২১. অর্জ্জুনের দশ নামের কারণ ও গান্ধারীসহ কুন্তীর শিব পূজা লইয়া বিরোধঅর্জ্জুন বলেন, শুন বিরাট-নন্দন।দশ নাম-হেতু তোমা বলিব এখন।।হস্তিনা নগরে পূর্ব্বে ছিলাম যখন।আমার জননী পূজা করে পঞ্চানন।।স্বয়ম্ভূ পাষাণ লিঙ্গ নাম যোগেশ্বরে।রাজপত্নী বিনা অন্যে পূজিতে না পারে।।প্রভাতে উঠিয়া মাতা করি স্নান দান।নানা উপচারে হরে পূজিবারে যান।।যেইরূপে শিবলিঙ্গ পূজিতে জননী।সেইরূপে সদা পূজে সুবলনন্দিনী।।দোঁহে শিব পূজে, কেহ কাহারে না জানে।দৈবযোগে দোঁহাকারে দেখা এক দিনে।।গান্ধারী বলেন, কুন্তী কেন তুমি হেথা।ফল পুষ্প দেখি, বুঝি পূজিতে দেবতা।।মাতা বলে, সদা আমি করি যে পূজন।তুমি বল এই স্থানে কিসের কারণ।।গান্ধারী বলেন, রাঁড়ি এত গর্ব্ব তোর।কিমতে পূজিস্ লিঙ্গ, সংপূজিত মোর।।রাজার গৃহিনী আমি, রাজার জননী।কোন ভরসায় তুমি পূজ শূলপাণি।।মাতা বলে, গান্ধারী গো বল কেন এত।তুমি জ্যেষ্ঠা ভগিনী যে, তেঁই বল যত।।যেই দিন আমি আসিয়াছি কুরুকুলে।সর্ব্বলোকে জানে আমি পূজি ফল ফুলে।।কত দিন আছিলাম বনের ভিতর।সেই হেতু পূজিবারে পেলে যোগেশ্বর।।এখন আপন দেশে আসিলাম আমি।আমার পূজিত লিঙ্গ কেন পূজা তুমি।।জিজ্ঞাসহ ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র বিদুরেরে।মম এই ইষ্টলিঙ্গ কে পূজিতে পারে।।গান্ধারী বলিল, ছাড় পূর্ব্ব অহ্ঙ্কার।এখন তোমার শিবে কোন্ অধিকার।।সবাকার অনুমতি, পূজি আমি হরে।আপনি জিজ্ঞাস গিয়া সবাকার তরে।।দূর কর ফল পুষ্প, যাহ হেথা হৈতে।ভাল নাহি হবে পুনঃ আসিলে পূজিতে।।মাতা বলে, যত দিন নাহি ছিনু দেশে।তেঁই সবে বুঝি বলে পূজিতে মহেশে।।পুনশ্চ ভগিনী আর না আসিও হেথা।শিবপূজা কৈলে দ্বন্দ্ব ঘটিবে সর্ব্বথা।।এইমত দ্বন্দ্ব হয় দুই ভগিনীর।লিঙ্গ ভেদি সদাশিব হলেন বাহির।।কহিলেন, কেন দ্বন্দ্ব কর দুই জন।দ্বন্দ্ব ত্যজি শুন দোঁহে আমার বচন।।সবাকার ইষ্ট আমি, সবে পূজা করে।কার শক্তি আছে মোরে অংশ করিবারে।।অর্দ্ধ অঙ্গ হয় মম পর্ব্বত-কুমারী।কোন জন নিতে নারে মোরে অংশ করি।।তোমা দোঁহে কুরুবধূ সমান ভকতি।দোঁহের পূজায় হয় মোর বড় প্রীতি।।আপনার বলি বল, আমি কারু নই।কিন্তু রাজরমণীর পূজ্য আমি হই।।দোঁহে রাজপত্নী তোমা, দোঁহে রাজমাতা।উভয়ে আমার পূজা করহ সর্ব্বথা।।এক জন হয়ে যদি চাহ পূজিবারে।তবে মম দৃঢ় বাক্য কহি দোঁহাকারে।।কনকের দল হবে, মাণিক্য কেশর।সুগন্ধি সহস্র চাঁপা, অতি মনোহর।।রজনী প্রভাতে যেই প্রথমে পূজিবে।নিশ্চয় জানিহ শিব তাহারি হইবে।।এমত বিধানে যেই করিবেক পূজা।তার পুত্র জানিহ এ রাজ্যে হবে রাজা।।শুনিয়া শিবের বাক্য গান্ধারী উল্লাস।মাতারে চাহিয়া বলে করি উপহাস।।