নারদের মুখে দক্ষপ্রজাপতির যজ্ঞ সংবাদঃ

দেবর্ষি নারদ দক্ষপ্রজাপতির যজ্ঞসংবাদ দেবদেব মহেশ্বরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন,” হে দয়াময়! আপনার শ্বশুর দক্ষপ্রজাপতি আপনাকে অপমান করার জন্যেই এ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত্য, রসাতল সকলকে এ যজ্ঞে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কেবল সে যজ্ঞে আপনাকে এবং সতীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আপনি কি এ যজ্ঞে গমন করবেন? মহাদেব শান্তস্বরে জবাব দিলেন,” বৎস! আমাদের এ যজ্ঞে গমন করার কোন প্রয়োজন নেই। দক্ষপ্রজাপতি যেভাবে ইচ্ছা হয় তা তিনি করুন।” তখন নারদ পুনরায় বললেন,” দয়াময়! এতে কি আপনার হানি হবে না? শিবাপমানের ইচ্ছাতে এ যজ্ঞ সম্পন্ন হলে লোকের আপনার প্রতি অবজ্ঞ হবে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খের বিষয় হবে। তাই আপনি তথায় গমন করে বলপূর্বক এ যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করুন নতুবা এ যজ্ঞ নষ্ট করুন।”
তারপর এ যজ্ঞে যাওয়ার জন্য সতী জামাতা ও শ্বশুরের ইষ্ট অনিষ্ট বিষয়ে অনেক বাক্য বললেন। কিন্তু মহাদেব বললেন,” দক্ষপ্রজাপতি আমাকে চিরকালই ভিক্ষাজীবী সুদরিদ্র বলে থাকেন, তাই এ যজ্ঞে গমন করলে তিনি আমাকে বিনা আমন্ত্রণে যজ্ঞে যাওয়ার জন্য ভিক্ষুক বলে পরিহাস করবেন। তাই শঙ্করি! তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি এ যজ্ঞে যেতে পারব না।” তখন সতী বললেন,” আপনি যদি যজ্ঞে গমন না করেন তবে আমাকে যজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমার মুখ দর্শন করলে পিতা অবশ্যই সমাদর করবেন এবং পিতাকে বলে যজ্ঞের ভাগ আনায়ন করব। যদিও পিতা মোহবশত: আপনাকে পরমাত্মা স্বরুপে জানতে পারছেন, তিনি কি আপনার শ্বশুর হয়ে চিরকাল অজ্ঞানী থেকে যাবে? তাকে জ্ঞান দান করাও তো আপনার কর্তব্য। হে দয়াময়! আপনিইতো জ্ঞানদাতা, অদ্বিতীয় গুরু, পিতার অজ্ঞান নাশ করে যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করুন।” তখন মহাদেব বললেন,” হে সতী! যে কায়মনে বাক্যে আমাকে আত্ম সমর্পণ করে, আমি তাকে বিশুদ্ধ জ্ঞান দান করি। দক্ষপ্রজাপতি আমাকে অপমান করার জন্যেই এ যজ্ঞের আয়োজন করেছে এবং সে শ্রীঘ্রই এর ফল পাবে।” তুমি সেখানে গেলে দক্ষপ্রজাপতি তোমাকে দেখে আমার নিন্দা থেকে বিরত হবে না। আমার নিন্দা শ্রবণ করে কি তোমার কোন সুখ হবে? আমার নিন্দা শ্রবণ করার পর তোমার যে কি সর্বনাশ হবে তা স্মরণ করে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। তোমাকে আমি এ যজ্ঞে তেতে দিতে পারি না। পতির কথা না শুনলে নারী অবশ্যই দু:খে পতিত হয়।” সতী বললেন,” আপনি হাজার বার বারণ করলেও আমি ধৈর্য ধারণ করতে পারছিনা। এ কথা শুনে মহাদেব ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি আরষ্ট নয়নে