মহাভারত:বনপর্ব-০৯৬-১০০

৯৬. যুধিষ্ঠিরের নিকট মার্কণ্ডেয় মুনির আগমন
জন্মেজয় বলে, মুনি কহ অতঃপর।
কোন কর্ম্ম করিলেন পঞ্চ সহোদর।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
আশ্রমেতে বাসিলেন ভাই পঞ্চজন।।
সমাপ্ত করিয়া কর্ম্ম নিত্য নিয়মিত।
ভোজনান্তে বসিলেন সকলে দুঃখিত।।
হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটন।
মার্কণ্ডেয় মুনি করিলেন আগমন।।
মহাতেজোবন্ত যেন দীপ্ত হুতাশন।
দেখিয়া সম্ভ্রমে উঠিলেন পঞ্চ জন।।
আগুসারি কত দূরে গিয়া পঞ্চ জনে।
প্রাণিপাত করিলেন মুনির চরণে।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন মার্কণ্ডেয় মুনি।
আর সবে প্রণমিল লোটায়ে ধরণী।।
সেইমত সম্ভাষেন ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী।
বসাইয়া মুনিরাজে মহা কুতূহলী।।
আনিয়া সুগন্ধি জল ধর্ম্মের নন্দন।
আপনি করেন ধৌত মুনির চরণ।।
পাদ্য অর্ঘ্য আদি দিয়া পূজে বিধিমতে।
সান্ত্বাইয়া তাঁরে লাগিলৈন জিজ্ঞাসিতে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, করি নিবেদন।
কহ শুনি, এখানে কি হেতু আগমন।।
মুনি বলে, ইচ্ছা হৈল তোমা দরশনে।
এই হেতু মম আগমন কাম্যবনে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভাগ্য ছিল যে আমার।
সেই হেতু নিজে প্রভু কৈলে আগুসার।।
এইরূপে নানাবিধ কথোপকথনে।
বসিলেন মহানন্দে সবে যোগ্য স্থানে।।
মহা অভিমানে ক্ষুব্ধ রাজা যুধিষ্ঠির।
বিরস বদনে বসিলেন নম্রশির।।
দেখিয়া মুনির মনে জন্মিল বিস্ময়।
সম্ভ্রমে জিজ্ঞাসে, কহ ধর্ম্মের তনয়।।
অভিপ্রায়ে বুঝি তব চিত্ত উচাটন।
মলিন বদন দেখি নিরানন্দ মন।।
বহু দুঃখ পাইয়াছ, অল্প আছে শেষ।
অতঃপর অবিলম্বে পাবে রাজ্য দেশ।।
কত শত কষ্ট সহিয়াছ নিজ অঙ্গে।
তথাপি থাকিতে নিত্য কথার প্রসঙ্গে।।
পাপরূপ চিন্তা হয়, বহু দোষ ধরে।
সুবুদ্ধি পণ্ডিত জানে মতি লোপ করে।।
বহু দুঃখে চিন্তা নাহি কর সে কারণে।
তাহা বুঝাইব কত তোমা হেন জনে।।
বহুদিন অন্তে আসি তব দরশনে।
তোমায় দুঃখিত হেরি দুঃখ পাই মনে।।
রাজা বলে, কিবা কহ মোরে মুনিবর।
আসাম সম দুঃখী নাহি ত্রৈলোক্য ভিতর।।
না হইল, না হইবে, আমার সমান।
উত্তম মধ্যমাধ্যমে দেখহ প্রমাণ।।
বড় বংশে জন্মিলাম পূর্ব্বভাগ্য ফলে।
পিতৃহীনে বিধি দুঃখ দিল অল্পকালে।।
পরান্নে বঞ্চিনু কাল পরের আলয়।
না জানিনু সুখ দুঃখ অজ্ঞান সময়।।
ছল করি যেই কর্ম্ম কৈল দুষ্টগণে।
পাইনু যতেক দুঃখ, জানহ আপনে।।
সে দুঃখ ভুঞ্জিয়া যেই তুলিলাম মাথা।
এমন সংযোগ আনি করিল বিধাতা।।
ছলেতে লইল দুষ্ট রাজ্য অধিকার।
ভ্রাতৃ পত্নীসহ হৈল বৃক্ষতলা সার।।
রাজপুত্র হতভাগ্য মোরা পঞ্চ জনে।
চিরকাল দুঃখে দুঃখে বঞ্চিনু কাননে।।
আমা সবাকার দুঃখ নাহি করি মনে।
ভুঞ্জিব কর্ম্মের ফল বিধির ঘটনে।।
রাজত্নী হয়ে কৃষ্ণা সমান দুঃখিতা।
মহারণ্যে ভ্রমে যেন সামান্য বনিতা।।
নানা সুখে বঞ্চে পূর্ব্বে পিতার আগারে।
এবে দুঃখ ভোগ করে আসি মম ঘরে।।
নারী মধ্যে হেন আর নাহি সুশিক্ষিতা।
