১১. দস্যুগণ কর্ত্তৃক যদুপত্নীগণ হরণও তাঁহাদের পাষাণত্ব বিবরণকৃষ্ণের শরীর পার্থ কোলেতে করিয়া।বিলাপ করেন বহু কান্দিয়া কান্দিয়া॥কৃষ্ণ প্রাণ কৃষ্ণ নাথ কৃষ্ণ ধন জন।কৃষ্ণ বিনা পাণ্ডবের আছে কোন্ জন॥এতদিনে পাণ্ডবেরে বঞ্চিলেন বিধি।কোন দোষে হারাইনু কৃষ্ণ গুণনিধি॥এই দ্বারাবতী আমি পূর্ব্বে আসিতাম।আমারে পাইলে কত পাইতে বিশ্রাম॥সখা সখা বলি মোরে করি সম্বোধন।ভূজ প্রসারিয়া আসি দিতে আলিঙ্গন॥পূর্ব্বেতে কহিলে তুমি সভার ভিতর।কৃষ্ণার্জ্জুন এক তনু নহে ভিন্ন পর॥পাণ্ডুপুত্রগণ মম প্রাণের সমান।পাণ্ডবের কার্য্যেতে বিক্রীত মম প্রাণ॥সলিল রক্ষিত যেন মৎস্য আদি জন।সেইরূপ পাণ্ডব রক্ষিত নারায়ণ॥সারথিত্ব করিয়া সঙ্কটে কৈলে পার।দুর্য্যোধন ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার॥আমি তব সখা প্রাণসখী যাজ্ঞসেনী।পরম বান্ধবরূপে রাখিলে আপনি॥পাখা যেন রক্ষা করে পাখীর জীবন।সলিল রক্ষিত যেন জলচরগণ॥ওহে প্রভু যদুনাথ নাহি শুন কেনে।কোন্ দোষে দোষী হৈনু তব ও চরণে॥তব প্রিয় সখা আমি সেই ধনঞ্জয়।সখারে বিমুখ কেন হৈলে মহাশয়॥একবার চাও প্রভু মেলিয়া নয়ন।সখা বলি বারেক করহ সম্বোধন॥বারেক দেখাও চাঁদমুখের সুহাস।বারেক বদনচাঁদে কহ সুধাভাষ॥রত্ন সিংহাসন ত্যজি ভূমিতে শয়ন।চাঁদমুখে লাগিয়াছে রবির কিরণ॥কোন্ মুখে যাব আমি হস্তিনানগরে।কি বলিব গিয়া আমি রাজা যুধিষ্ঠিরে॥ভাইগণে কি বলিব দ্রৌপদীর তরে।কেমনে ধরিবে প্রাণ ধর্ম্ম নৃপবরে॥হায় বিধি! এতদিনে করিলে নিরাশ।কোন্ দোষে হারাইনু মিত্র শ্রীনিবাস॥বিস্মরিলা সব কথা স্বীকার করিয়া।সঙ্গে নিলে নিজ জনে পাণ্ডবে ত্যজিয়া॥ভাগ্যবন্ত যদুকুল পুণ্য নাহি সীমা।ইহলোকে পরলোকে পাইলেক তোমা॥আমা সম হতভাগ্য পাপিষ্ঠ দুর্ম্মতি।কোন্ গুণে পাব সেই কৃষ্ণপদে মতি॥হা কৃষ্ণ কমলাকান্ত করুণা নিদান।তোমা বিনা দহে মম হৃদয় পরাণ॥কি বুদ্ধি করিব আমি কোথায় বা যাব।আর কোথা সে চাঁদবদন দেখা পাব॥শিরেতে হানিয়া হাত কাঁন্দি উচ্চৈঃস্বরে।ভূমে গড়াগড়ি যান পার্থ ধনুর্দ্ধরে॥দারুক সারথি বোধ করায় অর্জ্জুনে।স্থির হও ধনঞ্জয় শোক ত্যজ মনে॥অকারণে শোক কৈলে কি হইবে আর।আমি যাহা কহি তাহা শুন সারোদ্ধার॥বিধি নীতি আছে যেই ক্ষত্ত্রিয়ের ধর্ম্ম।আপনি সবার তুমি কর প্রেতকর্ম্ম॥পূর্ব্বেতে আমারে কহিলেন গদাধর।সর্ব্ব হৈতে বড় প্রিয় পার্থ ধনুর্দ্ধর॥যোগ আচরিয়া পরে পাইবে আমারে।এই কথা দারুক কহিবা পাণ্ডবেরে॥সে কারণে এই কর্ম্ম তোমার বিহিত।সবার সৎকার কর্ম্ম করিতে উচিত॥বহুমতে সান্ত্বনাদি করিল অর্জ্জুনে।সৎকার করিতে পার্থ করিলেন মনে॥চন্দনের কাষ্ঠ তথা করি রাশি রাশি।জ্বালিলেন চিতানল গগন পরশি॥দেবকী রোহিণী বসুদেবের সহিত।অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করিল হরষিত॥রেবতী রামের সনে পশি হুতাশন।অগ্নিকার্য্য সবাকার করিল অর্জ্জুন।সবাকার অগ্নিকার্য্য করি সমাপন।বিধিমতে করিলেন শ্রাদ্ধাদি তর্পণ॥দারুক পুনশ্চ কয় অর্জ্জুনের প্রতি।অর্জ্জুন বন্ধুর কার্য্য করহ সম্প্রতি॥স্ত্রী গণে লইয়া যাও হস্তিনানগরে।প্রভুর রমণীগণ বিদিত সংসারে॥তোমা বিনা কার শক্তি রাখিবারে পারি।