মহাভারত:আদিপর্ব ১২৭-১৩১

১২৭. শ্রীকৃষ্ণের দান পাইয়া নারদের গমনোদ্যোগ
দান পেয়ে নারদ নাচের ঊর্দ্ধবায়।
যতেক দক্ষিণা পায় ব্রাহ্মণে বিলায়।।
নারদ দ্বারকানাথে লৈয়া যায় ধরি।
শুনিয়া দ্বারকা শুদ্ধ ধায় নর নারী।।
পারিজাত বৃক্ষ হৈতে খসান বন্ধন।
গোবিন্দে বলেন সব ফেল আভরণ।।
এখন গোপাল আর এ বেশে কি কাজ।
তপস্বী হইলা ধর তপস্বীর সাজ।।
কিরীট ফেলিয়া শিরে ধর পিঙ্গ জটা।
কনক-পইতা ফেলি লহ যোগপাটা।।
কনক-মুকুতা হার ফেল বনমালা।
পীতাম্বর ফেলিয়া পরহ বাঘছানা।।
মুনির বচনে হরি ত্যজি সেইক্ষণ।
ধরেন তপস্বী-বেশ দৈবকী-নন্দন।।
হাতেতে করিয়া বীণা কাঁধে মৃগছালা।
পাছে পাছে যান যেন সন্ন্যাসীর চেলা।।
দেখিয়া কৃষ্ণের বেশ কান্দে সর্ব্বজন।
উগ্রসেন বসুদেব করয়ে ক্রন্দন।।
কান্দয়ে যাদব যত নারী আর শিশু।
থাকুক অন্যের কথা কান্দে বণ্য-পশু।।
বাল বৃদ্ধা যুবা কান্দে ভূমিতলে পড়ি।
দৈবকী রোহিণী কান্দে দিয়া গড়াগড়ি।।
রুক্মিণী প্রভৃতি ষোল-সহস্র রমণী।
পাছে পাছে চলি যায় যতেক কামিনী।।
নারদ বলেন যে তোমরা যাহ কোথা।
রুক্মিণী বলেন যে তোমরা যাবে যেথা।।
নারদ বলেন, কি তোমায় প্রয়োজন।
নানা স্থানে ভ্রমি আমি তপস্বী ব্রাহ্মণ।।
রুক্মিণী বলেন, কৃষ্ণ দান পেলে মুনি।
যৌতূক পাইলা ষোল-সহস্র রমণী।।
মুনি বলে, রুক্মিণী না কর মিছা দ্বন্দ্ব।
পাছে ক্রোধ না করিল বলি ভাল মন্দ।।
যখন করিল দান সত্রাজিত-সুতা।
তখন ত কেহ না কহিলা কোন কথা।।
তার আগে কহিবারে নহিলে ভাজন।
আমার সহিত তব কোন্ প্রয়োজন।।
রুক্মিণী বলেন, পুনঃ শুন মুনিরায়।
সত্যভামা দিল দান, আমার কি তায়।।
প্রাণনাথে লয়ে যাহ আমা সবাকার।
কহ মুনি, আমরা রহিব কোথা আর।।
মহাভারতের কথা সুধা সমতুল।
কাশীরাম দাস রচে জগতে অতুল।।
১২৮. নারদকে শ্রীকৃষ্ণ পরিমাণে ধনদান
গোবিন্দেরে লইয়া নারদ-মুনি যান।
বিষণ্ন বদন হৈয়া সত্যভামা চান।।
ঘন পড়ি উঠি ধায় বাতুল-সমান।
দুই হাতে আগুলিয়া মুনিরে রহান।।
বুঝিনু নারদ-মুনি চতুরালি তোর।
ভাড়াইয়া লেয়া যাও প্রাণপতি মোর।।
বালকে ভাঁড়ায় যেন হাতে দিয়া কলা।
কাঁচ দিয়া লৈয়া যাও কাঞ্চনের মালা।।
শিলা দিয়া লৈয়া যাও পরশ-রতন।
শুধু কায় দিয়া যাও লইয়া জীবন।।
না চাহি যে ব্রত, না চাহি যে ফল তার।
বাহুড়িয়া প্রাণনাথে দেহ ত আমার।।
মুনি বলে, সত্যভামা সত্যভ্রষ্টা হৈলা।