দান ধর্ম্ম শিল্পকর্ম করণে দীক্ষিতা।।
যেন রূপ তেন গুণ একই সমান।
কতবার মহাকষ্টে কৈল পরিত্রাণ।।
নিজ দুঃখ হেরি সকাতন মন।।
বিশেষ শুনহ মুনি আজিকার কথা।
শূন্যালয় দেখিয়া আইল জয়দ্রথা।।
রন্ধনে আছিল কৃষ্ণা দেখি শূন্যঘরে।
হরিয়া লইতেছিল হস্তিনা-নগরে।।
পথে হেরি বাহুড়িল পঞ্চ সহোদর।
চক্ষুর নিমিষে তবে ধরে বৃকোদর।।
ধরিয়া তাহার চুলে করিল লাঞ্ছনা।
পরাণ রাখিল মাত্র শুনি মম মানা।।
কেবল তোমার মুনি চরণ-প্রসাদে।
নিমিষেতে পরিত্রাণ হৈনু অপ্রমাদে।।
এইমাত্র আশ্রমেতে আসি পঞ্চ জনে।
সে কারণে বসে আছি নিরানন্দ মনে।।
সহনে না যায় মুনি রমণী-লাঞ্ছনা।
ইহা হেতু মৃত্যু শ্রেয়ঃ বিবেচনা।।
আজন্ম পাইনু দুঃখ, নাহি পরিমাণ।
না হয়, না হবে দুঃখী আমার সমান।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির হেন বাক্য শুনি।
ঈষৎ হাসিয়া তবে কহে মহামুনি।।
কহিলে যতেক কথা ধর্ম্মের নন্দন।
দুঃখ হেন বলি, নাহি লয় মম মন।।
কি দুঃখ তোমার রাজা অরণ্য ভিতর।
ইন্দ্র চন্দ্র তুল্য সঙ্গে চারি সহোদর।।
বিশেষ সংহতি যার যাজ্ঞসেনী নারী।
মহিমা বর্ণিতে যার আমি নাহি পারি।।
এতেক ব্রাহ্মণ নিত্য করাও ভোজন।
যদি তুমি বনবাসী, গৃহী কোন জন।।
দয়া সত্য ক্ষমা শান্তি নিত্য দান ধর্ম্ম।
পৃথিবী ভরিয়া রাজা তোমার সুকর্ম্ম।।
নিশ্চয় কহিনু এই লয় মম মন।
বসুমতীপতি যোগ্য তুমি সে রাজন।।
অল্পদিনে দেখ রাজা কৌরবের অন্ত।
কহিনু তোমারে রাজা ভবিষ্য বৃত্তান্ত।।
আর যে কহিলে তুমি দুষ্ট জয়দ্রথে।
দ্রৌপদী লইতেছিল হস্তিনার পথে।।
নারীতে এতেক কষ্ট, কেহ নাহি পায়।
কিছু দুঃখ নাহি মনে আমার তাহায়।।
দ্রৌপদী হইতে শত গুণেতে দুঃখিতা।
লক্ষ্মীরূপা জনকনন্দিনী নাম সীতা।।
অনাদি পুরুষ যাঁর পতি নারায়ণ।
হরিয়া লইল তাঁরে লঙ্কার ‍রাবণ।।
দশ মাস ছিল বন্দী অশোক কাননে।
অবিরত প্রহার করিত চেড়ীগণে।।
তবে রাম মারি সব রক্ষ দুরাচার।
মহাক্লেশে করিলেন সীতার উদ্ধার।।
যতেক দুঃখের কথা বর্ণনে না যায়।
চতুর্দ্দশ বর্ষ ভ্রমি বনে মহাক্লেশে।
জটা বল্ক পরিধান তপস্বীর বেশে।।
দশ মাস মহাকষ্ট রামের বিচ্ছেদ।
কি দুঃখে কৃষ্ণার রাজা, কেন কর খেদ।।
মার্কণ্ডেয়-মুখে এত শুনিয়া বচন।
জিজ্ঞাসা করেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
নিবেদন করি মুনি, কর অবধান।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।।
কেন জন্ম নিল লক্ষ্মী দেব ‍নারায়ণ।
কি মতে তাঁহার সীতা হরিল রাবণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
৯৭. জয়-বিজয়ের প্রতি ব্রাহ্মণের অভিশাপ
ইহা কহিলেন যদি ধর্ম্মের নন্দন।
কৃপাবেশে কহিলেন মহা তপোধন।।
শুন যুধিষ্ঠির ধর্ম্মসুত নৃপমণি।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই অপূর্ব্ব- কাহিনী।।
যবে সত্যযুগ আসি করিল প্রবেশ।
বৈকুণ্ঠে ছিলেন প্রভু দেব হৃষীকেশ।।
দ্বাররক্ষা হেতু ছিল উভয় কিঙ্কর।
জ্যেষ্ঠ জয়, বিজয় কনিষ্ঠ সহোদর।।
একদিন দেখ রাজা দৈবের ঘটনে।
ব্রাহ্মণ যাইতেছিল কৃষ্ণ সম্ভাষণে।।