সমুদ্র গ্রাসিবে এই দ্বারকানগরী॥আজ্ঞা কর আমি বনে যাই মহাশয়।শুনিয়া স্বীকার করিলেন ধনঞ্জয়॥এতেক বৃত্তান্ত পার্থে কহি মহামতি।দারুক চলিল যথা বনের নিবৃত্তি॥কৃষ্ণের রমণীগণে লইয়া সংহতি।গেলেন হস্তিনাপথে পার্থ মহামতি॥দ্বারকা গ্রাসিল আসি সমুদ্রের জল।প্রভুর মন্দির মাত্র জাগয়ে কেবল॥এক শত পঞ্চ বর্ষ শ্রীমধুসূদন।মর্ত্ত্যপুরে নিবসেন দ্বারকা ভুবন॥স্ত্রীগণে লইয়া পার্থ করেন গমন।হাতে ধরি গাণ্ডীব অক্ষয় শরাসন॥হেনকালে দৈত্যগণ আছিল কোথায়।কৃষ্ণের রমণীগণে দেখিবারে পায়॥একত্র হইয়া যুক্তি করে সর্ব্বজন।কৃষ্ণের রমণীগণে হরিব এখন॥অর্জ্জুন লইয়া যায় যতেক সুন্দরী।কাড়িয়া লইব হেন হৃদয়ে বিচারি॥পার্থে আগুলিল আর সকল রমণী।হস্তে ধরি স্ত্রীগণের করে টানাটানি॥দেখিয়া কুপিত অতি বীর ধনঞ্জয়।গাণ্ডীব ধরিল বীর ক্রোধে অতিশয়॥অগ্নিদত্ত গাণ্ডীব অক্ষয় শরাসন।যাহাতে করেন পার্থ ত্রৈলোক্য শাসন॥দেবের বাঞ্ছিত ধনু অতি মনোহর।খাণ্ডবদাহন কালে দিল বৈশ্বানর॥ধরি ধনু হেলায়, হেলায় দিত গুণ।এবে গুণ দিতে শক্ত নহেত অর্জ্জুন॥মহাভয় হৈল ধনু তুলিতে না পারি।কত কষ্টে গুণ দেন বহু শক্তি করি॥টানিতে না পারি ধনু আকর্ণ পূরিয়া।কিছু অল্প টানি, বাণ দিলেন ছাড়িয়া॥মহাকোপে ছাড়িলেন বজ্রসম বাণ।দৈত্য অঙ্গে ঠেকি পড়ে তৃণের সমান॥বাছিয়া বাছিয়া বাণ বিন্ধে প্রাণপণে।অবহেলে বাণ ব্যর্থ করে দৈত্যগণে॥এড়িল অক্ষয় অগ্নি বাণ ধনঞ্জয়।যত বাণ এড়িলেন সব ব্যর্থ হয়॥যত বিদ্যা পাইলেন দ্রোণগুরু স্থান।যত বিদ্যা পাইলেন অমর ভুবন॥এ তিন ভুবনে যারে মানে পরাজয়।দৈত্য সনে রণে সর্ব্ব অস্ত্র ব্যর্থ হয়॥ব্রহ্ম অস্ত্র অর্জ্জুনের হৈল পাসরণ।বিস্ময় মানিয়া চিন্তিলেন মনে মন॥গাণ্ডীব ধনুক বীর ধরি দুই করে।প্রহার করেন দৈত্যগণের উপরে॥ইতর মনুষ্য যেন করে ধরি বাড়ি।দৈত্যগণ অর্জ্জুনেরে করে তাড়াতাড়ি॥দৈত্যগণ অর্জ্জুনেরে পরাজিয়া রণে।স্ত্রীগণে লইয়া গেল স্বচ্ছন্দ গমনে॥দৈত্যগণ পরশে প্রভুর নারীগণ।পাষাণ পুত্তলি হ’ল ত্যজিয়া জীবন॥পরাজয় মানি পার্থ পরম চিন্তিত।কান্দিতে কান্দিতে যান অত্যন্ত দুঃখিত।।বদরিকাশ্রমে গিয়া ব্যাসের নিকটে।দণ্ডবৎ প্রণাম করিল করপুটে।।অর্জ্জুনেরে মলিন দেখিয়া অতিশয়।জিজ্ঞাসা করেন তাঁরে ব্যাস মহাশয়।।কি হেতু হইলে দুঃখী কুন্তীর নন্দন।আজি কেন দেখি তব মলিন বদন।।দুষ্কর্ম্ম করিলে কিবা কহত আমারে।পরাজয় হৈল কিবা সংগ্রাম ভিতরে।।দেব-দৈত্যে হিংসিলে কি সুজনে পীড়িলে।দুর্জ্জন সেবনে কিবা হীনতা পাইলে।।এত বলি আশ্বাসিয়া মুনি মহাশয়।করে ধরি বসাইল বীর ধনঞ্জয়।।কান্দিয়া কহেন পার্থ মহাধনুর্দ্ধর।কি কহিব মুনি সব তোমাতে গোচর।।এত দিনে পাণ্ডবেরে বিধি হৈল বাম।গোলোকনিবাসী হ’ল কৃষ্ণ বলরাম।যাঁর অনুগ্রহে আমি বিজয়ী সংসারে।হেলায় গাণ্ডীব ধনু ধরি বাম করে।।যম সম বৈরীগণে না করিনু ভয়।পরাক্রমে করিলাম তিনলোক জয়।।মম পরাক্রম-দেব সব জান তুমি।এক রথে চড়িয়া জিনিনু মর্ত্ত্যভূমি।।সেই তূন সেই ধনু সেই ধনঞ্জয়।সকল নিষ্ফল হৈল শুন মহাশয়।।দৈত্যগণ আসি মোরে পরাজিল রণে।কৃষ্ণের রমণী কাড়ি নিল মম স্থানে।।প্রভু বিনা এই গতি হইল এখন।