সবাকার সাক্ষাতে গোবিন্দে দান দিলা।।
এক্ষণে কহিছ ব্রতে নাহি প্রয়োজন।
দান লইয়াছি আমি, দিব কি কারণ।।
একক দেখিয়া চাহ বল করিবারে।
মোর ঠাঁই লইতে কাহার শক্তি পারে।।
এত বলি নারদ ঘুরান দুই আঁখি।
শরীর কম্পিত দেবী মুনি-মুখ দেখি।।
সত্যভামা বলে, তব ক্রোধ নাহি ডরি।
বড় ক্রোধ হইলে ফেলাবে ভস্ম করি।।
গোবিন্দ-বিচ্ছেদে মরি, সেই মোর সুখ।
না দেখিব কৃষ্ণে আর, এই বড় দুখ।।
এক কথা কহি, অবধান কর মুনি।
পূর্ব্বে যে বলিলা ব্রত করিল ইন্দ্রাণী।।
পার্ব্বতী করিল আর স্বাহা অগ্নি-প্রিয়া।
তারা পুনঃ স্বামী পেলে কেমন করিয়া।।
নারদ বলেন, সর্ব্বভক্ষ্য হুতাশন।
চারি মুখে ধরে তার প্রচণ্ড কিরণ।।
তাহারে লইয়া সতি কি করিব আমি।
সে কারণে স্বাহারে ফিরায়ে দিনু স্বামী।।
পার্ব্বতীর পতি রুদ্র বলদ-বাহন।
হাড়মালা, ভস্ম মাখে অঙ্গে ফণিগণ।।
নিরন্তর ভূত প্রেত লৈয়া তার মেলা।
না নিলাম তাহারে করিয়া অবহেলা।।
শচীপতি পুরন্দর সহস্রলোচন।
ত্রৈলোক্য পালিতে ধাতা কৈল নিয়োজন।।
কভু ঐরাবতে, কভু উচ্চৈঃশ্রবা রথে।
বিনা বাহনেতে ইন্দ্র না পারে চলিতে।।
তারে না নিলাম আমি ইহার লাগিয়া।
তথাপিহ স্বর্গে আছে আমার হইয়া।।
তোমার এ স্বামী কৃষ্ণ রূপে নাহি সীমা।
তিনলোক মধ্যে দিব কাহাতে উপমা।।
যথায় যাইব, তথা সঙ্গে করি লব।
অনুক্ষণ দিবানিশি নয়নে দেখিব।।
জনমে জনমে মোর এই বাঞ্ছা ছিল।
অনেক তপের ফলে বিধ মিলাইল।।
নয়ন মুদিয়া মুনি ধ্যান করে যাঁকে।
তাঁহাকে পাইয়া হাতে দিব কি তোমাকে।।
আসিতেছি যাঁর চিন্তা করি নিরবধি।
দরিদ্র কি ছেড়ে দেয় পেলে সেই নিধি।।
ব্রতের কারণ ছেড়ে দিলে কৃষ্ণধন।
ব্রতফল কিন্তু তাহা নাহি পারে।।
এ কথা শুনিয়া সতী হলেন মূর্চ্ছিতা।
নাহি জ্ঞান, সত্যভামা মৃতা কি জীবিতা।।
দেখিয়া সতীর কষ্ট কৃষ্ণে হৈল দয়া।
নারদেরে বলেন, ছাড়হ মুনি মায়া।।
নারদ বলেন, কর্ম্ম ভুঞ্জুক আপন।
তোমারে ত্যজিয়া দিল ব্রত-ফলে মন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, অজ্ঞ সহজে স্ত্রীজাতি।
কোথা পাইবেক জ্ঞান তোমার যেমতি।।
শরীরে নাহিক প্রাণ, হেন লয় মনে।
যোগবলে আত্মা মুনি দেহ এইক্ষণে।।
দেখিয়া সতীর কষ্ট মুনি চমৎকার।
উঠহ বলিয়া ডাকিলেন বারেবার।।
মুনির আশ্বাসে দেবী পাইয়া চেতন।
উঠিয়া ধরেন পুনঃ মুনির চরণ।।
নারদ বলেন, দেবি এক কর্ম্ম কর।