বেত্র দিয়া দ্বারে তাঁরে রাখে দুই জনে।
তবে ক্রোধেতে ক্ষিপ্ত হইয়া অপমানে।।
দ্বিজবর অভিশাপ দিল দুই জনে।
জন্ম লহ দোঁহে মর্ত্ত্যে আমার বচনে।।
বজ্রতুল্য দ্বিজবাক্য শুনি দুই জন।
দুঃখেতে চলিল যথা প্রভু নারায়ণ।।
কহিল শাপের কথা করিয়া বিশেষ।
কহিলেন শুনি তবে দেব হৃষীকেশ।।
আমা হৈতে শতগুণে শ্রেষ্ঠ দ্বিজবর।
হইল তাঁহার মুখে অলঙ্ঘ্য উত্তর।।
কাহার শকতি তাহা করিবে হেলন।
অবশ্য জন্মিবে ক্ষিতিমধ্যে দুই জন।।
জন্ম লহ দোঁহে মর্ত্ত্যে আমার বচনে।।
বজ্রতুল্য দ্বিজবাক্য শুনি দুই জন।
দুঃখেতে চলিল যথা প্রভু নারায়ণ।।
কহিল শাপের কথা করিয়া বিশেষ।
কহিলেন শুনি তবে দেব হৃষীকেশ।।
আমা হৈতে শতগুণে শ্রেষ্ঠ দ্বিজবর।
হইল তাঁহার মুখে অলঙ্ঘ্য উত্তর।।
কাহার শকতি তাহা করিবে হেলন।
অবশ্য জন্মিবে ক্ষিতিমধ্যে দুই জন।।
শুনিয়া নিষ্ঠুর কথা ঈশ্বরের মুখে।
জিজ্ঞাসা করিল দোঁহে অতিশয় দুঃখে।।
কর্ম্মদোষ দ্বিজবাক্য লঙ্ঘন না যায়।
কিরূপে শাপান্ত হবে, জন্মিব কোথায়।।
আজ্ঞা করি শীঘ্র পাই যাহাতে তোমায়।
কতকাল থাকিব ছাড়িয়া তব পায়।।
গোবিন্দ বলেন জন্ম লহ মর্ত্ত্যলোকে।
মোর মিত্রভাবে জন্ম লহ গিয়া যদি।
ভ্রমণ করিবে সপ্ত জনম অবধি।।
শত্রুরূপে হিংসা যদি করহ আমার।
গর্ভের যন্ত্রণা মাত্র, তিন জন্ম সার।।
চিন্তা না করিহ কিছু আমার হিংসনে।
আমিও জন্মিব গিয়া ভক্তের কারণে।।
শত্রুরূপে হিংসা যদি লহ তিন বারে।
শাপান্ত করিব আমি তিন অবতারে।।
এতেক প্রভুর মুখে শুনিয়া উত্তর।
মর্ত্ত্যেতে জন্মিল দোঁহে দুঃখিত অন্তর।।
মহাভারতের কথা মহাকাব্য ভাণ্ড।
দ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত অষ্টাদশ কাণ্ড।।
৯৮. হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপুরূপে
জয়-বিজয়ের মর্ত্ত্যে প্রথমবার জন্ম
এত শুনি কহেন ধর্ম্ম, চাহিয়া মুনি।
কিরূপে কোথায় জন্মে দোঁহে কহ শুনি।।
মার্কণ্ডেয় কন রাজা শুন জন্মকথা।
একদিন দিতিদেবী কশ্যপ বনিতা।।
পুত্রকাম্য করি গেল স্বামীর গোচর।
সায়ংসন্ধ্যা করিবারে যায় মুনিবর।।
দিতি বলে, পশ্চাৎ করিবে সন্ধ্যা তুমি।
আজ্ঞা কর, পুত্রকামা আইলাম আমি।।
মুনি বলে হৈল এই রাক্ষসী সময়।
ইথে পুত্র জন্ম হৈলে, কভু ভাল নয়।।
দিতি বলে, মুনিরাজ নহিলে না হয়।
মানস করহ পূর্ণ, জন্মাহ তনয়।।
হেনমতে এই কথা কহে যদি দিতি।
পুত্রবর দিয়া মুনি কহে দুঃখমতি।।
মুনি বলে, না শুনিলে আমার বচন।
হইবে অবশ্য তব যুগল নন্দন।।
মহাবল পরাক্রম আমার ঔরসে।
কিন্তু তারা দুষ্ট হবে সময়ের দোষে।।
ধর্ম্মপথ বিরোধি, জিনিবে ত্রিভুবন।
দেখিয়া দেবের দুঃখ প্রভু নারায়ণ।।
অবতরি নিজ হস্তে বধিবে দোঁহাকে।
তুমিহ পরম দুঃখ পাবে পুত্রশোকে।।
এতেক বিলল মুনি ভবিষ্য উত্তর।
নিজালয়ে গেল দিতি দুঃখিত অন্তর।।
মুনির ঔরসে আর দিতির গর্ভেতে।
জয়-বিজয়ের জন্ম হৈল হেনমতে।।
যথাকালে প্রসবিল দেবী দাক্ষায়ণী।
প্রত্যক্ষ হইল যত মুনির কাহিনী।।
জন্মকালে হৈল তবে বিবিধ উৎপাত।
ধরণী কাঁপিল শব্দে সঘনে নির্ঘাত।।
প্রাতঃকাল হৈতে যেন বাড়ে দিনকর।
জন্মমাত্র হৈল দোঁহে মহাবলধর।।
হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু দুই জন।
ধর্ম্মপথ বিরোধিতে করিলেক মন।।
যজ্ঞ নষ্ট করিয়া হিংসিল দেবগণে।
ইন্দ্রপদ লইয়া বসিল সিংহাসনে।।
একত্র হইয়া তবে যত দেবগণে।
নিজ দুঃখ জানাইল বিধাতার স্থানে।।
অতি দুঃখ পান ব্রহ্মা দেব-দুঃখ শুনি।
আশ্বাসিয়া কহিলেন তবে পদ্মযোনি।।
ভয় না করিয়া সবে যাহ যথাস্থানে।
পূর্ব্বেতে বিচার আমি করিয়াছি মনে।।
অখিল জীবের গতি দেব নারায়ণ।
তাঁহা বিনা নিস্তারিতে নাহি কোন জন।।
আমার বচনে ঘরে যাহ সর্ব্ব জন।
শুনিয়া আনন্দে সবে করিল গমন।।
অপূর্ব্ব শুনহ তবে রাজা যুধিষ্ঠির।
যুদ্ধ হেতু দৈত্যপতি হইল অস্থির।।
সুরাসুর সবে জিনে যত ত্রিভুবনে।
হেন জন নাহি, যুদ্ধ কর তার সনে।।
যুদ্ধ বিনা থাকিতে না পারে দৈত্যপতি।
মল্লযুদ্ধ করে হীনবলের সংহতি।।
হিরণ্যকশিপু ভায়ে রাখি সিংহাসনে।
আপনি চলিল দৈত্য যুদ্ধ অন্বেষণে।।
মহাপরাক্রমে ধায় গদা লয়ে হাতে।
দৈবযোগে নারদ সহিত দেখা পথে।।
মুনি দেখি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।
কার সনে যুদ্ধ করি কহ মহাশয়।।
নারদ বলেন, তব সম যোদ্ধা হরি।
দৈত্য বলে, তারে বল কোথা চেষ্টা করি।।
কহ মুনি, কোথা তার পাব দরশন।
তোমার প্রসাদে তবে সুখে করি রণ।।
নারদ বলেন, তুমি বিক্রমে বিশাল।
সেই ভয়ে লুকাইয়া আছেন পাতাল।।
ধরিয়া বরাহমূর্ত্তি আছে দুঃখমনে।
শীঘ্র গিয়া তথা, যুদ্ধ কর তাঁর সনে।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি, বিক্রমে বিশাল।
মুনিরাজে প্রণমিয়া প্রবেশে পাতাল।।
তথায় দেখিল পরিপূর্ণ সব জল।
না পায় হরির দেখা চিন্তে মহাবল।।
জলেতে গদার বাড়ি মহাক্রোধে মারে।
কহ হরি কোথা গেলে, ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।।
হেনকালে কৃপাসিন্ধু প্রভু নারায়ণ।
ভক্তের উদ্ধার হেতু দেন দরশন।।
কতদূরে গর্জ্জি দেব করে মহাশব্দ।
শুনিয়া দৈত্যের পতি হৈল মহাস্তব্ধ।।
মহাক্রোধে ধায় বীর গদা লয়ে হাতে।
দৈবাৎ বরাহ সহ দেখা হৈল পথে।।
হিরণ্যাক্ষ বলে, দেখ তোমার গর্জ্জন।
শুনিয়া কম্পিত তিন ভুবনের জন।।
নহে বা এমন দর্প হেথা কেবা করে।
নিশ্চয় মরিবে আজি আমার প্রহারে।।
বাক্যযুদ্ধ হৈল আগে, পরে গালাগালি।
পশ্চাতে করিল যুদ্ধ দুই মহাবলী।।
বিশেষ প্রকারে যুদ্ধ হৈল বহুতর।
বিস্তারিয়া সেই কথা কহিতে বিস্তর।।
তবে হরি বধিলেন দৈত্যেরে পরাণে।
কামরূপী বরাহ রহেন সেই স্থানে।।
হেথায় বিলম্ব হেরি যত পুরজন।
চিন্তিত হইল সবে, না বুঝে কারণ।।
কনিষ্ঠ আছিল তার অমরের রিপু।
সিংহাসনে মহারাজ হিরণ্যকশিপু।।
ভ্রাতার বিলম্ব দেখি চিন্তাকুল মন।
হেনকালে উপনীত ব্রহ্মার নন্দন।।
নারদে দেখিয়া দৈত্য আনন্দিত মনে।
হাতে ধরি বসাইল রত্ন-সিংহাসনে।।
মুনিরাজে জিজ্ঞাসিল ভ্রাতার বারতা।
নারদ কহিল, রাজা শুন তার কথা।।
যুদ্ধ হেতু তব ভ্রাতা ভ্রমি বহুকাল।
যোগ্য না দেখিয়া পাছে প্রবেশে পাতাল।।
পূর্ব্বে ক্ষিতি উদ্ধরিতে দেবদেব হরি।
দেবকার্য্য সাধিতে বরাহরূপ ধরি।।
দৈবযোগে তাঁর সহ দেখা রসাতলে।
দারুণ হইল যুদ্ধ দুই মহাবলে।।
তাঁর ঠাঁই হিরণ্যাক্ষ হইল নিধন।
এতদিন না জান এ সব বিবরণ।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি পায় বড় শোক।
এদিকে নারদ চলিলেন ব্রহ্মলোক।।
দৈত্যপতি বলে, মোর খণ্ডিল বিস্ময়।
বিষ্ণু সে আমার শত্রু জানিনু নিশ্চয়।।
তাহা বিনা না হিংসিব কভু অন্য জনে।
পাইব তাহার দেখা ধর্ম্মের হিংসনে।।
এতেক বিচারি দৈত্য করি বড় ক্রোধ।
যথা ধর্ম্ম, যথা যজ্ঞ, করয়ে বিরোধ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে সবে পায় ভয়।
নিস্তেজ হইল সবে গণিয়া প্রলয়।।
কত দিনান্তরে রাজা শুন বিবরণ।
প্রহ্লাদ নামেতে তার জন্মিল নন্দন।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।
৯৯. প্রহ্লাদ চরিত্র
শুন যুধিষ্ঠির রাজা অপূর্ব্ব কথন।
প্রহ্লাদ নামেতে তার জন্মিল নন্দন।।
দিনে দিনে হৈল শিশু মহাভক্তিমান।
বৈষ্ণবেতে নাহি কেহ তাহার সমান।।
নারায়ণ পরায়ণ শান্ত শুদ্ধমতি।
তাহার পরশে শুদ্ধ হয় বসুমতী।।
পুত্রের চরিত্র দেখি দুঃখিত অন্তরে।
নিযুক্ত করিল গুরু পড়াইতে তারে।।
আশ্চর্য্য, শুনহ বলি তার বিবরণ।
পাঠশালে গুরু বসি থাকে যতক্ষণ।।
কেবল রাখিয়া মাত্র পুস্তকেতে দৃষ্টি।
মনে মনে জপে নিজ নারায়ণ ইষ্টি।।
কার্য্য হেতু গুরু যবে যায় যথা তথা।
তবে শিশুগণে ডাকি কহে এই কথা।।
শুন ভাই, এই পাছে কোন্ প্রয়োজন।
না জানহ বড় শত্রু আছয়ে শমন।।
তরিয়া যাইবে আর নাহিক উপায়।
কৃষ্ণপদে রাখ চিত্ত, করো ‍নাহি দায়।।
এমত প্রকারে নিত্য কহে শিশুগণে।
আর দিন তারা সব কহিল ব্রাহ্মণে।।
শুনিয়া শিষ্যের কথা গুরু ধায় বেগে।
প্রহ্লাদ চরিত্র কহে নৃপতির আগে।।
বিপ্র বলে, ,শুন রাজা হইল প্রমাদ।
সকল করিল নষ্ট তোমার প্রহ্লাদ।।
যতেক পড়াই আমি, তাহে নাহি মন।
অনুক্ষণ জপে বিষ্ণু রাম নারায়ণ।।
কৃষ্ণ বিনা তার আর নাহি মনোরথ।
সকল বালকেরে সে কহে এই মত।।
এতেক বৃত্তান্ত যদি ব্রাহ্মণ কহিল।
ক্রোধভরে নরপতি পুত্রে ডাকাইল।।
জিজ্ঞাসিল, কহ বাপু বিচার কেমন।
আমার পরম শত্রু সেই নারায়ণ।।
কেবা সেই বিষ্ণু, তার চিন্তা কর বৃথা।
অধ্যাপক ব্রাহ্মণের নাহি শুন কথা।।
শিশু বলে, এই কথা পড়িলে কি হবে।
অনিত্য সংসার পিতা কেমনে তরিবে।।
না জান পরম শত্রু আছে যে শমন।
তাহে কে করিবে রক্ষা বিনা নারায়ণ।।
অখিল সংসার মাঝে যত চরাচর।
সেই নারায়ণ সর্ব্বভূতের ঈশ্বর।।
এ তিন ভুবনে আছে যাঁহার নিয়ম।
তাঁহার আশ্রয় নিলে কি করিবে যম।।
অসংখ্য তাঁহার মায়া কহনে না যায়।
সর্ব্বভূতে আত্মরূপে ভ্রমিয়া বেড়ায়।।
নিযুক্ত করেন নানা বুদ্ধি স্থানে স্থানে।
বৈরীরূপে সদা তুমি ভাব তাঁরে মনে।।
অভাগ্য তাহারে বলি, ভক্তি নাহি যায়।
চিরকাল দুঃখে ভ্রমে, মিথ্যা জন্ম তার।।
ধ্যান করি ব্রহ্মা যাঁর নাহি পান দেখা।
তুমি আমি কিবা ছার, তাহে কোন্ লেখা।।
আমার পরমারাধ্য সেই দেব হরি।
অশেষ বিপদ হতে যাঁর নামে তরি।।
তাহা ছাড়ি অন্য পাঠ পড়ে যেই জন।
অমৃত ছাড়িয়া করে গরল ভক্ষণ।।
শুনিয়া পুত্রের মুখে এতেক ভারতী।
মহাক্রোধে বলে তবে দানবের পতি।।
মোর বংশে হৈল এই দুষ্ট দুরাত্নন।
কাষ্ঠের ভিতর যথা থাকে হুতাশন।।
জন্মিলে পোড়ায়ে কাষ্ঠে করে ছারখার।
তেমতি জন্মিল দুষ্ট কুপুত্র আমার।।
আমার শত্রুর গুণ গায় অবিরত।
আত্মপক্ষ ত্যজি হয় পর অনুগত।।
না রাখিব এই শিশু মার এই কাল।
বিলম্ব হইলে বহু বাড়িবে জঞ্জাল।।
রাজার আদেশ শুনি যত দৈত্যগণ।
চতুর্দ্দিকে ধরি সবে করে প্রহরণ।।
একে একে করিল সকলে অস্ত্রাঘাত।
কিছুতেই না হইল তাহার নিপাত।।
বিস্ময় মানিয়া পুত্রে ডাকি দৈত্যপতি।
জিজ্ঞাসিল, কি প্রকারে পেলে অব্যাহতি।।
এখন করহ ত্যাগ শত্রুগণ কথা।
নিজ শাস্ত্র অধ্যয়ন করহ সর্ব্বথা।।
নিতান্ত যদ্যপি তোর আছে ইষ্টে মন।
করহ শিবের সেবা করিয়া যতন।।
প্রহ্লাদ কহিল, মোরে রাখিলেন হরি।
হরি সখা থাকিতে কে হয় মম অরি।।
কত শিব, কত ব্রহ্মা, কত দেব দেবী।
না ‍পায় যাঁহার অন্ত বহুকাল সেবি।।
আমার পরম ইষ্ট তাঁহার চরণ।
অন্য পাঠ পঠনেতে নাহি প্রয়োজন।।
এত শুনি মহাক্রোধে দৈত্যের ঈশ্বর।
কহে, শুনি মার আনি দন্তাল কুঞ্জর।।
আজ্ঞামাত্র ধাইল যতেক দৈত্যগণ।
প্রহ্লাদে বেড়িল আনি যতেক বারণ।।
অঙ্কুশ আঘাতে দন্ত দিল হস্তীগুলা।
অঙ্গে ঠেকি ভাঙ্গে যেন সুকোমল মূলা।।
বিস্ময় মানিয়া রাজা জিজ্ঞাসে বৃত্তান্ত।
কহ পুত্র কি প্রকারে ভাঙ্গে গজদন্ত।।
শিশু বলে, করীদন্ত বজ্রের সমান।
কি মতে ভাঙ্গিব আমি নহি বলবান।।
একান্ত আছয়ে যার নারায়ণে মতি।
তাহার করিতে মন্দ কাহার শকতি।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি অতি ক্রোধ মনে।
আদেশ করিল যত অনুচরগণে।।
যেইরূপে পার শীঘ্র মার এই পাপ।
ইহার জীবনে বড় পাইব সন্তাপ।।
ইহা শুনি যত দৈত্য প্রহ্লাদে ধরিল।
বিষম অনল জ্বালি তাহাতে ফেলিল।।
কৃষ্ণ বলি অগ্নি মাঝে পড়া মাত্র শিশু।
শীতল হইল বহ্নি, না হইল কিছু।।
দেখিয়া যতেক দৈত্য দুঃখিত অন্তর।
নিকটে পর্ব্বত ছিল অতি উচ্চতর।।
সবে মিলি গিরিশিরে প্রহ্লাদেরে তুলি।
পৃথিবী উপরে তারে ফেলাইল ঠেলি।।
পড়ে শিশু নারায়ণ চিন্তিয়া অন্তরে।
বালক শুইল যেন তূলার উপরে।।
দেখিয়া দৈত্যের পতি চিন্তাকুল মনে।
নিকটে ডাকিয়া তবে যত মল্লগণে।।
সংহার করিতে দিল তাহাদের হাতে।
কতেক প্রহার করি নারিল বধিতে।।
তবে রাজা নিকটেতে ডাকি বিপ্রগণে।
এক যজ্ঞ আরম্ভিল বধিতে নন্দনে।।
প্রহ্লাদে মারিতে কৈল যজ্ঞ আরম্ভণ।
তাহাতে হইল দগ্ধ সকল ব্রাহ্মণ।।
তবেত দেখিয়া শিশু দ্বিজের মরণ।
পরিত্রাহি ডাকে, রক্ষা কর নারায়ণ।।
এইত ব্রাহ্মণ হয় তোমার শরীর।
ইহার মৃত্যুতে আমি হইনু অস্থির।।
বিশেষে আমার হেতু ব্রাহ্মণের ক্লেশ।
আমারে করিয়া কৃপা রাখ হৃষীকেশ।।
তবে যদি ব্রাহ্মণ না হইবে সজীব।
অগ্নিতে প্রবেশ করি আমিহ মরিব।।
এরূপে করিল শিশু অনেক স্তবন।
ভক্ত-দুঃখ দেখি তবে দেব নারায়ণ।।
বাঁচাইতে দিলেন সে সকল ব্রাহ্মণে।
দেখিয়া প্রহ্লাদ হৈল আনন্দিত মনে।।
দৈত্যপতি শুনি এই সব সমাচার।
না জানিয়া মূঢ়মতি বলে পুনর্ব্বার।।
যাহ সবে সযত্নেতে, আন কালসাপ।
দংশিয়া মারুক আজি কুলাঙ্গার পাপ।।
রাজার আজ্ঞায় যায় যত দৈত্যগণ।
ভুজঙ্গ আনিয়া দিল করিতে দংশন।।
পরম বৈষ্ণব তেজ শিশুর শরীরে।
তাহাতে ভুজঙ্গ বিষ কি করিতে পারে।।
পাষাণ বান্ধিয়া তবে প্রহ্লাদের গলে।
ক্রোধমনে ফেলাইল সমুদ্রের জলে।।
শিশুর সন্ত্রাস কিছু নহিল তাহায়।
নিমগ্ন করিয়া চিত্ত গোবিন্দের পায়।।
ডাকিয়া বলিল শিশু, রাখহ সঙ্কটে।
তোমার কিঙ্কর মরে দুষ্টের কপটে।।
অবশ্য মরিব নাথ, দুঃখ নাহি তায়।
সবে মাত্র ভজিতে না ‍পেনু রাঙ্গা পায়।।
এরূপ অনেক মতে করিল স্তবন।
জানিয়া সেবক দুঃখ দেব নারায়ণ।।
পাষাণ ভাসিল জলে কৃষ্ণের কৃপায়।
বিষ্ণুভক্ত জনে কভু নাহিক সংশয়।।
তাহা অবলম্ব করি আপনার সুখে।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপে শিশু পরম কৌতুকে।।
জানিয়া একান্ত ভক্ত দেব দামোদর।
ভক্তের অধীন প্রভু আসিয়া সত্বর।।
কোলে করি আলিঙ্গন করেন তাহায়।
পদ্মহস্ত বুলাইলেন প্রহ্লাদের গায়।।
কহেন প্রহ্লাদে তবে, মাগ ইষ্টবর।
শুনিয়া কহিল শিশু যুড়ি দুই কর।।
যাহারে এতেক স্নেহ আছয়ে তোমার।
ব্রহ্মপদ তুচ্ছ তার, বর কোন ছার।।
ইঙ্গিতে ইন্দ্রের পদ দিতে পার তুমি।
কেবল লাঞ্ছনা তাহা, জানিলাম আমি।।
রাজ্য ধন ভ্রাতা পুত্র দারা পরিবার।
প্রভুপণে সবাকে করিব অহঙ্কার।।
মহামদে মত্ত হয়ে অনীতি করিব।
আছুক অন্যের দায় তোমা পাসরিব।।
ব্রহ্মপদে প্রভু মোর নাহি প্রয়োজন।
কেবল আমার বাঞ্ছা তোমার চরণ।।
তবে যদি বর দিবে অখিলের পতি।
কৃপা করি কর মোর পিতার সদগতি।।
শুনিয়া শিশুর মুখে এতেক কথন।
তুষ্ট হয়ে শ্রীগোবিন্দ দেন ‍আলিঙ্গন।।
প্রহ্লাদে কহেন, তুমি শরীর আমার।
মম সুখ দুঃখ ভোগ সকলি তোমার।।
উদ্ধার করিব আমি তোমার জনকে।
নিজালয়ে যাও তুমি পরম কৌতুকে।।
দুষ্ট দৈত্যগণে তুমি না করিহ ভয়।
যথা তুমি তথা আমি, জানিহ নিশ্চয়।।
এত বলি বৈকুণ্ঠেতে যান দৈত্যরিপু।
চর জানাইল যথা হিরণ্যকশিপু।।
শুন রাজা তোমার পুত্রের সমাচার।
পাষাণ ভাসিল জলে সহিত তাহার।।
নানাবিধ যন্ত্রণা দিলাম মোরা সবে।
না জানি, পাইল প্রাণ কার অনুভবে।।
শুনিয়া চরের মুখে এতেক বচন।
নিকটে ডাকিল দৈত্য আপন নন্দন।।
বিনাশকালেতে বুদ্ধি বিপরীত হয়।
চরগণে আদেশিয়া পুত্রকে আনায়।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, স্বর্গের সোপান।।
১০০. নৃসিংহাবতার ও হিরণ্যকশিপু বধ
নিকটে আনিয়া রাজা আপন সন্ততি।
মধুর বচনে কহে প্রহ্লাদের প্রতি।।
কহ পুত্র, বিস্ময় যে হৈল মোর মনে।
এতেক বিপদে তোরে রাখে কোন জনে।।
শিশু বলে, সর্ব্বভূতে যেই নারায়ণ।
সঙ্কট হইতে মোরে তরে সেই জন।।
নয়ন থাকিতে পিতা না হইও অন্ধ।
তোমারে কহিনু ঘুচাইয়া মনোধন্ধ।।
একান্ত হইয়া ভজ সেই বিষ্ণুপদ।
নষ্ট না করিহ পিতা এ সুখ সম্পদ।।
বিদ্যমানে দেখিলে যে মোরে বধিবারে।
কত না করিলে পিতা অশেষ প্রকারে।।
যত অস্ত্র প্রহারিল সব দৈত্যগণে।
হস্তীগন্ত ঠেকি দেহে ভাঙ্গে ততক্ষণে।।
শীতল হইল অগ্নি, দেখিলে পরীক্ষা।
পড়িনু পর্ব্বত হৈতে, তাহে পেনু রক্ষা।।
মহামত্ত মল্লগণ হৈল হীনদর্প।
আরো জান বিষহীন হৈল কালসর্প।।
প্রসাদে পাইনু রক্ষা যজ্ঞের অনলে।
সমুদ্রে ফেলিলে তবে শিলা বান্ধি গলে।।
সাক্ষাতে দেখিলে, জলে ভাসিল পাষাণ।
তথাচ নহিল দূর তোমার অজ্ঞান।।
এ হেন বিভব সুখ সম্পদ তোমার।
তাঁর ক্রোধে নিশিষেকে হবে ছারখার।।
ইহা শুনি দৈত্যপতি কহিল পুত্রেরে।
কোথা আছে তোর বিষ্ণু, কোন রূপ ধরে।।
শিশু বলে, আছে প্রভু সবার অন্তর।
অনন্ত যাঁহার রূপ, বেদে অগোচর।।
আব্রহ্ম পর্যন্ত্য কীট সকল সংসারে।
আত্মরূপে আছে প্রভু সবার ভিতরে।।
দৈত্য বলে, বিষ্ণু আছে সবার হৃদয়।
সংসার বাহির পুত্র এই স্তম্ভ নয়।।
ইতিমধ্যে বিষ্ণু যদি থাকিবে সর্ব্বথা।
যথার্থ জানিব তবে তোমার এ কথা।।
প্রহ্লাদ কহিল, শুন মোর নিবেদন।
যত জীব, তত শিব রূপে নারায়ণ।।
স্তম্ভমধ্যে অবশ্যই আছে মোর প্রভু।
অন্যথা আমার বাক্য না জানিহ কভু।।
শুনিয়া পুত্রের মুখে এতেক ভারতী।
নির্ণয় জানিতে তবে দৈত্য কুলপতি।।
হাতে গদা লয়ে উঠে করি মহাদম্ভ।
মধ্যখানে হানিলেক স্ফটিকের স্তম্ভ।।
হেনকালে শুন রাজা অপূর্ব্ব কাহিনী।
ভক্তবাক্য পালিবারে দেব চক্রপাণি।।
সেবকের বাক্য আর রাখিতে সংসার।
স্তম্ভমধ্যে আসি হরি হন অবতার।।
পূর্ব্বেতে ব্রহ্মার স্তবে ‍যিনি নারায়ণ।
মনুষ্য শরীর আর সিংহের বদন।।
স্তম্ভ মধ্যে নরসিংহ দেখে দৈত্যপতি।
দেখিল অনন্ত ‍সূক্ষ্ম অপূর্ব্ব আকৃতি।।
সুন্দর সিংহের মুখ মনুষ্য শরীর।
মুহূর্ত্তেকে স্তম্ভ হৈতে হইল বাহির।।
ক্রমে ক্রমে বাড়ে যেন প্রভাতের ভানু।
নরসিংহ বিস্তারিল ক্রমে নিজ তনু।।
দেখিয়া বিরাট মূর্ত্তি কাঁপে দৈত্যঘটা।
ব্রহ্মাণ্ড ঠেকিল গিয়া দিব্য সিংহজটা।।
গভীর গর্জ্জিয়া করে অট্ট অট্ট হাস।
শব্দ শুনি ত্রৈলোক্য মণ্ডলে হৈল ত্রাস।।
এমত প্রকারে রাজা দেব নরহরি।
হিরণ্যকশিপু দৈত্যে রোষভরে ধরি।।
ঊরুমধ্যে রাখি তারে বিদারিলা বুক।
মারেন দুরন্ত দৈত্য, দেবের কৌতুক।।
মহামূর্ত্তি দেখি ভয় পায় দেবগণ।
নির্ভয় প্রহ্লাদ মাত্র করিল স্তবন।।
কৃপা কর কৃপাসিন্ধু অনাথের নাথ।
ত্রৈলোক্য কাঁপিল শব্দ শুনিয়া নির্ঘাত।।
বিশেষ বিরাটমূর্ত্তি দেখিয়া তোমার।
সুরাসুর মূর্চ্ছাগত নর কোন ছার।।
সংবরহ নিজমূর্ত্তি, দেখি লাগে ভয়।
কি কারণে কর প্রভু অকালে প্রলয়।।
হেনমতে কহে শিশু হইয়া বিকল।
অন্তর্য্যামী নারায়ণ জানিল সকল।।
শান্তমূর্ত্তি হয়ে তবে কহে ভগবান।
না হল, না হবে, ভক্ত তোমার সমান।।
মহাভক্ত তুমি হও শরীর আমার।
চিরকাল কর সুখে রাজ্য অধিকার।।
একান্ত আমার ভক্তি না ছাড়িবে মনে।
তাপ না করিহ কিছু পিতার মরণে।।
জন্মিবে তোমার বংশে যত মহাবল।
অবশ্য আমার ভক্ত হইবে সকল।।
হেনমতে সান্ত্বাইয়া প্রহ্লাদ কুমার।
অভিষেক করি তারে দেন রাজ্যভার।।
এইমতে দুই ভাই শাপে মুক্ত হয়।
পুনর্ব্বার হৈল দোঁহে রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, শুনে লভে নর জ্ঞান।।

বেদ সম্পর্কে সামান্য ধারণা

শ্রীমদ্ভগবতগীতার সম্পূর্ণ শ্লোকের অর্থ

বিবিধ


মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র