এ পাপ জীবনে মম নাহি প্রয়োজন।।বিক্রম বিজয় মোর সব দামোদর।তাঁহার অভাবে ধরি পাপ কলেবর।।কহ মুনি কি উপায় করিব এখন।কেমনে পাইব আমি শ্রীমধুসূদন।।উচ্চৈঃস্বরে কান্দেন সঘনে বহে শ্বাস।অর্জ্জুনেরে আর্শ্বাসিয়া কহিলেন ব্যাস।।স্থির হও ধনঞ্জয় শোক পরিহর।আমি যাহা করি তাহা শুন বীরবর।।যা হইলে ধনঞ্জয় সব আমি জানি।বল বুদ্ধি পরাক্রম দেব চক্রপাণি।।অনাদি পুরুষ তিনি ব্রহ্ম সনাতন।উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি সেই নারায়ণ।।নির্লেপ নির্গুণ নিরঞ্জন নিরাকার।অক্ষয় অব্যয় তিনি অনন্ত আকার।জল স্থল শূণ্য তিনি সকল সংসার।সর্ব্বভূতে আত্মারূপে নিবাস তাঁহার।।আত্মপর নাহি তাঁর সব সমজ্ঞান।কীট পক্ষী মনুষ্যাদি সকলি সমান।।তিনি ব্রহ্মা তিনি বিষ্ণু তিনি পঞ্চানন।ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য তিনি পবন শমন।।চরাচর সর্ব্বভূতে বিশ্বে যেই জন।পরমাত্মা রূপে ব্রহ্ম সেই সনাতন।।কে জানিতে পারে সেই প্রভূর মহিমা।চারিবেদে কিঞ্চিৎ না পায় যাঁর সীমা।।শত কোটি কল্প যোগী ধ্যানে রাখি মন।তবু নাহি পায় সেই প্রভু দরশন।তোমরা পাইলে কত পুণ্যে সে বান্ধব,কৃষ্ণ বিনা অন্য নাহি জান তোমা সব।।ভক্তির অধিন সেই প্রভু নারায়ণ।ভক্তিযোগে পাই সেই প্রভু দরশন।।ত্যজিয়া মনের ধন্দ ভজ গিয়া তাঁহে।ভক্তিরূপ ভগবান দূর হরি নহে।।অচিরে অর্জ্জুন সেই কৃষ্ণকে পাইবে।প্রিয়জন স্মরণেতে সতত চিন্তিবে।।নিকটে থাকিতে তাঁরে যত ভক্তি ধরে।শত কোটি ভক্তি হয় থাকিলে অন্তরে।।জানিয়া অর্জ্জুন তুমি স্থির কর মন।গৃহেতে গমন কর জানিয়া কারণ।।পুনশ্চ বলেন পার্থ শুন মহাশয়।এক কথা কহি, মোর খণ্ডাও বিস্ময়।।দৈত্য হরি লইল প্রভুর নারীগণ।ইহার কারণ তুমি কহ তপোধন।।পূর্ব্বপুণ্যে কৃষ্ণ পতি পাইল স্ত্রীগণ।সদাকাল সেবিলেক শ্রীকৃষ্ণ-চরণ।।তাহা সবাকার কেন হৈল হেন গতি।কহিবে ইহার হেতু মুনি মহামতি।।অর্জ্জুনের বাক্য শুনি কহিলেক মুনি।কার শক্তি হরিবেক শ্রীকৃষ্ণ-রমণী।।পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কহি শুন ধনঞ্জয়।বিদ্যাধরীগণ ছিল ইন্দ্রের আলয়।।প্রভুর প্রকাশ যবে হইল অবনী।তাহা সবাকারে আজ্ঞা হৈল পদ্মযোনি।।পৃথিবীমণ্ডলে জন্ম লহ গিয়া সবে।ভাগ্য পূণ্যফলে সবে কৃষ্ণ পতি পাবে।।লক্ষ্মী অংশ পেয়ে হবে লক্ষ্মীর সমান।ভক্তিতে করিবে বশ বিষ্ণু ভগবান।।বিধির আদেশ সর্ব্ব কন্যাগণ লৈয়া।পৃথ্বীতে চলিত সবে হৃষ্টমতি হৈয়া।।স্নান করিবারে গেল পুণ্যনদী তীরে।অষ্টাবক্র নামে মুনি তথা তপ করে।।ভক্তি করি কন্যাগণ প্রণতি করিল।তুষ্ট হৈয়া মুনিবর আশীর্ব্বাদ দিল।।পৃথিবীতে গিয়া সবে পাবে কৃষ্ণ পতি।মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে শুন গুণবতী।।আশীর্ব্বাদ লাভ করি চলিল রমণী।হেনকালে জল হৈতে উঠে মহামুনি।অষ্ট ঠাঁই কুব্জ বক্র খর্ব্ব কলেবর।পাদযুগ বঙ্কিম, বঙ্কিম দুই কর।।শ্রবণ নাসিকা চক্ষু সব বিপরীত।দেখিয়া অপূর্ব্ব সব হইল বিস্মিত।।মুনিরূপ দেখি সবে উপহাস কৈল।তাহা শুনি মুনিবর কূপিয়া কহিল।।আমা দেখি উপহাস কর নারীগণ।সে কারণে শাপ দিব শুন সর্ব্বজন।।পৃথিবীতে গিয়া সবে কৃষ্ণে পতি পাবে।