নিশ্চয় তোমার এবে হৈল মহেশ্বর।পুত্রগণে চম্পা মাগি আনহ সত্বর।।এত বলি নিজ গৃহে করিল গমন।ডাকাইয়া আনাইল শত পুত্রগণ।।কহিল কুন্তীর সহ দ্বন্দ্ব যেই মতে।হেম চাঁপা দেহ, শিবে পূজিব প্রভাতে।।সাক্ষাৎ ইহা কহিলেন ত্রিপুরারি।যে পূজিবে, তার পুত্র রাজ্য-অধিকারী।।শুনি দুর্য্যোধন আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।সহস্র সহস্র আনাইল কর্ম্মিগণ।।মণিমুক্তা দিল চন্দ্র জিনিয়া কিরণ।ভাণ্ডার হইতে দিল স্বর্ণ শত মণ।।আমার জননী শুনি হরের বচন।অতি দুঃখ চিত্তে চলে, আপন ভবন।।স্বামীহীন, পুত্র শিশু, সহজে দুঃখিত।পরগৃহে বঞ্চি পর-অন্নেতে পালিত।।কি করিব, কি হইবে, চিত্তে ভাবি দুঃখ।কারে কিছু নাহি কহিবাহে অধোমুখ।।ভোজন সময় হৈলে আসে ভ্রাতৃগণ।ক্ষুধায় আকুল ভীম মাগিল ভোজন।।অন্ন দেহ মাতা বলি ডাকে বৃকোদর।দুঃখেতে আবৃত মাতা, না দিল উত্তর।।উত্তর না পেয়ে ভীম অধিক কুপিল।রন্ধন সামগ্রী ছিল সাক্ষাতে দেখিল।।সকল লইল ভীম দুই হাতে করি।থরে থরে রাখে বীর ধর্ম্ম বরাবরি।।ধর্ম্ম কন, নিজে খাদ্য কেন আন হেথা।ভীম কন, মাতা কেন নাহি কহে কথা।।দ্বিতীয় প্রহর বেলা, অন্ন নাহি হয়।জিজ্ঞাসিলে মাতা কিছু, কথা নাহি কয়।।অস্ত্রশিক্ষা পরিশ্রমে দহে ক্ষুধানল।সে কারণে আনিলাম আমান্ন সকল।।রন্ধন হইলে অন্ন খাব রাজা পাছু।আজ্ঞা হৈলে এইমত খাই কিছু কিছু।।যুধিষ্ঠির বলিলেন, খাবে কোন্ সুখে।জননী আছেন কেন জান অধোমুখে।।কি দুঃখে তাপিতা মাতা, না জানি কারণ।আমান্ন করিবে ভাই কিমতে ভক্ষণ।।পুনঃ গিয়া শীঘ্র ভাই জিজ্ঞাসহ মায়।কি হেতু বসিলে হেঁট করিয়া মাথায়।।ভীম বলে, আমা হতে নহে নরবর।অনেক ডাকিনু, মাতা না দিল উত্তর।।ক্ষুধানলে দহে অঙ্গ, কম্পিত সঘন।এত বলি বৈসে হেঁট করিয়া বদন।।সহদেব নকুলেরে পাঠান রাজন।কাহারে কিছুই মাতা না বলে বচন।।আমারে করিল আজ্ঞা ধর্ম্ম নরপতি।জননীর পায়ে ধরি করিনু মিনতি।।তুমি দুঃখচিত্ত, রাজা দুঃখিত হইল।ক্ষুধায় আকুল ভীম কুপিয়া রহিল।।সহদেব নকুল যে ক্ষুধিত অপার।আজ্ঞা কর জননী গো কি দুঃখ তোমার।।শুনিয়া কহেন মাতা করিয়া ক্রন্দন।দোঁহাকার পাশে যথা শঙ্কর বচন।।সহস্র কাঞ্চন চাঁপা চাহে ত্রিলোচন।গান্ধারী আজ্ঞায় সব গড়ে শিল্পিগণ।।কি করিবে তোমা সবে, কি হবে কহিলে।এই হেতু দহে অঙ্গ দুঃখের অনলে।।আমি কহিলাম, মাতা এবা কোন্ কথা।যত পুষ্প চাহ, আমি তত দিব মাতা।।মাতা বলে, কেন তুমি করহ ভণ্ডন।তুমি কোথা হৈতে দিবে, কোথা পাবে ধন।।আমি কহিলাম, মাতা ত্যজ চিন্তা মন।আমি কহিলাম, মাতা ত্যজ চিন্তা মন।কোন্ বড় কথা হেতু করিব ভণ্ডন।।রন্ধন করহ মাতা, অন্ন জল খাহ।আমি দিব পুষ্প আনি, তুমি যত চাহ।।শুনি হৃষ্টা হৈয়া মাতা করিল রন্ধন।