দান দিয়া লৈতে চাহ, অধর্ম্ম দুস্তর।।
গোবিন্দে তৌলিয়া দেহ আমারে রতন।
পাইবা ব্রতের ফল শাস্ত্রেতে যেমন।।
শুনি সত্যভামা মনে হইয়া উল্লাস।
পুত্রগণে ডাকিয়া কহেন মৃদুভাষ।।
করহ তুলেন সজ্জা, যে আছে বিহিত।
মম গৃহ হৈতে রত্ন আনহ ত্বরিত।।
আজ্ঞা পেয়ে কামাদি যতেক পুত্রগণ।
কনকে নির্ম্মাণ তুল কৈল ততক্ষণ।।
এক ভিতে বসাইল দৈবকী-নন্দনে।
আর ভিতে বসাইল যত রত্নগণে।।
সত্যভামা-গৃহে রত্ন যতেক আছিল।
তুলে চড়াইল, তবু সমান নহিল।।
রুক্মিণী কালিন্দী নগ্নজিতা জাম্ববতী।
যে যাহার ঘর হৈতে আনে শীঘ্রগতি।।
চড়াইল তুলে, তবু সমতুল নহে।
ষোড়শ-সহস্র কন্যা নিজধন বহে।।
কৃষ্ণের ভাণ্ডারে ধন কুবের জিনিয়া।
ত্বরা করি চড়াইল তুলে সব লৈয়া।।
না হয় কৃষ্ণের সম, অপরূপ কথা।
দ্বারকাবাসীর দ্রব্য যার ছিল যথা।।
শকটে উটেতে বৃষ বহে অনুক্ষণ।
নহিল কৃষ্ণের সম, দেখে সর্ব্বজন।।
পর্ব্বত-আকার চড়াইল রত্নগণে।
ভূমি হৈতে তুলিতে নারিল নারায়ণে।।
দেখি সত্যভাম দেবী করেন রোদন।
ক্রোধমুখে বলেন, নারদ তপোধন।।
উপেন্দ্রাণী বলিয়া বলাও এই মুখে।
রত্নে জুখি উদ্ধারিতে নারিলি স্বামীকে।।
শিশু প্রায় পুনঃপুনঃ করহ রোদন।
এত দিনে জানিলাম তব বিবরণ।।
বক্র চক্ষু করিয়া কহয়ে তপোধন।
হেন জন হেন ব্রত করে কি কারণ।।
এবে জানিলাম ধন না পারিলি দিতে।
উঠ বলি নারদ ধরেন কৃষ্ণ-হাতে।।
শুনি সত্যভামা মুখে না সরিল বুলি।
ভূমে গড়াগড়ি যায় আউদর-চুলী।।
হেনমতে কান্দে সব যাদবী যাদব।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে বলে উদ্ধব।।
আপন শ্রীমুখে কহিয়াছেন বার বার।
আমা হৈতে নাম বিনা বড় নাহি আর।।
চিন্তিয়া বলিয়া সবে মোর বোল ধর।
যত রত্ন আছে তুলে ফেলাহ সত্বর।।
একৈক ব্রহ্মাণ্ড যার এক লোমকূপে।
কোন্ দ্রব্য সম করি তোলিবা তাহাকে।।
এত বলি আনি এক তুলসীর দাম।
তাহে দুই অক্ষর লিখিল কৃষ্ণনাম।।
তুলের উপরে দিল তুলসীর পাত।
নীচে হৈল তুলসী ঊর্দ্ধেতে জগন্নাথ।।
দেখি উল্লাসিতা হৈলা সকল রমণী।
সাধু সাধু বলিয়া হইল মহাধ্বনি।।
কৃষ্ণ-নাম গুণের নাহিক বেদে সীমা।
বৈষ্ণবে সে জানে কৃষ্ণনামের মহিমা।।
শ্রীকৃষ্ণ হইতে কৃষ্ণনাম ধন বড়।
জপহ কৃষ্ণের নাম চিত্তে করি দৃঢ়।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলিয়া পাইবা কৃষ্ণদেহ।
কৃষ্ণের মুখের বাক্য নাহিক সন্দেহ।।