এই অপরাধে সবে দৈত্য হরি লবে।।মুনির বচনে সবে কম্পিত শরীর।নিবেদন করে তবে চরণে মুনির।।অবলা স্ত্রীজাতি মোরা সহজে চঞ্চলা।ক্ষম অপরাধ মুনি দেখিয়া অবলা।।প্রসন্ন হইয়া কর শাপ বিমোচন।ধর্ম্মে মতি রহু আজ্ঞা কর তপোধন।।তুষ্ট হ’য়ে পুনরপি মুনিবর কহে।কহিলাম যে কথা সে কভু ব্যর্থ নহে।।অবশ্য হরিবে দৈত্য না হবে এড়ান।দৈত্যের পরশে সবে হইবে পাষাণ।।পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই জানাই তোমায়।কন্যাগণে দৈত্য হরে এই অভিপ্রায়।।পাষাণ হৈল তারা দৈত্যের পরশে।প্রভুর রমণীগণ গেল তাঁর পাশে।।না ভাবিও চিত্তে দুঃখ চল নিজ ঘরে।ভোগ অভিলাষ ত্যজি ভজহ কৃষ্ণেরে।।এত বলি অর্জ্জুনেরে দিলেন বিদায়।প্রণমিয়া ধনঞ্জয় যান হস্তিনায়।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।১২. অর্জ্জুন কর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরেরনিকট যদুবংশ ধ্বংস কীর্ত্তনজন্মেজয় কহে তবে শুন তপোধন।অতঃপর কি হইল কহ বিবরণ।।পাণ্ডুপুত্র পঞ্চভাই শ্রীকৃষ্ণ বিয়োগে।কিমতে ধরিল প্রাণ এত শোক ভোগে।।বিশেষিয়া কহ মুনি মহাশয় মোরে।এ তাপ খণ্ডাও মম মনের ভিতরে।।তব মুখে শ্রুতবাক্য সুধা হৈতে সুধা।শ্রবণেতে আমার খণ্ডিল সব ক্ষুধা।।পিতামহ উপাখ্যান অপূর্ব্ব আখ্যান।তব মুখে শুনিলে জন্ময়ে দিব্যজ্ঞান।।বিখ্যাত বৈশম্পায়ন মহাতপোধন।ব্যাস উপদেশ শাস্ত্রে অতি বিচক্ষণ।।নৃপতির বাক্য শুনি আনন্দিত মনে।কহিতে লাগিল মুনি জন্মেজয় স্থানে।।মুনি বলে শুন কুরুবংশ চূড়ামণি।অনন্তরে শুন পিতামহের কাহিনী।।বসিলেন ধর্ম্মরাজ রত্ন সিংহাসনে।শিরেতে ধরিল ছত্র পবন-নন্দনে।।চামর ঢুলায় দুই মদ্রবতী-সুত।পাত্র মিত্র অমাত্য সংযুত গুণযুত।সভায় বসিয়া রাজা ধর্ম্ম অবতার।হরষিতে বসি সবে করেন বিচার।।হেনকালে অমঙ্গল দেখি বিপরীত।দিবসেতে শিবাগণ ডাকে চারিভিত।অন্তরীক্ষে গৃধ্রপক্ষী উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে।বিপরীত শব্দ করি ঘন ডাকে কাকে।।বিনা মেঘে ঘোর ডাকে ভীষণ গর্জ্জন।বিপরীত বাত বহে ভস্ম বরিষণ।।প্রলয় প্রলয়ে যেন অগ্নি বরিরণ।ঘোরতর শব্দে ডাকে পশু-পক্ষীগণ।।ঘরে ঘরে নগরে লোকের কলরব।অন্যে অন্যে কোন্দল করযে লোক সব।।পিতাপুত্রে বিবাদ শাশুড়ী বধূ সনে।ব্রাহ্মণ সহিত দ্বন্দ্ব করে শূদ্রগণে।।জনকের কেশে ধরি মারয়ে তনয়।ভাল মন্দ নাহি মুখে যাহা আসে কয়।।দেউল প্রাচীর ভাঙে দেবের দেহর।প্রতিমা সকল নাচে গায় মনোহর।।অবিশ্রান্ত ক্ষণে ক্ষনে নাচে বসুমতী।বিধিধ উৎপাত বহু হইল অনীতি।।দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।চিন্তাযুক্ত হ’য়ে মনে করেন ভাবন।।না জানি কি হেতু হয় এত অমঙ্গল।মন স্থির নহে মম হৃদয় বিকল।।দ্বারকানগরে গেল পার্থ মহারথা।তার ভদ্রাভদ্র কিছু না পাই বারতা।।না জানি কি বিরোধ করিল কার সনে।নাহি জানি কি কর্ম্ম করিল সেইখানে।।কিবা পার্থ সমরে পাইল পরাজয়।এত অমঙ্গল দেখি অকারণ নয়।।কিরূপে ত্বরিতে পাই পার্থের বারতা।শীঘ্রগতি দূত পাঠাইয়া দেহ তথা।।কি কারণে আজ মম আকুল পরাণ।বাম আঁখি নাচে এই বড় অলক্ষণ।।এইরূপে যুধিষ্ঠির করেন ভাবন।