শ্রীমদ্ভগবত গীতা প্রথম অধ্যায়

শ্রীমদ্ভগবত গীতা প্রথম অধ্যায়-বিষাদযোগ

|ধৃতরাষ্ট্র উবাচ|
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবাঃ ।
মামকাঃ পান্ডবশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়ঃ ।।১।।
অর্থ : ধৃতরাষ্ট্র বললেন- হে সঞ্জয়! যুদ্ধাভিলাষী আমার পুত্রগণ এবং পান্ড্রুপুত্রগণ পূণ্যক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেত হয়ে কি করলেন?
|সঞ্জয় উবাচ|
দৃষ্ট্বা তু পান্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা ।
আচার্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২।।
অর্থ : সঞ্জয় বললেন-তখন রাজা দুর্যোধন দেখলেন, পান্ডব সৈন্যদল ব্যুহের আকারে সজ্জিত। তখন তিনি আচার্য দ্রোণের নিকটে গিয়ে বললেন
পশ্যৈতাং পান্ডুপুত্রাণামাচার্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা ।।৩।।
অর্থ : হে আচার্য, দ্রুপদপুত্র আপনার বুদ্ধিমান শিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন এই ব্যুহ রচনা করেছেন। আপনি পান্ডবগণের এই বিশাল সৈন্যসমাবেশ দেখুন।
অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জুনসমা যুধি ।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ ।।৪।।
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীর্যবান ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গব:।। ৫।।
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব এব মহারথাঃ।।৬।।
অর্থ : দুর্যোধন বললেন-এখানে এই সেনাবাহিনীর মধ্যে পান্ডবপক্ষীয় শ্রেষ্ঠ বীরগণকে দেখতে পাবেন-এই সেনাবাহিনীতে যুদ্ধে ভীমার্জুনের সমান মহাধনুর্ধর বহু বীর আছেন-সাত্যকি, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্যশালী কাশীরাজ, কুন্তিভোজ, পুরুজিত, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, পরাক্রান্ত উত্তমৌজা, সুভদ্রারপুত্র অভিমন্যু, ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ এঁরা সকলেই মহাযোদ্ধা।
অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭।।
অর্থ : হে বিপ্রবর, আমার সৈন্যবাহিনীতেও যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন, তাদের নামও জেনে রাখুন। আপনার অবগতির জন্য বলছি।
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তিস্তথৈব চ।।৮।।
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতা।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্বে যুদ্ধবিশারদাঃ ।। ৯ ।।
অর্থ : সমর বিজয়ী আপনি আছেন, ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র এবং জযদ্রথ এঁরা সকলেই যুদ্ধবিজয়ী এঁরাও আছেন। তাছাড়া, আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত এমন আরও অনেক বীর আছেন-তাঁরা সকলেই সমর-কুশলী।
অপর্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ।। ১০ ।।
অর্থ : হে আচার্য! পিতামহ ভীষ্ম কর্তৃক সুরক্ষিত আমাদের সৈন্যবল অপরিমিত অর্থাৎ জয়লাভে সক্ষম।
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব এব হি ।। ১১ ।।
অর্থ : এখন আমাদের সকলের কর্তব্য ভীষ্মকে রক্ষাকরা । সৈন্যবাহিনীর ব্যুহ প্রবেশের দ্বারে দাঁড়িয়ে থেকে আপনারা সকলেই ভীষ্মকে রক্ষা করুন।
তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ।।১২।।
অর্থ :দূর্যোধেনর হৃদয় আনন্দ সৃষ্টি করে প্রতাপশালী কৃরুকুলের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম সিংহনাদের সঙ্গে শংখ-ধ্বনি করেন।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্ষশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যস্ত স শব্দস্তুমুলোহভব।। ১৩ ।
অর্থ : তারপর সেই রণক্ষেত্রে অসংখ্য শংখ, ভেরী , মৃদ্ঙ্গ, ঢাক ও রণশিঙ্গা একসঙ্গে বেজে উঠলো। সেই শব্দ হয়ে উঠলে ভীষণ।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ।
মাধবঃ পান্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদ্ধমতুঃ ।। ১৪ ।।
অর্থ : তখন শ্বেতাশ্বযুক্ত বৃহত রথে উপবিষ্ট কৃষ্ণ ও অর্জুন তাদের দিব্যশঙ্খ দুটো বাজালেন।
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনংজয়ঃ ।
পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকোদরঃ ।। ১৫ ।।
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ ।। ১৬ ।।
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ ।। ১৭ ।।
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্বশঃ পৃথিবীপতে ।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মু: পৃথক্ পৃথক্ ।। ১৮ ।।
অর্থ : শ্রীকুষ্ণ বাজালেন তার পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অর্জুনও বাজালেন তাঁর দেবদত্ত নামক শঙ্খ, ভীমকর্মা ভীমও তাঁর শঙ্খ বাজালেন- পৌন্ড্র তার নাম।১৫। কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির জাজালেন তাঁর অনন্তবিচয় নামক শঙ্গ, নকুল আর সহদেবও শঙ্খ বাজালেন-তাদের শঙ্খের নাম সুঘোষ আর মণিপুষ্পক।১৬। হে রাজন! মহাধনূর্ধর কাশীরাজ, মহাবীর শিখন্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন, রাজা বিরাট, অপরাজিত সত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং মহাবীর অভিমন্যূ - সকলেই সকল দিক থেকে পৃথকভাবে নিজের নিজের শঙ্খ বাজালেন।১৭-১৮।
স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ ।
নভশ্চ পৃথিবীং চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ ।। ১৯ ।।
অর্থ : সেই ভয়ঙ্কর শব্দ আকাশ ও পৃথীবিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হৃদয় বির্দীর্ণ করে দিল।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পান্ডুবঃ ।।২০।।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত ।।২১।।
অর্থ : হে রাজন! অর্জুনের রথে বনর চি্হ্নিত পতাকা। সেই রথে আরুঢ় হয়ে তিনি দেখলেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তত। তিনি তখন অসআত্র চালনায় প্রবৃত্ত হয়ে ধনুক তুলে শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বললেন।
|অর্জুন উবাচ|
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মি রণসমুদ্যমে ।। ২২।।
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ ।। ২৩ ।।
অর্থ : অর্জুন বললেন-হে শ্রীকৃষ্ণ, দুই সেনাদলের মধ্যে আমার রথ স্থাপন করুন-আমি ততক্ষণ যুদ্ধ কামনরায় যাঁরা উপস্থিত হয়েছেন তাদেঁর দেখি, এই যুদ্ধে কাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, দুষ্টবুদ্ধি দুর্যোধনের হিতৈষী যাঁরা এখানে উপস্থিত -সেই সব যুদ্ধলিপ্সুকেও আমি দেখি।
|সঞ্জয় উবাচ|
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত ।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্য স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্ ।। ২৪ ।।
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্বেষাং চ মহীক্ষিতাম ।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি ।। ২৫ ।।
অর্থ :সঞ্জয় বলণেন হে ধৃতরাষ্ট্র, অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বললেন তখন দুই সেনদলের মধ্যে এবং ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য নরপতির সামনে সেই শ্রেষ্ঠ রথ স্থাপন করলেন। তারপর তিনি অর্জুনকে বললেন-র্পাথ , যুদ্ধের জন্য উপস্থিত এই কৌরবদের তুমি দেখ।
তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহান্ ।
আচার্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা ।
শ্বশুরান সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি ।।২৬।।
অর্থ : তিনি দেখলেন, পিতৃব্য, পিতামহ, আচার্য, মাতুল,শ্বশুর, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র ও বন্ধুগণকে-সকলেই এসেছেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্বান্ বন্ধুনবস্থিতান্ ।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ ।।২৭।।
অর্থ : সেই সমম্ত বন্ধুজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত দেখে গভীর করুণায় আর্জুনের হৃদয় অভিভূত হল। তিনি দু:খ করতে করতে এই কথা বললেন।
|অর্জুন উবাচ|
দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখং চ পরিশুষ্যতি ।।২৮।।
অর্থ : অর্জুন বললেন- যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন-তাঁরা সবাই আমার স্বজন, সবাই আত্মীয়। কিন্তু এঁদের যুদ্ধাভিলাষী দেখে আমার দেহ অবসান হচ্ছে, মুখও শুকিয়ে যাচ্ছে।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে ।
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব্ পরিদহ্যতে ।।২৯।।
অর্থ : অর্থ : অর্জুন বললেন- আমার দেহ কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হচ্ছে, আমার হাত থেকে গান্ডীব খসে পড়ে যাচ্ছে এবং চর্মে এক জ্বালা অনুভব করছি।
ন চ শক্নোম্যব্স্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব ।।৩০।।
অর্থ : হে কৃষ্ণ! আমি আর স্থির থাকতে পারছি না-আমার মন যেন চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি অশুভ লক্ষণ সব দেখতে পাচ্ছি।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে ।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ।।৩১।।
অর্থ : অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ! যুদ্ধে আত্মীয় বধ করে কোন্ মঙ্গল হবে তা আমি বুঝতে পারছিনা। আমি যুদ্ধে জয়লাভ করতে চাই না, রাজ্য বা সুখ ভোগও কামনা করিনা
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ ।।৩২।।
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্যা: পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ ।।৩৩।।
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন ।।৩৪।।
অর্থ :হে কৃষ্ণ! রাজ্যভোগ একা কেউ করে না, যাদের জন্য রাজ্য ভোগ- সুখ কামনা করে সেই সব আচার্য ,পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র শ্যালক ও কুটুম্বগণ অর্থ ও প্রানের মায়া বিসর্জন দিয়ে এখানে যুদ্ধকরতে উপস্থিত হয়েছে। তখন আমাদের রাজ্যে কি কাজ? ভোগসুখ বা জীবনেই বআ কি প্রয়োজন? এরা আমাকে বধ করতে চাইলেও আমি এদের বধ করতে পারবো না।
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন ।।৩৫।।
অর্থ : হে কৃষ্ণ! দুর্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে বধ করলে আমাদের কি সুখ হবে? এরা আততায়ী হলেও এদের বধে আমাদের পাপই আশ্রয় করবে।
পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ।। ৩৬।।
অর্থ : সুতরাং ধৃতরাষ্ট্রেরপুত্রগণ এবং তাদের বান্ধবদের হত্যা করা আমাদের উচিত নয়। হে মাধব! স্বজনদের বধ করে আমরা কিভাবে সুখী হব?
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ ।। ৩৭ ।।
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্তিতুম ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দন ।। ৩৮ ।।
অর্থ : যাঁরা যুদ্ধে এসেছেন তাঁদের হৃদয় লোভে কলুষিত। তাই তাঁরা কুলক্ষয়জনিত এবং মিত্রক্ষয়জনিত পাপের কথা ভাবছেন না। কিন্তু আমরা কুলক্ষয়জনিতপাপ উপলব্ধি করছি-আমরা কেন এই পাপ থেকে নিবৃত্ত থাকতে পারবো না।
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্মাঃ সনাতনাঃ ।
ধর্মে নষ্টে কুলং কৃত্স্নমধর্মোহভিভবত্যুত ।। ৩৯ ।।
অর্থ : বংশ যদি নষ্ট হয় তবে সনাতন কুল ধর্মও নষ্ট হয় কারণ ধর্মের কোন অনুষ্ঠাতা থাকে না। এভাবে কুলধর্ম লুপ্ত হলে (অনাচাররুপী) অধর্ম এসে সেই বংশকে গ্রাস করে।
অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ ।। ৪০ ।।
অর্থ : হে কৃষ্ণ! কুলস্ত্রীগণ অসচ্চরিত্রা হলে অধর্মের প্রভাবে আর নারীগণ ব্যাভিচারিণী হলে বর্ণ সঙ্করের উৎপত্তি হয়।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ ।। ৪১ ।।
অর্থ : যদি কুলের মিশ্রণ ঘটে, কুলনাশকগণ নরকবাসী হন এবং শ্রাদ্ধ ও তর্পণ ক্রিয়া লুপ্ত হওয়ায় তাঁদের পিতৃপুরুষগণও নরকে গমন করেন-তাঁদের সদ্গতি হয় না। বৈধ সন্তানের অভাবে এঁদের পিন্ডের অভাব ঘটে।
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ ।
উৎসাদ্যুন্তে জাতিধর্মাঃ কুলধর্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ।। ৪২ ।।
অর্থ : যারা বর্ণসঙ্কর সৃষ্টি করে তাদের দোষে সকল ধর্মই লুপ্ত হয়-জাতিধর্ম, কুলধর্ম ও আশ্রমধর্ম।
উৎন্নকুলধর্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন ।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ।। ৪৩ ।।
অর্থ :যারা কুলধর্ম বর্ণধর্ম ও আশ্রম ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট, তাদের অদৃষ্টে অনন্ত নরকবাস একথা আমি (শাস্ত্র থেকে জেনেছি ও আচার্যের মুখে) শুনেছি।
অহো বত মহৎ পাপং কর্তুং ব্যবসিতা বয়ম্ ।
যদ্ রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ।। ৪৪ ।।
অর্থ :হায়! আমরা কি মহাপাপে প্রবৃত্ত হয়েছি, যেহেতু আমরা রাজ্যসুখের লোভে স্বজন বধে উদ্যত।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ।। ৪৫ ।।
অর্থ : আমি অস্ত্র ত্যাগ করবো, আত্মরক্ষা কোন ব্যবস্থাই করব না, এই অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা যদি আমাকে বধ করে, তাকেও আমি মঙ্গল বলে জানবো। |সঞ্জয় উবাচ|
এবমুক্ত্বার্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ ।। ৪৬ ।।
অর্থ : সঞ্জয় বললেন- অর্জুন এই কথা বলে শোকবিহ্বল চিত্তে ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের উপরে বসে রইলেন।

গীতার শ্লোকের ব্যাখ্যা: ব্যাখ্যা(১) : ধৃতরাষ্ট্র তার সচিব সঞ্জয়ের কাছে জানতে চাচ্ছেন কুরুক্ষেত্র অর্থাৎ ধর্মক্ষেত্রে তার পুত্ররা ও পান্ডবেরা সমবেত হয়ে যুদ্ধ করার জন্য কি করছে। কারণ ধৃতরাষ্ট্র জন্ম অন্ধ ছিলেন। সঞ্জয় তার গুরুদেব ব্যাসদেবের কৃপায় দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টি লাভ করে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমস্ত ঘটনাবলি ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করতেন। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করতে চেয়েছিলেন কিন্ত তিনি গ্রহণ করেননি। তার কারণ সম্ভবত পুত্রের পরাজয় তিনি দেখতে চাননি। প্রশ্ন হচ্ছে সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টি প্রদান বিষয়ে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন এবং তার ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করেন। তবে গীতায় কোথাও সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্তির উল্লেখ নেই। এমনকি অষ্টাদশ অধ্যায়ের ১৮/৭৫ শ্লোকে সঞ্জয়ের বর্ণনা থেকে উপলদ্ধি করা যায় তিনি স্বয়ং সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ হতে পরমগুহ্য যোগ শ্রবণ করেছিলেন। তবে ব্যাসদেব তার শিষ্য সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টির বর দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র একটি প্রধান তীর্থস্থান। এর আরেক নাম সমন্তপঞ্চক। পরশুরাম ক্ষত্রিয়দের বিনাশের পর এ তীর্থস্থানে রুধির তর্পণ করেছিলেন। ব্যাখ্যা(২) : সঞ্জয় বললেন, পান্ডব সৈন্যগণ ব্যুহাকারে সজ্জিত হয়েছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে এ কথাগুলো বললেন। এখানে দ্রোণাচার্যকে “আচার্য” বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আচার্য তাকে বলা হয় যারা বৃদ্ধ, অলোভী, আত্মবান, দম্ভহীন, সম্যক, শিক্ষিত, সরলচেতা। তিনি নিজে আচার পালন করেন এবং অন্যকে আচার পালনে উদ্বদ্ধু করেন। ব্যাখ্যা (৩-৬) : শ্লোকে যে সকল বীর ধনুর্ধারীদের কথা বলা হয়েছে তারা সকলেই মহারথা। এখানে মহারথা তাকেই বলা যে এককভাবে দশ হাজার ধনুর্ধারীর সাথে যুদ্ধ করতে পারেন। নরপুঙ্গব অর্থে এখানে বৃষকে বুঝানো হয়েছে। ঐ সময় অনেকে বৃষে আরোহণ করে যুদ্ধ করতেন। ব্যাখ্যা (৭-১১) : দুর্যোধন তাদের ও পান্ডবদের সৈন্য সজ্জা বিষয়ে আচার্য দ্রোণকে অবহিত করছিলেন। দুর্যোধনের দৃষ্টিতে পান্ডবদের সৈন্য সংখ্যা তাদের চেয়ে বেশী এবং তারা এক এক জন মহারথা। পক্ষান্তরে ভীষ্নের দ্বারা রক্ষিত তাদের সৈন্য সংখ্যা পরিমিত। দুর্যোধনের এ আশংকার কারণ এই যে, শিখন্ডীর হাতে ভীষ্মের মুত্যু আর সে জন্যেই দুর্যোধন ভীষ্মকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার জন্য তাদের সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছেন। ব্যাখ্যা (১২-১৯): তখনকার সময় সম্মুখ সমরে যুদ্ধ হতো। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কখন যুদ্ধ হতো না। ফলে উভয় পক্ষই সমর সজ্জা পরিদর্শন করার সুযোগ পেতেন। আর এ সুযোগটি অর্জুন কাজে লাগিয়েছেন। যুদ্ধের প্রস্তুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হতো। এগুলি ব্যবহৃত হতো সৈন্যদের উৎসাহ দেয়ার জন্য। বিপক্ষীয় দলের মধ্যে ভীতি বা ভয় সৃষ্টি করার জন্য প্রত্যেক পক্ষের প্রধান প্রধান যুদ্ধবিশারদগণ নিজ নিজ শঙ্খ বাজাতেন। শঙ্খগুলির নির্দিষ্ট নাম ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চজন নামক অসুরকে বধ করে তার অস্থি দ্বারা পঞ্চজন নামক শঙ্খ তৈরি করা হয়েছিল। আর এ সকল শঙ্খের ধ্বনি ছিল সিংহের গর্জনের মতো। ব্যাখ্যা (২০-২৫): শ্লোকগুলিতে আমার ‘কপিধ্বজ’ ‘হৃষীকেশ’ ‘গুড়াকেশ’ ‘অচ্যুত’ ‘পরন্তপ’ এ শব্দগুলির প্রয়োগ দেখতে পাই। প্রতিটি শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের জানা দরকার। কারণ গীতার প্রকৃত অর্থ হৃদঙ্গম করতে না পারলে নিজে যেমন রস আস্বাদন করা যাবে না তেমনি শ্রুতাদেরকে গীতার প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে না। এখানে ‘কপিধ্বজ’ অর্থ হচ্ছে হনুমান অর্থাৎ অর্জুনের রথে হনুমান বসতেন। সে জন্যেই এ নামকরণ। হৃষীকেশ-এর অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের অধিশ্বর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে তা বুঝানো হয়েছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণকে অচ্যুত বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অচ্যুত এর অর্থ হচ্ছে অভ্রষ্ট বা অপতিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনও ভ্রষ্ট হন না। তিনি অভ্রষ্ট। আর গুড়াকেশ-এর অর্থ হচ্ছে নিদ্রাজয়ী। অর্জুন নিদ্রাকে জয় করেছেন। অর্জুন নিদ্রা ও আলস্য পরিত্যাগ করে কঠোর পরিশ্রম করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। অর্জুনকে পরন্তপ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পরন্তপ-এর অর্থ হচ্ছে যিনি শক্রকে বিনাশ করেন। এখন অর্জুন যদি বলেন তিনি যুদ্ধ করবেন না। তাহলে এটা হবে গুড়াকেশ শব্দের পরিপন্থী। ব্যাখ্যা (২৬-৩৬): অর্জুন কুরুক্ষেত্রের ময়দানে আত্মীয়স্বজন সকলকে যুদ্ধ করার মানসে দেখতে পেলেন। তা দর্শন করে তার হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হলো। যুদ্ধে আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হলে তার পাপ হবে এটা মনে করা অর্জুনের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। স্বজনের মৃত্যুই তার দুঃখের প্রধান কারণ। আত্মীয়স্বজনের সাথে যে তার যুদ্ধ করতে হবে এটা অর্জুনে নিশ্চিয় জানা ছিল। দেহাত্মবোধ তাকে যুদ্ধ না করার জন্য প্ররোচিত করছিল। কারণ অর্জুন দেহকেই প্রধান্য দিচ্ছিলেন বেশী। যুদ্ধ না করার পক্ষেও অর্জুন তার যুক্তি প্রদর্শন করলেন। ব্যাখ্যা (৩৭-৪৬): বর্ণিত শ্লোকসমূহে যুদ্ধের কারণে সামাজিক ব্যবস্থায় কি প্রভাব বিস্তার করবে তার যুক্তি অর্জুন প্রদর্শন করেছেন। যুদ্ধে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হবে। তাদের তর্পণ ক্রিয়া করার জন্য কোন লোক থাকবে না। পিতৃপুরুষেরা নরমগামী হবে। স্ত্রীরা স্বামীবিহীন হয়ে ব্যভীচারে লিপ্ত হবে ফলে সমাজে বর্ণসংকর সৃষ্টি হবে। ধর্ম নষ্ট হবে। অর্জুনের বক্তব্য হচ্ছে কৌরবরা এসকল দেখেও দেখছে না কিন্তু তারা এসকল দেখে কেন যুদ্ধ করবে কেনই বা পাপের ভাগী হবে। যুদ্ধ করলে মানুষ হত্যা করতে হবে সেটা অর্জুন জানে। তারপও তার ভিতর কেন এ দূর্বলতা? সেজন্যে অর্জুন বলছেন- কৌরবরা যদি তাকে হত্যা করে তবে তা ভালই হবে কারণ তাতে অনেক মানুষের প্রাণ রক্ষা পাবে এবং তার কোন পাপও হবে না। তখন সঞ্জয় বললেন- অর্জুন শোকবিহ্বল হয়ে ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের উপর আসন গ্রহণ করলেন এবং বললেন- তিনি যুদ্ধ করবেন না। এগুলি যে অর্জুনের মনের কথা নয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে আমার তা শ্রবণ করব। বিষাদ-যোগ" নামক শ্রীমদ্ভগবত গীতার প্রথম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র