সবাকারে অন্ন দিয়া করান ভোজন।।কতক্ষণে বলিলেন পুষ্প দেহ আনি।সমস্ত দিবস গেল হইল রজনী।।কখন কনক পুষ্প দিবে মোরে আর।এইমত মাতা মোরে কহে বারে বার।।আমি যত বলি মাতা প্রবোধ না হয়।সমস্ত রজনী গেল প্রভাত সময়।।ধনুক লইয়া আমি গুণ চড়াইয়া।সন্ধানী যুগল অস্ত্র উত্তর চাহিয়া।।দ্রোণাচার্য্য গুরুপদে নমস্কার করি।বায়ব্য যুগল মনোভেদী অস্ত্র মারি।।কাটিয়া কুবেরপুরী পুষ্পের কানন।বায়ু অস্ত্রে উড়াইয়া করি বরিষণ।।সুগন্ধি কনক-পদ্ম চম্পক-মিশ্রিত।শিবের উপরে বৃষ্টি হৈল অপ্রমিত।।বাহির ভিতর আর দেউল উদ্যান।পুষ্পেতে পূর্ণিত হৈল, নাহি হেন স্থান।।জননীকে বলিলাম, যাহ স্নান করি।পুষ্প আনিলাম গিয়া পূজ ত্রিপুরারি।।কৌতুকে জননী গিয়া মহেশে পূজিল।তুষ্ট হয়ে সদানন্দ মায়ে বর দিল।।তব পুত্রগণ হবে কুরুকুলে রাজা।আজি হৈতে একা তুমি কর মম পূজা।।আমারে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন বচন।ধনপতি জিনি তুমি করিলে পূজন।।আজি হৈতে নাম তব হৈল ধনঞ্জয়।সেই হৈতে মোর নাম ধনঞ্জয় হয়।।উত্তর কহিল, কহ বীর চূড়ামণি।কি করিল শুনি তবে সুবলনন্দিনী।।অর্জ্জুন বলেন, প্রাতে উঠিয়া গান্ধারী।সহস্র কনক-পুষ্প হেমপাত্রে করি।।কুসুম চন্দন আর বহু উপাচারে।নারীগণ সহ যান পূজিতে শঙ্করে।।শিবের আলয় দেখি পুষ্পেতে পূর্ণিত।যাইতে নাহিক পথ, কে করে গণিত।।দেখিয়া গান্ধারী দেবী বিষণ্ণ বদন।কুন্তীরে দেখিয়া বলে, কহ বিবরণ।।মাতা বলে, এই পুষ্পে পূজিলাম আমি।বর দিয়া নিজ স্থানে গেল উমাস্বামী।।শুনিয়া গান্ধারী ক্রোধে পুষ্প জলে ফেলে।গৃহে গিয়া নিজ পুত্রগণে মন্দ বলে।।সাধু কুন্তী, সাধু পুত্র গর্ভেতে ধরিল।অকারণে শত পুত্র আমার জন্মিল।।মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।২২. অর্জ্জুনের বীভৎসু ও অন্যান্য নামের বিবরণপার্থ বলিলেন, শুন বিরাট-নন্দন।কহি এবে আর নাম যাহার কারণ।।বিজয় বলিয়া ডাকে সকলে আমারে।বিজয় করিয়া আসি, যাই যথাকারে।।শ্বেতবর্ণ চারি অশ্ব মম রথ বহে।শ্বেতবাহনক বলি লোকে মোরে কহে।।সূর্য্য অগ্নি সম মম কিরীট যে মাথে।কিরীটী দিলেন নাম তেঁই সুরনাথে।।বীভৎসু বলিয়া ডাকিলেন নারায়ণ।কহিব বিরাট পুত্র তাহার কারণ।।এক দিন কৃষ্ণ সহ নৈমিষ-কাননে।জিজ্ঞাসা করেন কৃষ্ণ সহায্য বদনে।।ধন্য ধনঞ্জয় তুমি, বলে মহাবল।তোমা সম বীর নাহি ধরণীর তল।।লক্ষ রাজা জিনি কৃষ্ণা নিলে স্বয়ম্বরে।জিনিলে অঙ্গারপর্ণ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বরে।।খাণ্ডব দহিয়া অগ্নি নির্ব্যাধি করিলে।ইন্দ্র সহ সুরাসুর সমরে জিনিলে।।কুবেরে জিনিয়া ধন আনিলে সকল।তিন লোক আসি খাটে তব ছত্রতল।।