বিষাদ করেন রাজা চিন্তাকুল মন।।পার্থ আইলেন তবে দ্বারকা হইতে।হস্তিনায় প্রবেশিল কান্দিতে কান্দিতে।।হায় কৃষ্ণ বলিয়া কান্দেন ঘনে ঘন।কিমতে যাইব আমি হস্তিনা ভুবন।।কি বলিব গিয়া আমি ধর্ম্ম নৃপবরে।হায় প্রভু তোমা বিনা কি হবে আমারে।।নয়নযুগলে বারি বহে অনিবার।শুষ্কমুখে কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি হাহাকার।।গাণ্ডীব ধরিতে নাহি হইলেন ক্ষম।কৃষ্ণের সহিত গেলে বীরত্ব বিক্রম।।রথেতে গাণ্ডীব রাখি বীর ধনঞ্জয়।পদব্রজে চলিলেন অতি দীন প্রায়।।দূরে দেখি ধর্ম্ম জিজ্ঞাসেন বৃকোদরে।এই দেখ অর্জ্জুন আসিছে কতদূরে।।অর্জ্জুনের রথ হেন পাই দরশন।অর্জ্জুন আইসে মম হেন লয় মন।।কিহেতু এতেক ধীরে চলে রথবর।বিষাদ গমন হেন বুঝি যে অন্তর।।অর্জ্জুনেরে দেখি আজি বড়ই মলিন।কৃষ্ণবর্ণ শুষ্কমুখ যেন অতি দীন।।দারুক আইল পূর্ব্বে কৃষ্ণের আদেশে।অর্জ্জুনে লইয়া গেল গোবিন্দের পাশে।।কতবার যায় পার্থ দ্বারকা ভুবন।আনন্দসাগরে আসে নিজ নিকেতন।।আজি কেন অমঙ্গল দেখি অপ্রমিত।কলহ করিল কিবা কাহার সহিত।।কিম্বা কোন অপরাধ কৈল প্রভুস্থানে।সেই দোষে কৃষ্ণ কি করিলেন ভর্ৎসনে।।বলভদ্র সহ কিবা করিল বিবাদ।না জানি ঘটিল আজি কেমন-বিষাদ।।যদি পার্থ হ’য়ে থাকে কৃষ্ণের বর্জ্জিত।সকলে নৈরাশ হ’ল পাণ্ডব নিশ্চিত।।কৃষ্ণ বিনা পাণ্ডবের কেবা আছে আর।সকল সম্পদ মম চরন তাঁহার।।তাঁহার বর্জ্জিত হ’য়ে কে ধরিবে দেহ।কি করিব রাজ্যধন কি করিব গেহ।।এইমত যুধিষ্ঠির করেন চিন্তিত।নিকটে আইল পার্থ ইন্দ্রের নন্দন।।চিত্র পুত্তলিকা প্রায় মুখে নাহি বোল।পড়িল ধরণীতলে হইয়া বিহ্বল।হা কৃষ্ণ বলিয়া বীর লোটায় ধরণী।অর্জ্জুনের নেত্রজলে ভিজিল অবনী।।রাজা জিজ্ঞাসেন কহ কুশল সংবাদ।পাণ্ডবের তরে কিবা হইলে প্রমাদ।।কি দোষ করিলে তুমি কৃষ্ণের চরণে।গোবিন্দ বর্জ্জিত কি হইলে এত দিনে।।স্বরূপেতে বলহ কুশল সমাচার।কি কারণে এত দুঃখ হইল তোমার।।উঠ উঠ ধনঞ্জয় কহ বিবরণ।কি প্রকারে আছে সে শ্রীমধুসূদন।।কি কারণে ত্বরিত সে দারুক আইল।ভাল মন্দ সমাচার কিছু না কহিল।।তোমাকে লইয়া গেল দ্বারকা নগরী।কহ তুমি কিরূপে ভেটিবে দেব হরি।।জগতের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।এক লোমকূপে তাঁর বৈসে কত জন।।কত শিব ইন্দ্র যাঁর এক লোমকূপে।তাঁহারে সম্ভাষ তুমি করিলে কি রূপে।।মাতুল নন্দন হেন বিচারিল মনে।সেই দোষে কৃষ্ণ নাহি চাহিল নয়নে।।কিবা বলভদ্র সহ কৈলে অবিনয়।কি দোষ করিলে তুমি ভাই ধনঞ্জয়।।চারিভিতে চারি ভাই মলিন বদন।ধূলায় লোটায় বীর ইন্দ্রের নন্দন।।অর্জ্জুন কহেন রাজা কি কহিব আর।এতদিনে কৃষ্ণহীন হইল সংসার।।পাণ্ডবের বন্ধুরূপী সেই নারায়ণ।তাহাতে বর্জ্জিত হ’লে শুনহ রাজন।।ব্রহ্মশাপে যদুবংশ হইলেক ক্ষয়।দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করি সবে করিল প্রলয়।।কামদেব আদি যেই কৃষ্ণের নন্দন।কৃতবর্ম্মা সাত্যকি যতেক যদুগণ।।পরস্পর যুদ্ধ করি হইল সংহার।একজন যদুকূলে না রহিল আর।।যোগে তনু ত্যজিলেন রেবরীরমণ।নিম্ববৃক্ষে আরূঢ় ছিলেন নারায়ণ।।ব্যাধ এক আছি বাণে বিন্ধিল চরণ।তাহে ত্যজিলেন প্রাণ শ্রীমধুসূদন।।