শ্রীমদ্ভগবত গীতা তৃতীয় অধ্যায়

শ্রীমদ্ভগবতগীতা-তৃতীয় অধ্যায়-কর্মযোগ

তৃতীয় অধ্যায় এর সারসংক্ষেপ: গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের নাম “কর্মযোগ”। গীতার এ অধ্যায়ে ৪৩টি শ্লোক রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে মূলত: সাংখ্যযোগ, জ্ঞানযোগ, নিষ্কাম কর্ম, কর্মসন্ন্যাস, ভক্তিযোগ, ও মোক্ষ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়টি শুরু হয়েছে অর্জুনের দুটি প্রশ্নে। যদি জ্ঞাননিষ্ঠা কর্মনিষ্ঠা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হয় বা সকাম কর্ম নিষ্কাম কর্ম অপেক্ষা নিকৃষ্ট বা জ্ঞানযোগ কর্মযোগ অপেক্ষা বড় বা কর্ম অপেক্ষা সাম্যবুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ বা কর্ম অপেক্ষা সাম্যবুদ্ধি শ্রেষ্ঠ হয় তবে তাকে কেন এ হিংসাত্মক কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে? আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- তুমি কর্ম কর, কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। কর্মফলে আশার কারণ হয়ে তুমি কর্ম করো না। আবার কর্ম না করার প্রতিও যেন তোমার প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা না হয়। আবার পরক্ষণই বলছেন- কর্ম অপেক্ষা সাম্যবুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ। অর্জুনের বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। তার প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, যদি জ্ঞানকে আশ্রয় করে মোক্ষ লাভ হয় তবে যুদ্ধ করার কি প্রয়োজন? এ জন্যেই অর্জুন বলছেন তিনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন।সঠিক পথটি বাতলিয়ে দেয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করছেন। তৃতীয় শ্লোক হতে অষ্টম শ্লোকে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর। নবম হতে ষোঢ়শ শ্লোক পর্যন্ত শ্লোকে যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বরের প্রীতির জন্য, সৃষ্টি রক্ষার জন্য অর্জুন তথা মানব জাতিকে যজ্ঞ করার জন্য বলা হয়েছে। সতের হতে চব্বিশ পর্যন্ত শ্লোকে যাদের কর্ম যজ্ঞময় তাদের কথা বলা হয়েছে। যারা অত্মাতে তৃপ্ত, আত্মাতে সন্তষ্ট, আত্মাতে পরম সুখ অনুভব করেন তাদের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে সে সকল যোগীদের কোন কর্তব্য কর্ম নেই। সে প্রাচীন মহাজনদের কথাই বলা হয়েছে যারা কর্ম দ্বারা সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন। প্রাচীন মহাজন-অর্থাৎ স্বয়ম্ভূ মনু, দেবর্ষি নারদ, কপিলদেব, সনৎকুমার, চতুষ্কুমার, শিব, মহারাজ জনক, বলি মহারাজ, প্রহ্লাদ মহারাজ, ব্রহ্মা, ভীষ্ম,যম যযাতি, যদু তাঁরা সকলই মুক্ত পুরুষ ছিলেন। পঁচিশ হতে ঊনত্রিশ পর্যন্ত শ্লোকে জ্ঞানী ও অজ্ঞানীদের পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে জ্ঞানীরা নিষ্কাম কর্মের আচরণের দ্বারা অজ্ঞানীদের অন্ধকার দূর করে আলোর বর্তিকা দেখাবেন। ত্রিশ হতে পঁয়ত্রিশ শ্লোকে শ্রীভগবান অর্জুনকে সর্বকর্ম তাকে সমর্পণ করে কর্মযজ্ঞের পূর্ণতা ও তৎপথের সন্ধান দিয়েছেন। ছত্রিশ শ্লোকে অর্জুন আবার শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করছেন মানুষ কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়? শ্রীভগবান বলছেন- স্বত্ত্ব, তম ও রজ: এ তিনটি গুণের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ পাপ কার্যে জড়িত হয় এবং তা থেকে পরিত্রাণের পথও বাতলিয়ে দিয়েছেন। সর্বকামনা বাসনা ত্যাগ করে সাম্যবুদ্ধি লাভ করলেই তো জীবের মোক্ষ লাভ হয়, তবে কর্মের প্রয়োজন কেন? এর উত্তরে শ্রীভগবান বলছেন- আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মোক্ষ লাভের দুটি পথ আছে একটি জ্ঞান ও অন্যটি কর্ম। জ্ঞান জ্ঞানীদের জন্য আর কর্ম কর্মীদের জন্য অর্থাৎ সাধারণের জন্য। জ্ঞানের জন্য যে মোক্ষলাভ হয় তা হয় জ্ঞানের জন্য, কর্মত্যাগের জন্য নয়। আর কর্মমার্গে যে মোক্ষলাভ হয় তা হয় সাম্যবুদ্ধি বা সম্যক জ্ঞানের জন্য। ইহা ব্যতীত কর্ম নিষ্কাম হয় না। সাম্যবুদ্ধিই নিষ্কাম কর্মযোগের মূল। সমতাই যোগ। চিত্তের নির্বিকার ভাবের নামই যোগ। আসক্তি থাকলে এ সমত্ব আসবে না; কর্মের সফতা বা বিফলতা জন্য কোন বিকার দেখা না দিলেই বুঝতে আসিক্তি নেই। এ সমত্ববোধ নিয়েই কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে। জয়ের আনন্দ বা পরাজয়ে বিষাদ এ দুইয়ই ত্যাগ করে, কর্মফলে আকাঙ্খা ত্যাগ করে নিষ্কাম হয়ে কাজ করতে হবে।
নিষ্কাম কর্ম কি সম্ভব?অনেক পাশ্চাত্য পন্ডিত এবং এ দেশের অনেক শিষ্য বলেন ( কর্ম বিষয়ে আলোচনা হলে অনেক বলেন নিষ্কাম কর্ম কোন কর্ম নয়, তা সম্ভবও নয়)- ফলের আশা না করে, কর্মের জয় বা পরাজয়কে তুল্য জ্ঞান করে কর্ম করা কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ উদ্দেশ্যে ছাড়া কেহ কর্ম করে না। উদ্দেশ্য ভিন্ন কোন কর্ম হয় না। উদ্দেশ্য ব্যতীত কর্ম হয় না, এটা সঠিক। শাস্থ্যে শাস্ত্রে আছে প্রয়োজনম অনুদিশ্য ন মন্দ অপি প্রবর্ততে- অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছাড়া মূঢ় লোকও কোন কাজ করে না। উদাসীনতা ও উদ্দেশ্যহীনতা এক কথা নয়। নিষ্কাম কর্মও উদ্দেশ্যহীন নয়। ‘লোক-সংগ্রহ’ ভগবানের সৃষ্টিরক্ষাই ইহার উদ্দেশ্য; ইহা ভগবানের কর্ম, জগৎ রক্ষার জন্য প্রকৃতি প্রেরণায় জীবের মধ্যে দিয়ে হয়। আমরা যা কিছু কাজ করি না কেন আমাদের বলতে হবে- হে রাধামাধব! হে গোবিন্দ! আমরা যা কর্ম করছি সবই তোমার জন্য করছি, তোমার সৃষ্টি রক্ষার জন্য করছি বলে সমস্ত কর্মফল “নমো: ব্রহ্মাণ্য দেবায় গো ব্রাহ্মণা হিতায় চ জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নম:” বলে সমর্পণ করতে হবে। যখন ভাগবত ইচ্ছা ও কর্মীর ইচ্ছা এক হয়, তখনই প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম সম্ভবপর, তখন কর্তার অহমবোধ বা কর্তৃত্বাভিমান থাকে না, কর্তার কোন ব্যক্তিত্ব থাকে না, কোন আসক্তি থাকে না। এ অবস্থায় সাম্যবুদ্ধি বা সমত্ববোধ অসম্ভব ব্যাপার তো নয়ই, পরন্তু ইহাই স্বাভাবিক হয়ে উঠে। যেমন দরুন- দুদল বালক দল বেঁধে খেলা করছে। তাদের উদ্দেশ্য খেলায় আনন্দ লাভ করা। ইহাই তাদের স্বভাব। জয়-পরাজয় মূল উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু যারা জুয়া খেলেন তারা জয়-পরাজয়ে উদাসীন হতে পারে না। কারণ তাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে জয়। বুদ্ধিযোগ: বুদ্ধিযোগ মানে নিষ্কাম কর্মযোগ। সাম্যবুদ্ধিই নিষ্কাম কর্মযোগের মূল। সিদ্ধি বা অসিদ্ধিতে যে সমত্ববুদ্ধি তার নাম যোগ। এ সমত্ববুদ্ধির যোগকেই বলা হয়েছে বুদ্ধিযোগ। ফলাফলে সমান ভাবই সমত্ববুদ্ধি এবং বুদ্ধিযোগ। কর্মের কর্তা ফলাকাঙ্খা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে নিষ্কামচিত্তে কর্ম সম্পাদন করবেন, তাহলে তিনি পুনর্জন্মকে জয় করে মোক্ষলাভ করবেন। কর্মের বিচারে বাহ্যিক ফলের বিচার মূখ্য নয়। কর্তা কি উদ্দেশ্যে কর্ম করেন, কিরূপ বুদ্ধিতে কর্ম করেন তাহাই বিচার্য বিষয়। কর্মের বিচারে কর্তার বুদ্ধি যদি স্থির, শুদ্ধ, সাম্য ও নিষ্কাম হয়, তবে কর্মের ফলই যা হোক না কেন তাতে কর্তার কোন পাপ হয় না, কোন কর্মফল ভোগ করতে হয় না। যেমন- কোন ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হওয়ার আশায় বন্যার সময় প্রচুর পরিমান দান করলেন। এতে অনেক লোকের প্রাণও রক্ষা পেল। অপর দিকে অতি দরিদ্র এক লোক নিজের যা আছ তা দিয়েই বন্যার্তদের মধ্যে অন্তত: একজনকে দান করল। একজন উপকৃত হল। এখন প্রশ্ন কার দান শ্রেষ্ঠ? নৈতিক বিচার দরিদ্র লোকের দান শ্রেষ্ঠ। কারণ উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত পাত্রে সে দান করেছে। তার দানে কোন উদ্দেশ্য নেই। এখানে দরিদ্র ব্যক্তির বুদ্ধি শুদ্ধ, পবিত্র, নিষ্কাম। অপরদিকে ধনী ব্যক্তি বুদ্ধি কলুষিত, কামনাজড়ি। সূত্র: শ্রীগীতা, শ্রীজগদীশ চন্দ্র ঘোষ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী

কর্মযোগ

|অর্জুন উবাচ |
জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন |
তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব || ১ ||
অর্থ :অজুর্ন বললেন হে জনার্দন! যদি আপনার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই হিসাংত্মক কর্মে (যুদ্ধে) কেন নিযুক্ত করছেন?
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে |
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ || ২ ||
অর্থ : আপনি সন্দেহজনক বাক্যের দ্বারা আমার মনকে বিভ্রান্ত করছেন। আপনি একটু নিশ্চয় করে বলুন যাতে আমি কল্যাণ লাভ করতে পারি।
|শ্রীভগবানুবাচ|
লোকেহস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ |
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাম্ কর্মযোগেন যোগিনাম || ৩||
অর্থ :শ্রীভগবান বললেন হে নিষ্পাপ অর্জুন! এই জগতে দুই প্রকার মোক্ষলাভের পথ আমি পূর্বে নির্দেশ করেছি-জ্ঞানাধিকারীদের জন্য জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগীদের জন্য কর্মযোগ।
ন কর্মণামনারম্ভান্নৈষ্কম্যং পুরুষোহশ্নুতে |
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||
অর্থ : কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু নিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ |
কার্যতে হ্যুবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||
অর্থ : কেউ কখনও ক্ষণকালের জন্যও কর্ম না করে থাকতে পারে না। প্রাকৃতজাত গুণের প্রভাবেই মানুষ কর্ম করতে বাধ্য হয়। সত্ত্ব, তম, রজ: এই তিনটি গুণ মানুষে রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। এই গুণের বশবতী হয়েই মানুষ কর্মে ব্রতী হয়।
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য আস্তে য মনসা স্মরন |
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||
অর্থ : যে মূঢ় ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি স্মরণ করতে থাকে লোকে তাকে মিথ্যাচার বলে।
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন |
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||
অর্থ :যিনি বিবেকযুক্ত মনের দ্বারা চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয় সংযত করেন এবং অনাসক্তভাবে কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করেন তিনিই বিশিষ্ট(শ্রেষ্ঠ)।
নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ |
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ || ৮ ||
অর্থ : তুমি শাস্ত্রবিহিত নিত্য কর্ম কর। কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। কর্মহীন হলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হবে না।
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ |
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||
অর্থ : ঈশ্বরের প্রীতির জন্য অনুষ্ঠ্তি কর্ম ভিন্ন অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ, সুতরাং তুমি অনাসক্ত হয়ে ঈশ্বরের প্রীতির জন্য শাস্ত্রবিহিত কর্ম কর।
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ |
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ || ১০ ||
অর্থ : সৃষ্টির প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা যজ্ঞাদিসহ প্রজাসকল সৃষ্টি করে বলেছিলেন- " এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও। এই যজ্ঞ তেমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূর্ণ করবে।"
দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ |
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||
অর্থ : তোমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রীত হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন। এভাবেই পরপস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে।
ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ |
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যা যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||
অর্থ : যজ্ঞের ফলে সন্তষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্চিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। কিন্তু দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাঁদের নিবেদন না করে যে ভোগ করে, সে নিশ্চই চোর।
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্য়ন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ |
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||
অর্থ :ভগবদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ |
যজ্ঞাদ ভবতি পর্জান্যে যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||
অর্থ :অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্ |
তস্মৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||
অর্থ :যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভুত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ য়ঃ |
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি || ১৬||
অর্থ : হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।
যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ |
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে || ১৭ ||
অর্থ :কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত এবং আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই।
নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন |
ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থ ব্যপাশ্রয়ঃ || ১৮ ||
অর্থ : আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য়ং কর্ম সমাচর |
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ || ১৯ ||
অর্থ :অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে।
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ |
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি || ২০ ||
অর্থ : জনক আদি রাজারাও কম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিৎ।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ |
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে || ২১ ||
অর্থ : শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুসরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারই অনুসরণ করে।
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন |
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি || ২২ ||
অর্থ :হে পার্থ ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
যদি হ্যহং নং বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ |
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যা পার্থ সর্বশঃ || ২৩ ||
অর্থ : হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হযে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্মচেদহম্ |
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪ ||
অর্থ :আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।
সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত |
কুর্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ || ২৫ ||
অর্থ : হে ভারত! অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমন জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে , মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্ |
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ || ২৬ ||
অর্থ : জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তারা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।
প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ |
অহংকারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে || ২৭ ||
অর্থ : অহঙ্কারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে ' আমি কর্তা'- এই রকম অভিমান করে।
তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ |
গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে || ২৮ ||
অর্থ : হে মহাবাহো! তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে, কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্তি হন না।
প্রকৃতের্গুণসংমূঢাঃ সজ্জন্তে গুণকর্মসু |
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ || ২৯ ||
অর্থ :জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।
ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা |
নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ || ৩০ ||
অর্থ : অতএব হে অর্জুন! অধ্যাত্মচেতনা-সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশূণ্য, নিষ্কাম ও শোকশূণ্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।
যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ |
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্মভিঃ || ৩১ ||
অর্থ : আমার নির্দেশ অনুসারে যে সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন , তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।
যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্ |
সর্বজ্ঞানবিমূঢাংস্তান বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ || ৩২ ||
অর্থ : কিন্তু যারা অসূয়াপূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত , বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।
সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যা: প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি |
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ||৩৩ ||
অর্থ : জ্ঞানবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যেকেই ত্রিগুনজাত তাঁর স্বীয় স্বভাবকে অনগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে?
ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ |
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ||৩৪ ||
অর্থ : সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ |
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ || ৩৫ ||
অর্থ :স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযক্ত হলেও উক্তমরুপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।
|অর্জুন উবাচ|
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পূরুষঃ |
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ || ৩৬ ||
অর্থ :অর্জুন বললেন হে বার্ষ্ণেয়! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়।
|শ্রীভগবানুবাচ|
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ |
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ || ৩৭ ||
অর্থ :পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভব কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শক্র বলে জানবে।
ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ |
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ || ৩৮ ||
অর্থ :অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।
আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা |
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ || ৩৯ ||
অর্থ : কামরুপী চির শক্রর দ্বারা শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।
ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে |
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ ||৪০ ||
অর্থ : ইন্দ্রিসমুহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।
তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ |
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ ||৪১ ||
অর্থ : অতএব হে অর্জুন! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরুপ এই কামকে বিনাশ কর।
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্য: পরং মনঃ |
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ || ৪২ ||
অর্থ : স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়, ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়, মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়, আর তিনি(আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধ্বা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা |
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ || ৪৩ ||
অর্থ : হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরুপ দুর্জয় শক্রকে জয় কর।
ইতি-কর্মযোগ নামক শ্রীমদ্ভগবতগীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র