মহাভারত:অশ্বমেধপর্ব-০০৬-০১০

০৬. যুবনাশ্বগৃহে ভীমের আগমন
নৃপ হরষিত, অমাত্য সহিত,
করিলেক বিবেচনা।
আমার বৈভব, আর কত কব,
বিধি করিল ঘটনা।।
পাণ্ডুর তনয়, ভীম মহাশয়,
আসিবে আমার পুরে।
নগর শোভন, কর প্রজাগণ,
আনন্দ করি অন্তরে।।
পেয়ে নৃপাদেশ, ঘুচে সর্ব্বক্লেশ,
করে পুরী সংস্কার।
ছড়াইল জল, করি সমস্থল,
ঘটে শোভে আম্রসার।।
নগর শোভন, কৈল প্রজাগণ,
চান্দোয়া চামর দোলে।
রাগ-তাল-ধরা, নাচিছে অপ্সরা,
শত শত কুতূহলে।।
কুসুম চন্দন, লয়ে দ্বিজগণ,
দাণ্ডাইল রাজপথে।
শঙ্খ বীণা বেণী, কাঁসী বাজে সানী,
আনন্দিত নগরেতে।।
ভূষা শোভে গায়, দেখিবারে ধায়,
বৃদ্ধ শিশু আর যুবা।
ভট্ট রায়বার, পড়িছে সুধার,
অমর নগর কিবা।।
পথেতে অম্বর, পাতে নরবর,
ভীম আগমন আশে।
ঘট বহুতর, রাখিল সত্বর,
পথের উভয় পাশে।।
মূর্ত্তি যেন বিধু, যত কুলবধূ,
রহিল গবাক্ষদ্বারে।
দেখি বৃকোদর, হরিষ অন্তর,
আর বৃককেতু বীরে।।
হেথা নৃপজায়া, হর্ষে পূর্ণকায়া,
ডাকি সহচরীগণে।
সবাই সুবেশা, করি বেশভূষা,
চলে ভীম দরশনে।।
হাতে হেমথালা, নৃপতি-মহিলা,
শুভসজ্জা তদুপরি।
পুরনারী যত, চৌদিকে বেষ্টিত,
ত্যজি যায় অন্তঃপুরী।।
রহি সিংহদ্বারে, শুভসজ্জা করে,
হেথা আসে বৃকোদর।
প্রবেশি পুরেতে, আনন্দিত চিতে,
দেখি পুরী মনোহর।।
আগে দ্বিজগণ, অগুরু চন্দন,
দিল ভীম মহাবীরে।
জিনি নরপতি, ভীমের মূরতি,
চারু গতি ধীরে ধীরে।।
নগরের রামা, দেখি তিন জনা,
দূর করে যত শোক।
রাম আগমনে, হরষিত মনে,
যেন অযোধ্যার লোক।।
এল রাজদ্বারে, তিন মহাবীরে,
করয়ে পটহ-ধ্বনি।
মঙ্গলায়োজন, করি নির্ম্মঞ্ছন,
আনন্দ করিল রাণী।।
আপনি রাজন, আনি সিংহাসন,
বসাইল বৃকোদরে।
চামর ব্যজন, করে সখীগণ,
ভীমসেন-কলেবরে।।
কর্ণের নন্দনে, বসায় আসনে,
নির্মঞ্ছ করিল সুখে।
ঘটোৎকচ-সুতে, হরষিত চিতে,
বসায় ভীম সম্মুখে।।
পূজিল পাণ্ডবে, পরম গৌরবে,
যুবনাশ্ব নৃপবর।
কহে কাশীদাস, কৃষ্ণপদে আশ,
কথা হয় মনোহর।।
০৭. যুবনাশ্ব রাজার হস্তিনা
গমন ও শ্রীকৃষ্ণ দর্শন
বলেন বৈশম্পায়ন শুনহ নৃপতি।
এই বিবরণ কহিলাম তোমা প্রতি।।
জন্মেজয় বলিলেন শুন তপোধন।
এবে কহ যুবনাশ্ব রাজার কথন।।
ভীমেরে পূজিল রাজা অতি সমাদরে।
কহ সে কেমনে গেল হস্তিনা নগরে।।
কি কহিল নরপতি যুধিষ্ঠির স্থানে।
সে কথা শুনিব প্রভু তোমার বদনে।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন জন্মেজয়।
সিংহাসনে বসিলেন ভীম মহাশয়।।
নানা উপহারে রাজা ভীমেরে তুষিল।
মহাসুখে বৃকোদর ভোজন করিল।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা সম্প্রীতি পাইয়া।
ভীমের সম্মূখে রহে যোড়হাত হৈয়া।।
তোমার প্রসাদে দেখি গোবিন্দ চরণ।
যুধিষ্ঠির দরশনে পাপ বিমোচন।।
গঙ্গাস্নান করিয়া দেখিব নারায়ণ।
শুন ভীমসেন মম এই নিবেদন।।
প্রভাত সময়ে রাজা দিলেন ঘোষণা।
কৃষ্ণ দরশনে সব যাইব হস্তিনা।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা আনন্দিত হৈয়া।
মায়ের নিকটে বলে প্রণাম করিয়া।।
চল গো জননি যাব হস্তিনানগরী।
গঙ্গাস্নান করি সবে দেখিব শ্রীহরি।।
ঘুচিবে সকল পাপ কৃষ্ণ দরশনে।
বিলম্ব না কর মাতা চল ভীমসনে।।
এত যদি কহিলেন যুবনাশ্ব রাজ।
কহিতে লাগিল মাতা বুঝিয়া অকাজ।।
রাজার নন্দিনী হই আমি রাজরাণী।
দেশান্তরে যাব আমি কভু নাহি শুনি।।
ঘরে বাহির আমি না হই কখন।
কি বুঝিয়া বল বাপু কুৎসিত বচন।।
তবে যুবনাশ্ব বলে, শুন গো জননি।
থাকিলে অনেক ভাগ্য দেখে চক্রপাণি।।
কত জন্ম ফলেতে করয়ে গঙ্গাস্নান।
মরিলে গঙ্গার জলে পাইবে নির্ব্বাণ।।
বধূগণ সঙ্গে লয়ে চলহ সত্বর।
দেখিবে পরমানন্দে হস্তিনানগর।।
শুভক্ষণে অশ্বেরে পালন কৈনু আমি।
দেখিব তুরগ হৈতে অখিলের স্বামী।।
পুত্রের শুনিয়া কথা বলিল আবার।
এতধর্ম্ম না করিল জনক তোমার।।
একছত্রে ভুঞ্জিলেক ভদ্রাবতীপুরী।
নানা যজ্ঞদান কৈল বলিতে না পারি।।
আমার সবা লয়ে কভু না গেল বিদেশে।
কৃষ্ণ নাম না শুনিনু থাকি গৃহবাসে।।
ও ধন সম্পত্তি বাপু রাখি যাব কোথা।
তোমার বচনে বড় মনে পাই ব্যথা।।
কৃষ্ণ দরশনে বাপু কিছু নাহি কাজ।
পুরীর বাহির হ’লে বড় হবে লাজ।।
না যাইব বাপু আমি কৃষ্ণ-দরশনে।
লোকমুখ গঙ্গা-কথা শুনি যে শ্রবণে।।
ক্রোধিত হৈল রাজা মায়ের বচনে।
পাত্রেরে বলিল লহ করিয়া যতনে।।
ভূপাদেশে পাত্র তারে বন্ধন করিল।
দিব্য চতুর্দ্দোল করি তাহাকে লইল।।
চতুর্দ্দোল করি তারে করিলেক স্কন্ধে।
মহাপাপে রাজমাতা উচ্চৈঃস্বরে কান্দে।।