পাণ্ডবকুলের নাথ দেব জনার্দ্দন।তাঁহার বিয়োগে হ’ল সকল মরণ।।কি করিব রাজ্যধন কি কাজ জীবনে।সকল নিরাশ হ’ল গোবিন্দ বিহনে।।গাণ্ডীব ধরিতে মম শক্তি নাহি আর।দশদিক শূন্য দেখি সকলি অন্ধকার।।মুষলপর্ব্বের কথা অপূর্ব্ব ঘটন।পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচন।।১৩. যুধিষ্ঠিরের বিলাপঅর্জ্জুনের বাক্য শুনি, যুধিষ্ঠির নৃপমণি,পড়িলেন ধরনী উপর।ভীমসেন মাদ্রীসুত, ভদ্রা কৃষ্ণা পরীক্ষিত,লোটাইয়া ধূলায় ধূসর।।চিত্রের পুত্তলি প্রায়, ভূমে গড়াগড়ি যায়,প্রাণধন গোবিন্দ বিহনে।হাহাকার শব্দ করি, কান্দি ধর্ম্ম অধিকারী,পড়িলেন ভূমে অচেতনে।।হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু, পাণ্ডবগণের বন্ধু,পার্থরূপ পক্ষীর জীবন।বিবিধ সঙ্কটে ঘোরে, রক্ষা কৈলে বারে বারে,কুরুক্ষেত্র আদি মহারণ।।খাণ্ডবদাহন কালে, ইন্দ্র আদি দিকপালে,তোমার কৃপায় হৈল জয়।নিবাত কবচ আদি, যত দেবগণ বাদী,একেলা বধিল ধনঞ্জয়।।উত্তর গোগ্রহে রণে, ভীষ্ম আদি বীরগণে,একেশ্বর জিনিল ফাল্গুনী।দুর্য্যোধন ভয় হৈতে, রক্ষা কৈলে কুরুক্ষেত্রে,সারথিত্ব করিলে আপনি।।পূর্ব্বেতে পাশায় জিনি, সভামধ্যে যাজ্ঞসেনী,ধরিয়া আনিল দুর্য্যোধন।বিবস্ত্রা করিতে তারে, দুষ্ট দুঃশাসন ধরে,বস্ত্র ধরি টানে ঘনে ঘন।।পঞ্চস্বামী বিদ্যমান, কিছুতে না দেখি ত্রাণ,ডাকিল তোমার নাম ধরি।অনাথের নাথ তুমি, তখনি জানিনু আমি,রক্ষা কৈলে দ্রুপদকুমারী।।দ্বিতীয় প্রহর নিশি, আসিল দুর্ব্বাসা ঋষি,ঘোরতর অরণ্য ভিতর।সে সমুদ্রে পাণ্ডুসুতে, ফেলাইল কুরুনাথে,তাহাতে রাখিলা দামোদর।।বিরাট নগর হৈতে, দুর্য্যোধন কুরুসুতে,হস্তিনা আইসে দূতগণে।তোমার মুখের বাণী, না শুনিল কুরুমণি,ঘোরতর করিল দারুণে।।কৃপাসিন্ধু অবতার, সঙ্কটে করিলে পার,বন্ধুরূপে পাণ্ডব নন্দনে।পুনঃ আমি শোকান্তরে, অরণ্যে যাবার তরে,সত্য চিন্তিলাম নিজ মনে।।প্রবোধিয়া বিধিমতে, আমারে রাখিলে তাতে,বুঝাইয়া অশেষ প্রকার।হায় দুঃখ বিমোচন, পাণ্ডবের প্রাণধণ,তোমা বিনা কে আছে আমার।।যুধিষ্ঠির নৃপবর, ধনঞ্জয় বৃকোদর,সহ দুই মাদ্রীর নন্দন।শোকসিন্ধু মধ্যে পড়ি, ধরণীতে গড়াগড়ি,কৃষ্ণ কৃষ্ণ ডাকে ঘনে ঘন।।ভারত অমৃত কথা, ব্যাসের রচিত গাথা,সর্ব্ব দুঃখ শ্রবণে বিনাশ।কমলাকান্তের সুত, সুজনের মনপ্রীত,বিরচিল কাশীরাম দাস।।১৪. দ্রৌপদীর সহিত পঞ্চপাণ্ডবের মহাপ্রস্থানরাজা বলে ভাই সব কি ভাবিছ আর।ব্রাহ্মণে আনিয়া দেহ সকল ভাণ্ডার।।কৃষ্ণ বিনা গৃহবাসে নাহি প্রয়োজন।কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে যাব নিশ্চয় বচন।।সকল সম্পদ মম সেই জগৎপতি।তাঁহা বিনে তিলেক উচিত নহে স্থিতি।।যথায় পাইব দেখা শ্রীনন্দননন্দনে।কৃষ্ণ অনুসারে আমি যাইব আপনে।।বুঝিয়া রাজার মন ভাই চারিজন।করপুট করিয়া করেন নিবেদন।।পাণ্ডবের গতি তুমি পাণ্ডবের পতি।তুমি যেই পথে যাবে সেই পথে গতি।।তোমা বিনা কে আর করিবে কোন কাজ।কৃপায় সংহতি করি লহ ধর্ম্মরাজ।।আজন্ম তোমার পাশে নহি বিচলিত।আমার সবা ত্যজিবারে নহে ত উচিত।।এত শুনি আশ্বাসেন ধর্ম্ম নরপতি।প্রণমিয়া করপুটে কহেন পার্ষতি।।আমি ধর্ম্মপত্মী তব ভাই পঞ্চজনে।