নাম পত্র লৈয়া মুনি তুষ্ট হৈয়া যান।
সত্যভামা রত্ন ধন ব্রাহ্মণে বিলান।।
পারিজাত হরণের এই বিবরণ।
এক্ষণে কহিব তবে সুভদ্রা হরণ।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
শুনিলে অধর্ম্মী হৈবে হেলে ভবপার।।
পারিজাত হরণে হরিষ রসকথা।
শ্রবণে শুনিলে ঘুচে সংসারের ব্যথা।।
পুরুষ শুনিলে হয় কৃষ্ণপদে মতি।
নারীজন শুনিলে সৌভাগ্য হয় পতি।।
আয়ুধন বংশ বাড়ে সর্ব্বত্র কল্যাণ।
কাশীদাস কহে, তাহা করিয়া প্রমাণ।।
১২৯. সুভদ্রার গান্ধর্ব্ব-বিবাহ
অতঃপর জিজ্ঞাসিলা রাজা জন্মেজয়।
পিতামহ-কথা কহ, শুনি মহাশয়।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন নরপতে।
ভদ্রা-পার্থে স্বয়ম্বর হইবে যেমতে।।
বলিলেন যদি ইহা বীর ধনঞ্জয়।
সত্যভামা তাহারে কহেন সবিনয়।।
ঔষধ করিবে পার্থ স্ত্রীর এই বিধি।
পুরুষ হইয়া তুমি কৈলে কি ঔধধি।।
ভণ্ডতা করিয়া হইয়াছ ব্রহ্মচারী।
মহৌষধি শিখিয়াছ ভুলাইতে নারী।।
অর্জ্জুন বলেন, স্তুতি করি সত্যভামা।
নিশাশেষ, নিদ্রা যাই, কর আজি ক্ষমা।।
জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী ব্রহ্মচারী আমি।
তীর্থযাত্রা করি দেশ দেশান্তরে ভ্রমি।।
মিথা অপবাদ কেন দিতেছে আমারে।
শুনিলে আমারে নিন্দা করিবে সংসারে।।
বুঝিয়া পার্থের মন উঠেন ভারতী।
সুভদ্রা বলেন, কহ কোথা যাও সতী।।
সতী বলে, আইসহ করিব উপায়।
এত বলি ভদ্রা লৈয়া গেলেন আলয়।।
নার মায়া জানে মায়াবতী কামপ্রিয়।
সখি দিয়া শীঘ্র রতি আনেন ডাকিয়া।।
গুপ্তেতে কহেন সব ভদ্রার চরিত্র।
রতি বলে, ঠাকুরাণী এ কোন্ বিচিত্র।।
জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী পার্থ গর্ব্ব করে।
পার্থের সে গর্ব্ব আজি দিব চূর্ণ করে।।
এত বলি সিন্দূর পড়িয়া দিল ভালে।
মন্ত্র পড়ি দিল দুই নয়ন কজ্জলে।।
যাত দেবি, এক্ষণে যাইতে পাবে বাট।
হস্ত দিলে ঘুচিবেক দ্বারের কপাট।।
শুনিয়া রতির বাক্য সানন্দ হইয়া।
পুনরপি ভদ্রা তথা উত্তরিল গিয়া।।
হস্ত দিতে কপাটের অর্গল ঘুচিল।
অর্জ্জুন-সম্মুখে গিয়া ভদ্রা দাঁড়াইল।।
বত্রিশ কলাতে যেন শোভিত চন্দ্রমা।
চিত্রকর-চিত্র যেন কনক প্রতিমা।।
কে তুমি বলিয়া ক্রোধে উঠিল ফাল্গুনি।
স্ত্রী নহিলে কাটিতাম খড়্গেতে এখনি।।
যাহ শীঘ্র হেথা হৈতে প্রাণ লৈয়া বেগে।
নহিলে নাসিকা কান কাটিব খড়্গেতে।।
এত বলি উঠিলেন হাতে লৈয়া ছুরি।
দেখিয়া সুভদ্রা অঙ্গ কাঁপে থরহরি।।
সিঁথায় সিন্দূর তার, নয়নে কজ্জল।
দেখিয়া পড়েন পার্থ হইয়া বিহ্বল।।
হরিল পার্থের জ্ঞান কামের বিভোলে।
তখনি উঠিয়া তারে করিলেন কোলে।।
আইস আইস বৈস ওহে প্রাণসখি।
তোমার বদন পূর্ণ চন্দ্রমা নিরখি।।
নাহি নাহি করি ভদ্রা বস্ত্রে মুখ ঢাকে।
জাতিনাশ কর কেন ছাড় ছাড় ডাকে।।
একি পার্থ এ তোমার কেমন বিচার।
অনূঢ়া কন্যার সহ একি ব্যবহার।।
বলেন বাহিরে থাকি সত্রাজিত-সুতা।
কহ পার্থ, গণ্ডগোল কি করিছ হেথা।।
সুভদ্রা বলেন, সখি দেখনা আসিয়া।
আমারে অর্জ্জুন বীর ধরে কি লাগিয়া।।
সত্যভামা বলে পার্থ, অনূঢ়া এ নারী।
কিমতে ধরহ বরে হয়ে ব্রহ্মচারী।।
বসুদেব সুতা হয় কৃষ্ণের ভগিনী।
কেন হেন কর্ম্ম কর, ধার্ম্মিক আপনি।।
বলেন বিনয় বাক্য পার্থ বীরবর।
অনন্ত নারীর মায়া বুঝিবে কি নর।।
তোমার অশেষ মায়া বিধি অগোচর।
আমি কি বুঝিব, নারিলেন দামোদর।।
না জানিয়া তব আজ্ঞা করিনু লঙ্ঘন।
ক্ষমহ, তোমার পায় লইনু শরণ।।
অর্জ্জুনের স্তবে তুষ্টা হইয়া ভারতী।
হাসিয়া বলিলেন ভীত নহ মহামতি।।
যে হইল অর্জ্জুন বুঝিনু তব কর্ম্ম।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ কর আছে ক্ষত্র-ধর্ম্ম।।
পাঁচ সাত সখী মিলি দিয়া ছলাহুলি।
দোঁহাকার গলে দোঁহে মালা দিল তুলি।।
হেনমতে দোঁহার বিবাহ করাইয়া।
সত্যভামা গোবিন্দে বলেন সব গিয়া।।
সত্যভামা বলেন, যে আজ্ঞা কৈলে তুমি।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ দিয়া আইলাম আমি।।
কালি প্রাতে কর তুমি বিবাহের কাজ।
দূত পাঠাইয়া আন কুটুম্ব-সমাজ।।
অতএব বলি যে বিলম্ব নাহি সয়।
গোবিন্দ বলেন, সতী এই মত হয়।।
কিন্তু বলভদ্রের অর্জ্জুনে নাহি প্রীত।
পার্থে দিতে তাঁহার নহিবে মনোনীত।।
সত্যভামা বলেন যে কি উপায় করি।
উপায় করিব, বলি বলেন শ্রীহরি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, সদা সাধু করে পান।।
১৩০.অর্জ্জুন সহ সুভদ্রার বিবাহে বলরামের অসম্মতি
প্রভাতে উঠিয়া সবে করি স্নান দান।
একত্র বসিল সব যাদব-প্রধান।।
উগ্রসেন বসুদেব সাত্যকি উদ্ধব।
অক্রূর সারণ গদ মুষলী মাধব।।
প্রসঙ্গ করেন তবে দেব নারায়ণ।
সুভদ্রা দেখিয়া মম স্থির নহে মন।।
বিবাহের যোগ্যা যে অবিবাহিতা থাকে।
অস্পৃশ্য তাহার অন্ন জল বলে লোকে।।
অনূঢ়া কুমারী যদি হয় ঋতুমতী।
উভয়তঃ সপ্তকুল হয় অধোগতি।।
কুলেতে কলঙ্ক হয় সংসারেতে লাজ।
এ কারণে কন্যা দিতে নাহি করিবে ব্যাজ।।
সপ্তম বৎসরে কন্যা দিলে ফল পায়।
অতঃপর ইহাতে বিলম্ব না যুয়ায়।।
ভদ্রার সম্বন্ধ যোগ্য না দেখি যে আর।
মোর চিত্তে লয় এক কুন্তীর কুমার।।
রূপে গুণে কুলে শীলে বলে বলবান।
পার্থ যোগ্য হয়, করিয়াছি অনুমান।।
শুনি বসুদেব তাহা করেন স্বীকার।
যা বলেন কৃষ্ণ চিত্তে লইল আমার।।
সাত্যকি বলিল, যদি কুলে ভাগ্য থাকে।
তবে ত পাইবে ভদ্রা স্বামী অর্জ্জুনকে।।
অর্জ্জুন-সমান যোগ্য না দেখি ভুতলে।
ভাল ভাল বলি বলে যাদব সকলে।।
এতেক সবার বাক্য শুনি হলধর।
রক্তচক্ষু করি ক্রোধে করেন উত্তর।।
কেন চিন্তা কর সবে সুভদ্রা কারণে।
তার হেতু বর আমি চিন্তিয়াছি মনে।।
কৌরব-কুলেতে শ্রেষ্ঠ রাজা দুর্য্যোধন।
উচ্চ কুল বলি হয় বিখ্যাত ভুবন।।
বলে জিনে মত্ত দশ-সহস্র বারণ।
রূপেতে কন্দর্প জিনে, ধনে বৈশ্রবণ।।
অর্জ্জুনের শতাংশ না গণি তার গুণে।
না বুঝিয়া হেন বাক্য বল কি কারণে।।
দূত পাঠাইয়া দেহ হস্তিনা নগর।
দুর্য্যোধনে তথা গিয়া আনুক সত্বর।।
শুভদিন করহ করিতে শুভ কার্য্য।
রাজগণ আনাইব যত আছে রাজ্য।।
এই বাক্য যদ্যপি বলেন হলধর।
অধোমুখ হৈয়ে কেহ না দিল উত্তর।।
কতক্ষণে বলরাম ডাকি দূতগণে।
রাজ্যে নিমন্ত্রণ-লিপি দেন জনে জনে।।
দুর্য্যোধনে লিখেন সকল সমাচার।
সুসজ্জা হইয়া এস বিভা যে তোমার।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশীদাস কহে, সাধু যায় ভব তরি।।
১৩১. দৈবকী ও রোহিণী সহ বলরামের কথোপকথন
দিবা অবসান হৈল, সন্ধ্যার সময়।
উঠি গেল যদুগণ যে যার আলয়।।
সত্যভামা জিজ্ঞাসেন গোবিন্দের প্রতি।
বিবাহে বিলম্ব কেন কর প্রাণপতি।।
গোবিন্দ বলেন, সখি কিসের বিবাহ।
পার্থ নাম শুনিয়া রামের জ্বলে দেহ।।
বলেন, যে বর করিয়াছি দুর্য্যোধনে।
দূত পাঠাইলেন তাহার সন্নিধানে।।
শুনি সত্যভামা হৈয়া চমকিত চিতে।
অধোমুখ করিয়া বসিলেন ভূমিতে।।
বলিলেন, কহ দেব কি হৈবে এখন।
অনর্থ হইল এবে সুভদ্রা কারণ।।
অর্জ্জুন শুনিলে পাছে যায় পলাইয়া।
ভগিনীরে দিবে কিহে অন্য বরে বিয়া।।
উপায় না করি কেনে মৌনেতে রহিলে।
হেন বুঝি, কলঙ্ক করিবে যদুকুলে।।
গোবিন্দ বলেন, দেবী কেন কর গোল।
করিব উপায় আমি, নহ উতরোল।।
সত্যভামা বলেন, বিলম্ব কথা নহে।
কেহ যদি এ কথা রামেরে গিয়া কহে।।
এই লজ্জা ভয়ে মম হইতেছে কাঁপ।
না দেখাব মুখ আর, জলে দিব ঝাঁপ।।
স্ত্রীলোকেতে জানে স্ত্রীলোকের যে বেদন।
শাশুড়ীর আগে আমি করি নিবেদন।।
এত বলি উঠি গেল দেবকী সদন।
কহিলেন যতেক সুভদ্রা বিবরণ।।
শুন শুন ঠাকুরাণী, করি নিবেদন।
কুল-লজ্জা-ভয়ে মম স্থির নহে মন।।
সুভদ্রা আসক্তা হৈল বীর ধনঞ্জয়ে।
বলিল, নহিলে প্রাণ ছাড়িব নিশ্চয়ে।।
গান্ধর্ব্ব-বিবাহ আমি দিলাম দোঁহার।
এবে শুনি এখন হইবে বর আর।।
শুনিয়া দৈবকী দেবী হইলা বিস্মিতা।
বলভদ্র-গৃহে যান রোহিনী সহিতা।।
দৈবকী বলেন, তাত শুন হলপাণি।
অর্জ্জুনে না দেহ কেন সুভদ্রা ভগিনী।।
রূপে গুণে কুলে শীলে সকলে বাখান।
কুটুম্বে কুটুম্ব হৈবে, কেন কর আন।।
রাম বলে, জননী না বুঝি কেন কহ।
পাণ্ডবগণের কথা সকল জানহ।।
আমার কুটুম্ব-যোগ্য নহে ধনঞ্জয়।
অযোগ্য-সম্বন্ধে মাতা কুল নষ্ট হয়।।
এই হেতু দুর্য্যোধনে পাঠাইনু দূত।
নিষ্কলঙ্ক সর্ব্ব যোগ্য হয়কুরুসুত।।
তিনলোকে বিখ্যাত পাণ্ডব জারজাত।
হেন জনে দিতে চাহ সুভদ্রা কিমত।।
রোহিণী বলেন, তাত সবার বিচার।
পিতা ভ্রাতা তোমার যতেক জ্ঞাতি আর।।
কি হেতু সবার বাক্য করহ হেলন।
দেহ অর্জ্জুনেরে ভদ্রা, সবাকার মন।।
সাধু ধর্ম্মশীল পার্থ, গুণী সর্ব্ব গুণে।
তারে নাহি দিয়া ভদ্রা দিবা অন্যজনে।।
যে কহ সে কহ তাত ক্রোধ করে তুমি।
কল্য প্রাতে পার্থেরে সুভদ্রা দিব আমি।।
শুনিয়া মায়ের বাক্য কম্পিত অধর।
তাম্রবর্ণ চক্ষু যেন জ্বলে বৈশ্বানর।।
বাতুলের প্রায় মাতা কহিছ বচন।
অন্য হৈলে কোথা তার রহিত জীবন।।
গোবিন্দের কথা যত করিলা স্বীকার।
জাতি কুল গোবিন্দের নাহিক বিচার।।
ভক্তি করি দুই কথা যেই জন কয়।
না বিচারে ভাল মন্দ, সেই বন্ধু হয়।।
কল্য তার পুত্রে দুর্য্যোধন দিল সুতা।
নাহিক তিলেক স্নেহ, নব কুটুম্বিতা।।
শিষ্য বলি তারে অতি স্নেহ আমি করি।
এই হেতু সবে ক্রুদ্ধ তাহারি উপরি।।
কার শক্তি দিতে পারে ভদ্রা অর্জ্জুনেরে।
যাহ মাতা, আর কিছু না বলে আমারে।।
রামের এতেক বাক্য শুনিয়া দুজনে।
উঠি গেল দুই জনে বিষণ্ন বদনে।।
জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, মুনিরাজ শুন।
কোন্ কৃষ্ণপুত্রে কন্যা দিল দুর্য্যোধন।।
না কহিলা মুনি মোরে ইহার কথন।
কহ শুনি মুনিরাজ বড় ইচ্ছা মন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র