দেখিয়া রাজার ভক্তি বীর কৃকোদর।
ধন্য ধন্য প্রশংসা করিল বহুতর।।
সেই অশ্ব লয়ে রাজা চলিল আপনি।
অগ্রে গেল বৃকোদর বড় অভিমানী।।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ নৃপতির সাথে।
প্রবেশ করিল গিয়া পুর হস্তিনাতে।।
একা ভীমে দেখিয়া কহেন নরপতি।
বষকেতু কোথা ভীম কহ শীঘ্রগতি।।
মেঘবর্ণ বীর কোথা কহ সমাচার।
কোথায় যজ্ঞের অশ্ব না দেখি আমার।।
অশ্ব লয়ে যুবনাশ্ব আইসে আপনি।
কৃষ্ণ দরশন আসে শুন নৃপমণি।।
পরিবার সহিত আইসে নরপতি।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ লইয়া সংহতি।।
ভীমের বচনে আনন্দিত যুধিষ্ঠির।
কোল দিয়া ভীমসেনে চিত্ত করে স্থির।।
তবে যুধিষ্ঠির কহিলেন ভীমসেনে।
কহ গিয়া এই কথা দ্রৌপদীর স্থানে।।
যুবনাশ্বে পূজা করি আনহ মন্দিরে।
শুন ভীম এই ভার দিলাম তোমারে।।
আজ্ঞা প্রাপ্তে সত্বরে চলিল বৃকোদর।
কহিল সকল কথা দ্রৌপদী গোচর।।
কুন্তী যাজ্ঞসেনী আদি যত নারীগণ।
স্বর্ণথালে করিল মঙ্গল আয়োজন।।
ধূপ দীপ শঙ্খঘন্টা আদি যত দ্রব্য।
কুসুম চন্দন আর নিল হব্য গব্য।।
নৃপতির অভিলাষ বুঝি নারায়ণ।
দিব্যাসনে বসিলেন প্রসন্নবদন।।
নানামত বাদ্য বাজে হস্তিনানগরে।
ভীমসেন গেল যুবনাশ্বে আনিবারে।।
হেনকালে যুবনাশ্ব আইল নগরে।
ভীম তাঁরে আনিলেন মহা সমাদরে।।
অগ্রভাগে দ্রৌপদী করিতে নির্মঞ্ছন।
কুসুম চন্দন নিল নানা আয়োজন।।
পরিবার সহিত গেলেন নরপতি।
যুধিষ্ঠির চরণেতে করিল প্রণতি।।
নানাদান যজ্ঞ করে যাঁর দরশনে।
দেখিলাম নারায়ণ তোমার মিলনে।।
ধন্য ধন্য যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর নন্দন।
তোমা হৈতে দেখিলাম গোবিন্দ চরণ।।
এত বলি যুবনাশ্ব গলে বস্ত্র দিয়া।
ধরিল গোবিন্দ পদ ভূমে লোটাইয়া।
লক্ষ দণ্ডবৎ কৈল গোবিন্দ চরণে।
আনন্দেতে অশ্রু বহে রাজার লোচনে।।
সুবেগ রাজার পুত্র ভূমিষ্ঠ হইয়া।
কৃষ্ণপদ পরশিল দুই হস্ত দিয়া।।
পরে রাজনারী আসি করিল প্রণাম।
আশীর্ব্বাদ সবারে দিলেন ঘনশ্যাম।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা মাতারে ধরিয়া।
কৃষ্ণস্থানে কহিলেন বিনয় করিয়া।।
আমার মায়ের দোষ ক্ষম চক্রপাণি।
আপনার গুণে কৃপা করহ আপনি।।
জীবের জীবন তুমি সংসারের ‍সার।
তুমি না করিলে কৃপা কে করিবে আর।।
পরম কারণ তুমি পতিত পাবন।
তোমার দর্শনে মম পাপ বিমোচন।।
হিংসা করি পুতনাও পাইল তোমারে।
স্নেহগুণে তোমায় পাইল যুধিষ্ঠিরে।।
কামভাবে ব্রজবধূ পাইল তোমাকে।
এ সকল কথা শুনিয়াছি মুনি মুখে।।
মহাপাপকারিণী হে আমার জননী।
আপনার গুণে কৃপা কর চক্রপাণি।।
তবে কৃপাদৃষ্টিতে চাহিয়া নারায়ণ।
তাহার যতেক পাপ করেন মোচন।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা সম্প্রীতি পাইয়া।
কৃষ্ণকে করেন স্তব যোড়হস্ত হইয়া।।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি ত্রিলোচন।
তুমি ইন্দ্র তুমি যম কুবের পবন।।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্ত্য তুমি সে পাতাল।
তুমি জল তুমি স্থল দশদিকপাল।।
তুমি দিবা তুমি রাত্রি পর্ব্বত সাগর।
তুমি যোগ তুমি ভোগ তুমি চরাচর।।
মাস তুমি বার তুমি, তিথি পঞ্চদশ।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর তুমি, তুমি সে তাপস।।
তোমায় মহিমা প্রভু কে বলিতে পারে।
এই তত্ত্ব জানি আমি বিদিত সংসারে।।
এক সুবর্ণেতে হয় নানা অলঙ্কার।
একেলা ধরিলে কত শত অবতার।।
তোমার সকল সৃষ্টি সর্ব্বমূল তুমি।
ব্রহ্মাদি না পায় তত্ত্ব কি বলিব আমি।।
ধন্য যুধিষ্ঠির রাজা ‍পাণ্ডুর নন্দন।
দেখিলাম তোমা হৈতে অভয় চরণ।।
ধন্য বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।
যাহা হৈতে দেখিলাম গোবিন্দ চরণ।।
আমার যতেক ভাগ্য বলিতে না পারি।
তোমার অভয় পদ দেখিনু মুরারি।।
এত বলি বাজী বাগ ধরি নৃপবর।
আনিল যজ্ঞের ঘোড়া কৃষ্ণের গোচর।।
হরিষে আছেন যুধিষ্ঠির নরবর।
দ্বারকায় চলিলেন দেব দামোদর।।
অপার মহিমা তাঁর কে কহিতে পারে।
দ্বারকায় গেলেন না কহি পাণ্ডবেরে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
০৮. শ্রীকৃষ্ণের আদর্শনে যুধিষ্ঠিরের
উদ্বেগ ও শ্রীকৃষ্ণের পুনরাগমন
হেথা যুধিষ্ঠির রাজা রজনী প্রভাতে।
ডাক দিয়া অর্জ্জুনেরে আনেন সাক্ষাতে।।
একেলা অর্জ্জুনে দেখি কহেন রাজন।
বলহ কিরীটি কোথা বিপদ ভঞ্জন।।
অর্জ্জুন বলেন হরি ছিলেন সভায়।
তত্ত্ব নাহি জানি, তিনি আছেন কোথায়।।
ধর্ম্ম বলিলেন কৃষ্ণ তোমার গোচরে।