মহাভার ধরণী ধরিলে বাহুবলে।বাহুযুদ্ধে সদানন্দে সন্তোষ করিলে।।তপেতে তাপিলে তুমি হিমালয় গিরি।চক্ষুর কোণেতে নাহি চাহ পরনারী।।যে ঊর্ব্বশী দেখি ব্রহ্মা হলেন মোহিত।যে জন তোমার ঠাঁই হইল লর্জ্জিত।।বীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তুমি, তপেতে প্রধান।জিতেন্দ্রিয় রূপে গুণে কামের সমান।।এ তিন ভুবনে নাহি দেখি এক জনা।তোমার সদৃশ রূপগুণের তুলনা।।আমা হৈতে শতগুণে তোমারে বাখানি।তোমার সদৃশ কেবা আছে বীরমণি।।আমি হেন নাহি দেখি সংসার ভিতরে।তুমি যদি জান আছে, দেখাহ আমারে।।আমি কহিলাম বহু করিয়া প্রকার।ধাতার সৃজিত এই সকল সংসার।।আমা হৈতে অধিক আছয়ে রূপে গুণে।নাহি বলি শ্রীগোবিন্দ বল কি কারণে।।গোবিন্দ বলেন, সখা দেখাহ আমারে।আপন সদৃশ জন কে আছে সংসারে।।পুনঃ পুনঃ শ্রীগোবিন্দ বলেন আমারে।গোবিন্দের আজ্ঞা পেয়ে গেলাম সত্বরে।।স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল ভ্রমি ত্রিভুবন।আপন সদৃশ নাহি দেখি কোন জন।।কৃষ্ণের উদ্দেশে মনে করি বিবেচন।মম সম নাহি পাই এ তিন ভুবন।।আপন সদৃশ জন কারে না দেখিয়া।পুরীষ নিলাম আমি বসনে বান্ধিয়া।।গোবিন্দের আগে করিলাম নিবেদন।আমা হেন ত্রিভুবনে নাহি কোন জন।।তোমার মুখেতে পূর্ব্বে শুনিয়াছি আমি।যত জীব তত্র শিবরূপে আছ তুমি।।ব্রহ্ম কীট তৃণাদিতে তুমি আত্মা রূপে।তিনলোকে নাহি পাই আমার স্বরূপে।।ভাবিয়া চিন্তিয়া এই বুঝিলাম সার।তোমাতে পূরিত এই সকল সংসার।।আপন সদৃশ নাহি পাই এক জন।আমি যার তুল্য আনিয়াছি নারায়ণ।।হয় নয় সমতুল করিতে না পারি।আনিয়াছি জগন্নাথ দেখাইতে ডরি।।অন্তর্য্যামী বাসুদেব সকল জানিয়া।ফেলাহ ফেলাহ বলি বলেন ডাকিয়া।।কি কারণে ধনঞ্জয় এতেক ন্যূনতা।যেই আমি সেই তুমি, নহেক অন্যথা।।তোমায় আমায় কিছু নাহি ভেদাভেদ।ব্রহ্মা শিব জানে ইহা, জানে চারি বেদ।।এত বলি শ্রীগোবিন্দ করি আলিঙ্গণ।দিলেন বীভৎসু নাম করি নিরূপণ।।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।৩. অর্জ্জুনের অবশিষ্ট নামের ও ক্লীবত্বের বিবরণপার্থ বলিলেন, শুন বিরাট কুমার।যেই হেতু যেই নাম, হইল আমার।।দুই ভুজে ধনু আমি ধরি সমান।সমান প্রয়োগ অস্ত্র, সমান সন্ধান।।গুণের ঘর্ষণে দেখ কঠিন দুহাত।তেঁই সব্যসাচী নাম লোকে হৈল খ্যাত।।সসাগরা ধরাতলে রহে যত জন।রূপেতে আমার সম নাহি অন্য জন।।সমান দেখিয়া সবে মোর রূপ গুণ।এ কারণে মম নাম রাখিল অর্জ্জুন।।ফল্গুনি নক্ষত্র মধ্যে জনম আমার।ফাল্গুনী বলিয়া তেঁই ঘোষয়ে সংসার।।চতুর্দ্দশ ভুবনেতে ইন্দ্র-অধিপতি।ইন্দ্র ভুজাশ্রিত যত ইতিমধ্যে স্থিতি।।সবারে জিনিয়া ইন্দ্র জিষ্ণু নাম ধরে।এবে ইন্দ্র সহ জয় করিনু সবারে।।সে কারণে সবে মিলি যত দেবগণ।জিষ্ণু নাম মোরে সবে করেন অর্পণ।।নীলোৎপল কৃষ্ণবর্ণ দেখি মম কায়।কৃষ্ণ নাম বলি তাত রাখিল আমার।।প্রতিজ্ঞা আমার শুন বিরাটনন্দন।যুধিষ্ঠির রক্তপাত করিবে যে জন।।সবংশে মারিয়া তারে করিব নিপাত।পূর্ব্বাপর সত্য মম, সব লোকে জ্ঞাত।।এত শুনি রাজসুত ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে।কহিতে লাগিল পুনঃ প্রণাম করিয়ে।।হে বীর কমল-চক্ষে চাহ একবার।অজ্ঞানের অপরাধ ক্ষমহ আমার।।বহুদোষে দোষী আমি তোমার চরণে।সে সকল কিছু আর না করিবে মনে।।যে যে কর্ম্ম তুমি করিয়াছ মহামতি।তোমা বিনা করে হেন কাহার শকতি।।বড় ভাগ্য মম জনকের কর্ম্মফলে।শরণ লইনু আমি তব পদতলে।।কৃষ্ণের আশ্রিত যেন তোমা পঞ্চ জন।তেন আমি তব পদে নিলাম শরণ।।যদি অনুগ্রহ তুমি করিলে আমায়।দাস হয়ে সদা আমি সেবিব তোমায়।।অর্জ্জুন বলেন, প্রীত হলেম তোমারে।ধনু অস্ত্র লয়ে তুমি আইস সত্বরে।।কুরুগণে জিনি তব গোধন অর্পিব।মহা আর্ত্ত আজি কুরুসৈন্যেরে করিব।।কুরুসৈন্য সিন্ধু রাখে শত্রুগণ ভুজে।সকল দহিব আমি অস্ত্র অগ্নিতেজে।।পাছে তুমি ভয় কর সংগ্রামের স্থলে।আমার রক্ষণে তব ভয় নাহি তিলে।।উত্তর বলিল, মোর আর ভয় কারে।ধনঞ্জয় মহাবীর রাখিবে যাহারে।।তব পরাক্রম আমি ভালমাতে জানি।নাহি মোর ভয়, যতি আসে শূলপাণি।।এ বড় অদ্ভুত কথা জাগে মোর মনে।এ রূপেতে কাল কাট কিসের কারণে।।কি কারণে নপুংসক হৈলে মহাবল।ইহার বৃত্তান্ত মোরে কহিবে সকল।।নিরন্তর এই কথা মনে মোর ছিল।এ হেন শরীরে কেন ক্লীবত্ব পাইল।।অর্জ্জুন বলেন, শুন বিরাট-নন্দন।অরণ্যেতে যবে মোরা ছিনু পঞ্চ জন।।যুধিষ্ঠির আজ্ঞা লয়ে যাই হিমগিরি।শিবেরে সন্তোষ কৈনু উগ্র তপ করি।।তুষ্ট হৈল পশুপতি দেব ত্রিলোচন।তাঁর অনুগ্রহে তুষ্ট হৈল দেবগন।।কুবের বরুণ যম অস্ত্রগণ দিল।মাতলি পাঠায়ে ইন্দ্র স্বর্গে মোরে নিল।।নিবাতকবচ আর কালকেয় গণ।স্বর্গে আসি উপদ্রব করে সর্ব্বক্ষণ।।লুটিয়া পুটিয়া স্বর্গ করে ছারখার।দৈত্য-ভয়ে দেবে দুঃখ হইল অপার।।সব দুষ্টগণে আমি একা সংহারিনু।সকল অমরপুরী নিষ্কণ্টক কৈনু।।যতেক অমরগণ আনন্দিত হৈল।তুষ্ট হয়ে দেবগণ মোরে বর দিল।।ধন্য ধন্য ধনঞ্জয় কুন্তীর নন্দন।তোমা সম বীর নাই এ তিন ভুবন।।অচিরে হইবে তব দুঃখ বিমোচন।কৌরব জিনিয়া প্রাপ্ত হবে রাজ্যধন।।এরূপে অমরপুরী আছি কত দিন।নানাবিদ্যা শস্ত্র-শাস্ত্র করিনু পঠন।।দৈবে একদিন পিতা দেব পুরন্দর।নৃত্যগীত করাইল অপ্সরী অপ্সর।।ঊর্ব্বশী নামেতে তাহে ছিল বিদ্যাধরী।সবার সে শ্রেষ্ঠা হয় পরমা সুন্দরী।।যত যত বিদ্যাধরী কৈল নৃত্য গীত।চক্ষু মেলি নাহি চাহিলাম কদাচিত।।দেখিলাম ঊর্ব্বশীর নর্ত্তন নিমিষে।সে কারণে নিশাযোগে আসে মম পাশে।।প্রার্থিল কামতৃষ্ণা করিবারে পূরণ।প্রত্যাখান করিলে সে কহিল তখন।।সকল অপ্সরা ত্যজি মোরে নিরখিলে।সে কারণে আসিলাম এই নিশাকালে।।না করিলে মম তোষ পুরুষের কাজ।ক্লীবত্ব পাইয়া থাক স্ত্র্রীগণের মাঝ।।শুনিয়া বিনয় ভাষে কহিলাম তায়।কামভাবে আমি নাহি দেখিনু তোমায়।।পূর্ব্ব-পিতামহ যে যে পুরুষ পুরাতন।তোমার গর্ভেতে জন্মাইল পুত্রগণ।।অনেক পুরুষ পূর্ব্ব হতে হয়ে গেল।তোমার যুবতী দশা স্লান না পাইল।।এই হেতু পুনঃ পুনঃ দেখেছি তোমারে।কুলের জননী, কৃপা করিবে আমারে।।কুন্তী মাদ্রী যথা মম, যথা শচীন্দ্রাণী।ততোধিক তোমা আমি গরিষ্ঠেতে গণি।।আপনার বংশ বলি জানহ আমারে।লজ্জা পেয়ে ঊব্বশী যে কহে আরবারে।।যজ্ঞ ব্রত ফলে তব যত পিতৃগণ।ইন্দ্রের ভুবনে আসি থাকে হৃষ্ট মন।।সবে মোর সহ করে রতি-ব্যবহার।কেহ নাহি করে, যথা তোমার বিচার।।কহিল আমার শাপ নহিবে লঙ্ঘন।বৎসরেক ক্লীব রবে বিরাট ভবন।।শাপ হতে বর তুল্য হবে তব কাজ।অন্য বেশে লুকাইতে নার ক্ষিতিমাঝ।।বরষ রহিবে, বলি করে নিরূপণ।এই ক্লীবত্বের হেতু বিরাট নন্দন।।বৎসরেক ক্লীব হইলাম সেই দায়।সদাকাল ক্লীব আমি পরের দারায়।।উত্তর বলিল, মোরে হৈলে কৃপাবান।তেঁই মোরে নিজ কর্ম্ম করিলে বাখান।।আজ্ঞা কর কোন্ ধর্ম্ম করিব এখন।শুনিয়া অর্জ্জুন বীর বলেন বচন।।সারথি হইয়া তুমি বৈস মম রথে।কৌতুক দেখহ কুরুসৈন্যের মধ্যেতে।।উত্তর বলিল, আমি তোমার প্রসাদে।সকল ভুবন আজি দেখি তৃণপদে।।ইন্দ্রের মাতলি কিম্বা দারুক সারথি।তাদৃশ সারথ্য কর্ম্মে আমার শকতি।।বিশেষ তোমার ভুজাশ্রিত মহাবলী।এখনি লইব রথ সৈন্য মধ্যস্থলী।।মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে অনুব্রত।।২৪. অর্জ্জুনের রণসজ্জাতবে পার্থ মায়ারথ করেন স্মরণ।অগ্নিদত্ত কপিধ্বজ, শ্বেত অশ্বগণ।।পার্থ চিন্তা করামাত্র আসে সেইক্ষণ।কনক রচিত বিশ্বকর্ম্মার গঠন।।উত্তরের রথ হৈতে নামি ধনঞ্জয়।প্রদক্ষিণ করি তাহে করেন আশ্রয়।।পূর্ব্বের কুণ্ডল বীর ত্যজিয়া শ্রবণে।ইন্দ্রদত্ত কুণ্ডল যে দেন দুই কাণে।।বেণী ঘুচাইয়া শিরে উষ্ণীষ বন্ধন।ইন্দ্র দ্ত্ত কুণ্ডল যে দেন দুই কাণে।।বেণী ঘুচাইয়া শিরে উষ্ণীব বন্ধন।ইন্দ্রদত্ত কিরীটের করে বিভূষণ।।খড়্গ ছুরি তূণ আদি বাঁধিয়া কাঁকালি।গাণ্ডীব ধরিয়া গুণ দেন মহাবলী।।গুণ দিয়া ধনুকেতে দিলেন টঙ্কার।বজ্রাঘাতে গিরি যেন হইল বিদার।।দশদিক পূর্ণ হৈল, কম্পিত ধরণী।বধির হইল কর্ণ, কিছু নাহি শুনি।।শমী প্রদক্ষিণ করি রথ আরোহিয়া।চলিল উত্তরে রথে সারথি করিয়া।।সুগ্রীব পুষ্পক মেঘ আর বলাহক।শ্রীকৃষ্ণের হয় চারি সুন্দর ঘোটক।।শ্বেত-বাহনের অশ্ব ইহাদের সম।চালাল বৈরাটী অশ্ব অতি মনোরম।।চলিবার কালে তবে পাণ্ডব ফাল্গুনী।ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করে শঙ্খধ্বনি।।গর্জ্জিল রথের চক্র, গর্জ্জে কপিধ্বজ।মূর্চ্ছা হয়ে পড়ে রথে বিরাট অঙ্গজ।।প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জ্জিল গগন।শত বজ্র এক কালে যেমত নিঃস্বন।।স্থাবর জঙ্গম কাঁপে সপ্তসিন্ধু জল।শব্দ শুনি ভয়াকুল হৈল কুরুবল।।মূর্চ্ছিত দেখিয়া পার্থ বিরাট কুমারে।আশ্বাসিয়া সচেতন করেন তাহারে।।ক্ষত্রপুত্র হয়ে তুমি কেন এইমত।শব্দমাত্র শুনি কেন হৈলে জ্ঞানহত।।লক্ষ লক্ষ হবে যবে ধনুক টঙ্কার।এককালে শঙ্খনাদ হইবে সবার।।তখন সংগ্রাম স্থলে কি করিবে তুমি।রথ হতে খসি যদি পড় পাছে ভূমি।।উত্তর বলিল, মোরে নিন্দ অকারণ।এ শব্দে পৃথিবী মধ্যে কে আছে চেতন।।বহু শুনিয়াছি শব্দ, জলদ-গর্জ্জন।ধনুর্ঘোষ শঙ্খনাদ অনেক বাজন।।এতাদৃশ শব্দ কভু কর্ণে নাহি শুনি।রথচক্রে গর্জ্জে হেন ভয়ঙ্কর ধ্বনি।।রথের গর্জ্জনে হৈল বধির শ্রবণ।ধনুর্ঘোষ শঙ্খনাদে হৈনু অচেতন।।শুনিয়া কিরীটী হাসি বলেন বচন।যুদ্ধে স্থির হবে নাহি, লয় মম মন।।বামপদে আমি তোমা রাখিব ধরিয়ে।কেবল থাকিবে রথে অবলম্ব হয়ে।।এত বলি পুনর্ব্বার করিলেক শব্দ।সেই শব্দে কুরুকুল হইলেক স্তব্ধ।।পুনঃ পুনঃ মহাশব্দ শুনিয়া অদ্ভুত।কহিতে লাগিল তবে ভরদ্বাজ সুত।।গাণ্ডীব ধনুর মত শুনি যে টঙ্কার।দেবদত্ত বিনা হেন শব্দ আছে কার।।এ শব্দে আমার সেনা কেহ নহে স্থির।নিরখিয়া দেখ সবে আপন শরীর।।বিষণ্ণ হইল, রোমাঞ্চিত সব তনু।কর শির কাঁপে দেখ, কাঁপে বক্ষ জানু।।তোমা সবাকার চিত্তে কি হয়, না জানি।বধির হইল কর্ণ, হেন শব্দ শুনি।।অস্ত্রগণ জ্যোতিহীন, অগ্নিহোত্র মন্দ।সংজ্ঞাহীন দেখি সৈন্য, সবে নিরানন্দ।।রক্তমাংসাহারী পক্ষী সৈন্যশিরে উড়ে।ঘোরনাদ করি সবাকার শিরে পড়ে।।হয় হস্তিগণ দেখ করিছে ক্রন্দন।পুনঃ পুনঃ মল মূত্র ত্যজে ক্ষণে ক্ষণ।।সৈন্যমধ্যে প্রবেশিয়া শিবাগণ ডাকে।রথধ্বজ বেড়িয়াছে দেখ সব কাকে।।সত্য হৈল অকুশল সাক্ষাতে আমার।মহাবীর পার্থ বিনা কেহ নহে আর।।এমন এমন কর্ম্ম কর বীরগণে।মধ্যেতে রাখহ যত্নে রাজা দুর্য্যোধনে।।প্রহরীরা সর্ব্বত্রই জাগি বেড়ি রহ।বাঁটিয়া দু’ভিতে সৈন্য দউ ভাগে লহ।।অর্দ্ধসৈন্য গবীগণে রহ এবে বেড়ি।অসাধ্য যদ্যপি হয়, শেষে দিব ছাড়ি।।গবীগণ তরে ব্যস্ত নাহি হও আর।রাজারে রাখহ সবে, যত শক্তি যার।।জয়তি নীলানিদ্রনাথ নীলচক্রধারী।নীলপদ্ম সম মুখ, দুষ্ট-অন্তকারী।।নীলাম্বর সহিত লীলায় নীলাচলে।নীলকণ্ঠ আদি দেব সেবে পদতলে।।অরুণ-বরণ চক্ষু, অরুণ বসন।অরুণ অধর শোভা সে কর চরণ।।মস্তকে অরুণ হেম মুকুট রচিত।গলে মণি রত্নহার অরুণ উদিত।।অরুণ-বরুণ চক্ষু পক্ষ্মী বামপাশে।অরুণ চরণ সদা গায় কাশীদাসে।।মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।একমনে সাধুজন পিয়ে অবিরত।।২৫. দ্রোণের প্রতি দুর্য্যোধনের শ্লেষোক্তিদ্রোণের এতেক বাক্য শুনি দুর্য্যোধন।ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষ্মে চাহি বলিছে বচন।।পুনঃ পুনঃ মোর প্রতি কহেন এ কথা।পাণ্ডবের পক্ষ গুরু জানিহ সর্ব্বথা।।সতত কহেন পাণ্ডবের গুণাগুণ।অনুক্ষণ নিকটেতে দেখেন অর্জ্জুন।।এয়োদশ বর্ষ সবে করি গেল পণ।ইতিমধ্যে দেখা তারা দিবে কি কারণ।।বিশেষ একাকী কেন আসিবে হেথায়।অকস্মাৎ আসিবেক কোন্ অভিপ্রায়।।অর্জ্জুন হইল যদি, কিবা চাই আর।ভ্রাতৃসহ বনমাঝে যাবে আরবার।।বিরাটের পক্ষ হয়ে সে কেন আসিবে।অন্য কেহ সেনাপতি বিরাটের হবে।।কিম্বা সেই আসিতেছে বিরাট নৃপতি।কিম্বা আগে পাঠাইল মুখ্য সেনাপতি।।দক্ষিণ গোগৃহে রাজা সুশর্ম্মা যে গেল।মৎস্যদেশ জয় করি সেই বা আসিল।।না দেখিয়া না শুনিয়া শব্দমাত্র শুনি।পুনঃ পুনঃ কহিছেন আসিল ফাল্গুনি।।জানি আমি আচার্য্যের পাণ্ডুপুত্রে প্রীত।অতএব কহিছেন হয়ে হৃষ্টচিত।।মোরে ভয় দেখাইয়া শত্রুর প্রশংসা।পুনঃ পুনঃ কহিছেন অকুশন ভাষা।।পশুজাতি অশ্বগণ নিরবধি ত্রাসে।পক্ষীর স্বভাব সদা উড়য়ে আকাশে।।মেঘের সহজ কর্ম্ম উঠিলে গরজে।কভু ধীর কভু তীক্ষ্ণ পবনের তেজে।।ইহা দেখি কহিছেন নাহি আর জয়।না করিয়া যুদ্ধ গুরু পান এত ভয়।।নামেতে হইল ত্রাস, কি করিবে রণ।যুদ্ধস্থলে পণ্ডিতের নাহি প্রয়োজন।।প্রাসাদ মন্দির যথা নৃপতির সভা।সেই সব স্থলে হয় পণ্ডিতের শোভা।।পুরাণের বাক্য যদি বেদ অধ্যয়ন।সেই সব স্থলে হয় পণ্ডিত শোভন।।যথায় বালক শিক্ষা বিচার কথন।সেই স্থলে পণ্ডিতের হয় সুশোভন।।যদি বা আইসে পার্থ লঙ্ঘিয়া সময়।কিবা শক্তি আছে তার, কেন এত ভয়।।আসুক অর্জ্জুন, আমি করিব সংগ্রাম।ভয়ার্ত্ত হলেন গুরু, যান নিজ ধাম।।ভোজ্য অন্ন দিয়া তার পাইলাম ফল।সে মিত্রে কি কার্য্য যেই শত্রুর বৎসল।।ভক্তি হয় দুই গুরু করেন পাণ্ডবে।সদাকাল এইমত জানি অনুভবে।।হেথায় রহিয়া কিছু নাহি প্রয়োজন।যথা ইচ্ছা তথাকারে করুণ গমন।।সময়োচিত কর্ম্ম করহ পিতামহ।সৈন্যগণে ডাকি সব আশ্বাসিয়া কহ।।স্থানে স্থানে গুল্ম পাতি দৃঢ় কর সেনা।মোর স্থানে গবী লয় হেন কোন্ জনা।।গুরুকে করিয়া পাছু থাক গুল্মগণ।ভয়ার্ত্ত লোকেরে রাখি নাহি প্রয়োজন।।ভয়েতে কাতর কেন দেখি সেনাগণ।আচার্য্যের বাক্যে বুঝি হৈল ভীত মন।।যুদ্ধের সময় পাল যুদ্ধের যে নীতি।রণসাজে থাক সবে সৈন্য সেনাপতি।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon