শ্রীমদ্ভগবতগীতার পঞ্চম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

অর্জুন বললেন, হে কৃষ্ণ! তুমি কর্মযোগ ও কর্মসন্ন্যাস উভয়ই আমার কাছে ব্যাখ্যা করলে। কিন্তু এ দুটির মধ্যে কোনটি আমার পক্ষে শ্রেয় তা আমাকে নিশ্চয় করে বল। ভগবান বললেন, হে পার্থ! কর্মসন্ন্যাস (কর্মত্যাগ) ও কর্মযোগ (নিষ্কাম কর্ম) উভয় মুক্তিদায়ক। কিন্তু তারমধ্যে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগই (নিষ্কাম কর্ম) শ্রেষ্ঠ। হে মহাবাহো! যাঁরা দ্বেষ ও আকাঙ্খা রহিত, যিনি নির্দ্বন্দ্ব ও স্বর্গাদি সুখকামনা রহিত, তিনিই নিত্যসন্ন্যাসী। কেননা এরকম পুরুষই অনায়াসে সংসার বন্ধন হতে মুক্তি লাভ করেন। অজ্ঞানীগণ কর্মসন্ন্যাস ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্বতি বলে মনে করেন কিন্তু পন্ডিতেরা তা মনে করেন না। যিনি সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এর মধ্যে যে-কোন একটিকে বিশেষরূপে অনুষ্ঠান করেন তিনি উভয়ের প্রকৃত ফল লাভ করে থাকেন। সাংখ্য পুরুষ ( সন্ন্যাসী) গণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীগণও সেই স্থান প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে এক বলে জানেন তিনিই যথার্থদর্শী। কর্মযোগ ব্যতীত সন্ন্যাগ গ্রহণ (কর্মত্যাগ) করা অত্যন্ত দু:খজনক। কর্মযোগীগণ সন্ন্যাসী হয়ে শ্রীঘ্রই ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। যিনি যোগী হয়ে বিশুদ্ধাত্মা, যিনি দেহ ও ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করেছেন এবং যিনি আপনার আত্মাকে সর্বভূতের আত্মার ন্যায় জ্ঞান করেন, তিনিই সংসার নির্বাহের জন্য কর্মানুষ্ঠান করেও তাতে লিপ্ত হন না।পরমার্থদর্শী কর্মযোগীগণ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা ও নি:শ্বাস গ্রহণ, কথন, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করেও জানেন তিনি নিজে কিছুই করছেন না, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই আপন আপন বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে। যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পন করে কর্মফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক কর্মানুষ্ঠান করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না। কর্মযোগীগণ ফলকামনা পরিত্যাগপূর্বক অন্ত:করণ শুদ্ধির জন্য কেবল শরীর, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা কর্ম করেন। যুক্ত (যোগী) অর্থাৎ কর্মযোগী কর্মফল পরিত্যাগপূর্বক মোক্ষরূপ শান্তি লাভ করে থাকেন এবং অযুক্ত (অযোগী) ব্যক্তি কামনাবশত: ফল লাভে আসক্ত হয়ে সংসারে আবদ্ধ হন।
জিতেন্দ্রিয় আত্মদর্শী ব্যক্তি মনের দ্ধারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে নবদ্ধার-বিশিষ্ট দেহরুপ গৃহে পরম সুখে বাস করতে থাকেন, তিনি স্বয়ং কোন কার্য করেন না এবং অন্যকেও কোন কর্মে প্রবৃত্ত করেন না । জগৎপ্রভু লোকের কর্তৃত্ব ও কর্মফল সৃষ্টি করে না অথবা কর্মফল সম্বন্ধও সৃষ্টি করে না। অজ্ঞানরূপ মায়াই জীবকে কর্মে প্রবৃত্ত করে (জড়া প্রকৃতির গুণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে)। পরমেশ্বর ভগবান জীবের পাপ বা পূণ্য কিছুই গ্রহণ করেন না; অজ্ঞানের দ্বারা জ্ঞান আবৃত হওয়ার ফলে জীবসমূহ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। জ্ঞানের প্রভাবে যাদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, তাদের সে আত্মজ্ঞান অপ্রাকৃত পরতত্ত্বকে প্রকাশ করে, ঠিক যেমন সূর্য্য উদয়ে সবকিছূ প্রকাশমান হয়। যাদের বুদ্ধি ব্রহ্মনিষ্ঠা, পরব্রহ্মেই যাদের আত্মভাব, যারা ব্রহ্মনিষ্ঠাযুক্ত, যারা ব্রহ্মপারায়ণ এবং জ্ঞানের দ্বারা যাদের পাপ ও পূণ্য নিবৃত্ত হয়েছে, তারা মোক্ষলাভ করেন; তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না। জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গো, হস্তী, কুকুর ও চন্ডাল সকলকেই সমভাবে দর্শন করেন।
যাদের মন ব্রহ্মভাবে অবস্থিত, তারা জীবিতাবস্থায় সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হন। কেননা ব্রহ্ম নির্দোষ ও সম স্বরূপ; সমদর্শী পুরুষগণ ব্রহ্মেই অবস্থিত। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি প্রিয়বস্তু প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না আবার অপ্রিয় বস্তু প্রাপ্তিতে উদ্বিগ্ন হন না; কেননা তিনি মোহবর্জিত, স্থিরবুদ্ধি, ব্রহ্মবেত্তা এবং ব্রহ্মেই অবস্থিত। বাহ্য শব্দাদিতে আসক্তিশূন্য ব্যক্তি অন্ত:করণে শান্তি-সুখ অনুভব করেন; অবশেষে ব্রহ্মযোগযুক্ত হয়ে অক্ষয় সুখ লাভ করেন। হে কৌন্তেয়! পন্ডিত ব্যক্তিগণ ইন্দ্রিয় বিষয় হতে উদ্ভূত সুখসমূহে আসক্ত হন না; কারণ ঐ সকল সুখ দু:খের কারণ এবং এর কোন আদি ও অন্ত নেই। যিনি ইহলোকে দেহত্যাগ করার পূর্বেই কাম ও ক্রোধ হতে উৎপন্ন বেগ সহ্য করতে সমর্থ হয়েছে, তিনিই যোগী ও সুখী হন। যিনি আত্মাতেই সুখী, আত্মাতেই প্রীতিযুক্ত, আত্মাতেই যাঁর প্রকাশ (আত্মদৃষ্টিযুক্ত), সেই ব্রহ্মনিষ্ঠ যোগী পুরুষ নির্বাণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। যাঁরা নিষ্পাপ, সন্ন্যাসযুক্ত, সংশয় বর্জিত, একাগ্রচিত্ত ও সর্বভূতহিতৈষী তাঁরা নির্বাণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। যে সকল সন্ন্যাসী চিত্তকে বশীভূত করেছেন, কাম ও ক্রোধ হতে মুক্ত এবং আত্মতত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তাঁরা ইহকাল ও পরকাল উভয়েই মোক্ষ প্রাপ্ত হন। মন হতে বাহ্য বিষয়সমূহ বিদূরিত করে, চক্ষুদ্বয়কে ভ্রুমধ্যে স্থাপনপূর্বক প্রাণ ও অপান বায়ুকে নাসার মধ্যে অবরোধ করত: যিনি ইন্দ্রিয় ও মনকে জয় করেছেন এবং ইচ্ছা, ভয়, ক্রোধকে বশীভূত করেছেনে এবং যিনি বিষয় বিরাগী, সেই মননশীল পুরুষই সর্বদা জীবম্মুক্ত। আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সকল জীবের সুহৃদ জেনে মানবগণ জড় জগতের দু:খ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।

ConversionConversion EmoticonEmoticon

:)
:(
=(
^_^
:D
=D
=)D
|o|
@@,
;)
:-bd
:-d
:p
:ng

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র