সতত থাকেন ইহা বিদিত সংসারে।।
না বলিয়া গোবিন্দ গেলেন নিজালয়ে।
কি পাপ জন্মিল ভাই আমার হৃদয়ে।।
এত বলি অধোমুখে আছেন নৃপতি।
ভীম সহদেব তথা আইল ঝটিতি।।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুর আইল দুইজন।
হেনকালে আসিলেন ব্যাস তপোধন।।
ব্যাসে দেখি যুধিষ্ঠির করেন প্রণতি।
আশীর্ব্বাদ করিলেন ব্যাস মহামতি।।
অবধান কর শুন মুনি মহামতি।
ঘোড়া আনিলেক ভীম করিয়া শকতি।।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ বিক্রম করিল।
সহ পরিবার রাজা আমারে ভজিল।।
আপনি আইল রাজা তুরঙ্গ লইয়া।
সম্প্রীতি পাইল রাজা আমারে দেখিয়া।।
মুনি কন যুধিষ্ঠির শুনহ বচন।
আর ভয় নাই যজ্ঞ কর আরম্ভন।।
নিমন্ত্রিয়া আন যত্ ঋষি মুনিগণে।
যজ্ঞ আরম্ভন কর আজি শুভক্ষণে।।
উত্তম মধ্যমাধম এ তিন প্রকার।
সবাই পালিবে ধর্ম্ম যথাশক্তি যার।।
উত্তম যে লোক তার শুন ব্যবহার।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম ধর্ম্মের কুমার।।
লোভ মোহ ক্রোধ ত্যজি ‍কৃষ্ণে কর মতি।
উত্তম সে ভাগবত শুনে নরপতি।।
শত্রু মিত্র বলি তত্ত্ব কিছুই না জানে।
মধ্যম সে ভাগবত জানে সর্ব্বজনে।।
পরনারী পরদ্রব্য হরিবারে মন।
অধম বলিয়া তারে জানিবে রাজন্ ।।
চণ্ডাল করয়ে যদি বৈষ্ণবের কাজ।
মহাজন বলিয়া জানিবে মহারাজ।।
ব্রাহ্মণ করয়ে যদি চণ্ডালের কর্ম্ম।
চণ্ডাল বলিয়া তারে জানিহ হে ধর্ম্ম।।
যার যেই নিজ বৃত্তি করে যেই জন।
ধর্ম্মবন্ত বলি তারে জানিবে রাজন।।
নিজবৃত্তি ছাড়ি যেবা পরবৃত্তি করে।
সেই সে অধর্ম্ম বলি জানাই তোমারে।।
পিতৃকার্য্য দেবকার্য্য অতিথি সেবন।
যে জন করয়ে সেই হয় মহাজন।।
শুচি আর সত্যবাদী পালে নিজ ধর্ম্ম।
ইহার সমান আর নাহি কোন কর্ম্ম।।
কহিলাম সংক্ষেপে শুনহ নরপতি।
কৃষ্ণে আনি যজ্ঞ কর রাজা মহামতি।।
এ বড় বিস্ময় মম উপজিল মনে।
তোমার সংহতি কৃষ্ণ নাহি দেখি কেনে।।
যুধিষ্ঠির গেলেন ছিলা চক্রপাণি।
দ্বারকা গেলেন হরি তত্ত্ব নাহি জানি।।
কৃষ্ণ না দেখিয়া মম উচাটন মন।
না কহিয়া আমারে গেলেন নারায়ণ।।
সেই হেতু আমি বড় ভয় করি মনে।
না বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ গেলেন কি কারণে।।
ব্যাস বলিলেন রাজা শুনহ বচন।
দ্বারকা গেলেন হরি আছে প্রয়োজন।।
ভীমে পাঠাইয়া তুমি আনহ কৃষ্ণেরে।
আমি তপোবনে যাই তপ করিবারে।।
এত বলি ব্যাস চলিলেন তপোবন।
ভীমেরে ডাকেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
কৃষ্ণকে না দেখে মম মন উচাটন।
কৃষ্ণ বিনা নাহি রহে আমার জীবন।।
ভীম বলিলেক যাই কৃষ্ণ আনিবারে।
কি কারণে দুঃখ তুমি ভাবহ অন্তরে।।
রথ আরোহিয়া গেল দ্বারকা নেগরে।
দূত জানাইল গিয়া গোবিন্দ গোচরে।।
ভীম আগমন শুনি দেব নারায়ণ।
আনন্দে কহেন আন করিয়া যতন।।
ভোজন করিতে সুখে ছিলেন শ্রীহরি।
ভীমে আনিলেন দূত সমাদর করি।।
ভোজন করেন সুখে বসি নারায়ণ।
হেনকালে উপনীত পবন নন্দন।।
এস এস বলি কৃষ্ণ ডাকেন ভীমেরে।
দাসীগণ পাদ্য অর্ঘ্য যোগাইল তারে।।
গোবিন্দ বলেন ভাই করহ ভোজন।
রুক্মিনী আনিয়া দিল দিব্যান্ন ব্যঞ্জন।।
ভোজন করেন ভীম মনের হরিষে।
যত দেন তত খান আঁখির নিমিষে।।
ভীমের ভোজন দেখি হাসে সত্যভামা।
ধন্য তব উদর না দিতে পারি সীমা।।
লজ্জিত হইয়া ভীম গোবিন্দ মায়ায়।
না শুনিয়া সেই কথা আচাঁন ত্বরায়।।
কর্পূর তাম্বুল শেষে করিয়া ভক্ষণ।
বিচিত্র প্যলঙ্কোপরে করিল শয়ন।।
ভীম বলে কৃষ্ণচন্দ্র নিবেদি তোমারে।
দ্বারকা আইলে তুমি না কহি রাজারে।।
তোমা না দেখিয়া রাজা দুঃখ পায় মনে।
ব্যাস বলিলেলেন তাঁরে যজ্ঞ আরম্ভনে।।
আপনি তথায় চল যজ্ঞ দেখিবারে।
আমাকে পাঠান রাজা লইতে তোমারে।।
গোবিন্দ বলেন ভাই বঞ্চ এ রজনী।
প্রভাতে ভেটিব গিয়া ধর্ম্ম নৃপমণি।।
এত বলি নারায়ণ করেন শয়ন।
নানা কথা কুতূহলে রজনী যাপন।।
রজনী প্রভাতে হরি বিচারি অন্তরে।
ডাক দিয়া আনিলেন দেব হলধরে।।
অক্রূর উদ্ধব আর বিজ্ঞ সর্ব্বজনে।
গদ শাম্ব প্রদ্যুন্নাদি যত যদুগণে।।
কৃষ্ণে প্রণমিয়া সবে বসিল আসনে।
গোবিন্দ বলেন কথা সবা বিদ্যমানে।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিবেন যুধিষ্ঠির।
আসিলেক আমারে লইতে ভীম বীর।।
যজ্ঞ দেখিবারে আমি করিব গমন।
করিবে সকলে মেলি দ্বারকা রক্ষণ।।
রাখিয়া দ্বারকাপুরী সযত্ন হইয়া।
আমি যাব কৃতর্ম্মা উদ্ধবে লইয়া।।
দারুক আনিল রথ সাজায়ে সত্বরে।
শুভক্ষণে চাপিলেন হরি তদুপরে।।
অগ্র হয়ে ভীমসেন আইল সত্বরে।
কৃষ্ণ আগমন কথা কহিল রাজারে।।
শুনিয়া আনন্দ বড় ধর্ম্ম নরপতি।
চলিলেন কৃষ্ণেরে আনিতে শীঘ্রগতি।।
সহদেব নকূল অর্জ্জুন মহামতি।
বিদুরাদি সর্ব্বজন চলিল সংহতি।।
যুবনাশ্ব নরপতি যায় তার সঙ্গে।
কৃষ্ণ আনিবারে চলে অতি বড় রঙ্গে।।
হেনমতে আনন্দিত নগরের জনা।
কৃষ্ণ দরশনে যান সকল হস্তিনা।।
অগ্রগামী যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ আনিবারে।
হেনকালে শ্রীকান্ত আসিলেন নগরে।।
পদব্রজে আসিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
দেখিয়া ত্যজেন রথ কৃষ্ণ মহামতি।।
কি কব তুলনা যাঁর দিতে নারে বেদে।
সেই হরি প্রণমিল যুধিষ্ঠির পদে।।
আলিঙ্গন কৃষ্ণেরে দিলেন নরপতি।
হরিষে চলেন কৃষ্ণ পাণ্ডব সংহতি।।
যুধিষ্ঠির পুরে প্রবেশিলেন শ্রীজানি।
রাজসভা সুসজ্জা করেন নৃপমণি।।
সভাসদ্গণ সব বসিল সভাতে।
হেনকালে ব্যাস আসিলেন ইচ্ছামতে।।
কৃষ্ণে দেখি মহামুনি আনন্দ অপার।
প্রশংসা করেন ধন্য পাণ্ডুর কুমার।।
যজ্ঞ হোম দানে যাঁরে না পার দেখিতে।
হেন কৃষ্ণ দেখিলাম তোমার সাক্ষাতে।।
এত বলি সভাতে বসিল মহামুনি।
হেনকালে প্রসঙ্গ করেন চক্রপাণি।।
শুন রাজা যুধিষ্ঠির আমার বচন।
উপস্থিত কর যত আছে আয়োজন।।
দেশে দেশে পাঠাইয়া আন হব্য গব্য।
যজ্ঞ করিবারে চাহি ভাল ভাল দ্রব্য।।
বিলম্ব না হয় আন দূত পাঠাইয়া।
যতনে ‍রাখিবে দ্রব্য ভাণ্ডারে পূরিয়া।।
রাজাকে কহেন তবে ব্যাস তপোধন।
বিলম্ব না কর রাজা কর আয়োজন।।
আমার বচন তুমি শুন নরনাথ।
অশ্বমেধ যজ্ঞে বহু হইবে উৎপাত।।
সাধু কর্ম্মে আছয়ে বাধক বহুতর।
কিন্তু তব সখা এই দেব দামোদর।।
অতএব উদ্বেগ না হবে নরপতি।
তোমারে জিনিতে কার নাহিক শকতি।।
দূত পাঠাইয়া শীঘ্র কর আয়োজন।
আমন্ত্রণ করি আন দেব মুনিগণ।।
ব্যাসের বচনে ‍রাজা অর্জ্জুনে ডাকেন।
যজ্ঞ আয়োজন হেতু যতনে কহেন।।
অর্জ্জুন নিযুক্ত করিলেন যদুগণে।
নানা দ্রব্য আনে তারা পরম যতনে।।
পুরী পরিস্কার করে কত শত জন।
যজ্ঞের মণ্ডপ কেহ করয়ে গঠন।।
দধিকুল্য ঘৃতকুল্য দুগ্ধ সরোবর।
ত্রিবিধ করিল কত দেখিত সুন্দর।।
দধি সরোবর করে অতি মনোহর।
আয়োজনে পূর্ণ কৈল সকল ভাণ্ডার।।
কৃষ্ণ যাহে তুষ্ট তাহা হইল আপনি।
আইল কতেক দ্রব্য সংখ্যা নাহি জানি।।
কৃষ্ণ সঙ্গে যুধিষ্ঠির আছেন সভাতে।
হেনকালে উৎপাত হইল আচম্বিতে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
.০৯ অনুশাম্বের যুদ্ধ
জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়, ওহে মহামুনি।
কহ দেখি কি উৎপাত, তব মুখে শুনি।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুনহ রাজন।
আরম্ভ না হতে যজ্ঞ যুদ্ধের পত্তন।।
অনুশাল্ব নামে এক দৈত্যের ঈশ্বর।
কৃষ্ণের উদ্দেশে আসে হস্তিনা নগর।।
গজ বাজী রথ রথী সেনাগণ লৈয়া।
বহু সৈন্যে অনুশাল্ব আইল সাজিয়া।।
বেড়িল হস্তিনাপুরী শঙ্কা নাহি করে।
হাট বাট বেড়িল পদাতি থরে থরে।।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকে দৈত্য কোথা গদাধর।
পলায়ে আইলে মোর মারি সহোদর।।
আজি তোমা বিনাশিব, ইথে নাহি আন।
পাণ্ডবে শরণ নিলে রাখিবারে প্রাণ।।
পলাইয়া আইলে হে দ্বারকা ছাড়িয়া।
হস্তিনা আইনু আমি তোমার লাগিয়া।।
এত বলি অনুশাল্ব কহে সৈন্যগণে।
কৃষ্ণকে মারিব আমি আজিকার রণে।।
ভয় না করিহ কেহ করিতে সংগ্রাম।
আমার বিপক্ষ বড় দেব ভগবান।।
আজি কৃষ্ণে আমি যদি দেখিবারে পাই।
ক্ষণমাত্রে বিনাশিব, শুনহ সবাই।।
যতনে করহ সবে কৃষ্ণ অন্বেষণ।
লুকাইল মোর ডরে যাদব-নন্দন।।
যে মোরে দেখাবে কৃষ্ণ সংগ্রাম ভিতরে।
নানা ধন দিয়া তুষ্ট করিব তাহারে।।
কৃষ্ণকে জিনিয়া আমি যত ধন পাব।
সত্য করি কহিলাম, সব তারে দিব।।
যে আমারে দেখাইবে, গোপের নন্দনে।
সেই সে পরম বন্ধু, শুন সর্ব্বজনে।।
এত অহঙ্কার করি প্রবেশে নগরে।
দূত গিয়া সমাচার কহে যুধিষ্ঠিরে।।
অনুশাল্ব দৈত্য আসি বেড়িল নগর।
অহঙ্কারে আসিতেছে করিতে সমর।।
কুবচন কহিলেক কত নারায়ণে।
সে সকল কথা রাজা না শুনি শ্রবণে।।
দূতের বচনে যুধিষ্ঠির নরপতি।
সংগ্রাম করিতে আজ্ঞা দেন শীঘ্রগতি।।
কৃষ্ণ-নিন্দা শুনি সব পাণ্ডবের গণ।
দৈত্যের সহিত যায় করিবারে রণ।।
সহদেব নকুল আর যে ভীমবীর।
অর্জ্জুন গাণ্ডীব লয়ে সাজিলেন ধীর।।
মেঘবর্ণ আর সাজে সুবেগ কুমার।
নানা অস্ত্র লইয়া যতেক পরিবার।।
নানা অস্ত্র লয়ে তবে পাণ্ডবের গণ।
দৈত্যের সম্মুখে আসি দিল দরশন।।
সৈন্য দেখি অনুশাল্ব বলে উচ্চৈঃস্বরে।
কোথা কৃষ্ণ সৈন্য সব, দেখাহ আমারে।।
