কুন্তি

কুন্তি : পান্ডব জননী। উনার পিতার নাম যদুশ্রেষ্ঠ শূর এবং ভ্রাতার নাম বসুদেব। সে হিসেবে কৃষ্ণের পিসি। উনার আসল নাম পৃথা। রাজা শূর তার পিতৃষ্বসার পুত্র নি:সন্তান কুন্তিভোজকে এ কন্যাকে দান করেন। সে জন্যে পালক পিতার নামানুসারে উনার নাম হয় কুন্তি।

একদা মহর্ষি দূর্বাসা অতিথিরুপে কন্তিভোজের গৃহে আসেন। কুন্তি দূর্বাসা ঋষিকে প্রচুর সেবাযত্ন করেন। দূর্বাসা কুন্তির পরিচর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে একটি অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দেন। এ মন্ত্রবলে যে কোন দেবতাকে আহবান করলে তাদের প্রসাদে পুত্র সন্তান লাভ করবে। কুন্তি কৌতুহলবশত: মন্ত্রের সক্ষমতা দেখার জন্য সূর্যদেবকে আহ্বান করেন। সাথে সাথে সূর্যদেব আর্বিভূত হন। কুন্তি তার কৌতুহলের কথা সুর্যদেবকে বলেন। কিন্তু সূর্যদেব বলেন তার আহবান বৃথা হবে না। তার সাথে মিলনের ফলে সে এক দেবকুমার তূল্য পুত্র সন্তান লাভ করবে কিন্তু তার কুমারীত্ব ঠিক থাকবে। এ পুত্রই কবচ ও কুন্ডল ধারণ করে জন্ম গ্রহণ করবে। আর সে কর্ণ নামে খ্যাতি লাভ করবে। কিন্তু সমাজ ও লোক-লজ্জার কলঙ্কের ভয়ে কুন্তি পুত্রটিকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দেন। সূতবংশীয় অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা শিশুটিকে ভাসতে দেখে নদী থেকে তুলে নিয়ে তাকে বসুষেণ নাম দিয়ে পরম স্নেহে লালন পালন করতে থাকেন।

এদিকে রাজা কুন্তিভোজ মেয়ে কুন্তির জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলে কুন্তি পান্ডুর গলায় মালা দেন। পান্ডু শল্যেরাজের বোন মাদ্রীকেও বিবাহ করেন। একবার মৃগয়াকালে বন মধ্যে সংগমরত হরিণীকে পান্ডু ধনুর্বাণে নিহত করেন। কিমিন্দম মুনি লোক লজ্জার ভয়ে হরিণীর রূপে স্ত্রীর সাথে সঙ্গমেরত হলে পান্ডু হরিণভেবে হত্যা করে। কিমিন্দম মুনি অভিশাপ দেন যে, অতৃপ্ত অবস্থায় তাকে হত্যার কারণে ব্রহ্মহত্যার পাপে অভিষিক্ত না হলেও স্ত্রী সংগমে অতৃপ্ত অবস্থায় তার মৃত্যু হবে। অভিশপ্ত হয়ে পান্ডু বিলাপ করতে লাগল। অভিশাপের কারণে পুত্র সন্তান হবে না বিধায় পান্ডু তার দুই স্ত্রী কুন্তি ও মাদ্রীকে নিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অরণ্যবাসী হন। তারা নাগমত, চৈত্ররথ, কালকুট, হিমালয়ের উত্তরস্থ গন্ধমাদন পর্বত, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর এবং হংসকুট অতিক্রম করে শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে তপ্যা করতে লাগলেন। তথায় পান্ডুর সাথে অনেক মুনি-ঋষির সাক্ষাৎ হয়। তাদের কাছে পিতৃ-ঋণ (পিতৃ-ঋণ বলতে তিনি যেভাবে মাতৃগর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছেন তার পত্নির গর্ভেও যেন সেভাবে সন্তানের জন্ম হয়)। থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় স্থির করার জন্য অনুরোধ করেন। ঋষিরা বলে তারা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছেন তিন পুত্র সন্তান লাভ করবেন।

কুন্তি কোন এক সময় দূর্বাসা মুনিকে সন্তুষ্ট করে এমন বর লাভ করেন যে কোন দেবতাকে আহ্বান করলে তার গর্ভে সে দেবতার সন্তান উৎপাদন হবে। পান্ডুর নিকট কুন্তি অনুমতি চাইলেন। পান্ডু তাকে অনুমতি দিলে কুন্তি মন্ত্রবলে ধর্মকে আহ্বান করলে তাদের মিলনের ফলে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। তারপর বায়ুকে আহ্বান করলে কুন্তির গর্ভে ভীম ও ইন্দ্রকে আহ্বান করলে তার গর্ভে অর্জুনের জন্ম হয়।

তারপর মাদ্রীর দুই সন্তানসহ কুন্তি হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। পান্ডপগণ দ্রোণাচার্যের অধীনে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করতে থাকেন। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা সমাপ্ত হলে হঠাৎ করে রঙ্গভূমিতে যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শনকালে কর্ণ অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধ আহবান করলে পুত্রনাশের চিন্তায় কুন্তি অজ্ঞান হয়ে যান। কুন্তিসহ পান্ডপগণ একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে নগরে বক নামে এক রাক্ষস বাস করতো। সে নগর রক্ষার জন্য পালাক্রমে মানুষ ভক্ষণ করতো। ঘটনাক্রমে সেদিন ব্রাহ্মণের পালা ছিল, পরিবারের মধ্যে ক্রন্দের রোল উঠলে কুন্তি তা অবগত হয়ে ভীমকে বকের কাছে প্রেরণ করেন। ভীম ব্রাহ্মণের বেশ ধরে বককে হত্যা করে একচক্রাবাসীকে রক্ষা করেন। কুন্তির পরামর্শে পান্ডবরা পাঞ্চাল দেশের ভার্গব নামে এক কুম্ভারের গৃহে আশ্রয় নেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পান্ডবরা গৃহে প্রবেশকালে মাতাকে বলেন যে,“ তারা অপূর্ব এক জিনিস নিয়ে এসেছেন।” মাতা গৃহ থেকে উত্তর দেন,“ তোমরা পঞ্চ পান্ডব তা ভাগ করে নাও।” তারপর গৃহের বাহিরে এসে দ্রৌপদীকে দেখে মাতা কুন্তি বিহ্বল ও বিব্রত হন। মায়ের আজ্ঞা পালন করতে যেয়ে ব্যাসদেবের বিধান মতে পঞ্চ পান্ডবের সাথে দ্রৌপদীর বিবাহ দেয়া হয়।

যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার প্রাক্কালে অর্জুন ও কর্ণের মধ্যে যুদ্ধের ভয়বহতা অনুধাবন করে বিনাশ হওয়ার আশংকায় কুন্তি একদিন গঙ্গা নদীর তীরে জপরত কর্ণের সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন। জপ শেষে কুন্তিকে দেখে কর্ণ প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন,“আমি অধিরথ-রাধার পুত্র কর্ণ, আপনাকে অভিবাধন করছি, আজ্ঞা করুন আপনার জন্য কি করতে পারি?” কুন্তি বললেন,“কর্ণ, তুমি আমার পুত্র, তুমি কৌন্তেয়! তুমি অধিরথ-রাধার পুত্র নও, সূতকুলেও তোমার জন্ম নয়। সূর্যদেব তোমার জনক। তুমি কবচ-কুন্ডল ধারণ করে দেবশিশুর ন্যায় জন্ম গ্রহণ করেছে। পুত্র, নিজের ভ্রাতাদের চিনতে না পেরে তুমি দুর্যোধনাদির সহিত সখ্যতা করেছে। কৌরবগণ যা হরণ করেছে তা তোমরা ভ্রাতারা মিলে অধিকার কর, রাজ্য ভোগ কর। কৃষ্ণ-বলরামের মত তোমাদের কি অসাধ্য থাকতে পারে?” কর্ণ সূর্যদেব পিতার ও মাতার বাক্য শ্রবণ করে নিজেকে স্থির রাখলেন। বিচলিত হলেন না। কর্ণ বললেন,“মাতা! আপনার অনুরোধ আমি ন্যায় সংগত মনে করি না। কারণ আপনি আমাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন। তাতে আমার যশ ও কীর্তি বিনষ্ট হয়েছে। জন্ম আমার ক্ষত্রিয় হলেও ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা আমি পাইনি। ভাগ্যদোষে সূতগৃহে বড় হতে হয়েছে। সূতা মাতার দুগ্ধ পান করতে হয়েছে। সূত বলে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছে। এখন আপনি নিজের হিতের জন্য আমাকে উপদেশ করছেন। তবে মাতা, আমি প্রতিজ্ঞা করছি অর্জুন ভিন্ন অন্য চার ভ্রাতাকে আমি হত্যা করব না।” কুন্তি কর্ণকে আর্শিবাদ করে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলেন।

যুদ্ধ শেষে যখন পান্ডবরা নিহত আত্মীয়স্বজনদের সৎকার করেন, তখন কুন্তি পান্ডবদের কাছে কর্ণের জন্ম রহস্যে কথা জানান। পান্ডবাদী জানতে পারেন কর্ণ তাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

কুন্তি দৃঢ় চরিত্রা নারী, তেজস্বিনী বীর নারী, কষ্ট সহিষ্ণু নারী। পান্ডারা যখনই নিরুদ্যম হয়ে আছে দেখে কুন্তি তাদেরকে তীক্ষ্ম বাক্যে তাদের উৎসাহ করেছেন। এমন কি পুত্রদের অনুরোধ সত্ত্বেও পুত্রদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে তাদেরকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র