত্বরিত তুমি ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়া।
হেথাকারে যুধিষ্ঠিরে আনহ ডাকিয়া।।
ধর্ম্মরাজে না কহিবে এই বিবরণ।
এত শুনি ক্ষত্তা হৈল বিষণ্ণ-বদন।।
বিদুর কহিল, রাজা না কহিলা ভাল।
জানিলাম আজি হৈতে সর্ব্বনাশ হৈল।।
এত বলি বিদুর হইল ক্ষুন্নমতি।
ভীষ্ম-স্থানে জানাইতে গেল শীঘ্রগতি।।
সভাপর্ব্ব সুধারস, পাশা অনুবন্ধ।
কাশীরাম দাস কহে, পাঁচালি প্রবন্ধ।।
৩৩. দ্যূত-ক্রীড়ার মন্ত্রণা
জন্মেজয় বলে, কহ শুনি মুনিবর।
কি হেতু হইল পাশা অনর্থের ঘর।।
পিতামহ পিতামহী দুঃখ যাহে পাইল।
কেবা খেলা নিবর্ত্তিল কেবা প্রবর্ত্তিল।।
কোন্ কোন্ জন ছিল সভার ভিতর।
যেই পাশা হৈতে হৈল ভারত-সমর।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের তনয়।
ক্ষত্তাবাক্য শুনি অন্ধ চিন্তিত হৃদয়।।
দৃঢ় করি জানিল এ কর্ম্ম ভাল নয়।
একান্তে ডাকিয়া রাজা দুর্য্যোধনে কয়।।
হে পুত্র কদাচ তুমি না খেলিহ পাশা।
এ কর্ম্মেতে বিদুর না করিল ভরসা।।
সুবুদ্ধি বিদুর মত অহিত না ইচ্ছে।
তাঁর বাক্য না শুনিলে দুঃখ পাবে পিছে।।
দেবে যেন বৃহস্পতি দেবরাজ হিত।
এইরূপ ক্ষত্তা মম, জানিও নিশ্চিত।।
গুরুর অধিক পুত্র! ক্ষত্তার মন্ত্রণা।
বিচক্ষণ ক্ষত্তা কুরু-বংশেতে গণনা।।
সুরকুলে বৃহস্পতি, কুরুকুলে ক্ষত্তা।
বৃষ্ণিকুলে উদ্ভব, সুবুদ্ধি জ্ঞানদাতা।।
বিদুর কহিল, পাশা অনর্থের ঘর।
দ্যূত হৈতে ভেদাভেদ আছে সুগোচর।।
ভ্রাতৃভেদ হৈলে যে হৈবে সর্ব্বনাশ।
বিদুরের বাক্য শুনি হৈল মম ত্রাস।।
মাতা পিতা যদি তুমি মান দুর্য্যোধন।
না খেলাও দ্যূত, তুমি শুনহ বচন।।
পরম পণ্ডিত তুমি না বুঝহ কেনে।
কি কারণে হিংসা কর পাণ্ডব নন্দনে।।
কুরুকুলে জ্যেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরে গণি।
হস্তিনা-নগর কুরুকুল-রাজধানী।।
যুধিষ্ঠির বর্ত্তমানে পাইলে হস্তিনা।
তুমি যাহা দিলে, তাহা নিল পঞ্চজনা।।
ইন্দ্রের সমান পুত্র! তোমার বৈভব।
নরজন্ম লভি কার এমত সম্ভব।।
ইথে অনুশোচ পুত্র কিসের কারণ।
কি হেতু উদ্বেগ কর, কহ দুর্য্যোধন।।
দুর্য্যোধন বলে, পিতা সমর্থ হইয়া।
অহঙ্কার নাহি যার শত্রুকে দেখিয়া।।
কাপুরুষ মধ্যে গণ্য হয় হেন জন।
বিশেষ ক্ষত্রিয় জাতি, জানহ আপন।।
মোরে যে বলিলে, লক্ষ্মী গণি সাধারণ।
এই মত লক্ষ্মী পিতা ভুঞ্জে বহুজন।।
কুন্তী-পুত্র-লক্ষ্মী যেন দীপ্ত হুতাশন।
দেখি মোর ধন্য প্রাণ আছে এতক্ষণ।।
পৃথিবী ব্যাপিল পিতা পাণ্ডবের যশে।
যতেক নৃপতি পিতা হৈল তার বশে।।
যদু ভোজ অন্ধক কুক্কুর লোক অঙ্গ।
কারস্কর বৃষ্ণি, এই সপ্ত বংশ সঙ্গ।।
যুধিষ্ঠির-বচনে সদাই কৃষ্ণ খাটে।
সমস্ত ভূপতি কর দেয় করপুটে।।
আর করিলেক কত কপট পাণ্ডব।
মম স্থানে ধন রত্ন রাখিলেক সব।।
পূর্ব্বে নাহি শুনি পিতা যে রত্নের নাম।
সে সকল দেখিলাম যুধিষ্ঠির-ধাম।।
নানাবর্ণ-রত্ন সব, না যায় কথন।
সিন্ধুমধ্যে গিরিমধ্যে জন্মে যত ধন।।
ধরামধ্যে বৃক্ষমধ্যে জীবের অঙ্গেতে।
সর্ব্বরত্ন আছে পিতা তার ভাণ্ডারেতে।।
লোমজ পট্টজ চীর বিবিধ বসন।
গজদন্ত-বিরচিত দিব্য সিংহাসন।।
হস্তী অশ্ব উট গাধা মেষ আর অজা।
নানাবর্ণে আনি দিল নানাদেশী রাজা।।
শ্যামলা তরুণী দিব্যরূপা দীর্ঘকেশী।
সহস্র সহস্র দাসী নানাবর্ণে ভূষি।।
দেখিতে দেখিতে মম ভ্রম হৈল মন।
অপমান কৈল যত, শুনহ কারণ।।
মায়া-সভা মধ্যে কিছু না পাই দেখিতে।
স্ফটিকের বেদী সব হেন লয় চিতে।।
জল জানি তুলিলাম পিন্ধন-বসন।
দেখিয়া হাসিল লোক যত সভাজন।।
তথা হৈতে কতদূরে দেখি জলাশয়।
স্ফটিক বলিয়া তায় মনোভ্রম হয়।।
পড়িলাম মহাশব্দে সবস্ত্র তাহাতে।
চতুর্দ্দিকে লোকগণ লাগিল হাসিতে।।
ভীম ধনঞ্জয় আর যত সভাজন।
দ্রৌপদীর সহিত যতেক নারীগণ।।
সর্ব্বজন আমারে করিল উপহাস।
যুধিষ্ঠির পরিবারে দিল অন্য বাস।।
বলিল কিঙ্করগণে বস্ত্র আনিবারে।
পরাইল বাপী হৈতে তুলিয়া আমারে।।
কার প্রাণে সহে পিতা এত অপমান।
আরে যে করিল পিতা কর অবধান।।
স্থানে স্থানে ফটিকের নির্ম্মিত প্রাচীর।
দ্বার হেন বুঝিলাম আসিতে বাহির।।
মস্তকে লাগিল ঘাত, পড়িনু ভূতলে।
মাদ্রী-পুত্র ‍দুই আসি ত্বরিত তুলিলে।।
মম দুঃখে দুঃখিত হইল দুইজন।
হাতে ধরি দেখাইল দুয়ার তখন।।
এত অপমান পিতা সহে কার প্রাণে।
ক্ষত্র কি সহিতে পারে, সহে হীন জনে।।
এই হেতু হৈল পিতা মোর অভিমান।
কিবা তার লক্ষ্মী লই, কিবা যাক্ প্রাণ।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, পুত্র হিংসা বড় পাপ।
হিংস্রক জনের পুত্র জন্মে বড় তাপ।।
অহিংসক পাণ্ডবের না করিবে হিংসা।
শান্ত হয়ে থাক পুত্র! পাইবে প্রশংসা।।
সেই মত যজ্ঞ করিবারে যদি মন।
কহ পুত্র নিমন্ত্রণ করি রাজগণ।।
আমার গৌরব করে সব নৃপবর।
ততোধিক রত্ন দিকে আমার বিস্তর।।
ইহা না করিয়া যাহা করহ বিচার।
অসৎ মার্গেতে গেলে দূষিবে সংসার।।
পরদ্রব্য দেখি হিংসা না কের যে জন।
স্বধর্ম্মেতে সদা বঞ্চে সন্তোষিত মন।।
স্বকর্ম্মে উদ্যোগ করে পর-উপকারী।
সদাকাল সুখে বঞ্চে, কি দুঃখ তাহারি।।
পর নহে নিজ ভাই পাণ্ডুর নন্দন।
দ্বেষভাব তার নাহি করিহ কখন।।
পাণ্ডবের যশ যত নিজ করি জানি।
যথোচিত ভোগ কর অতি প্রীত মানি।।
তোমারেও করে স্নেহ ধর্ম্মের নন্দন।
দ্বেষভাব তারে না করিও কদাচন।।
দুর্য্যোধন বলে, পিতা প্রজ্ঞাবান্ নহি।
বহু শুনিয়াছি বলি শাস্ত্রকথা কহি।।
সে জন কি জানে পিতা শাস্ত্রের বিবাদ।
চাটু যেন নাহি জানে পিষ্টকের স্বাদ।।
রাজা হয়ে এক আজ্ঞঅ নহিল যাহার।
তারে রাজা নাহি বলি শাস্ত্র-অনুসার।।
রাজা হৈয়ে সন্তোষ না রাখিবে কদাচন।
ধনে জনে শান্তি না রাখিবে কখন।।
শত্রুকে বিশ্বাস আর নাহি কদাচন।
নমুচি-দানবে যথা সহস্রলোচন।।
এক পিতা হৈতে হৈল দোঁহার উৎপত্তি।
বহুকাল প্রীতে ছিল নমুচি সংহতি।।
সময়ে তাহারে ইন্দ্র করিল সংহার।
নিষ্কণ্টকে ভোগ করে অদিতি-কুমার।।
শত্রু অল্প যদি, তবু নাশে সে কারণ।
মূলস্থ বল্মীক যেন গ্রাসে তরুগণ।।
জ্ঞাতিমধ্যে যেই জন ধনে বলবান।
ক্ষত্রমধ্যে সেই শত্রু, গণি যে প্রধান।।
আপনি জানিয়া কেন করহ বঞ্চন।
নিশ্চয় জানিনু চাহ আমার নিধন।।
পুনঃ ধৃতরাষ্ট্র বহু মধুর বচনে।
নিবারিতে না পারিয়া পুত্র দুর্য্যোধনে।।
দৈবগতি জানিয়া বিদুরে ডাকাইল।
যুধিষ্ঠিরে আন গিয়া বলি আজ্ঞা দিল।।
বিদুর বলিল, রাজা শ্রেয়ঃ নহে কথা।
কুলনাশ হৈবে জানি মনে পাই ব্যথা।।
অন্ধ বলে, আমারে যে না বলিহ আর।
দৈববশ দেখি এই সকল সংসার।।
নারিল বিদুর আজ্ঞা করিতে হেলন।
রথে চড়ি ইন্দ্রপ্রস্থে করিল গমন।।
ধর্ম্মরাজ বিদুরে করিয়া দরশন।
যথাবিধি পূজা করিলেন পঞ্চজন।।
জিজ্ঞাসা করেন, কহ ভদ্র সমাচার।
কি কারণে অন্যচিত্ত দেখি যে তোমার।।
বিদুর বলেন, রাজা চল হস্তিনায়।
বিলম্ব না কর ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায়।।
আর যে বলিব, তাহা শুনহ সুমতি।
তব সভা তুল্য সভা করিয়াছে তথি।।
ভ্রাতৃগণ সহ মম সভা দেখ আসি।
দ্যূত-আদি ক্রীড়া কর সভামধ্যে বসি।।
সভায় বসিলে মম তৃপ্ত হয় মন।
এই হেতু আমারে পাঠাইল, রাজন।।
যুধিষ্ঠির বলে, দ্যূত অনর্থের ঘর।
দ্যূত-ক্রীড়া ইচ্ছে যত জ্ঞানভ্রষ্ট নর।।
যে হৌক সে হৌক, আমি অধীন তোমার।
কি কাজ করিব, মোরে কহ সমাচার।।
বিদুর বলেন, দ্যূত অনর্থের মূল।
দ্যূতেতে অনর্থ জন্মে, ভ্রষ্ট হয় কুল।।
করিলাম অন্ধ নৃপে অনেক বারণ।
আমারে পাঠাল তবু না শুনি বচন।।
বুঝিয়া করহ রাজা যাহে শ্রেয়ঃ হয়।
যাহ বা না যাহ তথা, যেবা চিত্তে লয়।।
ধর্ম্ম বলিলেন, আজ্ঞা দেন কুরুপতি।
গুরু-আজ্ঞা ভঙ্গ কৈলে নরকে বসতি।।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম তাত জানহ যেমন।
দ্যূতে কিম্বা যুদ্ধে যদি করে আবাহন।।
বিশেষে আমার সত্য প্রতিজ্ঞা-বচন।
দ্যূত কিম্বা যুদ্ধে আমি না ফিরি কখন।।
এত বলি যুধিষ্ঠির সহ ভ্রাতৃগণ।
দ্রৌপদীরে কহিয়া গেলেন ততক্ষণ।।
দৈবপাশে বান্ধি যেন লোকে লৈয়ে যায়।
ক্ষত্তাসহ পঞ্চ ভাই যায় হস্তিনায়।।
ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ সোমদত্ত।
গান্ধারী সহিত অন্তঃপুর-নারী যত।।
একে একে সবাকারে করি সম্ভাষণ।
রজনী বঞ্চেন তথা সুখে পঞ্চজন।।
৩৪. যুধিষ্ঠিরের সহিত শকুনির প্রথমবার
দ্যূতক্রীড়া ও শকুনির জয়লাভ
রজনি প্রভাতে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
সুখে দিব্য সভামধ্যে করিল গমন।।
একে একে সম্ভাষ করিয়া সর্ব্বজনে।
বসিলেন অপূর্ব্ব কনক সিংহাসনে।।
হেনকালে শকুনি আনিল পাশা-সারি।
যুধিষ্ঠিরে বলে তবে প্রবঞ্চনা করি।।
পুরুষের মনোরম দূতক্রীড়া জানি।
দ্যূতক্রীড়া কর আজি ধর্ম্ম-নৃপমণি।।
যুধিষ্ঠির বলে, পাশা অনর্থের ঘর।
ক্ষত্র-পরাক্রম ইথে না হয় গোচর।।
কপট এ কর্ম্ম, ইথে কপট বাখান।
অনীতি কর্ম্মেতে মম নাহি লয় মন।।
শকুনি বলিল, পাশা সুবুদ্ধির কর্ম্ম।
দ্যূত কিম্বা যুদ্ধ এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
যুদ্ধেতে অজাতি জাতি নাহিক বিচার।
হীনজাতি যবনাদি করয়ে প্রহার।।
পাশার সমান সেহ বুদ্ধির সমর।
ক্ষত্রধর্ম্ম আছে হেন, বলে মুনিবর।।
যুধিষ্ঠির বলে, পাশা অনর্থের মূল।
অধর্ম্ম করিয়া মোরে না জিনি মাতুল।।
অন্য নাহি মনে মম দ্বিজ সেবা বিনা।
এ কর্ম্ম মাতুল আমি না করি কামনা।।
শকুনি বলিল, তুমি যাও নিজ স্থানে।
পণ্ডিতে পণ্ডিতে ক্রীড়া, পণ্ডিত সে জানে।।
যদি দ্যূতক্রীড়া ইচ্ছা নাহিক তোমার।
নিবর্ত্তিয়া গৃহে তবে যাহ আপনার।।
যুধিষ্ঠির বলে, যবে ডাকিলা আমারে।
সত্য মম না টলিবে পাশার সমরে।।
সত্য আমি খেলিব পাশার আবাহনে।
তব সহ পণ কিন্তু করে কোন্ জনে।।
মেরুতুল্য আমার যে আছে বহু ধন।
চারি সমুদ্রের মধ্যে যতেক রতন।।
দুর্য্যোধন বলে, মম মাতুল খেলিবে।
সর্ব্বরত্ন দিব আমি যতেক হারিবে।।
এইরূপে দুইজনে পাশা আরম্ভিল।
দেখিবারে সর্ব্বজন সভাতে বসিল।।
ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ মহামতি।
চিত্তে অসন্তোষ অতি বিদুর প্রভৃতি।।
ধর্ম্ম বলিলেন, পণ হইল আমার।
ইন্দ্রপ্রস্থে যত মম রত্নের ভাণ্ডার।।
ঈদৃশ তোমার ধন কোথা দুর্য্যোধন।
হারিলে, কোথা হইতে দিবে এই পণ।।
দুর্য্যোধন বলে, মম আছয়ে অনেক।
অবশ্য অর্পিব আমি জিনিবে যতেক।।
নির্ণয় করিয়া সারি ফেলিল শকুনি।
কটাক্ষে সকল রত্ন লইলেক জিনি।।
ক্রোধে যুধিষ্ঠির পুনঃ করিলেন পণ।
কোটি কোটি মহাবল যত অশ্বগণ।।
শকুনি হাসিয়া ফেলি জিনিলাম কয়।
কি পণ করিবা আর কহ মহাশয়।।
যুধিষ্ঠির বলে, মোর রথ অগণন।
নানারত্নে বিভূষিত, মেঘের গর্জ্জন।।
শকুনি হাসিয়া বলে ডাকি ততক্ষণ।
এবে দেখ জিনিলাম, কর অন্য পণ।।
ধর্ম্ম বলিলেন, হস্তীবৃন্দ যে আমার।
ঈষাদন্ত মহাকায় বলে অনিবার।।
সব হস্তী করি পণ, পুনঃ খেলি পাশা।
জিনিলাম শকুনি বলিয়া কহে ভাষা।।
যুধিষ্ঠির বলে, তবে আছে দাসীগণ।
সহস্র সহস্র, নানারত্নে বিভূষণ।।
সবার সৌজন্য বড় ব্রাহ্মণ-সেবাতে।
করিলাম তাহা পণ এবার পাশাতে।।
শকুনি ফেলিয়া পাশা বলয়ে হাসিয়া।
অন্য পণ কর, হের নিলাম জিনিয়া।।
ধর্ম্ম বলে, গন্ধর্ব্বাশ্ব আছে অগণন।
তিলেক না হয় শ্রম ভ্রমিলে ভুবন।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্ব তুরঙ্গ আনি দিল।
এবার দ্যুতেতে সেই অশ্ব পণ হৈল।।
হাসিয়া বলয়ে তবে সুবল-কুমার।
অশ্বগণ জিনিলাম, কর পণ আর।।
যুধিষ্ঠির বলে, যে আছয়ে যোদ্ধাগণ।
মহারথী-মধ্যে করি সে সব গণন।।
এবার দ্যুতেতে আমি করিলাম পণ।
হাসিয়া জিনিনু বলে গান্ধার-নন্দন।।
এই মত প্রবর্ত্তিল কপট দেবন।
একে একে হারিলেন ধর্ম্ম সর্ব্বধন।।
৩৫. ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের উক্তি
দেখিয়া ব্যাকুল হৈল বিদুরের মন।
ধৃতরাষ্ট্রে ডাকি তবে বলিছে বচন।।
আমি যত বলি, তব মনে নাহি লয়।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঔষধ না খায়।।
ওহে অন্ধরায় তুমি হইলা কি স্তব্ধ।
জন্মকালে এই পুত্র কৈল খর-শব্দ।।
তখনি বলিনু আমি সকল বিস্তার।
কুরুকুল-ক্ষয় হেতু হইল কুমার।।
না শুনিলা মম বাক্য করিয়া হেলন।
সেই সব রাজা ব্যক্ত হতেছে এখন।।
সংহার-রুপেতে এই আছে তব ঘরে।
স্নেহেতে ভুলিয়া নাহি পাও দেখিবারে।।
দেব-গুরু-নীতি রাজা কহি সে তোমারে।
মধুহেতু মধুলোভী উঠে বৃক্ষোপরে।।
নাহিক পতন-ভয় মধুর কারণ।
সেইরূপ মত্ত হইয়াছে দুর্য্যোধন।।
মহারথিগণ সহ করয়ে বৈরিতা।
পশ্চাৎ জানিবে, এবে নাহি শুন কথা।।
এইরূপে কংস ভোজ হইল উৎপত্তি।
সপ্তবংশ পিতার নাশিল দুষ্টমতি।।
উগ্রসেন আদি সবে করি এ প্রকার।
গোবিন্দের হাতে তবে হইল সংহার।।
সপ্তবংশ সুখে বৈসে গোবিন্দ সংহতি।
মম বাক্য শুন রাজা, পাবে বড় প্রীতি।।
শীঘ্রগতি পার্থে আজ্ঞা করহ রাজন।