কোথা গেল গোপ উগ্রসেন-অনুচর।
আইস আমার সঙ্গে করিতে সমর।।
পাণ্ডব সহিত আমি যুদ্ধ নাহি করি।
প্রতিজ্ঞা আমার আছে মারিব শ্রীহরি।।
এত যদি অনুশাল্ব বলিল বচন।
তাহা শুনি কুপিত হইল সর্ব্বজন।।
রণে প্রবেশিল সবে ধনু টঙ্কারিয়া।
দৈত্যকে বিন্ধিল বাণ আকর্ণ পূরিয়া।।
ভীম সহদেব দোঁহে ধনুক পাতিল।
দেখি অনুশাল্ব দৈত্য গর্জ্জিতে লাগিল।।
কুপিত হইয়া তবে দৈত্যের ঈশ্বর।
ভীম সহদেবে বিন্ধি করিল জর্জ্জর।।
দৈত্য-শরে অচেতন হৈল দুই বীর।
সহিতে নারিল রণে, হইল অস্থির।।
ভয়ে ভঙ্গ দিল দোঁহে পরিহরি রণ।
মার মার ডাক ছাড়ে দৈত্য-সেনাগণ।।
দৈত্যের বিক্রম দেখি বীর ধনঞ্জয়।
লোহিত লোচন অতি কুপিত হৃদয়।।
মহাক্রোধে পার্থ বীর করেন সমর।
তাহা দেখি ডাকে তবে দৈত্যের ঈশ্বর।।
শুনহ অর্জ্জুন তুমি আমার বচন।
তোমার প্রতিজ্ঞা যত জগতে ঘোষণ।।
আমারে জিনিতে তব নাহিক শকতি।
সংগ্রাম করিব আমি শ্রীকৃষ্ণ সংহতি।।
আমার বিবাদ-যোগ্য দেব নারায়ণ।
তোমার সহিত আমি না করিব রণ।।
অশক্ত জনের সনে না করি সংগ্রাম।
তুলারাশি দেখি আমি তব যত বাণ।।
এত যদি ডাকিয়া বলিল দৈত্যেশ্বর।
কহিলেন কুপিয়া গাণ্ডীবী ধনুর্দ্ধর।।
কি বলিলি ওরে মূঢ়, নাহি তোর জ্ঞান।
আমি কি সংগ্রামে নহি তোমার সমান।।
খাণ্ডব দহিয়া আমি তুষিনু অনলে।
নিবাতকবচগণে জিনিনু পাতালে।।
আমার সংগ্রামে তুষ্ট হিইলা ঈশান।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্বেরে কৈনু অপমান।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি যত কুরুসেনা।
সবারে জিনিয়া আমি রাখিনু ঘোষণা।।
তোর সম নাহি পাপী, শুন রে বর্ব্বর।
কৃষ্ণের সহিত চাহ করিতে সমর।।
বামন হইয়া চাহ চন্দ্রমা ধরিতে।
আমি তোমা বিনাশিব আজি সমরেতে।।
যদ্যপি আমার হাতে পাও অব্যাহতি।
তবে সে করিহ যুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণ সংহতি।।
ইহা বলি অর্জ্জুন গাণ্ডীব লয়ে করে।
অগ্নিবাণ মারিলেন দৈত্যের উপরে।।
ক্রুদ্ধ হৈল অনুশাল্ব অর্জ্জুনের বাণে।
সংগ্রাম করয়ে বীর কঠোর সন্ধানে।।
অর্জ্জুনের যত বাণ নিবারিল শরে।
দুই বীরে মহাযুদ্ধ সংগ্রাম ভিতরে।।
বরুণাস্ত্র সন্ধানিল বীর ধনঞ্জয়।
বায়ুবাণে নিবারিল দৈত্য দুরাশয়।।
মারেন বরুণবাণ ইন্দ্রের নন্দন।
অগ্নিবাণে দৈত্য বীর করে নিবারণ।।
সর্পবাণ এড়িল অর্জ্জুন মহামতি।
গরুড়াস্ত্রে সংহার করিল দৈত্যপতি।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণ এড়েন শ্বেতবাহন।
ক্ষুরপা বাণেতে দৈত্য করে নিবারণ।।
হেনমতে অর্জ্জুনের যত অস্ত্র ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা বাণে নিবারিল।।
হেনমতে অর্জ্জুনের যত অস্ত্র ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা বাণে নিবারিল।।
জিনিতে না পারিলেন ইন্দ্রের তনয়।
দৈত্যের সমরে বড় উপজিল ভয়।।
তবে অনুশাল্ব দৈত্য বিচারিয়া মনে।
অর্জ্জুনে বিন্ধিল বীর এক লক্ষ বাণে।।
মূর্চ্ছিত হইয়া রথে পড়েন কিরীটি।
তাহা দেখি ভঙ্গ দিল সেনা কোটি কোটি।।
কৃতবর্ম্মা সাত্যকি সুবেগ ধনুর্দ্ধর।
অনুশাল্ব সহ গেল করিতে সমর।।
বাণাঘাতে বীর সব অচেতন হৈল।
সংগ্রাম ত্যজিয়া সবে রণে ভঙ্গ দিল।।
যুবনাশ্ব রাজা তবে প্রবেশিল রণে।
অনেক সংগ্রাম কৈল অনুশাল্ব সনে।।
দৈত্যবাণে নরপতি হইয়া জর্জ্জর।
প্রাণভয়ে পলাইল ত্যজিয়া সমর।।
গদ শাল্ব আদি করি যত বীর ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য সহ অনেক যুঝিল।।
জিনিতে নারিল যুদ্ধে প্রাণপণ করি।
ভয়ে পলাইল সবে রণ পরিহরি।।
চিন্তিত পাণ্ডব-সৈন্য দৈত্যের প্রহারে।
প্রাণ লয়ে গেল সবে কৃষ্ণের গোচরে।।
সংগ্রাম-বৃত্তান্ত যত কৃষ্ণেরে কহিল।
তাহা শুনি শ্রীকৃষ্ণের দয়া উপজিল।।
দৈত্য-যুদ্ধে পার্থ বীর হইল কাতর।
শুনিয়া ঈষৎ হাসিলেন গদাধর।।
হাতে পান করি বলে দেব নারায়ণ।
অনুশাল্ব দৈত্যে ধরি দিবে যেই জন।।
আসিয়া লউক পান আমার গোচরে।
ঘুষিবে তাহার যশ জগৎ ভিতরে।।
বীরপুঞ্জ সমক্ষেতে কহিলাম আমি।
ঘুষিতে থাকুক তার যশের কাহিনী।।
ইহা শুনি প্রদ্যুম্ন সাহসে করি ভর।
লইতে কৃষ্ণের পান সবার ভিতর।।
অঙ্গীকার করিলেক কৃষ্ণের সাক্ষাতে।
সাজিল মকরধ্বজ দৈত্যকে মারিতে।।
ধনুর্ব্বাণ নানা অস্ত্র নিল যুদ্ধ হেতু।
সুসজ্জ হইয়া রথে চড়ে মীনকেতু।।
অনুশাল্ব দৈত্য যথা আছয়ে সমরে।
তথাকারে গেল বীর যুদ্ধ করিবারে।।
সৈন্যেতে বেষ্টিত হয়ে আইল অনঙ্গ।
দুই বীরে দেখাদেখি হৈল বড় রঙ্গ।।
আকর্ণ পূরিয়া কাম পূরিল সন্ধান।
অনুশাল্ব হৃদয়ে মারিল দশ বাণ।।
বাণাঘাতে ক্রুদ্ধ হৈল দৈত্য-অধিপতি।
ডাক দিয়া প্রদ্যুম্নেরে বলে শীঘ্রগতি।।
যুঝিতে আইলে তুমি লয়ে ধনুর্ব্বাণ।
দেখিলে না সংগ্রামে বীরের ভঙ্গীয়ান।।
সম্মুখ হইয়া যদি যুঝ মোর সনে।
তবে পাঠাইব তোমা যমের সদনে।।
চোরবংশে জন্ম তোর, জানহ চাতুরী।
গোপঘরে তোর বাপ ননী কৈল চুরী।।
উদুখলে নন্দজায়া বান্ধিল তাহারে।
মিথ্যা নহে এই কথা বিদিত সংসারে।।
গোপিকার বসন হরিল যে শ্রীহরি।
রুক্মিণীরে তোর বাপ আনে চুরি করি।।
কপট করিয়া সে মারিল যত জনে।
না বুঝি অবোধ লোক তাহারে বাখানে।।
কিন্তু সে সকল কর্ম্ম নারিব করিতে।
আমি তোরে যমঘরে পাঠাব নিশ্চিতে।।
এতেক বচনে কাম ক্রুদ্ধ হৈল মনে।
যুড়িল সহস্র বাণ ধনুকের গুণে।।
আকর্ণ পূরিয়া মারে দৈত্যের উপরে।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা নিবারিল শরে।।
তবে দৈত্য শত বাণ পূরিল সন্ধান।
আকর্ণ পূরিয়া কামে মারিলেক বাণ।।
বাণেতে কাটিল সব কৃষ্ণের কুমার।
তাহা দেখি দৈত্য-কেপি বাড়িল অপার।।
দিব্য অস্ত্র ধনুকে যুড়িল দৈত্যপতি।
প্রদ্যুম্নে মারিল বাণ করিয়া শকতি।।
সারথি সহিত উড়াইল রথখান।
পড়িল প্রদ্যুম্ন গিয়া কৃষ্ণ-বিদ্যমান।।
কামদেব দেখি ক্রোধ হৈল গদাধরে।
লাথি মারিলেন তার মস্তক উপরে।।
দৈত্য-বাণে অচেতন ছিল শম্বরারি।
চেতন পাইল বীর পরশিতে হরি।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন প্রদ্যুম্নে চাহিয়া।
রণে ভঙ্গ দিলে তুমি মম পুত্র হৈয়া।।
শুন রে পামর পুত্র তুমি কুলাধম।
তোমা হৈতে কলঙ্ক হইল অনুপম।।
প্রাণভয়ে পলাইলি ত্যজিয়া সংগ্রাম।
কিসের কারণে হেন রাখহ পরাণ।।
আমার সম্মুখে গেলে করি অহঙ্কার।
রণে ভঙ্গ অপযশ ঘুষিবে সংহার।।
ইহা যদি নারায়ণ কহিলেন ক্রোধে।
অধোমুখে রহে কাম মনের বিষাদে।।
পুত্র-অপমান দেখি দুঃখিতা রুক্মিণী।
চিন্তিত হইলেন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।।
অর্জ্জুন আসিয়া তবে প্রদ্যুম্নে তুলিল।
এ কর্ম্ম উচিত নহে, কৃষ্ণকে কহিল।।
যুদ্ধে জয় পরাজয় আছে সবাকার।
আপনি জানহ কৃষ্ণ সংসারের সার।।
গরুড়ে চাপিয়া তবে গেলেন শ্রীহরি।
প্রবেশ করেন রণে গদা চক্র ধরি।।
কৃষ্ণে হেরি হরষিত হৈল দৈত্যপতি।
নানা অস্ত্র লয়ে যুঝে কৃষ্ণের সংহতি।।
শত শত বাণ দৈত্য কৈল অবতার।
চক্রে নাশিলেন তাহা দেবকী-কুমার।।
তবে গদা সন্ধান পূরিল নারায়ণ।
প্রাণভয়ে পলাইল দৈত্য-সেনাগণ।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখিয়া কুপিল দৈত্যেশ্বর।
ধনু ধরি যুদ্ধ করে কৃষ্ণের গোচর।।
অপার মহিমা কৃষ্ণের জানে কোন্ জন।
দৈত্যসহ করিলেন ঘোরতর রণ।।
দৈত্যশরে জর্জ্জরিত হয়ে দেব হরি।
রহিতে না পারিলেন গরুড় উপরি।।
জর্জ্জর হইল বাণে বিনতা-নন্দন।
দৈত্যশরে কাতর অত্যন্ত নারায়ণ।।
ক্রোধে অনুশাল্ব দৈত্য গদা লয়ে হাতে।
সক্রোধে মারিল গদা গরুড়ের মাথে।।
মোহ গেল, পক্ষীরাজ পলায় সত্বরে।
কৃষ্ণেরে লইয়া গেল ধর্ম্মের গোচরে।।
অচেতন নারায়ণ গরুড় উপরে।
তা দেখি জন্মিল ভয় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
চিন্তাকুল হৈল বড় পাণ্ডবের গণ।
রণে ভঙ্গ দিয়া আইলেন নারায়ণ।।
এই অমঙ্গল কথা শুনিয়া রুক্মিণী।
কৃষ্ণের সম্মুখে আসি কহে প্রিয়বাণী।।
বুঝিতে পরের দুঃখ কেহ নাহি জানে।
ফলিল আপন অঙ্গে, জ্ঞান হয় মনে।।
যুদ্ধ করি কামদেব হৈল হীনবল।
পলাইল সারথি, পাইলে তুমি ছল।।
চরণ-প্রহারে তারে কৈলে অপমান।
তুমি কেন ভয়ে ভঙ্গ দিলে ভগবান।।
দৈত্য-যুদ্ধ সহিবারে না পারিলে তুমি।
প্রদ্যুম্নে মারিলে লাথি, কি বলিব আমি।।
ঈষৎ হাসেন কৃষ্ণ রুক্মিণী-বচনে।
হেনকালে ভীমসেন কহে নারায়ণে।।
মোর এক নিবেদন শুন চক্রপাণি।
হাসিয়া কলঙ্ক ঘুচাইতে চাহ তুমি।।
না বুঝিয়া প্রদ্যুম্নে করিলে তিরস্কার।
রণভঙ্গ-কথা আমি শুনিনু তোমার।।
তবে যুধিষ্ঠির রাজা ব্যাসে জিজ্ঞাসিল।
দৈত্য-যুদ্ধে নারায়ণ কেন ভঙ্গ দিল।।
ব্যাস বলিলেন, শুন ধর্ম্মের নন্দন।
অনন্ত-মহিমা কৃষ্ণ, বুঝে কোন জন।।
ব্রাহ্মণের বাক্য কৃষ্ণ সত্য করিবারে।
রণে ভঙ্গ দিয়া যান পুরীর ভিতরে।।
গর্গমুনি অভিশাপ দিল নারায়ণে।
অপমান পাবে তুমি অনুশাল্ব-রণে।।
সে কারণে রণে ভঙ্গ দিলেন শ্রীহরি।
শুন রাজা, তোমারে কহিনু সত্য করি।।
নহে কি কৃষ্ণের ভঙ্গ আছয়ে সংগ্রামে।
উৎপত্তি প্রলয় হয় যাঁহার বচনে।।
যন্ত্রের আকার প্রাণী, শুনহ রাজন।
বেদশাস্ত্রে বাখানিল যন্ত্রী নারায়ণ।।
ব্যাসের বচনে তাঁর বিস্ময় ঘুচিল।
দৈত্য-সিংহনাদে মনে ভয় উপজিল।।
হেনকালে বৃষকেতু রাজার সাক্ষাতে।
অহঙ্কার করি বীর বলে যোড়হাতে।।
আজ্ঞা দেহ, যাব আমি করিতে সমর।
দৈত্যকে বান্ধিয়া আনি তোমার গোচর।।
কৃষ্ণের প্রসাদে আমি জিনিব সমর।
ভয় নাই,আজ্ঞা দেহ, শুন নৃপবর।।
দৈত্য-সিংহনাদ আর না পারি সহিতে।
আজ্ঞা দেহ, যাই আমি সংগ্রাম করিতে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন বাছাধন।
তোমারে পাঠাই, হেন নাহি লয় মন।।
রণে ভঙ্গ দিল যবে স্বয়ং যদুপতি।
কিমতে জিনিবে তুমি সে দুষ্ট দুর্ম্মতি।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব কামদেব আর।
না পারিল সহিবারে পরাক্রম যার।।
তুমি শিশু হয়ে যুদ্ধ করিবে কেমনে।
তাই বৃষকেতু আমি ভয় পাই মনে।।
কর্ণশোক পাসরিনু তোমাকে দেখিয়া।
সমরে নাহিক কাজ থাকহ বসিয়া।।
বৃষকেতু বলে, মোর ভয় নাহি মনে।
আজ্ঞা দেহ, যুদ্ধ আমি করি তার সনে।।
তবে অনুমতি দেন রাজা যুধিষ্ঠির।
ধনুর্ব্বাণ হাতে করে যান মহাবীর।।
সিংহনাদ করি সাজে বীর বৃষকেতু।
গোবিন্দে প্রণমি চলে যুঝিবারে হেতু।।
ধর্ম্মরাজে প্রণমিল আর চারি জনে।
সিংহনাদ করি বীর প্রবেশিল রণে।।
ধনুর্ব্বাণ হাতে করি কর্ণের কুমার।
দৈত্যের সম্মুখে বীর বলে মার মার।।
শত শত বাণ বীর এড়ে একবারে।
অগ্নি হেন বাণ বিন্ধে দৈত্যের শরীরে।।
বাণে বাণ নিবারিল দৈত্য-মহামতি।
হেনমতে দোঁহে কৈল অনেক শকতি।।
তবে বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।
হৃদয়ে ভাবনা কৈল অভয়-চরণ।।
কৃষ্ণপদ ধ্যান করি যুড়িলেক শর।
বাণাঘাতে মূর্চ্ছাপন্ন দৈত্যের ঈশ্বর।।
মূর্চ্ছাগত অনুশাল্ব হরিল চেতন।
ধাইয়া ধরিল তারে কর্ণের নন্দন।।
অনুশাল্ব দৈত্যেশ্বরে ধরিয়া ত্বরিতে।
আনিয়া দিলেক শীঘ্র ধর্ম্মের অগ্রেতে।।
ধন্য ধন্য বৃষকেতু করিয়া বাখান।
ধর্ম্মপুত্র দেন তারে আলিঙ্গন দান।।
যুদ্ধেতে রাখিলে তুমি আপনার যশ।
বৃষকেতু-গুণে কৃষ্ণ হিইলেন বশ।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব প্রীতি পায় মনে।
আলিঙ্গন দিল সবে কর্ণের নন্দনে।।
তবে অনুশাল্ব দৈত্য পাইল চেতন।
মায়া ঘুচাইল তার কমললোচন।।
দিব্যজ্ঞান দেন তবে দৈত্যের ঈশ্বরে।
কৃষ্ণে দেখি দৈত্যরাজ দণ্ডবৎ করে।।
প্রণমিয়া কহে দৈত্য যোড় করি হাত।
প্রসন্ন হইবে মোরে দেব জগন্নাথ।।
ধন্য ধন্য বৃষকেতু কর্ণের নন্দন।
বান্ধিয়া আনিল মোরে করিয়া যতন।।
সে কারণে দেখিলাম চরণ তোমার।
সফল হইল জন্ম আজি যে আমার।।
যে চরণ হইতে আইল ভাগীরথী।
যে চরণ পরশে সানন্দা বসুমতী।।
যে চরণ সতত ভাবয়ে যোগিগণ।
সে পদ দেখিনু, মোর সফল জীবন।।
ধন্য যুধিষ্ঠির তুমি ধর্ম্মের কুমার।
কৃষ্ণ দরশন পাই মিলনে তোমার।।
আমার অনেক ভাগ্য জন্মে জন্মে ছিল।
সে কারণে কৃষ্ণ-পাদপদ্ম দেখা গেল।।
মদে মত্ত হৈয়া আমি করিলাম রণ।
অপরাধ না লইবে ধর্ম্মের নন্দন।।
তুমি দোষ ক্ষমা কৈলে আর নাহি ভয়।
প্রসন্ন হবেন মোরে কৃষ্ণ মহাশয়।।
দৈত্যের বচনে কহিছেন ধর্ম্মরাজ।
শুন দৈত্য ক্ষমিলাম তোমার অকাজ।।
এত বলি প্রসাদ দিলেন নরপতি।
ধর্ম্মরাজে দৈত্যরাজ করিল প্রণতি।।
দৈত্যকে কহেন ধর্ম্ম মধুর বচনে।
বিদায় দিলাম আমি, যাহ নিকেতনে।।
তবে অনুশাল্ব বলে করি যোড়হাত।
দেশে না যাইব আমি পাণ্ডবের নাথ।।
থাকিব তোমার সঙ্গে হস্তিনা নগরে।
সতত দেখিতে পাব দেব গদাধরে।।
রাজ্য ধনে মম কিছু নাহি প্রয়োজন।
আজ্ঞা কর, কি করিব ধর্ম্মের নন্দন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন দৈত্যেশ্বর।
অর্জ্জুন সহিত তুমি যাইবে সত্বর।।
রাখিবে যজ্ঞের ঘোড়া করিয়া শকতি।
এই ভার তোমারে দিলাম দৈত্যপতি।।
তুমি আর যুবনাশ্ব অর্জ্জুন সহিত।
রাখিবে যজ্ঞের ঘোড়া হয়ে অবহিত।।
তাহা শুনি অনুশাল্ব আনন্দিত মন।
নিজ সৈন্য আনিলেক করিয়া সাজন।।
অশ্ব রাখিবারে দৈত্য কৈল অঙ্গীকার।
তাহা শুনি প্রীতি পান ধর্ম্মের কুমার।।
এই বিবরণ কহি তোমার গোচর।
আর কি শুনিতে ইচ্ছা, কহ নৃপবর।।
ভারতে অমৃত-কথা আনন্দ লহরী।
কাশী কহে, শুন যদি যাবে ভবে তরি।।
১০. অশ্বমেধ যজ্ঞের উদ্‌যোগ
জন্মেজয় কহিলেন কহ মহামুনি।
যজ্ঞের আরম্ভ কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।।
অর্জ্জুন গেলেন যদি অশ্ব রাখিবারে।
ভ্রমণ করিল ঘোড়া পৃথিবী ভিতরে।।
ধরিয়া রাখিল ঘোড়া কোন্ বলবান।
কার সহ কি প্রকার সংগ্রাম বিধান।।
আমাকে সে সব কথা কহ তপোধন।
তোমার প্রসাদে শুনি পূর্ব্ব বিবরণ।।
বলেন বৈশম্পায়ণ শুন জন্মেজয়।
অশ্ববেধ শ্রবণেতে পাপ নষ্ট হয়।।
বলিলেন ব্যাস তবে ধর্ম্মরাজ প্রতি।
মুনি ঋষি আমন্ত্রিয়া আন শীঘ্রগতি।।
আরম্ভ করহ যজ্ঞ মধূ পূর্ণিমাতে।
যজ্ঞের সামগ্রী তুমি আনহ ত্বরিতে।।
ব্যাসের বচনে রাজা ভীমে পাঠাইয়া।
ঋষি মুনি ব্রাহ্মণেরে অনেন ধরিয়া।।
পাণ্ডবের আমন্ত্রণ প্রাপ্তে মুনিগণ।
হস্তিনানগরে আসি দিল দরশন।।
পাদ্য অর্ঘ্যে যুধিষ্ঠির করিয়া পূজন।।
বসিলেন যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে স্মরিয়া।
ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল লইয়া।।
অনুচরে আয়োজন সব যোগাইল।
যজ্ঞের মণ্ডপে যব যতনে থুইল।।
বেদের বিধানে মঞ্চ করিল নির্ম্মাণ।
আশী হাত গর্ত্ত সেই সুন্দর গঠন।।
শাস্ত্রমত কুণ্ড শত হাত পরিসর।
নির্ম্মাইল যজ্ঞবেদী পরম সুন্দর।।
সুবর্ণ রচিত ঘট অরোপিল তাতে।
পুষ্পঝারা বান্ধিল চান্দোয়া চারিভিতে।।
দ্রৌপদীর সহিত ধর্ম্মরাজ করি স্নান।
করিলেন দোঁহে শুক্লবস্ত্র পরিধান।।
বেদধ্বনি করিলেন সর্ব্ব মুনিগণ।
ধৌম্য পুরোহিত করে বেদ উচ্চারণ।।
সঙ্কল্প করেন শুভক্ষণে নরপতি।
তবে ব্যাসদেব নৃপে দেন অনুমতি।।
ব্রাহ্মণ বরণ কর বসন ভূষণে।
ত্বরায় আনহ অশ্ব যজ্ঞ সন্নিধানে।।
ব্যাসের বচনে রাজা সানন্দ হইয়া।
আনাইল তুরঙ্গকে যজ্ঞে সাজাইয়া।।
আসন বসন সব কনকে রচিত।
সুবর্ণের থালি ঝারি মণিতে খচিত।।
বিংশতি সহস্র বিপ্রে করিছে বরণ।
প্রত্যক্ষ সবারে দেন আসন ভূষণ।।
বরণ পাইয়া চিত্তে আনন্দিত মনে।
বসিল সকল দ্বিজ যজ্ঞ আরম্ভনে।।
দ্রৌপদী সহিত ব্রতী হইল রাজন।
মধুপূর্ণিমাতে হৈল যজ্ঞ আরম্ভন।।
সর্ব্ব সুলক্ষণ ঘোড়া আনিয়া সত্বর।
প্রক্ষালেন দুই পদ ধর্ম্ম নরবর।।
কুসুম চন্দনে ঘোড়া করিল ভূষণ।
বান্ধিলেন অশ্বভালে সুবর্ণ দর্পন।।
যুধিষ্ঠির নিজ নাম লিখেন দর্পণে।
পৃথিবী ভ্রমিবে ঘোড়া আপনার মনে।।
যদি কেহ বীর থাকে পৃথিবী ভিতরে।
ধরিলে যজ্ঞের ঘোড়া জিনিব তাহারে।।
নিজ বলে ছাড়াইয়া তুরগ আনিব।
তবে অশ্বমেধ যজ্ঞে সঙ্কল্প করিব।।
অশ্বভালে দর্পণেতে এ সব লিখিল।
ঘোটক অঙ্গেতে নানা অলঙ্কার দিল।।
কুন্তী আর গান্ধারী প্রভৃতি যত নারী।
হুলাহুলি মঙ্গল করিল আগুসরি।।
সত্যভামা আমি যত কৃষ্ণের রমণী।
মঙ্গল বিধানে অশ্ব পূজিল তখনি।।
ধনঞ্জয়ে ডাকিয়া বলিল নরবর।
অশ্ব রক্ষা হেতু ভাই সাজহ সত্বর।।
আমি ব্রতী হইয়া রহিব যজ্ঞস্থানে।
দিবানিশি দ্রৌপদী সহিত একাসনে।।
অসিপত্র ব্রত আচরণে দিব মন।
যতনে করিও ভাই ঘোটক রক্ষণ।।
অশ্ব চুরি হৈলে যজ্ঞ সাঙ্গ নাহি হবে।
ব্রত নস্ট হবে আর কলঙ্ক রটিবে।।
শুনিয়াছি মুনি মুখে এ সব কথন।
অশ্বহারা হয়ে দুঃখ পায় কত জন।।
যতনে রাখিবে অশ্ব বীর ধনঞ্জয়।
পৃথিবী ভ্রমিলে ঘোড়া কার্য্য সিদ্ধি হয়।।
নকুল থাকিবে মাত্র আমার সংহতি।
সঙ্গেতে লইয়া যাও যত সেনাপতি।।
খাণ্ডব দহিয়া তুমি তুষিলে অনলে।
নিবাত কবচ বিনাশিলে বাহুবলে।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্বে করিলে অপমান।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ সহ করিলে সংগ্রাম।।
অর্জ্জুন বলেন রাজা চিন্ত অকারণে।
আমারে জিনিতে বীর নাহি ত্রিভুবনে।।
পৃথিবী ভ্রমিয়া আমি তুরঙ্গ আনিব।
যদি কেহ ঘোড়া ধরে তারে বিনাশিব।।
কৃষ্ণের প্রসাদে ভয় না করি কাহারে।
কহিলাম সত্য আমি সবার গোচরে।।
এত বলি ধনঞ্জয় হইল বিদায়।
ঋষি মুনিগণ দিল জয়ধ্বনি তায়।।
অশ্ব পিছে ধনঞ্জয় করেন প্রয়াণ।
বাজায় দামামা তেরি খমক নিশান।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন ভীম মহাবীরে।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যাও অশ্ব রাখিবারে।।
প্রদ্যুন্নকে ডাকিয়া বলিল নারায়ণ।
অশ্ব রাখিবারে পুত্র করহ গমন।।
কৃতবর্ম্মা সাত্যকি যতেক ধনুর্দ্ধর।
গদা শাম্ব সঙ্গে লয়ে চলহ সত্বর।।
রাখিও তুরগ সবে মন্ত্রণা করিয়া।
যুঝিও সমর মধ্যে সাবধান হৈয়া।।
এত বলি প্রত্যেকেরে করিলা বিদায়।
প্রণমিয়া নারায়ণে সব সৈন্য যায়।।
যুবনাশ্ব অনুশাল্ব সুবেগ কুমার।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যান অশ্ব রাখিবার।।
বৃষকেতু বীর আদি কর্ণের নন্দন।
অনেকে অশ্বের সঙ্গে করিল গমন।।
দৈবযোগে তুরঙ্গ চলিল শুভক্ষণে।
প্রথমে যজ্ঞের ঘোড়া চলিল দক্ষিণে।।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে ভবরারি।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র