বললেন,” তুমি পত্নী হয়ে পতিবাক্য বার বার অবহেলা করছ? কেন তুমি এ যজ্ঞে গমন করবে? তুমি মনে মনে কি চিন্তা করেছ তা না প্রকাশ করলে তোমার যাওয়া হবে না। যে দুরাত্মাদের মানহানির ভয় নেই তারাই ঐ সকল স্থানে গমন করে। আমাকে নিন্দা করবে নিশ্চয় জেনেও যখন তুমি একান্ত ইচ্ছা করছ সেখানে যাওয়ার, তখন আমার বোধ হচ্ছে যে আমার নিন্দাতে তোমার সন্তোষ লাভ হয়।” মহাদেবের এরুপ কঠিন ও কর্কশ বাক্য শ্রবণ করে সতী ক্রোধভরে আরক্তনয়না হয়ে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন।

সতীর দশ মহাবিদ্যা রুপধারণঃ
সতী মনে মনে বললেন,” মহাদেব অনেক তপস্যা দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হয়ে গর্বিত হয়েছেন এবং অপ্রিয বাক্যসকল প্রয়োগ করেছেন। এবং দর্পিত পিতাকে একেবাবে পরিত্যাগ করে আর শঙ্করকে কিছু সময়ের জন্য পরিত্যাগ করে নিজ লীলায় স্বস্থানে অবস্থান করব, তারপর আমার বিরহে মহাদেব যখন অতিশয় কাতর হবে আমাকে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা দ্ধারা আমাকে প্রার্থনা করবে তখন আমি হিমালয়ের কন্যা হয়ে পুনরায় তাকে পতি রুপে পাব।” মনের মধ্যে এরুপ ইচ্ছা ব্যক্ত করে দাক্ষায়ণী আরক্ত নয়নদ্বারা মহাদেবকে মোহিত করলে শম্ভু দেখলেন সতী ভীষণ ক্রোদ্ধান্বিত হলেন। তার ওষ্ঠাধার কম্পিত হচ্ছে। নয়নদ্ধয় অগ্নির ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠছে। সতী অট্ট হাস্য করতে করতে মৌম্যমূতি পরিত্যাগ করে অপর এক ভীমা মূর্তি ধারণ করল। সে মূর্তি প্রাণি দেখামাত্রই ভয়ে জরাগ্রস্থ হবে। তার দেহ তিমির বর্ণ, দিগম্বরী, আলুলায়িতকেশ, লাল জিহ্বা, চতুর্বাহু ধারণী, রোম কূপ হতে অগ্নি নি:সরিত হচ্ছে, গলদেশে মুন্ডমালা, মাঝে মাঝে ভয়ানক হুংকার শব্দ করছে, কোটি সূর্যের ন্যায় প্রভাবতী, ললাট ফলকে অর্দ্ধচন্দ্র। মহাদেব এরুপ ভয়ানক মূর্তি দর্শন করে অতি কষ্টে ধৈর্য অবলম্বন করে নিজে মূর্ছা থেকে রক্ষা করলেন এবং সে স্থান হতে পলায়নে উদ্যত হলেন। মহাদেবের এরুপ অবস্থা দেখে প্রকৃতি বললেন.” হে আশুতোষ! ভয় নেই । তুমি পলায়ন করিও না।” কিন্তু প্রকৃতির সে বাণী মাহাদেবকে আস্বস্থ করতে পারল না। তিনি আরও দ্রুত বেগে স্থান ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হলেন। পতিকে এ রকম ভীত ও পলায়নপর হতে দেখে তার হৃদয়ে দয়া হল। তিনি মহাদেবের গতি রোধ করার জন্য দশটি ভয়ানক মূর্তি ধারণ করে দশদিকে অবস্থান নিলেন। তখন সম্মুখে আর একটি ভীমা মূতি দর্শন করে অন্য দিকে পলায়নপর হলেন কিন্তু সেদিকেও আর একটি ভীমা মূর্তি দর্শন করে পলায়নের বৃথা চেষ্টা করলেন। তারপর পলায়নে অক্ষম হয়ে নিজ হাতে বদন আচ্ছাদন করে দন্ডায়মান থাকলেন। তারপর নয়ন উন্মোচন করে দেখলেন তার সামনে পূর্বের থেকেও অনেক প্রশান্তভাব এক শ্যামামূর্তি বিরাজমান। তাকে দেখে সাহসের সাথে বললেন,” শ্যামা দেবী! আপনি কে? আমার সতী কোথায় গমন করলেন? এ কথা শুনে প্রকৃতি বললেন,” মহাদেব! আমিই তো আপনার সতী। তুমি আমাকে চিনতে পারলে না।? তোমার নির্মল বুদ্ধিতে মোহমালিন্য কিরুপে উপস্থিত হল? তখন মহাদেব বলল,” ‍তুমি যদি আমার প্রাণবল্লভ সে সতীই হবে তবে কৃষ্ণাবর্ণা দেহধারী মূর্তি কে? আর দশ দিকেই বা এ সকল মূর্তি কারা? তারমধ্যে কোন ভীমা মুর্তিটি তোমার তার পরিচয় আমাকে দাও। তখন সতী বললেন,” শম্ভূ! তুমি কি পূর্বের সমস্তই বিস্মৃতি হয়েছ? আমি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কারীকর্ত্রী পরমা প্রকৃতি, তোমার তপস্যার প্রভাবে পূর্বের স্বীকারমত দক্ষপ্রজাপতির কন্যা হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলাম। সেই আমি এখন পিতার যজ্ঞ নষ্ট করার জন্য ভয়ানক হয়েছি। তুমি আমার নিকট আর ভীত হয়ো না। প্রকৃতির এরুপ কথায় মহাদেবে ভয় মোহ দূর হল। কিন্তু মহাদেব মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন হায়! যার প্রসন্নতায় আমি দেবাদিদেব মহাদেব হয়েছি, সেই পরমারাধ্য প্রকৃতিকে আমি তিরস্কার এবং কর্কশ বাক্য প্রয়োগ করেছি। হায়! কি অকৃতঘ্ন। মহাদেব বলতে লাগলেন,” হে পরমেশ্বরী! আমি অজ্ঞানবশত: আপনার প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ করেছি। আমি অপরাধ করেছি। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমাকে এখন রক্ষা করা আপনার কর্তব্য। হে বিশ্বজননি! আপনি এ দীন দাসকে ক্ষমা করুন।” মহাদেবের বাক্য শ্রবণ করে প্রকৃতি মৃদু হাস্য করতে লাগলেন। ইহাতে মহাদেব নির্ভয় হলেন। তিনি বললেন,” যে ভয়ানক মূর্তি দর্শন করলাম, তাদের নাম কি তা কীর্তন করুন।” তখন সতী বললেন,” হে আশুতোষ! দেবতা মাত্রই আমার স্বরুপ। “ আমি সে সকল দেবতাদের নাম কীর্তন করছি তুমি তা শ্রবণ কর।” সতী বললেন,” তোমার সম্মুখে কৃষ্ণবর্ণা ভীমত্রিলোচন, ইহার নাম কালী, যিনি উপরিভাগে অবস্থিত শ্যামাবর্ণা ইহার নাম তারা, তোমার সব্যভাগে যে দেবী মস্তকসমেত ছিলেন ইহার নাম ছিন্নমস্তা, বামভাগে যে দেবী ছিলেন ইহার নাম ভুবনেশ্বরী, পৃষ্ঠদেশে যে দেবতা ছিলেন ইহার নাম বগলামুখী, অগ্নিকোণে বিধবারুপ যে দেবতা ছিলেন ইহার নাম ধূমাবতী, নৈঋতভাগের ত্রিপুরা সুন্দরী, বায়ু কোনস্থা যে দেবী ছিলেন ইহার নাম মাতঙ্গী, আর ঈশানকোণে যে দেবী ছিলেন ইনি ষোড়শী আর আমি ভৈরবী ভীমা।” আমার এ সকল রুপ দর্শন করলে চতুবর্গ ফল ভক্তকে প্রদান করে। মহেশ্বর তুমি তো অবগত আছ জগৎ সংসারে যাবতীয় দেবতা আছেন, সে সকল দেবতার দেবত্ব আমি, ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্তৃত্ব যে রুপ সে আমি, বিষ্ণুর পালনকর্তৃত্ব যে রুপ সেও আমি এবং তোমার সংহারকর্তৃত্ব যে রুপ সেও আমি।” তুমি আমার প্রাণবল্লভ বলে আমি তোমার নিকট এ সকল কথা বিস্তারিত বললাম। আমি তোমার সে সতী। দর্পিত পিতার যজ্ঞ নষ্ট করার জন্য আমাকে পিতার গৃহে যেতে হবে। আর আপনি যদি না যান তবে আমাকে আজ্ঞা দিন। এমনিতেই মহাদেব ভয়ানক মূর্তি দর্শন করে ভীত ছিলেন এক্ষণে সতীর অভয় বাণী শুনে বললেন,” হে দেবী! আপনাকে আমি পরমা প্রকৃতিরুপে জানতে পেরেছি। ইত:পূর্বে আমি মোহবশত: আপনার পরমতত্ত্ব না জেনে যে অপরাধ করেছি তা ক্ষমা করুন। হে পরমেশ্বরী! আপনি যদি দক্ষযজ্ঞ বিনাশ করেন আপনাকে প্রতিরোধ করার আমার ক্ষমতা কি আছে? যজ্ঞ বিষয়ে আপনা যা অভিরুচি তাই করুন।”

ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব কর্তৃক ভগবতীর স্তবঃ
দক্ষালয়ে গমন করে যজ্ঞ কুন্ডের অদূরে সতীর দেহ দর্শন করে মহাদেব অত্যন্ত শোকাকুল হয়ে পড়ল। ‘হা সতী হা সতী‘ বলে বিলাপ করতে লাগল। সতী বিয়োগে মহেশ্বর এতই কাতর হয়ে পড়ল যে তার বাকশক্তি রোধ হয়ে যাচ্ছিল। তখন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে বলল,” দেবদেব! ব্রহ্মময়ীকে আমরা স্তব কর। তিনি যে প্রকারে আপনার প্রতি প্রসন্ন হয়ে পুনরায় দর্শন দান করেন সে বিষয়ে আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করব। যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি আমাদের স্তবে তুষ্ট না হন, তবে আমরা ঘোরতর তপস্যায় প্রাণ বিসর্জন করব।” অতপর ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তিন জনেই একান্তভাবে ভক্তিযুক্ত হয়ে সে পরমারাধ্য প্রকৃতির স্তব করলে লাগলেন। দেবত্রয় কর্তৃক স্তবে তুষ্ট হয়ে এবং মহাদেবের ব্যাকুলতা ও বিষন্নভাব দর্শন করে মহাদেবী তার প্রতি দয়া পরবশ হলেন। আকাশ পথে তাদের দর্শন দিলেন। মহাদেব মহাদেবীকে দর্শন করতে করতে অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হলেন। মহাদেবকে এরুপ দেখে প্রকৃতি বললেন,” হে আশুতোষ! আমি যখন দক্ষালয়ে যজ্ঞানুষ্ঠানে গমন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে তুমি সামান্য স্ত্রী বিবেচনায় আমার প্রতি অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করেছিলে; সে অপরাধেই কিছুদিন আমি তোমাকে পরিত্যাগ করেছি। তুমি শান্ত হও। অচিরেই আমাকে তুমি প্রাপ্ত হবে। আমি মেনকার গর্ভে হিমালয়ের ঔরশে জন্ম গ্রহণ করে পুনরায় তোমাকে পতিত্বে বরণ করব।” আমার কৃপাবলে তুমি মৃতুঞ্জয় ও ত্রিলোকের সংহার কর্তা। যজ্ঞকুন্ডস্থ স্থল হতে আমার দেহ মস্তকে ধারণ করে মর্ত্যলোকে পরিভ্রমণ কর তাতেই তোমার কিঞ্চিৎ বিরহের অবসান হবে। সে দেহ ক্রমে ক্রমে বহুখেন্ডে খন্ডিত হয়ে ধরণীমন্ডলে পতিত হবে। যে যে স্থানে পতিত হবে সে সকল স্থান মহাপাপনাশক পীঠস্থান হবে। যোনিভাগ যে স্থানে পতিত হবে সে স্থান সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং যোনিপীঠ সর্বপীঠ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ইতাতে কোন সংশয় নেই।” এ কথা বলে মহাদেবী ত্রিলোচনকে বার বার আশ্বাস প্রদান করে অন্তর্দ্ধান হলেন। বিষ্ণু কর্তৃক সতীর দেহ ছেদন ও মহাদেব কর্তৃক বিষ্ণুকে অভিসম্পাতঃ
তারপর ব্রহ্মাদি দেবতারা স্ব স্ব স্থানে গমন করলে মহাদেব পুনরায় দক্ষালয়ে প্রবেশ করে যজ্ঞকুন্ডস্থ স্থানে সতীর দেহ দর্শন করে হা সতি! হা সতি! বলে প্রাকৃত জনের ন্যায় প্রলাপ বকতে লাগলেন। মহাদেব সে মৃত দেহ মস্তকে ধারণ করা মাত্রই শোকসন্তপ্ত হৃদয় সুশীতল হল। তখন তার মুখ থেকে “আ” এ শব্দ বাহির হল। তিনি বলতে লাগলেন,” হে পরমেশ্বরী! আপনার বাক্যের কি অমোঘ শিক্তি। সতীর মৃতদেহ আমি পূর্বেও স্পর্শ করেছিলাম, তাতে আমার বিরহের অনল নিবৃত্তির চেয়ে দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্ত এক্ষণে সন্তাপ দূর হয়েছে। মহাদেব সতীর মৃত দেহ মস্তকে ধারণ করে নৃত্য করতে লাগলেন। তার সাথে সাথে প্রমথগণ নৃত্য করতে লাগল। সে নৃত্য দর্শন করার জন্য ব্রহ্মাদি দেবশ্রেষ্ঠ এবং ইন্দ্রাদি দেবতা সকলেই নভোমন্ডলে সমবেত হলেন এবং প্রমথনাথের সুললিত নৃত্য দর্শন করে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। মহাদেব সতীর দেহ কখন বাম হস্তে, কখনও ডান হস্তে কখনও বা বুকে ধারণ করে নৃত্য করতে লাগলেন। আশুতোষের এ তান্ডব নৃত্যে তার পদাঘাতে ধরণী কম্পিত হতে লাগল। ত্রিভুবনের সকলেই আসন্ন অকাল প্রলয় ভয়ে ভীত হতে লাগল। তখন ব্রহ্মা সকলকে ভীত না হয়ে সস্ত্যয়ন করতে আদেশ দিলেন। ব্রহ্মাদি দেবতা ব্যাকুল হতে দেখে বিষ্ণু বললেন,” হে দেববৃন্দ! তোমরা ভীত হয়ো না। আমি ইহার প্রতিকার করছি। মহাদেবীর আজ্ঞা আছে তার মৃতদেহ খন্ড খন্ড হয়ে পৃথিবীর যে যে স্থানে পতিত হবে সে সকল স্থান মহাপীঠ ও তীর্থস্থান হবে। এ আজ্ঞা কখনও অন্যথা হবে না। মহাদেব আনন্দে মগ্ন আছেন, তিনি যাতে জানতে না পারেন সে জন্য আমি সুদর্শন চক্র দ্ধারা সতীর দেহ অল্প অল্প করে ছেদন করব।”
তারপর বিষ্ণু দেবতাদিগকে আশ্বাস প্রদান করে মহাদেবের পিছন পিছন চলতে লাগলেন। যে সময় মহাদেব অতিশয় আনন্দে মগ্ন থাকেন সে সময় বিষ্ণু শানিত সুদর্শন চক্র দ্ধারা সতীর দেহ ছেদন করেন। এভাবে সতীর দেহ প্রায় ছেদন করলেন। সতীর দেহ খন্ড খন্ড হয়ে যে সকল স্থানে পতিত হলো সে সকল দেশ বা স্থান মহাপবিত্র পূণ্য তীর্থ এবং সে সকল স্থানে জগদীশ্বরীরর আবির্ভাব থাকল। এ সকল পীঠস্থানে শক্তিরুপিনীকে উদেশ্যে করে যে পূজা হোম করা হবে অন্য যে কোন স্থান অপেক্ষা কোটিগুণ ফল লাভ হবে। পীঠস্থান সকল দেব দুর্লভ মুক্তিক্ষেত্র, অমরগণও সে স্থানে মৃত্যু ইচ্ছা করেন। যদি কোন ব্যক্তি ধর্মানুষ্ঠান না করে কেবল এ সকল স্থানে প্রাণ ত্যাগ করেন তাহলে তিনি মোক্ষ লাভ করবেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সতীর দেহ খন্ড ভূমি সংলগ্ন হওয়া মাত্রই তা পাষাণময় হয়ে রইল। এভাবে চক্রপাণি সুদর্শন চক্র দ্ধারা সতীর দেহ সম্পূর্ণরুপে ছেদন করলে মহাদেব জানতে পারলেন তার মস্তকে সতীর দেহ নেই। স্তম্ভিত হলেন। তিনি দেখলেন জগৎমন্ডল ব্যাকুল হয়েছে, তাতে তার হৃদয়ে দয়া উদয় হলো। তখন বিষ্ণু নারদকে বললেন,”বৎস! এখন মহাদেব যদি কোন ব্যক্তিকে তার সম্মুখে দেখেন তাকে তাকে সতীর অপহরণকারী বলে কোপ প্রকাশ করবেন। অতএব তুমি শ্রীঘ্রই মহাদেবে নিকট যাও কারণ তুমি বিষয় কার্যে বিরত ও বৈরাগ্যস্বভাব। তোমাকে দেখলে সতীর দেহ কে অপহরণ করেছে তা মহাদেব জানতে চাইবে। তখন তুমি সে কথা বলবার উপক্রমে স্তবদ্ধারা দেবদেবকে শান্ত করে আনুপূর্বিক সমস্ত জ্ঞাত করবে।” নারদেকে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখে মহাদেব বললেন,” বৎস নাবদ! আমার সতী আমাকে পরিত্যাগ করেছে।” এ বলে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন। নারদ বললেন,” হে দয়াময়! আপনি শান্ত হোন। আপনি অবশ্যই সতী দেবীকে পুনরায় লাভ করবেন। আপনি সর্বজ্ঞ, আপনি ত্রিকালজ্ঞ। কেন আপনার হৃদয়ে প্রতীত হয় না প্রভূ, আপনি স্থির হোন, অন্যমনস্ক হয়ে আর অকালে প্রলয় ডেকে আনবেন না। বৎস নারদ! আপনি এ কি বলছেন? আমি অকালে প্রলয় উপস্থিত করছি? আমি সতী বিরহে মুহ্যমান, অন্যমনস্ক ছিলাম। কিন্তু নারদ কোন ব্যক্তি আমার সতীকে অপহরণ করল? শোকসাগরে সতীর দেহকে অবলম্বন করে প্রাণ রক্ষণের যে উপায় ছিল তা কোন দুষ্টমতির সহ্য হলো না। তখন নারদ বলল,” হে প্রভূ! আপনি শান্ত হোন। আমি সমস্তই আপনার নিকট নিবেদন করছি। আপনার এ ভয়ানক তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী কম্পিত হয়েছে, পর্বত শিখর ভেঙ্গে পড়েছে, সমুদ্র জল উছলিত হয়ে দেশ প্বাবিত করেছে, অনেক প্রাণি প্রাণ ত্যাগ করেছে, অনেকে মূর্ছা গেছে, দেবতারা ভীত হয়ে আপনার নিকটে আগমন করতে পারছে না। আমি নিতান্তই শরনাগত বলেই প্রভূর নিকট উপস্থিত হয়েছি। আপনি আর কিছুকাল এ রকম তান্ডব নৃত্য করলে সুরাসুর সকলেই বিনষ্ট হবে। নারদের কথা শ্রবণ করে মহাদেব লজ্জাবনত হয়ে বলল,” আমার নৃত্যভরে পৃথিবীর অবস্থা এত খারাপ হয়েছে। শোকানলে আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়েছি। আমি এক্ষণে শান্ত হলাম। কিন্তু আপনি বলুন আমার সতীর দেহকে কোন ব্যক্তি হরণ করেছে?
তখন নারদ বললেন,” সতীর মৃতদেহ নিয়ে আপনি যখন নৃত্য করলে লাগলেন, তখন সুরাসুর সে সুললিত নৃত্যে দর্শন করে পরম আনন্দ লাভ করতে লাগল। কিন্তু নৃত্যবেগ বর্দ্ধিত হয়ে এক সময় প্রলয় নৃত্যে পরিণত হলো। তখন ব্রহ্মাদি দেবতারা কোন উপায় খুজে পেলেন না। পরে ত্রিলোকরক্ষাকর্তা বিষ্ণু সকলকে আশ্বাস প্রদান করে আপনাকে শান্ত করার মানসে নিজ চক্র দ্ধারা সতীরদেহ খন্ড খন্ড করেছেন; সে দেহ যে যে স্থানে পতিত হয়েছে সে স্থান মহাতীর্থ স্থানে পরিণত হয়েছে। তারমধ্যে কামাখ্যা নামক মহাপাঠ স্থানে তপস্যা করলে আপনি সতীকে দেবীকে পুন: প্রাপ্ত হবেন; আমি পিতার নিকট এমনই শ্রবণ করেছি এবং মহাদেবীও এরুপ আজ্ঞা করেছেন। নারদ মুখ হতে এমন বচন শ্রবণ করার পর মহাদেব বলতে লাগলেন,” হে মহর্ষে! আমি সতীর দেহ তত্তুল্য করে দিন অতিবাহিত করছিলাম। কিন্তু বিষ্ণু তা নষ্ট করে দিল। অতএব আমি তাকে অভিসম্পাত করছি, ত্রেতাযুগে তিনি সূর্যবংশীয় রাজভবনে জন্ম গ্রহণ করবেন। প্রতিতযশা হয়ে আমার সতীর মত অসাধারণ গুণ সম্পন্ন প্রিয়তমা পত্নী পাবেন। সে পত্নী কিছুকাল তার নিকট অবস্থান করার পর কোন সঙ্কট মুর্হুতে সস্বরুপ ছায়াকে পতিপার্শ্বে স্থাপন করে স্বয়ং অন্তর্দ্ধান করবেন। মায়াজালে বিমূঢ় হয়ে বিষ্ণু কিছুই জানতে পারবেন ন। কিয়ৎকাল পর একজন ক্রূরকর্মা রাক্ষস এসে তার ছায়াপত্নীকে হরণ করবে। মায়াবশে সুদূরে নীত বিষ্ণু ঐ প্রাণপ্রিয়ার দর্শন লালসায় মহাবেগে আগমন করে দেখবেন ঐ স্থানে তার প্রেয়সী নেই। তখন তিনি আমার মত শোকাতর হয়ে হা প্রেয়সী! হা প্রেয়সী করে বোদন করবেন। প্রিয়া বিরহে সন্তাপ কত দূর দু:সহ তা তিনি সম্যক উপলদ্ধি করতে পারবেন।” মহাদেব বিষ্ণুকে অভিসম্পাত দিয়ে কিছুকাল নিস্তদ্ধ হয়ে ধ্যাননিমীল নয়নে সতীর দেহ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যে যে স্থানে পতিত হয়েছিল সে সমস্ত স্থান পবিত্রময় পূণ্যক্ষেত্রস্বরুপ; তারমধ্যে কামরুপে যোনি পীঠ সাক্ষাত দেবীই যেন দেদীপ্যমান। মহাদেব তা দর্শনে রোমাঞ্চিত হয়ে কামবাণে ব্যাকুল হলেন।
এ সময় এক চমৎকার ঘটনার সৃষ্টি হলো। সে পরমা দেবী প্রকৃতি চৈতন্যরুপিনী বলে তার অঙ্গখন্ডও কি চৈত্যময়, কি আশ্চর্য! মহাদেব কামভাব হয়ে তা দর্শন করার অপরাধে সে যোনি তৎক্ষণাতই পাতালে প্রবেশ করতে লাগল। তখন মহাদেব মনে করলেন সর্বনাশ উপস্থিত। আমি যে স্থানে তপস্যা করে পুন: সতীকে পাব সে আশা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি যাতে পৃথিবী ভেদ করে পাতালে প্রবেশ করতে না পারেন তার জন্য তৎক্ষণাত স্বকীয় অংশ দ্ধারা এক বৃহৎ পর্বতরুপ ধারণ করে সে যোনি পাঠকে ধারণ করলেন। যোনি পীঠ পর্বতগহ্বরে স্থির হলে মহাদেবের চিত্তও স্থির হলো। অতপর কামরুপাদি সর্ব পীঠ স্থানেই পাষাণময় লিঙ্গ হলো। মহাদেবীর আজ্ঞা স্মরণ করে মহাদেব শান্ত হয়ে যোনিপীঠ নিকটে স্থিরাসনে তপস্যা করতে লাগলেন। নারদ মহাদেবকে প্রশান্ত দেখে বিষ্ণুর নিকট গিয়ে তার প্রতি মহাদের অভিশাপ, মহাদের ব্যাকুলতা, পর্বতরুপ ধারণ, তপোনুষ্ঠান ইত্যাদি সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। নারদমুখে বিশদ বিবরণ শ্রবণ করে ব্রহ্মা বিষ্ণু পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময় করে বললেন “ চলুন আমার মহাদেবে সমীপে যাই।” কামরুপে উপস্থিত হয়ে দেখলেন মহাদেব তপস্যানুষ্ঠানরত; কিন্তু চিত্তচঞ্চল হেতু বিমনায়মান হয়ে ইতস্তত: অবলোকন করছেন এবং অশ্রুজলে বক্ষ সিক্ত হচ্ছে। ব্রহ্মা-বিষ্ণুকে দর্শন করে সতী বিরহ আরও প্রবল হলো। তিনি প্রাকৃত লোকে মত মুক্তকন্ঠে রোদন করতে লাগলেন। তখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বরকে বললেন,” মহেশ্বর! নিত্যা প্রকৃতি সতী কখনিই বিনষ্ট হবার নয়, ইহা জেনেও কেন আপনি মিথ্যা শোক করছেন।” মহাদেব বললেন,” আপনারা যা বলছেন, তা সকলই সত্য, সতী আমার নিত্যা প্রকৃতি, সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্রী, সাক্ষাত ব্রহ্মরুপিনী ইহা জেনেও তাকে পত্নীভাবে দর্শন করার জন্য আমার মন ব্যাকুল হচ্ছে। তাকে পাওয়ার উপায়ন্তর বলুন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সজল নয়নে বললেন,” দেবদেব! আপনি কামরুপে অবস্থান করে পরমাপ্রকৃতিতে মনোনিধান করে তপস্যা করুন। নিশ্চয় আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তার মহাদের একটি নির্জন গুহায় প্রবেশ করে তপস্যায় রত হলেন। এভাবে বহুকাল তপস্যা করার পর প্রকৃতি প্রসন্ন হয়ে মহাদেবক,জিজ্ঞাসা করলেন,” তোমার অভিলাষ কি? মহাদেব গদগদ চিত্তে বললেন,” আপনি পূর্বে যেভাবে আমার পত্নী ছিলেন, পুনরায় আপনি সে প্রকার হোন এ আমার অভিলাষ।” পরমা প্রকৃতি বললেন,” আমি হিমালয় ভবনে জন্ম গ্রহণ করে তোমাকে প্রাপ্ত হবো। আমার দেহ মস্তকে ধারণ করে নৃত্য করেছিলে সে জন্যে গঙ্গা নাম ধারণ করে তোমার মস্তকে কিছুকাল বাস করব। মহাদেবকে বর প্রদান করে পরমা প্রকৃতি অন্তর্দ্ধান হলেন।
তারপর মেনকার গর্ভে গঙ্গা’র জন্ম হলো। তথায় দেবর্ষি নারদ উপস্থিত হয়ে গিরিরাজকে প্রশ্ন করলেন.”গিরিবর! আপনার কন্যাটি যথার্থ তত্ত্ব অবগত হয়েছেন কি? দেবর্ষির বাক্য শুনে গিরিরাজ বলল,” আমার এ কন্যাটি সুলক্ষনা ও সবাঙ্গসুন্দরী এ জানি। তখন নারদ বলল, তবে গিরিরাজ শুশুন, আপনা এ কন্যাটি স্বয়ং মূল প্রকৃতি, ব্রহ্মাদি দেবতার প্রসবকর্ত্রী এবং দক্ষকন্যা সতীরুপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তিনিই স্বকীয় অংশে মহাদেবকে পুনরায় পতি রুপে লাভ করার জন্য আপনার কন্যারুপে জন্ম গ্রহণ করেছেন। ইহার “গঙ্গা” নামকরণ করবেন। ইহার বিবাহ স্বর্গপুরে হবে। আপনার নিকট ব্রহ্মা কন্যাটি প্রার্থনা করবেন। নারদ ব্রহ্মলোকে গমনপূর্বক পিতাকে অষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সকলই সবিস্তারে বর্ণনা করল। ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর প্রতি মহাদেব রুষ্ট ছিলেন। নরাদ জানালেন গঙ্গাকে স্বর্গপুরে এনে মহাদেবের সাথে বিবাহ দিলেই মহাদেব তাদের প্রতি তুষ্ট হবেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবরাজ ইন্দ্রসহ সকল দেবতা ব্রহ্মলোকে গমন করলেন। তখন ব্রহ্মা, ইন্দ্র, চন্দ্র, কুবের, বরুন, সোম, সূর্য, অগ্নি,মরুৎ এবং নারদ গঙ্গাকে আনার জন্য গিরিরাজ ভবনে গমন করে গঙ্গাকে ব্রহ্মার নিকট সম্প্রদান করার জন্য প্রার্থনা করলে গিরিরাজ গঙ্গাকে সমর্পন করেন। কিন্তু মাতা মেনকাকে না বলে স্বর্গপুরে গমন করার জন্য মাতা মেনকা গঙ্গাকে অভিশাপ দিলেন যে গঙ্গাকে দ্রবময়ী হয়ে এ সসাগরায় পুনরায় মহীতলে আসতে হবে।
Previous
Next Post »

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র