দুর্য্যোধনে রাখ গিয়া করিয়া বন্ধন।।
নির্ভয়ে পরম-সুখে থাকহ নৃপতি।
কাক-হস্তে ময়ুরের না কর দুর্গতি।।
শিবা-হস্তে সিংহের না কর অপমান।
শোক-সিন্ধু মধ্যে রাজা না কর প্রয়াণ।।
যে পক্ষী প্রসব করে অমূল্য রতন।
মাংসলোভে তারে নাহি খায় বিজ্ঞজন।।
সুবর্ণের বৃক্ষ রাজা রোপিয়া যতনে।
বৃক্ষ রক্ষা কৈলে, পুষ্প পায় অনুদিনে।।
যে হইল, এখন নিবর্ত্ত নরপতি।
পুত্রগণে কেন কর যমের অতিথি।।
এ পঞ্চ জনের সহ কে করিবে রণ।
কহ শুনি রাজা তব আছে কোন্ জন।।
দিক্পাল সহ যদি আইসে বজ্রপাণি।
পাণ্ডবে জিনিতে নারে, তোমা কিসে গণি।।
হে ভীষ্ম, হে দ্রোণ, কৃপ নাহি শুন কেনে।
সবে মেলি রঙ্গ দেখ, বুঝিলাম মনে।।
অগাধ সমুদ্রে নৌকা না ডুবাহ হেলে।
সবে মিলি যম-গৃহে যাইতে বসিলে।।
অক্রোধ অজাত-শত্রু ধর্ম্মের তনয়।
যে ক্ষণে করিবে ক্রোধ ভীম ধনঞ্জয়।।
যমজ যুগল যবে করিবেক ক্রোধ।
কে আছে সহায় তব করিতে বিরোধ।।
হে অন্ধ, পাশাতে যত লইবে বেসাত।
বুঝিলা কি তাহাতে তোমার নাহি হাত।।
কপট করিয়া তাহে কোন্ প্রয়োজন।
আজ্ঞামাত্র দিবে সব ধর্ম্মের নন্দন।।
এই শকুনিরে আমি ভালমতে জানি।
কপট কুবুদ্ধি খলগণ-চূড়ামণি।।
কোথায় পর্ব্বতপুর ইহার নিবাস।
কে আনিল হেথায় করিতে সর্ব্বনাশ।।
বিদায় করহ, ঘরে যাক আপনার।
উঠ গো শকুনি পাশা করি পরিহার।।
সভাতে এতেক যদি বিদুর বলিল।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত ঢালি দিল।।
দুর্য্যোধন বলে, আমি তোমা না জিজ্ঞাসি।
কার হৈয়ে কহ ভাষা সভামাঝে বসি।।
জিহবাতে হৃদয়-তত্ত্ব মনুষ্যের জানি।
সদাকাল চাহ তুমি ধৃতরাষ্ট্র-হানি।।
পাণ্ডু-পুত্র প্রিয় তব সর্ব্বলোকে জানে।
নিকটে না রাখি কভু শত্রু-হিত জনে।।
উঠিয়া যথায় ইচ্ছা যাহ আপনার।
হেথায় রহিতে যোগ্য না হয় তোমার।।
কুজনরে যদি রাখে করিয়া যতন।
তথাপি অসৎ-পথে করিবে গমন।।
সভামধ্যে যতেক কহিলা তুমি ভাষা।
অন্য হৈলে নাহি থাকে জীবনের আশা।।
যতেক তোমারে আমি করি পূজা মান।
তত অনাদর মোরে কর অল্পজ্ঞান।।
সভামধ্যে কহ কথা যেন স্বয়ং প্রভু।
এ হেন হেয় উক্তি না কহে কেহ কভু।।
বিদুর বলেন, আমি না কহি তোমারে।
ধৃতরাষ্ট্র-দুঃখ দেখি হৃদয় বিদরে।।
তোরে কি কহিব, ধৃতরাষ্ট্র নাহি শুনে।
হতায়ু জনেতে কভু হিত নাহি মানে।।
আমারে কি হেতু তুমি জিজ্ঞাসিলে কথা।
জিজ্ঞাসহ নিজ তুল্য লোক পাও যথা।।
এত বলি নীরব হৈল ক্ষত্তা মহাশয়।
পুনঃ আরম্ভিল পাশা সুবল-তনয়।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র