আমারে ছাড়িয়া সবে যাইবে কেমনে।।তোমা সবা সঙ্গে আমি যাইব নিশ্চয়।অনুগত জনেরে না ত্যজ কৃপাময়।।তোমার যে গতি রাজা আমার সে গতি।অনুগত জনে রাজা করহ সংহতি।।শুনি আশ্বাসেন তবে ধর্ম্মের নন্দনে।দ্রুপদনন্দিনী হৈল হরষিত মনে।।সোনা রত্ন সবারে বিলান অপ্রমিত।মথুরা নগরে দূত পাঠান ত্বরিত।।ঊষা (?) অনিরুদ্ধসূত বজ্রনাম ধরে।যদুবংশ শেষ মাত্র তিনি একেশ্বরে।।যুধিষ্ঠির আশয় বুঝিয়া বজ্রবীর।সত্বরে আইল যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।বজ্রবীরে পেয়ে পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।আলিঙ্গন করি হৈল আনন্দ অপার।।ইন্দ্রপরস্থপাটে তারে অভিষেক করি।ছত্রদণ্ড অর্পিলেন ধর্ম্ম অধিকারী।।তাহারে কহেন তবে ধর্ম্ম নৃপবর।কৃষ্ণের প্রপৌত্র তুমি বৃষ্ণিবংশধর।।এই ইন্দ্রপ্রস্থ তুমি কর অধিকার।হস্তিনাতে পরীক্ষিত পাবে রাজ্যভার।।তোমার প্রপিতামহ শ্রীমধুসূদন।করিলেন বন্ধুরূপে আমারে পালন।।এত কহি যুধিষ্ঠির সত্বর হইয়া।বজ্রহস্তে ইন্দ্রপস্থে দেন সমর্পিয়া।।তবে যুধিষ্ঠির রাজা হস্তিনা ভুবনে।পরীক্ষিত বসায়েন রাজ-সিংহাসনে।।পঞ্চতীর্থ জল আনি করি অভিষেক।সমর্পিয়া পাত্র মিত্র অমাত্য যতেক।।চতুর্দ্দিকে ঘন হয় হরি হরি ধ্বনি।হস্তিনায় পরীক্ষিত হৈল নৃপমণি।।শুভক্ষণ করিয়া পাণ্ডব পঞ্চবীর।পাঞ্চাল নন্দিনী সঙ্গে হইল বাহির।শ্রীহরি শ্রীহরি বলি ডাকি উচ্চৈঃস্বরে।বিদায় দিলেন যত বন্ধু বান্ধবেরে।কৃপাচার্য্য গুরুপদে প্রণাম করিয়া।ধৌম্য পুরোহিত স্থানে বিদায় হইয়া।।চলিল পাণ্ডব সহ দ্রুপদনন্দিনী।হৃদয়ে ভাবিয়া সে দেব চক্রপাণি।।১৫. প্রজাগণের খেদোক্তিহায় ধর্ম্ম বৃকোদর, ধনঞ্জয় বীরবর,সহদেব নকুল কুমার।দ্রৌপদী পাঞ্চাল-সুতা, সতীসাধ্বী পতিব্রতা,চরিতে লক্ষ্মীর অবতার।।দ্রুপদ তোমার তাত, পাঞ্চালের নরনাথ,তোমা কন্যা হৈতে হৈল সুখী।তব স্বয়ম্বর-কালে, পৃথিবীর মহীপালে,তোমারে দেখিল শশিমুখী।।ধৃষ্টদ্যুম্ন সহোদর, অতুল বিক্রমধর,যজ্ঞেতে জন্মিল দুই জন।সবে বলে মহাতেজা, এল এক লক্ষ রাজা,দ্রুপদ ভাবেন মনে মন।।এ কন্যার যোগ্য পতি, অন্য নাহি দেখি ক্ষিতি,পাণ্ডুর তনয় বিনা আর।অপূর্ব্ব ভাগ্যের বশে, উপনীত সেই দেশে,কুন্তীসহ পাণ্ডুর কুমার।।সভামধ্যে লক্ষ্য হানি, তোমারে লইল জিনি,দ্বিজরূপে ইন্দ্রের তনয়।অনাথ দেখিয়া তারে, দুষ্ট যত নৃপবরে,বেড়িল লইয়া অস্ত্রচয়।।এক লক্ষ নরপতি, সবে হৈল একমতি,প্রহারয়ে নানা অস্ত্রগণ।ভীম পার্থ দুই বীরে, জিনিলেক সবাকারে,তোমা লয়ে করিল গমন।।তুমি এলে পাণ্ডুকুলে, তোমার আশ্রয়ফলে,পাণ্ডবের সম্পদ অপার।জিনিল সকল পৃথ্বী, রাখিল অনেক কীর্ত্তি,সখ্য-বল করিয়া তোমার।।দুর্য্যোধন নরপতি, পাশায় জিনিল তথি,সভামধ্যে আনিল তোমায়।তাহে লজ্জা নিরারণ, করিলেন নারায়ণ,সর্ব্বজন দেখিল সভায়।।সেই অপরাধে যত, গান্ধারী-তনয় শত,একে একে হইল সংহার।তুমি সর্ব্ব গুণবতী, সাধ্বী পতিব্রতা সতী,জননী সমান মো সবার।।প্রত্যক্ষ সকলে জানে, তোমার এ সুলক্ষণে,দয়াময়ী জননী- রূপিণী।তুমি লক্ষ্মী সরস্বতী, স্বাহা স্বধা শচী রতি,সাবিত্রী পার্ব্বতী কাত্যায়নী।।তুমি ত জগৎ-মাতা, সবে জানে তব কথা,বিষ্ণুর প্রেয়সী সহচরী।স্বামীগণ সঙ্গে করি, ত্যজিয়া হস্তিনাপুরী,কোন্ স্থানে চলেছ সুন্দরী।।প্রায় হেন লয় মন, পুনরপি দুর্য্যোধন,কপটে আনিয়া পাশা-সারি।জিনিলেক রাজ্যধন, তোমা সব যাহ বন,আমা সবাকারে পরিহরি।।না ত্যজ না ত্যজ মাই, তোমা বিনা গতি নাই,আমরা চলিব সর্ব্বজন।ওহে ধর্ম্ম-মহারাজা, ভীম পার্থ মহাতেজা,ওহে দুই মাদ্রীর নন্দন।।তোমা বিনা গৃহবাস, আর যত অভিলাষ,ছাড়ি পাপ জীবনের সাধ।মহারাজ তোমা হৈতে, সদা সুখ পৃথিবীতে,আজ কেন এতেক প্রমাদ।।বাহুড় বাহুড় রায়, তোমারে এ না যুয়ায়,নির্দ্দয় হৈতে কদাচিৎ।তুমি ধর্ম্ম-অধিকারী, কৃপাময় অবতরি,তুমি সর্ব্ব জগতে বিদিত।।তোমার এমন কাজ, যুক্তি নহে মহারাজ,শোকবংশ ত্যজহ সংসার।পূর্ব্বে মহাশোক করি, তপস্বীর বেশ ধরি,বনে যেতে করিলে বিচার।।দেববেদ চক্রপাণি, ভীষ্মদেব ব্যাসমুনি,প্রবোধ দিলেন যে প্রকার।এবে শোক নিবারণ, করাইবে কোন্ জন,কেহ আর নাহিক তোমার।।ওহে ভীম ধনঞ্জয়, মাদ্রীর তনয়দ্বয়,প্রবোধ করহ নৃপবরে।সবে হৈল শোকান্তর, শুন বীর বৃকোদর,শোক ত্যজি বুঝাহ সবারে।।এইমত প্রজাগণ পাত্র মিত্র পুরজন,সর্ব্বলোক কান্দিয়া কাতর।দেখিয়া এমন কাজ, সদ পাণ্ডবরাজ,প্রবোধেন বাক্যে বহুতর।।ক্ষমা দেহ সর্ব্বলোক, আর না করিহ শোক,মায়াময় এই ত সংসার।বুঝিয়া কার্য্যের গতি, সবে স্থির কর মতি,অসার সংসার, কৃষ্ণ সার।।পাণ্ডবের ইষ্ট বন্ধু, সেই কৃষ্ণ কৃপাসিন্ধু,ত্যজিলেন দ্বারকা-নিবাস।সে হেন বান্ধব বিনু, নিষ্ফল হইল তনু,বিফল সকল অভিলাষ।।মাহভারতের কথা, ব্যাসের রচিত গাথা,শ্রবণে কলুষ বিনাশন।শিরেতে বন্দিয়া নিজ, দ্বিজগণ পদরজঃ,কাশীরাম দাস বিরচন।।১৬. প্রজালোকের প্রতি যুধিষ্ঠিরের প্রবোধবাক্য এবং অর্জ্জুনের গাণ্ডীব ধনু ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় পরিত্যাগধর্ম্ম বলিলেন শুন আমার বচন।শোক না করহ সবে যায় নিকেতন।।এই পরীক্ষিত হ’ল রাজ্যেতে রাজন।আমা সম তোমা সবে করিবে পালন।।সংসার অসার সার নন্দের নন্দন।মনেতে চিন্তহ সেই কৃষ্ণের চরণ।কৃষ্ণ ভজ কৃষ্ণ চিন্ত কৃষ্ণ কর সার।ভেবে দেখ কৃষ্ণ বিনা গতি নাহি আর।।এইরূপে প্রবোধ করিয়া বহুতর।কৃষ্ণ বলি চলিলেন পঞ্চ সহোদর।।হেনমতে পঞ্চ ভাই যান পূর্ব্বমুখে।হেনকালে বৈশ্বানর দেখেন সম্মুখে।অর্জ্জুনে চাহিয়া চলিছেন বৈশ্বানর।আমার বচন শুন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।আমি হুতাশন, শুন ইন্দ্রের নন্দন।মম হেতু করিয়াছ খাণ্ডবদাহন।।তোমা পঞ্চ সহোদর দেব অবতার।বিষ্ণু সহ পৃথিবীতে করিলে বিহার।।করিলে অনেক কর্ম্ম বিনাশিলে ভার।পরম সন্তোষ হৈল পৃথিবী অপার।।অতঃপর কিছু আর নাহি প্রয়োজন।স্বর্গবাসে চলিলে তোমরা পঞ্চজন।।অক্ষয় যুগল তূণ গাণ্ডীব ধনুক।দেহত আমায় তবে এ নহে কৌতুক।।এত শুনি পঞ্চভাই পাঞ্চালী সহিত।প্রণিপাত করিলেন হ’য়ে হরষিত।।গাণ্ডীব ধনুক আর তূণপূর্ণ শর।অগ্নি বিদ্যমানে দেন পার্থ ধনুর্দ্ধর।।ধনুক লইয়া অগ্নি হৈল অন্তর্দ্ধান।করপুটে পঞ্চজন করেন প্রণাম।।তবে পূর্ব্বমুখ হ’য়ে যান ছয় জন।বনে বনে চলিলেন ভাই পঞ্চজন।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon